একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু পর্ব-০৭

0
12

#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#সপ্তম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

পুষ্পি ক্লাস শেষ করে কলেজের বাহিরে এসে রিকশার অপেক্ষায় দাঁড়াল। বেলা তখন একটার দোরগোড়ায়। সূর্যের আলোকরশ্মি চোখের মনিকোঠায় এসে লাগছে। তেজস্বী সূর্যের তেজ থেকে চোখ আড়াল করতেই কার্নিশে হাত ঠেকাল মেয়েটা।
ইশশ! প্রয়োজনের সময় একটা রিকশাও পাওয়া যায় না। রিকশাওয়ালা গুলো সব গেল কই?

পুষ্পির এমন আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝেই আকস্মিক কেউ ওকে ওর নাম ধরে সম্বোধন করে ডাকল। মেয়েটা এমন আকস্মিক ডাকে হতচকিত হয়ে পাশ ফিরে চাইল। ওর সমবয়সী এক হাস্যোজ্জ্বল তরুণ। কাঁধে ব্যাক। সাদা টি-শার্ট এর উপর সাদা-কালো চ্যাক প্রিন্টের শার্ট। হাতে ঘড়ি। সুদর্শন এক যুবক।

ছেলেটাকে পুষ্পি চিনে। নাম মাহদী। একই স্কুলে পড়ত। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল। একই স্কুলে পড়লেও পুষ্পির সাথে তেমন কথাবার্তা হয়নি। যদিও পুষ্পিও ভালো ছাত্রী হওয়ার ফলস্বরূপ মাহদী বেশ কয়েকবারই সখ্যতা গড়তে চেয়েছিল। কিন্তু পুষ্পির মুখচোরা স্বভাবের ফলস্বরূপ তা হয়ে ওঠেনি। ওই টুকটাক দেখা-সাক্ষাৎ আর দুই-তিনটা বাক্য বিনিময় ব্যাতিরেকে তেমন কোনো সুসম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তাও ওকে এই বোরকা পরিহিত অবস্থায় কিভাবে চিনল তা ভেবে বিস্মিত হলো কিঞ্চিৎ।
মাহদী চুল ঠিক করতে বলল, “পুষ্পি-ই তো, না? আমায় চিনতে পেরেছ?”

পুষ্পি মুখে কিছু না বলে, শুধু দু’বার মাথা নাড়াল। যার অর্থ দাঁড়ায়, সে চিনতে পেরেছে।

মাহদী পুনরায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি এখানেই এডমিশন নিয়েছ?”

পুষ্পি এবারও ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ায়।

মাহদী সুন্দর হেসে বলে, “আমিও এখানেই এডমিশন নিয়েছি। কোন সাবজেক্টে তুমি?”

পুষ্পির একদমই ইচ্ছে হচ্ছে না কথা বলতে। এক প্রকার বাধ্য হয়েই এবার মুখ খুলতে হলো। ছোট্ট করে বলল, “বাংলা।”

মাহদী নিজের এক হাতের মুঠোয় অন্য হাত নিয়ে বলল, “বাহ! নাইস। আমি উদ্ভিদ বিজ্ঞান এ নিয়েছি।”

পুষ্পি মুখে কিছু বলল না ঠিক তবে মনে মনে বলল, “তুই প্রাণী নাকি উদ্ভিদ আমি জানতে চেয়েছি? বেশি পকপক! এমনিতেই রিকশা পাচ্ছি না, জ্বালাস না তো ভাই। ভাল্লাগে না।”

মাহদী পুষ্পির দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসল। তারপরেও বলল, “তুমি এখনও সেই আগের মতোই মেপে মেপে কথা বলো। যেন কথা ফুরিয়ে যাবে, সেই ভয়ে বলো না। মাঝেমধ্যে কি ইচ্ছে হয় জানো? আমার ভাগের থেকে ‘কিছু কথা’ তোমায় দিয়ে দেই। তাও যদি কথার মাত্রা একটু বাড়াও।”
বলেই দন্ত বিকশিত হাসলো।

এর মাঝেই একটা রিকশা চলে এলো। পুষ্পি তড়িঘড়ি করে রিকশায় উঠে বসল। মাহিদী নিজ থেকেই বলল, “ওকে বায়। সি ইউ লেটার।”

রিকশা চলতে শুরু করেছে ততক্ষণে। পুষ্পি বিড়বিড় করে বলে, “তোমার ‘সি ইউ’র গুল্লি মারি। ফাজিল ছেলে….”

পুষ্পি সেই শুরু থেকেই মাহদীকে অপছন্দ করে। কেন অপছন্দ করে তার কোনো সুস্পষ্ট কারণ নেই। কারণ মাহদী কখনোই ওর সাথে তেমন কোনো অসদাচরণ করেনি। তবুও কেন যেন ছেলেটার প্রতি পুষ্পির মারাক্তক বিতৃষ্ণা।

তবে ধারণা করা যায় এর অবশ্য দুটো কারণ থাকতে পারে৷ একটি হতে পারে, পড়াশোনার দিক দিয়ে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। যেহেতু দুজনই ভালো স্টুডেন্ট। দ্বিতীয়টি হতে পারে, ছেলেটা প্রায়শই পুষ্পি সল্পভাষী স্বভাবের কারণে পিঞ্চ মেরে কথা বলত৷
সে যাই হোক, ছেলেটাকে পুষ্পির ভারী অপছন্দ।
.
রিকশা কিছুদূর যেতেই পথিমধ্যে দেখা হলো লাবণ্যর সাথে। পুষ্পি রিকশা থামিয়ে লাবণ্যকে ডাকল। লাবণ্যকে দেখলেই পুষ্পির মনে হয়, মেয়েটা এত মিষ্টি! কিন্তু হাসিখুশি কম। পরক্ষণেই আবার ভাবে, হাসিখুশি কম, নাকি ওর সামনেই মুখটা মলিন হয়ে থাকে! মেয়েটার ইমোশন ও বুঝতে পারে৷
পুষ্পির ডাক শুনে লাবণ্য থেমে দাঁড়ায়। মুখে জোর পূর্বক হাসি এঁকে সালাম প্রদান করে। পুষ্পি সালাম নিয়ে বলে, “কোথায় যাচ্ছ তুমি? ক্লাস শেষ?”
লাবণ্য বলে, “ক্লাস শেষ না। আমার ভালো লাগছিল না তাই চলে এসেছি।”
পুষ্পি বিচলিত হয়ে বলে, “ভালো লাগছে না? ওদিকটাতেই তো যাবে না? রিকশা উঠে বসো।”

লাবন্য প্রথমে ‘না না’ করলেও পরবর্তীতে উঠে বসে রিকশায়।
লাবণ্যর নিজেরও বেশ পছন্দ হয়েছে পুষ্পিকে৷ এত আন্তরিক মানুষটা! পুষ্পি সল্পভাষী হওয়া স্বত্বেও কেন যেন লাবণ্যর সাথে ও নিজ থেকেই অনেক কথা বলছে। পড়াশোনার বিষয়ে জানছে৷ একপর্যায়ে শাহরিয়ারকে নিয়ে কটুক্তি করে বলে, “তোমাদের স্যার তো খুব পাগল একটা মানুষ। তোমরা খুব সতর্কতার সহীত ক্লাস করবা। পাগল স্যারের ক্লাস করা মারাক্তক রিস্কি।”

লাবণ্য হেসে দিয়ে বলে, “মোটেও স্যার পাগল না। ইউ নো হোয়াট, হি ইজ দ্যা বেস্ট।”
পুষ্পির হঠাৎ-ই খুব গর্ভবোধ হয়। মুখে পাগল বললেও, মনে মানুষটার জন্য প্রচন্ড দরদ অনুভব হয়। আগে এমন লাগেনি। ইদানীং এমন লাগছে। সে আশেপাশে থাকলেও ভালো লাগে। কী আশ্চর্য! এ কেমন বন্ধন!

পুষ্পির ভাবনার রেশ কাটতেই বলে, “ফুসকা খাবা লাবণ্য? চলো ফুসকা খাই।”

লাবণ্য সম্মতি দিতেই রিকশা থেকে নেমে ওরা কেবল ফুসকা খাওয়াতেই সীমাবদ্ধ রইল না। ফুসকা খেল, ঝালমুড়ি খেল, হাওয়াই মিঠাই খেল৷ এই অল্প সময়ের মাঝেই দুজনের মাঝে খুব সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠল।
লাবণ্যর বুকটার মাঝে যেই পাথরটা জমে ছিল তা যেন আকস্মিক-ই দূর হয়ে গেল। বিষন্ন মুখের মেয়েটার মুখ চমৎকার হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠল।

পুষ্পি লাবণ্যকে বিদায় দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ঘড়ির কাটা তিনটা ছুঁইছুঁই হলো।
বাড়ি ফিরে পুষ্পির জন্য অপেক্ষা করছিল আরেক সারপ্রাইজ। দরজা খুলল পুষ্পির শ্বশুর, হাসনাত সাহেব।
ভদ্রলোক পুষ্পির বিয়ের পরদিনই ব্যবসায়ীক কাজে শহরের বাহিরে গিয়েছিল। সে কারণে পুষ্পির সাথে সখ্যতাও তার কম। মানুষটার ব্যাপারে কোনো ধারনাও নেই তার। দেখে মনে হচ্ছে একটু কাটখোট্টা, রাগী টাইপ হবে।

কিন্তু পুষ্পিকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “আম্মাজান! আপনার এতক্ষণে আসার সময় হলো? আমরা দুই বুড়ো-বুড়ি না খেয়ে-দেয়ে আপনার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছি। দ্রুত আসুন।”
সাবেরী খাতুন ততক্ষণে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন। বাজখাঁই কন্ঠে বলে উঠলেন, “মা? তুমি এই ভদ্রলোককে এক্কেবারেই পাত্তা দিবা না। এই ব্যক্তির জীবনে খানাপিনা ছাড়া কিচ্ছু নাই। আহার-আসক্ত রুগী।”
হাসনাত সাহেব সংশোধন করে দেয়ার মতন করে বলে, “আহার-আসক্ত আবার কী জিনিস? এটা কি এলকোহল নাকি? কতদিন বলেছি, এটাকে বলে ভোজনরসিক। ভাষা শহীদ, সাহসী ছেলেগুলো কি ভাষার এমন অপব্যবহার এর জন্য রক্ত দিয়েছে নাকি?”
সাবেরী খাতুন মুখ ভেঙিয়ে বলে, “ওরে আমার সব জান্তা শামসের রে! আসছে….”
হাসনাত সাহেব তীব্র প্রতিবাদ করে বলে, “কথায় কথায় শামসেরকে টানো! সত্যি করে বলো, এই শামসের কে?”
সাবেরী খাতুন হতবিহ্বল চোখে বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো।
পুষ্পি টোনাটুনির কান্ড দেখে ফিক করে হেসে ফেলল। এই পুরো পরিবারই যেন একটা হাস্য-মঞ্চ!
মেয়েটা বুদ্ধিমতীর মতো খুব সুন্দর করে পুরো পরিস্থিতি সামলে নিল। দুজনকেই নয়-ছয় বুঝিয়ে ঠান্ডা করল৷ নিজে ফ্রেশ হয়ে সকলের সাথে একত্রে খেল৷

সকল কাজকর্ম শেষ করে অবশেষে নিজের রুমে এলো। রুমে আসার পর মনে হলো শাহরিয়ার আজ সারাদিনে একবারও ওর খোঁজ নেয়নি। পুষ্পির হঠাৎ-ই ভারী অভিমান হতে লাগল। অন্যদিন দু-তিনবার করে খোঁজ নেয়। অথচ আজ সে বাহিরে গেল। সারাদিন পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে অথচ জনাবের কোন হদিস নেই!
পুষ্পি গোমড়া মুখে রুমের এপাশ-ওপাশ পায়চারি করল খানিকক্ষণ। তারপর এসে খাটে অর্ধশোয়া অবস্থায় বসল। নানাবিধ ভাবনার মাঝে কখন যে ঘুমিয়ে গেল! ঘুম যখন ভাঙল তখন মাগরিবের আজান দিচ্ছে। পুষ্পি ঝটপট করে উঠে বসে। দ্রুত ফোন চেক করে। নাহ! কোনো কল নেই।
আশাহত হয়ে ফোন রেখে গিয়ে ফ্রেশ হয়। ওজু করে নামাজ পড়ে নিচে আসে। মজার শ্বশুর-শাশুড়ি আর ননদের সাথে মিলে নাস্তা করে। ফাঁকেঝোকে নানাবিধ হাস্যরস যুক্ত বাক্যের আদান-প্রদান ঘটে।

কিন্তু এবার পুষ্পি মন হয়ে থাকে অন্যমনস্ক। এই একদিনের খানিক দূরত্বেই বোকা মেয়েটার মনে হতে লাগল, মানুষটা বদলাতে শুরু করছে নাকি?
এক ফাঁকে মুনমুনকে জিজ্ঞেস করল, শাহরিয়ারের কথা। মুনমুন জানায় ভাইয়ের মেজাজ আজ চূড়ান্ত খারাপ ছিল। সে আজ তাই ভাইয়ের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। এবং এও জনায়, তার ভাই একজন বদরাগী টিচার!
পুষ্পি নিজেও লক্ষ্য করে মুনমুন শাহরিয়ারকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে। সাংঘাতিক ভয় পায়। কোনো ভুল কাজ করলে ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে। তবে মুনমুন এও জানায় যে, শাহরিয়ারের আজ ফিরতে দেরি হবে৷ মুনমুনকে সে এ কথা জানাতে বলে দিয়েছে। দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করেছে।
পুষ্পির অভিমানের পারদ বাড়ে বৈ কমে না।

পুষ্পি সবাইকে জোর করে রাতের খাবার খাইয়ে-টাইয়ে রুমে পাঠিয়ে নিজে একা শাহরিয়ারের জন্য অপেক্ষা করে। শাহরিয়ারের সেদিন বাসায় ফিরল অনেক দেরিতে। রাত প্রায় এগারোটার কাছাকাছি। অভিমানী মেয়েটা দরজা খুলেই ডাইনিং এর কাছে চলে গেল। একটা কথাও না বলে খাবার প্রস্তুত করতে লাগল।
শাহরিয়ার বিষয়টা লক্ষ্য করল৷ তবে তক্ষুনি কিছু বলল না। ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে বসে বলল, “তুমিও বসো পাশে৷ খেতে খেতে তোমায় ডিফাইন করছি, কেন দেরি হয়েছে৷ আমি তো জানি, আমার বউ আমায় কত মিস করে! ইচ্ছে করে কি লেইট করতে পারি বলো?”
পুষ্পি ভ্রুকুটি করে তাকায়, “আমি মোটেও কাউকে মিস করিনি!”
শাহরিয়ার উল্টো প্রতিক্রিয়া করে বলে, “আরে বুঝি তো। লজ্জা পেয়ে অস্বীকার করছো কেন? নিজের জামাইকেই তো মিস করছো, অন্য কাউকে তো করছো না।”
বলেই সে মিটিমিটি হাসে। তারপর বলে, “হয়েছে কি শোনো। টিউশনি শেষে ফেরার পথে আমার এক ব্যাচমেট এর সাথে দেখা হয়। তারও সদ্য বিয়ে হয়েছে। এখন সে তার বউয়ের গুনকীর্তন গাইছিল তাই হিংসায় হিংসান্বিত হয়ে আমিও আমার বউয়ের গুনকীর্তন গাইতে লাগলাম। ওই ব্যাটার দোষ। আমার কোনো দোষ নেই এখানে, ট্রাস্ট মি।”
পুষ্পি জিজ্ঞেস করে, “আপনার মোবাইল ফোন কোথায়?”
শাহরিয়ার জবাব দেয়, “ডেড! ব্যটারি লো। বউয়ে মত্ত হয়ে আজকাল ফোনেরও খোঁজখবর রাখছি না। বোঝো আমার অবস্থা!”

মানুষটার উপর পুষ্পির অভিমানী রাগ জন্মায়। সে চলে যেতে লাগলে শাহরিয়ার হাত ধরে আটকে ফেলে। হেঁচকা টানে পাশে বসিয়ে ভাতের প্লেটে ভাত বেরে দেয়৷ মাথায় বা’হাত বুলিয়ে বলে, “এই পুষ্প! রাগলে তো তোমায় অপ্সরী লাগে। তুমি কি তোমার রূপ-লাবণ্যের জালে আটকে আমাকে ঘুর-কুনো করে ফেলতে চাও? কি সর্বনাশ! আমার সুন্দরী বউ, সুন্দরীতমা? প্লিজ আর রেগে থেকো না।”
এরপরও কি রেগে থাকা যায়? মোহ-মায়ায় আবিষ্ট হয়ে রাগ গলে জল হয়ে যাওয়া উচিত নয় কি? একশবার উচিত। হাজারবার উচিত।
(চলবে)….