এক পশলা প্রেম পর্ব-১৮

0
6

#এক_পশলা_প্রেম
#পর্ব_১৮
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

ক্লাসে ছিলো আয়ান, তখনই প্রণয় আসে খবরটা নিয়ে। খবরটা শোনার পর পাগলের মতো ছুটছিল মানুষটা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। হসপিটালে পৌঁছে অনিমাকে জীবিত অবস্থায় আর দেখতে পারেনি। পথেই মারা গেছিল মেয়েটা । যদিও খবরটা আগেই জানতো আলিফ ও প্রণয়। পথে আয়ানের সাথে প্রণয় ও আলিফও ছিলো। কিন্তু স্যারের অবস্থা বিশেষ ভালো না ভেবে কিছু বলেনি।

দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। ঘন্টাদুয়েক ধরে অনিমার লাশকে কোলে নিয়ে বসে আছে আয়ান। হসপিটালের কেউ ওর কাছে আসার সাহস পাচ্ছে না। প্রণয় আর আলিফ কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলে,ও হাউমাউ করে কেঁদে উঠছে, চেল্লাচিল্লিও করছে। মাঝে একবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল আয়ান। বেচারার অবস্থা দেখে অন্যান্য রোগীদের অভিভাবকদের চোখও ঝাপসা হয়ে গেছে। এলোমেলো চুল, গালে চোখের জল শুকিয়ে কেমন লাগছে। আলিফ, প্রণয় থেমে থেমে কাঁদছে। হাসিখুশি, চঞ্চল মেয়েটা এই অসময়ে ওদেরকে ছেড়ে চলে গেছে বিষয়টা মানতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তার ওপর আয়ান স্যারের আহাজারি সহ্য করার মতো না। এতো ভালোবাসা মেয়েটার কপালে সহ্য হলোনা। লাশের যা অবস্থা তাতে বেশিক্ষণ দাফন ছাড়া রাখা সম্ভব না। যেকোনো সময় অনিমা ও আয়ানের বাড়ির লোকজন চলে আসবে। মূলত ট্রাফিক জ্যামের কারণে ওনাদের আসতে দেরি হচ্ছে।

দু’দিন ধরে বিছানায় পড়ে আছে আয়ান। আতিক চৌধুরীর শরীরটাও বিশেষ ভালো না। ছেলের জীবনে কখনো এমন পরিস্থিতি আসবে দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি কখনো। অনিমা গত হয়েছে আজ তিনদিন হলো। সেই থেকে আয়ানের এই অবস্থা। খাওয়াদাওয়া না করা এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপে অসুস্থ হয়ে গেছে। সাকিন আর পাখি সারাক্ষণ নজরে নজরে রাখে আয়ানকে। কী থেকে কী হয়ে গেলো!

” কী হলো? খাবার খাবে না? ”
বিছানায় শুয়ে আছে সাকিন। পাখি খাবার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
” বললাম তো পাখি, খেতে ইচ্ছে করছে না এখন। ”
পাখি খাবারের প্লেটটা পাশের টেবিলের ওপর রেখে সাকিনের পাশে বসলো।
” আমি বুঝতে পারছি সাকিন, তোমার মন মানসিকতা খারাপ। কিন্তু না খেয়ে থাকলে কোনো কিছুর সমাধান হবে বলো? বড়ো আব্বুর শরীর খারাপ, ভাইয়া ওভাবে পড়ে আছে। তারমধ্যে তুমিও যদি এভাবে না খেয়ে থাকো বাড়ি, অফিস এসব কে দেখবে বলো? ”

সাকিন কিছু না বলে শোয়া থেকে উঠে হুট করে জড়িয়ে ধরল পাখিকে। পাখি কিছু বললো না। সাকিনও চুপ করে আছে। কিছুক্ষণ পর বলল পাখি,
” বিপদের সময় ধৈর্য ধরতে হবে সাকিন। আমাদেরই এখন সবাইকে আগলে রাখতে হবে। ভাইয়াকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে হবে, কোম্পানির হাল ধরতে হবে, বড়ো আব্বুর যত্ন নিতে হবে। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের কাঁধে এখন অনেক দায়িত্ব। বুঝতে পেরেছ? ”

সাকিন মাথা নাড়ল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
” হ্যাঁ। আমাদেরকে সবকিছু সামলাতে হবে। ভাইয়াকে সুস্থ করে তুলতে হবে। ”

” গুড বয়। আসো খেয়ে নিবে। ভাইয়া ঘুমোচ্ছে, বড়ো আব্বুকে বলেকয়ে একটু স্যুপ খাইয়ে এসেছি। ”

সাকিন সোজা হয়ে বসেছে। পাখি খাবারের প্লেট এনে বিছানায় রাখল।

” ভালো করেছ। আমি ভাইয়ার সাথে শোবো। খাইয়ে দাও। ”

” সেটাই ভালো হবে। ভাইয়ার যা মানসিক অবস্থা এখন তাতে সাথে একজন থাকা জরুরি। ”

পাখি সাকিনকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে। সাকিন খেতে খেতে মাথা নেড়ে বলে,
” হুম। ”

পিটপিট করে চোখ মেলে তাকিয়েছে আয়ান। কেমন ঝাপসা লাগছে সবকিছু। মস্তিষ্ক সজাগ হতেই ওর মনে পড়ে গেছে অনিমা আর নেই! মুহুর্তেই বুকের ভেতর শতশত যন্ত্রণার কীট কিলবিল করতে লাগল ওর। চোখের কোণে পানি টলমল করছে। নিঃশ্বাস নিতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে। আজকের সকালটা যেন হতাশায় মোড়া। মেঘলা আকাশের নিচে সূর্যের আলোর কোনো উজ্জ্বলতা নেই, কেবল ধূসর একটা আভা। বাতাসে একটা ভারী, বেদনাদায়ক অনুভূতি। আয়ানের মনে হচ্ছে এখন আর পাখিদের কিচিরমিচির নেই। চারপাশটা থেমে গেছে, মানুষের কোলাহল নেই, কেবল দূরে কোথাও একটা বিষণ্ণ কাক ডেকে উঠছে। জানালার কাচ দিয়ে বাইরে তাকালে দেখা যায় ভেজা মাটির গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে, যদিও বৃষ্টি থেমেছে অনেক আগেই। রাস্তার ধারে একটা ফেলে রাখা ছাতা কাদার মধ্যে পড়ে আছে, যার মালিক হয়তো চিরতরে চলে গেছে। কেউ একটা ধোঁয়া তোলা চায়ের কাপে হাত রেখে ভাবছে, ‘জীবন কি এমনই? শুধু শূন্যতার গল্প?’ আজকাল বিষণ্ণ সকালে সবকিছু যেন এক অজানা দুঃখের স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে।

সেদিন অনিমাকে কতো করে বলেছিল,
” আমার সাথে বাড়ি ফিরবে আজ। ”

কিন্তু নাহ, অনিমার সেদিন বড্ড তাড়া ছিলো। আয়ানের দেরি হবে ভেবে একা একা বাড়ি যাবে বলে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসে। আর তারপর! তারপর সব শেষ। সেই বাসওয়ালাকে পুলিশ হয়তো টাকাপয়সা জরিমানা করেছে, অথবা কয়েকমাসের জন্য জেলও হয়েছে তার। কিন্তু তাতে কী হবে? অনিমা তো ফিরবে না আয়ানের জীবনে।

” আয়ান, আসবো বাবা? ”

আচমকা অনিমার বাবার কণ্ঠে চমকে উঠল আয়ান। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আয়ান বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো কোনোমতে। শরীর ভীষণ দূর্বল।
” আসুন বাবা। এ ঘরে ঢুকতে আপনার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। ”

সত্তার শেখ আস্তে ধীরে রুমে প্রবেশ করলেন। আয়ান দাঁড়িয়ে আছে, অনিমার বাবাকে বসতে বলল ও। তিনি বসলেন, সাথে আয়ানকেও পাশে বসতে বললেন। দরজার বাইরে আতিক চৌধুরী, সাকিন আর পাখিও দাঁড়িয়ে আছে। তবে আয়ানকে বুঝতে দেয়নি সেটা।

” আয়ান, চেহারার কী হাল করেছ ? এভাবে নিজেকে কষ্ট দিলে কি অনিমা ভালো থাকবে? কষ্ট কি আমার হচ্ছে না? তোমার শ্বাশুড়ির হচ্ছে না, বলো? এভাবে না খেয়ে থাকলে তুমি আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। আমরা যদি নিজেদের কষ্ট দেই অনিমার কি ভালো লাগবে বলো? ”

আয়ান মাথা নিচু করে বসে আছে। ঠোঁট জোড়া কেমন কাঁপছে ওর। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কিছু বলতে চেয়েও পারছে না। সত্তার শেখ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আয়ানের কাঁধে হাত রেখে আবার বলতে শুরু করলেন,

” মানুষ মরণশীল। আজ কিংবা কাল আমাদের সবাইকে চলে যেতে হবে আয়ান। প্রিয়জন হারানোর কষ্ট খুব বেদনাদায়ক। আমারও তো সন্তান হারিয়েছি, বুকটা খালি হয়ে গেছে। অনিমার মা তিনদিন ধরে ঠিকমতো কথা বলে না। তারমধ্যেও আমাকে বোঝায়। মেয়েটার সাথে আমার অনেক ঝগড়া হতো। ঝগড়া বলতে খুনসুটি আরকি। বিয়ের পর তো এ বাড়িতে চলে এলো, ভাবতাম কার সাথে ঝগড়া করবো আমি? কিন্তু না! মেয়ে আমার ফোনেই সেই ঝগড়া সেড়ে ফেলতো। এমন অনেক স্মৃতি তোমারও আছে, আমি জানি। সেই সুখময় স্মৃতিগুলো মনে করো। মানুষের জীবনে কোনোকিছুরই গ্যারান্টি নেই। কিন্তু এই যে সুখের স্মৃতিগুলো? এগুলো স্থায়ী। স্মৃতি ভোলার কোনো পদ্ধতি নেই। তাই ভালো, মন্দ সব স্মৃতি নিয়েই আমাদের বাঁচতে হয়, হবে। আমরা ভালো থাকলে অনিমাও ভালো থাকবে না। জানি এটা অনেক কঠিন হবে আমাদের জন্য কিন্তু অসম্ভব নয় আয়ান। সময় সবকিছু ঠিক করে দিবে। তুমি নিজেকে শক্ত করো। এভাবে নিজেকে শেষ করে ফেলো না। তোমার বয়স্ক বাবার কি ভালো লাগে, তোমাকে এভাবে দেখতে? ”

দরজার বাইরে থেকে আয়ানের দিকে তাকিয়ে আছেন আতিক। দুচোখে স্পষ্ট নোনাজল। আয়ানের চোখেও পানি। বিষাদের মেঘে ছেয়ে গেছে চৌধুরী বাড়ি।

” বাবা আমি চেষ্টা করবো, নিজেকে সামলে নিবো। অন্তত বাবার জন্য হলেও স্বাভাবিক হবো। আপনি চিন্তা করবেন না। মায়ের দিকে খেয়াল রাখবেন। ”

সত্তার শেখ মাথা নেড়ে আয়ানকে জড়িয়ে ধরে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়ান। এতকিছু পাওয়ার দুনিয়ায় ওই মানুষটাকে আর কিছুটা সময় পেলে কি এমন ক্ষতি হতো? খুব কি সমস্যা হতো? একটা মানুষই তো! সৃষ্টিকর্তা না হয় টাকাপয়সা সব নিয়ে নিতেন , তবুও ভালোবাসার মানুষটাকে আর কিছুদিন সাথে রাখতেন!

কেটে গেছে দু’টি বসন্ত, আর সেই সাথে যেন সবকিছু বদলে গেছে। যে মানুষটা ছিল হৃদয়ের খুব কাছাকাছি, সে এখন দূরবর্তী স্মৃতি। একসময়ের উচ্ছ্বাসমাখা দিনগুলো এখন শুধুই নীরবতা বহন করে। তবুও এই বদলে যাওয়া বাস্তবতার মাঝেও জীবন তার পথে এগিয়ে চলেছে, নতুন কিছু পাওয়ার আশায়, বা হয়তো শুধুই বয়ে চলার জন্য।

আতিক চৌধুরী এখন আর কোম্পানির দায়িত্বে নেই। চৌধুরী কোম্পানির সিইও এখন আয়ান চৌধুরী, সাথে আছে সাকিন। দুই ভাই এখন সমানতালে কোম্পানি সামলে যাচ্ছে। কাজ ছাড়া কোনো অস্তিত্ব নেই আয়ানের। সারাদিন কাজে ডুবে থাকে সে। শিক্ষকতার পেশা ছেড়েছে অনিমা চলে যাওয়ার কয়েকমাস পরেই। নিজেকে এখন সে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখে । সাকিন মাঝে মধ্যে বলে, একটু বিরতি নিতে। কিন্তু না, আয়ান কাজ থেকে ছুটি চায় না। অনিমা চলে যাওয়ার পর এই কাজই ওর সব কষ্ট, যন্ত্রণার ওপর প্রলেপের মতো কাজ করেছে।

চলবে,