এক চিলতে প্রেম পর্ব-০৩

0
5

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_৩
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)

এখন সন্ধ্যা। আকাশে ধীরে ধীরে নেমে আসছিল সোনালি আলো। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে পড়া হালকা আলোটা ছড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে।
মৌসুমী বেগম চুলার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।চুলার আগুনের উত্তাপে তার কপালে ঘাম জমেছে। মেঝেতে বসে থাকা সাঁঝ সিদ্ধ আলুগুলো ছোলার কাজে মন দিচ্ছে।

এই সময়ে বেজে উঠে ফোন। রান্নাঘরের তাকেই রাখা ছিল। তীক্ষ্ণ রিংটোনে চমকে তাকালেন মৌসুমী বেগম। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে নাম, আরশানের বাবা। এক মুহূর্তের জন্য চোখে-মুখে একটা ছায়া নেমে এলো। অতীতের হাজারটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল। কিছুটা কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা ধরেও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, ফোনটা আবার রেখে দিলেন আগের জায়গায়। ধরলেন না। আরশান মানা করেছে। “আমাদের খোঁজ নিয়ে কোনো লাভ নেই । উনি এখন আমাদের কেউ না।”

ছেলের কণ্ঠে যে জেদ, যে অভিমান, তা একজন মায়ের মন খুব ভালোভাবেই টের পায়। আর
এমনটা যে বলেছে, তার কারণ আছে। কারণটা খুবই স্পষ্ট। আরশানের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। মৌসুমী বেগমের জীবনের সমস্তটা যিনি একসময় ছিলেন, তিনি এখন অন্য কারো পাশে ঘর বেঁধেছেন। তিন বছর আগে, যখন খবরটা এল, মৌসুমী বেগম ভেঙে পড়েননি। হয়তো তখন আর চোখে জল আসত না। বছরের পর বছর ধরে এই সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার সমস্ত চিহ্ন তার বুকের গভীরে জমে ছিল। শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল। আর সেই সময়টাই এল।

তবে মৌসুমী বেগম নিজেকে সামলে নিয়েছেন। নিজের বাবার দেওয়া ভিটে আর কিছু জমিজমা ছিল তার নামে। সেই সম্পত্তির অর্ধেক দিয়ে দুই তলা একটা বাড়ি বানিয়েছেন। এখন সেই বাড়িতেই থাকেন তিনি, তার ছেলেদের নিয়ে।
আরশান এখন বড় হচ্ছে । বয়স এখন ১৯ । দেখতে দেখতে ছেলেটা তার বাবার মতোই ফর্সা, লম্বা-চওড়া হয়েছে, তবে মায়ের মতো গভীর এবং দায়িত্বশীল। ছোট থেকেই বইয়ের দিকে ঝোঁক ছিল ওর। স্কুলে সবসময় প্রথম। কলেজে উঠে যখন ব্যাচেলর লেভেলের স্কলারশিপের জন্য আবেদন করল, মৌসুমী বেগম শুধু চুপ করে ওর পাশে দাঁড়ালেন। ভিতরে ভিতরে দোয়া করতেন প্রতিদিন। দোয়া যে কাজে লেগেছে, সেটা বোঝা গেল গত সপ্তাহে।

ব্যাচেলর লেভেলের স্কলারশিপ পেয়েছে আরশান। কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে সে। পুরো খরচ বিশ্ববিদ্যালয়ই বহন করবে।
সেই মুহূর্তে মৌসুমী বেগম কিছুই বলেননি। শুধু ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত কষ্ট, এক ভয় আর এক তৃপ্তির তীব্র মিশ্র অনুভূতি চেপে বসেছিল। কানাডা… এত দূরে ছেলেটা চলে যাবে। কিন্তু তার ভবিষ্যতের জন্য তো এটাই দরকার। তাই তিনি কিছু বলেন না এখন। বরং প্রতিদিন ছেলের প্রিয় খাবার রান্না করেন, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে দেন, যাতে বিদেশে গিয়ে কোনোরকম অস্বস্তিতে না পড়ে।

আজও তাই। সাঁঝ আলু ছুলে দিচ্ছে। আরশানকে আলুর চপ খাওয়াবেন বলে। ফোনটা আবার বাজে। তবে এবারও তিনি ধরেন না। জানেন, কিছু সম্পর্ক আর কখনোই আগের মতো হয় না। তবে এক নতুন অধ্যায়ের শুরু হতে চলেছে। ছেলেকে নিয়ে তার স্বপ্নও বড় হচ্ছে। নিজের মতো করে।

অর্ণব সোফার কোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। মুখটা কেমন বিবর্ণ, নাক লাল হয়ে গেছে সর্দির কারণে। টিসু হাতে নিয়ে সে বারবার নাক ঝাড়ছে। একটা কাশি এসে গেলে গলা চেপে ধরে আওয়াজ না হয়। পাশে ছোট্ট একটা গামলা রাখা, যেখানে ফেলে দিচ্ছে টিসুগুলো। তার এখন পড়তে ভালো লাগছে না। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে।
সন্ধ্যার নরম বাতাস জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকছে। এমন সময় হঠাৎ পেছন থেকে মাথায় দুম করে টুকা পরে। অর্ণব চমকে উঠে পেছনে তাকায়। আরশান দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে, হাতে একটা বই।

“সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এখনও বই খুলিসনি?”

“আসছি।” অর্ণব মুখটা এমন করে বলল, যেনো পৃথিবীর সব কষ্ট ওরই হয়েছে।

আরশান হালকা ধমকের সুরে বলল, “এই আসছি, আসছি করে পড়তে বসবি কখন? ওঠ, টেবিলে আয়। আজ কিন্তু ম্যাথ করাবো, আগেই বলে দিলাম।”

তারপর আরশান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “সাঁঝ কই?”

“আম্মুর রুমে।”

আরশান এবার একটু জোরে বলে উঠল,”সাঁঝ।”

ঘরের ভিতর থেকে টুপটাপ পায়ে দৌড়ে বেরিয়ে এল সাঁঝ। পরনে গোলাপি জামা, চুলে রঙিন ক্লিপ। মুখে মিষ্টি একটা হাসি।
সাঁঝ আসতেই টেবিলের চারপাশে গুছিয়ে বসে পড়ে তারা। অর্ণব মুখ ভার করে হলেও খাতা বের করে। সাঁঝ চট করে তার রঙিন পেনসিলগুলো সাজিয়ে নেয়। আরশান খাতায় লিখে দেয় কয়েকটা অঙ্ক।

এমন সময় সাঁঝ খিলখিল করে হেসে উঠে। মুখটায় টুকটুকে একটা হাসি, চোখে দুষ্টুমি। ছোট্ট আঙুল দিয়ে অর্ণবের দিকে ইশারা করে বলে উঠল,

“অর্ণব ভাইয়ার নাক থেকে বেলুন বের হচ্ছে।”

অর্ণব তখন বইয়ের ওপর ঝুঁকে ছিল। মুখ গম্ভীর, কপালে ভাঁজ। সে বুঝতেই পারেনি, তার নাক দিয়ে একটু সর্দি পড়েছে। সাঁঝের কথায় সে চমকে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলে তাকালো, আর ঠাস করে নাক মুছে ফেললো হাতের পাশে রাখা টিস্যু দিয়ে। মুখ গম্ভীর করে তেড়ে আসতে গিয়েও থেমে গেল। আরশানের চোখের ভাষা সে চেনে। ঘন কালো ভুরু কুঁচকে, ঠোঁট শক্ত করে তাকিয়ে ছিল আরশান। আরশানের সেই চোখ রাঙানিতে অর্ণব মুহূর্তেই ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

আরশান এবার সাঁঝের দিকে মুখ ফিরিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

“এদিক-ওদিক না তাকিয়ে পড়ার দিকে মন দে।”

সাঁঝ মুখ বাঁকিয়ে বলল,

“আমার মুখ ব্যথা করছে।”

“তাহলে লেখ।”

সাঁঝ এবার দু’হাত টেনে দেখিয়ে বলল,

“হাতও ব্যথা করছে।”

আরশান চোখ সরু করে তাকাল।

“পড়তে বসলেই তোর হাত ব্যথা, মুখ ব্যথা, পিঠে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। আর খেলার সময় সব একদম ঠিকঠাক থাকে, তাই না?”

সাঁঝ মুখ নিচু করলো। একটু চুপচাপ বসে রইল। তারপর ফিসফিস করে বলল,”একটুখানি বিরক্ত লাগে, বইগুলো খুব পঁচা।”

আরশান এবার গম্ভীর গলায় বলল,

“আজকের মতো শুধু এগুলো শেষ কর। তারপর ছুটি। না হলে সারারাত বসে থাকবি, আমি উঠছি না।”

অর্ণব ধীরে ধীরে মুখ গোমড়া করে নিজের অঙ্কে মন দিল। সাঁঝও চাপা মুখে লিখতে শুরু করল, পেনসিলটা মাঝে মাঝে দাঁত দিয়ে কামড়াচ্ছে।
লেখা শেষ করতে হবে,নাহলে যে ছুটি পাবে না।
তবে লেখায় মন দিতে পারল না সাঁঝ। হঠাৎ একটা টুপ করে শব্দ। চোখ নামিয়ে দেখে, তার খাতার ওপর দিয়ে একটা বড়সড় আরশোলা হেঁটে যাচ্ছে। সাঁঝ ভড়কে গেল।

“উইইইইইই….” চিৎকার করে উঠে চেয়ার থেকে লাফিয়ে দাঁড়াল সে।

তার চিৎকার শেষ হওয়ার আগেই সেই আরশোলা উড়ে এসে সোজা সাঁঝের মাথায় বসে পড়ল। সাঁঝ এবার ঠিক কাঁদবে না হাসবে বুঝতেই পারল না। অর্ণব সেই দৃশ্য দেখে হেসেই যাচ্ছে। পেট চেপে ধরে বলল,

“আরশোলা রানির মাথায় আবার মুকুট পরে বসেছে।”

আরশান তখন ঠোঁট চেপে হাসি আটকে রেখেছে। সে জানে, এখন হাসলে পুরো নিয়ন্ত্রণ হারাবে, তাই সে পরিস্থিতি বুঝে নিজের লাভ তুলে নিতে চাইল।
“তোকে অনেকবার বলেছি, আমায় আর আরশোলা বলে ডাকবি না। এবার তার ফল পেলি। আর বলবি?”

“আমি আর বলবো না।”

অর্ণব আবার হেসে ফেলে, “ওই আর বললে আবার উড়ে আসবে।”

সাঁঝ ছোট মুখ করে বলল,

“এখনও কী আছে।”

“তোকে দেখে আরশোলাটা ভয় পেয়েই পালিয়েছে। এখন বস।”

সাঁঝ চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। বুকের ভিতরটা এখনও ধুকধুক করে কাঁপছে, ভয়টা এখনো পুরোপুরি কেটে যায়নি।

চলবে…..