#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৩৯
#নিশাত_জাহান_নিশি
“ব্যথাগুলো সব দূরে সরে যাচ্ছে। এভাবেই কিছুক্ষণ জড়িয়ে থাকো আমাকে। ডক্টর ডাকার কোনো তাড়া নেই। এত সহজে আমার মৃ*ত্যু নেই।”
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অয়ন্তী। রাফায়াত কেমন তাকে সুশৃঙ্খলভাবে মিথ্যা বলে চলছে। শরীরের অকথিত যন্ত্রণা সে অনায়াসেই গোপন করছে। শারীরিক শান্তির বদলে মানসিক শান্তিকে এই মুহূর্তে বেশী প্রাধান্য দিচ্ছে। যা অয়ন্তীর সম্পূর্ণ ইচ্ছাশক্তির বাইরে। রাফায়াত কষ্ট পাওয়া মানেই তো হলো অয়ন্তীর কষ্ট পাওয়া। যোজন বিয়োজনে এভাবে কষ্ট না পেয়ে বরং কষ্টটা ভাগাভাগি করে নেওয়াই শ্রেয়। অনেকটা জোর-জবরদস্তি করেই অয়ন্তী রাফায়াতের বুকের পাঁজর থেকে ওঠে এলো। চোখে এক সাগর জল নিয়ে সে রাফায়াতের মুমূর্ষু মুখমণ্ডলে তাকালো। অশ্রসজল গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কীভাবে এমন হলো আপনার বলুন না? কে মে’রে’ছে আপনাকে?”
চোখ-মুখ কেমন যেন উল্টে এলো রাফায়াতের! শরীরের ব্যথা এবার তার গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল। ফ্যাকাসে হয়ে উঠল মুখমণ্ডল। ক্রমশ রুদ্ধশ্বাস ফেলতে লাগল সে। দিন দুনিয়া অসহ্য ঠেঁকল। মনে হলো যেন তার জানটা ভেতর থেকে এক্ষণি বের হয়ে আসবে! অয়ন্তীকে বুঝি এবার দেখা থামিয়ে দিবে। ম’র’ণ প্রাণ অবস্থা তার। ভয়ে তাৎক্ষণিক আঁতকে উঠল অয়ন্তী। জানে পানি শুকিয়ে এলো তার। চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে সে তার মা-বাবাকে ডেকে আনল। মৃগী রোগীর মত ছটফট করতে লাগল সে। দৌঁড়ে এসে অয়ন্তীর মা-বাবা রাফায়াতকে এই অবস্থায় দেখে প্রচুর ঘাবড়ে উঠলেন। আশেপাশের মানুষজনকে ডেকে এনে তারা রাফায়াতকে ধরাধরি করে হসপিটালে নিয়ে গেলেন। খবরটা রাফায়াতের পরিবারের কানে পৌঁছানো মাত্রই তারা মাঝরাতেই রওনা হলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। জীর্ণ শীর্ণ অবস্থা তাদের। কান্না কান্না মুখ সবার। বিপদ যেন কিছুতেই ছাড়ছেনা রাফায়াতকে। চতুর্পাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। কবে মুক্ত পাবে রাফায়াত এসব ভ’য়’ঙ্কর বিপদ আপদ থেকে? এসব ভাবতে ভাবতেই রাফায়াতের মা মুখ চেপে কাঁদতে লাগলেন।
অয়ন্তীর মা এবং বাবা কাগজপত্রে কিছু ফর্মালিটিস পূরণ করে দিলেন। তাৎক্ষণিক রাফায়াতকে ইর্মাজেন্সি রুমে ঢুকানো হলো। রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে অয়ন্তী এবং অয়ন্তীর পরিবার দুঃশ্চিন্তায় পায়চারী করতে লাগল। এই নিয়ে না আবার পুলিশ কে’ই’স হয়ে যায় সেই চিন্তায় তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল।
অয়ন্তীর অবস্থা প্রায় সূচনীয়। কাঁদতে কাঁদতে তার ম’র’ণ দশা। ঐসময়ের দেখা রাফায়াতের মু’মূ’র্ষু মুখমণ্ডলটি যেন কেবল তার দু’চোখে ভেসে উঠছে। ক্ষণে ক্ষণে অন্তরআত্তা কেঁপে উঠছে তার। রাফায়াতকে না হারিয়ে ফেলে সেই আশঙ্কায় সে কাতর। এই করতে করতে সে নিজেও এবার অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এই ভ’য়া’বহ পরিস্থিতি পেরিয়ে রাফায়াত যেন খুব দ্রুত তার কাছে ফিরে আসে সেই প্রার্থণা করতে করতেই তার সময় অতিবাহিত হচ্ছে। এক পর্যায়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেতেই অয়ন্তী অবচেতন হয়ে পড়ল! ঢুলে পড়ল তার মায়ের বুকে।
সারারাত ইর্মা’জে’ন্সি রুমে থাকার পর ভোরের দিকে রাফায়াতকে মোটামুটি সুস্থ অবস্থায় কেবিনে শিফট করা হলো! রাফায়াতের পরিবারও এসে এই মুহূর্তে হাজির হলো। হসপিটালে সবার কান্নার ঢল পড়ে গেল। অয়ন্তীরও মাত্র জ্ঞান ফিরে এলো। আবারও তার কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল। কেবিনে এই মুহূর্তে কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ। প্রায় ছয় ঘণ্টা অবজারভেশনে রাখা হলো রাফায়াতকে। এই দিকটা ঠিকঠাক হতেই অয়ন্তী এবার কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিলো৷ রাফায়াতের বাবা-মায়ের মুখোমুখি বসে সে শক্ত গলায় বলল,,
“মা-বাবা। আপনাদের ছেলেকে নিয়ে আমার কিছু বলার ছিল।”
রাফায়াতের মা এবং বাবা তৎপর দৃষ্টিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালেন। অয়ন্তীকে দেখে বেশ সিরিয়াস মনে হচ্ছে। তাই তারাও বেশ নিঃসংকোচে সম্মতি জানিয়ে বললেন,,
“বলো মা? কী বলতে চাও?”
নাক টেনে চোখের জল নিবারণ করল অয়ন্তী। নিজেকে শতরূপ ধাতস্থ করল বর্তমান পরিস্থতিতে। স্পষ্ট গলায় বলল,,
“আমি চাইনা আপনাদের ছেলে আর চট্টগ্রাম ফিরে যাক! ঢাকায় থেকেই কিছু একটা করুক!”
অয়ন্তীর সিদ্ধান্তে যদিও রাফায়াতের মা-বাবা বেশ অবাক হয়েছেন৷ তবুও যেন তারা স্বাভাবিক গলায় অয়ন্তীর দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন,,
“হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত মা?”
ভরাট দৃষ্টিতে অয়ন্তীর তার হবু শ্বশুড়, শ্বাশুড়ীর দিকে তাকালো। নাক ফুলিয়ে কেঁদেকেটে আকুতি ভরা গলায় বলল,,
“চট্টগ্রাম ফিরে গেলেই আপনাদের ছেলে আবার ঐ পথে ফিরে যাবে। মা’রা’মা’রি, খু’না’খু’নি, র’ক্তা’র’ক্তি আমি এসব চাইনা আর। আমি চাই তার সুস্থ একটা জীবন। তার সুস্থ একটা ভবিষ্যৎ৷ আমাদের সুস্থ একটা সংসার। পৃথিবীর প্রতিটি মেয়েই তো এমনটি চায়। তার সুস্থ এবং নিরাপদ একটা সংসার জীবন। তাহলে আমি কেন তার ব্যতিক্রম হব বলুন? তার সাথে এখন আমার জীবন জড়িয়ে আছে। তার খারাপ কিছু একটা হয়ে যাওয়া মানেই হলো আমার জীবনটা তছনছ হয়ে যাওয়া। আমি আমার সুখকে এভাবে হারাতে দিতে পারিনা। আশা করি আপনারা আমার বিষয়টা বুঝবেন। আমার সিদ্ধান্তে সহমত পোষণ করবেন।”
রাফায়াতের মা এবং বাবা দুজন দুজনের মুখ দেখাদেখি করলেন। মিনিট পাঁচেক তারা কিছু একটা ভেবে সঠিক সিদ্ধান্তে এলেন। রাফায়াতের বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপেক্ষেয়মান অয়ন্তীর দিকে তাকালেন। স্বাভাবিক স্বরেই বললেন,,
“তোমার সিদ্ধান্তের উপর আমাদের আর কোনো সিদ্ধান্ত থাকতে পারেনা মা। রাফায়াতকে নিয়ে এখন তুমি যা ভাববে তাই হবে। কারণ, আমাদের ছেলের ভবিষ্যৎ এখন তোমার হাতেই। তুমি যা করবে নিশ্চয়ই আমাদের ছেলের ভালোর জন্যই করবে। সেই বিশ্বাস আমাদের আছে। তবে বিয়ের আগে তো এক বাড়িতে থাকার কোনো নিয়ম নেই মা। এই দিকটাও একটু ভেবে দেখো।”
“ভেবে দেখার তো কিছু নেই বাবা। আমরা আলাদা ফ্লাটেই থাকব। সেই ফ্লাটে শুধু রাফায়াত নয় বরং আপনারাও থাকবেন! আমি বলতে চাইছি বাবা চট্টগ্রামের বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে আপনারা বরং ঢাকায় একটা ফ্লাটে ওঠে যান। ঐ বাড়ি থেকে যা ভাড়া পাবেন তা দিয়ে ঢাকায় ফ্লাটের ভাড়া চলে যাবে। বাকি সাংসারিক খরচ না হয় আমার বাবা দেখে নিবে! তবে এই বিষয়ে রাদিফকে কিছু জানাবেন না প্লিজ। বিষয়টা গোপন থাকবে। শুধু আপনাদের আর আমাদের মধ্যে থাকবে।”
“না না মা। এ কীভাবে হয়? আমার নিজেরও তো একটা আত্নসম্মানবোধ আছে। তাছাড়া আমি এখন অবসরে থাকলেও আমার বড়ো ছেলে তো আর বেকার নয়। সংসারের খরচ কোনো রকমে চলে যাবে আমাদের। ঢাকায় শিফট হওয়ার ব্যাপারটা আমি মন থেকেই মেনে নিলাম মা! আসলে সিদ্ধান্তটা আমার আরও পাঁচ ছয় বছর আগেই নেওয়ার উচিৎ ছিল। যা এখন তোমার মাধ্যমে সম্পন্ন হলো।”
স্বস্তি খুঁজে পেল অয়ন্তী। দুঃখের মাঝেও এক প্রকার সুখ খুঁজে পেল। দুই পরিবারের সবাই অয়ন্তীর সিদ্ধান্তকে মেনে নিলো। অয়ন্তীর বাবা অলরেডি ফ্লাট খুঁজতে শুরু করে দিয়েছেন! হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়েই যেন রাফায়াত ঢাকায় নতুন ফ্লাটে উঠতে পারে সেজন্যে। দুপুরের দিকে রাফায়াতের জ্ঞান ফিরে এলেও অয়ন্তী একটিবারের জন্যও রাফায়াতকে দেখতে গেলনা! অভিমান নিয়ে কেবিনের বাইরে জনাজীর্ণ অবস্থায় বসে রইল৷ রাফায়াত অনেকবার দেখতে চেয়েও অয়ন্তীকে দেখতে পারলনা। অসুস্থ শরীর নিয়ে রাফায়াত অয়ন্তীকে অনেকবার ডেকেও কেবিনের ভেতরে আনতে পারলনা। অভিমান বেড়ে যেন অয়ন্তীর আকাশ ছুঁতে চাইল।
রাতটা এভাবেই কোনোমতে পাড় হয়ে গেল। কেবিনের ভেতর রাফায়াতের সাথে রাফায়াতের মা-বাবা ছিল। কেবিনের বাইরে বসা ছিল অয়ন্তী! রাতে বাড়ি ফিরেনি সে। খাবারদাবারও খায়নি। হাজার জোর করেও কেউ তার মুখে খাবার তুলতে পারেনি। অদম্য জেদ চেপে বসেছে তার মস্তিষ্কে। তাই ঠায় চেয়ারে বসে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিয়েছে। আর অনর্গল চোখের জল ফেলেছে।
সকাল হতেই রাফায়াত চিৎকার চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিলো! অয়ন্তীর নাম ধরে সে গলা ছেড়ে ডাকতে লাগল। বেঁধে গেল হু’লু’স্থুল কাণ্ড। অন্যান্য রোগীদের এতে অসুবিধা হতে লাগল। রাফায়াতের নামে কমপ্লেইন আসতে লাগল। রাগান্বিত হয়ে অয়ন্তী কেবিনের ভেতরে আড়চোখে তাকালো। অমনি দেখতে পেল রাফায়াত তার হাতের ক্যানোলা খোলার চেষ্টা করছে! অসুস্থ শরীর নিয়ে বেড থেকে ওঠে আসার চেষ্টা করছে। এসব দেখে অয়ন্তী আর তার জেদ ধরে রাখতে পারলনা! চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো সে। দৌঁড়ে গেল কেবিনের ভেতরে। অয়ন্তীকে এক পলক দেখামাত্রই যেন রাফায়াত শান্ত হলো। গোঙাতে গোঙাতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। উচ্চশব্দে চিৎকার করে বলল,,
“কই ছিলা এতক্ষণ তুমি হ্যাঁ? শুনতে পারছিলে না? আমি তোমাকে ডাকছিলাম?”
অয়ন্তী ইশারায় রাফায়াতের বাবা-মাকে বলল কেবিন থেকে বের হয়ে যেতে। অয়ন্তীর ইশারা বুঝে তারাও কেবিন থেকে বের হয়ে গেলেন। কেবিনের দরজা আটকে অয়ন্তী দূরে থেকেই রাফায়াতের দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। চোয়াল উঁচিয়ে বলল,,
“কী হইছে? এটা একটা হসপিটাল জানেন না? এভাবে সিনক্রিয়েট করতেছেন কেন? আপনার জন্য অন্যান্য রোগীদের সমস্যা হচ্ছে। এটা কি আপনি আপনার বাড়ি পেয়েছেন? বা আপনার নিজের এলাকা পেয়েছেন? যে গলা তুলে গু*ন্ডাদের মত গু*ন্ডামি করবেন?”
“তুমি আবারও আমাকে গু*ন্ডা বললে?”
“গু*ন্ডাকে গু*ন্ডা বলব না তো কী বলব? গু*ন্ডামি করতে গিয়ে আ*হত হয়ে এসেছেন আবার বড়ো বড়ো কথা বলছেন।”
“গু*ন্ডামি করতে যাইনি আমি। তোমার কথা মত এই পথ ছেড়ে দিচ্ছি আমি। ইভেন ছেড়েও দিয়েছি।”
“ছেড়ে দেওয়ার এই নমুনা হ্যাঁ? এই নমুনা? আর একটু হলেই তো ম*রা দেহটা নিয়ে ফিরে আসতি! বাঁচাতে পারতাম না আমরা তোকে! এই? তোকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে কী আমি ভুল করেছি বল? আমার জীবনটাকে ন’রক করে তুলছি? আমার লাইফ ঝুঁ’কি’র মধ্যে ফেলে দিচ্ছি? হাতে ধরে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করছি?”
অয়ন্তীর প্রতিটা কথা যেন রাফায়াতের গাঁয়ে সূচের মত বিঁধল। ভেতরে বাহিরে প্রচণ্ড আ’ঘাত পেল সে। রাগ ভুলে আ’হ’ত দৃষ্টিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। কেমন যেন মিইয়ে আসা গলায় বলল,,
“কী বললে তুমি? আমার জন্য তোমার জীবন নষ্ট হচ্ছে?”
রাফায়াতের দিকে তেড়েফুঁড়ে এলো অয়ন্তী। চেয়ার টেনে রাফায়াতের পাশে বসল। রাগে গজগজ করে উঁচু গলায় রাফায়াতকে শাসিয়ে বলল,,
“নষ্ট হচ্ছে না তো কী হচ্ছে? তোর লাইফের কোনো গ্যারান্টি আছে? দেখা যাবে বিয়ের পরের দিনই আমি বি’ধ’বা হয়ে গেলাম! তখন কী হবে আমার হ্যাঁ? বল কী হবে আমার?”
ভরাট দৃষ্টিতে রাফায়াত অয়ন্তীর দিকে তাকালো। গভীর আ’ঘা’তে যেন কুঁকড়ে উঠল সে। অস্ফুটে গলায় বলল,,
“আরেকটা বিয়ে করে ফেলবে! আমার জন্য তো আর তোমার জীবন থেমে থাকবেনা! মাশাআল্লাহ্ রূপে গুনেও অপরূপা তুমি। অবিবাহিত ছেলেরাও তোমাকে বিয়ে করতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে! তাছাড়া ফারহান তো আছেই! তোমাকে সুখে রাখবে।”
“তখন ফারহান ভাইও আমাকে বিয়ে করবেনা! বলবে অবিবাহিত ছেলে হয়ে আমি কেন একটা বি’ধ’বা মেয়েকে বিয়ে করব?”
“তাহলে বিয়েটা ভেঙে দাও!”
“মানে?”
এক টানে হাত থেকে ক্যানোলাটা খুলে ফেলল রাফায়াত! টলটলিয়ে র’ক্ত বইতে শুরু করল হাতের ফিনকি বেয়ে। বিক্ষুব্ধ হয়ে রাফায়াত অয়ন্তীর হাত থেকে জোর জবরদস্তি করে তাদের এনগেজমেন্ট রিংটা খুলে ফেলল! ঘাড়ের রগ টান টান করে চিৎকার করে বলল,,
“আজ থেকে তুমি মুক্ত! বিয়েটা ভেঙে দিলাম আমি। আমার এই অনিশ্চিত জীবনের সাথে তোমাকে জড়াতে হবেনা। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোমার এবং ফারহানের বিয়েটা দিব। সুখে থাকবে তুমি।”
দিশা খুঁজে না পেয়ে অয়ন্তী ঠা’স করে রাফায়াতের গালে জোরে এক চ’ড় বসিয়ে দিলো! খারাপ ভাষা ব্যবহার করে বলল,,
“জা’নো’য়া’র! আমার হাত থেকে রিং খোলার সাহস তোকে কে দিলো? অন্যায় তো করবি করবি আবার রাগও দেখাবি? তোর একার-ই শুধু রাগ আছে না? আমার কোনো রাগ নেই? কোনো অভিমান নেই? আমি কী রাগের মাথায় তোকে দু’একটা কথা শুনাতে পারিনা? নাকি সেই অধিকারটাও আমার নেই? কিনে নিয়েছিস সব অধিকার তুই?”
চোখ লাল করে রাফায়াত অয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে রইল। রাগ যেন কিছুতেই থামছেনা তার। বেগতিক বাড়ছে। হিংস্র বাঘের ন্যায় গ’র্জে উঠছে। হাতের ফিনকি বেয়েও র’ক্তের ধারা বইছে। চটে বসল অয়ন্তী। মাথা গরম হয়ে গেল তার। বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো সে। একের পর এক রাফায়াতের গালে ঠা’স ঠা’স করে চ’ড় বসাতে লাগল। ক্ষোভে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,
“কী করছস তুই এটা হ্যাঁ? কী করছস? হাত থেকে ক্যানোলা কেন খুললি? এখন এই র’ক্ত পড়া থামবে কীভাবে? আর কত র’ক্ত গাঁ থেকে ঝড়াবি? দয়ামায়া কী নেই তোর? ব্যথা বেদনা নেই তোর শরীরে? এত অ’মা’নুষ কেন তুই?”
একনাগাড়ে ছয় সাতটা চ’ড় দেওয়ার পর অয়ন্তী থামল। কাঁদতে কাঁদতে সে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে ডক্টর ডেকে আনল। অয়ন্তীর উপর রেগে গেলেন ডক্টর! দু’একটা কটু কথা শুনিয়ে দিলেন। কেন রাফায়াতকে এই মুহূর্তে উত্তেজিত করল তাই। কিছু একটা করে ডক্টর র’ক্ত পড়া বন্ধ করলেন। পুনরায় ক্যানোলাটা হাতে লাগিয়ে দিলেন। এই মুহূর্তে কেবিনে কারো থাকাটা তিনি এলাউড করলেন না। এমনকি অয়ন্তীকেও না। কাঁদতে কাঁদতে অয়ন্তী কেবিন থেকে বের হতেই রাফায়াত অশ্রসিক্ত গলায় পেছন থেকে অয়ন্তীকে ডাকল। জড়িয়ে আসা গলায় বলল,,
“বললাম তো আমি ভালো হয়ে যাব অয়ন্তী। আর একটা সুযোগ দাও আমায় প্লিজ। তোমার সুখের জন্য আমি সবকিছু ছাড়তে রাজি। শুধু আরও একটু সহ্য করে তুমি আমার পাশে থেকে যাও। কথা দিলাম আমি, আর কখনও তোমার চোখের জলের কারণ হব না আমি।”
থমকে দাঁড়ালো অয়ন্তী। নিশ্চল দৃষ্টিতে পিছু ফিরে তাকালো। রাফায়াতের কাতর মুখশ্রী তাকে মায়ায় জড়িয়ে দিলো। ডক্টরের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সে পিছু ঘুরে দৌঁড়ে এলো রাফায়াতের কাছে। লাজ লজ্জা খুইয়ে সে রাফায়াতের কপালে দীর্ঘ এক চু’মু খেয়ে দিলো। ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল,,
“শান্ত হও এবার। অয়ন্তী তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছেনা। দেখবে আমরা খুব সুখী হব। কষ্টের পর স্বস্তি রয়েছে। এখন আমরা কষ্ট করছিনা? একটা সময় পর দেখবে সেই কষ্ট আমাদের সুখ হয়ে ঝড়বে।”
#চলবে…?
#এক_খণ্ড-কালো_মেঘ
#পর্ব_৪০
#নিশাত_জাহান_নিশি
“শান্ত হও এবার। অয়ন্তী তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছেনা। দেখবে আমরা খুব সুখী হব। কষ্টের পর স্বস্তি রয়েছে। এখন আমরা কষ্ট করছিনা? একটা সময় পর দেখবে সেই কষ্ট আমাদের সুখ হয়ে ঝড়বে।”
চোখের কিনারা বেয়ে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ল রাফায়াতের। শুষ্ক হয়ে আসা মলিন ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠল। রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, বেদনা নিমিষেই ভুলে সে শান্তশিষ্ট,কোমল এবং নিরিবিলি হয়ে উঠল। দেখে যেন বুঝা-ই যাচ্ছিল না একটু আগেই এই ছেলেটি পাগলের ন্যায় সর্বত্র উন্মাদনা ছড়িয়ে রেখেছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠতেই রাফায়াতের কপাল থেকে ওষ্ঠদ্বয় তুলে নিলো অয়ন্তী। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। রাফায়াতের দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকাতেই একদফা অবাক হলো সে। চোখের পলকেই যেন ঘুমিয়ে পড়ল রাফায়াত! তবে কী আজ এতটাই ক্লান্ত ছিল রাফায়াত? শরীর বুঝি তার এতটাই দুর্বল এবং অবসন্ন ছিল? যার দরুন প্রশান্তিতে চোখজোড়া বুজতেই হুরহুর করে চোখের পাতায় ঘুম নেমে এলো? ম্লান হাসল অয়ন্তী। ঘুমে সিক্ত স্নিগ্ধ রাফায়াতকে দু’চোখ ভরে দেখতে লাগল। শেষবারের মত রাফায়াতের কপালে অতি আদুরে হাত বুলিয়ে সে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। এক প্রকার জোর করেই সে এবার রাফায়াতের মা এবং বাবাকে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো। বয়স্ক মানুষ। তাদেরও বিশ্রাম প্রয়োজন। সময়মত খাবারদাবার এবং আরামের প্রয়োজন।
প্রায় তিনদিন পর রাফায়াতকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করা হলো। আজ তার বাড়ি ফেরার পালা। সব বাঁধা পেরিয়ে তাদের নতুন ফ্লাটে উঠার পালা। অয়ন্তীর বাবার পরিচিত এক বন্ধুর ফ্লাটেই উঠবে তারা। ফ্লাটটাও অয়ন্তীদের বাসার পাশেই! মেইন গেইট থেকে বের হয়ে পাশের ফ্লাটটা। এই নিয়ে বেশ খুশি অয়ন্তী। যখন ইচ্ছে হবে তখন সে রাফায়াতের বাসায় যেতে পারবে। রাফায়াতকে দেখে আসতে পারবে। সময় কাটাতে পারবে। ঢাকায় স্যাটেল্ড হওয়ার বিষয়টায় যদিও রাফায়াত প্রথমে রাজি হতে চায়নি তবে পরে অয়ন্তীর চোখ গোঁড়ানোতে ঠিক-ই রাজি হতে বাধ্য হয়েছে! সাংঘাতিক ভয় পেতে শুরু করেছে সে অয়ন্তীকে। যাকে বলে হারানোর ভয়! প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলার ভয়।
চট্টগ্রাম থেকে ট্রাক ভর্তি আসবাপত্র ঢাকায় এনে নতুন ফ্লাটে শিফট করল রায়হান। আর ঐ বাড়িটা বিশ্বস্ত একজন মানুষের কাছে ভাড়ায় দিয়ে এলো। একটা রুম ফাঁকা রেখে এলো। চঞ্চল সহজে ছাড়তে পারলনা মির্জা ফখরুল হকের হয়ে চামচামি করা! কারণ, তার মধ্যে রাফায়াতের মত এতটাও হিম্মত ছিলনা যে ফখরুল হকের মুখের উপর কথা বলবে সে। কিংবা তাদের সাথে একা ল’ড়ে নিজের ভিটে বাড়ি ত্যাগ করে নতুন আবাসস্থল খুঁজবে! তাই চেয়েও সে রাফায়াতের মত নিজেকে মুক্ত করতে পারলনা এই পা’পী জীবন থেকে। শুধু রাফায়াতকেই সেদিন ঘটনাচক্র থেকে উ’দ্ধা’র করে আ*হত অবস্থায় ঢাকায় অয়ন্তীর কাছে পাঠিয়ে দিলো। রাফায়াতের সুস্থ, সুন্দর, নিরাপদ একটি ভবিষ্যতের জন্যে। যদিও আ’ক্রো’শ এখানেই শেষ নয়! তবে এখন ভবিষ্যতের কথা ভেবে তো বর্তমানও নষ্ট করা যায়না।
সন্ধ্যার দিকেই রাফায়াতকে নিয়ে নতুন ফ্লাটে ওঠা হলো। অয়ন্তী এবং অয়ন্তীর পরিবারও সেখানে উপস্থিত ছিল। মোট তিনটি বড়ো রুম আছে ফ্লাটটিতে। দুইটি এডজাস্ট করা বাথরুম। ড্রইংরুম, কিচেন রুম, বিশাল ব্যালকনী মিলিয়ে বেশ ভালো এবং সুবিধাজনক একটি ফ্লাট-ই পেয়েছে তারা। বাড়িটির নিচতলার ফ্লাটটিতে উঠেছে তারা। দু’তলা এবং তিনতলাও ভাড়ায় দেওয়া। রায়হান আপাতত চট্টগ্রাম থেকে তার অফিসে যাওয়া আসা করবে! তাদের বাড়ির একটা রুম সে এই কারণেই ফাঁকা রেখে এসেছে। সেই রুমটিতে থাকবে সে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম প্রতিদিন জার্নি করাটা তার পক্ষে অসম্ভব। মাস দুয়েক বাদেই সে তার অফিস থেকে ট্রান্সফারের আবেদন করবে। ভাগ্যক্রমে যদি মওকুফ হয় তো সবার জন্যই মঙ্গল।
রাত প্রায় আটটা তখন। সময় স্বচ্ছ পানির ন্যায় গড়াচ্ছে। নতুন বাড়িতে ওঠে সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রাফায়াতকে সন্ধ্যার নাশতা দিতে অনেকটা-ই দেরি হয়ে গেল। রাফায়াতের মা এবং ভাবি এখনও ব্যস্ত তাদের ঘর গোছানোর কাজে। তাই অয়ন্তীই রাফায়াতের জন্য নাশতা নিয়ে গেল। নাশতার ট্রে-তে করে অয়ন্তী বড়ো গ্লাস ভর্তি খাঁটি গরুর দুধ, জুস, বিস্কিট এবং কেক নিয়ে এলো। এতক্ষণ যাবত রাফায়াত ঠিকই বিছানায় শুয়ে শুয়ে আরামচে ফোন ঘাটছিল। অয়ন্তীর হাতে ট্রে-ভর্তি নাশতা দেখেই সে চোরের মত কাঁথা টেনে ঘুমানোর ভান ধরল! মুখটা বাংলার পাঁচের মত করে নিলো। এই তিন/চারদিন ধরে অয়ন্তীর অতিরিক্ত সেবায় সে তিক্ত হয়ে উঠেছে! বিশেষ করে খাবারদাবারের বিষয়টা নিয়ে। রীতিমতো জোর করেই রাফায়াতের মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিচ্ছে অয়ন্তী। এত এত খাবার রাফায়াত গিলবে নাকি উগলে দিবে সেই চিন্তাটাও করছেনা। ভাবছে হাড়ি হাড়ি খেতে পারলেই হয়ত রাফায়াতের শরীর দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে! কপাল চাপড়ালো রাফায়াত। কাঁথার ভেতর মুখ ঢুকিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করে বলল,,
“ওহ্ গড! আবার চলে এসেছে ডিশ ভর্তি খাবার নিয়ে। খাওয়াতে খাওয়াতে এই মেয়েটা আমাকে ঠিক মে*রেই ফেলবে! কোনো কথাই শুনবেনা। মনে করছে এত এত খাবার খেলেই হয়ত আমি সুস্থ হয়ে যাব। সার্জারির পরেও তো এত খাবার খাইনি বাপ। সামান্য কয়েকটা সেলাইয়ে এখন যত খাবার খেতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে তো মাসখানিক ও লাগবেনা এরমধ্যেই আমার ভুঁড়ি বের হয়ে যাবে!”
অয়ন্তী ঠিক বুঝতে পেরে গেছে রাফায়াত ভান ধরেছে! আদোতে ঘুমুচ্ছেনা সে। খাবার দেখে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। নাশতার ট্রে-টা অয়ন্তী আওয়াজ করে ডেস্কের উপর রাখল। রাফায়াতের পাশে বসে হেঁতো হাসল। কাত হয়ে থাকা রাফায়াতকে দু’হাত দ্বারা ঝাকাতে লাগল। দ্রুত গলায় বলল,,
“এই শুনছেন? উঠুন? আমি জানি আপনি সজাগ আছেন। খাবার দেখে এখন ইচ্ছে করে নাটক করছেন। কী মনে করেছেন? আমি বুঝিনা আপনার ছলা কলা?”
এভাবে ধরা পড়ে যাওয়ার পরেও রাফায়াত শান্ত থাকার যথেষ্ট চেষ্টা করল! নড়াচড়া না করে মুখটা জোরপূর্বক বন্ধ রেখে মিছেমিছি চোখ বুজে রইল। খিঁচ খেয়ে পড়ে রইল। অয়ন্তী আবারও বুঝে গেল রাফায়াতের ট্রিক। দেঁতো হেসে সে ফট করে রাফায়াতের গাঁ থেকে কাঁথাটা তুলে নিলো। সঙ্গে সঙ্গেই রাফায়াত কাঁচা ঘুম থেকে জেগে ওঠার মত ভান ধরল! চমকে ওঠে কেমন যেন ভীরু গলায় বলল,,
“কে কে?”
রাফায়াতের নাটকীয় মুখে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল অয়ন্তী! কাঁথাটা হাত থেকে ছু’ড়ে ফেলে সে দাঁতে দাঁত চাপল। উড়নচণ্ডী গলায় বলল,,
“নাটক করছেন না? কী ভেবেছেন আমি কিছু বুঝব না? ঘুমের মানুষও বুঝা যায়। আবার ঘুমের ভান ধরা মানুষও বুঝা যায়। আপনার চোখ-মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে আপনি ঘুমুননি।”
অসুস্থ শরীর নিয়ে তড়তড়িয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসল রাফায়াত! নির্বোধের মত ভান ধরল সে। খাটের কার্ণিশে হেলান দিয়ে বসে অয়ন্তীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বাঁ পাশের ভ্রুটা উঁচু করে বলল,,
“আচ্ছা তোমার কী ভুড়িওয়ালা ছেলে পছন্দ?”
অবাক হলো অয়ন্তী। খরতরভাবে কপাল কুচকে সে রাফায়াতের দিকে তাকালো। নাক-মুখ খিঁচে বলল,,
“মানে? হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”
“যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দা। আসলেই কী তোমার ভুড়িওয়ালা ছেলে পছন্দ?”
“কই না তো! আপনার তো ভুঁড়ি নেই। তো পছন্দ হলো কীভাবে?”
“নেই। তবে হতে কতক্ষণ?”
“আরে আরে এসব কী বলছেন আপনি? আপনার কেন ভুঁড়ি হবে? আপনি তো বডি বিল্ডারদের মত ঠিক-ই আছেন। একদম পার্ফেক্ট!”
“কোথায় আর পার্ফেক্ট থাকলাম? দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা তুমি যেভাবে আমাকে খাবারের উপর রাখছ! গাল চাপা সব ব্যথা হয়ে গেল আমার হাড়ি হাড়ি খাবার চিবুতে চিবুতে। দুধ, ডিম, ফলমূলও প্রতিবেলা জোর করে খাওয়াচ্ছ। এত ভিটামিন নিতে পারবে আমার শরীর?”
“কী আশ্চর্য! বোকা বোকা কথা বলছেন কেন? আপনি এখন অসুস্থ। আর অসুস্থ রোগীকে এসব ভিটামিন জাতীয় খাবার প্রচুর খেতে হয়। ফলমূল, দুধ, ডিম এসব তো প্রতিদিনকার রুটিন।”
“উফফ। তুমি বুঝতে পারছনা অয়ন্তী। আমার ওজন বেড়ে যাচ্ছে! নিশ্চয়ই তিন/চারদিনে আরও পাঁচ/ছয় কেজি ওজন বেড়ে যাবে। এভাবে ওজন বাড়তে থাকলে তো বিয়ের পর তোমারই কষ্ট হবে!”
“কী? আমার কষ্ট হবে মানে?”
“মানে। আমার এত ভার কী তুমি নিতে পারবে বলো? এমনিতেই তুমি পিচ্চি বাচ্চা!”
বলেই ক্রুর হাসল রাফায়াত! চাহনি তার দুষ্টুমিতে ভরা। ইশারা করছে নেগেটিভ দিকে! ফট করে রেগে গেল অয়ন্তী। রাফায়াতের গাঁয়ে দু/একটা চা’প’ড় মেরে সে বিরক্ত ভরা গলায় বলল,,
“খালি ইয়ার্কি না? খাবার না খাওয়ার জন্য এসব উল্টা পাল্টা বাহানা দিচ্ছেন আপনি? আর কোনো লজিক পাননি না? শেষ পর্যন্ত এসব লু’চ্চা”মি মার্কা লজিক?”
“আরে লু’চ্চা’মি করলাম কই? সত্যিই তো বললাম। কয়েকদিন পর সত্যিই আমার ভুঁড়ি টুড়ি বেড়ে একাকার হয়ে যাবে। তখন তুমি রাতেও শান্তি পাবানা! আর দিনেও রাস্তাঘাটে চলতে পারবা না! পাড়া প্রতিবেশীরা, বন্ধু-বান্ধীরা দেখলেই তোমাকে টিটকারি করে বলবে– “কী রে তোর জামাই নাকি ভুড়িওয়ালা?” তখন তুমি তাদের কাছে মুখ দেখাবা কীভাবে বলো? লজ্জা লাগবেনা?”
“রাদিফ বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। খাবার দাবার নিয়ে কোনোরকম অনিয়ম করা চলবেনা। ইললজিক্যাল কোনো যুক্তি দেখানো যাবেনা। শরীর, স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হবে। এতগুলো বছর ধরে তো অনেক অনিয়ম করে এসেছেন। এসব আর চলবেনা। আমি অন্তত তা চলতে দিবনা।”
রাফায়াতও নাছোড়বান্দা। কাত হয়ে সে পুনরায় শুয়ে পড়ল! সমস্ত শরীরে কাঁথা জড়িয়ে নিলো। কাঁথার তলা থেকেই ভাসা ভাসা গলায় বলল,,
“খাবনা আমি। নিয়ে যাও এসব। পারলে দুইটা সি’গা’রেট এনে দাও! অনেকদিন খাইনা। ভেতরটা হাসফাস করছে।”
“কী বললি তুই?”
রেগেমেগে অয়ন্তী দাঁতে দাঁত চাপল। কাঁথাটি পুনরায় রাফায়াতের গাঁ থেকে টেনে নেওয়ার পূর্বেই রাফায়াত তার রোগা শরীর নিয়ে প্যাঁচিয়ে ধরল অয়ন্তীকে! মুহূর্তেই অয়ন্তীকে কাঁথার মধ্যে ঢুকিয়ে নিলো সে। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে উঠল অয়ন্তী। মিটমিটি অন্ধকারে সে কাঁথার নিচে তাকালো। কেমন যেন লাল রঙ ধারণ করেছে রাফায়াতের চোখ দুটি! অদ্ভুত এক নেশাধরা চাহনি। ঘন ঘন গরম শ্বাস পড়ছে রাফায়াতের। উষ্ণতা বিরাজ করছে সর্বত্র। বেসামাল হয়ে উঠল রাফায়াত। এক ধরণের উত্তেজনা কাজ করতে লাগল তার দেহজুড়ে। রাফায়াতের এহেন চরম উত্তেজনা বুঝতে পারল অয়ন্তী! আশকারা দিতে চাইল না রাফায়াতের উত্তেজনাকে। শুকনো ঢোক গিলে সে রাফায়াতের দিকে ভীরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ততক্ষণে রাফায়াত একটু একটু করে অয়ন্তীর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। শঙ্কায় চোখ জোড়া আ’গুনের ফুলকির লাল ন্যায় করে অয়ন্তী দু’হাত দ্বারা রাফায়াতকে ঠেলে দিলো। খাপছাড়া গলায় বলল,,
“এই থামুন থামুন। এভাবে এগিয়ে আসছেন কেন আপনি?”
তবুও যেন ঘোর থেকে বের হতে পারলনা রাফায়াত! একটু আধটু ভুল করতে ইচ্ছে করল তার। মাথা ঘুরে গেল প্রায়। থামিয়ে দিলেই এই নেশা থেমে যাবেনা। যতক্ষণ অবধি না ভুল কিছু ঘটে যায়। হেঁচকা টানে অয়ন্তীকে কাছে টেনে নিলো রাফায়াত। অয়ন্তীর ভয়ে রঙিন হয়ে থাকা আবেদনময়ী মুখশ্রীতে সে নেশালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বেপরোয়া হয়ে অয়ন্তীর নরম, কোমল, উষ্ণ ওষ্ঠের দিকে নির্ভয়ে এগিয়ে গেল! রসালো গলায় বলল,,
“আচ্ছা যাও সি’গা’রেট লাগবেনা। আপাতত যে নেশা মাথায় চড়েছে সে নেশায় ডুবে যেতে দাও।”
কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই অয়ন্তীর কম্পায়মান ওষ্ঠদ্বয় নির্দয়ভাবে দখল করে নিলো রাফায়াত! হকচকানো দৃষ্টি ফেলল অয়ন্তী রাফায়াতের ঘোরে নিমজ্জিত মুখশ্রীতে। প্রখর নেশায় মত্ত রাফায়াত। হিতাহিতজ্ঞান শূণ্য প্রায়। থামবার পর্যায়ে নেই সে। অয়ন্তী বুঝে উঠতে পারছেনা কী ঘটছে কী তার সাথে! এরম পরিস্থিতিতে লাইফে ফার্স্ট টাইম পড়ল সে। তাই তার বর্তমান অবস্থা অনুভূতিশূণ্য এক মানব মূর্তির ন্যায়! রাফায়াতের ভালোবাসা গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল। বুদ্ধি সুদ্ধি সব লোপ পেল। মাথা প্রায় খারাপ হয়ে গেল তার। অয়ন্তী এবার বোশ ক্ষেপে বসল। শরীরের সমস্ত শক্তি কাজে লাগিয়ে সে রাফায়াতকে সজোরে এক ধা’ক্কা দিলো। অমনি রাফায়াত এক ফুট দূরত্বে গিয়ে ছিটকে পড়ল। আচমকা সর্বনাশা ঘোর থেকে বের হয়ে এলো সে। অয়ন্তীর চোখের কোণে ঘৃণার জল! রাফায়াতের পাশে বসে সে চোখ টিপে কাঁদতে লাগল। আঙুল উঁচিয়ে শঙ্কিত রাফায়াতের দিকে তাকালো। শ্লেষাত্মক স্বরে বলল,,
“ছিঃ। এই ছিল আপনার মনে? পুরুষ মানুষের পরিচয় দিলেন এভাবে?”
ঘাবড়ে উঠল রাফায়াত। শোয়া থেকে ওঠে বসল সে। শরীরে ব্য’থা লাগা সত্ত্বেও পা দুটো ভাঁজ করে অয়ন্তীর মুখোমুখি বসল। মলিন দৃষ্টিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। ঝেড়ে কেশে বলল,,
“কোথায় কী ছিল আমার মনে? এসব না করলেও তো আমি পুরুষ মানুষ-ই তাইনা? আলাদাভাবে প্রমাণ দেওয়ার কী আছে? তাছাড়া তুমি যা বুঝাতে চাইছ তা কিন্তু নয় অয়ন্তী। জানিনা হঠাৎ কী হয়ে গিয়েছিল আমার! কেন আমি এসব করলাম।”
“কিচ্ছু বুঝতে হবেনা আমার। আমি বুঝে গেছি আপনি কেমন! বিয়ের আগেই এসব! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!!”
ধি’ক্কা’র জানিয়ে অয়ন্তী মুখ ঘুরিয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। রাগে রঙিন হয়ে তেড়েমেরে দরোজার দিকে পা বাড়ালো। অমনি রাফায়াত নাটকের আশ্রয় নিলো! বুকের ব্যান্ডেজ করে রাখা অংশগুলোতে সে হাত রেখে ব্যথায় কুঁকিয়ে ওঠা গলায় বলল,,
“ওমা! ব্য”থা! আর পারছিনা।”
#চলবে….?