একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু পর্ব-০৯

0
12

#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#নবম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

শাহরিয়ার সকালে কলেজ যাওয়ার সময় মুনমুন ভীতু ভীতু মুখশ্রী নিয়ে শাহরিয়ারের সামনে এসে দাঁড়ায়। শাহরিয়ারের রাগ অনেকখানি কমে গেলেও, মুখে তার পরিস্ফুটন ঘটায় না। এক পলক মুনমুনের দিকে চেয়ে সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে।
মুনমুন সেটা লক্ষ্য করে একটুখানি ব্যথিত হয়।
আড়াল থেকে পুষ্পি ইশারা করে কিছু বোঝাতে চায়৷ এর মাধ্যমে এটা বুঝা যায় যে, দুই ননদ-ভাবী কিছু একটা পরিকল্পনা করে করে মাঠে নেমেছে। পুষ্পির কলেজ আজ অনেক দেরিতে তাই তখন সে শাহরিয়ারের সাথে যাচ্ছিল না। রান্নাঘরে কিছু করছিল। এবং সেখান থেকে ড্রয়িং রুমটা স্পষ্ট দেখা যায় বলে সহজেই মুনমুনের সাথে ইশারায় ভাব বিনিময় করতে পারছিল।
শাহরিয়ার জুতা পরিষ্কারের জন্য ছোট টুকরো একটা কাপড় নিতেই মুনমুন সেটা কেড়ে নিল। তারপর ভীতু হেসে বলে, “আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।” বলেই সে পরিষ্কার করতে লাগে।

শাহরিয়ার কিঞ্চিৎ বিস্মিত। সে বোধহয় তার বোন থেকে এত দ্রুত এমন স্বাভাবিকতা প্রত্যাশা করেনি।
শাহরিয়ার নিজেকে সামলে নেয়। কন্ঠে গাম্ভীর্য এনে বলে, “ইট’স ওকে, আর পরিষ্কার করতে হবে না।”
মুনমুন উঠে দাঁড়ায়। ভয়ে ভয়ে ভাইয়ের দিকে চায়।
শাহরিয়ার গলা ঝেড়ে কাশে। মুনমুনের দিকে না তাকিয়েই বলে, “নয়টা বেজে গিয়েছে অলরেডি। এখনও কলেজ যাওয়া হয়নি কেন!”

দূর হতে শাহরিয়ারের এমন বাচ্চাসুলভ মুখভঙ্গি দেখে পুষ্পি মিটিমিটি হাসে। মানুষটা ভালো গম্ভীর হতে জানে তো! নিত্য সে কত রূপে চিনছে মানুষটাকে!
মুনমুন ভাইয়ের এমন প্রশ্নের জন্যই যেন এতক্ষণ অপেক্ষা করে ছিল। সুন্দর হেসে বলে, “তোমার সাথে যাব আজ। তাই ওয়েট করছিলাম। অনেকদিন হয়ে গিয়েছে তুমি আমায় নিয়ে যাও না
কলেজে। আজ কোচিং নেই। তাই ভেবেছি তোমার সাথে যাব। নিবে না তোমার সাথে?”
শাহরিয়ারের সাথে তার ছোট বোনটার বয়সের অনেক ব্যবধান। একমাত্র বোন হওয়ার ফল স্বরূপ প্রচন্ড স্নেহও করে। একটু বড়ো হয়ে যাওয়ার পর থেকেই কেন যেন বোনের সাথে খানিক দূরত্ব বেড়েছে তার। আজ অনেকদিন পর বোনের এমন আবদারে মনটা তুলোর মতো নরম হয়ে গেল। কালকের এমন শাসনের পরও এত দ্রুত সব ভুলে যাওয়াতে খানিক আশ্চর্যও হলো।
এরপরই চোখে পড়ল পুষ্পি আর মুনমুনের ইশারায় ভাব বিনিময়ে। শাহরিয়ারের বুঝতে আর বাকি রইল না, তার বোনের এত দ্রুত স্বাভাবিক আচরণের কারণ।
হঠাৎ নিজের বউটার প্রতি আহ্লাদে মনটা ভরে উঠল তার। মেয়েটা কত দ্রুত তার পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের সাথে নিজেকে মিশিয়ে নিচ্ছে। কত চমৎকার ভাবে পরিবারের সব ঝামেলা গুলো দুমড়েমুচড়ে দিতে চাচ্ছে! আচ্ছা? এটা কি প্রত্যেক মেয়েরই আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা? কেমন করে পারে তারা এত সুন্দর সব কিছু সামলে নিতে!
শাহরিয়ার মুনমুনের দিকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে চায়। শীতল কন্ঠে বলে, “বাহিরে গিয়ে দাঁড়া, বাইক বের করে নিয়ে আসছি।”
মুনমুন উৎফুল্ল কন্ঠে, “ঠিক আছে ভাইয়া।” বলে বাহিরে চলে যায়।
শাহরিয়ার কাঁধে অফিস ব্যাগটা নিতে নিতে ডাকে, “পুষ্প! ঘড়িটা রেখে এসেছি। নিয়ে এসো।”

পুষ্পি যেন প্রস্তুতই ছিল। সে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে দ্রুত রুমে যায়। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ঘড়িটা নিয়ে দ্রুত নিচে নামে।
শাহরিয়ারের দিকে ঘড়িটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “রোজ রোজ ঘড়ি রেখে চলে আসেন। এত মনভুলা মানুষ; টিচার হলেন কেমন করে ভেবে পাই না।”
শাহরিয়ার খুব দারুণ হাসে। ঘড়িটা হাতে পরতে পরতে বলে, “সব কিছু মনে রাখার মাঝে আনন্দ নাই, বরং ভুলে যাওয়াতেই আনন্দ। আমি ভুলে যাব, তুমি মনে রাখবা, একারণেই ভুলে যাই।”
কথাটা বলেই পুষ্পির মাথায় হাত রাখে।
পুষ্পি মুখ বাকিয়ে বলে, “কথা একদম ঠোঁটের আগায়!”
শাহরিয়ার এবারও হাসে। মেয়েটা আজকাল খুব কথার পৃষ্ঠে কথা বলতে শিখে গিয়েছে।
আহ্লাদী, সন্তুষ্টি মন নিয়েই বলে, “পুষ্প? থ্যাংক ইউ। থ্যাংস ফর মেকিং মাই ডে স্পেশাল।”
বলেই বেড়িয়ে যায়। পুষ্পি ভেবে পায় না, হুট করে থ্যাংস-ট্যাংস দিয়ে ভরিয়ে ফেলল কেন!

.
শাহরিয়ার শেষবার যেই ক্লাস-টেস্ট নিল সেখানে লাবণ্য, মুনমুন আর রূপা ছাড়া ওদের গ্যাংয়ের বাকি সবাই খারাপ করেছে। এবং আনন্দ লেগেছে এটাতেই যে, লাবণ্য তার চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্ট করেছে এবং সাকসেস হয়েছে। হাইয়েস্ট মার্ক ছিল লাবণ্যর-ই।
শাহরিয়ার ক্লাস শেষে যাওয়ার সময় আদিল, সোহেল, সায়মা আর মিয়াদকে বলল দেখা করতে গিয়ে।

শাহরিয়ার বেড়িয়ে যেতেই সোহেল বলে উঠল,
“ইন্না-লিল্লাহ! সবাই আমার আত্মার মাগফিরাত কর! আজ আর বোধহয় রক্ষা নেই। আমি শেষ।”

রূপা মুখ ভেঙিয়ে বলে, “একদম ঠিক হয়েছে। উচিৎ শিক্ষা হবে।”
আদিল ক্ষেপে গিয়ে, “সিলভারের বাচ্চা, তুই তো জলজ্যান্ত মিরজাফর! আমার সামনে থেইকা সর কইলাম….”
রূপা প্রতিবাদ করে বলে, “সরমু না। কি করবি তুই? বেয়াদব….”

আদিল প্রতিত্তুর করার আগেই লাবণ্য তেজী হয়ে বলে, “উফফ! তোরা চুপ করবি? কি শুরু করলি!”

মিয়াদ মুনমুনকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তোর ভাইয়ের আতংকে একদিন দেখবি আমি কাইত! ইহজনমের ইস্তফা ঘটিয়ে পরপারে পাড়ি জমাবো!”

মুনমুন ঠোঁট উল্টে বলে, “যাহ! আমার ভাইয়াকে নিয়ে কিছু বলবি না।”
মিয়াদ বদমাইশি হাসে। বলে, “ভাবছি, তোর এই ‘পাকিস্তানি মিলিটারী’ টাইপ ভাই যেদিন জানবে আমি তার একমাত্র বোনের সাথে লাইন মারি, সেদিন বোধহয় মার্ডারই করে ফেলবে রে।”
এবার বোধহয় মুনমুনও চিন্তিত হয়ে পড়ল। মিয়াদ এবার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, “বন্ধু ও বান্ধুবীগন পিলিইইইজ প্রে ফর মিহ! ভবিষ্যৎ ভাবিয়া আমি খুব আতংকিত।”

যাদের যাদের শাহরিয়ার দেখা করতে বলেছে, তারা সবাই মিলে মিয়াদকে টেনে নিতে নিতে বলে, “ভবিষ্যৎ লইয়া আতংকিত পরে হইও বাছা! আগে বর্তমান লইয়া চিন্তিত হও।”

মুখে বলে ঠিকই তবে মনেহয় না, ইহজগতের কোনো বিষয়াদি তাদের খুব বেশি চিন্তিত কিংবা আতংকিত করতে পারে। এরা যেন ঠিক ভাবনা বিহীন পক্ষী-ছানা!
.
পুষ্পি ক্লাস শেষ করে একটা বুকশপে এলো। তার কিছু বই কিনার ছিল। মনে মনে ঠিক করল, নিজের বইয়ের পাশাপাশি শাহরিয়ারের জন্যেও একটা ইংরেজি নোভেল কিনবে।
যেই ভাবনা সেই কাজ। সে কলেজের পাশের একটা বুকশপে এলো। কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করে নিজের বই, পাশাপাশি শাহরিয়ারের জন্য বইও কিনল। তারপর বাসায় ফিরল।
বাসায় ফিরে দেখে আরেক হুলুস্থুলে কান্ড। মহামান্য শ্বশুর-শাশুড়ি জগৎ উল্টে ফেলার মতো ঝগড়া করছে। পুষ্পি যেতেই তার কাছে দুজন-দুজনের নামে নালিশ করতে থাকে। এ বাড়িতে এটা নতুন কিছু না। প্রায় রোজই এই দুই মহামান্য ব্যক্তি কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে হুলুস্থুল বাঁধাবে-ই! আজকের কারণ জনাব শ্বশুর মশাই ভুল করে শাশুড়িকে বলে ফেলেছিল, “তুমি আজকাল বেশি কথা বলো।”
এখন সাবেরী খাতুন কেঁদেকেটে অস্থির। পুষ্পি ভাবতেই পারে না, তার এমন সাহসী, বুদ্ধিমতী, স্ট্রং শাশুড়ি; স্বামী একটু কিছু বললেই কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে পরে!
সাবেরী খাতুন পুষ্পিকে নালিশ করে বলল, “জানো মা? বিয়ের শুরুতে বলত, ‘তোমার কথা টিয়া পাখির বুলির মতো শ্রুতি মধুর। তুমি চুপ থাকলে ভালো লাগে না।’ আর এখন বলে, আমি নাকি বেশি কথা বলি।”
একটু থেমে বিলাপ করে বলে, “হায় আমার আল্লাহ! এখন তো আমার কথাবার্তা কিছুই ভালো লাগবে না। বুড়ি হয়ে গেছি না!”
বেচারা শ্বশুর মশাই হতভাগার মতো বসে থাকে। তার আর তর্ক করার জো নেই।
করজোড়ে বলে, “আমার ভুল হইছে! মাফ কইরা দেও। ইহজনমে আমি এই বাক্য আর দ্বিতীয়বার মুখে আনিব না। মাফ চাই।”
শ্বাশুড়ি আরো তেজস্বী হয়ে বলে, “আপনার মাফের ‘খেতা শিলাই’। আপনার মাফ আপনার কাছে রাখেন।”
একটু থেমে চিরাচরিত মা দের মতো বলে, “আমি দেইখা এতকাল আপনার মতো পুরুষের সংসার করছি। অন্যকেউ হলে কবে…..”
শ্বশুর এবার আবার রেগে যায়। মাঝখান থেকে পুষ্পি পরে মাইনকার চিপায়। সে যাকেই থামতে বলে, সে অন্য জনকে থামাতে বলে।
পুষ্পি সোফায় বসে মাথায় হাত ঠেকিয়ে প্রার্থনা করে, “হে প্রভু! রক্ষা করো!”

টানা দের ঘন্টা ঝগড়ার পর দুজনে ক্লান্ত হয়ে থামে। সাবেরী খাতুন কাঁদুকাঁদু হয়ে রুমে চলে যায়। সাবেরী খাতুন চলে যেতেই হাসনাত সাহেব গলার স্বর নিচু করে বলে, “বুঝলা আম্মাজান? মহিলা মানুষ মানেই হলো যন্ত্রণা, অশান্তি আর আতংক।”
পুষ্পি কপাল কুঁচকে টেনে টেনে বলল, “বাবা….!”
হাসনাত সাহেব বুঝলেন যাকে নালিশ করছে সেও মহিলা জাত! জ্বিহ্ব কেটে নিজেকে সংশোধন করে বলে, “স্যরি স্যরি, সবাই না আবার! এই ভদ্রমহিলার মতো ঝগড়ুটে যারা, তাদের কথা বলেছি।”
পুষ্পির ভীষণ হাসি পেল। তাও আগের থেকেও বেশি টেনে শাসন করার মতোন করে বলল, “বাবা! আবার….”
হাসনাত সাহেব এবার আফসোসের সুরে বলে, “আহারে! নির্যাতিত পুরুষ মানুষ! হুদাই দেশটারে স্বাধীন করছে। কোনো বাক-স্বাধীনতা নাই!”
পুষ্পির হাসি এবার বাঁধ ভেঙে যায়৷ হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে আসে। কি পাগলা পরিবার!

হাসাহাসি শেষে শাশুড়ির খাবার শ্বশুরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “কিভাবে ম্যানেজ করবেন আমি জানি না।” বলে সে তার রুমের দিকে হাঁটা দেয়।

হাসনাত সাহেব কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে পুষ্পির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর এক ‘দীর্ঘশ্বাস’ ছেড়ে নিজের রুমের দিকে হাঁটা দেয়!

পুষ্পি নিজের রুমে এসে প্রথমে ফ্রেশ হয়। দুপুরে ক্যান্টিনে খেয়েছিল তাই খাওয়ার প্যারা নাই।
ফ্রেশ-ট্রেশ হয়ে যেই বইগুলো কিনে এনেছিল সেই বই গুলো বুকসেল্ফে গুছিয়ে রাখতে যায়। শাহরিয়ারের বইটা আলাদা করে রাখে, সে আসলে দিবে তাই। বিষয়টা ভাবতে মনটা কেমন প্রেমময় হয়ে ওঠে! মানুষটার প্রতি দিন দিন মায়া-টান বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার কথা মনে হলেই আপনা-আপনি মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। সত্যিকারে নিজের মানুষদের প্রেমে পড়া এমনই সুন্দর বোধহয়। মস্ত বড়ো পুষ্পকাননে অনেক অনেক পুষ্পের মাঝে কেবল একটি পুষ্প জ্বলজ্বল করার মতো সুন্দর অনুভূতি!
পুষ্পির পরনে কালো রঙের শাড়ি। ভেজা চুলগুলো খোলা। চোখে লেপ্টে যাওয়া কাজল।
পুষ্পি শাড়ির আঁচলটা ভাজ করে কাঁধের উপর রাখে। একদম উপরের তাকটাতে বই রাখতে গিয়ে একটা বই এসে পুষ্পির গায়ে পরে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘উত্তরাধিকার’ বইটি! পুষ্পি বইটি রাখতে গিয়ে দেখল একটা চিঠির মতো কিছু বেড়িয়ে আছে৷ পুষ্পি কি মনে করে বইটা আর সেল্ফে রাখল না। বইটা নিয়ে খাটে গিয়ে বসল।
চিঠিটা বের করে হাতে নিল। প্রথমে চিঠিটা না খুলে, বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখতে পেল দুই লাইনের ছোট্ট একটা বার্তা…..

“জীবন নদীর মতো, স্রোত বয়ে যায় অবিরত। জীবনে তোমার এমন কেউ আসুক, আমার কথা মনে না পরুক। বিচ্ছেদ তোমার জীবনে দুঃখ নয়, বরং সুখ নিয়ে আসুক৷ চিঠিটা হয়তো পড়তে চাইবে না। কিন্তু পোড়ো, প্লিজ!
চারু কিংবা চারুলতা।”
(চলবে)…….