এক পশলা প্রেম পর্ব-১০

0
15

#এক_পশলা_প্রেম
#পর্ব_১০
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

অক্টোবর শেষে নভেম্বরের আগমন ঘটেছে।নভেম্বরে গ্রামের মতো শহরেও প্রকৃতি বদলায় নীরবে। দিনের আলোতে আর আগের সেই উজ্জ্বলতা থাকে না, সূর্যের রোদ যেন একদম মোলায়েম হয়ে এসেছে। আর তার আলোয় শহরের রাস্তাগুলো কেমন যেন কোমল হয়ে ওঠে আজকাল। বড় বড় দালানকোঠার ছায়া লম্বা হয়ে মাটিতে বিছিয়ে পড়ে, আর সেখানে ছড়িয়ে থাকে কিছু শুকনো পাতা, বাতাসে কাঁপে মৃদু শব্দে। ফুটপাতের ধারে থাকা গাছগুলোর পাতা ঝরে পড়ে রাস্তার ওপর, আর মাঝে মাঝে বাসের চাকায় সেগুলো গুঁড়ো হয়ে যায়। শহরের পার্কগুলোতে সকালের দিকে কুয়াশার আস্তরণ দেখা যায়, যেন ধোঁয়াশায় মোড়ানো এক স্বপ্নজগৎ। ছুটির দিনে মানুষজন সেখানে এসে বসে, হালকা শীতের ছোঁয়া গায়ে মেখে। রাস্তাঘাটে মানুষের ভিড় কমে না, কিন্তু হাঁটার ছন্দ যেন একটু ধীর। গায়ে শীতের ছোঁয়া নিয়ে মানুষ দ্রুত হাঁটে, কোট কিংবা মাফলার জড়িয়ে। বিকেল বেলা, সূর্যাস্তের আলো যখন বিল্ডিংগুলোর জানালায় ঝিলমিল করে, শহরটাও যেন একটু উদাস হয়ে যায়। নভেম্বরের সন্ধ্যায় দোকানগুলো আলোকিত হতে শুরু করে, রাস্তাগুলো আরও উজ্জ্বল মনে হয়, আর চারপাশে যেন একধরনের শান্ত শিহরণ ছড়িয়ে থাকে। আসন্ন শীতের অপেক্ষা শহরের বাতাসে মিশে থাকে, আর প্রতিটা মোড়, প্রতিটা অলিগলি যেন নিঃশব্দে শীতের আগমনের প্রহর গুনে।

” কী ব্যাপার? এই সন্ধ্যাবেলা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছো? ”
আয়ান রুমে ঢুকে টেবিলের ওপর একটা প্যাকেট রেখে গায়ের শার্ট খুলতে খুলতে শুধালো। অনিমা শোয়া থেকে উঠে বসেছে।
” আরে ঠান্ডা লাগছে সেজন্য। চেঞ্জ করার জন্য ওয়াশরুম আছে। এখানে দাঁড়িয়ে করতে হবে কেন? ”
” কেনো? ভয় পাচ্ছ? কন্ট্রোল হারাবে না-কি! ”

আয়ানের কথায় মুখ ভেংচি কেটে অন্য দিকে দৃষ্টিপাত করলো অনিমা। কম্বল সরিয়ে সোজা হয়ে বসলো। আজকাল ভালোই শীত শীত লাগছে।

” আমার বয়েই গেছে। ”
” বুঝলাম। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। দেখো তো ব্যাগে কী আছে, পছন্দ হয় কি-না। আর ওখানে বাদাম আছে। ”
আয়ান টেবিলের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে একটা প্যাকেট দেখাল। অনিমা মাথা নেড়ে, বসা থেকে উঠে টেবিলের দিকে এগোচ্ছে। আয়ান তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছে। বাদাম ভাজা অনিমার ফেভারিট। প্যাকেটের মধ্যে একটা শাল, একটা কালো রঙের জামদানি শাড়ি সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ ও পেটিকোট আছে। শাল না হয় হালকা শীতের কারণে গায়ে দিবে কিন্তু হঠাৎ নতুন শাড়ি কেনো? অনিমা মাথা চুলকে শাড়িটা ওলটপালট করে দেখলো। বেশ সুন্দর! কালো আয়ানের প্রিয় রঙ। অনিমারও ভালো লাগে তবে সাদা বেশি ভালো লাগে।
” পছন্দ হয়েছে? ”
আয়ান তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে অনিমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সামনের চুলগুলো থেকে টুপটুপ করে পানি ঝরছে। নিজস্ব পুরুষের দিকে অনিমা একঝলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মনে মনে বলে উঠলো, “ মাশাআল্লাহ! ”

অনিমার নীরবতায় আয়ান ফের বলে উঠল,
” পছন্দ না হলেও সমস্যা নেই। অন্য শাড়ি এনে দিবো। কালো শাড়িতে তোমাকে সুন্দর লাগবে ভেবেই কিনলাম। ”
” আরে পছন্দ হয়েছে তো! আমি একটু অন্য কথা ভাবছিলাম সেজন্য উত্তর দিতে লেট হলো। ”
” কী ভাবছ? আমাকে বলো। ”
” তেমন কিছু না। ”
অনিমা ঠোঁট টিপে হাসছে। আয়ানকে সে কীভাবে বলবে তার সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে আনমনে জল্পনাকল্পনা করছিল!
” সত্যি তো? ”
” হ্যাঁ। ওয়েট!”
” ওকে। ”
অনিমা শাড়িটা নিজের গায়ে ধরে আয়ানের দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,
” কেমন লাগছে? ”
” আমার বউ মানেই সব সময় সুন্দরী। মাশা-আল্লাহ। ”
” ধন্যবাদ স্যার! ”
” এই দুষ্ট মেয়ে! ”
আয়ান অনিমাকে ধরতে গেলে অনিমা দরজার দিকে ছুট লাগায়। ফলশ্রুতিতে বউকে আর ধরতে পারে না সে। রাতের জন্য রান্না করতে হবে। সেজন্য গেলো অনিমা। কিন্তু অর্ষার বিয়ের জন্য কী গিফট কিনবে সে নিয়ে তো আলোচনা করা হলো না! আয়ান এটা ভেবে গায়ে টি-শার্ট জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলো। ওখানে বসেই না হয় আলোচনা করে নিবে।

” সাকিন! ”
” হুম বড়ো আব্বু বলো। ”
” কী বলব? তুমি কি আমার কথা শুনছো না? ”
বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করলেন আতিক চৌধুরী। সাকিন এতক্ষণে ফোনের স্ক্রিন থেকে নজর সরিয়ে সামনে তাকাল। প্রতিদিনের মতোই আজও বসার ঘরে সোফায় বসে ফোনে গেইমস খেলছে সাকিন।
” সরি। এবার বলো। ”
এরমধ্যে অনিমার সাথে কথা বলবে বলে আয়ানও রান্নাঘরে ঢুকে দাঁড়াল।
” এভাবে কি জীবন চলে সাকিন? হয় কোম্পানিতে জয়েন হও নয়তো বিয়ে করো। ”
” কাজকর্ম তো আমাকে দিয়ে হবে না। তাহলে আমাকে কে বিয়ে করবে বড়ো আব্বু?”
” সাকিন বিয়ে তো করতেই হবে তাই না? তাছাড়া এখনো কাজকর্ম না করলে কবে করবে? তোমার মাস্টার্স শেষ। এখনও যদি নিজের বিষয় সিরিয়াস না হও আর কবে? ”

সাকিন একটু নড়েচড়ে উঠলো। সিরিয়াস কথাটা শুনেই ওর মনে পড়লো পাখি ওকে দেখা করতে বলেছিল। ইশ! মেয়েটা বাসায় না এলেই হয়।

” বড়ো আব্বু তুমি থাকো। আমার একটা সিরিয়াস কথা মনে পড়ে গেল। একটু বের হবো। ”

আতিক চৌধুরী হতাশ হয়ে বললেন,
” যাচ্ছ যাও তবে রাতে বাইরে থেকো না। ”

সাকিন এরমধ্যে বসা থেকে উঠে দরজা খুলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। আতিক চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিভি অন করে খবরের দিকে মনোযোগ দিলেন।

বাসা থেকে বেরিয়ে রিক্সা নিয়ে পাখিদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে সাকিন। পরনে ওর হাফপ্যান্ট, কালো রঙের টি-শার্ট। বাবরি চুল হওয়ায় চুলগুলো বেশ এলোমেলো লাগছে। তবে সাকিন যে নিজের চুলের খুব একটা যত্ন করে তেমনও নয়। কিন্তু এখন কীভাবে বাসা থেকে বের করবে পাখিকে? লাস্ট পাঁচ দিন আগে পাখির সাথে কলে কথা হয়েছিল সাকিনের। মেয়েটা ভীষণ রেগে ছিলো তখন। মাসের অর্ধেক সময় নিজের মতো করে থাকে সাকিন। পাখির সাথে কোনো যোগাযোগ পর্যন্ত করে না। ইচ্ছে মতো বাসায় গেমস খেলে সময় কাটায় নয়তো একা ঘুরতে বের হয়ে যায়। এসব পাখির খুব বিরক্ত লাগে। মেয়েটা রাগ করে কিন্তু সাকিন রাগ ভাঙানোর চেষ্টাও করে না। এরকম করলে কোন মেয়ে রিলেশনশিপ কন্টিনিউ করে? সাকিন দাঁড়িয়ে আছে। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তবুও পাখিকে কল করেনি সে। বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে কেবল। সাকিন জানে কখন বারান্দায় আসবে পাখি। আর মাত্র কয়েক মিনিটের অপেক্ষা! তারপরই সে আসবে বারান্দায়। সাকিনের ধারণাই ঠিক হলো। ঠিক চার মিনিটের মধ্যে বারান্দায় দৃশ্যমান হলো পাখি। কোমড় অবধি লম্বা চুলগুলো আজ খোঁপা করে রেখেছে মেয়েটা, পরনে থ্রি-পিস। পাখি একেবারে চুপচাপ, শান্ত স্বভাবের একটা মেয়ে। সহজে রাগ করে না। আর রাগ করলেও কখনো ঝগড়া কিংবা চেল্লাচিল্লি করে না। সাকিন কোনো কথা না বলে পাখিকে দেখছে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে। মিনিট দশেক ওভাবেই দেখল শুধু। পাখিও দেখেছে সাকিনকে। সে-ও নিশ্চুপ। দু-চোখ ছলছল করছে মেয়েটার। যতই রাগ করুক সাকিনকে দেখলে বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা করে। অভিমানে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে শুধু কাঁদতে পারে না। সাকিন এতক্ষণে পাখিকে ইশারা করে। পাখি বুঝেও চুপ করে আছে। বাসা থেকে বের হতে বলছে সাকিন। পাখি শহরে লেখাপড়া করার জন্য বান্ধবীদের নিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকে। সেজন্য যখন-তখন বাসা থেকে বের হওয়া নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই তার। বারকয়েক বলার পরও যখন পাখি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না তখন ওর ফোনে কল করলো সাকিন।

” পাখি! ”
” বলো। ”
” নিচে এসো। ”
” আসবো না। ”
” কেনো?”
” ইচ্ছে করছে না। ”

সাকিন চুপ করে থাকে। পাখিও কথা না বলে চুপচাপ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সাকিন আবার বলতে শুরু করে,

” পাঁচ মিনিটের জন্য এসো। ভালো না লাগলে চলে যেও। ”
” ঠিক আছে। ”

কল কাটে না সাকিন। পাখি ঠিক পাঁচ মিনিট পর নিচে নেমে আসে। এখনও কল কাটেনি কেউ। মুখোমুখি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। কল কাটল সাকিন। পাখি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সাকিন কোনো কথা না বলে আরেকটু সামনে এগিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো পাখিকে। বাঁধা দিলো না সে-ও। সাকিনকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে চোখবুঁজে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এভাবেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো দু’জন। ওদের এমন ভালোবাসাময় মুহুর্ত দেখে অনেক পথচারী মুচকি মুচকি হাসছে। তাতে ওদের কিছু যায় আসে না। বুকে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় সাকিন শুধালো,

” বাসায় ফিরে যাবে? না-কি রিক্সায় চড়ে ঘুরবে? ”
” বাসায় যাবো না। ”
অস্ফুটে স্বরে জবাব দিলো পাখি। সাকিন হেসে কোলে তুলে নিলো পাখিকে। খিলখিল করে হাসছে ছেলেটা। পাখি ব্যস্ত হয়ে বললো,
” কী করছো? ”
” কোলে নিয়ে হাঁটব। ওয়েট রিক্সা দাঁড় করাচ্ছি। ”

চলবে,