এক চিলতে প্রেম পর্ব-১১

0
5

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_১১
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)

সামির যেভাবে বর্ণনা দিয়েছিল, সাঁঝের মনে হলো ওটা নিশ্চিত এরিক। এরিক… নাম শুনলেই বিরক্তি আসে সাঁঝের। ভীষণ বাজে স্বভাবের, অহেতুক সবাইকে উত্যক্ত করা ওর নেশা। কোথায় কার কী দুর্বল জায়গা, সেটা ধরতে পারলেই কটাক্ষ করে বসবে। সাঁঝ জানে এরিক মোটেই ভালো কিছু করবে না। আর সব সমস্যার শুরু হলো তখনই, সামির যখন সাঁঝ কে পাচ্ছিলো না, তখন সে এরিক কে বলেছিল। সাঁঝের নাম শুনে এরিক বাজে কথা শুরু করে দেয়। তার এই অ’শ্লীল ইঙ্গিত আর খোঁচামারায় সামির রাগ সামলাতে না পেরে আচমকাই ঘুষি মেরে বসে এরিকের মুখে। আর সঙ্গে সঙ্গে এরিক তার সঙ্গীদের ডাকলো। পরিস্থিতি তখন ঘোলাটে। তখন মিটিং শেষে জাইরানরা বের হয়েছিল। তাদের সামনে ব্যাপারটা আরো খারাপ রূপ নিল। কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি। এরপর সবাই থানায় যেতে বাধ্য হলো।

ড্রইংরুমে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।
কেউই জোরে কথা বলছে না, কিন্তু প্রত্যেকের মুখের ভাঁজে বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা অশান্তি জমে আছে। সামিরের বাবা সেলিম সাহেব সোফার এক কোণে গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তাঁর চোখ-মুখে স্পষ্ট রাগ আর হতাশা। মুখ শক্ত হয়ে আছে, গলার শিরা ফুলে উঠেছে। পাশে বসা হেলেনা,সামিরের মা উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকাচ্ছেন। সাঁঝের মা সোফিও একপাশে চেয়ারে সোজা হয়ে বসে আছেন, তাঁর মুখেও এক ধরনের অস্বস্তি আর চিন্তার ছাপ। দুই তলার রেলিংয়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে সাঁঝ। ওর বুকের ভেতর কেমন ধকধক করছে। নিচের আলো-আঁধারি ঘরে বসে থাকা মানুষগুলোকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস হচ্ছে না। সবকিছুই তো ওর জন্য হয়েছে।

সেলিম সাহেব কর্কশ কণ্ঠে কথা শুরু করলেন।

“তুই ওই ছেলেটার সাথে লাগতে গেলি কেন, সামির? নিজে গিয়ে তো পুলিশ স্টেশনে নাম লিখিয়েছিস। তার ওপর আবার জাইরান
তোর জন্য ঝামেলায় পড়ল। লোকজন এখন আমাকে কী বলবে? আমার মান-সম্মান আর থাকলো না।”

সামির চেয়ারের ধারে বসে ছিল, কিন্তু বাবার কথা শুনে উঠে দাঁড়াল। মুখে বিরক্তি আর অস্বস্তি মিলেমিশে আছে।

“আমি কী বলেছিলাম ওদের ওখানে আসতে, বাবা? আর ওই বাজে ছেলেগুলো আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে, আমি চুপচাপ বসে থাকব? ওরা সীমা ছাড়িয়েছে, আমি সহ্য করিনি।”

কথাগুলো বের হতেই সাঁঝের বুক কেঁপে উঠলো। ও জানে, সামির যেটা বলছে সেটা পুরোপুরি মিথ্যে নয়, কিন্তু ঘটনা এমনভাবে বাঁক নিয়েছে যে এখন দোষ সব সামিরের ঘাড়েই এসে পড়ছে। হেলেনা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি জানেন, ছেলে রাগী, কিন্তু এই রাগ একদিন তাদের জন্য বড় বিপদ বয়ে আনবে।

“সামির, বাবা, তুই বুঝতে পারছিস না? এই শহরে আমাদের একটা নাম আছে। তুই যদি বারবার এমন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়িস, মানুষ আমাদের কী চোখে দেখবে?একের পর এক ঝামেলা, লোকজন তো হাসাহাসি করবে।”

সামির তখন আর শোনার মতো অবস্থায় নেই। তাঁর ভেতরে আগুন জ্বলছে।

“সবাই শুধু আমার দোষ দেখছো।”

বলেই সে রাগে চেয়ারের ধাক্কা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
ঘরের ভেতর আবার নিস্তব্ধতা নেমে এলো। সেলিম সাহেব বিরক্ত দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন।

“ছেলেকে বোঝাও, হেলেনা। আর যেন এসব না দেখি। আমার সহ্যশক্তি ফুরিয়ে আসছে।”

উপরে দাঁড়িয়ে সব শুনলো সাঁঝ। বুকের ভেতরটা কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠল। সামিরকে ও চেনে, রাগী, জেদি, কিন্তু মনের ভেতরটা নরম। ভাইয়ের মতো ওকে সবসময় আগলে রাখে। সাঁঝে ধীরে ধীরে নিজের রুমে চলে এলো। রুমটা আধো অন্ধকার হয়ে আছে। জানালার পর্দা টেনে দেওয়া। সে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় ফেলে দিলো। চোখের পাতা ভারী হয়ে এসেছে, তবু ঘুম নেই। বুকের ভেতর নানা রকম চিন্তার ঢেউ খেলছে। তার আঙুল অন্যমনস্কভাবে গলার কাছে থাকা চেইনটা স্পর্শ করলো। ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বললো সাঁঝ, “আপনার আর আমার দেখা হোক… এই অপেক্ষার প্রহর শেষ হোক…”

কখনও কখনও সাঁঝের মনে হয়, সে যেনো এখানে পুরোপুরি নিজের নয়। মনের মধ্যে অজান্তেই ভেসে উঠল পুরোনো দিনের স্মৃতি।
সেই জায়গাটা যে এখনো তার ভেতরে বেঁচে আছে। আরশান ভাইয়া , অর্ণব ভাইয়া, ফুফিদের খুব মনে পড়ে তার। তখন সাঁঝ ছোট ছিল, কিছু না বুঝলেও একটা টান তাকে টেনে রাখত সেই জায়গার সাথে। আর যখন একটু বড় হলো, বুঝতে শিখল, প্রশ্ন করতে শিখল। তখনই মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করত। মায়ের চোখের ভেতর তখন কিছু অদ্ভুত ঝড় বইতে দেখেছিল সে। কিন্তু সাঁঝ তো থেমে যায়নি। বারবার বলেছে, “চলো না মা, আমরা যাই বিডিতে। আরশান ভাইয়া, অর্ণব ভাইয়া, ফুফিদের কাছে যেতে মন চায়।”

তখনই সোফি হঠাৎ রেগে যেতেন। ফুফিদের নাম শুনলেই মায়ের চোখ লাল হয়ে উঠত, ঠোঁট শক্ত হয়ে যেত। কেন এমন হয়, তা কখনো বুঝতে পারেনি সাঁঝ। বহুবার প্রশ্ন করেছে ।
কিন্তু কোনো উত্তর আসেনি। শুধু কঠিন দৃষ্টি আর নীরবতা। সাঁঝ একবার শুধু প্রশ্ন করেনি, অনেকবার চেষ্টা করেছে বিডিতে ফেরার।

লুকিয়ে লুকিয়ে সে প্ল্যান করেছিল। কোনওভাবে টিকেট কিনবে, চলে যাবে। কিন্তু প্রতিবারই ধরা পড়ে গেছে। সবচেয়ে বড় বাধা পাসপোর্ট। ওর পাসপোর্ট সবসময় মায়ের কাছে তালাবদ্ধ। সে কারণেই আর যাওয়া হয়নি। তবে একদিন সে অবশ্যই যাবে। নিজেকে যে কথা দিয়েছে। ভাবতে ভাবতে সাঁঝর চোখ ভিজে এলো। ঠান্ডা বাতাস গাল বেয়ে নেমে যাওয়া অশ্রু শুকিয়ে দিলেও বুকের ভেতরের ব্যথাটা শুকোলো না।

————

রাত নামছে।
কানাডার বসন্তের ঠাণ্ডা হাওয়ায় রাস্তাগুলো কুয়াশার মতো ধোঁয়াটে। রোডলাইটের আলোয় ফুটপাথে নরম সবুজ পাতার ছায়া দুলছে। হালকা বাতাসে ম্যাপল পাতাগুলো ঝরে পড়ছে। এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে নির্ভাণ। কানে হেডফোন, গলায় গলা ফাটানো সুর। সে গানকে একেবারে নিজের মতো করে বাজিয়ে তুলেছে, যেনো চারপাশটা তার কনসার্ট। মাঝে মাঝে থাল মিলিয়ে আঙুল দিয়ে তালে তালে বাজাচ্ছে নিজের শরীরেই। তবুও তার ভেতর উদ্দাম খুশি।
পাশে দাঁড়িয়ে আরশান বাইকের সিটের উপর বসে ফোনে গেম খেলছে। চেহারায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। গেমে বারবার হারতে হারতে ধৈর্য শেষ হয়ে আসছে। নির্ভনের বেসুরো গলা তার মেজাজ আরও খারাপ করে তুলছে। চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

“তোর মুখটা চুপ রাখবি। মাথা ধরছে আমার।”

নির্ভাণ হেডফোন নামিয়ে চোরা হাসি দিয়ে তাকালো আরশানের দিকে।

“শা’লা, তোর সব কিছুতেই তো বিরক্তি। গান গাইলেই বিরক্তি, খেললে বিরক্তি, শ্বাস নিলেও বিরক্তি।”

তখন পাশের বড় ফুলের দোকানের কাঁচের দরজা ঠেলে বের হয়ে এলো জাইরান। তার হাতে একগুচ্ছ ফুল। মিরাবের সাথে দেখা করতে যাবে একটু পরই। নির্ভাণ দুষ্টুমি ভরা চোখে তাকিয়ে হেসে বলে উঠল,

“তুই তো ছক্কা মেরে দিলে জাইরান! আমাদের কী তোর চোখে পড়ে না? কয়দিন পর তো বিয়েই করে ফেলবি।”

জাইরান থেমে একবার ওদের দিকে তাকালো, ঠোঁটে হাসি।

“আমি কী তোদের বেঁধে রেখেছি নাকি? পছন্দ হলে করে নে।”

নির্ভাণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কণ্ঠে হালকা আক্ষেপ মেশানো স্বর।

“আজ পর্যন্ত কাউকে পেলাম না রে। কেউ যদি একটু চোখে পড়ত।”

ওর কথায় আরশান আর জাইরান হেসে দেয়। হাসিটা নির্ভনের বুকের ভেতর আরও খোঁচা দেয়। আরশান বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বলে,

“তুই এখন যা ভাই। আমরা গিয়ে কোনো লাভ নাই। কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না।”

নির্ভাণ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,

“হ্যা, তোর রোমান্স দেখে আমার বুক আরও জ্বলবে। তুই যা। শান, চল। আমরা বের হয়ে যাই।”

জাইরান ওদের কে বিদায় দিয়ে চলে যায়।
নির্ভাণ আরশানের বাইকের পিছনে উঠে বসলো। রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া মুখে এসে লাগছে। বাইক এগোতেই রাস্তার আলো একে একে পেছনে মিলিয়ে যাচ্ছিল। নির্ভাণ আবার হেডফোনটা কানে গুঁজলো।

আরশান হ্যান্ডেল ধরে বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল,

“হাত সরা নির্ভন। ঠিকমতো বসতে পারিস না নাকি? পড়ে গেলে দুজনকেই হাসপাতালে যেতে হবে।”

কিন্তু নির্ভাণ যেনো ওর কথা শুনছেই না। চিৎকার করে গান চালিয়ে যাচ্ছে, শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে গাইছে। বাইক খানিকটা দুলে উঠতেই আরশান চেঁচিয়ে বলল,

“শা’লা! তুই নিজে মরবি, সাথে আমাকেও মারবি। গান গাইতে হলে অন্তত হয়ে সোজা বস।”

চলবে…….
Aiza Ahmed – আইজা আহমেদ