এক পশলা প্রেম পর্ব-১৭

0
5

#এক_পশলা_প্রেম
#পর্ব_১৭
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।

বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল আয়ান। অনিমা এরমধ্যে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে আবার।

” দুষ্ট লোক! ”

” তাই? ”

আয়ান অনিমার পিছনে দাঁড়িয়ে দু-হাত কোমরে রেখে প্রিয়তমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলল। অনিমার কাঁধে থুতনি রেখে বাইরের দিকে দৃষ্টিপাত করলো আয়ানও।
” অবশ্যই তাই। ইদানীং বেশি দুষ্ট হয়ে যাচ্ছ। ”
” বদনাম যখন হচ্ছেই তখন আরো একটু দুষ্টমি করি? ”
আয়ান কথাটা বলে হাতের চাপ বৃদ্ধি করলো। অনিমা শিউরে ওঠে তাতে। উন্মুক্ত পেটে আয়ানের আকস্মিক জোড়ালো স্পর্শ বেসামাল করে তুলেছে ওকে।
” কী করছো? ”

ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল অনিমা। আয়ান উত্তর দিলো না। নিঃশব্দে সুনিপুণভাবে উষ্ণতা ছড়াতে ব্যস্ত সে। ক্রমে ক্রমে অনিমা টালমাটাল হয়ে যাচ্ছে। প্রিয়তমর গভীর স্পর্শে ও ঘাড়ে তপ্ত নিঃশ্বাসে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে সে। আয়ান সময় নিলো না আর, অনিমাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানার দিকে এগোচ্ছে। অনিমাকে বসিয়ে নিজে ওর পিছনে বসেছে।

জানালার কাচে আঘাত করছে নভেম্বরের বৃষ্টি। প্রতিটি ফোঁটা যেন অদ্ভুত এক শব্দের সৃষ্টি করছে। শীতল বাতাস পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ছে, চারপাশের পরিবেশকে করে তুলছে আরও নিবিড়। আলো-আঁধারিতে মেঝেতে ছায়ার খেলা, যেন প্রকৃতি নিজেই সাক্ষী হয়ে আছে। রুমের এক কোণে বিছানায় বসে উষ্ণতার আলিঙ্গনে জড়াচ্ছে দু’জন। জানালার পাশে দাঁড়ানোর ফলে অনিমার চোখেমুখে পানির ছিটে লেগেছিল। আয়ান তার আঙুলের সাহায্যে অনিমার ভেজা মুখমন্ডলে আলতোভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সে একবার তাকায় আয়ানের দিকে, দুজনের চোখে একধরনের অজানা রোমাঞ্চ।

বৃষ্টির প্রতিটি শব্দ যেন তাদের হৃদস্পন্দনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজছে। আয়ান অনিমাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বসায়, ওর হাত ধরে, নিজের ঠোঁট তার কপালে আলতোভাবে রাখে। অনিমা চোখ বন্ধ করে, বৃষ্টির গান আর তার প্রিয়জনের স্পর্শের মাঝে হারিয়ে যায়। বাইরে প্রকৃতি যতটাই তীব্র, ঘরের ভেতরটা ততটাই নরম, স্নিগ্ধ।

নভেম্বরের সকাল। সময় দশটা। চারদিকে রোদ ঝলমল করছে, তবে শীতল একটা হাওয়া যেন জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। চায়ের দোকানে বসে কাঁচের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে একদল মানুষ। আবার কেউ কেউ হালকা জ্যাকেট বা সোয়েটার পরে বেরিয়েছে, যদিও রোদের তাপে সেটা খানিক অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে। শহর জেগে উঠেছে অনেক আগেই। রাস্তা ইতিমধ্যে কর্মব্যস্ত। অফিসগামী মানুষের তাড়াহুড়ো, রিকশা-গাড়ির ঘন্টার শব্দ আর বাসের হর্নে শহর এক অদ্ভুত সুরের সৃষ্টি করেছে। ফুটপাত ধরে পথচলা মানুষজনের চেহারায় কাজের চাপ স্পষ্ট। কেউ দ্রুত পা চালাচ্ছে, আবার কেউ হাঁটতে হাঁটতে ফোন দেখছে। স্কুলগামী কিছু বাচ্চা আর অভিভাবকদের ক্লান্ত মুখে সপ্তাহের শেষদিকের কাজের চাপ যেন স্পষ্ট। বাচ্চাদের ক্লান্তি লেখাপড়া করাতে আর অভিভাবকদের ক্লান্তি বাচ্চাদের সামলাতে সামলাতে! ঢাকার সকাল মানেই ব্যস্ততা, আর এই সময়ে শহরের জীবনের প্রতিটি ছন্দ যেন একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত।

” হয়েছে, থামো। ”

ভার্সিটির গেটের মুখে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়েছে আয়ান, পেছনে অনিমা বসে আছে। অনিমার কথায় বাইক থামাল আয়ান। নীল রঙের গাউন পরেছে সে। কানে ছোটো দুল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক ও খোলা চুলে বেশ লাগছে অনিমাকে।

” কী হলো? এখানে থামাতে বললে কেনো? ”

আয়ান বিস্ময় নিয়ে শুধালো। অনিমা আশেপাশে তাকিয়ে বলল,

” ছাত্রছাত্রীরা গেট দিয়ে ঢোকার সময় আমাদের দিকে কেমন করে তাকাচ্ছে। ভেতরে ঢুকলে তো হা করে তাকিয়ে থাকবে! ”

আয়ান জোরে হাসতে লাগলো। অনিমা ওর পিঠে আস্তে ঘুষি মেরে ফের বলল,

” হাসছ কেন? ”

আয়ান ফের বাইক স্টার্ট করেছে। ক্যাম্পাসে পৌঁছে থামবে একেবারে।

” হাসবো না? কে হা করে তাকাল, আর কে মুখ বন্ধ করে তাকাল সেটা ভেবে আমাদের কী কাজ বলো? ”

” হুম বুঝতে পেরেছি। স্যারের বেশ সুখ সুখ ফিল হচ্ছে। ”

” অবশ্যই! এই মেয়েটা যে আমার বউ সেটা সবাইকে জানাতে হবে তো। সবাইকে বুঝতে হবে মেয়েটা সিঙ্গেল নেই আর। ”

অনিমা ভেংচি কেটে আরো একটা ঘুষি মারলো ওর পিঠে। আয়ান বাইক থামিয়েছে। ক্যাম্পাসে পৌঁছে গেছে ওঁরা। দূরে ঘাসের ওপর প্রণয়, আলিফ, প্রিয়ন্তি বসে ছিলো। অনিমাকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো ওঁরা। আয়ান চলে গেলেই এগোবে হয়তো। এরমধ্যেই আশেপাশের ছাত্রছাত্রীরা আয়ান ও অনিমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ তো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে শুরু করে দিয়েছে। আয়ান বিষয়টা বেশ উপভোগ করছে।

” বুঝলাম। এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। আমি যাই একটু ওদের সাথে কথা বলি। ”

বন্ধুদের দিকে ইশারা করে বলল অনিমা। আয়ান মুচকি হাসলো। অনিমার কপালে লেপ্টে থাকা এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল,
” যাও। ক্লাস শেষে অপেক্ষা করবে, একসাথে ফিরবো। ”

” সেটা বলতে পারছি না। কারণ তোমার অনেক দেরি হয়! ”
” ঠিক আছে। তাহলে সাবধানে বাসায় যেও। ”
” ওকে। ”

আয়ান চলে গেলো। সবাই অনিমার দিকে কেমন করে তাকাচ্ছে। একজন মেয়ে তো জিজ্ঞেস করেই ফেলল,

” স্যারের না বউ আছে? তবুও এরকম নির্লজ্জতা কীভাবে করছিস রে! ”

অনিমা কিছু বলতে যাবে এরমধ্যেই প্রণয় বলে উঠল,

” স্যারের যে বউ আছে, সেই বউটিই হচ্ছে অনিমা চৌধুরী। আয়ান স্যারের ওয়াইফ সে। আগে জানবি তারপর কিছু বলতে আসবি। যা ভাগ! ”

প্রণয়ের কথায় উপস্থিত সবাই চুপসে গেছে। অনিমা আর ওখানে না দাঁড়িয়ে প্রণয়, আলিফ ও প্রিয়ন্তির সাথে ক্লাসের দিকে এগোলো।

দুপুরের তপ্ত রোদে রাস্তায় কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে সাকিন । বাসার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে পাখি। আশেপাশের লোকজন তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে ওর দিকে। তাতে পাখি বেশ মজা পাচ্ছে।

” এই পাখি! শোনো না? ”

সাকিন অনুনয় করছে অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু পাখি নিশ্চুপ। ঠোঁট টিপে হাসছে সে। সাকিন ফের বললো,

” পাখি? ”
” এই পাখি?”

এবার পাখি ইশারায় জিজ্ঞেস করল, ” কী হয়েছে? ”

সাকিন চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বে,

” আমি কাল থেকে অফিসে যাবো। ”

” সত্যি? ”

পাখি খুব খুশি হয়ে গেছে। কাজকর্ম করা নিয়েই যত ঝামেলা। সাকিন যদিও বিয়ের আগে বলেছিল কোম্পানিতে জয়েন করবে কিন্তু এখন সেসব ভুলে গেছে। সারাক্ষণ আগের মতো ফোন নিয়ে বসে থাকে সে। এজন্য পাখি রেগেমেগে রাস্তায় কান ধরে দাঁড় করিয়েছে আজ। হয় কান ধরবে অথবা অফিসে জয়েন করবে নয়তো পাখি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে বলে হুমকি দিয়েছিল । বেচারা সাকিন অফিসে জয়েন করার থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাটাই বেছে নিয়েছিল। কিন্তু ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকার পর অবশেষে সিন্ধান্ত বদলে ফেলল সে।
” হ্যাঁ সত্যি। এবার কান ধরা বন্ধ করি? প্লিজ! ”

” আসো আসো, বাসায় আসো। ”

পাখি বেলকনি থেকে সরে যেতেই সাকিনও এক দৌড়ে বাসার গেটের ভেতর ঢুকলো। বউ যে কতটা ভয়ানক প্রাণী এখন সেটা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে সাকিন।

ভার্সিটির গেট পেরিয়ে রাস্তার সাইড ধরে হাঁটছে অনিমা। রাস্তার ওইপাশ থেকে বাস ধরতে হবে। ফোনের রিংটোনের শব্দে দাঁড়িয়েছে সে৷ আয়ান কল করেছে ।

” কোথায় তুমি? ”
” রাস্তায় আছি, বাসে উঠবো। কেনো? ”
” এমনি জিজ্ঞেস করলাম। সাবধানে যেও। ”
” এতো বউ পাগল হলে লোকে তো বলবে আমি জাদু টোনা করেছি!”
অনিমা হেসে বললো। আয়ান হাসলো না। কেমন জানি অস্থির লাগছে ওর।
” বলে বলুক৷ শোনো বাসায় গিয়ে কল দিও। রাখছি৷ ”
” ওকে স্যার। ”

কল কেটে ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল অনিমা। ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নামলো। সাই-সাই করে গাড়ি আসাযাওয়া করছে। লোকজন গাড়ির ফাঁকে ফাঁকে রাস্তা পার হচ্ছে। অনিমাও রাস্তা পার হতে লাগলো। হাত দিয়ে ইশারা করতে করতে রাস্তার মাঝখানে আসতেই পিলে চমকে ওঠে ওর। একটা বাস দ্রুত বেগে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। হাত দিয়ে ইশারা করার পরেও থামছে না। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড অতঃপর মিনিটখানেক সময়ের মধ্যে অনিমার কোমল শরীরটাকে মাড়িয়ে চলে গেলো বাসটা। এরমধ্যে অনিমার চারপাশে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। সামনে যাওয়া বাসটাকেও লোকজন আটকে ফেলেছে। ভার্সিটির সামনের রাস্তা হওয়ার সুবাদে আশেপাশে আরো স্টুডেন্ট ছিলো। তারাই এগিয়ে এসেছে অনিমার কাছে। রক্তে জবুথবু অবস্থা ওর। মাথা ফেটে কলকলিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। হাত-পা ছেঁচে গেছে। সেই অবস্থা বর্ণনা করার মতো না। কোনোরকমে ঠোঁট নড়ছে ওর, হাতের আঙুল নাড়ানোর শক্তি শেষ। চোখের সামনে আয়ানের অস্পষ্ট মুখখানা ভাসছে। লোকটা বলেছিল বাসায় গিয়ে কল দিতে! আর হয়তো কল দেওয়ার সুযোগ হবে না। শরীরের যন্ত্রণায় দু-চোখ বেয়ে পানি পড়ছে অনিমার। বাবা-মার মুখগুলো ভাসছে চোখের সামনে। ধীরে ধীরে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে, সবববব…..

” এই তোরা ওকে আশেপাশের হসপিটালে নিয়ে যা। আমি দেখি ভার্সিটিতে গিয়ে। স্টুডেন্ট আইডি কার্ড দেখালেই সবাই চিনে ফেলবে মেবি। ”

সুমন অন্য ভার্সিটির ছাত্র। এই ভার্সিটিতে এসেছিল প্রেমিকা জুইয়ের সাথে দেখা করতে৷ পথে এরকম একটা ঘটনা দেখে ছুটে না এসে পারলোনা। ওর সাথে ওর বন্ধু তালেব আর অভিও আছে। পাশাপাশি আরো কিছু মহিলা পথচারী আছে অনিমার সাথে। একটা ট্রাকে তোলা হয়েছে ওকে। প্রাইভেট গাড়ি পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায়নি কেউ। অবস্থা খারাপ, যেকোনো মুহুর্তে খারাপ কিছু ঘটতে পারে। সুমন ওদেরকে রেখে রাস্তা পেরিয়ে অনিমাদের ভার্সিটিতে ঢুকে ওর স্টুডেন্ট আইডি কার্ডটা নিয়ে এগিয়ে গেলো ক্যাম্পাসের ভেতর। একজনকে দেখাতেই চিনে ফেলে অনিমাকে। মুহূর্তের মধ্যে সে ছুটে যায় টিচার্স রুমের দিকে।

চলবে,