এক পশলা প্রেম পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0
6

#এক_পশলা_প্রেম
#পর্ব_১৯(শেষ)
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

সময় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা অবিরাম বয়ে চলে নদীর স্রোতের মতো। মানুষের দুঃখ, কষ্ট বা বেদনার অনুভূতিগুলো সময়ের স্রোতে ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে। প্রথমে তীব্র বেদনা আমাদের মনকে গ্রাস করে, মনে হয় এই কষ্ট কখনোই কাটবে না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে স্মৃতিগুলো ম্লান হয়, আবেগগুলো দুর্বল হয়ে যায়। সময় মানুষের মনে একটি প্রাকৃতিক নিরাময়কারী হিসেবে কাজ করে। নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন মানুষ, আর জীবনের পরিবর্তিত ঘটনাপ্রবাহ দুঃখের স্থানে নতুন অনুভূতিগুলো নিয়ে আসে। যেমন কোনো গভীর ক্ষত ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায় এবং তার জায়গায় একটি দাগ রেখে যায়, ঠিক তেমনই সময়ের প্রভাবে দুঃখের তীব্রতা কমে গিয়ে তা স্মৃতির পাতায় একটি অধ্যায় হয়ে রয়ে যায়। তাই সময় শুধু বহমানই নয়, এটি জীবনের সমস্ত আবেগের একটি সঙ্গী, যা দুঃখকে হ্রাস করে এবং আমাদের সামনে এগিয়ে চলার শক্তি দেয়।

ওটি রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে চৌধুরী পরিবারের দুই ছেলে। সাথে অবশ্য পাখির বাবা-মাও আছেন। আতিক চৌধুরী শুধু আসেননি। বয়স হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফলে শারীরিকভাবে দূর্বল হয়ে গেছেন তিনি।

প্রেগন্যান্সি নিয়ে বেশ কিছু জটিলতা ছিলো পাখির। সেজন্য খুব ভয়ে ভয়ে আছে সাকিন। টেনশনে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ছেলেটার। আয়ান বারবার ভরসা দিচ্ছে ওকে। এই বাচ্চাটা নিয়ে আয়ানেরও অনেক স্বপ্ন, আশা। বাড়িতে একটা ছোট্ট প্রাণ আসবে ভেবে মনের দুয়ারে নতুন করে ভালোলাগার সৃষ্টি হয়েছে তার।

” আর কতক্ষণ লাগবে বলো তো! ”
সাকিন অধৈর্য হয়ে বারবার পায়চারি করছে। আয়ানও সাথে সাথে হাঁটছে। পাখির বাবা সোলায়মান আলম ওটি রুমের পাশেই জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়তে শুরু করেছেন। খানিকক্ষণ আগেই পাখির মা শায়লা আলমও নামাজ আদায় করেছেন।
” আরে ধৈর্য ধর একটু। সবাই এতো নার্ভাস হলে চলবে? প্রতিটি কতশত বেবি হচ্ছে, পৃথিবীতে নতুন কিছু তো না! এতো প্যানিক করিস না। অপেক্ষা কর। ”

আয়ান স্থির হয়ে বলল। এমনিতে ওর যে চিন্তা হচ্ছে না তেমনটা নয়। তবে সাকিনকে সাহস যোগাতেই এভাবে বলেছে শুধু। সাকিন কিছু বললো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে এখন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ওটি রুমের দরজা খুলে ডাক্তার পারভীন আহমেদ বেরিয়ে এলেন। সাকিন, আয়ান এগিয়ে গেলো ডাক্তারের কাছে। সোলায়মান আলম ও শায়লা আলমও ডাক্তারের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।

” ডাক্তার আমার মেয়ে কেমন আছে? ”
শায়লার প্রশ্ন শেষ হতেই সাকিন ব্যতিব্যস্ত হয়ে শুধালো,
” সবকিছু ঠিক আছে তো ম্যাম? পাখি ঠিক আছে তো? আমাদের বেবি? ”

ডাক্তার পারভীন মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
” মা এবং বেবি দু’জনেই সুস্থ আছে। মেয়ে বেবি হয়েছে আপনাদের। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেবিনে শিফট করা হবে। ততক্ষণ সবাই ধৈর্য ধরুন। আর হ্যাঁ অভিনন্দন মিস্টার সাকিন। ”

সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এতক্ষণে। ডাক্তারের কথায় সবার মুখে হাসি ফুটেছে। খুশিতে সাকিনের চোখে জল টলমল করছে।
” থ্যাংক ইউ ম্যাম। ”
” ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। ”

ডাক্তার পারভীন চলে যান৷ খুশিতে শ্বশুর, জামাই কোলাকুলি করছে। শায়লা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে ব্যস্ত। আয়ানও খুব খুশি। তবে ওর চোখেমুখে তেমন প্রতিক্রিয়া বোঝা যাচ্ছে না। আয়ানের জীবনের গভীর শূন্যতা তাকে এক অদ্ভুত অবস্থায় নিয়ে গেছে। সুখ-দুঃখের অনুভূতিগুলো যেন ধীরে ধীরে তার ভেতর থেকে মুছে যাচ্ছে। একসময় প্রাণবন্ত এই মানুষটি আজ এমন এক যান্ত্রিক জীবনে আটকে গেছে, যেখানে হাসি-আনন্দ বা বেদনা—কোনো কিছুই আর স্বাভাবিক মনে হয় না। আয়ানের আচরণ দেখে মনে হয়, সে যেন জীবনের রঙ হারিয়ে বসে আছে। অবশ্য অনিমাই তো তার জীবনের সকল রঙ ছিলো। তাই আজকাল খুশির মুহূর্তেও আয়ানের চেহারায় কোনো উচ্ছ্বাস নেই, যেন সব অনুভূতির ওপর একটা ভারি পর্দা টানা। আবার মন খারাপের সময়েও সে কাউকে কিছু বুঝতে দেয় না, নিজের কষ্টগুলো নিয়ে চুপচাপ পড়ে থাকে। দিন দিন আয়ান যেন এক যান্ত্রিক অস্তিত্বে পরিণত হচ্ছে—মনের গভীর ব্যথা তাকে এক রোবটের মতো অনুভূতিহীন করে তুলেছে।

তার এই পরিবর্তন দেখে আশপাশের, পরিবারের মানুষ হতবাক, কিন্তু কেউ তাকে ছুঁতে পারে না, তার ভেতরের অনুভূতিগুলোকে ফিরিয়ে আনতে পারে না। একা থাকা আর নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখা কষ্টই যেন তার জীবনের একমাত্র সঙ্গী হয়ে উঠেছে। তবে নতুন সদস্যকে নিয়ে সাকিন ও পাখি খুব আশাবাদী। ওরা আগে থেকেই এসব নিয়ে আলোচনা করেছে। বাড়িতে বাচ্চা এলে একটু হলেও আয়ানের পরিস্থিতি বদলাতে পারে বলেই ধারণা ওদের। হলো – ও তাই!

হসপিটাল থেকে পাখিকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে আজ পনেরো দিন। এরমধ্যেই রুহির সাথে আয়ানের বেশ ভাব জমেছে। রুহি সাকিন ও পাখির মেয়ের নাম। মেয়েটা ভীষণ কিউট। দেখতে একদম বাবার মতোই হয়েছে। অফিস শেষে বাসায় ফিরে আয়ান আগে রুহিকে এক নজর দেখে তারপর নিজের রুমে যায়। এভাবেই চলছে আয়ানের জীবন!

শীতকালের দুপুরবেলা এক অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে আসে। শীতের নরম রোদ গায়ে মাখার জন্য যেন প্রকৃতি হাত বাড়িয়ে ডাকে। চারপাশে স্নিগ্ধ এক আবেশ, হালকা ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে রোদ মিলে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা তৈরি করে। গাছের পাতাগুলো রোদে ঝিলমিল করে, আর কোনো কোনো গাছে পাতার সংখ্যা কমে যাওয়ায় শাখাগুলো খালি খালি লাগে। প্রকৃতি এই সময়টা যেন এক ধরনের শান্তি আর আরামদায়ক সৌন্দর্যে ভরা। চারপাশে হিমের ছোঁয়া থাকলেও দুপুরের রোদ যেন এক অদ্ভুত উষ্ণ আলিঙ্গনের আমন্ত্রণ জানায়। মাঠে দেখা যায় শিশির ভেজা ঘাস শুকিয়ে হালকা খটখটে হয়ে উঠেছে। দূরে কোথাও কোনো কৃষক হয়তো ধান মাড়াই করছে, আর সেই সোনালি ধানের গন্ধে বাতাস ভরে উঠেছে। শহরের দৃশ্য অবশ্য আলাদা। শহরের রাস্তার ধারে দুপুরে চায়ের দোকানে গরম চা আর সিঙ্গারার ধোঁয়া উড়তে থাকে, আর মানুষজন ভিড় জমায় নিজেদের গা একটু গরম করার জন্য।

” রুহি! এই রুহি! দাঁড়া মা। আমি তোর সাথে ছুটে পারছি না। তুই ফার্স্ট, আমি না। ”

আয়ান কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুটা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কথাগুলো। রুহি সোফায় বসে খিলখিল করে হাসছে। বড়ো আব্বুকে জব্দ করতে পেরে সে বেজায় খুশি।

” কী মজা, কী মজা! বলো আব্বু পালে না হিহি… ”

” কী হচ্ছে এখানে হুম? দুপুরের খাওয়াদাওয়া কি করতে হবে না? শুধু বাবা-মা খেললেই হবে? ”

আয়ান ও রুহির খেলার মধ্যে পাখি এসে হাজির হয়েছে। সাকিন এরমধ্যে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসেছে। আতিক চৌধুরীর খাবার ঘরেই দিয়ে এসেছে পাখি। চলাফেরা করতে বেশ কষ্ট হয় ওনার। মা’কে পেয়ে রুহি সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আয়ান মুচকি মুচকি হাসছে।
” জানো মাম্মা, বলো আব্বু আমাল সাথে পালেনি। ”

( র /ড় – কে ল উচ্চারণ লেখা হয়েছে।)

” হ্যাঁ জানি তো। এখন খেতে চলো। আজকে তো অফ ডে, বড়ো আব্বু বিকেলেও বাসায় থাকবে। ”

আয়ান হেসে বললো রুহিকে, ” হ্যাঁ মা চলো খেয়ে আসি। বিকেলে আবার খেলবো। ”

” ঠিক আছে, চলললো। ”

আয়ানের হাত ধরেই খেতে গেলো রুহি। সাকিনের সাথে যতটা না সময় কাটায় রুহি, তারচে বেশি সময় আয়ানের সাথেই থাকে। মাঝে মধ্যে রাতে একসাথে ঘুমায় দু’জন। রুহিকে নিয়ে আয়ানের জীবনটা নতুনভাবে সেজে উঠেছে। এরমধ্যে আতিক চৌধুরী আয়ানকে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আয়ান সরাসরি “না” করে দিয়েছে। অবশ্য আয়ানের উত্তর আগে থেকেই সকলে জানতো। জীবন চলমান, কারো জন্যই থেমে থাকে না। সুখ কিংবা দুঃখে একভাবে না একভাবে কেটে যায়। তবে দুঃখের মাঝেও সুখ খুঁজে নিতে হয়। সব খারাপের মধ্যে যেমন ভালো লুকিয়ে থাকে সেরকম জীবনে অনেক দুঃখকষ্ট থাকলেও সামান্য সামান্য সুখ খুঁজে নিয়ে সেটুকু আঁকড়ে ধরতে হয়। মানিয়ে নিতে পারলেই জীবন সুন্দর।

________________________________

❝ প্রিয় আয়ান স্যার,

ভালোবাসিইইইই! আপনাকে বহুত ভালোবাসি! কেনো ফাসিইইইই? আপনার প্রেমে বারবার ফাসি! এখানে একটা হতাশামূলক ইমোজি ইমাজিন করে নিবেন। আপনি জানেন, যখন ক্লাসের বদ মেয়েগুলো আপনাকে চোখ দিয়ে গিলে খায় তখন আমার কত্তো কষ্ট হয়? না কীভাবে জানবেন? আপনি তো কিছুই জানেন না, বোঝেন না। একেবারে অবুঝ শিশু! রাগ হচ্ছে? আহ রাগ করে না। অনেক আবেগ মিশিয়ে চিঠি খানা লিখলাম। তবে আফসোস হাতে লিখে দিলাম না, কম্পিউটারে কম্পোজ করেই দিতে হলো। কেনো বলুন তো? পারলে মাথা খাটিয়ে বের করবেন। ওক্কে স্যার?

ইতি

আপনার একান্ত বাধ্যগত ছাত্রী ❞
_____________________________

চিঠিটা পড়লো আয়ান। একবার, দুইবার, বহুবার। তারপর বুকে আঁকড়ে ধরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শখের মানুষ হোক কিংবা জিনিস কেনোকিছুই চিরস্থায়ী হয় না। খুব প্রিয় মানুষ, জিনিসগুলো কীভাবে যেনো হারিয়ে যায়। রয়ে যায় শুধু স্মৃতি! আয়ানের দু-চোখ ভিজে উঠেছে। সবাই মনে করে আয়ান চৌধুরী রোবট হয়ে গেছে। আদতে সে আজও তার প্রিয়তমার জন্য আড়ালে চোখের জল ফেলে সেটা কেউ জানে না, বোঝেও না। তার সব অনুভূতি ওই একটা মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে হয়তো। চিঠিটা হাতে নিয়ে জানালার দিকে এগোলো আয়ান। আজকে খুব বেশি করে মনে পড়ছে অনিমাকে। আজকের দিনেই অনিমা এসেছিল আয়ানের জীবনে। আজ ওদের বিবাহবার্ষিকীর তারিখ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পাখিগুলো যে যার নীড়ে ফেরার জন্য উড়ে যাচ্ছে। মেঘ করেছে আকাশে। হয়তো বৃষ্টি আসবে। বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ! আয়ান চোখ মুছল। মুচকি হেসে আনমনে বলে উঠলো,

❝ এক পশলা বৃষ্টির মতোই তুমি এসেছিলে আমার জীবনে, এক পশলা প্রেম নিয়ে! আমি অপেক্ষায় আছি অনিমা। জানি ফিরবে না তবুও অপেক্ষা করবো আমি। ভালোবাসি আমার ভালোবাসা। এপারে না হলেও ওপারে দেখা দিও। ❞

সমাপ্ত