এক চিলতে প্রেম পর্ব-০৫

0
5

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_৫
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)

ড্রইংরুমটা আজ একটু বেশিই নিঃসঙ্গ লাগছিল সাঁঝের। দেয়ালে ঝোলানো ক্লকটার টিকটিক শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। রোদ্দুরটা জানালা বেয়ে পড়ছিল ঠিকই, কিন্তু তাতেও সাঁঝের ছোট্ট মনটা উজ্জ্বল হচ্ছিল না।
সে পায়ের পাতায় ভর দিয়ে চুপিচুপি হেঁটে সারা ড্রইংরুমটা একবার চক্কর দিয়ে নিল। চেয়ারগুলোর নিচে উঁকি দিল, টেবিলের উপর রাখা পত্রিকাগুলোর পাতা উল্টে দেখল। কিন্তু কিছুতেই মন বসলো না। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে সাঁঝ আবার এসে দাঁড়াল আরশানের পাশে।

আরশান তখন ডিভানের এক কোণে হেলান দিয়ে গম্ভীর মুখে ফোনে কথা বলছিল। গলার স্বরটা নিচু, চোখ দুটো মোবাইল স্ক্রিনে আটকে।
সাঁঝ ধীরে ধীরে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়াল। কণ্ঠে একরকম আশা নিয়ে বলল,

“ভাইয়া, আজ ঘুরতে নিয়ে যাবে না?”

এই প্রশ্নটা সাঁঝ একটু আগেও করেছিল, কিন্তু উত্তর মেলেনি। যেনো আরশান শুনতেই পায়নি। এজন্য সে আবার এসেছে। সাঁঝ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর আবার বলল এবার একটু জোরে,

“আরশান ভাইয়া… ঘুরতে যাবো না?” মুখে ছিল নিষ্পাপ আকুতি।

আরশান মুখ ঘুরিয়ে তাকাল সাঁঝের দিকে। দৃষ্টি জ্বালা ধরা, চোখে মুখে বিরক্তির রেশ। তারপর কর্কশ গলায় বলল,

“আমার কানের কাছে চড়ুই বাচ্চার মত ছোঁ ছোঁ করবি না, নাহলে ঠোঁট সেলাই করে দিবো।”

সাঁঝ হকচকিয়ে গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল ওর জায়গায়। ওর গোলাপি ঠোঁট দুটোতে ধীরে ধীরে হাত রেখে দিল। ঠোঁট সেলাই করে দিবে মানে কী? সেলাই মানে তো ব্যথা। ছোট্ট বুকটা ধক করে উঠল। সাঁঝ বোঝে না, কেন ভাইয়া এমন করে বলল। সে তো শুধু একটু ঘুরতে যেতে চেয়েছিল। ভুল কী করেছে সে?
আরশান ততক্ষণে উঠে গিয়ে বাগানে চলে গেছে। সাঁঝ কিছুক্ষণের জন্য স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর সে ও চুপচাপ পেছন পেছন বাগানে গেল। আরশান যে চেয়ারটায় বসেছে তার ঠিক পাশের চেয়ারে বসে সাঁঝ।

টেবিলটার ওপর রাখা ছিল ছোট একটা খেলনার সেট। কাঠের ব্লক দিয়ে তৈরি একটা মিনার বানানোর খেলা। সাঁঝ সেটার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল, তারপর ছোট হাত দিয়ে ধীরে ধীরে ব্লক সাজাতে লাগল। ধীরে ধীরে তার মন খেলায় ডুবে গেল। আর বেড়াতে যাওয়ার কথা ভুলে গেল। আরশান চোখ সরিয়ে সাঁঝের দিকে তাকাল,

“সাঁঝ, মমকে বল তো আমার জন্য একটা কপি বানাতে।”

সাঁঝ কি শুনল? না কি শুনেও না শোনার ভান করল? কে জানে। সে চোখ নামিয়ে খেলায় আরও মন দিল।

আরশানের কণ্ঠে এবার কিছুটা জোর এল,

“কি রে! আমার কথা শুনতে পারছিস না?”

সাঁঝ না তাকিয়েই বলল,

“আমি যাবো না। এখন খেলবো।”

আরশানের ভ্রু কুঁচকে গেল। ধৈর্য যেনো ফুরিয়ে এলো। কোনো উত্তর না পেয়ে আরশান হাত বাড়িয়ে সাঁঝের গালটা ধরে একটু টান দিল।
“এখনই যাবি।”

সাঁঝ হঠাৎই থেমে গেল। তারপরই টলমল করে তাকাল আরশানের দিকে। চোখে জল জমছে, ঠোঁট কেঁপে উঠল। তারপর মুখ ভেংচে কান্না শুরু করে দিল সাঁঝ। আরশান চমকে গেল।
সে তো খুব জোরে টান দেয়নি। তবে সাঁঝ কাঁদছে কেন?

“এই… এই একদম কান্না করবি না।”

তখন, বল হাতে মাঠ থেকে ছুটে এল অর্ণব। মুখে একরকম দুষ্টু হাসি। মিথ্যা অভিযোগ এনে বলল,

“আম্মু, ভাইয়া সাঁঝকে মেরেছে।” অর্ণবের মুখ থেকে হাসি সরছেই যেনো বিশ্বযুদ্ধ জয় করে ফেলেছে বলে।

আরশান এবার শান্ত চোখে অর্ণবের দিকে তাকাল। কোনো কথা বলল না। শুধু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অর্ণব অবাক হয়ে গেল।
চুপ কেন? ওকে কিছু বলছে না কেন?
সাধারণত তো এতটুকু কিছু হলেই সে রেগে যেত। ধমকে দিত। কিন্তু আজ এত চুপ কেন?
আরশান মুখ না খুলেই আবার নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে বসে পড়ল। ফোনটা হাতে নিল, যেনো কিছু হয়নি।

———-

বসার ঘরে আলো-ছায়ার খেলা চলছিল জানালার পর্দা ছুঁয়ে। সোফায় বসে আছেন মমতাজ খাতুন,আরশানের দাদি। গায়ে জামদানি শাড়ি,চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।বয়স পঁচাত্তরের কাছাকাছি, তবুও চোখে মুখে বয়সের রেখার সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতার এক গাম্ভীর্য আছে। সামনের সেন্টার টেবিলের পাশে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে সাঁঝ। পরনে গোলাপি ফ্রক, কাঁধে দুটো বেণি ঝুলছে। তার চোখে কিছুটা কৌতূহল, কিছুটা ভয়, আর অনেকখানি অপরিচয়। এই প্রথমবার সে আরশানের দাদি কে দেখছে। সাঁঝ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, দু’হাত পেছনে গুঁজে।

মমতাজ খাতুন চশমার ফ্রেমটা একটু তুলে তাকালেন মেয়েটার দিকে। কণ্ঠে ছিল মায়াভরা দৃঢ়তা।

“এই দিকে আয়, এখানে আয়।”

সাঁঝ কোনো কথা বলল না। তার পায়ের পাতাগুলো একটু নাড়িয়ে আবার থেমে গেল। সে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল, ঠিক করতে পারছে না, যাবে কি যাবে না। মুখে কোনো ভীতি নেই, কিন্তু একটা দ্বিধা ছড়িয়ে আছে চেহারাজুড়ে। তখন মৌসুমী বেগম ঘরে। হাতে নাস্তা-ভর্তি ট্রে,গরম গরম সেমাই, চা, বিস্কুট, আর ছোট্ট একটা কাপে দুধ। তিনি ট্রেটা টেবিলে রাখলেন।

“আয় সাঁঝ, দাদির কাছে গিয়ে বস।”

সাঁঝ কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মৌসুমী বেগমের কথায় যেনো সাঁঝ একটু আশ্বস্ত হলো। কী মনে করে সে এবার ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে মমতাজ খাতুনের পাশে গিয়ে বসল। মমতাজ খাতুন হালকা হাসলেন, মুখটা একটু নিচু করে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“তোর নাম কী মা?”

“আমায়রা সাঁঝ।”

“বেশ সুন্দর নাম তো। ঠিক যেমন সন্ধ্যার সময়ের আকাশ শান্ত, কোমল।

সাঁঝ একটু মুখ তুলে চাইল তাঁর দিকে, কিন্তু মুখে ভ্রু কুঁচকে অদ্ভুত এক ভাব। মমতাজ খাতুন লক্ষ করলেন তার মুখটা খানিকটা বিষণ্ন।

“তাহলে মুখটা এমন করে রেখেছিস কেন?”

“আরশান ভাইয়া বলেছে আমার ঠোঁট সেলাই করে দিবে। আমি কথা বললে নাকি তার মাথা ধরে।”

নিষ্পাপ কণ্ঠে এই কথাগুলো শুনে মমতাজ খাতুন ও মৌসুমী বেগম দু’জনেই হেসে উঠলেন।

“ও তোকে মজা করে বলেছে। ভয় পাস না। ঠোঁট সেলাই করবে? এতবড়ো সাহস কারোর আছে।”

এই বলে তিনি ধীরে ধীরে তাঁর পাশে রাখা ব্যাগটা খুললেন। ব্যাগ থেকে সোনার একজোড়া ছোট কানের দুল আর একই সেটের ডিজাইনের চেইন বের করলেন।

“এইটা আমি তোর জন্য এনেছি।”

বলেই তিনি নিজ হাতে সাঁঝের গলায় চেইনটা পরিয়ে দিলেন। তারপর কানে পরানো হলো দুলদুটো।এখন সে সত্যি একটা ছোট্ট রাজকন্যা লাগছে। সাঁঝ হাত দিয়ে চেইনটা ছুঁয়ে দেখল। চোখে জ্বলজ্বল করা বিস্ময় আর আনন্দ। মুখের বিষণ্নতা মিলিয়ে গিয়ে এবার ফুটে উঠল এক চমৎকার হাসি।
মমতাজ খাতুন তাকে কাছে টেনে কপালে চুমু দিয়ে বললেন,

“পছন্দ হয়েছে।”

সাঁঝ হাসল, “হুম সুন্দর।”

————–

বাইরে সন্ধ্যার আলো ছায়া ছুঁয়ে যাচ্ছে জানালার কাঁচে, আর ভেতরে চলছে নীরব শাস্তি। অর্ণব প্রায় এক ঘণ্টা ধরে মেঝেতে বসে আছে আরশানের পায়ের কাছে। দুই হাতে সে পা টিপে দিচ্ছে। একেক সময় রাগে, একেক সময় বিরক্তিতে মুখটা ফুলে যাচ্ছে তার, কিন্তু কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। কারণ, একটু আগেই সে সাহস দেখিয়ে বলেছিল।
“আম্মু ভাইয়া সাঁঝকে মেরেছে।” আর ফলাফল? পিঠে ঝাঁট নয়, কিন্তু শাস্তি হিসেবে পা টিপে দিতে হচ্ছে। আর সেই থেকে চলছে এই নিরব নির্যাতন। পায়ের পাতার হাড়গোড় গুনতে গুনতে অর্ণব বিরক্ত হয়ে গেছে।

“থামলি কেন?”

অর্ণব চমকে উঠে আবার গা জোরে পা টিপতে শুরু করল। কেন যে মুখ চালিয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, মনের কথা মুখ ফসকে বেরোনো মানেই বিপদ ডেকে আনা। আরশান আধশোয়া ভঙ্গিতে সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। চোখ বোজা, কপালে এক হাত রেখে ভাবভঙ্গিতে যেন পৃথিবীর সমস্ত ক্লান্তি তার উপর ভর করেছে।

অর্ণব একটু পর বলল,
“এখন যাই? অনেক হয়েছে তো।”

“না।” আরশানের ঠাণ্ডা উত্তর।

অর্ণব দম ফেলে বিড়বিড় করে বলল,
“জল্লাদ ভাই একটা…”

আরশান শুনে ফেলল কথাটা, তবু কিছু বলল না। বরং একটা ধীরে হাসি ঠোঁটে ফুটে উঠল।
অর্ণব এবার বেশ জোরে বলল,

“আমি আর পারবো না ভাইয়া। অনেকক্ষণ ধরে করছি। তোমার মন ভরছে না কেন?”

আরশান ধীরে কপাল থেকে হাত সরিয়ে চোখ খুলে তাকাল ওর দিকে। তারপর গম্ভীর গলায় বলল,
“এখন হাতটা টিপে দে। নাহলে তোর একটা খেলনাও আস্ত থাকবে না, আর তুইও না।”

অর্ণব থ হয়ে গেল। হাতও টিপতে হবে এবার?
তার চোখে জল আসা আসা অবস্থা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুঃখের ভার এখন তার উপর।
সে ধীরে ধীরে বলল,
“আমি তো সাঁঝের কথা বলেই পুড়লাম… এখন তো মনে হচ্ছে, আমি যদি একাই কেঁদে ফেলতাম।”

আরশান হালকা হেসে চোখ বন্ধ করে বলল,
“তাই কর। কান্না করে হাত টিপ। দুই কাজ একসাথে শিখে নে।”

অর্ণব মুখ কুচকে হাত টিপতে লাগল, আর মনে মনে ঠিক করল। আগামীবার আর কোনো কথা বলবে না।

চলবে….