এক পশলা প্রেম পর্ব-১৩

0
201

#এক_পশলা_প্রেম
#পর্ব_১৩
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

সাকিন এখনো পাখিকে নিয়ে বাসায় আসেনি। হঠাৎ করে পাখির একজন রুমমেট অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে নিয়ে হসপিটালে গেছে পাখি। সাকিনও আছে সাথে। আয়ান মিনিট পাঁচেক আগে কল করেছিল, বলেছে রাস্তায় আছে ওরা। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।

চৌধুরীর বাড়ির ডাইনিং টেবিলে হরেকরকমের খাবার সাজানো হয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই সাকিন পাখিকে নিয়ে এসেছে। আয়ান, আতিক চৌধুরী সবাই পাখির সাথে টুকটাক কথা শেষে এখন খেতে বসেছে। পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছে সাকিন ও পাখি। অনিমা সবাইকে খাবার পরিবেশন করছে। আয়ান চুপচাপ প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্ষিদের জন্য পেটে চুচু করছে তার। সাকিন পাখির দিকে মাঝে মাঝেই আড়চোখে তাকাচ্ছে। আতিক চৌধুরী খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে। আগে অতিথি খাওয়া শুরু না করলে তো খাওয়া যায় না।

” খাওয়া শুরু করো পাখি। লজ্জা পেতে হবে না। কিছুদিন পর তো এইখানে বসেই খাবে। ”

অনিমা হেসে বললো। এরমধ্যে সবাই খাওয়া শুরু করেছে। পাখি মুচকি হেসে বললো,

” খাচ্ছি ভাবি। আপনিও বসুন! সবাই একসাথে খাবো। ”
” হ্যাঁ তুমিও বসো। সবকিছু তো টেবিলে রাখাই আছে, আমরা নিয়ে নিবো। ”

পাখির কথা শেষে আয়ান বললো। অনিমাও বসলো খেতে।

” তারপর পাখি আমাদের কেমন লেগেছে? এ বাড়ির ছোটো বউ হয়ে আসবে তো? ”

আতিক চৌধুরীর থেকে এরকম কথা শুনে আবেগে ভেসে যাচ্ছে পাখি। কতটা সম্মান দিয়ে কথা বলছে সবাই! সত্যি সাকিনের মতো ওর পরিবারের লোকজনগুলোও জোশ।

” আমার সৌভাগ্য আপনাদের বাড়ির বউ হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। অবশ্যই আসবো। ”

” বাহ! ঠিক আছে মা। ”

এভাবেই সবাই মিলে কথা, হাসি-তামাশা করতে করতে রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে।

” তারপর পাখি, আমার অমন বাউণ্ডুলে দেবরকে কীভাবে সামলাও তুমি? ”

বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো অনিমা। পাখিও শুয়েছে। শাড়ি চেঞ্জ করে অনিমার থ্রি-পিস পরেছে পাখি। আয়ান আর সাকিন, সাকিনের রুমে থাকবে আজ।

” আমি নিজের মতো চুপচাপ থাকি ভাবি। তার যখন মনে পড়ে, কেউ একজন আছে জীবনে তখন নিজে থেকেই আসে খোঁজ নিতে। বাকিটা সময় আমার একাকীত্বে কাটে। মাঝে মধ্যে খুব খারাপ লাগে যদিও, কিন্তু কিছু আো করার নেই। আমি তো ওকে ছাড়া থাকতে পারব না। ”

কথাগুলো বলে লজ্জায় দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো পাখি। অনিমা মিটিমিটি হাসছে। ভালোবাসা দেখলেও ভালো লাগে।

” বেশ, বেশ। বুঝতে পেরেছি। এতো লজ্জা পেতে হবে না। ”

অনিমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে দরজায় ঠকঠক করে আওয়াজ ভেসে এলো। পাখি বলল,

” মনে হয় ভাইয়া কিছু বলতে এসেছেন। তুমি গিয়ে দরজা খুলে দাও। ”

অনিমা শোয়া থেকে উঠে বসল। পাখির কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দরজার দিকে এগোলো। দরজা খুলতেই আয়ানকে দেখে জিজ্ঞেস করে অনিমা,

” কী হয়েছে? ”
” আচ্ছা শোনো না, পাখি না হয় এ ঘরে একাই থাক? তুমি আর আমি বরং গেস্ট রুমে ঘুমাবো? ”

ফিসফিস করে বললো আয়ান। অনিমা ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,
” এসবের দরকার কী? একটা রাতের ব্যাপার। যান শুয়ে পড়ুন। ”
” আরে শোনো না! ”
” হ্যাঁ বলুন। ”
” আমার তোমাকে ছাড়া ঘুম আসছে না। প্লিজ চলো না। ”

অনিমা হাসতে লাগলো। লোকটা কী যে পাগলামি করে আজকাল!

” তা হয় না। পাখি মনে মনে কী ভাববে বলুন তো? ”

আয়ান সত্যি ভাবলো কিছু একটা। তারপর মুখটা গোমড়া করে ফেলে বলল,
” তা-ও ঠিক বলেছ। কী আর করার! আচ্ছা শুভ রাত্রি। ”
” শুভ রাত্রি। ”

অনিমা দরজা আঁটকে দিবে এমন সময় আয়ান একটা হাত দরজায় রেখে বাঁধা দিলো।
” এই একটা কিস করে দাও। এই যে কপালে দিলেই হবে। ”
” পাখি তাকিয়ে আছে এদিকে। ”
” তুমি আমার সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়ে তারপর দাও। ও বুঝবে না, আর বুঝলেও বা কী? দাও নইলে যাচ্ছি না। ”

” ওকে ওকে। ”

অনিমা শেষমেশ আলতো করে আয়ানের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। খুশিতে বাক-বাকুম করতে করতে আয়ান সাকিনের রুমের দিকে এগোচ্ছে দেখে দরজা আঁটকে দিলো অনিমাও।

কয়েকদিনের মধ্যেই পাখির বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলতে যান আতিক চৌধুরী। মেয়ের বাবা-মা একবাক্যে বিয়েতে হ্যাঁ করে দেয়। চৌধুরী পরিবারের নামযশ নেহাত কম না। তার ওপর পাখির পছন্দের মানুষ সাকিন চৌধুরি! মেয়ে ভালো থাকবে বুঝলে সব বাবামায়েরাই বিয়েতে রাজি হন। দুই পরিবারের সম্মতিতে আগামী শুক্রবার বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করা হয়েছে। সেই হিসেবে দু’দিন পর ওদের বিয়ে। মোটামুটি সব কেনাকাটা হয়ে গেছে এরমধ্যে। পাখি বিয়ের পরও লেখাপড়া চালিয়ে যাবে। সাকিনও এটাই চায়। তাছাড়া বিয়ের ঝামেলা মিটলে সাকিন নিজেও কোম্পানির কাজে হাত দিবে বলে জানিয়েছে সে।

মাঝরাতে ছাদে উঠে দাঁড়িয়েছে অনিমা আর আয়ান। আকাশ যেন গভীর নীল রঙের বিশাল ক্যানভাস, যেখানে অগণিত তারা ঝিকমিক করছে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে চারপাশের গাছপালা হালকা রূপোলি আভা ছড়াচ্ছে, যেন প্রকৃতির নিজস্ব মায়াবী আলোকসজ্জা। ঠান্ডা হাওয়া ধীরে ধীরে বয়ে আসছে, আর সেই হাওয়ায় শীতলতা যেন দু’জনের অনুভূতিকে এক নতুন মাত্রা দিচ্ছে।

আয়ানের হাত শক্ত করে ধরেছে অনিমা, তার চোখে চাঁদের আলো পড়ে এক অদ্ভুত মায়া তৈরি করছে। নিস্তব্ধ রাতের মাঝে কেবল তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ, আর দূরের কোনও পাখির ক্ষীণ ডাক। আয়ান অনিমার কাঁধে হাত রেখে আলতোভাবে কাছে টেনে নেয়। ছাদের কোণ থেকে দুজনেই নিঃশব্দে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে , যেন চাঁদ তাদের নীরব সাক্ষী। মাঝে মধ্যে উত্তরের হিমশীতল হাওয়া এসে গায়ে লাগছে ওদের।

” শীত লাগছে না-কি? ”

আয়ান অনিমাকে আষ্টেপৃষ্টে বুকে জড়িয়ে নিলো। অনিমা আবেশে বুকে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

” উঁহু! আপনার বুকে থাকতে শীত লাগবে কীভাবে? অতটা ঠাণ্ডা তো এখনো পড়েনি। ”

” যাক তা-ও ভালো। তা এই মাঝরাতে ছাদে আসার শখ জাগলো কেনো? ”

” তেমন কোনো কারণ নেই স্যার। ইচ্ছে করলো আর বললাম। ”
” বেশ বুঝলাম। তা আর কতদিন ভার্সিটিতে নিজেকে সিঙ্গেল বলে রাখবে? আমি কি স্বামী হিসেবে স্বীকৃতি পাবো না? ”

অনিমা নিঃশব্দে হাসছে। আয়ান দীর্ঘশ্বাস একটা।

” কেনো বলুন তো? বিয়ে করেছি, সংসার করছি। সেসব ভার্সিটিতে বলার কী আছে! ”

” ওহ তাই না? ”

” হ্যাঁ, তাই তো। ”

” সিঙ্গেল বুঝেই তো ছেলেগুলো তোমার পেছনে পড়ে থাকে। প্রেম করতে আসে, বিয়ের প্রস্তাব দেয়। এসব কি সহ্য করার মতো বলো? আমার ভালো লাগে না এসব। ”

প্রায় বাচ্চাদের মতো করে বললো আয়ান। অনিমা বুক থেকে মাথা উঁচিয়ে আয়ানের চোখে চোখ রাখল সে। লোকটার চোখে হালকা অভিমান লুকিয়ে আছে।

” বুকে চিন চিন করছে? ”
” একটু!”
” বেশ ব্যাথা সারিয়ে দিবো। সাকিনের বিয়েটা মিটে যাক, তারপর যেদিন ক্লাসে যাবো সেদিন হাঁটে হাড়ি ভাঙব। ”

” ওকে ম্যাম। ”

আয়ান অনিমাকে পেছন দিকে ফেরালো। কোমরে দু’হাত রেখে আরেকটু গভীরভাবে জড়িয়ে নিলো । প্রেয়সীর খোলা চুলে মুখ ডুবিয়ে গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিলো কিছুক্ষণ। আয়ানের তপ্ত নিঃশ্বাসে অস্থির হয়ে উঠেছে অনিমা। কেমন বেসামাল হয়ে যাচ্ছে সে। আয়ান ঘাড়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই অনিমা লজ্জায় সামনে ফিরে আয়ানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। গুনগুন করে সুর ধরেছে আয়ান। অনিমাকে বুকে জড়িয়ে রেখেই গান ধরল সে,

❝ তোমার মাঝে নামব আমি,
তোমার ভেতর ডুব
তোমার মাঝে কাটব
সাঁতার, ভাসবো আমি খুব
তোমার মাঝেই জীবন যাপন,
স্বপ্ন দেখা, স্বপ্ন
ভাঙ্গা।

সারা নিশি ভিজব দুজন
ছাদে ঝরা জলে।
সবুজ সুখে করব কুজন নীল
আকাশের তলে
পাজর দিয়ে আগলে রব
তোমায় সারা জীবন। ❞

চলবে,