এক চিলতে প্রেম পর্ব-২৭ এবং শেষ পর্ব

0
5

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_২৭ (অন্তিম পাতা )🍁
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)

ওরা বিডিতে বেশি দিন থাকেনি চলে আসে কানাডায়। মাত্র এক মাস থেকেছে। তার পরেই আবার ব্যস্ততা। তবুও এই ছোট্ট সময়টাতে কত কিছু বদলে গেছে চারপাশে। সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। আকাশের নীলচে রঙটাকে অন্ধকার গ্রাস করছে। চারপাশে নেমে আসছে শান্ত-অশান্ত সন্ধ্যার আবেশ।
সেই সময়ে আরশানের গাড়ি গ্যারেজে ঢোকে।গাড়ি গ্যারেজে রেখে আরশান ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে ভিতরে ঢোকে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে রুমে যায়। এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায় আরশান। চোখ এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়।
সাঁঝ রুমে নেই। আরশান ব্যালকনিতে, পাশের রুম গুলোতেও যায় । কিন্তু না, কোথাও নেই।

“সাঁঝ…”

কোনো সাড়া নেই। আরশানের ভ্রু কুঁচকে যায়। ঠোঁট শক্ত হয়ে আসে। “আবার গেছে?”

গত ক’দিন ধরে প্রায়ই হচ্ছে এটা। আগে এক মুহূর্ত দূরে থাকতে চাইত না, আজকাল সাঁঝ অকারণেই সোফির কাছে চলে যায়। না বলে যায়, না কিছু বলে। কেন এমন করছে সে ?
আর স্থির থাকতে পারল না। আবার গাড়ির চাবি হাতে তুলে নেয়। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে অন্ধকার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর পরিচিত বাড়ির সামনে এসে থামে। গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল। ওই তো সামনে। দুলনায় হেলান দিয়ে বসে আছে সাঁঝ। হাতে একটা বই, তাতে পুরো মনোযোগ ডুবে আছে। কপালের সামনে ঝুলে পড়া চুল গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে, মুখে নির্লিপ্ত শান্তি। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল আরশান। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল তার সামনে। বুকের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতি দোলা দেয়। তবুও রাগী কণ্ঠেই বলে,

“এখানে আসবি, আমাকে বললি না কেন?”

সাঁঝ ধীরে বইয়ের পাতা বন্ধ করে তাকায় তার দিকে। চোখে অবাক দৃষ্টি। তারপর শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে, “কখন আসলেন?”

আরশান গম্ভীর স্বরে বলল, “উঠ, বাড়িতে যাবো।”

“আমি থাকবো কয়েকদিন, প্লিজ ।”

আরশানের ভ্রু কুঁচকে গেল। কণ্ঠস্বর আরও গম্ভীর হলো। “আমি আর একবার বলবো, তুই উঠবি।”

সাঁঝ উঠলো না। আরশান এগিয়ে গিয়ে এক ঝটকায় বইটা ওর হাত থেকে সরিয়ে রাখল। সাঁঝ ভড়কে গিয়ে তাকাল। তারপরই পাজকোলে তুলে নেয়।

“আরে…. নামান। কী করছেন এসব? আম্মুকে তো বলে যাই।”

“ফোন করে বলে দিবি।”

সাঁঝ বুকের ওপর হাত রেখে তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে। গম্ভীর দৃষ্টি, ঠোঁট চেপে ধরা। সাঁঝ দেখে হেসে উঠলো।

আরশান কাপড় পাল্টে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। এমন সময় সাঁঝ ঢুকলো রুমে। হাতে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ কপি। আরশান কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিলো। তারপর সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে তোর?”

এক মুহূর্ত তার চোখে চোখ রাখল, তারপর হঠাৎই কিছু একটা আরশানের হাতে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল।আরশান বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে হাতে ধরা জিনিসটার দিকে তাকাল। কিছু সেকেন্ড পর হঠাৎ বুকটা ধক করে উঠল।প্রেগনেন্সি টেস্ট কিট। দীর্ঘক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। হাত কাঁপছে, অথচ চোখ ভিজে উঠছে আনন্দে। সে বাবা হতে চলেছে। ওদের মাঝে ছোট্ট সুখ আসছে। দরজার আড়াল থেকে সবকিছু দেখছে সাঁঝ। চুপচাপ দাঁড়িয়ে, বুকের ভেতর ঝড় বইছে তারও। চোখ ভিজে উঠেছে, তবে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি খেলে গেল।

——-

আরশান এখন অফিসের কাজ শেষ করেই দ্রুত বাড়ি ফিরে আসে। সাঁঝকে নিয়ে তার এখন ভয়ের একটা টান, যেনো চোখের আড়াল হলেই কিছু একটা হয়ে যাবে। সাঁঝকে নিয়ে হাঁটাহাঁটি, সময়মতো খাওয়ানো, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট। সবকিছুর প্রতি তার যত্নশীলতা।এরই মধ্যে কেটে গেছে কয়েক মাস। সময় গড়িয়ে এখন সাঁঝ নয় মাসের অন্তসত্ত্বা। পেটের ভেতরে একটা ছোট্ট প্রাণ নড়াচড়া করছে। যার উপস্থিতি দু’জনের জীবনকেই অন্যরকম মায়ায় ভরিয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে আরশান দ্রুত রুমের দিকে গেল। দরজা খুলেই তার বুক কেঁপে উঠল।ফ্লোরে বসে আছে সাঁঝ, মুখটা দুই হাতে ঢেকে কাঁদছে। আরশান এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসে পড়ল।

“কী হয়েছে, এভাবে ফ্লোরে বসে কাঁদছিস কেন? ব্যথা করছে? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো এখনই।”

সাঁঝ কাঁদতে কাঁদতে মুখটা উঠাল। চোখ লাল হয়ে আছে।

“আমার কাঁদতে ইচ্ছে হয়েছে, আমি কাঁদবো… এতে আপনার কী?”

আরশান নিঃশ্বাস ছেড়ে ছোট্ট করে হেসে ফেলল। সত্যি বলতে কী, গত কয়েক মাসে সে এইসব অভ্যাস করে ফেলেছে। ছোটখাটো কারণে হঠাৎ কান্না, হঠাৎ রাগ, আবার মুহূর্তেই হাসি, সবই এখন সাঁঝের সঙ্গী। আরশানের কাছে সবকিছুই এখন স্বাভাবিক লাগে। সে আস্তে করে হাত বাড়িয়ে সাঁঝের চোখ মুছে দিল। আলতো স্বরে বলল,

“চড়ুই বাচ্চা আমার, এমন করিস না। তোর কাঁদতে ইচ্ছে করে কর, কিন্তু এভাবে ফ্লোরে বসে কাঁদবি না, ঠান্ডা লাগবে তো ।”

সাঁঝ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“আপনি আমার কথা শোনেন না, সবসময় নিজের মতো করেন।”

আরশান হেসে সাঁঝের মাথাটা বুকের কাছে টেনে নিল।

“আমার সবকিছুই তো তুই। নিজের মতো করলেও তো তোকে নিয়েই করি। আর যখন কাঁদতে ইচ্ছে হবে, আমার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদবি, ঠিক আছে? তোর প্রতিটা কান্না আমি সামলাবো।”

সাঁঝ চোখ মুছে নীরব হয়ে রইল। তার ঠোঁটে
হাসি ফুটে উঠল। বুকের ভেতরে জমে থাকা অস্থিরতা আস্তে আস্তে গলে গেল আরশানের কথায়।

সেই মুহূর্ত চলে এলো। যে মুহূর্তের জন্য গত নয় মাস ধরে বুক ধড়ফড় করেছে, অস্থিরতা আর অপেক্ষায় কেটেছে প্রতিটা দিন, আজ সেই ছোট্ট সুখ আসতে চলেছে।
হাসপাতালের সাদা দেওয়ালগুলো আরশানের চোখে ধূসর কুয়াশার মতো লাগছে। রাত প্রায় একটা ছুঁই ছুঁই। রাত হয়ে গেছে এজন্য আরশান এখনও কাউকে জানায়নি। কোলাহল থেমে যাওয়া শহর ঘুমিয়ে আছে, অথচ আরশানের চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই। ওটির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার পায়চারি করছে। হাত দু’টো অস্থিরভাবে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখছে, আবার বের করে চুলে হাত বুলাচ্ছে। প্রতিটা মিনিট তার কাছে এক একটা বছর লাগছে। মাথার ভেতর শুধু একটাই চিন্তা, সাঁঝ ঠিক আছে তো। এই ভাবনায় বুকটা চেপে ধরছে। কয়েক মিনিট পর ওটির দরজা ধীরে খুলে গেল। নার্স বের হয়ে এলেন, কোলের ভেতরে মোড়ানো এক ছোট্ট প্রাণ। সাদা কাপড়ে জড়ানো ক্ষুদ্র শরীরটা নড়েচড়ে উঠছে, নরম কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। নার্স এগিয়ে এসে মৃদু হাসি দিয়ে বললেন,

“অভিনন্দন, স্যার। আপনার ছেলে হয়েছে।”

আরশান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ আটকে গেল সেই ছোট্ট প্রাণের দিকে। বুকের ভেতর ঢেউ খেলে গেল অস্থির আনন্দে। শব্দ আটকে গেল কণ্ঠে। কয়েক সেকেন্ড পর জিজ্ঞেস করল,
“আমার ওয়াইফ? সে ঠিক আছে?”

নার্স আশ্বাসভরা কণ্ঠে বললেন, “উনি ঠিক আছেন। একটু পরে কেবিনে দেওয়া হবে।”

আরশানের বুক থেকে ভারী পাথর নেমে গেল, ঠোঁট কাঁপল।

“কোলে নেবেন না? বাবা হয়ে গেছেন এখন।”

আরশান এক মুহূর্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইল। হাত দু’টো নিজের অজান্তেই কাঁপছে। কীভাবে নেবে, কীভাবে ধরবে, কিছুই বুঝতে পারছে না।
এমন ভঙ্গি দেখে নার্স হেসে ফেললেন।

“ভয় নেই, আপনি হাত সামনে বাড়ান। আমি দিয়ে দিচ্ছি।”

আরশান ধীরে ধীরে দুই হাত এগিয়ে দিল। আর নার্স আলতো করে রাখলেন তার হাতে। সেই ক্ষুদ্র, উষ্ণ শরীর তার বাহুর ভেতর আশ্রয় নিতেই বুকের ভেতর বর্ণনাতীত আবেগ ভরে উঠলো। দুই চোখ ভরে উঠল অশ্রুজলে। আরশান মাথা নিচু করে কপালে আলতো চুমু খেল।

——-

দেখতে দেখতে কেটে গেছে দু’টা বছর।
সময় কত দ্রুত চলে যায়। গতকাল যে ক্ষুদ্র হাত-পা নড়ানো বাচ্চা জন্ম নিয়েছিল, আজ সে-ই সারা বাড়ির প্রাণ হয়ে উঠেছে।
আরশান আর সাঁঝের জীবনের আলো হয়ে এসেছে তাদের ছোট্ট প্রাণ, আরিদ। সারা বাড়ি এখন আরিদের ছোট ছোট পায়ের শব্দে মুখরিত হয়ে থাকে। সে হাঁটতে শিখেছে অনেক আগেই, এখন দৌড়ানোই তার কাজ। এদিকে যায়, ওদিকে যায়, একমুহূর্তও স্থির হয়ে বসে না। মাঝে মাঝে তার চঞ্চলতায় সারা ঘর মাথায় তোলে। আবার যখন কান্না শুরু করে, তখন সেই কান্নার আওয়াজে পুরো ঘর কেঁপে ওঠে।

সাঁঝ আরিদকে খাইয়ে সে এখন সোফায় বসিয়ে দিয়েছে। তখন দরজাটা খচখচ শব্দ করে খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ভেসে এল মিষ্টি কণ্ঠস্বরের হাসি। ভিতরে ঢুকল সারা আর জারা। চার বছরের দুই জমজ বোন। দু’জনেই মিরাব আর জাইরানের আদরের কন্যা। তাদের ছোট ছোট পায়ে টুকটুক শব্দ করে ঘরে ঢোকে।
দু’জনের গায়ের সাদা ফ্রক, চুলে রঙিন ফিতা। কারো চুল সামান্য এলোমেলো, আবার অন্যজনের কপালে ঘামের বিন্দু টলমল করছে।
সাঁঝ তাদের দেখে হাসি চাপতে পারল না। এগিয়ে গিয়ে দু’জনকে আদরে জড়িয়ে ধরে গালে গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল।

“আমার মিষ্টি মেয়েরা এসেছে।”

সারা আর জারা দু’জনেই খিলখিল করে হেসে উঠল। কিন্তু এ দৃশ্য যে সহ্য করতে পারল না, সে হলো আরিদ। মায়ের গালে চুমু না পেয়ে সে ফোঁপাতে শুরু করল। ধীরে ধীরে পুরো মুখ লাল করে তুলল। সাঁঝ তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিল।

“আরে , মাম্মা তোমাকে ভুলে যায়নি তো।”

তারপর আদরে আরিদের দুই গালে একের পর এক চুমু খেয়ে দিল। ছেলেটা একটু শান্ত হলো, ছোট্ট হাতে সাঁঝের গলা জড়িয়ে ধরল সে।
সাঁঝ তখন সারা আর জারার দিকে তাকিয়ে বলল,

“সন্ধ্যার আগে নিয়ে আসবে, ঠিক আছে?”

সারা গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। “আচ্ছা, মনি।”

সাঁঝ ধীরে ধীরে আরিদের হাত ধরে তাদের বাইরে নিয়ে এল। সারা এক হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে আরিদকে, আরেক হাতে জারার ছোট্ট আঙুল জড়িয়ে আছে। তিনজন মিলে গেট পেরিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে সামনের বাড়িতে গেল।

সাঁঝ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
এই ফাঁকেই সে ঠিক করল মেহুলের কাছে যাবে। অনেকক্ষণ হলো ওদের দেখা হয়নি।
মেহুলের ঘরে ঢুকে সাঁঝ দেখল, মেহুল এক কোণে বসে মন দিয়ে কাপড় গুছাচ্ছে। একেকটা জামা ভাঁজ করে রাখছে।

বিছানার উপরেই ছড়িয়ে আছে ছোট্ট আইরা।মেহুল আর নির্ভাণের আদরের মেয়ে। বয়স মাত্র ছ’মাস। ফর্সা গাল, চোখদুটো আধখোলা। হাত-পা ছড়িয়ে সে বিছানার মাঝখানে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে ছোট্ট হাত নেড়ে বাতাস আঁকড়ে ধরছে। ঠোঁটে ফোঁপা ফোঁপা আওয়াজ করছে। সাঁঝ এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশে বসল।

“আইরা কী ঘুমাচ্ছে?”

মেহুল কাপড় ভাঁজ করতে করতে তাকায়।

“আজ সারাটা সকালই ও ঘুমায়নি। এখন গিয়ে একটু শান্ত হলো।”

সাঁঝ মৃদু হেসে আইরার নরম আঙুল নিজের আঙুলে জড়িয়ে নিল। ছোট্ট আইরা কেঁপে উঠে আবার শক্ত করে ধরে ফেলল। উষ্ণ স্পর্শে সাঁঝের বুক ভরে গেল মায়ায়। মেহুল তখন তার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল।

“ঠিক নির্ভাণের মতো চেহারা পেয়েছে।”

সাঁঝ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল।
“হ্যাঁ, তবে চোখদু’টো কিন্তু তোর মতোই। একদম টুকটুকে।”

দু’জনেই হেসে উঠল। ছোট্ট আইরা চেয়ে চেয়ে দেখলো। সাঁঝ মেহুলের ঘরে বেশিক্ষণ থাকল না। আরিদ যদি এসে ওকে না দেখে কান্না শুরু করে দেবে। তাই মেহুলকে হেসে বিদায় জানিয়ে সাঁঝ তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ফিরে এল। ঘরে ঢুকে সোফায় গিয়ে বসতেই দৌড়ে এলো সারা।

“মনি, আরিদ আসছে না।”

সাঁঝ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। “এই ছেলেকে নিয়ে আমি পারি না।”

সাঁঝ উঠে দাঁড়াল। দ্রুত পা ফেলে বাইরে বেরিয়ে গেল। সামনের গেটের দিকে তাকাতেই তার বুক ধক করে উঠল। আরিদ ছোট্ট দু’হাত বাড়িয়ে শক্ত করে গেটের গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। গেটের ওপার দিয়ে উঁকি মেরে একবার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে, আবার একবার গেট নেড়ে দেখছে।

“আরিদ, এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভিতরে আসো।”

“আমি যাবো না।”

সাঁঝ কোলে তুলে নেয় আরিদকে।

“আপ্পিদের বিদায় দাও।”

আরিদ হাত দেখিয়ে বলে, “বাই, আপ্পি।”

সারা আর জারা চলে যায়।

——–

সাঁঝ বারবার কোলে নিচ্ছে, পানি খাওয়াচ্ছে, খেলনা দিচ্ছে, নানা চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না আরিদ। ছোট্ট মুখ লাল হয়ে গেছে কান্না করতে করতে, চোখ ভিজে আছে অশ্রুতে, নাকও টেনে আসছে। সাঁঝের কপালে ঘাম জমে গেছে, অসহায় লাগছে তাকে। তখন দরজা ঠেলে রুমে ঢোকে আরশান। অফিস থেকে ফিরেছে। দরজা খুলেই দেখে তার ছোট্ট ছেলেটা বুক ভেঙে কান্না করছে।

“আমার ছেলে কান্না করছে কেন?”

সাঁঝ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“অর্ণব ভাইয়া ফোনে কী দেখিয়েছে ,এখন আরিদ সেটা চাইছে। ফোন থেকে আমি কী করে এনে দেব ?”

আরশান এগিয়ে গিয়ে আরিদকে কোলে তুলে নেয়। “ব্যাডি , কাঁদছো কেন? কান্না বন্ধ করো তো, পাপা তোমাকে অন্য কিছু এনে দেবে।”

কিন্তু আরিদ হেঁচকি তুলে কেঁদে কেঁদে বলে ওঠে, “ফোন তেকে এনে দাও।”

আরশান তাকে কোলে বসিয়ে নরম হাতে চোখ-মুখ মুছে দেয়। তারপর পাশে রাখা খেলনার বাক্সটা সামনে টেনে আনে।

“এগুলো দেখো, গাড়ি, বল, তোমার ট্রেন এগুলো দিয়ে খেলো। পাপা তোমাকে নতুন খেলনা এনে দেবে, ঠিক আছে?”

কিন্তু কে শোনে কার কথা। আরিদ গোঁ ধরে বসেছে। আরও জোরে কাঁদতে শুরু করল। বুক ভেঙে আসা সেই কান্না।

“না…. ফোন তেকে এনে দাও।”

ছোট্ট হাত দু’টো ছুঁড়ে দিচ্ছে, চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। সাঁঝ এবার এগিয়ে এসে বলে, “দেখছেন ? একবার কিছু চাইলেই না পাওয়া পর্যন্ত শান্ত হয় না।”

আরশান ছেলের ছোট্ট শরীরটাকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে নিল। চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে, কান্নার হেঁচকি এখনও বুক কাঁপিয়ে তুলছে। আরশান মাথায় চুমু খেয়ে বলল,

“চলো , আমরা বাইরে যাই। পাপা তোমাকে বাইক কিনে দেবে।”

যদিও কান্না পুরোপুরি থামেনি, আরিদ ছোট্ট দুই হাত দিয়ে বাবার শার্ট আঁকড়ে ধরল, তবুও চোখ থেকে পানি পড়তেই থাকল।

আরশান বাইকটা কিনে আনার পর থেকেই আরিদের মুখে আনন্দ থামছেই না। বাইকটা এখন আরিদের পুরো দুনিয়া হয়ে গেছে। বাইকটাকে হাত দিয়ে ঠেলছে। কৌতূহলী চোখে বাইকের চাকা, হ্যান্ডেল সব খুঁটিয়ে দেখছে সে।
এদিকে ভিভানে আরশান আধশোয়া ভঙ্গিতে আছে। তার বাহুর উপর মাথা রেখে সাঁঝ চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়েছিল। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সাঁঝ হকচকিয়ে বলল,
“বারোটা তো বেজে গেছে, উঠুন।”

আরশান ভ্রু কুঁচকে চোখ মেলে তাকালো, “এখনই উঠতে হবে?”

সাঁঝ হেসে হাত ছাড়িয়ে উঠে বসলো।
“আপনি ভুলে গেছে নাকি? আজ আমাদের রাজপুত্রের জন্মদিন।”

সাঁঝ রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। কিচেনের ফ্রিজ খুলে বড়ো যত্ন করে রাখা কেকটা বের করলো। আজকে আরিদ দু বছরে পা দিবে। সুন্দর করে সাজানো চকোলেট কেকের ওপর রঙিন ক্রিম দেওয়া। সাঁঝ কেকটা হাতে নিতেই মনে হলো, সময় কত দ্রুত চলে গেছে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো দুই বছর আগের সেই মুহূর্ত, যখন প্রথমবার আরিদকে কোলে নিয়েছিল। কেকটা নিয়ে সাবধানে আবার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলো। ওপরে গিয়ে দেখলো, আরিদ এখনও বাইক নিয়ে খেলায় মগ্ন। তার ছোট্ট চুলগুলো কপালে লেগে আছে, গাল লাল হয়ে উঠেছে খেলতে খেলতে।

সাঁঝ ডেকে উঠলো, “আরিদ, এদিকে আসো।”

আরিদ খেলা থামিয়ে সাঁঝের দিকে তাকালো। কেক দেখে বলল, “মাম্মা , কেক?”

সাঁঝ হেসে এগিয়ে এসে টেবিলে কেকটা রাখলো। ছোট্ট ছেলেটা বাইক ছেড়ে দৌড়ে এলো মায়ের কাছে। তিনজন মিলে কেক কাটলো। কেক কেটে হয়ে গেলে সাঁঝ সুন্দর করে টুকরো পিস করে প্লেটে সাজাতে লাগলো। এদিকে আরিদ চুপচাপ বসে নেই। তার চোখ বারবার কেকের দিকে। একসময় হঠাৎ দুই হাত ভরে সে কেকের ওপর বসিয়ে দিল। নরম চকোলেট ক্রিম তার আঙুলে, হাতের তালুতে মাখামাখি হয়ে গেল।

সাঁঝ চমকে উঠলো, “কী করলে এটা?”

আরিদ হেসে দুই হাত উঁচু করে দেখালো, হাতে লেগে থাকা কেকটা জিভ দিয়ে খেয়ে নিল।
সাঁঝ বিরক্ত হয়ে আরশানের দিকে তাকালো, “আপনি ওকে আটকালেন না কেন?”

আরশান ধীরে ধীরে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ওর জন্মদিন আজ। আজকেই যদি ওকে আটকাই, তবে কবে আনন্দ করবে?”

“আপনার ছেলে একদিন আমাকে পাগল করে ছাড়বে।”

আরশান হেসে উত্তর দিলো , “ছেলেটা একদম আমার মতো হয়েছে।”

এবার সাঁঝ রাগ দেখানোর ভান করে বললো, “তাহলে তো আমার দুঃখের শেষ নেই।”

সাঁঝ দ্রুত আরিদের কেকমাখা হাতগুলো ধুয়ে দিল। নাহলে সারা রুম ভরিয়ে ফেলবে। আরিদ বারবার হাত ঝাপটাচ্ছিল, পানি পেলে আর শান্ত হয়ে থাকে না। সাবান মেখে ভালো করে হাত ধোয়ার পর সাঁঝ তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দেয়। আরিদ খুশিতে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে দৌড়ে গিয়ে আরশানের কাছে দাঁড়াল। তার চোখ-মুখে আবদার ফুঁসে উঠছে।

“পাপা, ঘুরতে যাবো।”

“এখন? এখন তো রাত হয়ে গেছে। আমরা কালকে যাবো, ঠিক আছে।”

কিন্তু আরিদ জেদ ধরে বসলো, তার ছোট্ট ঠোঁট ফুলিয়ে বললো, “না, এখনই যাবো।”

“আরিদ, রাত হয়ে গেছে। এভাবে রাতে ঘুরতে যায় না।”

আরিদ প্রায় কান্নার ভঙ্গি করে ফেললো। তখনই সাঁঝ আরিদের কথা শুনে এগিয়ে আসে।
“চলুন না, যাই।”

আরশান ছেলের উচ্ছ্বসিত মুখটা একবার দেখলো, চোখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অবশেষে হাল ছেড়ে হেসে বলল, “ঠিক আছে, তবে বেশি দূরে নয়।”

আরিদ খুশিতে তালি দিয়ে লাফিয়ে উঠলো।
“ইয়ে! পাপা বেস্ট।”

আরশান রেডি হয়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে এলো। শীতের কারণে জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে। বাইরে বেরিয়েই পিছনে তাকাল সে, কিন্তু কোথাও আরিদের দেখা নেই।

“আরিদ?”

অল্পক্ষণের মধ্যেই ভেতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো আরিদ। ছোট ছোট পায়ে মোটা বুট পরে দৌড়াতে গিয়ে হোঁচট খাওয়ার মতো হলেও সে সামলে নিলো। একেবারে ছোট্ট পুতুলের মতো লাগছিল তাকে। ঠোঁট থেকে সাদা ধোঁয়ার মতো নিঃশ্বাস বের হচ্ছে। ছোট্ট গলায় বলে উঠলো,

“I am coming.”

আরশান হেসে নিচু হয়ে তাকে কোলে তুলে নিল। আরিদের গালে লালচে আভা জমে গেছে শীতের জন্য, যেনো টুকটুকে আপেল।

“তোমার মাম্মাম আসছে না কেন?” আরশান জিজ্ঞেস করতেই আরিদ দুই হাত তুলে মিষ্টি গলায় ডাক দিল, “মাম্মা।”

ভেতর থেকে ভেসে এলো সাঁঝের কণ্ঠ,”আসছি, একটু দাঁড়াও।”

কিছুক্ষণ পরেই সাঁঝ দরজা টেনে বের হয়ে এলো। ঠান্ডা হাওয়া তার গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে।
তিনজন একসাথে হাঁটতে শুরু করলো। কানাডার শীতের রাত। রাস্তার দুই পাশে গাছগুলো বরফে মোড়া, চারপাশে বরফের সাদা চাদর, রাস্তার লাইটগুলো ঝিকিমিকি করছে। আরিদ আরশানের হাত ছেড়ে নিচে নেমে এল। ছোট ছোট বুট পায়ে টুপটাপ শব্দ তুলে দৌড়াতে শুরু করলো। মুখে খুশির ঝলক।

“ধীরে দৌড়াও, পড়ে যাবে।”

কিন্তু আরিদ শুনলো না, আরও জোরে দৌড়াতে লাগলো, মাঝে মাঝে বরফে হাত দিয়ে ছুঁয়ে আবার তাঁদের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
আরশান আর সাঁঝ ধীর পায়ে হাঁটছে। সাঁঝের হাত শক্ত করে ধরে আছে আরশান, ঠান্ডার হাওয়া কেটে আসছে, তবুও এই মুহূর্তে উষ্ণতার অভাব নেই।

“দেখুন না, ও কী খুশি হয়েছে।”সাঁঝ মৃদু হেসে বলল।

আরশান সাঁঝের মুখের দিকে তাকালো, ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। আরিদ তখনও দৌড়াচ্ছে সামনে, হাসছে, আবার বরফ হাত দিয়ে ছুঁয়ে বলছে, “পাপা, মাম্মা, দেখো।”

আরশান তাকিয়ে রইলো, তার জীবনের সবথেকে সুন্দর মুহূর্তগুলো। শীতের শহরে উষ্ণ ভালোবাসার এক টুকরো রাত।

~ সমাপ্ত ~