এক চিলতে প্রেম পর্ব-০২

0
6

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_২
#লেখা_আইজা_আহমেদ
[📌 অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আর নিচের নোটটা সবাই পড়বেন।]

ধীরে ধীরে রাতের নিস্তব্ধতা বাড়ছে। নরম বাতাসে জানালার পর্দাগুলো দুলে উঠছে। দূরে কোনো কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল, রাতের নিস্তব্ধতায় একটা খণ্ডিত আওয়াজ।
মোসুমী বেগম আলতোভাবে সাঁঝের মাথার চুল বেণী করে দিয়ে সামনের ছোট চুলগুলো সুন্দর করে আচড়িয়ে দিলেন। মেয়েটার গাল দুটি মাখনের মতো নরম, মুখখানি চাঁদের মতো শান্ত। চোখে ক্লান্তি, কিন্তু সেই ক্লান্তিও ছিল কোমল, অবুঝ শিশুর মতন। সাঁঝ লক্ষ্মী মেয়ের মতো চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। মোসুমী বেগম তার ছোট্ট মাথাটায় একটা হালকা চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

“ঘুমিয়ে পড়। আমি লাইটটা বন্ধ করে দিচ্ছি।”

লাইট বন্ধ হয়ে গেলে ঘরটা অন্ধকারে ঢেকে গেল। জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলো কিছুটা ঘরের এক কোণায় পড়ছিল, তাতে সাঁঝের ছোট্ট অবয়বটা দেখা যাচ্ছিল অস্পষ্টভাবে।
মোসুমী বেগম এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। একহাতে নিজের কপাল ঠেকিয়ে, আরেক হাত বাড়িয়ে রাখলেন সাঁঝের মাথায়। হাত বুলাতে বুলাতে তার বুকের ভেতরটা ভার হয়ে উঠল। স্মৃতিগুলো হু হু করে ফিরে আসছিল।
সাঁঝের মা ছিল বিদেশি। চোখদুটো হালকা বাদামি, গায়ের রঙ দুধে-আলতা মেশানো। পরিবারের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও মৌসুমী বেগমের ছোট ভাই রাশেদ সাঁঝের মা’কে বিয়ে করেছিল। মোসুমী বেগমের বাবা এই বিয়ে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। সেজন্য রাশেদ বাধ্য হয়ে শহরের এক প্রান্তে ভাড়া বাসায় চলে যান। মৌসুমী বেগম, তখনও ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ রাখতেন গোপনে। কখনো রান্না করে পাঠাতেন, কখনো গিয়ে দেখে আসতেন।

দাম্পত্য জীবনটা খুব সুখের ছিল। একে অপরকে ভালোবাসতেন। সেই ভালোবাসার প্রতিফলনই ছিল সাঁঝ। সাঁঝের মা যখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখনই ঘটে দুর্ঘটনাটা। রাস্তায় এক্সিডেন্ট আর ঘটনাস্থলেই মৃ/ত্যু।

মোসুমী বেগম খবর শুনে ছুটে গিয়েছিলেন। তখন সাঁঝ দুনিয়ার আলো দেখেনি। মোসুমী বেগম ভেবেছিলেন, হয়তো সময়ের সাথে সাঁঝের মা মেনে নেবে সব, মেয়েটাকে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে। কিন্তু ভাগ্য যেনো ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

সাঁঝের মা সাঁঝ কে রেখে চলে যায়। মৌসুমী বেগম ভেবে পায় না,কীভাবে একজন মা তার সদ্যোজাত মেয়েকে রেখে চলে যেতে পারে? কীভাবে পারে নিজের রক্তের শিশুটিকে ফেলে যেতে? একবারও কি মায়ার বাঁধন তাকে টেনে রাখেনি? একবারও কি মনে হয়নি, বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার জন্য লড়তে হবে?
মৌসুমী বেগম শীতল চোখে মেয়েটার মুখের দিকে তাকান। ছোট্ট, লাল টুকটুকে একটা মুখ। গায়ের রঙ ঠিক পাকা টমেটোর মতো লালচে। একদম তার মায়ের মতো হয়েছে।
এই বয়সে যেখানে তার মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে সে শুয়ে আছে অন্য এক নারীর ছায়ায়, ভালোবাসায়। যদিও মৌসুমী বেগম তাকে নিজের সন্তানের মত ভালোবাসে।

সাঁঝ বড় হচ্ছে। বড় ভাইয়ের সংসারে থাকলেও সাঁঝকে দেখে মনে হয় না ও ভালো আছে। কিছুদিন আগে ওকে নিয়ে এলেন বাড়িতে, তখনই খেয়াল করেন মেয়েটার পিঠে আঘাতের দাগ। সরাসরি কিছু বলেননি, কিন্তু বুঝে গিয়েছিলেন।
রুনা, তাঁর ভাইয়ের বউ, বরাবরই তীব্র মেজাজের। তার নিজেরও দুই ছেলে। সে হয়তো সাঁঝকে নিজের মনে করে না। তাই তো কখনো খেয়াল করে না মেয়েটা খেলছে কিনা, না খেয়ে রয়ে গেছে কিনা, কেঁদে কাঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা। এই কারণেই মোসুমী বেগম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সাঁঝ এখানেই থাকবে। এই ঘরে, যেখানে ওর জন্য একটা কোণাও বরাদ্দ থাকবে।
ভালোবাসার, সুরক্ষার এক ছোট্ট পৃথিবী।

————

সকালের নরম রোদ জানালার পর্দা ছুঁয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকছে। চারদিকে একটা প্রশান্তি।
আরশান ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। তার পরনে হালকা নীল টি-শার্ট আর সাদা ট্রাউজার, চুলগুলো এলোমেলো । চোখেমুখে এখনো খানিকটা ঘুমের ছাপ রয়ে গেছে। নিচে নামতেই ডাইনিং টেবিলে চোখ যায়। সেখানে সাঁঝ আর অর্ণব আগেই বসে খেতে শুরু করেছে।

আরশান গম্ভীর মুখে চেয়ার টেনে বসলো। কিছু না বলে নিজের প্লেট টেনে নেয় আর ধীরে ধীরে খাওয়া শুরু করে। তখন মৌসুমী বেগম রান্নাঘর বেরিয়ে এলেন। একটা কাগজ ধরিয়ে বললেন,

“বাজারে গিয়ে এগুলো আনিস তো।”

আরশান এক চামচ খেয়ে মুখ না তুলে বলল,
“রাখো।”

অর্ণব হঠাৎ মাথা তুলে বলল,
“আমিও যাবো।”

আরশান ভ্রু কুঁচকে তাকাল ওর দিকে।
“তুই গিয়ে কী করবি?”

অর্ণব দমে গেল না। মা’র দিকে তাকিয়ে ঠোঁট গোল করে বলল,
“মা, বলো না… আমি যাবো, প্লিজ?”

এই কথার সঙ্গে সাঁঝের ছোট্ট কণ্ঠও যোগ হলো,
“আমিও যাবো।”

আরশান বিরক্ত হয়ে এক দৃষ্টিতে দু’জনের দিকে তাকায়।

“তোরা গিয়ে করবি? আমি কোন বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি না।”

সাঁঝ আর অর্ণব কিছু বলার আগেই মৌসুমী বেগম বলেন,
“এমন করিস না। ওদের নিয়ে যাস। আমি যাই, রান্নার কাজ পড়ে আছে।”

আরশান এবার কিছু না বলে চুপচাপ খাওয়া শেষ করল। মুখটা আরও গম্ভীর হয়ে উঠেছে। খাওয়া শেষে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ল। কোনো কথা না বলেই উপরের দিকে সিঁড়ি ধরে চলে গেল নিজের রুমে। পনেরো মিনিট পর সে রেডি হয়ে নিচে নামে। পরনে কালো হুডি। নিচে নেমে দেখে, অর্ণব আর সাঁঝ দু’জনেই একেবারে রেডি। সাঁঝ পরেছে হলুদ ফ্রক আর অর্ণব পরেছে তার স্পাইডারম্যানের জ্যাকেট, চোখে চশমা, ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনের মুখেই খুশির ঝিলিক।

আরশান দু’পা এগিয়ে সামনে দাঁড়াল, একবার চোখ বুলিয়ে নিল দুই উৎসুক মুখের দিকে। কিছু বলার আগেই অর্ণব বলে উঠল,
“চলো, আমরা রেডি।”

আরশানের মুখের কোণে বিরক্তির রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখন এই দুই বিচ্ছু কে নিয়ে যেতে হবে। তবুও সে কিছু না বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “চল।”

সুপারশপ থেকে বেরিয়ে আসে ওরা তিনজন। দুই’টা ব্যাগ হাতে আরশানের। পেছনে সাঁঝ আর অর্ণব খুশি মনে হাঁটছে। তখন সাঁঝ হঠাৎ বলে উঠল,”আরশান ভাইয়া, আইসক্রিম খাবো।”

আরশান এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে ছোট্ট মুখটার দিকে। ক্লান্ত হলেও কিছু না বলে পাশে আইসক্রিমের দোকানের দিকে এগিয়ে যায়।
আইসক্রিম হাতে পেয়ে অর্ণব খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। সাঁঝও চোখ বড় বড় করে চুমুক দিতে শুরু করে। সবাই আবার হাঁটতে শুরু করে।

হাঁটতে হাঁটতে সাঁঝ আরশানের দিকে ফিরল,
“ভাইয়া, তুমি খাবে?”

সাঁঝ কিছু না ভেবে বাড়িয়ে দেয় আইসক্রিমটা। আরশান নিচু হয়ে কামড় বসায় একেবারে বড় করে। কিন্তু এক কামড় বলতে যা বোঝায়, সে খেয়েছে প্রায় অর্ধেক।

সাঁঝ চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে আইসক্রিমের দিকে। তার আইসক্রিমটা অর্ধেক খেয়ে ফেলল আরশান ভাইয়া । এরপর হুট করে হাত বাড়িয়ে আরশানের চুলে টান দেয়।

“বেয়াদব! আমার চুল ছাড়।” আরশান সাঁঝের হাতটা চুল থেকে সরায়।

সাঁঝ শব্দ করে কেঁদে ফেলে।
“আমার আইসক্রিম।”

চারপাশে হাঁটতে থাকা মানুষজন তাকাতে শুরু করেছে। কয়েকজন হাসছে, কেউ কেউ চোখ কুঁচকে তাকাচ্ছে। আরশানের চেহারা লাল হয়ে গেল লজ্জায়। মনে মনে নিজেকেই গালি দিল,
“কেন যে খেলাম।”

আরশান কান্না থামাতে গিয়ে বলল,
“আচ্ছা থাম, তোকে আরেকটা কিনে দিচ্ছি, ঠিক আছে?”

সাঁঝ কান্না থামিয়ে মাথা নাড়ল। পেছন থেকে অর্ণব গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
“আমাকেও দেবে।”

“তোর তো আছে আইসক্রিম। আবার কেন?”

অর্ণব ভ্রু কুঁচকে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বলে,
“সাঁঝের তো এখন দু’টা আইসক্রিম হবে।”

আরশান বিরক্ত হয়ে বলল,”ওটা আমি খাবো।”

অর্ণব মুখ নামিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল,
“কিপ্টা ভাই একটা…”

“কী বললি?”

অর্ণব চোখ ঘুরিয়ে বলে, “কিছু না।”

আরশান আবার দোকানের দিকে ফিরে যায়। সাঁঝকে আরেকটা আইসক্রিম কিনে দেয়। ফেরার পথে নিজের মনেই বিড়বিড় করে,
“তওবা! জীবনে আর কোনোদিন ওদের কাছ থেকে এক কামড়ও খাবো না। যত প্যারা।”

চলবে…….