এক খণ্ড কালো মেঘ পর্ব-৪১+৪২

0
371

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৪১
#নিশাত_জাহান_নিশি

“ওমা! ব্য”থা! আর পারছিনা।”

নিমিষেই পিছু ঘুরে তাকালো অয়ন্তী। তবে ক্ষোভ কাটিয়ে বিন্দুমাত্র সহানুভূতিরও ছিটেফোঁটা দেখা গেলনা তার মুখমণ্ডলের কোথাও! রাফায়াতের নাটকীয় প্ল্যান সব ভেস্তে গেল। হায় হায় করার বদলে সে তবুও তার নাটক চালিয়ে গেল। হার মানতে চাইলনা অয়ন্তীর জেদের কাছে। মানবেই বা কেন? সামান্য রাগের কারণে অয়ন্তীর থেকে দূরে যাওয়া তার শোভা পায়না! সমস্ত মুখমণ্ডল রাফায়াত এতটাই বিদঘুটে ভাবে কুঁচকে নিলো যে বুঝার জো ছিলনা আবারও সে সত্যিই নাটক করছে! কোঁমড়ে দু’হাত গুজে বাঁ পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো অয়ন্তী। ডান পাশের ভ্রুটি ঈষৎ উঁচিয়ে তুলল। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আবারও নাটক করছেন?”

“উফফ। সত্যিই খুব ব্য’থা পাচ্ছি।”

“তো ব্য’থা কী আমার কারণে পেয়েছেন?”

“তো কার কারণে পেয়েছি?”

“নিজের কারণে পেয়েছেন!”

“আমি আবার কী করলাম?”

“চু’ম্মা চা’টি কে করেছে? অসুস্থ শরীর নিয়ে আমার সাথে জোর-জবরদস্তি কে করেছে? শরীরে প্রেশার কে নিয়েছে?”

“বললাম তো ভুল হয়ে গেছে। এবার সত্যি সত্যিই ব্য’থা পাচ্ছি। চিনচিন করছে বুকটা। শান্ত হয়ে বসবে একটু আমার পাশে? তোমাকে দেখব!”

“আমাকে দেখলেই কী ব্য’থা সেরে যাবে?”

“কোনো সন্দেহ-ই নেই!”

“এত কনফিডেন্স?”

“পাশে বসেই দেখো না।”

“আগে আমার শর্ত মানতে হবে!”

“কী শর্ত?”

“ট্রে-তে করে যা যা নাশতা এনেছি সব খেতে হবে।”

মনে মনে যোগ-বিয়োগে লেগে পড়ল রাফায়াত! অয়ন্তীকে এখন কাছে পেতে হলে সব শর্ত তাকে মানতে হবে। ইদানিং অয়ন্তীকে ছাড়া তার কিছুই ভালো লাগেনা। সবকিছু কেমন ফিকে ফিকে লাগে। পানসে ঠেকে। এক মুহূর্তের দূরত্বও যেন সয়না। কেমন পাগল পাগল লাগে। হৃদয়ে এক গভীর শূণ্যতা কাজ করে। ক্রমশ ভালোবাসা বাড়তে বাড়তে এখন অয়ন্তীকে ছাড়া তার বেঁচে থাকাও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। একটা সময় অয়ন্তীকে কাছে পাওয়া তার কাছে নিতান্তই প্রজ্জ্বলিত দিনের আকাশে চাঁদ দেখার মত অভাবনীয় চিন্তাভাবনা ছিল। তবুও যেন সয়ে গেছিল সেই দূরত্ব। কিন্তু এখন ভাগ্যের হেরেফেরে অয়ন্তীকে কাছে পেয়ে তার মনে বড্ড লোভ চেপে বসেছে! দিনের আকাশেও যেন তার চাঁদ উঠেছে! এখন দিন রাত সব এক তার। বস্তুত ভালোবাসায় সে কাতর হয়ে উঠছে। দূরত্বে দম বন্ধ হয়ে আসছে। এক দিক থেকে ভালোবাসা যেমন মানুষকে মহান করে তোলে তেমনি অসহায়ও করে তুলে। কাউকে বাঁচতে শেখায় তো কাউকে দেবদাস বানিয়ে ছাড়ে! এসব আকাশ কুসুম ভাবনা চিন্তাভাবনা ছেড়ে গলা ঝাড়ল রাফায়াত। সরু দৃষ্টিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। বেশ তৎপর মনে হলো তাকে। চিরাচরিত স্বাভাবিক গলাতেই বলল,,

“আচ্ছা আসো। খাব।”

অল্পতেই যেন তুষ্টি খুঁজে পেল অয়ন্তী। গম্ভীর ভাবভঙ্গি ভুলে ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল। আনন্দঘন গলায় শুধালো,,

“সত্যি?”

“হ্যাঁ সত্যি আসো।”

দ্রুত পা ফেলে হেঁটে এলো অয়ন্তী। ট্রে থেকে প্রথমে দুধের গ্লাসটি হাতে তুলে নিলো। বিনাবাক্য প্রয়োগে মিটিমিটি হেসে রাফায়াতের মুখের কাছে দুধের গ্লাসটি ধরল। প্রথমে রাফায়াত নাক সিটকালেও পরে ঢকঢক করে গিলে খেল সম্পূর্ণ গ্লাস ভর্তি দুধ। খাওয়া শেষে অয়ন্তীকে টেনে পাশে বসালো সে। বিনা সময় ব্যয়ে অয়ন্তীর কোলে মাথা রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল সে। শিথিল এক জোড়া চক্ষু দ্বারা অয়ন্তীর মায়াভরা মুখশ্রীতে তাকালো। কিছুক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে সে মোহময়ী অয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে-ই রইল। এভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে তার চোখে সর্বনাশা ঘুম নেমে এলো। অথচ এখনও একই জায়গায় ঠায় বসে রইল অয়ন্তী। রাফায়াতের মাথায় অতি আদুরে হয়ে হাত বুলাতে লাগল। উদ্ভ্রান্ত রাফায়াত তার ভালোবাসায় রাতারাতি এতটা পরিবর্তন হয়ে যাবে, এতটা শান্তশিষ্ট হয়ে যাবে তা ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারেনি অয়ন্তী। উপর ওয়ালার কাছে সে বড্ড ঋণী। যাকে যেভাবে চেয়েছে তাকে সে সেভাবেই পেয়েছে। পৃথিবীর তৃতীয় কোনো শক্তি আর তাদের ভালো থাকায় নজর লাগাতে পারবেনা।

জ’খ’ম কাটিয়ে পুরোপুরি সুস্থ হতে রাফায়াতের মোটামুটি দু’সপ্তাহ সময় লেগে গেল! এই দুই সপ্তাহে সে একটিবারের জন্যও বাড়ি থেকে বের হতে পারেনি। সারাক্ষণ চার দেয়ালের মধ্যে-ই বন্দি ছিল। একটুখানি বাইরে বের হওয়ার জন্য প্রতিটা মুহূর্তে সে কেবল হাসফাঁস করেছে। চারবেলা নিয়ম করে খাবার খেতে খেতে সত্যিই তার ওজন ক্রমাগত বাড়তে শুরু করেছে! ফলমূল, দুধ, ডিম প্রতিবেলায় তাকে নিয়ম করে খেতে হয়েছে। অয়ন্তী একপ্রকার জোর খাঁটিয়েই তার খাবারের দিকটায় পূর্ণ খেয়াল রেখেছে! অয়ন্তীর মন রক্ষার্থেই রাফায়াত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গপাগপ করে সমস্ত অপছন্দের খাবারও গিলে খেয়েছে। তবে এসবের মধ্যে রাফায়াতের গাঁয়ের রঙ পূর্বের তুলনায় অনেকখানিই উজ্জ্বল হয়ে গেছে! ধবধবে ফর্সা হয়ে গেছে একদম! বাইরে বের হওয়া হয়নি বলেই হয়ত রাতারাতি তার এত পরিবর্তন। একবার তার দিকে তাকালে দ্বিতীয়বার আর চোখে ফিরাতে মন চাইবেনা। ভয় যেন বেড়ে গেল অয়ন্তীর! এত সুন্দর দেখতে উডবি তার! তার উপর লম্বাচওড়া, স্মার্ট, হ্যান্ডসাম পাড়ার মেয়েদের না আবার তার উডবির উপর নজর পড়ে যায় সে চিন্তায় অস্থির সে!

বিকেল গড়াতেই রাফায়াতের মনে হলো তার একটু সেলুনে যাওয়া উচিৎ। চুল, দাঁড়ি সব কাটতে হবে। এই দুই, তিন সপ্তাহে অনেকখানি বড়ো হয়ে গেছে তার চুল, দাঁড়ি। তার উপর সি’গা’রেট খাওয়ারও প্যারা উঠে গেছে তার! দুই সপ্তাহ অয়ন্তীর কড়া নিয়মে থেকে প্যারা ওঠা সত্ত্বেও তার সি’গা’রেট খাওয়া হয়নি আর। কে যাবে ইচ্ছে করে হিং’স্র বা’ঘিনী’র তোপের মুখে পড়তে? আজ যেহেতু অয়ন্তী তার বাড়িতে ঘুমুচ্ছে কেননা এখনি বাড়ি থেকে বের হওয়া যাক। চুল, দাঁড়িও কে’টে আসা যাক সাথে সি’গা’রেট ও গি’লে আসা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। কালো রঙের একটি টি-শার্ট পড়ে রাফায়াত সাদামাটা ভাবেই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল! গেইটের বাইরে পা রাখতেই হঠাৎ পেছন থেকে রাফায়াতের মা রাফায়াতের নাম ধরে হাঁক ছাড়লেন। কৌতূহলী হয়ে পিছনে ফিরে তাকালো রাফায়াত। অমনি হাত নাড়ালেন রাফায়াতের মা। উচ্চশব্দে বললেন,,

“কী রে কোথায় যাচ্ছিস?”

জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেই রাফায়াত প্রত্যত্তুরে বলল,,

“সেলুনে যাচ্ছি। কেন?”

“অয়ন্তীকে বলে বের হয়েছিস?”

“মানে কী মা? অয়ন্তীকে বলে কেন বের হতে হবে?”

“না। এসে যদি আবার রেগে যায় তাই বললাম।”

“রাগতে যাবে কেন হঠাৎ? সামান্য সেলুনেই তো যাচ্ছি। চুল, দাঁড়ি বড়ো হয়েছে কা’ট’তে হবে। মাঝে মাঝে তুমিও না অয়ন্তীর মত ছেলে মানুষী হয়ে যাও মা। ভেবেচিন্তে কথা বলোনা।”

“বিয়ের আগেই অয়ন্তীর আঁচলে বাঁধা পড়েছিস তুই! তাই অযথা অশান্তি যেন না হয় তাই সাবধান করছি। শুনলে শুনবি না শুনলে তোর ব্যাপার!”

বলেই বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন রাফায়াতের মা। এবার সত্যিই বিরক্ত হয়ে গেল রাফায়াত। এসব আবার কী ধরনের কথা? অয়ন্তীর আঁচলে বাঁধা পড়েছে মানে এসব কী? বাড়ি থেকে বের হতেও কী এখন অয়ন্তীর অনুমতি নিতে হবে তার? ধ্যাত! মাথাটাই গরম হয়ে গেল তার। এভাবে আর কতদিন চলা যায়? স্বাধীনতা বোধ কী হারিয়ে ফেলেছে সে? হনহনিয়ে হেঁটে রাস্তার অপর পাশে গেল রাফায়াত। প্রথমেই টং দোকান থেকে একটি সি’গা’রেট ধরালো। এতদিন পরে সি’গারেটিতে ফুঁক দিয়ে সে যেন মনেপ্রাণে শান্তি খুঁজে পেল! এই শান্তিটাই তো সে এতদিন যাবত খুঁজছে! সি’গারেটটি মুখে রেখেই রাফায়াত রাস্তার অপর পাশে অয়ন্তীর বাড়ির দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বিশেষ করে অয়ন্তীর রুমের ব্যালকনির দিকে। সম্পূর্ণ ফাঁকা ব্যালকনিটি। অয়ন্তীর অস্তিত্ব বিশেষও দেখা যাচ্ছেনা। মন মেজাজ শান্ত হয়ে গেল রাফায়াতের! ধরা পড়ার ভয় কমে গেল তার। নিশ্চিন্তে এবার এক প্যাকেট সি’গারেটও অনায়াসেই গিলে ফেলা যাবে।

ইতোমধ্যেই রাফায়াতের চোখ গেল সামনের সেলুন দোকানটির দিকে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় ঝাপসাভাবে আরিফকে দেখা যাচ্ছে! সি’গা’রেটটি কয়েক টানে শেষ করে রাফায়াত আরও এক প্যাকেট সি’গারেট হাতে নিয়ে বিল চুকিয়ে দৌঁড়ে গেল সামনের সেলুনে। এক নাগাড়ে ফোন টিপছে আরিফ। এদিক ওদিক তাকানোরও যেন সময়টি নেই তার। ক্রুর হাসল রাফায়াত। চ্যালচ্যালিয়ে হেঁটে গিয়ে আরিফের মুখোমুখি দাঁড়ালো। হুট করেই আরিফের হাত থেকে ফোনটি কেড়ে নিলো সে। ঘটনার আকস্মিকতায় ভড়কে উঠল আরিফ। অগ্রে বিস্ফোরিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই সে আশ্চর্যিত হয়ে গেল! হাসিমুখে রাফায়াত ভ্রু যুগল ঈষৎ উঁচালো। হেয়ালি গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী রে? ফোন কেড়ে নিলাম কিছু বলবি না?”

হাসতে হাসতে আরিফ বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। আবেগ আপ্লুত হয়ে সে মুহূর্তেই রাফায়াতকে জড়িয়ে ধরল! প্রফুল্লিত গলায় বলল,,

“আরে ভাই আপনি? কতদিন পরে দেখা!”

“ফোন করে তো সামান্য খবরও নেসনি। হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়াতে এত ভালোবাসা?”

“ভাই। আপনি বোধ হয় আপনার নাম্বারটা চেঞ্জ করেছিলেন তাই আপনাকে ট্রেস করতে পারিনি। তবে মাঝেমধ্যেই আপনাকে অনেক মনে পড়ত।”

“যোগাযোগ করতে চাইলে অনেক উপায়ই ছিল। আলিজার সাথে তো আর যোগাযোগ বন্ধ হয়নি! আলিজার থেকে আমার নাম্বারটা নিতে পারতিস।”

“ভুল হয়ে গেছে ভাই। এতদিন পর আপনার সাথে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগছে।”

“আমারও।”

রাফায়াতকে ছেড়ে দাঁড়ালো আরিফ। রাস্তার ঐ পাশে অয়ন্তীর বাড়ির দিকে বার কয়েক তাকাল সে। পরক্ষণেই রাফায়াতকে টিটকারি করে বলল,,

“কী ভাই? ভাবির সাথে দেখা করতে এসেছেন নাকি?”

“শুধু তাই নয়। এখন থেকে আমি এই এলাকারও বাসিন্দা!”

“মানে? বুঝলাম না ভাই।”

“রাজীব চাচার ফ্লাটে ভাড়ায় এসেছি। এখন থেকে এটাই আমার এলাকা।”

খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল আরিফ।রাফায়াতকে সে যেন আপনের চেয়েও আপন মনে করছে৷ তাই আনন্দঘন হয়ে পুনরায় সে রাফায়াতকে জড়িয়ে ধরল! উদ্বেলিত গলায় বলল,,

“কী বলছেন কী ভাই আপনি? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছেনা। এভাবে আপনাকে আবারও ফিরে পাব স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। আপনাকে বলে বুঝাতে পারবনা ভাই আমি কতটা খুশি।”

ইতোমধ্যেই একটি ফর্সা দেখতে মেয়ে তার সাথে করে একটি পিচ্চি ছেলেকে নিয়ে সেলুনে ঢুকল। ছেলেটি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেই চলছে! মেয়েটির হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। রীতিমতো আহাজারি গলায় বলছে,,

“আমি চুল কা’ট’ব না আপু প্লিজ। শারিন বলেছে, আমাকে বড়ো চুলে স্মার্ট দেখায়! হ্যান্ডসাম দেখায়।”

মেয়েটি রাগে গজগজ করে ছেলেটির দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“মাত্র তো পড়ছিস ফোরে। এখনি মেয়ে বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছিস? তার থেকে কমপ্লিমেন্টও নিচ্ছিস? তার মন রাখারও চেষ্টা করছিস? কেন রে? এই বয়সে কীসের এত পিরিতি?”

ডানে বায়ে না তাকিয়ে মেয়েটি হুট করেই জড়িয়ে থাকা অবস্থায় রাফায়াত এবং আরিফের সাথে জোরচে এক ধা’ক্কা খেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় দুজন দুদিকে ছিটকে দাঁড়ালো। তক্ষণি মেয়েটির গরম চোখ পড়ল রাফায়াত এবং আরিফের দিকে। উড়নচণ্ডী গলায় বলল,,

“কী আশ্চর্য! ছেলে মানুষের এত গ’লা’গ’লি কীসের হ্যাঁ? লেস”বি’য়ান নাকি?”

রাফায়াত এবং আরিফ রীতিমতো তাজ্জব বনে গেল। মুখে হাত চলে যাওয়ার উপক্রম হলো তাদের। পরক্ষণেই তেলে বেগুনে জ্ব’লে উঠল রাফায়াত। এই অ’প’মান তার গাঁয়ে সইলনা। টি-শার্টের কলার উঁচু করে সে তার আগের রূপে ফিরে এলো! মেয়েটির দিকে তেঁড়ে গিয়ে বলল,,

“হেই। হাউ ডেয়ার ইউ! আমরা লে’স’বিয়া’ন?”

“লে’সবি’য়ান না তো কী? পাবলিক প্লেসে চিপকা চিপকি করছিলেন! একদম খাঁটি লে’সবি’য়ানদের মত।”

রাফায়াতের মাথা যেন আরও গরম হয়ে গেল! রাগ সাংঘাতিক পর্যায়ে চলে গেল। নিবারণ করার মত নয়। মেয়েটির দিকে তেজস্ক্রিয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“মেয়ে মানুষদের মুখে মুখে এত তর্ক কেন হ্যাঁ? এত সাহস কেন? আমরা ছেলে মানুষ। পাবলিক প্লেসে যা ইচ্ছা তা করতে পারি এতে আপনার এত জ্ব’লে কেন? নিজের কাজে এসেছেন কাজ করে যান। ডানে-বায়ে তাকানোর কী দরকার?”

মেয়েটিও উড়নচণ্ডী। ঝগড়া করতে তেড়েফুঁড়ে গেল রাফায়াতের দিকে। উঁচু গলায় বলল,,

“কী বললেন আপনি? আমার এত সাহস কেন আমার এত জ্ব’লে কেন? মেয়ে মানুষ বলে আমাকে সবসময় নত হয়ে থাকতে হবে? এদিক ওদিক চোখ মেলে তাকানোও যাবেনা? পৃথিবীর কোন আইনে এটা পেয়েছেন হ্যাঁ? এক্ষণি সেই আইন আমাকে দেখাবেন।”

“এই? আপনি কী আমাদের গাঁয়ে পড়ে ঝ’গ’ড়া করতে এসেছেন? মতলবটা কী আপনার?”

দুজনের মধ্যে তুমুল বা’কবি’তন্ডা শুরু হয়ে গেল। আরিফ অনেক চেষ্টা করেও দুজনের কাউকেই থামাতে পারছেনা। কেবল নির্বোধের মত দুজনের দিকে চেয়ে আছে। সুযোগ বুঝে পিচ্চি ছেলেটিও তার বোনের হাত ছেড়ে দৌঁড়ে পালালো! পালিয়ে যাওয়ার খুশিতে সে আত্নহারা! কে আর খুঁজে পায় তাকে! ইতোমধ্যে অয়ন্তীও ঘুম থেকে উঠল৷ হামি তুলতে তুলতে সে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। অমনি তার চোখ পড়ল অদূরের সেই সেলুন দোকানটির দিকে! যেখানে রাফায়াত এবং মেয়েটির মধ্যে অবিশ্রান্ত তর্ক চলছে। নিমিষেই চোখ জোড়া চড়কগাছ হয়ে উঠল অয়ন্তীর। এসব কী দেখছে সে? রাফায়াত বাড়ি থেকে বের হয়েছে? শুধু তাই নয় উকিল সাহেবের বড়ো মেয়ের সাথে আবার ঝগড়াও করছে? সময় ব্যয় করতে চাইলনা অয়ন্তী। গলায় ওড়না প্যাঁচিয়ে সে দৌঁড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। রাস্তা পাড় হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সোজা সেলুনে চলে গেল। প্রথমে রাফায়াত অয়ন্তীকে খেয়াল না করলেও খানিক বাদে অয়ন্তীর অস্তিত্ব বিশেষ সে টের পেয়েছে। তাও আবার আরিফের খোঁচাখুঁচিতে! কনুই দ্বারা আরিফ রাফায়াতকে খোঁচা মেরে বলল,,

“ভাই দেখুন। ভাবি এসেছে! দেখে মনে হচ্ছে আজ আপনাকে গি’লে খাবে!”

তাৎক্ষণিক রাফায়াত তর্ক থামালো। উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি মেলে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। চোখ থেকে যেন অয়ন্তীর আ’গু’ন ঝড়ছে! সেই আ’গু’নে জ্বা’লিয়ে পু’ড়ি’য়ে খাঁক করে দিচ্ছে রাফায়াতকে! ভয়ে শুকনো ঢোক গিললেও রাফায়াত তটস্থ গলায় আবিফকে লক্ষ্য করে বলল,,

“এই? তোর ভাবিকে সালাম দিয়েছিস?”

সঙ্গে সঙ্গেই ডান হাত তুলে আরিফ বেশ নম্রতার স্বরে অয়ন্তীকে সালাম দিলো। বিপরীতে সালাম নিয়ে ফোঁস করে তেজী শ্বাস ফেলল অয়ন্তী। তর্ক করতে থাকা মেয়েটি তখনও তর্কে বহাল রইল। তীক্ষ্ণ গলায় ভাষণ দিয়ে বলল,,

“আপনাদের মত ছেলেদের জন্যই রাস্তাঘাটে মেয়েরা আজ লাঞ্চিত। চলাফেরার স্বাধীনতা নেই তাদের। মেয়েরা ভীতু বলে তাদের বেশী করে চেপে ধরেন। তবে মিস্টার শুনুন? পৃথিবীর সব মেয়েরা ভীতু হলেও উকিল এরশাদ মিয়াজীর মেয়ে কিন্তু ভীতু নয়! কে’টে রেখে দিব ঠিক।”

বিরক্ত হয়ে উঠল রাফায়াত। এমনিতেই ক্ষিপ্ত অয়ন্তীর ভয়ে সে নাজেহাল। তার উপর ঐ মেয়ের এক্সট্রা বকবকানি। অধৈর্য হয়ে রাফায়াত মেয়েটির কাছে হাত জোর করে বলল,,

“আরে বইন থাম প্লিজ! আমার বৌ আইছে। হাতে ধরে আর কে’ই’স খাওয়াইস না আমারে!”

তাজ্জব বনে গেল মেয়েটি। পিছু ঘুরে অয়ন্তীকে ভালো ভাবে না দেখেই সে বিস্মিত গলায় বলল,

“এই লে’স’বিয়া’নের আবার বউও আছে?”

ঘেটে ‘ঘ’ হয়ে গেল অয়ন্তী। মেয়েটির দিকে সূচালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। রীতিমতো সন্দিহান হয়ে উঠল। খরখরে গলায় বলল,,

“লে’সবি’য়ান মানে? এসব আপনি কী বলছেন ইতি আপু?”

ইতি মেয়েটি এবার অয়ন্তীর দিকে বিস্মিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অয়ন্তীকে চিনে ফেলা মাত্রই সে দ্রুত গলায় শুধালো,,

“এই অয়ন্তী? এই লে”সবিয়া’নটার বৌ তুই?”

“এসব তুমি কী বলছ ইতি আপু? আমার বর লেসবিয়ান হতে যাবে কেন? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?”

রাফায়াত পারছেনা ইতি মেয়েটির মাথা ফাটিয়ে দিতে! প্রচণ্ড রকম ক্ষেপে গেছে সে। মুখশ্রী তার রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। ঘাড়ের রগ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তবে ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারছেনা। এরমধ্যৈঈ ইতি মেয়েটির কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অয়ন্তী এবার রাফায়াতের দিকে তেড়ে গেল। তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আপনি এখানে কী করছেন হ্যাঁ? কাজ কী এখানে আপনার?”

শুকনো ঢোক গিলল রাফায়াত। অয়ন্তীর বিক্ষিপ্ত চোখের দিকে সে ভীতু দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কাঠ কাঠ গলায় বলল,,

“আরে আমি তো আসছি চুল কা’টতে। এই মেয়েটা জেচে এসেই আমার সাথে ঝগড়া করতে করছে।”

কথাগুলো অনর্গল বলেই সে পাশ ফিরে আরিফের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ভয়ে জর্জরিত গলায় বলল,,

“এই? বুঝা তোর ভাবিকে!”

#চলবে…?

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৪২
#নিশাত_জাহান_নিশি

“এই? বুঝা তোর ভাবিকে!”

জায়গা থেকে ঈষৎ নড়েচড়ে দাঁড়ালো আরিফ। টগর মগর দৃষ্টি ফেলে সে কিছুক্ষণ রাফায়াতের দিকে তাকালো তো কিছুক্ষণ অয়ন্তীর দিকে। গলা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে এক পর্যায়ে তার শুকনো কাশি ওঠে গেল৷ কোথায় এনে ফাঁসিয়ে দিলো রাফায়াত তাকে? আরিফের এহেন অস্বাভাবিক কার্যকলাপ দেখে বিরক্তবোধ করল রাফায়াত। দাঁতে দাঁত চাপল সে। ঝাঁঝালো গলায় পুনরায় বলল,,

“কী রে বল?”

শুকনো ঢোঁক গিলে আরিফ এবার অসহায়ের মত অয়ন্তীর দিকে তাকালো। অপারগ হয়ে অনর্গল গলায় বলল,,

“ভাবি বিশ্বাস করুন। ভাইয়ের এখানে কোনো ফল্ট-ই ছিলনা। অনেকদিন পর ভাইয়ের সাথে আমার দেখা। তাই অতিরিক্ত আবেগ আপ্লুত হয়ে আমিই প্রথমে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। তখনই ইতি আপু আসে সেলুনে। আমাদের ঐ অবস্থায় দেখে ফেলে৷ তারপর থেকে মুখ দিয়ে যা আসছে তাই কন্টিনিউয়াসলি তাই বলে চলছে। তাই বাধ্য হয়ে রাফায়াত ভাইয়াও মাঝেমধ্যে দু’একটা কথা শুনিয়ে দিয়েছে আপুকে। দেট’স ইট। ভাইয়াকে অযথা ভুল বুঝবেননা ভাবি প্লিজ।”

স্বস্তি ফিরে পেল রাফায়াত। অয়ন্তীর দিকে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। নাক টেনে মিনমিনে গলায় বলল,,

“আরিফ যা বলেছে সব সত্যি বৌ। প্লিজ ট্রাস্ট মি। আমি ইচ্ছে করে মেয়েটির সাথে কথা বাড়াইনি। ইনফেক্ট মেয়েটিকে তো আমি চিনিও না। লাইফে ফার্স্ট টাইম দেখলাম। সো অযথা তর্কে জড়াতে যাব কেন বলো?”

রাফায়াতের থেকে রাগী দৃষ্টি সরিয়ে অয়ন্তী এবার ইতি মেয়েটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ভ্রু যুগল কুঁচকে শ্লেষাত্নক গলায় বলল,,

“কী ব্যাপার আপু? তুমি অকারণে ছেলেদের গাঁয়ের উপর পড়ে ঝ’গ’ড়া করো এই ব্যাপারটা তো আমার আগে জানা ছিলনা!”

পূর্বের তুলনায় খানিক হকচকিয়ে উঠল ইতি। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। সাহসী এবং ডানপিটে মনোভাব পাল্টে সে শান্তশিষ্ট হয়ে উঠল। অনৈতিক কিছু করে ফেলার অস্থিরতা কাজ করতে লাগল তার স্বীয় মুখমণ্ডলে। অধীর গলায় সে অয়ন্তীকে বলল,,

“আর বলিসনা অয়ন্তী। ঐ মুহূর্তে আমার মাথা গরম ছিল। তাই সামনে যাকে পেয়েছি তার সাথেই রুড বিহেভ করেছি! এরমধ্যে এই ছেলেটিও পড়েছে। যা হয়েছে ভুলে যা ওকে? মাঝেমধ্যে হয়ে যায়। সো চিল ওকে?”

“ছেলেটি আমার উডবি আপু। তাই বলব তুমি তার সাথে যা করেছ, একদমই ঠিক করোনি। আমার মাইন্ডে লেগেছে বিষয়টা! সরি সে টু সে আপু, আমি বিষয়টা ভুলতে পারছিনা!”

“সিরিয়াসলি অয়ন্তী? ছেলেটি সত্যিই তোর উডবি?”

অয়ন্তী তার হাতে থাকা এনগেজমেন্ট রিংটি উঁচু করে ইতির মুখের সামনে ধরল। আংটিকে দেখিয়ে নির্বিঘ্নে বলল,,

“এই যে দেখো আপু। আমার এনগেজমেন্ট রিং। এবার বিশ্বাস হলো?”

অয়ন্তীর থেকে মুখ ফিরিয়ে ইতি এবার সূক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলল রাফায়াতের দিকে। উপর নিচ পর্যন্ত রাফায়াতকে যতটা সম্ভব সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। বিষয়টায় বিব্রতবোধ করল রাফায়াত। শাণিত দৃষ্টি ফেলল সে ইতির দিকে। রাফায়াতের দিকে তাকানো থাকা অবস্থাতেই ইতি সিক্ত গলায় অয়ন্তীকে লক্ষ্য করে বলল,,

“বাই দ্যা ওয়ে অয়ন্তী। তোর চয়েজ কিন্তু ভালো!”

মুহূর্তেই রাফায়াতের থেকে চোখ সরিয়ে নিলো ইতি। ফিকে হেসে অয়ন্তীকে বলল,,

“ওকে বাই অয়ন্তী৷ সময় পেলে তোর উডবিকে নিয়ে আমাদের বাসা থেকে ঘুরে আসিস ওকে?”

জোরপূর্বক হেসে অয়ন্তী হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। ইতির চাহনি, ভাবভঙ্গি, হঠাৎ পাল্টে যাওয়ার মনোভাব স্বাভাবিক লাগল না অয়ন্তীর! সন্দেহজনক মনে হলো। হুট করেই রাফায়াত রাগে গিজগিজিয়ে উঠল। ইতির যাওয়ার পথে তাকিয়ে সে রাগী গলায় অয়ন্তীকে বলল,,

“মেয়েটাকে তুমি এভাবে যেতে দিলে অয়ন্তী? দোষ করল অথচ সরি বলল না?”

ইতোমধ্যেই অয়ন্তী, রাফায়াত এবং আরিফকে একদফা অবাক করে দিয়ে ইতি হঠাৎ পেছন থেকে রাফায়াতকে লক্ষ্য করে মৃদু হেসে বলল,,

“সরি মিস্টার রাফায়াত! প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।”

হাসতে হাসতেই জায়গা পরিত্যাগ করল ইতি। অয়ন্তীর সন্দেহ এবার গাঢ় থেকে গভীর হতে লাগল। কোঁমড়ে হাত গুজে সে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ইগু সেটিজফাইড হওয়া রাফায়াতের দিকে। তটস্থ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আপনি কি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন?”

“চুল, দাঁড়ি কা’ট’ব না?”

“আহামরি বড়ো তো হয়ে যায়নি চুল, দাঁড়ি। আজই যে কা’ট’তে হবে এমন না।”

“এসব কোন ধরনের কথা অয়ন্তী? তুমি আর কতদিন আমাকে এভাবে চার দেয়ালের মাঝে আটকে রাখবে বলো? আমিও তো মানুষ তাইনা? আমারও দম বন্ধ লাগে।”

“তিক্ত হয়ে উঠছেন, না? বিরক্তি করে ফেলছি এই কয়েকদিনে?”

“আমি এটা বুঝাতে চাইনি অয়ন্তী। সহজ বিষয়টা আমি তোমাকে সহজভাবেই বুঝানোর চেষ্টা করছি। আমাকে নিয়ে এত ভ’য় পাওয়ার তো কিছু নেই অয়ন্তী৷ আমি এখন যেমন আছি মৃ’ত্যুর আগ অবধিও ঠিক তেমনই থাকব। তুমি অযথা আমাকে নিয়ে এত এত টেনশন করো অয়ন্তী। এত ভ’য়ে ভ’য়ে থাকো।”

“ওকে। তাহলে চুল, দাঁড়ি কেটেই আসুন।”

গম্ভীর ভাব নিয়ে অয়ন্তী পিছু ঘুরল। রাস্তা পাড় হয়ে সোজা তার বাড়ি চলে এলো। বেড রুমের দরোজা আটকে সে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে দূর থেকে মিহিভাবে রাফায়াতকে দেখতে লাগল! অহেতুক অভিমান নিয়ে ভরাট গলায় বলল,,

“আমি জানি, আমি আপনার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছি রাদিফ। কিন্তু কী করব বলুন? আপনাকে নিয়ে আমার ভ’য় হয়! সাং’ঘা’তিক রকম ভ’য় হয়। দম বন্ধ হয়ে আসার মত ভ’য় হয়। কখনো কখনো তো মনে হয় এই বুঝি আমি আপনাকে হারিয়ে ফেললাম! চোখের আড়াল হলেই সেই ভয় আরও দ্বিগুন হয়। কোনো মূল্যেই আমি আপনাকে হারাতে চাইনা রাদিফ। আমার দেহের প্রতিটি শিরায় শিরায় আপনি বইছেন। কোনোভাবে আপনি থেমে যাওয়া মানেই হলো আমার নিঃশ্বাস ও থেমে যাওয়া। কীভাবে আপনাকে বুঝাই আমার ভেতরের এই হাহাকার?”

বিমর্ষ হয়ে রাফায়াত সেলুনে চুল কা’ট’তে বসল। অয়ন্তীর অহেতুক রাগ, অভিমান, ভ’য় তাকে আরও দুর্বল করে তুলছে। এতটা ভ’য় কেউ পায়? যে ভয়ের আদোতে কোনো মানেই হয়না! কেন অয়ন্তী ভয় ভুলে স্বাভাবিক হচ্ছেনা? কেন সে সন্দেহ করা ছাড়তে পারছেনা?”

ঘণ্টা খানিক পর চুল, দাঁড়ি কা’টা শেষ হলো রাফায়াতের। তখন চারিদিকে মাগরিবের আযান ও পড়ে গেল। আরিফের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে রাফায়াত ভাবল অয়ন্তীদের বাসায় যাবে। রাগ ভাঙাবে অয়ন্তীর। আজ রাতের ডিনারটা না হয় তারা বাইরে থেকেই করবে। একটু ঘুরলে ঘারলে হয়ত অয়ন্তীর উদাস মনটা ভালো হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। দুটি ডেইরি মিল্ক চকলেট হাতে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে রাফায়াত অয়ন্তীদের বাসায় গেল। সদর দরোজা খুলে দিলেন অয়ন্তীর মা। হবু মেয়ে জামাইকে দেখে তিনি তৎক্ষনাৎ খুশি হয়ে গেলেন। কৌশল বিনিময় করে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন চা-নাশতার জোগাড়ে।

ড্রয়িংরুমের সোফায় ভেজা চুল মেলে উদাস চিত্তে বসে আছে অয়ন্তী! হাতে তার ধোঁয়া উঠা চায়ের মগ। চায়ের মগে ঘন ঘন চুমুক দিচ্ছে আর টিভি ছেড়ে ডিয়ার কমরেড মুভিটি দেখছে! রাফায়াতকে দেখে সে বিন্দুমাত্রও খুশি হলোনা! বরং একবারের জন্য শুধু রাফায়াতের দিকে তাকিয়ে আবার সেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। কোনো অনুভূতি-ই যেন তার মধ্যে কাজ করছেনা! রাফায়াতকে চিনেও না এমন একটা ভান ধরল। বিষয়টায় বেশ অবাক হলো রাফায়াত। বুঝতে বেশী বেগে পেতে হলোনা অয়ন্তী ভীষণ রাগ করেছে তার উপর। গলা ঝাঁকিয়ে অয়ন্তীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল রাফায়াত। কাজের কাজ কিছুই হলোনা! কিছুতেই যেন অয়ন্তীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেলনা। অতঃপর ভীরু পা ফেলে রাফায়াত অয়ন্তীর পাশে বসতেই অয়ন্তী নিমিষেই জায়গা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো! টিভি বন্ধ করে সে দ্রুত পায়ে হেঁটে সোজা তার রুমে চলে গেল। ফিক করে হেসে দিলো রাফায়াত! সে জানত ঠিক এমনটিই হবে। অয়ন্তীর রাগ ভাঙানো চাট্টিখানি কথা নয়। ভা’ঙবে তবু মচকাবে না। যাক ভালোই হলো! অয়ন্তীর রাগ ভাঙাতে ড্রয়িংরুমে যা করতে পারবেনা সে, তা বেডরুমে অনায়াসেই করতে পারবে!

রুমের দরজাটা অয়ন্তী ভেতর থেকে আটকানোর পূর্বেই রাফায়াত দরজায় এসে হা’ম’লা দিলো। রাফায়াতের অসীম শক্তির সাথে না পেরে অয়ন্তী হার মেনে নিলো! দরোজা থেকে সেরে এসে সে বিছানার উপর বদরাগী ভাব নিয়ে বসল। ভেতর থেকে দরোজাটা আটকে রাফায়াত চুপটি করে অয়ন্তীর পাশে এসে বসল। পাশ ফিরে কিছুক্ষণ অয়ন্তীর রাগে, অভিমানে মাখা বিবর্ণ মুখশ্রীতে তাকালো। অতঃপর অয়ন্তীর ভেজা চুলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী ব্যাপার? এই সময়ে শাওয়ার?”

“একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনি জিজ্ঞেস করার কে?”

“কে আবার? তোমার জামাই।”

“এখনো হননি।”

“এত রা’গ?”

“আমি যার তার সাথে রাগ করিনা।”

“আমি যা তা?”

“হুম।”

“আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো!”

“কেন এসেছেন আগে সেটা বলুন?”

“বৌয়ের কাছে এসেছি। আবার কেন?”

“আমি আপনার বৌ না!”

“তো কী?”

“জানিনা।”

“কেন জানো না?”

নিরুত্তর অয়ন্তী। মাখো মাখো অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে। এক হাতে বিছানার চাঁদর খাঁমচাতে লাগল। ঝট করে রাফায়াত পেছন থেকে অয়ন্তীকে জড়িয়ে ধরল! আদুরে গলায় বলল,,

“কী হইছে হ্যাঁ? এত রাগ কীসের?’

নিশ্চুপ অয়ন্তী। নড়াচড়া বন্ধ করে কেবল শান্ত হয়ে বসে রইল। অয়ন্তীর এই মৌনতা যেন রাফায়াতকে আরও ভ’য়ের মুখে ফেলে দিলো। দিশা খুঁজে না পেয়ে সে অয়ন্তীর ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো। নাক ঘঁষে আদুরে শুধালো,,

“বলো না কী করেছি আমি? কীসের এত রাগ?”

“ইতি আপু আপনার দিকে কীভাবে তাকিয়েছিল দেখেছেন?”

“এটা তো তোমার ইতি আপুর প্রবলেম। আমি তাকালে আমার প্রবলেম ছিল।”

“তাকাতে কতক্ষণ আপনার? ইতি আপু তো আমার চেয়েও অনেক বেশী সুন্দরি! যদি আপনার নজর আমার থেকে ইতি আপুর দিকে চলে যায়, তো?”

সঙ্গে সঙ্গেই অয়ন্তীকে ছেড়ে দাঁড়ালো রাফায়াত! রাগে টইটম্বুর সে। শিরা, উপশিরায় অদম্য জেদ বইতে লাগল। মনে হলো অয়ন্তী এবার তার সাথে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছে! যা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। জায়গা ছেড়ে দরোজার সামনে পা বাড়াল রাফায়াত। আর খিটখিটে মেজাজে বলল,,

“বায়।”

“কেন? ইতি আপুর কাছে যাবেন?”

মুহূর্তেই অয়ন্তীর দিকে তেরেমেরে এলো রাফায়াত। চোখ জোড়া অসম্ভব রকম লাল করে ধমকের স্বরে অয়ন্তীকে বলল,,

“এবার কিন্তু চ’ড় খাবা তুমি! মাথা মুথা একদম গরম করবে না আমার। এতে যেমন তোমার মঙ্গল, তেমনি আমারও। কু’কু’রের লেজ কিন্তু সোজা হয়না অয়ন্তী! আমাকে আর বাঁকা হতে বাধ্য করো না!”

হু হু করে কেঁদে দিলো অয়ন্তী। ভরাট দৃষ্টিতে রাফায়াতের রাগান্বিত মুখমণ্ডলে তাকালো সে। রাফায়াতকে আপোষে আনার জন্য রুক্ষ গলায় বলল,,

“হু’ম’কি দিচ্ছেন আমাকে না? রুড বিহেভ করছেন আমার সাথে? আবারও মেজাজ দেখাচ্ছেন? ছেড়ে যাবেন আমাকে তাই তো? আমি আপনাকে নিয়ে অতিরিক্ত ভাবী বলে আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন?”

“আশ্চর্য! আমি আবার এসব কখন বললাম?”

“বলা লাগেনা। ইশারাই যথেষ্ট!”

“তুমি একটু থামবা প্লিজ? মুডটাই নষ্ট করে দিলো! থাকো তুমি তোমার রাগ নিয়ে, সন্দেহ নিয়ে। আমি সত্যিই গেলাম।”

রাফায়াতকে আটকালো না অয়ন্তী! ক্ষোভ নিয়েই যেতে দিলো তাকে। একা ঘরে আবারও ফ্যাস ফ্যাস করে কেঁদে উঠল অয়ন্তী। বিছানায় কপাল ঠুকে বলল,,

“বুঝতেছিনা কী হচ্ছে এসব! এমন করছি কেন আমি? কী হয়েছে আমার? কেন অযথা আমি রাদিফকে নিয়ে ভ’য় পাচ্ছি? কেন এত সন্দেহ করছি? কেন তার সাথে রুড বিহেভ করেছি? কেন তাকে আটকাতে পারিনি?”

_______________________________

রাত তখন বারোটা প্রায়। পরিবেশ ক্রমাগত নিস্তব্ধ হয়ে উঠছে। রাত যেন তার নিজস্বতা ফিরে পাচ্ছে। চাঁদ, তাঁরার দেখা মিলছে আকাশে। নিকষ কালো অন্ধকার কেটে জোছনা নেমেছে আকাশ জুড়ে। সব মিলিয়ে মায়াবী এক রাত। অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও রাতের খাবার না খেয়েই রাফায়াত শুয়ে পড়েছে। মন ভালো নেই তার। অসম্ভব রকমের মন খারাপ। অয়ন্তীর বাসা থেকে ফিরে এসেই সে প্রথমে লম্বা এক শাওয়ার নিয়েছে। অতঃপর চাকরীর বই নিয়ে পড়ার টেবিলে পড়তে বসে গেছে। বারোটা বাজতেই পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠেছে। ব্যালকনি থেকে রাতের আকাশে তাকাতেই রাফায়াতের মন পূর্বের তুলনায় আরও অধিক খারাপ হয়ে উঠল। এই মায়াবী জোছনা ভরা রাতে অয়ন্তীকে কাছে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা চেপে বসল। হৃদয়ে বেড়ে ওঠা সুপ্ত অভিমানে বেহায়া মনকে সে সন্তপর্ণে সামলে নিলো! আকাশ সমান বিমর্ষতা নিয়ে ব্যালকনি ত্যাগ করল। কাঁথা টেনে বিছানার উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল সে। ভুলবশত দরোজার ছিটকিনি লাগানো হয়নি। দরোজা খোলা রেখেই ঘুমানোর চেষ্টা করল সে। অস্থিরতা নিয়ে বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে লাগল। এভাবে মিনিট কয়েক অতিবাহিত হয়ে গেল। অলক্ষুণে ঘুম যেন কিছুতেই তার চোখে ধরা দিলোনা। ব্যাপারটায় বেশ বিরক্ত বোধ করল রাফায়াত। উদোম শরীরে উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। বালিশটা মাথার উপর চেপে ধরল। এই করতে করতে তার প্রচণ্ড মাথাব্যথাও শুরু হয়ে গেল!

ইতোমধ্যেই তার মনে হলো পিঠের উপর টগবগে গরম জাতীয় কিছু পড়ল! মানুষের দেহ বলে মনে হলো। তৎক্ষনাৎ রাফায়াত বিস্ফোরিত দৃষ্টি ফেলল তার পিঠের দিকে। অমনি ভড়কে উঠল সে। অয়ন্তীর আবার জ্বর হলো কখন? জ্বরে তো তার সমস্ত শরীর জ্ব’লে পু’ড়ে যাচ্ছে। উদ্বিগ্ন হয়ে রাফায়াত অয়ন্তীকে তার পিঠের উপর থেকে উঠালো। ঘুরিয়ে সোজা করে শোয়ালো তার পাশে। অতিরিক্ত জ্বরের প্রভাবে অয়ন্তীর সমস্ত শরীর নেতিয়ে পড়েছে। চোখ মেলে তাকানোরও শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই। চোখ বুজেই সে মিনমিনে গলায় রাফায়াতকে বলল,,

“আমাকে ক্ষমা করে দিন রাদিফ। আ’ম সো সরি। আই ডোন্ট নো আমার কী হয়েছে! কেন আমি অবিবেচকের মত আচরণ করছি। কেন আমি এত অশান্ত। কেন এতটা ভীরু আপনাকে নিয়ে। কেন অহেতুক সন্দেহ করছি আপনাকে।”

চক্ষুজোড়া আতঙ্ক নিয়ে রাফায়াত অয়ন্তীকে তার বুকের মাঝে চেপে ধরল। অনুশোচনায় জর্জরিত হয়ে উঠল সে। ভরাট গলায় বলল,,

“তুমি কেন সরি বলছ পরাণ? সরি তো আমার বলার কথা। আমার ঐসময় বুঝার উচিৎ ছিল তুমি আমাকে নিয়ে টু মাচ পসেসিভ। উটকো রাগ দেখালাম আমি। এখন এসব বাদ দাও প্লিজ। আগে বলো তোমার এত জ্বর হলো কখন?”

#চলবে…?