এক চিলতে প্রেম পর্ব-০১

0
2

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_১
#লেখা_আইজা_আহমেদ
[ সতর্কতা – কপি করা নিষিদ্ধ 🚫]

দশ বছরের একটা ছোট্ট মেয়ের সাথে বিয়ে হবে। খালি গায়ে বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে ছিল আরশান। চিন্তার ঘোর কাটিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসে, পাশে রাখা মেরুন রঙের শার্টটা গায়ে চাপিয়ে রুম থেকে বের হয়। রুমের দরজা খুলতেই সামনে এসে দাঁড়ায় সাঁঝ। চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক।

“আরশান ভাইয়া আমি বউ হবো।”

ছোট্ট এই মেয়েটি, যে এখনো জীবনের অর্থই বুঝে না সে এমন কথা বলছে? অবুঝ সাঁঝের কথা শুনে আরশান বলে,

“এত টুকু বাচ্চা মেয়ে তুই আমার বউ হবি? আমাকে চিনিস? এই শেরহাম আরশান কে চিনিস?”

আরশানের কথা শুনে ছোট্ট মুখে রাগ এনে বলল,

“হ্যাঁ চিনি তো, আরশোলা। তুই একটা বিরক্তিকর আরশোলা। আমাকে শুধু বকিস, ভয় দেখাস।”

ছোট্ট দুজোড়া স্যান্ডেলের টুংটাং শব্দে পেছন ঘুরে দৌড় দিল ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। ছোট্ট পায়ের ছুটে চলা ধুপধাপ শব্দ উঠছিল টাইলসের ওপর। বাতাসে দুলছিল তার বিনুনির লাল ফিতা। সে দৌড়ে যেতে যেতে খিলখিল করে হেসে উঠল।

পাল্টা আঘাতে ছুরির মতো চেরা শব্দগুলো শুনে আরশান থ হয়ে যায়। খালি গলায় আচ্ছন্ন কাঁচের মতো শব্দ ভেদ করে ধাতব কংকনে তার বুকের ভেতর ধাক্কা দেয়। এই টুকু একটা মেয়ে, তাকে তুই বলেছে? তার এত সুন্দর নামটাকে আরশোলা বলেছে? এভাবে বলতে পারলো? মুহূর্তেই মুখটা লাল হয়ে যায় রাগে, নাক ফুলে উঠে। নীরবতা ভেঙে আরশান বজ্রকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল,

“আবার আমার সামনে আসিস। চর মেরে তোর দাঁত ফেলে দেব বেয়াদব।”

কথাগুলোর রেশ ঘরজুড়ে বিদ্যুতের মতো ছুটল, তবে কাচের জানালার ওপারে তখন গোধূলির তামাল রঙা আকাশ। গোলাপি-সোনালি আলোতে আরশানকে বন্দি করে রেখেছে তার নিজের অক্ষম ক্রোধ। একপলক স্তব্ধ। হাতদুটো রাগে মুষ্টিবদ্ধ। তার দামী সুইস ঘড়িতে তখন খচখচ শব্দ তুলছে।

আরশান আর দাঁড়ালো না বেরিয়ে যায় । রাগে গা কাঁপছে তার। রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নিচে নেমে আসে। চোখে মুখে তীব্র বিরক্তি। এই বিয়ে সে করবে না। পরিস্থিতির চাপে এত বড় সিদ্ধান্ত নেবে না । সিঁড়ি ধাপের শব্দ আসা পদক্ষেপের সঙ্গে তার মনে জমে থাকা ক্ষোভটাও তাল মিলিয়ে কাঁপছিল।

নিচে ড্রয়িংরুমে এসে আরশান থেমে দাঁড়ায়। চোখ পরে সামনে সোফায় বসা থাকা সাঁঝের দিকে। সে গোল হয়ে বসে আছে। মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। আরশান কটমট করে তাকায় সাঁঝের দিকে। যেনো কাছে পেলেই খেয়ে ফেলবে। আরশান কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কুঁকড়ে গেল সাঁঝ । সেই চোখে অব্যক্ত আগুন টের পায়। দুই কাঁধ জমে বরফ হয়ে আসে, চোখ পিটপিটিয়ে তাকিয়েও সাহস করে আরশানের মুখোমুখি হতে পারে না। একটু আগে যে সে আরশান কে আরশোলা বলেছে। এই ভয়ে এক লাফে উঠে অন্য রুমে ছুটে যায় সাঁঝ।
আরশান সে স্রোতে ভেসে না গিয়ে সোজা চলে যায় তার মা মৌসুমী বেগমের রুমের দিকে। ভিতরে ঢুকেই আরশান বলে উঠল,

“মম, এসব বন্ধ করো প্লিজ। আমি হাঁটুর বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারব না।”

মৌসুমী বেগম তখন ধীর ভঙ্গিতে গহনা গুছিয়ে রাখা বাক্সটা বন্ধ করে ছেলের দিকে তাকালেন,

“এখন আমি কিছু শুনতে চাই না, আরশান। সবকিছু রেডি কালকেই তোদের বিয়ে। কয়েক দিন পরই কানাডা চলে যাচ্ছ, কবে আবার ফিরবি, কী ঠিক। এর মধ্যে সাঁঝ বড় হয়ে যাবে। তখন আর এইটুকু মেয়ে বলতে পারবে না।”

“সাঁঝ এখনো স্কুলে পড়ে। সামনে ওর ভবিষ্যৎ পরে আছে। এমনটা না করলে হয় না।”

মৌসুমী বেগম ঘাড় শক্ত করে দাঁড়ালেন।
“একটু কী ভেবেছিস, তোর মামার বাড়ির অবস্থা? সাঁঝের তো আপন বলতে কেউ নেই। তখন থেকেই মেয়েটা এক ছায়ার মতো বেঁচে আছে। ওকে ওরা কিভাবে রাখে, জানিস তুই? এই বাড়ি, এই ছাদ, এই পরিবার এটাই ওর জন্য নিরাপদ। যদি আমরা ওকে নিজের ঘরে না রাখি, তাহলে কে রাখবে?”

“আমি পারবো না।”

“জেদ করিস না, আরশান। তোর বাবা ও…”

“ভুলেও ওই লোকটার কথা মুখে আনবে না। যে নিজের সন্তান আর স্ত্রীকে রেখে চলে যায়, তার কোনো কথাই আমার জীবনে জায়গা পাবে না। তার মতো আমি হতে চাই না। আর আমি সাঁঝের সঙ্গে এই অসম বয়সের, অসম সম্পর্ক করতে পারব না।”

“তুই যেটা অসম সম্পর্ক ভাবছিস, সেটা আমি সাঁঝের রক্ষা বলেই দেখছি। তুই না থাকলে, ওর কোনো ভরসা থাকবে না এই দুনিয়ায়। কেউ ওকে নিজের বলে দাবি করবে না।”

“আমি এমন কিছু করতে চাই না, যার জন্য পরে সারা জীবন অনুশোচনা করতে হয়।”

মৌসুমী বেগম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
“সময় খুব বেশি নেই, আরশান। অনেক কিছু সময়ের হাতে থাকে না। কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয় হৃদয় দিয়ে, যুক্তি দিয়ে নয়।”

“আমি পারবো না বিয়ে করতে। অন্য ব্যবস্থা করো।”

আরশান আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না, গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল ঘর থেকে । মৌসুমী বেগম স্থির দৃষ্টিতে ছেলের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটা ওখানে ভালো নেই। ভাইজির এমন করুণ দশা দেখবেন কী করে? তিনি সাঁঝকে আর ওই বাড়িতে পাঠাবেন না। এই ঘরই হবে তার ঘর। আর আরশান স্কলারশিপ পেয়েছে কয়দিন পরই চলে যাবে কানাডায়। তার আগে তিনি চান, আরশান আর সাঁঝের বিয়ে হোক। একমাত্র এই পথেই সাঁঝকে স্থায়ীভাবে এই বাড়িতে রাখা যাবে। একবার যদি বিয়ে হয়ে যায় তাহলে আর ও বাড়ি থেকে কেউ সাঁঝ কে নিতে পারবে না।

————–

বাইরে সন্ধ্যার নরম আলো ধীরে ধীরে গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। ড্রইংরুমে টিভির পর্দায় চলছে টম এন্ড জেরির ক্লাসিক এক এপিসোড। সাদা-ধূসর রঙের সোফায় পাশাপাশি বসে আছে সাঁঝ আর অর্ণব। অর্ণব, গম্ভীর মুখে কার্টুন দেখছে, যেনো টিভির স্ক্রিনটা ভেতর দিয়ে সে ঢুকে পড়বে। এতটাই মনোযোগ! দু’জনেই কার্টুনে ডুবে, হেঁসে উঠছে, আবার মুখ গম্ভীর করে পরবর্তী কাণ্ড দেখছে।
ওদিকে রান্নাঘর থেকে ডাইনিং টেবিলের দিকে হাঁটছেন মৌসুমী বেগম, হাতে গরম গরম খাবার।

“সাঁঝ, অর্ণব! খেতে আয়।”

কিন্তু কারো কোন সাড়া নেই। টিভির শব্দ আর টম আর জেরির দৌড়ঝাঁপে ওদের মন জুড়ে আছে শুধু স্ক্রিনে। মৌসুমী বেগম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়েন। আরশান বিরক্ত চোখে একবার টিভির দিকে তাকায়। তারপর পেছনে গিয়ে হঠাৎ দু’জনের মাথায় দুম করে টুকা মারে।

“কি রে তোরা খাবি না?”

সাঁঝ মাথা চেপে ধরে তাকালো পেছনে। অর্ণবও মুখ ভার করে বলল, “এইভাবে কেউ মারতে আসে নাকি?”

আরশান এবার টিভির রিমোট তুলে নিয়ে একটানে বন্ধ করে দিল।

“দেখা শেষ, এখন চল টেবিলে। দেরি করলে দু’জনেই মার খাবি।”

টিভি বন্ধ হতে না হতেই সাঁঝ আর অর্ণব ভয় পেয়ে গেল। দু’জনেই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল ডাইনিং টেবিলের দিকে। নাহলে যে মার খাবে। কিন্তু সেখানে গিয়েই নতুন কাণ্ড শুরু। সাঁঝ টেবিলের এক কোণার চেয়ারে বসতে যাবে, এমন সময় অর্ণব হঠাৎ চেয়ারটা টেনে নিয়ে বলল,

“এই চেয়ারে আমি বসবো। এটা আমার চেয়ার।”

সাঁঝ চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“না! এই চেয়ার আমার। আমি প্রতিদিন এখানে বসি।”

“আজ আমি বসব। তুই অন্য জায়গায় যা।” অর্ণব হুমকি দিয়ে বলল।

এই নিয়ে শুরু হয় টেবিলের পাশে চেয়ারে টানাহেঁচড়া। চেয়ারের শব্দ, হাতের ধাক্কাধাক্কি, দু’জনের ঝগড়ার আওয়াজে রাগে ফেটে পড়ে আরশান। সে সোজা এগিয়ে এসে, একটাও কথা না বলে চেয়ারে বসে পড়ে।

“দু’জনেই চুপ। এই চেয়ারে আমি বসবো।”

আরশান বসে পড়লে আর কোনো ঝামেলা চলবে না। অগত্যা সাঁঝ মুখ ফুলিয়ে পাশের চেয়ারে বসে। অর্ণব গোঁ গোঁ করতে করতে বসে ঠিক তার পাশেই। তখন মৌসুমী বেগম প্লেট সাজিয়ে খাবার এনে রাখেন টেবিলে। ভাত, মুরগির ঝোল,ডিম,ডাল আর সালাদ। সব কিছুই সাঁজানো। সাঁঝ তখন একটু নাক সুঁকলো।

“উফ! অর্ণব ভাইয়া, তুমি পাদ দিয়েছো।” সাঁঝ নাক চেপে ধরে বলল, চোখ-মুখ কুঁচকে।

অর্ণব প্রথমে চুপচাপ থাকলেও, পরে চোখ বড় বড় করে বলল,

“আমি আবার… তুই গন্ধ পেলেই আমার নাম বলবি কেন?”

“তুমিই দিয়েছো।”

অর্ণব এবার রেগে গিয়ে বলল, “তুই নিজেই হয়তো পাদ দিছিস। আবার আমাকে বলছিস।”

সাঁঝ মুখ ফুলিয়ে বলল,”না।”

“হ্যাঁ।”

“না।”

এদের কান্ড দেখে আরশান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এই! তোরা কি খেতে এসেছিস? আর একবার কেউ কিছু বললে কাউকেই খেতে দিব না, বেয়াদব। আর তোর কী খাবার টেবিলেই এইসব করতে মন চায়।”

অর্ণব অসহায়ভাবে বলল,
“পাদ আসলে আটকে রাখা যায় না। কী করবো? আমি তো আর ফ্লাওয়ার বের করতে পারবো না।”

চলবে ??