#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_৪
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)
গোসল শেষে আয়নার সামনে দাঁড়ায় আরশান। ভেজা চুলে আঙুল চালিয়ে নেয় একবার, তারপর হেয়ার ড্রায়ার হাতে তুলে নেয়। ড্রায়ারের হালকা গরম বাতাসে চুল গুলো একে একে শুকিয়ে যায়, এলোমেলো ভেজা ভাবটুকু মুছে গিয়ে ফিরে আসে তার গম্ভীর লুক। শার্টের বোতাম গুলো লাগাতে লাগাতে সে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নেয়। তারপর বের হয়ে আসে।
করিডোর দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎই তার পা থেমে যায় মৌসুমী বেগমের রুমের দরজার সামনে। ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে, কেউ কিছুর উপর জোরে জোরে চাপ দিচ্ছে। দরজা ভেজানো, তাই নিঃশব্দে ঠেলে সে ঢুকে পড়ে ভেতরে। চোখে পড়ে ড্রেসিং টেবিলের উপরে সাঁঝ বসে আছে। আয়নার সামনে চুপচাপ বসে নিজের মুখে কিছু একটা করছে সে। তার মুখটা… অদ্ভুত রকম রঙিন। চোখ দুটোতে গাঢ় কালো কাজল এমনভাবে লাগানো যে মনে হচ্ছে রাগ করে কেউ এঁকে দিয়েছে। গাল দুটো টকটকে লাল, যেনো চড় খেয়েছে অনেকগুলো একসাথে। ঠোঁটজুড়ে গাঢ় লাল লিপস্টিক, ওটাতে যেন এক প্যাকেট লিপস্টিক মেখে রেখেছে। ঠোঁটের বাইরেও ছড়িয়ে গেছে।
আরশানের চোখ কপালে উঠে যায়। সে হতভম্ব হয়ে বলে,
“কী করছিস সাঁঝ?”
কণ্ঠটা শুনে চমকে উঠে সাঁঝ। গলা শুনে দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। চোখ-মুখ ভয়ে ছোট হয়ে আসে। ধরা পড়ে গেছে । সব মিলিয়ে তার ছোট মুখটা আরও ছোট হয়ে আসে।
“এই মুখের কী অবস্থা করেছিস তুই,নিচে নাম।”
“আমি সাজুগুজু করেছি…”
আরশান হাসি চেপে রেখে তার ছোট্ট হাতটা ধরে টান দেয় নিচে নামায়।
“ধারা তুই।”
বলেই পকেট থেকে মোবাইল বের করে কয়েকটা ছবি তুলে নেয় সে। সাঁঝের অদ্ভুত চেহারার।
“নিচে চল।”
আরশান হাত বাড়িয়ে দেয়, সাঁঝ নিঃশব্দে তার হাত ধরে। নিচে নেমে ড্রয়িংরুমে আসতেই অর্ণব সোফায় বসে থাকা থেকে সাঁঝকে দেখে হেসে ফেলে।
“এই তুই তো একদম ভূত সেজেছিস।”
সাঁঝ থেমে গিয়ে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“একদম না। আমি প্রিন্সেস হয়েছি।”
সাঁঝ মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক তখন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন মৌসুমী বেগম। তাঁর চোখ সরাসরি পড়ে সাঁঝের মুখে। তিনি হঠাৎ থেমে গিয়ে বলে উঠলেন,
“ইয়া আল্লাহ, সাঁঝ! মুখে এইসব কী করেছিস।”
সাঁঝ এবার হাসিমুখে বলে,
“আমি সেজেছি ফুফি।”
“ওর মুখটা ধুয়ে দাও।”
মৌসুমী বেগম হাতের কাপড়টা কোমরে ঠেসে রাখেন, বিরক্তির ভঙ্গিতে বলেন,
“আয়, আয় আমার সাথে। মুখটা আগে ধুয়ে আস। সাজের বদলে ভূতের রূপ নিয়েছিস।”
সাঁঝকে মুখ ধুয়ে দিয়ে মৌসুমী বেগম যান আরশানের রুমে। ধীর পায়ে এসে আরশানের ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন।
“আরশান।”
“আসো।”মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে বলল আরশান। তখন সে ফোনে কিছু একটা খুঁজছে।
মৌসুমী বেগম একটু থেমে বললেন, “শোন আরশান, আমি তোর দাদিকে আনতে যাবো। বিয়েতে তো ওনার থাকা দরকার।”
আরশান হালকা মাথা নেড়ে বলল, “আমি যাবো তোমার সাথে?”
“তোর যাওয়া লাগবে না। আমি পারবো।”
মৌসুমী বেগম আবার বললেন, “আর দেখিস, সাঁঝ আর অর্ণব যেন সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে আসে।”
“আচ্ছা।”
মৌসুমী বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে। যেতে যেতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগবে। তাঁকে আরশানের দাদিই নিজের পছন্দে বউ হিসেবে এনেছিলেন। তবে উনি যোগাযোগ রাখেন তাঁদের সাথে।
———–
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আসছে। সূর্য এখনও পুরোপুরি ডুবে যায়নি, তবে তার আলো কারও মুঠোয় ধরা নরম কমলা শালির মতো বিস্তৃত আকাশজুড়ে ছড়িয়ে আছে। গাছের পাতাগুলো সেই আলোয় সোনালি ছায়া মেখে ঝিমিয়ে পড়েছে, পাখিরা নীড়ে ফেরার জন্য ডানায় ভর দিয়েছে। হঠাৎই বাইরের গেট খুলে বন্ধ হওয়ার শব্দ, তারপর পায়ের শব্দে বোঝা গেল। অর্ণব আর সাঁঝ এসে পৌঁছেছে। খেলার পর দুজনেই ক্লান্ত।
ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকেই, অর্ণব বলল, “আম্মু কই?”
সাঁঝও পা টেনে টেনে ঢুকে এসে সরাসরি গিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিল। সোফায় বসে থাকা আরশান ফোনে চোখ রেখেই বলল, “বাইরে গেছে।”
অর্ণব কুঁচকে গেল মুখটা, “ভাইয়া কিছু বানাবে? খুব খিদে পেয়েছে।”
আরশান কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল। একঘেয়ে বিকেলটা তার নিজেরও খিদে জাগিয়ে তুলেছে। মোবাইল রেখে সে রান্নাঘরের দিকে হাঁটল। আর তার ঠিক পেছনে নরম পায়ে টুপটাপ করে হাঁটতে লাগল সাঁঝ।
সাঁঝ রান্নাঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ভাইয়া কী বানাবে?”
আরশান দুষ্টু হাসি এনে বলল, “আজকে তোকে আরশোলা রান্না করে খাওয়াবো।”
সাঁঝ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎই বলল, “মানে তুমি রান্না হয়ে যাবে?”
আরশান থ হয়ে গেল। হাতের চামচটা থেমে গেল মাঝপথে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল সাঁঝের দিকে। আর সাঁঝ? সে আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে ঝট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড় লাগাল।
“সাঁঝ, দাঁড়া। তুই আবার কী বললি এখন।”
তার আগেই সাঁঝ হি হি করে হেসে দৌড়ে পালিয়ে গেছে রান্নাঘর থেকে। পেছনে পড়ে থাকে আরশানের থমকে যাওয়া মুখ। কটমট করে তাকাল দরজার দিকে। দুষ্টুমির জন্য সাঁঝকে ধমক দিতে যাবে ভেবেছিল, কিন্তু সাঁঝ তো দৌড়ে পালিয়েছে। আরশান মাথা নাড়ল বিরক্ত হয়ে।
“এইটুকুন মেয়ে, দিন দিন ভয়ংকর হচ্ছে।”
সে আর কিছু না বলে রান্নার দিকে মন দিল।
গ্যাসে হাঁড়ি চাপিয়ে ম্যাগি ও স্যুপ ফোটাতে লাগল। ফ্রিজ খুলে দেখে মাত্র দুইটা ডিম আছে।
তিনজনের জন্য রান্না করছে সে। রান্না শেষ হতে একটু সময় লাগল, তবে গন্ধে ভরে গেল।
টেবিলে সাজিয়ে রাখল তিনটা বাটি। ম্যাগি স্যুপে গাজর, ক্যাপসিকাম, কিছুটা পালং পাতা কাটা, মশলা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। তবে একটায় আস্ত একটা ডিম পড়েছে। যেটা মূলত সাঁঝের জন্য ।
অর্ণব এসে বসে খেতে খেতে বলল, “ভাইয়া, ওকে তো পুরো ডিম দিয়েছো।”
আরশান তার অর্ধেক ডিম দিয়ে দেয় অর্ণব কে।
তখন সাঁঝ নিজের বাটি তুলে নিয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে দেখল ডিমটা। তারপর তাকাল আরশানের বাটির দিকে। চামচ দিয়ে ডিমের অর্ধেক তুলে নিয়ে আরশানের বাটিতে রেখে দিল। আরশান অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল।
“দিলি কেন? খাবি না তুই?” কপাল ভাঁজ করল সে।
সাঁঝ চোখ ঘুরিয়ে বলল, “এত বড়োটা খেতে পারবো না।”
আরশান স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
এই মেয়েটার মধ্যে যে এতোটা খেয়াল করার মানসিকতা আছে, সেটা আগে বোঝেনি।
আরশান মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে, তবে আমি তোর ডিম খেলে পরে আবার আমার চুল ধরে টানবি না তো?”
“খেয়ে ফেলো। আমি আবার বড় হয়ে গিয়েছি।” বলেই সাঁঝ নিজের বাটিতে মন দিল।
অর্ণব তখন হঠাৎ বলল, “ভাইয়া, সাঁঝ বড় হয়েছে কবে থেকে? ও তো এখনো কার্টুন দেখে ঘুমায়।”
সাঁঝ বলল, “কালকে তো তুমি আরশান ভাইয়ার পকেট থেকে টাকা নিয়েছো।”
অর্ণবের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। আরশান তখন থামিয়ে রাখা চামচটা নামিয়ে রেখে ধীরে ধীরে তার দিকে তাকাল। চোখদুটো কটমট করে উঠল, গলায় গম্ভীর শীতলতা ভেসে উঠল,
“তুই… আমার পকেট থেকে টাকা নিয়েছিস?”
কণ্ঠস্বর ভয়ংকর শান্ত, যেমন ঝড়ের আগে আকাশ থাকে।
অর্ণব প্রথমে চোখ ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাল, তারপর গলাটা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“না মানে, আসলে… আমি তো… মানে… হঠাৎ দেখি মাটিতে পড়েছিল… আমি তো ভাবছিলাম…”
“ভাবছিলি কী?”
কিন্তু বাকিটুকু আর সে শেষ করতে পারল না। কারণ তখনই সে বুঝে গেল, আরশান উঠতে যাচ্ছে। অর্ণব বুঝে গেল, আর এক মুহূর্ত দেরি মানেই রক্ষা নেই। তার চেহারায় একরাশ ভয় জমে উঠল। “ও মা!” বলে চেয়ারের নিচ থেকে পা বের করে সে ছুট দিল বাইরের দিকে।
আরশান ধমকে বলল, “দাঁড়া তুই আজ তোর হাত-পা ভেঙে দেব বেয়াদব।”
কিন্তু ততক্ষণে অর্ণব দৌড়ে বেরিয়ে গেছে। পেছনে শুধু তার ছুটে পালানোর শব্দ আর আরশানের ধমকের সুর ভেসে আসছে।
চলবে…….