#এক_ফালি_প্রণয়|৯|
#শার্লিন_হাসান
মাইশাকে বিদায় দিয়ে কেউ থেকে গেছে আবার কেউ শিকদার বাড়ীতে চলে এসেছে। রোদ,শিশা,তূর্ণ তারা সন্ধ্যায় রওনা হয় শিকদার বাড়ীর উদ্দেশ্য। তূর্ণ ড্রাইভ করছে পেছনে শিশা,রোদ বসা। গাড়ীতে পূর্ণ নিরববতা বিরাজমান। সন্ধ্যায় ও রাস্তায় জ্যাম। জ্যামের মধ্যে বসে থেকো বেশ বিরক্ত তূর্ণ। সারাদিনের ব্যস্ততা একরাশ ক্লান্তি এসে ঘিরে ধরেছে তাকে। রোদ,শিশা পেছনে আধশোয়ার মতো। শিশা ঘুমিয়ে গেছে গাড়ীতেই। রোদ চোখ বন্ধ করে আছে।
আধাঘন্টা পরে জ্যাম ছাড়ে। কোনরকম গাড়ী টেনে মেইন রোড পেড়িয়ে ভেতরের রোডে ঢুকে। সেখানে বেশী ভীড় না থাকায় সহজে বাড়ীতে চলে আসে।
গ্যারেজে গাড়ী রেখে রোদ,শিশাকে জাগিয়ে তোলে তূর্ণ। তারা দু’জনে কোনরকম ভেতরে যায়। জামাকাপড়ের ব্যাগ তাঁদের গাড়ীতেই রয়ে গেছে। তূর্ণ ভেতরে গিয়ে প্রথমে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। বাড়ীটা পুরো নিস্তব্ধ। পূর্ণ বাইরে গেছে।
দশটার দিকে পূর্ণ বাড়ী ফিরে। তখন কিচেনে রোদ কিছু বানাচ্ছিল। পূর্ণ সেদিকটায় পা বাড়ায়। রোদকে দেখে বলে, ” আমার জন্য এক মগ কফি প্লিজ।”
আচমকা পূর্ণর কন্ঠস্বরে রোদ ভড়কে যায়। রোদের চোখমুখ ফোলা ফোলা। এই দশটা বাজে কফি বানাচ্ছিলো রোদ। পূর্ণ তাকে পুনরায় বলে, ” কী বলেছি মনে আছে?”
হ্যাঁ বোধকে মাথা নাড়ায় রোদ। তূর্ণর কফি মগ নিয়ে তূর্ণকে দিয়ে আসে। পূর্ণরটা নিয়ে পূর্ণর রুমের দিকে পা বাড়ায়। তখন পূর্ণ কারোর সাথে বেশ মিষ্টি স্বরে কথা বলছিলো। একবারে নরম,কোমল ভাবে। কিছু কথা রোদের কানে আসে। সেসবে রোদ পাত্তা দেয়না। ভেবে নিয়েছে হয়ত গার্লফ্রেন্ড আছে। নাহলে কেউ এতো নরম ভাবে কারোর সাথে কথা বলে? পূর্ণকে কফি দিয়ে তড়িঘড়ি প্রস্থান করে রোদ।
কল রেখে পূর্ণ কফিতে চুমুক দেয়। কিছু একটার হিসাব মেলানো ট্রাই করছে সে। তবে বরাবরের মতো কট খাচ্ছে। কিছুতেই মিলছে না। মাথা ঠান্ডা করে পূর্ণ পুনরায় ভাবে, ” সেদিন রোদকে বাঁচানোর জন্য কল আসে। তার জন্য ছুটে যায় পূর্ণর বাবা। কিন্তু কোথায় গিয়েছিলো? রোদ তো ঠিকই ছিলো। জীবন্ত মানুষ কাউকে বাঁচাতে গিয়ে মৃ’ত হয়ে ফিরে এসেছে। এই রোদ হয়ত সব জানে! কিন্তু কী জানে? রোদ নিজেই তো একটা না’টকবাজ। ছোট বেলা থেকে নাটক বাজ এই মেয়ে। এই মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে আমার বাবা ম’রেছে। এটা নাটক ছিলো।”
বেলকনিতে বসে রোদ ঠান্ডা বাতাস শরীরে মাখছে। চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো ভাবে উড়ছে। নিজেকে কেমন জেনো পাগ’ল টাইপের মনে হচ্ছে। বুকটা ভারী হয়ে আসছে। কাউকে কিছু বলতে চায় রোদ। কিন্তু বলার ইচ্ছে থাকলেও অনুমতি নেই।
***********
কেটে যায় দুইদিন। মাইশার বৌভাত অনুষ্ঠানে শিশা,রোদ,তূর্ণ, পূর্ণ ছাড়া বাকীরা সবাই গিয়েছে। এতো পথ জার্নি করে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই কারোর।
শিকদার বাড়ীর সদস্যরা তাঁদের বাড়ীতে। সবার আগের মতোই ব্যস্ত লাইফ শুরু। সকালে সবাই একসাথে নাস্তা করতে বসে। তিশা,রোদ যাবে ভার্সিটি। শরীফ শিকদার নিজেও বসে নাস্তা করছে সবার সাথে। তখন পূর্ণ আসে সবার শেষে। হাতে জুশের গ্লাস নিয়ে শরীফ শিকদারের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে, ” তাহসিনা খানমের নামে ইন্ডাস্ট্রি একটা লসের মুখে পড়বে। অবশ্য তোমার কিছু ভুলের কারণে। এর ক্ষতিপূরন কে দিবে চাচ্চু?”
” কিসের লস? এই ইন্ডাস্ট্রি আমার পরিশ্রমের এবং আমার দায়িত্বের। ভবিষ্যতে তাহসিনা দায়িত্ব নিলে তখন আমি আমার জায়গা ছেড়ে দিবে।”
“শিওর?”
” তা নয়ত কী?”
পূর্ণর কথায় জবাব দেয় শরীফ শিকদার। তখন পূর্ণ তূর্ণর পাশের চেয়ার টেনে বসে গুনগুন করে বলে, ” দেখা যাবে ভবিষ্যতে কী হয়। তাহসিনা তো এক নাম্বারের গা’ধা।”
ভার্সিটি আসতে রাফির সাথে দেখা হয় রোদের। রাফিকে যথেষ্ট ইগনোর করে রোদ। কিন্তু রাফি সেই ছ্যচড়ার মতো এসে এটা ওটা তাকে জিজ্ঞেস করে। এই নিয়ে বেশী বিরক্ত রোদ। আজকে তো রাফি ঠিক করে নিয়েছে রোদকে তার সাথে খানম বাড়ী যেতেই হবে। না বললে চলবে না। এই নিয়ে মহা জামেলায় পড়েছে রোদ। মনে,মনে দোয়া করছে তূর্ণ বা পূর্ণ কেউ আসুক তাঁদেরকে নিয়ে যেতে। তাহলে রাফি আর এগোবে না। কিন্তু তূর্ণ বা পূর্ণর কারোরই আসার কোন সম্ভাবনা নেই। পূর্ণ আসলেও তূর্ণ অফিসের কাজে ব্যস্ত। এট্টিটিউড, ইগো এক সাইডে রেখে রোদ পূর্ণকে নক দেয়। প্রথমে সালাম দিয়েই শুরু করে। রোদের আইডি চিনতে ভুল হয়নি পূর্ণর।
“একটু ভার্সিটি আসতে পারবে?”
“কেনো?”
“আর্জেন্ট আছে। তুমি আসো প্লিজ!”
“ঠিক আছে।”
রোদ ফোন রেখে ক্লাসে মনোযোগ দেয়।
পূর্ণ কাজ শেষ করে গাড়ী নিয়ে রোদের ভার্সিটি আসে। গেট দিয়ে প্রবেশ করতে দেখে রোদ কিছুটা তাড়াহুড়োয় আসছে। পেছন দিয়ে রাফিও ছুটে আসছে। পূর্ণর ব্যপারটা একদম পছন্দ হয়নি। রোদ পূর্ণর কাছে এসে দাঁড়াতে, রাফিও এসে থামে। তখন পূর্ণ রাফির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রোদকে কড়া কন্ঠে বলে, ” তিশা আসেনি? যাও গাড়ীতে গিয়ে বসো।”
“ও আজকে খানম বাড়ী যাবে। আর তুমি রাইট দেখানোর কেউ না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে রোদ খানম বাড়ী যাবে। চিন্তা করো না। আমার বোন তিশা আসুক। ও আসলেই রোদকে গাড়ী থেকে বের করে খানম বাড়ী পাঠাবো। রাফি দাদু আবদার করেছে তাহিয়ান শিকদার পূর্ণর কাছে সে আবদার বুঝি ফেলে দেওয়া যায়?”
“এই আমি কিন্তু ইয়ার্কি করছি না।”
“আমিও একদম ইয়ার্কি করছি না। পূর্ণ যা বলে তাই করে।”
রাফি আর কিছু বলেনি। তারা দু’জন দাঁড়িয়ে থাকতে,থাকতে তিশাও আসে। পূর্ণ তিশাকে নিয়ে গাড়ীর দিকে যায়। হাতে ইশারা করে রাফিকে আসতে। তিশাকে তার পাশের সীটে বসিয়ে পেছনের সীটে যায় পূর্ণ। যেখানে রোদ বসে আছে। ডোর খোলে রোদের হাত ধরে টেনে বাইরে বের করে পূর্ণ। রাফির দিকে রোদকে ধাক্কা দিয়ে পূর্ণ বলে, ” রাফি দাদুর তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরাঘুরি করার শখ রোদ। যাও নিজের বাপের বাড়ী গিয়ে থেকে আসো। আর হ্যাঁ অবশ্যই প্রতিটা জিনিস ঠিকঠাক যত্ন হচ্ছে কীনা দেখবে। আমিও আসছি আমার হবু শ্বশুর বাড়ীতে। আমার একমাত্র শালা বাবু ওরফে রাফি দাদুকে নতুন বাড়ীতে শিফ্ট করানোর জন্য।”
কথাটা বলে পূর্ণ গাড়ী নিয়ে চলে আসে। রোদ কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারেনা। কী হলো কিছুই বুঝতে পারছে না সে। এই পূর্ণ তাকে এভাবে ধোঁকা টা দিলো। তখন রাফি রোদকে টেনে গাড়ীর সামনে আনে। এমনিতে রোদের মেজাজ গরম তারউপর হাত ধরাধরি পছন্দ না। সাত পাঁচ না ভেবে রাফির গালে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। ইচ্ছে তো করছে থাপ্পড় দু’টো পূর্ণর গালে দান করতে। কিন্তু পূর্ণ তার আশেপাশে নেই। রাফি গালে হাত দিয়ে রোদকে বলে, ” সমস্যা নেই বিয়ের পর তো এই হাত দিয়েই আদর সোহাগ করবে।”
কথাটা বলে রোদের হাত ধরে গাড়ীতে বসিয়ে দেয় রাফি। গাড়ী স্টার্ট দিয়ে ভার্সিটির প্রাঙ্গণ পেড়িয়ে নিরিবিলি রাস্তায় আসে। রোদের একহাত রাফি ধরে রেখেছে। রোদ হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিছুটা দূরে আসতে রাফি ব্রেক কষে। সামনে পুলিশ সাথে কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ী থামতে পুলিশ আসে রাফির গাড়ীর সামনে।
রাফি গাড়ীর ডোর খোলে বাইরে আসে। তখন রোদ ও বাইরে আসে। একজন পুলিশ বলে, ” আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমরা জানি আপনাকে জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছিলো এই রাফি খান। সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি।”
রোদ তখন বলে, ” উনি আমায় সবসময় বিরক্ত করে। আজকে নিয়ে গিয়ে কী করতো আল্লাহ ভালো জানে।”
তখন পূর্ণর দলের একটা ছেলে এসে বলে, ” পূর্ণ ভাই আমাদের রোদ আপুকে প্রোটেক্ট করার জন্য রেখেছে। দেখছেন ঠিক সময়ে না আসলো কী হতো। আজকে আমাদের ও খবর করতো পূর্ণ ভাই।”
রাফি, রোদ দুজনে তাকিয়ে আছে। পূর্ণ নিজেই তো সবকিছু জানে? উল্টো সেই রাফির হাতে রোদকে তুলে দিলো। রোদ পূর্ণর মনোভাব বুঝতে পারে না। আসলেই কী চলে এই পূর্ণর মাথায়?
রাফিকে ইভটিজিং এর মা’মলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ যেতে কোথা থেকে পূর্ণ গাড়ী নিয়ে আসে। সাদা পান্জাবি পরিহিত শ্যামপুরুষ ঠোঁটের কোণে তার উজ্জ্বল হাসি। রোদ পূর্ণর দিকে একনজর তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। পূর্ণ রোদের সামনে এসে বলে, ” দেখলে তো কীভাবে এক ঢিলে দুই পাখি মারলাম। যাই হোক আশা করি ও আর তোমায় জ্বালবে না।”
রোদ উত্তর দেয়না। পূর্ণ রোদকে গাড়ীতে বসতে বলে। তার দলের ছেলেদের সাথে কিছু একটা বলে পূর্ণ নিজেও গাড়ীতে বসে পড়ে।
তবে পূর্ণ আজকে নিরব না। আপাতত তার কথা বলতে ইচ্ছে হলো। রোদের দিকে তাকিয়ে বলে, ” তাহসিনা খানম এতো বোকা কেনো? শেনো তোমায় একটা বিষয়ে সাবধান করি।”
“কী?”
” তুমি যা দেখো সব সত্যি না। মিথ্যেকেও কিন্তু সত্য বলে তুলে ধরা হচ্ছে তোমার সামবে। এছাড়া তুমি সামনে এমন অনেক বিষয়ের মুখোমুখি হবে, যে বিষয়গুলো সত্য মনে হবে তোমার কাছে, কিন্তু মূলত ওগুলো ফেইক। আবার কিছু ব্যপার তোমার কাছে ফেইক মনে হবে তবে সেই সব বিষয়গুলো চোখ বন্ধ করে বলতে পারো সত্য। এই জিনিসটা চেনা খুবই কঠিন। সত্য এবং মিথ্যা! তবে আমি পূর্ণ সব জানা সত্ত্বেও কখনো তোমায় বলবো না কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যে।”
#চলবে