#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_১৮
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)
বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক আগেই।বাইরে আকাশে হালকা ধোঁয়াটে মেঘ ভাসছে, মাঝে মাঝে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে জানালার কাঁচ কাঁপিয়ে দিচ্ছে। জানলার কাঁচ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানির ফোঁটাগুলো এখন শুধু ভেজা দাগ হয়ে আছে। বাইরে হালকা বাতাস বইছে, গাছের ডালপালা নড়ে উঠছে মাঝে মাঝে।
সাঁঝ ধীরে ধীরে ওয়াশরুমের দরজা খুলে উঁকি দেয়। ভেতরে ভিজে থাকা চুল কাঁধে লেপ্টে আছে, মুখে হালকা পানির ফোঁটা চকচক করছে । চোখে-মুখে দ্বিধা আর একটু অস্বস্তি, কারণ বাইরে আসার মতো শুকনা কাপড় তার হাতে নেই। চোখ পড়ে আরশানের দিকে। সাঁঝ একটু ইতস্তত করে, তারপর নিচু স্বরে বলে ওঠে,
“আমি কী পড়বো?”
আরশান তখন বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোনে স্ক্রল করছে। ফ্ল্যাশলাইটের মতো নীলাভ স্ক্রিনের আলো ওর মুখের উপর পড়ছে। সাঁঝের কণ্ঠ শোনা মাত্রই হাতের মোবাইল থামিয়ে তাকায়। চোখের দৃষ্টিতে সামান্য বিস্ময়। মেয়েদের কাপড় এখন সে কই পাবে? মুহূর্তের মধ্যে মাথায় ঘুরে যায় একগাদা চিন্তা। কিছু না বলে উঠে দাঁড়ায় সে। কাবাডের দিকে এগিয়ে যায়,কয়েক সেকেন্ড পর কাবাড থেকে একটা ঢিলেঢালা সাদা শার্ট আর গাঢ় রঙের ট্রাউজার বের করে। সাঁঝ তখনও দরজার ফাঁকে দাঁড়িয়ে। ভেজা চুলের গোছা কাঁধ বেয়ে নেমে আসছে, মুখের পাশে আটকে আছে ভিজে চুল।আরশান এগিয়ে আসে,তার হাতে বাড়িয়ে দেয়।
“আপাদত এটা পরে নে।”
সাঁঝ যখন ওয়াশরুম থেকে বের হলো, তখন রুমটা ফাঁকা।আরশান নেই, হয়তো নিচে গেছে।
সাঁঝ পা টিপে এগিয়ে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে। শার্টটা তার গায়ে ঢিলেঢালা, হাতার প্রান্ত প্রায় আঙুল ঢেকে ফেলেছে। শার্ট থেকে ভেসে আসছে পুরুষয়ালি ঘ্রাণ। যা অজান্তেই সাঁঝের ভেতরে শিহরণ জাগিয়ে তুললো। ঘ্রাণটা যেনো ধীরে ধীরে তাকে ঘিরে ধরছে। সাঁঝ শার্টের কলারটা আলতো করে মুখের কাছে নিয়ে আসে। একবার, দু’বার গভীরভাবে শ্বাস নেয়। বুক কেঁপে ওঠে। হৃদস্পন্দন একটু বেড়ে যায়। সাঁঝ চোখ বুজে ফেলে। মুহূর্তের জন্য মনে হয়, আরশান এই ঘরেই আছে, খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সাঁঝ আয়নায় তাকায় আবার। শার্টের ভেতরে ঢাকা শরীরটা কেমন নার্ভাস।ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি চলে আসে। সাঁঝ নিজের সাথে আস্তে করে ফিসফিস করে বলে ওঠে,”নাহ, মন্দ লাগছে না একেবারেই। বরং… কেমন যেন ভালোই লাগছে।”
তখন টেবিলের ওপর রাখা সাঁঝের ফোনটা কেঁপে ওঠে। সাঁঝ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাল। সোফি ফোন দিয়েছে। মুহূর্তেই গলার ভেতর শুকনো একটা দলা জমে গেলো।
মা নিশ্চয়ই চিন্তায় পাগল হয়ে গেছে। এই সময়ও বাড়ি ফেরেনি সে। কিন্তু সে তো এখন আরশানের বাড়িতে। কিছুক্ষণ দ্বিধায় কাটালেও শেষ পর্যন্ত কল রিসিভ করল সাঁঝ। ওপাশ থেকে সোফির কণ্ঠ উদ্বেগে,
“এতক্ষণ ধরে কোথায় আছিস এলি? বাড়িতে আসলি না কেন?”
“আমি মেহুলদের বাসায় আছি, মা। তুমি দুশ্চিন্তা করো না।”
কথাটা বলতেই বুকের ভেতর কেমন খচখচ করছে। সে জানে, এটা মিথ্যে। তবু আর যে কোনো উপায় নেই।
“মেহুলদের বাসায়? আচ্ছা… তুই ঠিক আছিস তো? কোনো সমস্যা হয়নি ?”
সাঁঝ ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখ বন্ধ করল। কী বলবে? সত্যিটা বলার মতো সময় নয়। মায়ের দুশ্চিন্তিটুকু কমানোর জন্য হলেও মিথ্যে বলতে হবে। ধীর কণ্ঠে সে জবাব দিল,
“হ্যাঁ মা, আমি ঠিক আছি। আমি সকালে চলে আসব।”
“আচ্ছা।”
ফোন কেটে দেয় সাঁঝ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা ধীরে টেবিলে রেখে দিল। টুপটাপ পায়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। আরশান এতক্ষন নিচে কী করছে? সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো সাঁঝ। নিচে নেমেই চোখে পড়ল ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে আরশান। টেবিলের ওপর একে একে গরম ধোঁয়া ওঠছে। সাঁঝের ক্ষুধার্ত শরীরকে এক মুহূর্তে নাড়া দিয়ে উঠল।আরশান সাঁঝকে নামতে দেখে তার চোখ হঠাৎ থেমে গেল। এক মুহূর্ত স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল। সাঁঝ পরেছে তারই শার্ট, শরীরের গড়নের তুলনায় সেটা বেশ ঢিলা। তবুও সেই অগোছালো ভঙ্গিতেই সাঁঝকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। সাঁঝ কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। চোখ নামিয়ে টেবিলের একপাশে বসে পড়ল।
দু’জন পাশাপাশি বসে খেতে শুরু করল।
সাঁঝের মনে হচ্ছিল, এ মুহূর্তটা থেমে যাক, আর কখনও যেন শেষ না হয়। খাওয়া শেষ হলে আরশান প্লেটগুলো হাতে নিয়ে কিচেনে চলে গেল। সাঁঝ উঠে গিয়ে সোফায় বসল, নরম কুশনে শরীর ডুবিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর আরশানও ফিরে এসে তার পাশে বসল। সাঁঝ এক মুহূর্ত দ্বিধা করল, তারপর নিঃশব্দে মাথা রাখল আরশানের কাঁধে। এক হাত বাড়িয়ে আরশান সাঁঝের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।আঙুলগুলো স্নিগ্ধ স্পর্শে সাঁঝের চুলের ভেতর দিয়ে বয়ে গেলো। সাঁঝের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আরশান বলল,”আমি তো ভেবেছিলাম এত বছর না দেখে ভুলে যাবি।”
সাঁঝ চোখ বন্ধ করে মৃদু হেসে বলল,
“দেখিনি তো কী হয়েছে? মনে তো ছিলেন। আমার কল্পনায় আপনি সবসময় ছিলেন, একটুও ফিকে হননি।”
আরশানের ঠোঁটের কোণে নরম হাসি ফুটল। সে সাঁঝকে আরও কাছে টেনে নিল। সে মাথা ঝুঁকিয়ে সাঁঝের মাথার ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো।
——–
মেহুল বসে আছে সোফার এক কোণে। তার হাতদু’টো হাঁটুর উপর আলগোছে রাখা, চোখ দু’টো শূন্যে স্থির। তার সামনে বসে আছেন তার মা। মুখভর্তি বিরক্তি, ঠোঁট শক্তভাবে চেপে ধরা, কপালে হালকা ভাঁজ। তিনি যেনো আবারো মেহুলকে নিয়ে হতাশ হয়েছেন।
“তুমি রাহাবের সাথে দেখা করতে যাওনি কেন?”
মেহুল মাথা নিচু করে নরম স্বরে বলল,
“মনে ছিল না।”
তার মা চোখ বড় বড় করে তাকালেন, যেনো এই উত্তরকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
“মনে ছিল না মানে কী? এসব ভুলে যাওয়ার মতো ব্যাপার? আগামীকালই দেখা করতে যাবে। দুই দিন পর বিয়ের তারিখ ঠিক হবে। কোনো জামেলা করবে না মেহুল।”
কথাগুলো ছুরি দিয়ে কেটে নেওয়ার মতো সোজাসাপ্টা। না কোনো আবেগ, না কোনো স্নেহ। শুধু নির্দেশ, আদেশ আর চাপ।
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে তিনি আবার বললেন,
“যাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”
কথাগুলো হুকুমের মতো বাজল মেহুলের কানে। ওর কোনো কথা বলার অধিকার নেই। কেবল মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে। ভারি পায়ে নিজের রুমের দিকে যায়।
দরজা লাগিয়ে বিছানায় বসতেই নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল। আজকাল কিছুই আর ভালো লাগে না তার। ওর মা-বাবা দু’জনেই সারাজীবন এত ব্যস্ত থেকেছেন যে, সন্তানের মুখের দিকে তাকানোর সময়ও পাননি। কখনো তাদের ভালোবাসার উষ্ণতা মেহুল পায়নি। এমনকি নিকোও একই শূন্যতায় বড় হচ্ছে। মেহুলের মা-বাবা দুজনই নিজেদের কাজে সবসময় ব্যস্ত। আদর-যত্ন, একসাথে সময় কাটানো এসব তাদের জীবনে কোনোদিন আসেনি।
মেহুল মনে করতে চেষ্টা করে, শেষ কবে মা তাকে কাছে বসিয়ে গল্প করেছিলেন, শেষ কবে বাবা তার মাথায় হাত রেখেছে। কিন্তু সে কিছুই মনে করতে পারে না। সেই স্মৃতি নেই, কারণ সেই মুহূর্ত কোনোদিন আসেইনি। সম্পর্কে রাহাব তার চাচাতো ভাই। আজও যখন বিয়ের প্রসঙ্গ উঠল, তার মা একবারও জিজ্ঞেস করলেন না সে রাজি কি না, সে কারো জন্য প্রস্তুত কি না।
যেনো তার কোনো অনুভূতিরই মূল্য নেই। সে একটা মূক চরিত্র, শুধু অন্যের ইচ্ছে মতো অভিনয় করবে। চোখ বন্ধ করতেই বুকের ভেতর অদ্ভুত শূন্যতা ভর করল। সে ভেবেছিল, হয়তো ভালোবাসা বা অন্ততপক্ষে সামান্য বোঝাপড়ার জায়গা একদিন পাবে পরিবারের কাছ থেকে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ততই বুঝছে, তার জীবনের সিদ্ধান্তগুলো সে নিজে নেয় না। তার হয়ে অন্যেরা নিয়ে নেয়।
—
সাঁঝ আরশানের কাঁধেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে উঠছে, বুকটা আস্তে আস্তে উঠছে-নামছে। আরশান তাকিয়ে মৃদু হাসলো। ধীরে ধীরে নিজের কাঁধ থেকে সাঁঝকে আলগা করল সে। যাতে সাঁঝের ঘুম না ভাঙে। তারপর সাবধানে দু’হাতে সাঁঝকে কোলে তুলে নিল।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে মাঝে মাঝে সাঁঝের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল সে। ম্লান আলোয় সাঁঝের মুখটা আরও কোমল লাগছে।
নিজের রুমে ঢুকে বিছানার ওপর আলতো করে শুইয়ে দিল আরশান। হাত সরাতে গিয়েও সরাতে পারলো না। কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়াল। তারপর ঝুঁকে এসে সাঁঝের কপালে হালকা ছোঁয়া দিল হাত দিয়ে। সাঁঝ নড়লো না, ঘুমই ভাঙলো না। আরশান চোখ ফেরাতে পারছিল না। ছোট্ট মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে। অথচ এভাবে তাকালে মনে হয় নতুন করে চিনছে। ছোট ছোট চুলগুলো কানের কাছে এলোমেলো হয়ে পড়েছিল। সাবধানে হাত বাড়িয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিল। আঙুল ছুঁয়ে গেলো সাঁঝের নরম গাল। মুখটা স্নিগ্ধ লাগছে। ঠিক যেনো সকালের শিশিরে ভেজা ফুলের মতো। আরশান ধীরে ধীরে নিচু হলো। বুকের ভেতর অদ্ভুত কাঁপুনি চলছিল, তবুও নিজেকে আটকাতে পারলো না। সাঁঝের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। একবার… দু’বার তারপর আরও কয়েকবার। সাঁঝ হালকা নড়লো, ঠোঁট কেঁপে উঠলো। কিন্তু ঘুম ভাঙলো না। নিঃশ্বাসের শান্ত ছন্দে আবারো ডুবে গেল সে। আরশান আর বসলো না উঠে চলে গেল। মনের অস্থিরতা লুকাতেই কী?
জানালা দিয়ে সকালের আলো রুমে ঢুকে পড়েছে, হালকা বাতাসে পর্দা দুলছে। বাইরে পাখিরা কিচিরমিচির করছে, আশেপাশে সকালের চঞ্চলতা শুরু হয়ে গেছে। বিছানার মাঝখানে সাঁঝ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, মুখের একপাশে এলোমেলো চুল ছড়িয়ে পড়েছে।
আরশান জগিং শেষ করে ফ্রেশ হয়ে শাওয়ার নিয়ে সাঁঝের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজাটা আধখোলা, ভেতরে তাকাতেই দেখতে পেল সাঁঝ এখনো বিছানায় মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। মাথার একপাশের চুল এলোমেলো হয়ে মুখে লেগে আছে।আরশান ভেতরে ঢুকে নরম স্বরে ডাক দিল,”সাঁঝ।”
কোনো সাড়া নেই। সাঁঝ একবার এপাশ থেকে ওপাশে ঘুরে আবার চাদর মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো। যেনো ইচ্ছে করেই শুনছে না। আরশান আবার বলল, “আর কতক্ষণ ঘুমাবি?”
সাঁঝের ঠোঁট নড়ল, চোখ আধখোলা রেখে ফিসফিস করল, “আরেকটু।”
আরশান ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে মাথা নাড়লো। হাসতে হাসতে নিচে রান্নাঘরে গিয়ে নিজের হাতে নাশতা তৈরি করলো। রান্নার গন্ধ পুরো ঘর ভরে উঠলেও ঘুমের রাজ্যে মগ্ন সাঁঝের এক বিন্দুও টোকা লাগলো না। নাশতা তৈরি হয়ে গেলে আরশান আবার উপরে গেল। ঘরে ঢুকে দেখে আগের মতোই বিছানায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে সাঁঝ। অবস্থার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি।
“কি রে, উঠবি না?”
তবু সাঁঝের কোনো নড়াচড়া নেই। এই পৃথিবীতে ঘুমের চেয়ে জরুরি আর কিছু নেই। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আরশান বিরক্ত হয়ে কপালে ভাঁজ ফেললো। এই মেয়ে এত সময় ঘুমায়। এভাবে চলতে থাকলে তো দুপুর গড়িয়ে যাবে।
আরশান বিছানার পাশে গিয়ে সাঁঝের হাতটা শক্ত করে ধরলো।
“আমি শেষবার বলছি, সাঁঝ উঠ।”
চোখ আধখোলা করে সাঁঝ মুখ গোমড়া করে বলল, “আমার ঘুমের সাথে আপনার এত শত্রুতা কেন? আমার ঘুম দেখে হিংসে হচ্ছে বুঝি?”
আরশান থমকে গেল, তারপর এক মুহূর্ত পর হেসে উঠলো।
“হিংসে? কারো ঘুম দেখে হিংসে হয়?”
চোখ বন্ধ রেখেই সাঁঝ মুচকি হেসে বলল,
“হয়, এই যে আপনার হচ্ছে।”
আরশান মাথা নাড়লো। সাঁঝকে এখনো উঠতে না দেখে এবার আরশানের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো। আরশান নিচু হয়ে বিছানার কোণায় বসলো। এক মুহূর্ত তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর কোনো কিছু না ভেবে সে সাঁঝকে কোলে তুলে নিল।
সাঁঝ ঘুমভাঙা চোখ মেলে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে বলল, “আমাকে… আমাকে নামান! এটা কী করছেন?”
শক্ত হাতে কোলে তুলে আরশান সোজা ওয়াশরুমের দিকে হাঁটা দিল। দরজা ঠেলে খুলে ভেতরে সাঁঝকে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর হাত গুটিয়ে বুকের ওপর রেখে বলল,
“এখন দাঁড়িয়ে থেকে আবার ঘুমাস না যেন। ফ্রেশ হয়ে বের হ।”
সাঁঝ বিরক্ত চোখে তাকাল। ঘুম-ভাঙা মুখটা লাল হয়ে আছে, চোখ কুঁচকে কপালে ভাঁজ।
“আপনার না একেবারেই ধৈর্য নেই। আমি যদি একটু বেশি ঘুমাই তাতে আপনার কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে?”
সবে নাস্তা সেরে সাঁঝ সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে। টেবিলে কফির মগ এখনো অর্ধেক ভরা। তখন হঠাৎই দরজার কলিং বেল জোরে বাজলো। সাঁঝ কৌতূহলী চোখে দরজার দিকে তাকায়। এরই মধ্যে আরশান দরজার দিকে হাঁটতে লাগল। দরজা খুলতেই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজনকে দেখে ভ্রু সামান্য কুঁচকালো। নির্ভাণ, জাইরান আর মিরাব এসেছে। মিরাবের হাতে একটা সুন্দর প্যাকেট করা কেক। এদিকে নির্ভাণ মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে ঝুঁকে আরশানের কানে কানে বললো,
“এতক্ষণ রোমান্স করছিলি এজন্যই দরজা খুলতে দেরি হলো, তাই না?”
কথাটা শুনে আরশান একদম কটমট করে তাকাল। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। কিন্তু নির্ভাণ মোটেও পাত্তা দিল না। সোজা ভিতরে চলে গেল, যেনো কিছুই শোনেনি। এবার মিরাব চোখ ছোট করে তাকালো সাঁঝের দিকে। তার দৃষ্টিতে অভিমান আর প্রশ্ন। সাঁঝ অনেক আগেই আরশানের কথা বলেছে। সাঁঝ হালকা থতমত খেলো, কিন্তু পরক্ষণেই উঠে গিয়ে মিরাবকে জড়িয়ে ধরলো।
“রাগ করিস না প্লিজ। আমি তোকে বলতে ভুলে গেছি।”
মিরাব ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“ভুলে গেছিস? নাকি ইচ্ছে করে বলিসনি?”
সাঁঝ হেসে মাথা নেড়ে বলল, “না রে, সত্যি ভুলে গেছি।”
মিরাব হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ফুফি জানে, তুই যে এখানে আছিস?”
একটু থেমে সাঁঝ ধীরে মাথা নাড়ল।
“না… এখনো বলেনি। তবে সময় হলো বলবো।”
“আচ্ছা, এত চিন্তা করিস না। আমি আছি তো তোর পাশে।”
তারপর হাতে থাকা কেকটা তুলে ধরে বলল,
“চল, আয়… কেক কাটি। সবাই চলে আসো।”
চলবে……
#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_১৯
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)
বিকেলের নরম সোনালি আলো বাগান জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। রোদের কিরণগুলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ছিটকে এসে কখনো টেবিলের ওপর, কখনো সাঁঝের মুখে এসে পড়ছে। টেবিলে বসে আছে সাঁঝ। তার দু’চোখ দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে, মুখে চিন্তার গাঢ় ছাপ। তিনদিন হলো সে ভেতরে ভেতরে এক ভারী বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। আরশানকে সবকিছু বলে ফেলেছে, কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। আরশান চেয়েছিল সোজা তাঁর মায়ের সাথে কথা বলতে। কিন্তু সে মানা করে দিয়েছে।নিজেই সামলে নেবে এজন্য । সাঁঝের বুক কেঁপে ওঠে শুধু সেই ভাবনাতেই।
কিন্তু নিজের কণ্ঠে বলার সাহস পাচ্ছে না সে।বারবার ভেবেছে, প্রতিদিন চেষ্টা করেছে, কিন্তু যতবারই মুখ খুলতে গেছে, শব্দ গুলো আটকে যাচ্ছে গলায়। সেই সময় সাঁঝের মনোযোগ ভাঙলো। সামনে এসে দাঁড়ালো সামির। হাতে ছোট্ট খাবারের একটা প্লেট।
“এই তোর নুটি কই?” সামির জিজ্ঞেস করল।
সাঁঝ আনমনে জবাব দিল,”দেখো, কোনো গাছে উঠেছে হয়তো।”
সামির এক মুহূর্ত দেরি না করে চারপাশের সব গাছের দিকে তাকাতে শুরু করল। বড় বড় চোখ মেলে প্রতিটি পাতার আড়াল খুঁজতে লাগল। কিন্তু নুটি কে কোথাও দেখা গেল না।
“এখানে নেই।”
এবার সাঁঝের ধ্যান ভাঙলো। বুকের ভেতরে হালকা একটা দুশ্চিন্তা খেলে গেল। চোখ ফেরাল চারপাশে ফুলগাছ, লতাগুল্ম, আঙিনার কোণ সব জায়গা খুঁজলো কিন্তু নুটি নেই।
তখনই গেইটের ফাঁক দিয়ে শব্দ আসে। এক লাফে দৌড়ে এলো নুটি। ফুঁফিয়ে ওঠা লেজটা এদিক-ওদিক দুলছে।
সাঁঝ দেখে হাসলো। হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাত বাড়িয়ে দিল সাঁঝ। নুটি ছুটে এসে উঠল তার কোলে। সাঁঝ হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল,”কোথায় গিয়েছিলি, বলতো? আমাকে এভাবে ভয় পাইয়ে দিলি কেন?”
নুটি গুনগুন শব্দে জবাব দিল যেনো। সামিরও হেসে উঠল, “দেখলি তো, আবার পালাচ্ছিল।”
—–
সকালের আবহাওয়া ছিল বেশ শান্ত। মেহুল নিকোকে স্কুলের জন্য তৈরি করে দিচ্ছিলো।মেহুল ধৈর্য ধরে ওর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল, “চুপ কর নিকো, একটু দাঁড়া, তোর চুল কত সুন্দর হয়ে গেছে।”
নিকো একবার আয়নায় তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,” আমি কি সুন্দর লাগছি?”
মেহুলের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল।”একবারে রাজপুত্রের মতো।”
চকচকে স্কুলের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিকো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুল বাসের হর্ন শোনা গেলো। মেহুল দরজা খুলে দিল। নিকো খুশি মনে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে বাসে উঠে গেল। জানালার কাচ থেকে শেষবারের মতো ডাক দিল, “বাই, আপু।”
মেহুল হাত নেড়ে উত্তর দিল। নিকো চলে যেতেই বাড়িটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল। ওইসময় মেহুলের মা ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে এসে শান্ত গলায় বললেন, “মেহুল, আমি একটা কথা ভাবছি।”
মেহুল অবাক হয়ে তাকাল।
“কি কথা ?”
“আমি আর তোমার বাবা ঠিক করেছি, নিকো কে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিবো।”
শুনে মেহুল কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে গেল।
“বোর্ডিং স্কুলে? কেন?”
মা সোফায় বসে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“দেখো, তোমার বিয়ের আর ক’টা দিন বাকি? তুমি নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে। আমি আর তোমার বাবা… আমরা তো অফিস নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকি। নিকো কে নিয়মিত সামলানো আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বোর্ডিং স্কুলে দিলে ওর পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া, সবকিছুই নিয়ম-মাফিক চলবে।”
মেহুল হতভম্ব হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। তার বুকের ভেতর অদ্ভুত ব্যথা জমে উঠল। কণ্ঠ কেঁপে উঠল,
“আশ্চর্য! তোমরা কি নিকোকে নিজের কাছে রাখতেও পারবে না? তোমাদের কি এতটুকু সময় নেই যে নিজের ছেলেকে একটু দেখাশোনা করবে?”
“আমরা এটা ওর ভালোর জন্যই করছি। বোর্ডিং স্কুলে গেলে ও ভালো পড়াশোনা করবে।”
মেহুলের চোখে জল চলে এলো। গলা ভারী হয়ে এলো, “ভবিষ্যৎ কি শুধু বইয়ের পাতায় তৈরি হয় মা? নিকো কি মা-বাবার ভালোবাসা ছাড়া বড় হতে পারবে? সে তো এখনো ছোট, তোমাদের স্নেহ চাই, তোমরা কি সেটা দিতে পারছো না?”
মায়ের সাথে তর্ক করার পর মেহুল আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। বুকের ভেতর অদ্ভুত একটা দমচাপা জমে উঠেছিল। চোখের কোণে জল টলমল করছিল। টেবিলে গরম গরম নাস্তা সাজানো ছিল, তবু তার ক্ষুধা একেবারে উধাও।
“খাবার খেলি না কেন?”
“আমার খিদে নেই।”
আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না মেহুল। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল।
জানালা দিয়ে রোদের শেষ ঝলক ঢুকে এসে বেঞ্চের উপর সোনালি আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। ক্লাসরুমে বসে আছে সাঁঝ আর মেহুল। মেহুল সামনের বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসে আছে, মুখটা ভারী হয়ে আছে,চোখের কোণে ক্লান্তি, ঠোঁট সোজা হয়ে আছে। সাঁঝ অনেকক্ষণ ধরেই তাকিয়ে আছে তার দিকে। মেহুল সাধারণত এভাবে চুপচাপ থাকে না। আজকে হটাৎ হলো কী? সাঁঝ ধীরে বলে উঠল,
“তুই নির্ভাণ ভাইয়ের প্রপোজাল ফিরিয়ে দিয়েছিস কেন?”
মেহুল হালকা চোখ মেলে তাকাল সাঁঝের দিকে। গলায় ভরাট কোনো শব্দ নেই।
“মা, রাহাব ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে।”
“এত তাড়াতাড়ি?”
কথাটা বলেই সে মেহুলের দিকে তাকিয়ে রইল। মেহুলের মুখে কোনো আবেগের ঝলক নেই। যেনো অনেক আগেই মেনে নিয়েছে বিষয়টা। সাঁঝ একটু অস্থির হয়ে উঠে আবার জিজ্ঞেস করল, “তো তুই বিয়ে করবি?”
মেহুল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার চোখ জানালার দিকে চলে গেল, বাইরে আকাশটা গাঢ় কমলা হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস ফেলে সে বলল, “জানি না।”
সাঁঝ কপাল কুঁচকে সে আরও তীব্র স্বরে বলল,
“জানিস না মানে কী? বিয়ে করবি না?”
মেহুল এবার চোখ ফিরিয়ে সাঁঝের দিকে তাকাল।
“এসব কথা বাদ দে। ক্লাস তো শেষ। চল।”
এই বলে সে ব্যাগটা কাঁধে নিতে গেল। কিন্তু সাঁঝ হাত বাড়িয়ে মেহুলের হাতটা শক্ত করে ধরে ফেলল।
“নিজের সাথে জোর করে কী লাভ মেহুল? তুই যদি সুখী না হোস, তোর তো কষ্টই হবে। আর আমি সেটা দেখবো দাঁড়িয়ে?”
“আমি চাই না কোনো জামেলা হোক। সবাই এই বিয়েতে খুশি।”
সাঁঝ দম নিয়ে তাকালো সরাসরি মেহুলের চোখে। “তুই খুশি?”
মেহুল চোখ ফিরিয়ে নিলো, যেনো দৃষ্টি সরালেই উত্তর দিতে হবে না। আঙুলের নখ দিয়ে বেঞ্চে অযথা দাগ কাটতে কাটতে বলল,
“চল বাইরে যাই। আরশান ভাইয়া তোকে নিতে আসবে না?”
সাঁঝ ঠোঁট কামড়ে ধরলো। বুঝতে পারল মেহুল ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে প্রশ্নটা।মৃদুস্বরে
উত্তর দিল, “আসবে।”
দু’জন একসাথে ক্লাস থেকে বের হলো। করিডোর পেরিয়ে বাইরে আসতেই রোদ ফিকে হয়ে গেছে। হালকা বাতাস বইছে। গেটের পাশে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, তার ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরশান। একহাতে পকেটে, অন্য হাতে ফোন মুখটা গম্ভীর, অথচ অদ্ভুত শান্ত। সাঁঝকে দেখে তার চোখ নরম হয়ে এলো।
মেহুল একবার সাঁঝের দিকে তাকালো, তারপর আরশানের দিকে। হাসলো সে, দু’জন কে বেশ মানিয়েছে। “তুই যা, আমি চলে যাবো।”
সাঁঝ মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। মেহুল হাঁটা দিলো বিপরীত দিকে। আর সাঁঝ এগিয়ে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আরশানকে।
আরশান দু’হাত দিয়ে সাঁঝকে আঁকড়ে ধরল।
সাঁঝ মাথা গুঁজে রাখলো আরশানের বুকের কাছে। তার ভেতরের অস্থিরতা ধীরে ধীরে শান্ত হতে লাগলো। এক মুহূর্ত পর আরশান নরম স্বরে বলল,”চল, গাড়িতে উঠ।”
সাঁঝের জন্য দরজা খুলে দিলো। সাঁঝ ভেতরে বসলো। তারপর আরশানও সিটে বসল। গাড়ির বাইরে থেকে আসা বিকেলের আলো জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকছে। গাড়ি চালু করে আস্তে আস্তে রাস্তা ধরলো আরশান। কিছুক্ষণ পর আরশান এক ঝলক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু খাবি?”
সাঁঝ হালকা হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে বলল,
“নাহ, ক্যান্টিনে খেয়েছি।”
ওরা দু’জন বাড়ির ভেতরে ঢোকার পর আরশান সরাসরি ওয়াশরুমে চলে গেল। সাঁঝ চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। কাবাড খুলে সাদা শার্ট বের করলো, আরশানের জন্য। সেই শার্টটা সুন্দরভাবে বিছানার উপর মেলে রাখলো। তারপর টেবিলের কোণ থেকে আরশানের হাতঘড়িটা নিয়ে শার্টের পাশে রাখলো। আরশান বের হয়ে এলে আর কিছু খুঁজতে না হয়। কয়েক মুহূর্ত পর আরশান বের হলো। হাত মুছতে মুছতে সাঁঝের দিকে তাকালো। সাঁঝ তখন বলল,
“আজকে কিন্তু সিসাইড হাউসে নিয়ে যাবেন।”
আরশান এক মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে থাকল। তারপর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলল।
“আচ্ছা, নিয়ে যাবো। তবে একটা শর্তে।”
সাঁঝ ভুরু কুঁচকে তাকালো, ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“শর্ত?”
আরশান ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কাছে ঝুঁকল, কানে মুখ এনে নরম স্বরে বলল কিছু কথা।
সাঁঝ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে উঠলো। গাল লাল হয়ে উঠলো এক নিমিষে।
“অসভ্য লোক।”
আরশান এবার মিটি মিটি হেসে মাথা নুইয়ে শার্টটা তুলে নিলো। এক হাতে বোতাম লাগাতে বের হয়ে আসে। বাইকের কাছে গিয়ে হেলমেট তুলে নিলো, তারপর উঠে বসল। সাঁঝ ধীরে ধীরে বাইকের পিছনে বসল। দু’হাত বাড়িয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আরশানকে। বাইক ছুটছে শহরের ভিড় পেরিয়ে। চারপাশের হাওয়ায় ভেসে আসছে। আরশান বলল,
“তোকে এখন ফেলে দেই রাস্তায়।”
সাঁঝ ঠোঁট কামড়ে বলল,”আপনি ঠিক থাকতে পারবেন তো?”
রাত নেমে এসেছে। আকাশে আধখানা চাঁদ, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা তারাগুলো সমুদ্রের উপর ঝিলিক দিয়ে পড়ছে। সাঁঝ নামতেই ঠান্ডা হাওয়া এসে চুল উড়িয়ে দিলো। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের তৈরি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। পুরো বাড়িটা উঁচু কাঠের দেয়াল, বাদামী রঙের ছোঁয়া, জানালাগুলো কাঁচের তৈরি। ভেতরে ঢুকতেই কাঠের মেঝে হালকা শব্দ তুলল তাদের পায়ের নিচে। দেয়ালে ঝোলানো লণ্ঠনের মতো লাইটগুলো পুরো ঘরটাকে একেবারে শান্ত, পরিবেশে ভরিয়ে রেখেছে।কোথাও কোনোরকম জৌলুস নেই,তবুও কত সুন্দর। সাঁঝ হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগোল। কাঠের আর কাঁচের বড় স্লাইডিং দরজাটা টেনে বাইরে বেরিয়ে এলো।
পিছনের সাইটে বিশাল বিচ। কালো রাতের বুক চিরে সাদা ফেনা তুলে গর্জে উঠছে ঢেউগুলো। বাতাস একের পর এক ঝাপটা দিয়ে সাঁঝের পা ভিজিয়ে দিলো, চুল এলোমেলো করে দিলো। চোখের সামনে অসীম সমুদ্র, কানে শুধু ঢেউয়ের শব্দ। সাঁঝের বুক ভরে উঠলো অনাবিল প্রশান্তিতে। হঠাৎ পিছন থেকে দু’টো শক্ত বাহু তার কোমর ঘিরে ধরলো। সাঁঝ চমকে উঠে চোখ বড় করলো, কিন্তু সেই পরিচিত স্পর্শে মুহূর্তেই নিশ্চিন্ত হয়ে গেলো। বুকের সাথে পিঠ ঠেকে গেছে, উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে। আরশানের কণ্ঠ খুব কাছে থেকে ভেসে এলো, “ভালো লেগেছে?”
সাঁঝের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। চোখ সরিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো,”হুম,
জায়গাটা অনেক সুন্দর।”
আরশান মাথা নিচু করে আরও কাছে ঝুঁকল,
“তোর চেয়ে সুন্দর কিছু নেই যদিও।”
সাঁঝ মুখ ঘুরিয়ে আবার সমুদ্রের দিকে তাকাল, কিন্তু বুকের ভেতরে কেমন অদ্ভুত এক টান অনুভব করছিল। ঢেউয়ের শব্দের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল তার দ্রুত হৃদস্পন্দন। কোমর থেকে আরশানের হাত সরিয়ে দিলো।
“আমি একটু সামনে যাই।”
সে হালকা দৌড়ে বালুর ওপর দিয়ে গিয়ে দাঁড়াল, যেখানে ঢেউ এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা পানির ছোঁয়ায় হেসে উঠলো। চাঁদের আলোয় সমুদ্রটা একেবারে রূপকথার মতো লাগছিল। ঠিক তখনই এক ঢেউ এসে সাঁঝের হাঁটু পর্যন্ত ভিজিয়ে দিলো। সাঁঝ চেঁচিয়ে উঠল,
“আহ্! কী ঠান্ডা।”
“এদিকে আয়, ঠান্ডা লাগবে তো।”
আরশান এগিয়ে এসে নিজের জ্যাকেটটা খুলে সাঁঝের কাঁধে জড়িয়ে দিলো। সাঁঝ নিচু গলায় বলল,”আমাকে নিয়ে এত ভাবেন কেন?”
আরশান বলল,”ভাবা কী অপরাধ?”
সাঁঝ প্রতিত্তোর করল না। শুধু নিঃশব্দে ধীরে ধীরে মাথাটা নামিয়ে দিলো আরশানের বুকে। আরশানের বুকের ধুকপুকানি কানে ভেসে আসছে স্পষ্টভাবে। সাঁঝ চোখ বুজে রইলো।
আরশানের হাত শক্ত হলো, আরও কাছে টেনে নিলো সাঁঝকে। ঠোঁটে নীরব এক হাসি খেলে গেলো। এই মুহূর্তে পৃথিবী থেমে গেলেও তার আপত্তি নেই।
চলবে…..।