#এক_পশলা_প্রেম
#পর্ব_১৫
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
সন্ধ্যার পরপর সিলেটে পৌঁছল ওরা চারজন। তারা সিলেটের বিখ্যাত “নাজিমগড় রিসোর্ট”-এ উঠেছে। রিসোর্টটি পাহাড়ি সৌন্দর্য, গাছপালা, এবং জলাশয়ের মাঝে অবস্থিত, যেখানে ভোরের হিমেল বাতাস আর পাখির ডাক মনকে প্রশান্তি এনে দেয়। হালকা নাস্তা করে যে যার রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে এখন। যদিও তেমন ক্লান্তি নেই কারোরই। দু’ভাই ভাগাভাগি করে গাড়ি চালিয়েছে আর পাখি ও অনিমা তো বসে ছিলো কেবল।
” অনিমা রিসোর্ট পছন্দ হয়েছে? ”
বিছানায় আধশোয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলো আয়ান। অনিমা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ানের কথায় পেছন ফিরে রুমের চারদিকে নজর বুলাতে লাগলো সে। রুমে রয়েছে চমৎকার ডিজাইনের কাঠের আসবাবপত্র, যা ঐতিহ্যবাহী বাংলার ছোঁয়া দেয়। বড় এবং আরামদায়ক বেড, বাথরুমও যথেষ্ট চমৎকার, সাথে ব্যালকনিতে দাঁড়ালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
” খুব পছন্দ হয়েছে। ”
” ওকে। রেস্ট করো তারপর ডিনার সেড়ে লম্বা একটা ঘুম দিবো। ”
” না ঘুমালে হয় না? ”
অনিমার চোখেমুখে দুষ্টমি। আয়ান ভরকে গেছে ওর চোখের ইশারায়।
” মেডাম কি মুডে আছে?”
” হয়তো আছে। ”
আয়ান শোয়া থেকে উঠে অনিমার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মেরুন রঙের শাড়ি পরে আছে অনিমা সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ, কানের দুল। চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, চুলগুলো খোলা। একটু আগেই ফ্রেশ হয়ে এসেছে সে।
” তাহলে গতকালের অপূর্ণ ইচ্ছে আজ পূর্ণ করা যাক? ”
অনিমা মুচকি হাসলো। আয়ান বুঝে গেছে তাকে কী করতে হবে। অনিমাকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গেলো সে।
রুমের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাখি। এ-র আগে কখনো সিলেটে আসিনি সে। পাহাড়েও যাওয়া হয়নি কখনো। সেজন্য জাফলং যাওয়ার জন্য একটু বেশি উত্তেজিত হয়ে আছে মেয়েটা। তবে রাত হওয়ায় কিছু দেখা যাচ্ছে না এখন। সকাল হলেই বারান্দায় গিয়ে আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখবে বলে ঠিক করে ফেলেছে সে।
” ডিনার করবে না? ”
সাকিন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল পাখিকে। কাঁধে থুতনি রেখে শুধালো কথাটা।
” হ্যাঁ, খুব খিদে পেয়েছে। ”
” বেশ চলো। ভাইয়া আর ভাবিকেও ডেকে নিচ্ছি। ”
” হ্যাঁ চলো।”
কথার ফাঁকে এরমধ্যেই পাখির গালে, কপালে কতগুলো কিস করা হয়ে গেছে সাকিনের। ওর এই স্বভাবটা ভীষণ ভালো লাগে পাখির।
” ভাইয়া? ভাবি? চলো খেয়ে আসি। পাখির খুব খিদে পেয়েছে। ”
সবে দু’জন দু’জনার খুব কাছাকাছি এসেছিল এরমধ্যেই ছোটো ভাইয়ের ডাকাডাকি শুনে শোয়া থেকে উঠে বসলো আয়ান। অনিমাও চমকে উঠেছে। দ্রুত শোয়া থেকে উঠে শাড়ি ঠিকঠাক করছে সে। আয়ান শার্টের বোতাম আঁটকে বিছানা থেকে নামলো। অনিমার দিকে তাকিয়ে ফের দরজা খোলার জন্য এগোল।
” তোরা যা আমরা আসছি। পাঁচ মিনিট! ”
” ঠিক আছে ভাইয়া। ”
সাকিন আর পাখি চলে যেতেই অনিমা ফিক করে হেসে উঠলো। আয়ান মুখ গোমড়া করে বলল,
” হাসি পাচ্ছে তোমার? ”
” তো কান্না করবো? মুখখানা এমন করে আছেন যেনো সবকিছু শেষ। ”
” ধুরর! বিশেষ মুহুর্তে বিরক্ত করা সাকিনের স্বভাব হয়ে গেছে। বাসায় থাকলেও এমন করে। দেখবে দরজা বন্ধ, বুঝবে না বদ্ধ ঘরে কী চলছে? ”
অনিমা চুলগুলো আঁচড়ে নিয়ে শাড়ি আরেকটু ঠিকঠাক করে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
” চলুন খেয়ে আসি। ”
” তারপর? ”
” ধ্যাৎ! আসুন। ”
অনিমা হেসে রুম থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগলো। আয়ান মাথা চুলকে মুচকি হেসে দরজা বাইরে থেকে লক করে ওর পিছু নিয়েছে।
খাবারের জন্য ওরা বাগানে এসেছে। রিসোর্টের ভেতরেও ডাইনিং ব্যবস্থা আছে আবার খোলা আকাশের নিচে বাগানেও আছে। আয়ানরা বাগানে বসে খাবে বলে এসেছে। নাজিমগড় রিসোর্টে বাগানে খাবারের জন্য ডেকোরেশন খুবই সুন্দর এবং মনোমুগ্ধকর। বাগানের চারপাশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং গাছপালা দিয়ে পরিবেশটি সাজানো হয়েছে । টেবিলগুলো সুন্দরভাবে সজ্জিত করা হয়েছে। সেই সাথে ফুল এবং পত্রপল্লব দিয়ে সাজানো আছে , যা পুরো পরিবেশে এক ভিন্ন ধরনের আভা নিয়ে এসেছে । এই রিসোর্টের রাতের খাবারের পরিবেশন এবং আয়োজনও সুন্দর হয়, এবং অনেক সময় অতিথিদের জন্য বিশেষ বার-বি-কিউ বা বুফে ডিনারের ব্যবস্থাও থাকে। পর্যটকেরা চাইলে তাদের রেস্তোরাঁয় বসে খেতে পারে, আবার রুম সার্ভিসের মাধ্যমে কক্ষে নিয়ে খাওয়ারও সুযোগ রয়েছে।
” কী খাবে বলো? আর তোরা কী খাবি? ”
আয়ান ফোনের স্ক্রিনে তাকানো অবস্থায় জিজ্ঞেস করলো ওদের।
” মেন্যু কার্ড আছে দেখে অর্ডার করছি। ”
” তা ঠিক আছে। তবে এখানে বাঙালি, চাইনিজ, থাই এবং কন্টিনেন্টাল সব খাবারের মেন্যু পাবে। সেজন্য বললাম কোন খাবার খাবে!”
” দাঁড়াও অর্ডার করছি আমরা। ”
” ওকে। ”
সবাই মেন্যু কার্ড দেখছে। পাখি, সাকিন, অনিমা সবাই নিজেদের মতো খাবার অর্ডার করার পর আয়ানও খাবার অর্ডার করলো।
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে অনিমার বাবা-মা । এমন সময় আতিক চৌধুরীর কল আসায় একটু অবাক হলেন সত্তার শেখ। স্ত্রী তানিয়া শেখ শুধলেন,
” কী হলো? কল রিসিভ করবে না? কে কল দিয়েছে? ”
” হ্যাঁ করছি, অনিমার শ্বশুর কল দিয়েছেন। ”
স্ত্রী’কে এটুকু কথা বলে কল রিসিভ করলেন সত্তার।
” আসসালামু আলাইকুম বেয়াই মশাই। কেমন আছেন? ”
” ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ, আপনি কেমন আছেন? ”
” আলহামদুলিল্লাহ। বেয়াইন সাহেবা কেমন আছেন? ”
” আলহামদুলিল্লাহ। শরীর-স্বাস্থ্যের কী খবর বলুন! ”
” এইতো ভালোই আছে সব। বাসায় একা পড়ে গেছি ভাই। সেজন্য ভাবলাম একটু কল দিয়ে কথা বলি! ”
” সে কী! ছেলে,ছেলের বউরা কোথায়? ”
” ওঁরা সবাই ঘুরতে ঢাকার বাইরে গেছে একটু। তিনদিন পর ফিরবে। ”
” তাই বলুন! আমিও তো ভাবছিলাম হঠাৎ এমন সময় বেয়াই মশাই কল দিলেন!”
আতিক চৌধুরী জোরেশোরে হেসে উঠলেন। সত্তার শেখও হাসছেন মিটিমিটি।
” এমনিতে বুঝি কল দেইনি কখনো হ্যাঁ? ”
” তা তো দিয়েছেন। আগামীকাল তাহলে আমাদের এখানে চলে আসুন। আড্ডা হবে, খাওয়াদাওয়াজ হবে। বাসায় একা থেকে কী করবেন? ”
” তা হয় না। ”
” কেনো হয় না? আপনি না আসলে আমরা যাবো হাহা! ”
অনিমার বাবার আন্তরিকতায় বরাবর মুগ্ধ হোন আতিক চৌধুরী। ভাগ্য করে এমন পরিবারের সাথে সম্মন্ধ হয়েছে ভেবে বেশ সন্তুষ্ট তিনি।
” বেশ বেশ আমি আসবো। তবে বিকেলবেলা। রাতে আড্ডা হবে। ”
” এইতো ভালো লোকের মতো কথা। তাহলে সেই কথাই রইলো? ”
” হ্যাঁ একদম। রাখছি এখন, ভালো থাকুন। ”
” আপনিও ভালো থাকুন। আল্লাহ হাফেজ। ”
” আল্লাহ হাফেজ। ”
তানিয়া শেখ স্বামীর কথোপকথনে বুঝে গেছেন, আগামীকাল মেহমান আসবে বাড়িতে।
” জিজ্ঞেস করলে না কী বললেন? ”
” যা বোঝার বুঝেছি। ঘুমিয়ে যাও এখন। বিকেলে বাজার করার দরকার নেই, সকালবেলা করবে বরং। ”
স্ত্রী’র কথায় স্বায় দিলেন সত্তার শেখ। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলেন।
পূর্ব আকাশে সূর্য উঠেছে। গোসল সেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে অনিমা। বারান্দায় দাঁড়ালে দেখা মেলে বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর, দূরের পাহাড়, আর ঘন বনাঞ্চল। সবুজের সমারোহ আর চারপাশের পাহাড় ও চা বাগানের সৌন্দর্যে চোখ ফেরানো দ্বায়। সূর্যের আলোতে সবুজ প্রকৃতি দেখার মতো অভিজ্ঞতা সত্যিই অপূর্ব। পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর হালকা বাতাসের স্রোত এখানে মানুষের সাথে প্রকৃতির গভীর সংযোগ তৈরি করে। অনিমা চুল মুছতে মুছতে প্রকৃতির রূপ-সুধা আহরণে ব্যস্ত। বাকিরা এখনো ঘুমোচ্ছে।
সকালে তারা নাস্তা শেষে জাফলংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সিলেট শহর থেকে বের হয়েই চোখে পড়ে দূরের সবুজে ঢাকা পাহাড়ের সারি। রিসোর্ট থেকে গাড়িতে করে গেলে প্রায় দুই ঘণ্টার পথ। পথে চা-বাগানের মনোরম দৃশ্য, পাহাড়ের গা বেয়ে বয়ে যাওয়া ঝরনার কুলকুল শব্দ, এবং অবারিত সবুজ প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে ওদের মন মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। জাফলং পৌঁছাতে দেড় ঘন্টা সময় লাগে ওদের। সেখানে গিয়ে দেখা মেলে স্বচ্ছ জলধারার পিয়াইন নদী, যার নিচে ছোট-বড় পাথরগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। নদীর পাশে পাহাড়ের চূড়া থেকে বয়ে আসা স্রোতগুলো আছড়ে পড়ছে নদীর বুকে। চারপাশের নির্জন পরিবেশ, ঝরনার ধারা, আর পাহাড়ের মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে সবার।
চলবে,