এক্স ওয়াই জেড পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
390

#এক্স_ওয়াই_জেড
শেষ অংশ

সেদিনের পর সব কেমন জানি তাড়াহুড়া করে হইয়া গেল। একদিন শাফকাতের বাড়ির লোকজন আইসা আমাকে একটা হীরা বসানো সোনার আংটি পরায় দিয়া গেল। ডিজাইনটা এত সুন্দর যে আমার দিনে বাইশ ঘন্টা ওইটার দিকে চাইয়া থাকতে মন চায়। এটা নাকি শাফকাতের পছন্দ করা। তার বাড়ির লোকের ধারণা তাদের ছেলের চয়েজ অতি উচ্চ পর্যায়ের। আর তার যেহেতু আমাকে পছন্দ তাই আমাকে নিয়ে তাদের মনে কোনো সংশয় নাই৷ ভাবা যায়!

কিন্তু ওই বিচ্ছুটারে বিয়া করার কোনো শখ আমার নাই। অনেক অনেকবার আম্মুকে বোঝানোর চেষ্টা করছি৷ কিন্তু আম্মু কেন বুঝবে! শুরু থেকেই তো গর্ত আমি নিজে খুঁড়ে ফেলছি। ফার্স্টে বলছি ছেলে পছন্দ হইছে, তারপর তার সাথে ঘুরতে গেছি বাসায় মিথ্যা বইলা, সেই ছবি আবার গেছে ফেসবুকে। এখন গর্তেও কবর আমারই হবে। বিদায় পৃথিবী! তুমি ভালো থেকো।

আম্মুরে তাও কতবার বলছি পোলার চরিত্র খারাপ, আমি বিয়া করতে চাই না ওরে! কিন্তু কিছু বলতে গেলেই বলে, ঝগড়া কইরা আসছোছ ওর সাথে তাই না? এখনই এমন করলে বিয়ার পর কী করবি? ধৈর্য ধর মা।

আরও বলে, তোর ওরে অনেক পছন্দ এইটা আমি তোর চোখ দেইখাই বুঝতে পারি। আমার সামনে এইসব তেড়িমেড়ি চলব না। ঢং দেখো মাইয়ার!

তাও যদি বলতে যাই বিয়া করব না। তখন বলে, তোর কষ্ট লাগতেছে আমাদের ছাইড়া যাইতে তাই না? কিন্তু সবারই তো বাপের বাড়ি ছাইড়া শ্বশুরবাড়ি যাইতে হয় রে মা।

বইলা আমারে আইসা জড়ায় ধরে।

বিয়ার কেনাকাটাও হইয়া যাচ্ছে। আমি হাত কামড়াইতেছি এদিকে। কেমনে বিয়াতে ভাঙতি দেয়া যায় এই চিন্তায় অস্থির! বান্ধুবীগুলাও হইছে আমার, দরকারের সময় তারা ব্যস্ত সব!

শাফকাতের সাথেও কথা হয় প্রতিদিন৷ ফোন দিয়া বকরবকর করে। তাও ভালো এখন এক্স ওয়াই জেডের প্যাচাল কম পারে। কিন্তু জ্বালাইতে ছাড়ে না কোনো বার।

মাঝখানে একদিন আবার তার সাথে যাইয়া তার প্রিয় রসমালাই খাইয়া আসছি। যথারীতি তার সামনে গিয়া হযবরল অবস্থা হইছে। খাইতে গিয়া বাটি উল্টাইয়া আমার জামা মাখাইছে। সে কইছে বিয়ার পর আমারে বর্ম পরায় বাইরে নিয়া যাবে। আর প্লাস্টিকের জামাকাপড় বানায় দিবে।

মেসেঞ্জারে আমার নিকনেম দিয়ে রাখছে, অঘটনঘটনপটীয়সী৷

এটার মানে নাকি যে অঘটন ঘটাইতে ওস্তাদ। এইটা কোনো কথা! আমিও তার নিকনেম দিছি শ্বেত ভাল্লুক। কিন্তু সে তাতে খুশি।

বিয়ার ডেটও চলে আসল দেখতে দেখতে। আমার ভয়ে গলা শুকায় আসে। এক রাতে স্বপ্ন দেইখা ফেললাম, বিয়ার পর হানিমুনে গেছি সী বীচে, সেইখানে যাইয়া দেখি একটার পর একটা মাইয়া আসে আর ওরে জড়ায় ধইরা বলে, কেমন আছ এক্স?

আমি চিল্লানি দিয়া উইঠা গেছি।

অবশেষে বিয়ার দিন চইলা আসল। আমি কাঁদতে কাঁদতে গেলাম পার্লারে।

সাইজা গুইজা বইসা আছি স্টেজে। এতদিনে অরুনার দেখা। ও হইছে বান্ধবীদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী আর উড়নচণ্ডী। ওরে কাহিনী মোটামুটি বইলা বললাম, দোস্ত আমি পালায় যামু।

-কিন্তু কার সাথে পালাবি? তোর বয়ফ্রেন্ড আছে?

– না।

-তো?

-একাই পালামু দোস্ত।

-একা পালানো যায় না৷ তুই পালাইয়া থাকবি কই?

– তোর বাসায় যাওয়া যায়।

-তুই পালাইলে সবার আগে যেইখানে খুঁজবে সেটা হইল আমার বাসা। অন্য কারো বাসা আছে যেখানে থাকতে দিবে আর তোর মা বাপ চিনবে না?

– না আম্মু তো সব বান্ধবীরেই চিনে।

– তো কই যাবি? কোনো আত্মীয়?

– সবাই আসছে বিয়েতে।

– তাইলে পালাইয়া কাজ নাই৷

– তুই আর আমি কোথাও যাই চল।

– কই যাব? পোলা হইলে যাইতামগা কবে! পোলারা চাইলে ফুটপাতেও ঘুমাইতে পারে৷ আমরা পারুম?

– না।

– মনে কর আমি একবার বয়ফ্রেন্ডের লগে পালাইছিলাম৷ ওই বান্দরে আমারে নিয়া গেছিল হোটেলে ওর লগে থাকতে। আমি তখন কত ড্রামা কইরা কাইন্দা কাইট্টা আইসা পড়ছি। তারপর থেকা পালানোর চিন্তা বাদ।

– কিন্তু…

– পালাইলে যা হইব তারচেয়ে এই এক্সওয়ালারে বিয়া করা ভালো। লাগলে বিয়ার পর ব্যবস্থা নিয়া এই ব্যাটারে জাতে আনা যাইব৷ আমার কাছে বহুত আইডিয়া আছে৷

– আচ্ছা।

– আর বিয়া একেবারেই না করতে চাইলে বলতে পারোছ, আমি কইরা ফালাই৷ তোর জামাই তো সেই সুন্দর। দেখলে চাইয়া থাকতে মন চায়।

– ওই নজর দিবি না।

– ও আমার সোনামনি, তুমি বিয়াই করতে চাও না, নজর দিলে সমস্যা কী?

– না চাইলেও করতে তো হবেই৷ তুই সামনে থেকা যা৷ তোর চেহারা দেখলে গা জ্বলতাছে।

– আচ্ছা।

বিয়ে পরানো হয়ে গেল। আমি জীবন দিয়া কান্দাকাটি কইরা আসলাম শ্বশুরবাড়ি। কতক্ষণ কিসব আচার পালন হইল। এক মিষ্টি, এক গ্লাসে শরবত দুইজনরে খাওয়াইল, তারপর আয়না দেখাইল। ওর দিকে এই পর্যন্ত ভালো কইরা তাকাই নাই। আয়নায় পুরা চেহারা দেখলাম৷ জামাই সাজে কী সুন্দর লাগে রে! বিচ্ছুটায় আমার দিকে চাইয়া চোখ মাইরা দিল! আমার কী শরম তখন!

বাসর ঘর।

আমি বসে আছি খাটে। সে দরজা লাগাইয়া আইসা প্রথমেই বলল, তোমাকে কী সুন্দর লাগছে নিতু! আমি মুগ্ধ।

বইলা আমার একটা হাত ধরে নিজের কাছে টান দিতে না দিতেই ঘরের মধ্যে বোম ব্লাস্টের মতো হাসির ধামাকা শুরু হইল। তারপর আলমারির ভিতর, খাটের নিচ, পর্দার আড়াল থেকে বের হইয়া আসল তার বিচ্ছু কাজিনের দল। আমি লজ্জায় শেষ।

সে কান ধইরা বের করল সবগুলারে।

তারপর আবার…..

এবার একটা ছোট্ট বক্স দিয়া বলল, তোমার জন্য গিফট।

খুলে দেখি একটা পেন্ডেন্ট৷ এত্ত সুন্দর! কিন্তু…কিন্তু…এটা আমি কই জানি দেখছি৷

সে রহস্য নিয়া হাসি দিয়া বলল, কী চেনে চেনা লাগে?

আমি কতক্ষণ চেষ্টা করলাম মনে করার৷ তারপর আচানক মনে পড়ে গেল! হায় হায় এই কি সে?

আগেই বলছি, আমার ফেসবুকে একটা রিলেশন ছিল রাজ নামের ফেক আইডির সাথে। আইডি ফেক হইলেও আমার ভালোবাসা ছিল রিয়েল। জীবনের প্রথম ভালোবাসা। তাই ব্রেকআপের পর তারে ভুলতে আমার যথেষ্ট কষ্ট হইছে।

সেই সময় সারাদিন ফেসবুকে এলোমেলো স্ক্রল করতাম। গল্প পড়তাম৷ একবার এক লেখকের সাথে পরিচয় হয়৷ আইডির নাম ছিল ‘ঝরা পালক’। ছবিটবি কিছু দেয়া নাই। খুব সুন্দর লিখত মনস্তাত্ত্বিক গল্প। আমি নিয়মিত পাঠক হইয়া গেছিলাম তার। তাকে নকও করতাম মাঝে মাঝে। সেও উত্তর দিত৷ একদিন আমার সব কথা তাকে বলছিলাম। সে সান্ত্বনা দিছিল। বলছিল কীভাবে মুভ অন করা যায়। তার এডভাইস শুনে উপকারও পাইছি অনেক।

একসময় আমরা ভালো ফ্রেন্ড হয়ে গেছিলাম৷ যদিও তারে সবসময় সন্দেহ লাগত সেও ফেক আইডি কি না৷ কিন্তু প্রেম তো আর করতেছি না তাই চিন্তা ছিল না৷

একদিন সে এই পেন্ডেন্টটার ছবি দিয়া বলছিল, কেমন হইছে?

বলছিলাম, সুন্দর।

তখন সে বলছিল, আমার খুব প্রিয় একজনের জন্য কিনেছি।

এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই আমার মোবাইল হারাইয়া যায়। এক মাস পর মোবাইল কিনি। এদিকে ফেসবুকের পাসওয়ার্ড ভুইলা যাওয়ার আগেরটা বাতিল হইয়া যায়, নতুন করে আইডি খুলি। কিন্তু অনেক খুঁজেও নতুন আইডি দিয়ে সেই লেখককে পাই নাই।

তার মানে কি….?

আমি অবাক হইয়া তাকাইলাম৷ সে বলল, কী ভাবো?

– আপনি ঝরা পালক তাই না?

– হ্যাঁ।

-তাহলে এক্স ওয়াই জেড ওগুলা কে?

– তোমার সাথে একটু মজা নিলাম নিতু! তুমি রাগলে তোমাকে যা সুন্দর লাগে!

আমি আবার রেগেমেগে কিছু বলতে যেয়েও পারলাম না৷ কারন সে তখন হো হো করে হাসতেছে। কী সুন্দর দাঁত! কী সুন্দর হাসি! উফফ!

(সমাপ্ত)

সুমাইয়া আমান নিতু