#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_৭
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)
আকাশে হালকা কমলা রঙের ছোঁয়া, চারপাশে নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে।
গাছের পাতার ফাঁক গলে রোদের ফোঁটা এসে পড়ছে সাঁঝ আর অর্ণবের গায়ে। দু’জনেই দাঁড়িয়ে আছে গেটের পাশে, তাদের চোখে কেমন একটা কৌতূহলী আর অবুঝ বিষণ্ণতা।
দূরে কালো রঙের গাড়িটা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে, ইঞ্জিন বন্ধ, কিন্তু চাকা যেনো যাত্রার জন্য অধীর হয়ে আছে। আজ রাতে ফ্লাইট। আরশান চলে যাবে কানাডায়। প্রিয়ম, আরশানের ছোটবেলার বন্ধু, হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে এসে বলে,
“সবকিছু নিয়েছিস? কিছু বাদ যায়নি তো?”
আরশান ব্যাগের চেইনটা টেনে বন্ধ করল, তারপর মাথা নেড়ে বলল,”হুম।”
ঠিক তখন, একটু দূর থেকে পায়ের শব্দ ভেসে এলো। গলির মোড় ঘুরে দেখা গেল রুনা মামী আসছে। আরশান ত্রু কুঁচকে তাকাল। আবার এসেছে কেন?
“আপনি?”
রুনা কাছে এসে বলল,”হ্যাঁ, এসেছি।”
“আপনাকে তো বলেছিলাম, সাঁঝ এখন থেকে এখানেই থাকবে।”
রুনা শান্ত গলায় উত্তর দিল,
“আমি তো সাঁঝকে নিতে আসিনি, তোমাকে বিদায় দিতে এসেছি।”
আরশান তিক্ত হেসে বলল,
“আপনার না এলেও চলতো।”
রুনা কিছুক্ষণ নীরব রইল। মুখ বুঝে অপমানটা
সহ্য করল। তারপর ধীর গলায় বলল,
“সাঁঝকে নিয়ে তোমার টেনশন করতে হবে না। আমি তো আছিই।”
আরশানের চোখে ঝিলিক,”এটাই তো টেনশন।”
পরিস্থিতি অস্বস্তিকর হয়ে উঠল। তখন মৌসুমী বেগম এগিয়ে এলেন। তিনি ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
“পৌঁছে ফোন করবি আর ঠিক মত খাবি।”
আরশান মায়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে দিল। প্রিয়ম এসে বলল, “চল।”
সাঁঝ তখন মৌসুমী বেগমের হাত ধরল।
“আরশান ভাইয়া কি কালকে আবার চলে আসবে, ফুফি?”
মৌসুমী বেগম মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন,
“না মা, পড়াশোনা শেষ করে তবেই আসবে।”
সাঁঝের চোখে কৌতূহল। সে গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। তার ছোট্ট মনে বিদায় শব্দের আসল মানে এখনো পুরোটা ধরা পড়েনি।
গাড়িতে বসে প্রিয়ম আরশানের দিকে তাকিয়ে কুটিল হাসি দিল।
“তোর ছোট্ট বেবি বউকে মিস করবি না ?”
আরশান চোখ কুঁচকে কটমট করে তাকাল।
“শালা, চুপ করবি।”
প্রিয়ম হেসে বলল, ” আরে ভাই, প্লেনে গিয়ে কাঁদিস না যেন।”
“তুই মুখ বন্ধ না করলে নামিয়ে দেব।”
গাড়ি ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করছে। আরশান প্রিয়ম এর দিকে তাকিয়ে বলল, “প্রিয়ম।”
“হ্যাঁ, বল।”
“আমার অবর্তমানে তোর উপর দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি… খেয়াল রাখবি আমার ফ্যামিলির।”
“তুই চিন্তা করিস না। আমি তো আছিই ।”
———
ভ্যাঙ্কুভার সিটি, কানাডা।
চারপাশে সাদা তুষারের আস্তরণ শহরটাকে এক পরীর দেশের মতো সাজিয়ে তুলেছে। রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্টগুলোর উপর জমে থাকা বরফে আলোর প্রতিফলন পড়ছে, যা দূর থেকে ঝিকমিক করে চোখে লাগে। ঠাণ্ডা বাতাসে নিঃশ্বাস বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট সাদা ধোঁয়ার মতো দেখা দিচ্ছে।
রাস্তার দুই ধারে সারি সারি পাইন গাছগুলো তুষারের ভারে মাথা নিচু করে আছে, আর দূরে পাহাড়গুলোও সাদা ধোঁয়ার চাদরে আচ্ছন্ন।
আরশানের এখানে আসার আজ ঠিক দুই সপ্তাহ পূর্ণ হলো। বাংলাদেশ থেকে হঠাৎ করেই কানাডায় আসা সবকিছুই একেবারে নতুন তার কাছে। এই দুই সপ্তাহে শহরের গাঢ় নীল আকাশ, তুষারের গন্ধ, আর দূর থেকে শোনা সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ তার মন ভরে দিয়েছে। তবে মানুষের ভিড়ে ভ্যাঙ্কুভার যতই ব্যস্ত মনে হোক, শীতের আবেশে নীরবতা লুকিয়ে আছে।
প্রথম কয়েকদিন সে একাই শহরের অলিগলি ঘুরে দেখেছে, কিন্তু এখন সে একা নয় দুই জন নতুন বন্ধুর সাথে পরিচয় হয়েছে। নির্ভাণ আর জাইরান। আজ বিকেলে তিনজন একসাথে হাঁটছে। শহরের এক কোণে ছোট্ট কফিশপ থেকে গরম বেরিয়েছে তারা। রাস্তায় হাঁটার সময় তুষারের উপর জুতোর কচকচ শব্দ, মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপটা সব মিলিয়ে ঠাণ্ডা শীতের এক আলাদা অনুভূতি তৈরি করছে।
মাঝে মাঝে জাইরান তার গ্লাভস পরা হাত দিয়ে তুষারের বল গড়ে আকাশে ছুড়ে মারছে, আর নির্ভাণ হাসতে হাসতে তা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।
আরশানও ওদের দেখে হাসছে।
———
“আম্মু… আম্মু…” অর্ণব হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এসে দরজার কাছে থামল। তার কপালে ঘাম, নিঃশ্বাস অগোছালো। চোখ দুটো অস্থির হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।
মৌসুমী বেগম রান্নাঘর থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে এসে বললেন,
“কি হলো? কেন এভাবে দৌড়াচ্ছিস?”
“আম্মু… সাঁঝ… সাঁঝকে পাচ্ছি না।”
মৌসুমী বেগম চমকে উঠলেন।
“পাচ্ছিস না মানে? ও তো তোর সাথেই খেলতে গিয়েছিল মাঠে।”
অর্ণব মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ, খেলছিলাম… কিন্তু হঠাৎ দেখি ও নেই। আমি ভেবেছিলাম হয়তো পাশের দোলনায় গেছে, কিন্তু ওখানেও নেই। অনেক খুঁজেছি… কিন্তু কোথাও নেই।”
মৌসুমী বেগমের বুকের ভেতর কেমন ধক্ করে উঠল। আর দেরি না করে বেরিয়ে গেলেন।
“চল, মাঠে চল।”
দু’জনে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। গোধূলির আলো ততক্ষণে ধূসর হয়ে আসছে, চারপাশে আধো অন্ধকার। মাঠ প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে, কিছু বাচ্চা বাড়ি ফিরছে। মৌসুমী বেগম চোখ কুঁচকে চারদিক খুঁজলেন। দোলনা, স্লাইড, গাছের আড়াল সব খুঁজে দেখলেন, কিন্তু সাঁঝের চিহ্ন নেই। তিনি মাঠের আশপাশে থাকা অন্য বাচ্চাদের মায়েদের জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনারা সাঁঝকে দেখেছেন?”
সবাই মাথা নেড়ে না বলল। অর্ণবের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। মৌসুমী বেগমের মনে আতঙ্কের ঢেউ আছড়ে পড়ল। এই সময়, এই অন্ধকারে মেয়েটা কোথায় গেল? আর এক মুহূর্ত দেরি না করে তিনি সরাসরি রুনার বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। নিশ্চয়ই রুনা সাঁঝ কে নিয়ে গেছে।
দরজায় কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে রুনা বেরিয়ে এল।
“সাঁঝ কোথায়? সাঁঝ?”
রুনা ভ্রু কুঁচকে তাকাল, “সাঁঝ কোথায় আমি কী করে জানব? ও তো তোমাদের সাথেই ছিল।”
মৌসুমী বেগমের চোখে সন্দেহের ছায়া নেমে এল। “দেখো রুনা, মিথ্যা বলে কোনো লাভ নেই। সাঁঝকে তুমিই এনেছো, তাই না?”
“আমি মিথ্যা বলব কেন? হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম সাঁঝ আমার কাছে থাকুক। কিন্তু আমি ওকে লুকিয়ে আনতে যাব কেন?”
মৌসুমী বেগমের শরীর হঠাৎ ভারী হয়ে গেল। মাথা ঝিমঝিম করছে। কাছের চেয়ারে বসে পড়লেন। রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। চারপাশের শব্দ বদলে যাচ্ছে। দূরে কুকুরের ডাক, গলির শেষ মাথায় মোটরের শব্দ মিলিয়ে যাওয়া…আর এই নীরবতার মাঝেই বেড়ে উঠছে তার বুকের ভেতরের ভয়। মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেল? সাঁঝ কি নিরাপদে আছে? কেউ কি তাকে নিয়ে গেছে? নাকি…
ফোনের শব্দে চিন্তার ঘোর কাটে। স্ক্রিনে ভেসে উঠল প্রিয়ম। তাড়াহুড়ো করে রিসিভ করলেন তিনি।
“প্রিয়ম! সাঁঝকে পেয়েছো?”
“না আন্টি… পাইনি। তবে আপনি চিন্তা করবেন না, আমি থানায় গিয়ে মিসিং রিপোর্ট করে এসেছি।”
মৌসুমী বেগম ঠোঁট কামড়ে চুপ রইলেন।প্রিয়মের কথা শান্ত করার জন্য হলেও, তার বুকের ভেতরটা আরও শূন্য হয়ে গেল। এখন… আরশানকে কী বলবেন তিনি?
—–
নির্ভাণ আর জাইরান কে বিদায় দিয়ে আরশান হোস্টেলের দিকে হাঁটা শুরু করল। পকেট থেকে ফোন বের করে মৌসুমী বেগম কে ফোন করল। দুই দিন ধরে ফোন ধরছে না কেন?
মোবাইলের স্ক্রিনে আরশানের নাম ভেসে উঠতেই মৌসুমী বেগমের বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল। তার হাত একটু কেঁপে উঠল, মনে হচ্ছিল ফোন ধরার পর কী বলবেন, তা তিনি নিজেই জানেন না। তবুও কাঁপা কাঁপা আঙুলে কল রিসিভ করলেন।
“ফোন ধরছিলে না কেন, মম ?”
মৌসুমী বেগমের ঠোঁট শুকিয়ে গেল। এক মুহূর্ত চুপ থেকে ধীরে বললেন, “আরশান…”
“বলো।”
“সাঁঝকে পাচ্ছি না… দুই দিন ধরে।”
ফোনের ওপাশে কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধতা।
“দুই দিন ধরে পাচ্ছ না! আর এখন আমাকে বলছো, মম? কোথায় সাঁঝ?” আরশান আবার বলল, “মামীর বাড়িতে দেখেছো?”
“আমি তোর মামীর বাড়িতেই আছি দুই দিন ধরে। সাঁঝ এখানে নেই।”
আরশানের গলার স্বর গাঢ় হয়ে উঠল,
“মিসিং রিপোর্ট করেছো তো ?”
“হ্যাঁ… প্রিয়ম করেছে।”
ফোনের ওপাশে দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। মনে হচ্ছিল আরশান মাথার ভেতর ঝড় সামলাচ্ছে। সাঁঝ গেল কোথায়? আরশানের বুক ধকধক করতে লাগল, শ্বাস মুহূর্তে ভারী হয়ে এলো। মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতর কিছু একটা শক্ত করে চেপে বসেছে। চোখের সামনে শুধু সাঁঝের ছোট্ট মুখটা ভেসে উঠছে হাসি ভরা, দুষ্টুমিতে ভরা সেই মুখ। এতটুকু একটা মেয়ে, কোথায় যেতে পারে? ও তো এখন বিডিতেও আসতে পারবে না। এখানে কানাডা থেকে বিডি যাওয়া তো সম্ভব না এই অবস্থায়।
এখন সে কী করবে? অপেক্ষা করা ছাড়া আর যে কোনো উপায় নেই।
চলবে……