এক চিলতে প্রেম পর্ব-০৯

0
6

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_৯
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)

লাইব্রেরির ভেতরে দুপুরের নীরবতা। জানালা দিয়ে ছড়িয়ে পড়া রোদ একেকটা বইয়ের মলাটে সোনালি আভা ফেলেছে। শেলফের গায়ে গায়ে সাজানো মোটা-পাতলা, রঙিন-ফ্যাকাশে কত বই। কোনোটা যে শত বছরের পুরনো, কোনোটা আবার একেবারে নতুন। এই নীরবতার মাঝে মেহুলের চোখে পড়ে, এক কোণে দাঁড়িয়ে এলিশা কী যেনো করছে। এই মেয়ে এত মন দিয়ে শেলফের সামনে দাঁড়িয়ে হাত নাচাচ্ছে যে, মনে হচ্ছে বইয়ের সাথেই কথা বলছে। মেহুল ভ্রু কুঁচকালো। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে কড়া গলায় বলল,

“এই তুই কী করছিস?”

এলিশা হঠাৎ ঘুরে তাকাল, চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক।

“আমি দেখছি আরশান ভাইয়া কতটুকু লম্বা হয়েছে।”

এ কথা বলেই সে এক হাত মাথার ওপরে তুলল,
“এতটুকু।” মুহূর্তের মধ্যে তার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটল। তারপর আবার সে হাতটা আরও উঁচু করল, গলা টেনে বলল,

“না না, এর চেয়ে আরেকটু… এতটুকু।”

মেহুলের ধৈর্য ফুরিয়ে গেল। তার কণ্ঠে বিরক্তি ভরে উঠল, “তোর এসব বন্ধ কর, এলি।”

এলিশা বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে, উল্টো শেলফের ওপর ঠেস দিয়ে বলল,

“আমাকে কী উনার সাথে মানাবে?”

মেহুল অবাক হয়ে বলল,” এসব কী কথা বলছিস! কেন মানাবে না? পরীর মতো মেয়েটা। এত লক্ষী মেয়ে আর তুই বলছিস মানাবে না?আর এসব কথা বলবি না, বলে দিলাম।”

এলিশা মাথা নাড়াল। মেহুল বলল,

“আচ্ছা চল, এবার বেরিয়ে যাই। অনেক বইয়ের গন্ধ খেয়ে ফুসফুস ভারি হয়ে যাচ্ছে।”

এলিশা হেসে মাথা নেড়ে বলল, “চল।”

দু’জনেই ধীরে ধীরে লাইব্রেরির শান্ত পরিবেশ পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। চোখ কুঁচকে কয়েক পা হাঁটতেই সামনে খোলা মাঠটা দেখা গেল। হালকা বাতাস বইছে, কিন্তু মাঠের মাঝখানে শান্তির লেশমাত্র নেই। কারণ, ওদের ক্লাসমেট এরিক এক ছেলেকে ধরে ধাক্কা দিচ্ছে,
আর ছেলেটা বাঁচার জন্য হাত তুলে কিছু বলার চেষ্টা করছে। এরিকের চোখ-মুখ লাল, শার্টের কলার টেনে ধরা, আর মুখে সেই চেনা রাগী ভাব। তাঁর কাছে সে যা করছে, সেটাই যেনো একমাত্র সঠিক কাজ। মেহুল এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে দেখে ভ্রু উঁচু করল। তারপর হালকা গলায় বলল,

“হাফ লেডিসটার আসলে মাথার তারই ছিড়া!”

মেহুলের কথায় এলিশা মুখ টিপে হাসলো। এরিক অবশ্য ওদের উপস্থিতি খেয়ালই করল না। সে পুরো মনোযোগ দিয়ে ছেলেটাকে নিজের বক্তব্য বোঝানোর চেষ্টা করছে। তখন হটাৎ একটা ছেলে আসলো এলিশার কাছে।
ছেলেটা হাতে ভাঁজ করা কাগজ, কথা না বাড়িয়ে সে কাগজটা এগিয়ে দিল। এলিশা ভ্রু কুঁচকে কাগজটা হাতে নিল,

“এগুলো মানে কী? কে দিয়েছে?”

ছেলেটা কোনো কথা না বলে হাত তুলে ইশারা করল। সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছেলেকে দেখিয়ে দিল। এলিশা চোখ সরু করে তাকাল। ওই ছেলেটা একদম চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে , তার দৃষ্টি কেমন লাজুক। এলিশা বিরক্ত মুখে নিঃশ্বাস ছাড়ল, “আহ্‌! আবার এই ছেলেটা।”

মেহুল তখনই এগিয়ে এসে এলিশার হাত থেকে কাগজটা টেনে নিল,

“এই হাফ লেডিস ২ কী দিল? নতুন মার্কেটিং নাকি?”

এলিশা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “আমি কী জানি… তুইই খুলে দেখ।”

মেহুল হাসি চেপে কাগজটা খুলে পড়া শুরু করল।

“তুমি আমি মিললে হবে ঝালমুড়ি,
তুমি না বললে আমি খাব গরুর ভুঁড়ি।
তুমি আমার চায়ের বিস্কুট,
না বললে করবো হার্টব্রেকের শুট।
তুমি যদি বলো হ্যাঁ, আমি দেবো মিষ্টি,
না বললে আমি হবো দুঃখের ফটোকপি।”

শেষ লাইন পড়া শেষ হতেই মেহুল পেট ধরে হেসে উঠল, “সিরিয়াসলি? এটা লাভ লেটার? কবি সাহেবের তো ডাব্বা ছাপানো দরকার।”

এলিশা এক হাতে কপাল চাপড়ে বিরক্ত স্বরে বলল, “হায় আল্লাহ, এগুলো কি কোনোদিন বন্ধ হবে না?”

ওরা হাসতে হাসতে আর লেটার নিয়ে মজা করতে করতে মাঠের পাশের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল। কয়েক কদম যাওয়ার পরই এলিশার চোখে পড়ল। গেটের বাইরে গাড়ির পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সামির। মেহুলও সামিরকে দেখে মুখ বাঁকাল,

“নে, শুধু এই বান্দারই আসার বাকি ছিল।”

এলিশা গভীর নিঃশ্বাস ফেলল, চোখ সরু করে বলল, “আজকে আমি যাব না।”

মেহুল ভ্রু তুলল, “কেন? ভাইয়া তো প্রতিদিন তোকে নিয়ে যায়।”

এলিশা চটপট ফিসফিস করে বলল, “চল, কোথাও ঘুরে আসি। আজকে যেতে ইচ্ছা করছে না।”

মেহুল অবাক হয়ে বলল, “তুই কি পাগল নাকি? তোর মা যদি পরে জানতে পারে?”

এলিশা দুষ্টু হাসি দিয়ে তার হাত ধরল,
“তখন সামলাবো। তুই এখন চুপ করে আমার সাথে আয়।”

ওরা দু’জনেই চারপাশে তাকিয়ে নিল। সামির ফোনে এতটাই ডুবে যে ওদের দিকে নজরই পড়লো না। এ সুযোগে এলিশা মেহুলকে টেনে একপাশের সরু গলি দিয়ে হাঁটা দিল।
পেছন ফিরে একবার দেখল। সামির এখনও গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে, কিছু বুঝতেই পারলো না ওরা যে উধাও হয়ে গেছে।
গলি দিয়ে বেরিয়ে কিছুদূর হাঁটতেই দু’জন এসে পড়ল চেরি ব্লসমের পথের কাছে। হালকা গোলাপি আর সাদা রঙের ফুলগুলো যেনো আকাশ থেকে মেঘের টুকরো নেমে এসেছে।গাছের ডালে ডালে ঝুলে আছে অসংখ্য নরম পাপড়ি। বাতাস বইলেই পাপড়িগুলো আলতো করে ঝরে পড়ছে।
মেহুল ক্যামেরা বের করে একের পর এক ছবি তুলতে লাগল, আর এলিশা মাথা উঁচু করে আকাশ ছোঁয়া ফুলের দিকে তাকিয়ে রইল।

দু’জনে একটু হাসি-ঠাট্টা করে, ফুলের নিচে হাঁটাহাঁটি করল, কিছু সেলফিও তুলল।
কিছুক্ষণ পর মেহুল ফোনে একটা কল পেল।
“আমি যাচ্ছি, ফোন এসেছে। তুই চলে যাস।”

এলিশা হেসে মাথা নেড়ে বলল,
“যা, আমি তাহলে বাসে করেই বাড়ি চলে যাবো।”

মেহুল বিদায় জানিয়ে চলে গেল, আর এলিশা একা দাঁড়িয়ে থাকল চেরি ব্লসমের পথে। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধ উপভোগ করল, তারপর ধীরে ধীরে বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা শুরু করল। হঠাৎ দূরে চোখে পড়ল বাসটা। চলে যাচ্ছে তো।
“না, না এভাবে মিস করা যাবে না।” এলিশা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। কিন্তু কিছুদূর যেতেই বুঝল, হাঁটা দিয়ে আর হবে না, পুরো দৌড়াতে হবে। দৌড় শুরু করতেই ঠান্ডা বাতাস চুল উড়িয়ে দিল। তার চুল পুরোপুরি কালো না, সূর্যের আলোয় কিছুটা লালচে আভা বেরিয়ে আসে। দৌড়ানোর কারণে গাল লাল হয়ে উঠেছে, নিঃশ্বাস দ্রুত উঠছে-নামছে।

“ওরে হতচ্ছাড়া, আমারে নিয়ে যা বে।” এলিশা চিৎকার করে বলল।

এই বিদেশের মাটিতে বাংলার শব্দ হঠাৎ কানে ধাক্কা দিল বাসের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা আরশানের। সে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। কাঁচের জানালার ওপারে দেখল। একটা মেয়ে হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে আসছে। তার চুল বাতাসে উড়ছে, কোটের ফাঁক দিয়ে স্কার্ফ দেখা যাচ্ছে। তুলতুলে গাল দুটো কেমন লাল হয়ে গেছে। ঠোঁট কামড়ে যেনো হাওয়া গিলতে গিলতে এগিয়ে আসছে। দরজাটা প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু আরশান দ্রুত উঠে দাঁড়াল। এক হাত দিয়ে দরজার পাশে ধরে রাখল, আর অন্য হাতটা সামনে বাড়িয়ে বলল, “হাতটা ধরো।”

এলিশা এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। চোখে সেই হাতটা ধরা পড়তেই বুকের ভেতর অদ্ভুত এক স্বস্তি নেমে এল। কারো অপরিচিত হলেও সেই মুহূর্তে তার মনে ভরসা এলো।
অপরিচিত এক ছেলে, এমনভাবে ধরছে যেনো সে এক মুহূর্তের জন্যও হাত ফসকে যাবে না।
এলিশা ছেলেটার হাত ধরল। ঠান্ডায় জমে যাওয়া আঙুলে হালকা উষ্ণতা পেল। আরশান এক টানে তাকে ভেতরে টেনে নিল। দরজাটা তাদের পেছনে ঠাস করে বন্ধ হয়ে গেল। এলিশা নিঃশ্বাস নিতে নিতে তাকাল সামনের ছেলেটার দিকে। গভীর চোয়াল, বাদামি চোখ গুলো কেমন শান্ত।

“থ্যাঙ্কস।” নিঃশ্বাস সামলে এলিশা বলল।

আরশান কিছু বলল না। শুধু স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইল, চোখে কোনো বিরক্তি নেই, আবার উষ্ণতা-ও নেই। শুধু মুখে এক অদ্ভুত গম্ভীর ভাব। এলিশা বুঝে উঠতে পারল না। ছেলেটা রাগী নাকি চুপচাপ স্বভাবের। মুহূর্তের দ্বিধায় মুখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে তাকাল।

চলবে…..
Aiza Ahmed – আইজা আহমেদ