#এক_পশলা_প্রেম
#পর্ব_১৬
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।
সারাদিন ঘোরাঘুরি শেষে কেবল রিসোর্টে ফিরেছে ওঁরা চারজন। সবাই বেশ ক্লান্ত। তবে সে তুলনায় পাখির কিছুটা কম ক্লান্ত লাগছে। প্রকৃতি এই অপার সৌন্দর্য বিমোহিত করে তুলেছে তাকে। ইচ্ছে করছে এখানেই থেকে যেতে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না।
ছেলের শ্বশুর বাড়িতে বেশ হাসি-তামাশায় মেতে উঠেছেন আতিক চৌধুরী। সত্তার শেখ বেশ মনখোলা মানুষ, সঙ্গে খুব মিশুক। সন্ধ্যায় হালকাপাতলা নাস্তা সেড়ে দুই বেয়াই মিলে ঘন্টাদুয়েক শুধু রাজনৈতিক আলোচনা দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। বেচারা তানিয়া! একা একা রান্নাঘরে কাজ করতে করতে শেষ । মেয়ের শ্বশুর এসেছে, তাকে তো যেনতেনভাবে আপ্যায়ন করলে হবে না। সেজন্য মাছ, মাংস, পোলাও, রোস্ট, বিরিয়ানি সবকিছুই রান্না করেছেন।
সন্ধ্যা নেমেছে শহরের বুকে। আজ সকালে তিন দিন সিলেট ট্যুর শেষে আজ ঢাকায় ফিরেছে সাকিন, পাখি, আয়ান ও অনিমা। ঘোরাঘুরি করলে আসলেই মন ফ্রেশ থাকে। শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে মাঝে মধ্যে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়া খুব দরকার। ছেলে ও ছেলের বউদের বাড়ি ফিরে আসায় আতিক চৌধুরী যেনো প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। একা বাড়িতে একটুও ভালো লাগছিল না উনার। সাকিন আজ অনিমার হাতের নুডলস খেতে চেয়েছে আজ সেজন্য অনিমা নুডলস রান্না করছে। পাখি এমনি পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ান বাসায় নেই। একটু কাজে বাইরে গেছে। কাল থেকে আবার ভার্সিটি শুরু, সেজন্য ব্যক্তিগত কাজগুলো এরমধ্যে শেষ করলে ভালো হবে। সামনে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা শুরু হলে চাপ আরো বাড়বে।
” ভাবি? নুডলস রান্না করতে গিয়ে আবার খেয়ে ফেলো না যেনো। ”
বসার ঘরে সোফায় বসে আছে সাকিন। সন্ধ্যাবেলায় এখানে বসে ফোন না টিপলে যেনো সাকিন অসম্পূর্ণ।
” ভাবি কি তোমার মতো নুডলস পাগলা নাকি? ”
অনিমা কিছু বলার আগে পাখিই বললো কথাটা। সাকিন বসা থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে এগোচ্ছে। অনিমা মুচকি মুচকি হাসছে। নুডলস রান্না শেষ হয়েছে। বাটিতে নুডলস পরিবেশন করছে সে।
” তুমি কি আমার বউ না শত্রু? কোথায় সব সময় আমার সাপোর্ট করবে, তা না করে বিরোধী দলের মতো আচরণ করো কেন? ”
” কারণ তুমি উল্টাপাল্টা কথা বলতেছ। ভাবি যে নুডলস খায় না সে কি তুমি জানো না? ”
সাকিন জিহ্বায় কামড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর এমন অবস্থা দেখে অনিমা ও পাখি জোরে হাসতে লাগলো। এরমধ্যে কলিংবেলের আওয়াজ ভেসে এলো। আয়ান এসেছে নিশ্চিত, আতিক চৌধুরী নিজের রুমে ভিডিও কনফারেন্সে ব্যস্ত আছেন। সাকিন দরজা খুলতে যাবে বলে পা বাড়ালে অনিমা বাঁধা দিয়ে বলল,
” তুমি গিয়ে বসো, পাখি নুডলস নিয়ে যাচ্ছে। আমি গিয়ে দরজা খুলছি। ”
” ঠিক আছে ভাবি। ”
অনিমার কথামতো পাখি নুডলসের বাটি হাতে বসার ঘরের দিকে এগোলো। সাকিন ওর পিছুপিছু যাচ্ছে। টিভি দেখতে দেখতে নুডলস খাবে সে। অনিমাকে দেখতেই মুচকি হাসলো আয়ান। পেছনে রাখা ডান হাতটা সামনে এনে একগুচ্ছ লাল গোলাপ এগিয়ে দিলো অনিমার দিকে। মেয়েটা ভীষণ খুশি হয়েছে।
” হঠাৎ এগুলো আনলেন? ”
অনিমা আয়ানের হাত থেকে ফুলগুলো নিলো।
” ফুলের জন্য ফুল এনেছি। তাতে হঠাৎ – এর কী হলো? ”
” ভাবলাম স্পেশাল কিছু আছে কি-না! ”
” তেমন কিছু না। চলো ভেতরে চলো। ”
আয়ান বাসার মধ্যে ঢুকল, অনিমা দরজা আটকাচ্ছে।
” এহেম, এহেম! মানুষ এখন ফুলও কেনে! আগে তো ফুলের ধারেকাছেও যেতো না। ”
আয়ানকে ক্ষ্যাপানোর জন্যই বললো সাকিন। তবে আয়ান বিশেষ পাত্তা দিলো না ওকে। মুচকি হেসে রুমে চলে গেলো। সাকিন মুখ গোমড়া করে বসে আছে। কোথায় ছ্যাঁত করে উঠবে একটু তা না! অনিমাও আয়ানের সাথে সাথে গেছে। পাখি সাকিনের চুলে আলতো করে টান দিয়ে বলল,
” ভাইয়াকে না বলে নিজেও তো ফুল আনতে পারো? বিয়ের পর একেবারে খারাপ হয়ে গেছো। ”
” কই? সিলেট যাওয়ার আগেই না কতগুলো ফুল এনে দিলাম! ”
” ফেরার পর তো দাওনি! ”
সাকিন নুডলস খাওয়া বন্ধ করে কান ধরে বলল,
” আমার ভুল হয়েছে। দয়া করে ক্ষমা করুন! আগামীকাল আপানকে অনেকগুলো ফুল এনে দেওয়া হবে। ”
” ঠিক আছে জনাব। আজকের মতো ক্ষমা করা হলো আপনাকে। ”
কথাগুলো বলা শেষে দু’জনেই একসাথে হেসে উঠলো। পাখিকেও নুডলস খাইয়ে দিতে লাগলো সাকিন।
নভেম্বরের রাত। আকাশের গভীর নীলাভ আবরণে যেনো একটা ছায়া ছড়িয়ে আছে। চারদিকে একটা নিস্তব্ধতা, কেবল বাতাসের মৃদু সুরেলা শব্দ। কিছুক্ষণ আগে শীতল হওয়া হাওয়া যেনো বারবার জানান দিচ্ছে, রাতটা অন্যরকম হতে চলেছে। চারপাশের গাছপালাগুলোও যেনো একটু কেঁপে উঠছে এই হাওয়ার সংস্পর্শে। দূরের মাটির গন্ধ, যেনো অপেক্ষায় আছে প্রথম ফোঁটা বৃষ্টির ছোঁয়ার।
আকাশের গাঢ় রঙে হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকানি। আকাশে মেঘের আনাগোনা, কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই ভারী মেঘের গর্জন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাগুলো মাটিতে আঘাত করতে শুরু করল, সেই সঙ্গে বাতাসে মিশে যাচ্ছে ভেজা মাটির গন্ধ।
বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর, চারপাশ যেনো একদমই বদলে গেলো। হালকা শীতল হাওয়া বয়ে যেতে লাগলো, আর বৃষ্টির ঝমঝম শব্দটা যেনো একটা সুরের মতো বাজতে লাগলো। গাছগুলো নতুন করে প্রাণ পেলো, তাদের পাতাগুলোতে বৃষ্টির ফোঁটা জমে মৃদু কাঁপছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা, কেবল দূর থেকে মাঝেমধ্যে কুকুরের ডাকার শব্দ শোনা যায়।
ঘড়িতে এখন সময় রাত বারোটা। অনিমা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘের গর্জনের আওয়াজে ওর ঘুম ভেঙে গেছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, শহরটা যেনো আরও গভীরভাবে ঘুমিয়ে গেছে। নভেম্বরের এই বৃষ্টি যেনো সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে মুছে দিচ্ছে, সবকিছুকে এক নতুন সজীবতার স্পর্শ এনে দিচ্ছে। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য অনিমা একাই উপভোগ করছে বিষয়টা ওর ভালো লাগছে না। আয়ান পাশে থাকলে বেশ ভালো লাগত। কী করবে? ঘুম ভাঙাবে? হ্যাঁ, তাই করবে। নভেম্বর রেইন তো সারারাত থাকবে না। নভেম্বর রেইন হুটহাট করে যেমন আসে আবার হুটহাট করে চলে যায়। যেই ভাবা সেই কাজ! অনিমা এক দৌড়ে বিছানায় গিয়ে বসল। তারপর আয়ানের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠুন। আপনার বউকে প্রকৃতি পাগল করে ফেলছে। আপনি এখুনি না উঠলে হয়তো বউকে হারাবেন। ”
আয়ান সাথে সাথে শোয়া থেকে উঠে বসল। আশেপাশে তাকিয়ে অনিমাকে কাছে দেখতে পেয়েই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। অনিমা কিছু বুঝতে পারছে না। ওর বলা কথাগুলো ঘুমের ঘোরে শুনেছে আয়ান? না-কি দুঃস্বপ্ন?
” কী হয়েছে? ”
” তুমি ঠিক আছো অনিমা? ”
হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো আয়ান। অনিমা ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
” শান্ত হও। আমি ঠিক আছি। ”
” তুমি করে বললে?”
” হ্যাঁ বললাম। সারাক্ষণ জামাইকে আপনি আপনি করে বলতে কার ভাল্লাগে? তাছাড়া এখন একটা রোমান্টিক ওয়েদার, এখন কি আপনি করে বললে ফিল আসে? ”
” কীসের ফিল? তুমি জেগে আছো কেনো? ”
অনিমার ছোঁয়া পেয়ে আয়ান আস্তে আস্তে শান্ত হচ্ছে। অনিমা হেসে বললো,
” আরে ওয়েদার সুন্দর, সেটা অনুভব করার অনুভূতি মানে সেই ফিলের কথা বলেছি। আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সেজন্য। আপনার কী হলো? ”
” বাদ দাও, দুঃস্বপ্ন ছিলো। বৃষ্টি হচ্ছে? চলো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে একসাথে ঘুমন্ত শহর দেখবো। ”
অনিমা খুব খুশি হয়ে গেলো। সহসাই আয়ানকে শক্ত করে জড়িয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
” এতক্ষণ আপনাকে মিস করেছি। আসুন। ”
” বউটা মনে হয় আজকাল একটু বেশিই মিস করছে আমাকে। ”
আয়ান অনিমার ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল সে। একপ্রকার জোর করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো অনিমা। তারপর ইশারায় আয়ানকে দাঁড়াতে বলল।
” আগে বৃষ্টি দেখতে আসুন। তারপর দুষ্টমি। ”
” তারমানে অনুমতি দিলে? ”
বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল আয়ান। অনিমা এরমধ্যে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে আবার।
” দুষ্ট লোক! ”
” তাই? ”
আয়ান অনিমার পিছনে দাঁড়িয়ে দু-হাত কোমরে রেখে প্রিয়তমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলল। অনিমার কাঁধে থুতনি রেখে বাইরের দিকে দৃষ্টিপাত করলো আয়ানও।
” অবশ্যই!”
চলবে,