এক পশলা প্রেম পর্ব-১১

0
125

#এক_পশলা_প্রেম
#পর্ব_১১
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

সাকিন হেসে কোলে তুলে নিলো পাখিকে। খিলখিল করে হাসছে ছেলেটা। পাখি ব্যস্ত হয়ে বললো,
” কী করছো? ”
” কোলে নিয়ে হাঁটব। ওয়েট রিক্সা দাঁড় করাচ্ছি। ”

” সেই কবে বলেছিলাম বাসায় এসো আর এলে আজ! আমার বেলায় কেনো এতো বেখেয়ালি তুমি? ”

সাকিন পাখিকে কোলে নিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছে। লোকজন ওদের তাকিয়ে দেখছে। এমন আধপাগল কাপল লোকজন খুব কম দেখেছে হয়তো। সাকিন পাখির কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। হেসে বললো,

” বিয়ে করবে? ”
” বিয়ের দিন তোমাকে খুঁজে পাবো তো সাকিন? ”

পাখির কথা শেষ হতেই দু’জনেই একসাথে হেসে উঠলো।

আজ অর্ষা আর আবরিশামের বিয়ে। বিয়ে বাড়ির সাজসজ্জা ঠিক স্বপ্নের মতোই লাগছে। অর্ষার বাবা মেয়ের বিয়েতে কোনো ত্রুটি রাখেননি। বাড়ির গেট থেকেই শুরু হয়েছে মুগ্ধতা। বড়, সোনালি বর্ণের গেটটিকে ঘিরে আছে সাদা আর গোলাপি ফুলের মালা, ওপরে ঝুলছে ছোট ছোট ফেইরি লাইটের মালা। গেট পেরিয়েই অতিথিদের পা রাখার জন্য একটি আলোকিত পথ তৈরি করা হয়েছে , যার সাহায্যে অতিথিরা সরাসরি মঞ্চের দিকে যেতে পারবে।

মঞ্চটি যেন এক রাজকীয় আয়োজনে তৈরি। সোনালি আর লালের সমন্বয়ে তৈরি করা মঞ্চটির ব্যাকগ্রাউন্ডে রয়েছে জ্যামিতিক ডিজাইনের ঝাড়বাতি ও কাপড়ের ঝুলানো পর্দা। এর সামনে সারিবদ্ধভাবে সাজানো রজনীগন্ধা আর গোলাপের তোড়া, যা দেখলে মনে হয় যেন ফুলের এক বিশাল পটভূমি। মঞ্চের মাঝখানে আবরিশাম ও অর্ষার বসার জায়গাটি তৈরি করা হয়েছে নরম ও আরামদায়ক সোফায়, যার ওপর সোনালি ও সাদা কুশনের সাজ। দুই পাশে বরকনে বসে আছে। তবে কনের সামনে পাতলা পর্দা দিয়ে ঘেরা, যাতে তাকে কেউ স্পষ্ট দেখতে না পারে। কাজী সাহেব বসে আছেন মাঝখানে। অর্ষার সাথে বসে আছে অনিমা। পরনে সেই কালো রঙের শাড়ি, খোঁপা করা চুলে লাল গোলাপ, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। আবরিশামের সাথে বসে আছে আয়ান। সবাই খুব খুশি।

অতিথিদের বসার জায়গাগুলোও সাজানো হয়েছে সুচারুভাবে। প্রতিটি চেয়ারের পেছনে সাদা সিল্কের কাপড়ের ফিতা বাঁধা, আর প্রতিটি টেবিলে রয়েছে ছোট লণ্ঠন ও মোমবাতির আলো। টেবিলের মাঝে ছোট গোলাপের তোড়া রাখা হয়েছে, যা পুরো পরিবেশে একটি নরম রোমান্টিক আবহ এনে দিয়েছে। ডাইনিং এরিয়ার দিকে আলাদা নজর দেওয়া হয়েছে। খাবারের টেবিলগুলো সাজানো হয়েছে বাফেট স্টাইলে, প্রতিটি টেবিলের উপরে রয়েছে ফেইরি লাইটের ঝলমলে সাজ, আর খাবারের ডিশগুলোও সুন্দরভাবে সাজানো। একপাশে রাখা বেলুন আর ছোট ছোট লাইটিং-এর সাজ পুরো পরিবেশটাকে আরও মোহনীয় করে তুলেছে।

অতিথিরা যেন প্রতিটি কোণায় ঢুকে এক নতুন চমকে ভরে যাচ্ছেন—এমনই এক রাজকীয় পরিবেশে অর্ষা আর আবরিশামের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে । প্রণয় আর আলিফ তো রীতিমতো অবাক হয়েছে এতো সাজসজ্জা দেখে। অর্ষার বাবা মেয়ের বিয়ে ভাগ্নের সাথে দিবে না দিবে করছিল আর এখন এতো সুন্দর করে বিয়ে দিচ্ছে!

” কবুল, কবুল, কবুল। ” তিন কবুলে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ল অর্ষা। এই তিন কবুলের মাধ্যমে মেয়েরা সারাজীবনের জন্য একটা মানুষের হৃদয়ে স্থান পায়। আবরিশামের দুচোখ ছলছল করছে। আয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। একজন পুরুষ মানুষ তার ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার জন্য কান্না করছে! কী ভয়ংকর সুন্দর মুহুর্ত…..

” আলহামদুলিল্লাহ! আজ থেকে তুইও আমার দলে। এখন শুধু প্রিয়ন্তি বাকি আছে। ”

অনিমা অর্ষাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো। মাথা নিচু করে মুচকি হাসলো অর্ষা। প্রিয়ন্তি বললো,

” আমার তো মাথা খারাপ হয়নি। যেচে পাবনার দিকে যেতে চাচ্ছি না। তোরা বছরখানেক পরে বিয়ের ওপর রিভিউ দিস। পছন্দ হলে ভেবে দেখব। ”

প্রিয়ন্তির কথায় সবাই একসাথে হেসে উঠলো।

যেহেতু অর্ষা ও আবরিশামদের বাড়ি খুব একটা দূরে না সেজন্য একটু রাত করেই বের হলো বরপক্ষ। বাবার বাড়ি থেকে চলে আসার সময় অর্ষার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু কিছু তো করার নেই! শ্বশুর বাড়ি যেতেই হবে। বাবা-মাকে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানিয়ে তাই শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়িতে বসে আছে সে। আবরিশাম কিছুক্ষণ পর পর টিস্যু দিয়ে ওর চোখ মুছে দিচ্ছে। আপাতত কিছু বলবে না। বাসায় যাক তারপর ধরবে। ফুপুর বাসায় যাচ্ছে তাতে এতো কান্নাকাটি করা লাগে?

ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল বিনুনি করছে অনিমা। আজকে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। বিয়ে বাড়িতে যাওয়া-আসা, তৈলাক্ত খাবার খাওয়া সব মিলিয়ে এখন অশান্তি লাগছে বেশ। আয়ান মাত্র রুমে ঢুকল। এতক্ষণ বসার ঘরে সাকিনের সাথে কথাবার্তা বলছিল। ঘরে ঢুকেই দরজা আঁটকে দিয়ে অনিমাকে অবাক করে দিয়ে কোলে তুলে নিলো সে।

” কী করছেন! আরে……”

আয়ান অনিমাকে বিছানায় শোয়াল । তারপর নিজেও ওর পাশে শুয়ে বললো,

” তোমার বান্ধবীর তো আজ ফুলসজ্জা! ”
” হ্যাঁ, তো? ”
আয়ান কনুইতে ভর দিয়ে শুয়ে অনিামর মুখের দিকে একটু ঝুঁকে দুষ্ট ইশারা করে বলে,

” তো মানে…. চলো না আমরাও? হুম হুম? ”

অনিমা হেসে আয়ানের বুকে কয়েকটা ঘুষি মারলো। বেচারা আয়ান ব্যথায় শুয়ে পড়লো এবার।

” এভাবে মারতেও পারো তুমি? বাবারে বাবা! একটু ফুলসজ্জাই করতে চেয়েছিলাম, তাতেই এরকম মার? ”

” একটু ফুলসজ্জা? আর কী করতে চান তাহলে হ্যাঁ? বদ লোক একটা। সরুন, সরুন বলছি। ”

আয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হতাশ হওয়ার ভাবসাব করে বললো,

” বুঝলাম! আজকে আর হচ্ছে না। যাগগে চুব রাত্রি। ”

” ওটা শুভ রাত্রি হবে নট চুব রাত্রি। ”

” যার বউ তাকে ফুলসজ্জা করতে না দেওয়ার জন্য মারধর করে তার আবার চুব রাত্রিও বা কী আর শুভ রাত্রির মধ্যে পার্থক্য কী! ”

অনিমা মিটিমিটি হাসছে শুধু। আয়ান মুখ ঘুরিয়ে শুয়েছে। সত্যি সত্যি আজ কিচ্ছু হবে না! কিন্তু আয়ানের ধারণা বদলে দিয়ে অনিমা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল তাকে।

” চলুন ফুলসজ্জা করি। ”

আয়ান দ্রুত অনিমার দিকে ফিরল। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইলো কিছু সময়।
” আজ থাক। আজকে আমার বউ খুব ক্লান্ত। ”
” বাব্বাহ! স্যার আপনি এতো কেয়ারিং কবে হলেন?”
” আজ থেকে। বুকে এসে শুয়ে ঘুমাও। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ”
অনিমা হাসলো। সত্যি আয়ানের বুকে মাথা রেখে কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্তির ঘুম দিলো সে।

” সমস্যা কী তোর? এমন ভ্যা ভ্যা করে কাঁদলি কেন তখন? বাসায় ঢুকলি আর আম্মু আর তুই শুরু করলি কান্নাকাটি! সিরিয়াসলি তোরা পারিস ও। ”

বিছানায় মুখোমুখি বসে আছে আবরিশাম ও অর্ষা। আবু ভাইয়ের বকা শুনতে মোটেও ভালো লাগছে না এখন। তবুও শুনতে হচ্ছে। আজ না কাঁদলে কবে কাঁদবে? আর অর্ষা কী করতে পারে যদি ওর ফুপুও কাঁদে!

” আমি কী করবো ফুপি কাঁদলে! ”
” সেই তো তুই কী করবি। মানলাম তুই বাবা বাড়ি রেখে এসেছিস বলে কান্নাকাটি করেছিস কিন্তু মা? আল্লাহ গো! তোদের কান্নাকাটি দেখে মনে হচ্ছিল আমি খুনের আসামি, তোকে খুন করে বাসায় নিয়ে আসছি। ”

অর্ষার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। আবরিশামের রাগী রাগী মুখটা দেখতে বাচ্চাদের মতো লাগছে। সুদর্শন পুরুষটিকে লাল পাঞ্জাবিতে এতো সুন্দর লাগবে ভাবতেও পারেনি অর্ষা। কতবার যে আড়চোখে আবরিশামকে সে দেখেছে, লোকটা হয়তো তা টেরও পায়নি।

” ফুপির বদলে আমি না হয় সরি বললাম। ”
” হইছে! ”

আবরিশাম আস্তে করে দু’হাত বাড়িয়ে অর্ষার গালের দু’পাশে রাখল। কিঞ্চিৎ চমকাল অর্ষা। তার স্পর্শে যেন এক নরম, মমতামাখা উষ্ণতা মিশে গেল। আবরিশামের আঙুলগুলো অর্ষার গালের কোমল ত্বকে আলতোভাবে ছুঁয়ে আছে , যেন স্পর্শের মধ্য দিয়েই সে তার মনের যত্ন, ভালোবাসা, আর প্রশ্রয় অনুভব করাতে চাচ্ছে । অর্ষা নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল আবরিশামের চোখের দিকে, তার মুখে লেগে থাকা হালকা হাসির মধ্যে যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তি।

” কী হলো আবু ভাই? ”

চট করে হাত সরিয়ে নিলো আবরিশাম। মুখটা প্যাঁচার মতে করে ফেলে বলল,

” তোর আমার সুখ সহ্য হয় না অর্ষা? কী সুন্দর একটা মুহুর্তে আবু ভাই কেন ডাকতে হলো! আদর করার মধ্যে পারলে বলিস, ‘ আবু ভাই ‘ ”

অর্ষা জোরেসোরে হেসে উঠলো এবার। আবরিশাম চোখমুখ কুঁচকে বসে আছে। মেয়েটা সব সময় এমন করে কেন?

” আচ্ছা আজকে আর বলছি না। ”

” সত্যি? ”
” হ্যাঁ সত্যি। ”
” আই লাভ ইউ আমার কিউট বউটা! ”
” আই লাভ মি। ”
অর্ষা আবারো হাসছে। আবরিশাম চোখে পাকিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
” লাভ ইউ টু বল। ”
” বলব না। ”
” না বললে নাই। বলতে হবে না। আপাতত বউকে আদর করি, লাভ ইউ না বললেও চলবে। ”

অর্ষা ভেংচি কেটে দূরে সরে বসলো একটু। আবরিশাম চোখ টিপ্পনী কেটে হেসে বললো,
” দূরে সরে লাভ নেই মামাতো বউ। তোমার বর খুব রোমান্টিক। ”

” মামাতো বউ! আল্লাহ আর কী কী যে শুনতে হবে জীবনে। ”

আবরিশাম অর্ষাকে পেছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,

” অনেক কিছু……. ”

চলবে,