এক চিলতে প্রেম পর্ব-১৪+১৫

0
4

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_১৪
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)

চারপাশে হালকা বাতাসে দুলছে গাছর পাতা। সিসাইড হাউস সমুদ্রের ধারে, পুরো বাড়িটা কাটের। তাঁর পিছনে বিস্তীর্ণ সোনালি বালির বিচ। লিভিং রুমে কোণের স্ট্যান্ডে রাখা আছে কালো কাঠের গিটার,পাশে আছে একটি গেমিং সেটআপ রুম আর কনসোল। উপরে রয়েছে তিনটা বেডরুম। বিশাল জানালা থেকে সরাসরি দেখা যায় সমুদ্রের নীল জল আর অস্তগামী সূর্যের রঙিন ছটা। সবে বাইরে সূর্য নামতে শুরু করেছে। আজকে ওরা তাঁদের আড্ডা স্থানে এসেছে। এয়ার কন্ডিশনের গুনগুন শব্দ। কিছুক্ষণ নীরবতা কাটতেই হঠাৎ গিটারের মিষ্টি সুর ভেসে উঠল। সেই সাথে নির্ভাণ পিয়ানোর সাদা-কালো চাবিতে আঙুল বুলিয়ে দিল।আরশান গিটার হাতে নিয়ে আঙুল চালাতে শুরু করেছে। আরশান ঠোঁটে ছন্দ মিলিয়ে গান ধরলো,

“তাকে খুঁজে বৃষ্টি চোখে…..
রূপকথা সে অচেনা….
ধরা দিয়েও দেয় না ধরা…
জেনেও যে রয়ও অজানা…
রয় অজানা…
কেন অজানা…”

গান শেষ হওয়ার সাথে সাথে কিচেনের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো জাইরান। তার হাতে একটা ট্রে, সাজানো স্ন্যাকস,চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আর কয়েকটা স্যান্ডউইচ। চোখে একরাশ দ্বিধা নিয়ে তখন আরশান বলে উঠল,

“এলিশা কে দেখলে মনে হয়, আমি ওকে মনে হয় চিনি। অথচ ওর সাথে এর আগে কোনোদিন পরিচয় হয়নি।”

কথাটা শুনে নির্ভাণ হেসে উঠল। “ভাই, তুই প্রেমে পড়েছিস।”

আরশানের ভুরু কুঁচকে গেল। গলায় দৃঢ়তা এনে সে বলল, “অসম্ভব।”

নির্ভাণ হেসে বলল, “কেন অসম্ভব? প্রেমের তো কোনো নিয়মকানুন নেই। হুট করে হতেই পারে।”

আরশান গভীর নিঃশ্বাস ফেলল, মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিল।

“তোরা সব জানিস আমার ব্যাপারে… আমার জীবনের কথা।”

এইবার নীরবতা ভাঙল জাইরান। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“দেখ শান, পরিস্থিতি বদলায়। সময় বদলায়। তাই বলে কি আমরা বসে থাকব? থেমে থাকব? তোর একটা জীবন আছে। এভাবে ভেতরে ভেতরে পুড়ে মরলে হবে না। আমরা কোনো কিছু ধরে রেখে বসে থাকলে তো চলবে না। তোরও একটা জীবন আছে। সামনে তোকে এগোতেই হবে।”

আরশান চোখ নামিয়ে বলল, “আমি যে দায়িত্ব নিয়েছি, সেটা কিভাবে ভুলে যাবো? সে দায়িত্ব আমি এভাবে ফেলে দিতে পারি না।”

জাইরান এবার একটু দৃঢ় স্বরে বলল,

“দায়িত্ব? কার জন্য দায়িত্ব, শান? দায়িত্বের কথা বলছিস। যার কোনো খোঁজ নেই, সে কোথায় আছে, কী করছে, এসব কি তুই জানিস? দশ বছর হয়ে গেল শান, দশটা বছর। ওকে খুঁজতে তুই কোনো চেষ্টা বাদ রাখিসনি। খবর বের করার জন্য কত কিছু করলি। কিন্তু কোনো ফল হলো? তাহলে কার জন্য এ দায়-দায়িত্ব?”

জাইরান একটু থেমে আবার বলল,

“কত বছর অপেক্ষা করবি? দশ বছর কি কম সময়? এভাবে কবে পর্যন্ত তুই নিজের জীবনকে অন্ধকারে ফেলে রাখবি? নিজের ভবিষ্যৎতের কথা ভেবেছিস একবারও? জীবন কি কেবল অপেক্ষা করার নাম? ওর জন্য তুই যতটুকু করতে পারিস, সবই করেছিস। আর কতটা? এখনও সময় এসেছে নিজের জন্য কিছু ভাব।”

আরশান প্রতিত্তোর করল না। ভেতরে হাজারটা শব্দ আটকে ছিল, কিন্তু একটাও বাইরে এলো না। উঠে দাঁড়ালো সে। কাঠের আর কাঁচের তৈরি দরজাটা ঠেলে বাইরে এলো। বাইরে বের হতেই চোখে পড়ল সেই সরু কাঠের রাস্তা
যেটা সোজা গিয়ে মিশেছে সমুদ্রতটে। সেখান থেকে দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে ঢেউয়ের আনাগোনা। আকাশটা ছিল আধো অন্ধকার, গোধূলির ছোঁয়া ছড়িয়ে আছে দিগন্তে। বাতাস সমুদ্রের বুক চিরে ধেয়ে আসছে। নোনা গন্ধে ভরে উঠেছে চারপাশ। আরশান দাঁড়িয়ে সেই বাতাসে চোখ বন্ধ করল এক মুহূর্ত। বুকের ভেতরে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো। দীর্ঘশ্বাসটা এত ভারী ছিল, মনে হচ্ছিল তার সঙ্গে বুকের সব ভাঙাচোরা আশা-অভিমান বেরিয়ে গেল। কিন্তু মন শান্ত হলো না। চোখ খুলে তাকাল আকাশের দিকে। কোথায় আছে তার ছোট্ট সাঁঝ? কেন সে আসছে না? কেন এত দূর সরে গেছে? কেন?আরশানের ঠোঁট কাঁপল আস্তে আস্তে। ফিসফিস করে বেরিয়ে এলো কিছু শব্দ,

“যাকে হারানোর ভয় সবচেয়ে বেশি… হয়তো তাকেই নিয়েই নিয়তি খেলে সবচেয়ে নির্মম খেলা।”

চোখ দুটো যেনো শূন্যে ঝুলে আছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর অদৃশ্য একটা শেকল বাঁধা, যা তাকে প্রতি মুহূর্তে টেনে ধরে রাখছে। সেই হাসির দিনগুলো ধূসর কুয়াশায় মিলিয়ে গেছে। একদিন হঠাৎ সবকিছু থেমে গেল। সে দিন থেকে আজ পর্যন্ত দশ বছর হয়ে গেল।সমুদ্রের ঢেউ ততক্ষণে তীব্র হয়ে উঠেছে। আরশান দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। বাতাস তার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে।

——-

কানাডার শরৎতের রাত। চারপাশে হালকা বাতাসে ঠান্ডার শিরশিরে স্পর্শ। গাছের পাতা ঝরে পড়ে রাস্তার উপর কার্পেটের মতো বিছিয়ে আছে সোনালি, লাল, কমলা। দূরে স্ট্রিটলাইটের হলুদ আলোয় সেই পাতাগুলো ঝিলমিল করছে। আকাশে চাঁদ অর্ধেক, তবে চারপাশের নিস্তব্ধতা একেবারে পূর্ণ। সেই রাতের নিস্তব্ধতার ভেতর, একা বসে আছে নির্ভাণ। গাড়ির ভেতরে অস্থিরভাবে হাতের আঙুলগুলো স্টিয়ারিং ঘষছে। চোখ বারবার গিয়ে থামছে সেই বাড়িটার দিকে, মেহুলদের বাড়ি। দুইতলা বাড়ি, জানালা দিয়ে আলো ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে ভেতরে হাসির শব্দ, আড্ডা, মানুষের উষ্ণতা জমে আছে, অথচ নির্ভাণ বাইরের হিমেল একাকীত্বে। তখন সময় দরজাটা খোলার শব্দ হলো। আলো ফুঁড়ে বেরিয়ে এল এক পরিচিত অবয়ব। মেহুল। কালো শাল জড়িয়ে বাইরে বের হলো ও। চুলগুলো খোলা, ঠান্ডা বাতাসে একটু এলোমেলো। গাড়ির ভেতরে বসে থাকা নির্ভাণের নিঃশ্বাস আটকে গেল। মুহূর্তের জন্য মনে হলো সময় থেমে গেছে। কিন্তু পরের মুহূর্তেই সাহস সঞ্চয় করে দরজা খুলল। হাতে সাদা লিলির তোড়া, যা মেহুলের জন্য ।
নির্ভাণ গাড়ি থেকে নেমেই ডাক দিল,”মেহুল।”

মেহুল একটু থামল, তবে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। নির্ভাণ এগিয়ে গেল কয়েক কদম।
“আরে! শুনো তো আমার কথা।”

মেহুল ঘুরে দাঁড়াল এবার। চোখেমুখে একরকম বিরক্তি,ঠোঁটের কোণে দৃঢ়তা জমে আছে।
“আপনি আমার পিছু করছেন?”

নির্ভাণ ধীরে ধীরে ফুলটা মেহুলের হাতে ধরিয়ে দিল।
“দেখো,আমি কোনো বাহানা করতে পছন্দ করি না। তাই….”

নির্ভাণ এবার গভীর দৃষ্টিতে তাকাল মেহুলের চোখে। “I love you.”

শব্দ তিনটা বাতাস কেটে বেরিয়ে এল। মেহুল তখন স্তব্ধ । হাতে ধরা সাদা লিলির ডাঁটা কেঁপে উঠছে, অথচ ওর চোখ স্থির নির্ভাণের দিকে। নির্ভাণ আর একদন্ড ও দাঁড়ালো না। বুকের ভেতর ধুকপুকানি এত জোরে বাজছিল যে মনে হচ্ছিল গোটা পৃথিবী শুনতে পাচ্ছে। তাড়াহুড়া করে গাড়ির দিকে ফিরে গেল সে। হাত কাঁপছে, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে, কিন্তু ঠোঁটে হালকা একটা স্বস্তির হাসি। কারণ অন্তত আজ সে বলতে তো পেরেছে। মেহুল এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে, নড়তে পারছে না। চোখ বিস্ময়ে ভরা, মুখে অবিশ্বাস। কানে বারবার বাজছে নির্ভাণের কণ্ঠস্বর। চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে এসেছে, অথচ মেহুলের ভেতরে কিছু একটা ভাঙছে, আবার কিছু একটা নতুন জন্ম নিচ্ছে। লিলি সাদা ফুলের পাপড়ি তখন হাওয়ায় দুলছে, সাথে মেহুলের মনও কী?

বাড়িতে ফিরে এসে নির্ভাণ অনেকক্ষণ ধরে মেহুলকে মেসেজ দিচ্ছিল। কিন্তু কোনো উত্তর আসছিল না। নোটিফিকেশনের আলো কয়েকবার জ্বলে উঠে নিভে গেছে, অথচ রিপ্লাই আসেনি। একসময় বিরক্ত হয়ে নির্ভাণ ফোনটা টেবিলে ছুঁড়ে রাখলো।

অন্যদিকে, সাঁঝ তখন ছোট্ট নুটিকে খাবার দিচ্ছিল। নুটি খেতে খেতে দুষ্টুমি করছে, বাদাম মুখে নিয়ে আবার এদিক-ওদিক দৌড়াচ্ছে। সাঁঝ হেসে ওকে খাওয়াচ্ছিল। ফোনের শব্দে তখন সাঁঝ তাকালো। ভেবেছিল হয়তো কোনো গ্রুপ নোটিফিকেশন। কিন্তু খুলে দেখে হতবাক হয়ে গেল। নির্ভনের মেসেজ। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, নির্ভন গ্রুপে লেখেনি। সরাসরি ওর আইডিতে দিয়েছে। “মেহুলের নাম্বারটা পাওয়া যাবে?” সাঁঝ হাসলো। তাহলে এই ব্যাপার। নির্ভাণ ভাইয়া এখন মেহুলের প্রেমে পড়েছে। একটু ভেবে নাম্বারটা দিল সাঁঝ।

হঠাৎ কী মনে করে নির্ভনের প্রোফাইলে ঢুকে পড়লো। নির্ভাণের ছবিগুলো ঘেঁটে দেখতে লাগলো, কিন্তু বিশেষ কিছু নেই। অকারণে স্ক্রল করতে করতে হঠাৎই নজর গেল আরশানের প্রোফাইলে। সাঁঝ প্রথমে অবাক হলো নামটা দেখে। তবে আবার ভাবলো এই নামে তো অনেকেরই থাকতে পারে। তবুও কৌতূহল বশে প্রোফাইলে ঢুকলো। প্রোফাইল পিকচারে দেখা গেল, আরশান অফিসের চেয়ারে ফরমাল স্যুট পরে বসে আছে। সাঁঝ দেখে ভেঙছি কাঠলো। একে একে ছবি বদলাতে থাকলো। আরশানের বিভিন্ন মুহূর্ত ধরা আছে ছবিগুলোতে। কোথাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি, কোথাও জাইরান আর নির্ভাণের সঙ্গে আড্ডা। তবে হঠাৎ সাঁঝের হাত থেমে গেল। চোখ স্থির হয়ে গেল স্ক্রিনে। শ্বাস আটকে এলো বুকের ভেতর। স্থির হয়ে রইল। ছবিটায় একটা ছেলে আর ছোট্ট এক মেয়ে বসে বায়োস্কোপ দেখছে। ছোট্ট মেয়েটা তো সে নিজেই। আর পাশে যে ছেলেটি… সে তো আরশান। সাঁঝ আবার ভালো করে দেখলো। এটা তো তাঁরই ছবি। বুকের ভেতরটা মোচড় দিতে লাগলো। এ কেমন সত্যি? এতদিন তার সামনেই ছিল, অথচ সে চিনতেই পারলো না।
চোখ ভিজে এলো সাঁঝের। সে তাড়াতাড়ি নাম্বার ডায়াল করল নির্ভাণকে। ফোন ধরতেই নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁপে ওঠা কণ্ঠে বলে উঠল,

“আচ্ছা ভাইয়া… আপনারা যাকে শান বলে ডাকেন, উনার পুরো নাম কী শেরহাম আরশান আর তাঁর কী কোনো ছোট ভাই আছে?”

নির্ভাণ অবাক হলো হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে।
“ওর ছোট ভাই আছে আর শানের ফুল নেইম এটাই।”

সাঁঝের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো। ভয় আর কৌতূহল মিলেমিশে তার গলার স্বর ভেঙে গেল,
“নামটা… নামটা বলবেন?”

এক মুহূর্ত চুপ থেকে নির্ভাণ বলল, “অর্ণব।”

সাঁঝের চোখের জল থামছেই না। বুকের ভেতর ধড়ফড়ানি যে বেড়ে গেল। তবু শেষ নিশ্চিত হতে সে আবার কাঁপা কণ্ঠে বলল, “উনার মায়ের নামটা… জানেন?”

নির্ভাণ আরও অবাক হয়ে গেল। সাঁঝ কেন এত অদ্ভুত প্রশ্ন করছে? কেন শানের এত কিছু জানতে চাইছে? তবুও মাথায় যতটুকু মনে পড়ল, বলল, “সম্ভবত…. মৌসুমী হবে।”

মুহূর্তেই সাঁঝ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ফোনের ওপাশে তার কান্নার শব্দ স্পষ্ট ভেসে গেল। ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠল সাঁঝ । এতদিনের বুকচাপা অপেক্ষা, হারিয়ে ফেলার বেদনা, আর খুঁজে পাওয়ার বিস্ময়। সব একসাথে বেরিয়ে আসছে। হটাৎ সাঁঝের কান্নায় নির্ভাণ হতবাক হয়ে গেল।

“আরে, তুমি কান্না করছে কেন? আমি কী কিছু ভুল বলেছি ?”

সাঁঝ কোনো উত্তর দিল না। তার গলা আটকে গিয়েছে। চোখের জল থামছে না। কেবল একটা ঘুরছিল মাথার ভেতর। এটাই যে তার আরশান ভাই। সে তো কতদিন ধরে আরশানকে সামনে দেখেছে। একসাথে তর্ক করেছে, ঝগড়া করেছে, বিরক্তি প্রকাশ করেছে অথচ সে জানতেই পারেনি। আর দেরি করল না। সাঁঝ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। বুকের ভেতর ঢেউ খেলে যাচ্ছে। চোখ দু’টো এখনো ভিজে, কিন্তু মুখে খুশির ঝিলিক। দীর্ঘদিনের খুঁজে পাওয়ার আনন্দ, কাছে পাওয়ার অনুভূতি তাকে আলোড়িত করছে। সে এক দৌড়ে দরজা খুলে বের হয়ে গেল। তাড়াহুড়োয় প্রায় হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে দেয়ালে হাত ঠেকিয়ে নিজেকে সামলাল। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল, তবুও পা থামাল না।

সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নিচে নেমে এল। বসার ঘরে নামতেই চোখে পড়ল। সোফায় হেলেনা, সোফি আর সামির বসে আছে। সাঁঝ থেমে গেল, তবু খুশি চেপে রাখতে পারল না।

“মা! আমি… আমি আরশান ভাইকে খুঁজে পেয়েছি। আমি এখনই উনার কাছে যাচ্ছি।”

“আর এক পাও বাড়াবি না। নাহলে ওই ছেলের লাশ ওখানে পড়ে থাকবে।”

সাঁঝের পা দু’টো থেমে গেল। বুকের ভেতর ধপধপ করছে, গলা শুকিয়ে গেল। নির্বাক হয়ে গেল মুহূর্তের জন্য। সাঁঝ চোখ ফেরাল সোফির দিকে। সবচেয়ে অদ্ভুত কিন্তু আরও ভয়ের বিষয়, সোফি একদম নির্লিপ্ত। মুখে কোনো বিস্ময় নেই, কোনো প্রতিবাদ নেই। যেনো সামিরের কথাটা খুব স্বাভাবিক। সাঁঝর বুকটা কেঁপে উঠল। হতাশা আর ভয়ের ঢেউ মিশে গেল কণ্ঠে। “মা….”

“এলি ,উপরে যা।” সামির গলা শক্ত করে বলল।

সাঁঝ এক পা-ও নাড়ল না।

“কেন যাবো আমি? কেন যাবো? আর শুনে রাখো উনাকে আঘাত করার আগে আমাকে আঘাত করবে।”

সাঁঝ ঘুরে তাকাল সোফির দিকে। সে কাঁপা কণ্ঠে বলল, “আম্মু … কেন এমন করছো? কেন বাধা দিচ্ছো? ওদের প্রতি এত রাগ কেন ? আমাকে যেতে দাও প্লিজ।”

সোফি কিছুক্ষণ চুপ রইল। তারপর দৃঢ় গলায় বলল, “এলি ! বললাম তো ওদের কাছে যাবি না। ওদের ভুলে যা। ওদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। ওরা আমাদের জন্য নেই।”

“আমি ভুলতে পারবো না, আম্মু। আমার পক্ষে সম্ভব না। তুমি ভুলে যেতে পারো, কিন্তু আমি পারি না। কেন আমার সাথে এমন করছো তোমরা? কেন আমায় অন্ধকারে রেখে দিলে? কেন ওদের প্রতি এতটা ঘৃণা?”

সামির দাঁত চেপে উঠে এল সামনে। মুহূর্তের মধ্যে হাত তুলে সাঁঝের গালে চড় কষিয়ে দিল।
সাঁঝ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সামিরের দিকে।

“তোর সাহস দেখছি দিন দিন বাড়ছে। মুখে মুখে তর্ক করছিস? কার সামনে কী বলছিস বুঝিস না?”

সাঁঝ কেঁদে ফেলতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই হেলেনা দ্রুত এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। আলতো করে চোখের জল মুছে দিয়ে শান্ত স্বরে বলল, “চল, মা… আমরা উপরে যাই।”

হেলেনার হাত ধরে সাঁঝ ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল।সে ধীরে ধীরে সাঁঝকে বিছানায় শুইয়ে দিল। কোমল হাতটা কপালে রাখল, মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,

“মায়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে, এলি? এভাবে আর বলিস না। সকালে নেমে গিয়ে স্যরি বলবি, বুঝেছিস?”

সাঁঝ ঠোঁট কামড়ে একটু চুপ করে রইল। তারপর নিচু স্বরে বলল,

“ঠিক আছে… কিন্তু আম্মু, কেন কিছু বলে না?

“আমরা এটা নিয়ে আরেকদিন কথা বলব। এখন ঘুমিয়ে পড়।”

হেলেনা সাঁঝের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল, কিন্তু সাঁঝের চোখে ঘুম নামলো না। ওর বুকের ভেতর অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছিল।
ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নিলো সাঁঝ। স্ক্রিন জ্বলে উঠতেই চোখে পড়ল আরশানের ছবি। ছবিটার উপর হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। কতক্ষণ যে এইভাবে কেটে গেল, সাঁঝ খেয়ালই করেনি। যখন ঘড়ির দিকে তাকালো, তখন বারোটার কাঁটা পেরিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছে গিয়ে কান পাতলো। পুরো বাড়ি ঘুমিয়ে আছে। সাবধানে দরজা খুলে করিডোরে বের হলো। অন্ধকারে করিডরটা পেরিয়ে ধীরে ধীরে গ্যারেজে পৌঁছাল। সেখানে কোণে রাখা সাইকেলটা টেনে বের করল সাঁঝ । হঠাৎ চোখ নামিয়ে দেখল। পায়ে কোনো জুতা নেই। খালি পা। এক মুহূর্তের জন্য ভেবে নিল আবার ঘরে গিয়ে স্যান্ডেল নিয়ে আসবে, থাক,খালি পায়েই যাই। সাইকেল দিয়ে আরশানের বাড়ি পৌঁছাতে অন্তত বিশ মিনিট লাগবে। সাঁঝ মুচকি হাসলো। আজকে আরশানকে একটু জ্বালানো যাক।

#চলবে…….

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_১৫
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)

সাইকেলের প্যাডেলে ধীরে ধীরে চাপ দিল সাঁঝ। রাতের এই নিস্তব্ধতা বুকের ভেতরে অদ্ভুত ভয় লাগছে । চারপাশের অন্ধকারে রাস্তার দুপাশের গাছগুলো আরও গা ছমছমে লাগছিল। সাঁঝ একটু থামল। সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে একবার চারপাশে তাকাল। রাত তো অনেক হয়েছে, এরকম শূন্য রাস্তায় একা থাকাটা মোটেও স্বস্তিদায়ক না। এখন একটু ভয় লাগছে। সাথে যদি তাঁর নুটি কে নিয়ে আসতো অত্যন্ত ভয়টা কম লাগতো। ফোনটা ও তো আনেনি।
“নাহ, ভয় পেলে চলবে না।” সাঁঝ নিজেকে বোঝালো। এসব ভেবে দাঁড়িয়ে থাকলে তো আরো বেশি ভয় লাগবে। গভীর শ্বাস নিয়ে সাইকেলটা আবার চালাল সে। চাকা ঘোরার শব্দ শুনে মনে হলো, এই নির্জনতায় শব্দটা অনেক বেশি স্পষ্ট। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সামনের দিকটা চেনা লাগতে শুরু করল। এটাই তো আরশানের বাড়ির । বুকের ভেতর চাপা দুশ্চিন্তার বদলে হালকা স্বস্তি ঢুকে পড়ল।
“অবশেষে এসে পড়লাম।” সাঁঝ ফিসফিস করে বলল, ঠোঁটে একটু স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল।
কিন্তু বাড়ির সামনে এসে থমকে গেল সে। উঁচু লোহার গেইট ভিতর থেকে বন্ধ।

“এখন ভেতরে যাব কিভাবে?” সাঁঝের ভ্রু কুঁচকে গেল। সাইকেলটা গেইটের পাশে ঠেকিয়ে দাঁড়াল। গেইটের ওপর হাত রেখে ঠেলল, কিন্তু সেটা শক্ত করে লাগানো। মুহূর্তেই আতঙ্ক আবার ভর করল মনে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাটাও তো নিরাপদ নয়। সে চারপাশ তাকাল। চোখে পড়ল গেইটের পাশের উঁচু দেয়াল। এখন একটাই উপায়,ওই দেয়াল টপকে ভেতরে ঢোকা। সাঁঝ গেইটের একপাশে গা লাগাল। হাত দিয়ে দেয়ালের খসখসে গায়ে ভর দিল। হাত দিয়ে উপরে আঁকড়ে ধরল, পা দিয়ে দেয়ালের ছোট ছোট ফাঁক খুঁজে ভর দিল।
প্রথমে ব্যালেন্স রাখতে কষ্ট হচ্ছিল। হাত পিছলে যাচ্ছিল। শরীর কেঁপে উঠল, মনে হলো যেনো নিচে পড়ে যাবে। কিন্তু দাঁত চেপে আরও জোর দিল। একসময় পায়ের আঙুলে ব্যথা সত্ত্বেও জোর করে টেনে তুলল নিজেকে। ধপাস করে নামল অন্যপাশে। শব্দটা তীক্ষ্ণভাবে প্রতিধ্বনিত হলো। সে এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কেউ টের পেল কিনা শোনার জন্য। “হুঁশ..অবশেষে ঢুকলাম।”স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল সাঁঝ। বড় দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই সেই স্বস্তি কিছুটা ফিরে এলো। দরজাটা কালো রঙের, আরশানের মতোই গম্ভীর । দুস্টু হাসলো সাঁঝ। হাত বাড়িয়ে কলিংবেলের বোতামে চাপ দিল ।

আরশান তখন গভীর ঘুমে ছিল। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে শরীরটা বিছানায় ঢলে পড়েছিল। কিন্তু হঠাৎ কলিং বেলের টুংটাং শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। চোখ কচলাতে কচলাতে বিরক্তি নিয়ে উঠে বসল। রাত প্রায় একটার উপরে। এত রাতে কে আসতে পারে? মনে হলো হয়তো নির্ভাণ এসেছে, ও তো মাঝে মাঝেই আসে। তবে ফোন দিলেই তো পারতো। বিরক্তিভাবটা কাটলো না। ভারী পা টেনে নিচে নামলো। হলঘর পেরিয়ে দরজার কাছে আসতেই দেখলো, কলিং বেল একটানা বাজছেই। নিরন্তর বাজিয়েই চলেছে ধৈর্য নেই একটুও। রাগে আরশানের ভ্রু কুঁচকে উঠলো। দরজা খুলে বলল,

“নির্ভাণ তোকে….”

আর বলতে পারলো না। সামনে সাঁঝ কে দাঁড়িয়ে থাকতে থমকাল। তাও আবার এত রাতে। আরশান বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর গম্ভীর গলায় বলল,

“তুমি! এখানে এভাবে? এত রাতে? আর… গেইট তো বন্ধ ছিল। ঢুকলে কিভাবে?”

সাঁঝ গভীর দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আরশানকে। সদ্য ঘুম ভাঙার অচেনা ক্লান্তি এখনও ভেসে আছে চোখে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের ওপর নেমে এসেছে।চওড়া কপাল আংশিক ঢেকে রেখেছে ছোট ছোট ঝরে পড়া গোছা। বিরক্তির ছাপ গাঢ় হয়ে ফুটে উঠেছে তার মুখে, তবু সেই বিরক্তি যে এক অদৃশ্য টান তৈরি করছে। যেখানে সাঁঝের চোখ আটকে গেল অজান্তেই।

“দেওয়াল টপকে এসেছি।”

আরশানের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। মুখে স্পষ্ট অবিশ্বাস।
“কিহ! দেওয়াল টপকে?”

একটা মেয়ের পক্ষে রাতদুপুরে এমনটা করা শুনতেই অদ্ভুত লাগছে। কিছুক্ষণের জন্য আরশান হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর চোখ সরু করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে।

“সত্যি বলছো? এত রাতে দেওয়াল টপকে এসেছো আমার বাসায়? মাথা খারাপ নাকি?”

“শুনুন,আমি একটা বিপদে পড়েছি। কোথায় যাবো বুঝতে পারছিলাম না। তাই… এখানে চলে এলাম।”

আরশান ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকাল। বুকের ভেতরে সন্দেহের ছায়া ঘনীভূত হতে লাগল। এত রাতে, এভাবে, দেয়াল টপকে? কোনো না কোনো ঘাপলা তো আছেই।

“তুমি কি ভাবছো আমি এতটা বোকা? সোজা কথা বলো, এত রাতে আমার বাড়িতে আসার আসল কারণটা কি? আর সামনের বাড়িতে তো তোমার বোন থাকে। ওখানে যেতে পারতে। ওখানে না গিয়ে আমার এখানে কেন?”

সাঁঝ বিরক্ত হলো। এই ছেলেটা এত প্রশ্ন করছে কেন? তারপর বলল,

“এত রাতে ওখানে গেলে খারাপ দেখাবে না? সবাই কি ভাববে?”

আরশান ঠোঁট বাঁকিয়ে বিদ্রুপের হাসি দিল, চোখ দুটো আরও সরু হয়ে গেল।

“ওহ্‌! তাই নাকি? তাহলে একা একটা ছেলের বাড়িতে এলে বুঝি খারাপ দেখায় না? তাও এত রাতে।”

আরশান এবার সাঁঝের কাছে ধীরে ধীরে এগিয়ে ফিসফিস করে বলল,

“এই মুহূর্তে এখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই। যদি আমি… কিছু করে ফেলি?”

আরশান ভাবলো তাঁর কথায় ভয় পাবে কিন্তু সাঁঝ ভয় পেল না হঠাৎ হেসে উঠল। চোখে দুষ্টুমি, ঠোঁটে খেলার ছোঁয়া। যেনো আরশান মজার কিছু বলেছে। একেবারে অপ্রত্যাশিত সেই হাসিতে আরশানের মুখের রাগ মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। সাঁঝ দুষ্টু হেসে আরশানের গাল টেনে বলল,

“আপনি না ভালো ছেলে। এখন সরুন তো।”

অপ্রস্তুত হয়ে আরশান সামান্য সরে দাঁড়াতেই সাঁঝ দ্রুত ভেতরে ঢুকে পড়ল। লম্বা করিডোরের দিকে এগিয়ে গেল। সাঁঝ ধাক্কা মেরে ভেতরে ঢুকতেই আরশান একরকম অবাক হয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। ঢুকেই চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল সাঁঝ। বাড়িটা বেশ সুন্দর।বড় হলঘর, দেয়ালে নরম আলো জ্বলে আছে। সাঁঝ ঠোঁট কামড়ে চারপাশ দেখল। তারপর হঠাৎই আরশানের দিকে ঘুরে বলল,
“তো আমি কোন রুমে থাকবো?”

আরশান বিরক্ত চোখে তাকাল। তার মুখভঙ্গিতে স্পষ্ট মেয়েটার বেপরোয়া ভাবটা তাকে মোটেও ভালো লাগছে না। কোনো উত্তর না দিয়ে গম্ভীর মুখে হাঁটা শুরু করল সিঁড়ির দিকে। সাঁঝ আবারও হাসল। কথা বলতে বলতে সেও পিছু নিল। দুজন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে। সে হাত উঁচু করে দেখল তার মাথা আরশানের প্রশস্ত বুক পর্যন্ত। আবার পেছনে হাত মিলিয়ে তুলনা করল তার সরু হাতটি আরশানের বলিষ্ঠ বাহুর সামনে ক্ষুদ্র। মিষ্টি হাসলো সাঁঝ। হঠাৎ করেই আরশান থেমে গেল। সাঁঝ ঠিক তখনই অসাবধানে ওর পিঠে গিয়ে ধাক্কা খেল।
আরশান সরু চোখে তাকাল ওর দিকে। ঠাণ্ডা গলায় বলল,

“এসব কী হচ্ছে?”

“কিছু হয়নি তো। আপনি এমন চোখ বড় করছেন কেন?”

আরশান বিরক্ত হয়ে একদম সামনে হাঁটা শুরু করল। করিডোর পেরিয়ে একটা রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে দেখাল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। কিন্তু সাঁঝ দাঁড়িয়ে রইল। রুমের ভেতরে যাওয়ার বদলে তার কৌতূহলী চোখ অন্যদিকে ঘুরে গেল। একপা, দু’পা এগিয়ে বড় একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল সে। দরজাটা অন্য ঘরগুলোর থেকে একটু আলাদা আর গায়ে হালকা বাদামি রঙ। সাঁঝ নিজের মনে ফিসফিস করে বলল,”হয়তো এটাই আরশানের রুম।”

চোখে ঝিলিক খেল কৌতূহলের। হাত বাড়িয়ে দরজাটা ছোঁয়ার আগেই হঠাৎ পিছন থেকে একটা টোকা পড়ল কাঁধে।

“উফফ… বিরক্ত করিস না তো।”

কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরে থমকে দাঁড়াল। মাথা ঘুরিয়ে দেখল ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে আরশান। দৃষ্টিটা এতটা কাছ থেকে পড়তেই সাঁঝের চোখ বড় হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঠোঁটে ভ্যাবলার মতো এক হাসি ফুটিয়ে তুলল।

“ওহ… আপনি।”

আরশানও একই ভাবে হাসলো। তারপরই সন্দেহ চোখে তাকাল। করিডোরের নরম আলোয় দুজনের চোখ একে অপরের চোখে আটকে রইল। সাঁঝ মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলল,
“আসলে… আমি শুধু দেখতে চাচ্ছিলাম… আপনার রুমটা কেমন।”

আরশান ধীরে ধীরে হাসিটা চাপা দিল, কণ্ঠে গম্ভীরতা ফিরিয়ে আনল,

“আমার রুম দেখে কী করবে?”

সাঁঝ এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, “আমি যাই।”

আর পিছনে ফিরে তাকাল না। ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। আরশান ও নিজের রুমে গেল।

ভোরের আলো তখন পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়ছে।সারারাত জেগে ছিল নির্ভাণ। গাড়ির জানালায় শিশির জমে সাদা হয়ে উঠেছিল কাচ।হেডলাইট বন্ধ, ইঞ্জিনও নিস্তব্ধ। শুধু সে আর তার অস্থির হৃদস্পন্দন। মেহুল ফোন ধরেনি। একবার, দু’বার নয়, অসংখ্যবার কল দিয়েও প্রতিবার একই নীরবতা। ভোরের আলো ফুটতেই পাখিদের ডাক ভেসে এলো। নির্ভাণের চোখ লাল হয়ে উঠেছিল জাগরণের যন্ত্রণায়। সে গাড়ির সিটে কুঁজো হয়ে বসে, জানলার ফাঁক দিয়ে একনাগাড়ে তাকিয়ে ছিল। অবশেষে গেইট খুলে গেল। সাদা রঙের সালোয়ার পরে বেরিয়ে এল মেহুল। ঘুম ভাঙা মুখ। নির্ভাণ এক মুহূর্ত দেরি না করে গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেল। মেহুল থমকে দাঁড়াল। বিস্মিত চোখে তাকাল তার দিকে।

“আপনি?”

নির্ভাণ একরাশ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মৃদুস্বরে বলল,

“তোমার উত্তর তো পেলাম না। ”

নির্ভাণের কথা শেষ হতে না হতেই পেছন থেকে বজ্রের মতো গর্জে উঠল কণ্ঠস্বর,

“এই রাবিশ! তুই এসেছিস কেন এখানে?”

নির্ভাণ দাঁত বের করে বলল, “এই ফাগুনী পূর্ণিমার রাতে… চল পলাইয়ে যাই।”

কথার সঙ্গে সঙ্গেই নির্ভাণ হঠাৎ মেহুলের হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিল। মুহূর্তেই তার দৌড় শুরু। মেহুল প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ছুটে চলল তার সাথে। বাতাস উড়িয়ে নিয়ে গেল মেহুলের ওড়না। নিকোও দৌড় দিল সাথে চিৎকার করে বলল,

“আমার বোনকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস, রাবিশ?”

রাস্তা ফাঁকা, কিন্তু পরিস্থিতি উত্তপ্ত। নির্ভাণ প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে, মেহুলের বুক ধুকপুক করছে, চোখ ভরে উঠছে জল। হঠাৎই সে তার হাত টেনে ছাড়িয়ে নিল।

“কি করছেন আপনি! হাত ছাড়ুন।” শ্বাস নিতে নিতে দাঁড়াল সে। তারপর বলল,
“আপনাকে মিথ্যা আশা আমি দিতে চাই না। আমার পক্ষে সম্ভব না। ভুলে যান আমাকে।”

নির্ভাণ থমকে দাঁড়াল। চোখ জ্বলছে তার, অথচ দৃষ্টি ভিজে।”মেহুল…”কেবল নামটুকুই উচ্চারণ করল, সেই নামের মধ্যে তার সমস্ত দুঃখ-আকাঙ্ক্ষা বন্দি।

“আমাকে একবারও সুযোগ দেবে না? মেহুল।”

ততক্ষনে নিকো হাপাতে হাপাতে এসে দাঁড়াল। ঘাম ঝরছে তার কপাল বেয়ে। কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,

“আর এখানে আসবি না, বুঝলি।”

মেহুল নিকোর দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙাল।
“তোকে না বলেছি এভাবে আর কথা বলবি না।”

মুহূর্তটুকু নিস্তব্ধ হয়ে রইল। নির্ভাণ শুধু শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে মেহুলের দিকে। কিন্তু মেহুল কোনো উত্তর না দিয়ে ধীরে ধীরে নিকোর হাত ধরে চলে গেল।

চলবে….