এক ফালি প্রণয় পর্ব-২৪+২৫

0
3

#এক_ফালি_প্রণয়|২৪|
#শার্লিন_হাসান

পূর্ণ বিড়বিড় করে বলে, “নির্ঘাত ডক্টরকে টাকা ঘুষ দিয়ে হসপিটালে ভর্তি হয়েছে। বুঝাতে হবে না ইন্ডাস্ট্রি বন্ধের পথে সেটা শুনে তার মিনি হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।”

তূর্ণ পূর্ণর দিকে তাকিয়ে বলে, “কী বিড়বিড় করছিস?”

“সে কিছু না। চাচ্চু হসপিটালে তাই তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।”

তখন রোদ কন্ঠে তেজ বৃদ্ধি করে বলে, “ছোট মামু ম’রে যায়নি হার্ট অ্যাটাক করেছে। তুমি কী সব ভুল ভাল বকছো? তার আত্মার মাগফিরাত মানে?”

তখন সিনথি বলে,
“মনে হয় ভাইয়া কিছু খেয়েছে রোদ।”

পূর্ণ নিজেও নিজের কথায় চুপসে যায়। আত্মার মাগফিরাত কামনা করার কথা কেন যে মুখ ফসকে বলে ফেললো। তাঁদের খাওয়া দাওয়া শেষ হতে সিনথি,তূর্ণ রুমে যায়। তূর্ণ সিনথিকে দেখে বলে, “কিছু বলবে?”

“হ্যাঁ! আন্টির ছেলে দেশে এসেছে। ওনার বিজন্যাসের একটা প্রজেক্ট সুন্দর ভাবে সম্পন্ন হয়েছে সেজন্য পার্টি রেখেছে। আমাদের ইনভাইট করেছে।”

“পার্টি কবে?”

“আগামী কাল সন্ধ্যায়।”

“ঠিক আছে চলে যেও।”

“আমাদের পুরো পরিবারকে করেছে। পূর্ণ ভাইকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন। আর হ্যাঁ আপনাকেও যেতে হবে। আমার আম্মুর একমাত্র মেয়ের একমাত্র বর আপনি। ঠিক আছে?”

“আচ্ছা দেখা যাবে। চাচ্চুর কী অবস্থা কে জানে?”

সিনথি আর কিছু বলে না।

রাতে লিভিং রুমে বসেছে সবাই। শূন্য এসেছে সন্ধ্যার পর সাথে তিশাও চলে এসেছে। শুধু সাইখা ইসলাম রয়ে গেছেন হসপিটালে। তখন পূর্ণ বলে, “আমার পুরোনো ফ্রেন্ড ওর একটা প্রজেক্ট সুন্দর ভাবে সম্পূর্ণ হয়েছে সেজন্য পার্টির অ্যারেন্জ করেছে। এনি ওয়ে সে কিন্তু সিনথি আপুর কাজিন।”

তখন শারমিন আঞ্জুম বলে,

“আদ্রিশ চৌধুরী নাকী?”
তখন পূর্ণ জবাব দেয়,
“হ্যাঁ!”

“ওনার বাবার নাম?”
রোদ প্রশ্ন করে। তখন পূর্ণ হেঁসে বলে, “আংকেলকে তো সবাই চিনে। এছাড়া আদ্রিশকে তুমি চেনো না রোদ?”

“তার বাবার নাম জিজ্ঞেস করেছি আমি, তাদের পপুলারিটি সম্পর্কে না।”

“রেগে যাচ্ছো কেন?”

পূর্ণর কথার প্রতিত্তোরে সিনথি রোদকে বলে, “আংকেলের নাম আলতাফ পারভেজ চৌধুরী।”

রোদ কিছু বলেনা। তখন শারমিন আঞ্জুম বলেন, ” রোদ তোমার বাবার সাথে তো মনে হয় একসময় ওনাদের ভালো সম্পর্ক ছিলো।”

“হ্যাঁ সে তো বটেই।”

“এখন তারা মা-রা যাওয়ার পর আর যোগাযোগ নেই।”

শারমিন আঞ্জুমের কথায় রোদ জবাব দেয়,
“প্রয়োজনে প্রিয়জন বানানো মানুষগুলো তিক্ত, বি’ষাক্ত।”

মূহুর্তে পূর্ণর মুখ কালো হয়ে যায়। তখন রোদ সবার সামনেই বলে, “বিষাক্ত মানুষগুলোকে আমার বেশ করে চেনা আছে মামী। ওঁদের বিষেই ওঁদের মারবো আমি।”

চোখেমুখে তার রাগ প্রকাশ পেয়েছে। তূর্ণ রোদের দিকে তাকায়। এ জেনো সে ভিন্ন রোদকে দেখতে পেয়েছে। তূর্ণ খুশি হয়। অনেক হিসাব বাকী আছে। রোদকে হতে হবে রোদের তেজের মতো প্রখর। মূহুর্তে পূর্ণর নিজের করা কিছু ভয়াবহ পাপের কথা স্মরণ হয়। সবচেয়ে বেশী স্মরণ হয়, “সত্য কখনো গোপন থাকে না।”

সেদিন আর কেউই তেমন কিছু বলেনি। সবাই জেনো নিজেদের মুখোশ ঢাকায় ব্যস্ত। তূর্ণ পূর্ণকে ছাঁদে ডেকে পাঠায়। পূর্ণ ও সময় নষ্ট করে না। ভাইয়ের ডাকে সারা দিয়ে ছাঁদে আসে। তখন পূর্ণ বলে, “ভাইয়া রোদ আজকে এটা কী বললো?”

“খারাপ কিছু বলেনি।”

“ও কী ইনডিরেক্টলি আমায় থ্রেট দিলো?”

“তুমি ভয় পাচ্ছো?”

“তো পাবো না?”

“তা পূর্ণ রোদকে কী তুমি ভালোবাসো?”

“হঠাৎ এই কথা কেন?”

“বলো না?”

“না!”

“তো এমন ভাব নেও কেন? জেনো তাকে তুমি পছন্দ করো ভালোবাসো?”

“স্যরি ব্রো! আমার ভাবের জন্য হয়ত তুমি তোমার ভালোবাসাকে পাওনি। এনি ওয়ে যা হয় ভালোর জন্যই হয় বুঝলে?”

“এটার ব্যাখ্যা বলো?”

“তুমি হয়ত জানো না শরীফ শিকদার খানম ইন্ডাস্ট্রি ওনার হওয়ার জন্য স্বপ্ন নিয়ে বসে আছে। সবচেয়ে বড় কথা তাহসিনা খানম রোদ হলো ইন্ডাস্ট্রির ওনার। এখন তাকে যে বিয়ে করবে সেও কিন্তু সেটার মালিক। কিন্তু এখানে খেলাটা ঘুরে গেছে। উনি আমাদের ইন্ডাস্ট্রি থেকে ড্রাগস পাচার করতো ওইসব প্রমান ও রেখেছেন ভিডিও করে। রোদের থেকে ইন্ডাস্ট্রি তার নামে করে দিতে পারলে উনি ভিডিও বা প্রমাণ পুড়িয়ে ফেলবেন নাহলে এসব লিক করে আমার নাম দিবেন। আমার ক্যারিয়ার উনি ধ্বংস করে দিবেন। কিন্তু আমি তো এসবের কিছুই চাইনি। রোদকে মা-রতে পারলে হয়ত বা গেমটা ক্লোজ হয়ে যেতো। কিন্তু কে জেনো তাকে বাঁচিয়ে নেয়। যাই হোক শা’লা কে গতকাল থ্রেট দিয়েছি আশা করি আর এমন করবে না।”

“ছিঃ পূর্ণ!”

“আমি ভালো ছেলে নই তূর্ণ ভাই।”

“আর কী, কী বাকী আছে বলো? রোদের কিছু হলে আমি ভুলে যাবে তুমি আমার ভাই।”

“আর কিছু নেই।”

“তাহলে রোদের থেকে সরে যাও।”

“চিন্তা করো না! তোমার ‘প্রণয়’ আমার হৃদয়ে স্থান পায়নি। আমার চিত্তে বসত করে অন্যজন। সে আমার প্রণয়!”

পূর্ণ কথাটা শেষ করে ছাঁদের দরজার দিকে নজর দেয়। কারোর যাওয়া টের পেয়েছে। খানিক চমকে উঠে তূর্ণর দিকে তাকিয়ে বলে, “আমারা ছাড়াও কেউ ছাঁদে ছিলো ভাইয়া।”

“না আমি কাউকেই দেখিনি।”

পূর্ণ ভরসা করতে পারে না। ফ্লাশ জ্বালিয়ে ছাঁদের চারদিকে ঘুরে,ঘুরে দেখে কিছু পায় কীনা। কিন্তু কিছুই চোখে পড়েনি। তূর্ণ পূর্ণকে বলে, “এসবে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। এসব কিছু থেকে তুমি সরে আসো আমার অনুরোধ। রোদের থেকে ক্ষমা চেয়ে নেও এটাই ভালো হবে।”

★★★

রোদ ল্যাপটপ ঘেঁটে কিছু পিকচার বের করে। পাঁচ বছর আগের কিছু পিকচার। চৌধুরী পরিবারের সাথে তাঁদের ছোট্ট পরিবার, বাবা মা আর সে। আদ্রিশ চৌধুরীর কিছু পিকচার ও তার কাছে আছে। সে-বার দেশে এসেছিলো আদ্রিশ। সব কেমন হারিয়ে গেলো। পাঁচটা বছরের ব্যবধানে। কিন্তু এখানে প্রিয়জনের মুখোশ পরিহিত মানুষগুলোর ভেতরের রুপটা যে আরো কুৎসিত।

“রোদ এতো বোকা না শিকদার পরিবারের পূত্রগণ। পূর্ণ, তূর্ণ কারোর প্রতি তার ফিলিংস আসেনি আর না কখনো আসবে। দ্বিতীয় কারোর প্রতি ফিলিংস আসলে তাহলে কী প্রথমজন আবেগ ছিলো? মোটেও না! আশেপাশের সব কয়টা লোভী।”

“আমরা একবার যাকে ভালোবাসি, তাকে না পেলেও তাদের জায়গাটা কাউকে দিতে পারবো না। তাহলে এটা ভালোবাসার প্রতি অন্যায় হবে।”
রোদ নিজের ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কিছু ইনফরমেশন দেখে। সাথে রহমান ইন্ডাস্ট্রি নিয়েও দেখে। যদিও ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কয়েক কোটি টাকা লস হলো।

★★★

বারোটার দিকে তূর্ণ রুমে আসে। তার বউ পরিবারের সাথে কথা বলছে। সিনথির আম্মু তার আন্টির বাসায়। চৌধুরী ভিলাতে ঈদের আনন্দ প্রায়। সিনথি তো পারছে না এখনি চলে যায়।
কল রেখে তূর্ণ সহ বেলকনিতে বসে সিনথি। তূর্ণর মন খারাপ। বিষয়টা সিনথির চোখ এড়ায়নি। তূর্ণকে দেখে সিনথি বলে, ” আবার কী হয়েছে?”

” আই লস্ট মাই লাভ ফর মাই ব্রাদার!”

“মানে?”

“কিছু না।”

“আপনি কাউকে ভালোবাসতেন?”

“গল্পটা আরেক দিন বলবো।”

সিনথি কথা বাড়ায়না। মনকে কঠিন ভাবে শাসায় সিনথি। “মানুষ ভালোবাাতে পারে। ভালোবাসা ছাড়া বেঁচে থাকা যায় না। কারোর না কারোর ভালোবাসা লাগে এবং ভালোবাসতে হয়। তূর্ণ তার ব্যতিক্রম যায়নি। যাই হোক এখন তো সিনথি তূর্ণর সব। চাইলেও এই বন্ধন থেকে বের হতে পারবে না।”

সেদিনের মতো সিনথি,তূর্ণ বেশ দূরত্বে ঘুমায়। তূর্ণ বুঝে সিনথি হয়ত হার্ট হয়েছে। নাহলে আজকে তার বুকে আসেনি। কিন্ত এই বাস্তবতা এতো,এতো তিক্ত কেন? পূর্ণ! একমাত্র পূর্ণর জন্য সে তার ভালোবাসা হারালো। পূর্ণ এমন করলো কেন?

★★★

শরীফ শিকদার পরের দিন বাড়ী চলে আসে। তাকে দেখে মনেই হয়না হার্ট অ্যাটাক করেছিলো। পূর্ণ বুঝতে পারেনা এর কী আসলেই নাটক ছিলো? নাকী চৌধুরী বাড়ীতে যাওয়ার জন্য এতো তাড়াহুড়ো। শরীফ শিকদারের সাথে তূর্ণ, পূর্ণ কেউই কথা বলেনা। তূর্ণ পূর্ণকে ইগনোর করা শুরু করে। নাস্তা শেষ করে নিজের মতো করে গাড়ী নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে।

রোদ ভার্সিটির উদ্দেশ্য রওনা হয়। সব কেমন এলোমেলো লাগছে পূর্ণর কাছে। গতকালকের পরের থেকে সবাই জেনো নতুন করে নিজেকে প্রকাশ করলো। আদ্রিশ চৌধুরী নামটা প্রকাশ পেলো না জেনো রোদ নিজেকে দ্বিগুণ চেঞ্জ করলো।

খানম বাড়ীতে এসেছে রোদ। রোদকে অসময়ে দেখে রাফির আম্মু রাত্রি বেশ অবাক হয়। রোদ তাকে পাত্তা না দিয়ে তার রুমে যায়। সব আগের মতোই পড়ে আছে। কেউই তার রুমে থাকেনি। কাবাড থেকে একটা চাবি বের করে রোদ নিজের বাবার ঘরে যায়। ঘরের তালা খোলে ঢুকে রোদ। কাবাড থেকে কিছু দরকারী ফাইল নেয়। সাথে নেয় কিছু ছবির এলবাম। নিজের রুমের টেবিল থেকে বের করে ধূলোময়লা জমা দু’টো পুরোনো ডায়েরি। সাথে বে-রঙিন চিঠি। রোদ পুরোনো ডায়েরির উপরের কাপর যেটা সুতো দিয়ে ফুল ফুটানো সাথে লেখা, ❝এক ফালি প্রণয়❞। কাঁধের ব্যাগে সব ঢুকিয়ে রোদ নিচে আসে। রাত্রি রোদকে দেখে বলে, “বাড়ী দখলের চিন্তায় আছো নাকী?”

“জাস্ট ছয়টা মাস সময় দাও চাচ্চি। গাড় ধাক্কা দিয়ে বের না করেছি তোমাদের তাহলে আমার নামটাই পাল্টে দিও।”

“তাহসিনা..

” গলা নিচে। ভুলে যেওনা বাড়ীটা আমার। অনলি সিক্স মানথ্ এই তাহসিনা কী বুঝে যাবে। অনেক ছাড় দিয়েছি সবাইকে আর না!”

“এই টুকো মেয়ে তো তেজ পাও কোথা থেকে?”

“সেটা তোমায় জানতে হবে না। ছয়মাস যা আরাম করার করে নেও। পারলে নতুন ফ্লাট কিনে এখনি প্রস্তুতি গ্রহণ করো।”

কথাটা বলে রোদ বেড়িয়ে যায়। রাত্রি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে রাফিকে কল দেয়। মূহুর্তে কল রিসিভ হতে রাত্রি তেজ দেখিয়ে বলে, ” তাহসিনা এসে আমায় থ্রেট দিয়ে গেছে। ও নাকী ছয়মাস পর আমাদের গাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে। রাফি ও শিকদার বাড়ী যাবে নিশ্চয়ই রাস্তায়ই ওকে পিষে দাও।”

“ওয়েট…

#চলবে

#এক_ফালি_প্রণয়|২৫|
#শার্লিন_হাসান

রাস্তায় এলোমেলো পা ফেলে হাঁটছে রোদ। হাতে তার পুরোনো ডায়েরিটা। দুনিয়ার কোন কিছুই তার মাথায় নেই। পাঁচ বছর আগের দিনগুলো শুধু চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে ভাসছে। রোদ যেই রাস্তায় হাঁটছে এটা মেইন রোড। নিজের প্রতি নিজের এতো অনিহা বোধ। দূরে গাড়ী থেকে রোদের হাঁটা খেয়াল করছে রাফি।

রাফি গাড়ীটা রোদের কাছাকাছি এসে চালাচ্ছে। সুযোগে বুঝেই মে’রে দিবে। ঠোঁটে কোণে তার কুটিল হাসি৷ রাফি থ্রি,টু,ওয়ান বলে গাড়ীর স্পিড বাড়ায়। আর কয়েক মূহুর্ত হলেই রোদের উপর কার উঠে যাবে। হুট করে রোদের হাতে টান পড়ে। রোদ সাইড কারোর শক্তপোক্ত হাতের বাঁধনে আবদ্ধ হয়। রাফি গাড়ীর স্টিয়ারিং থাবা মেরে বলে, “শীট! অল্পের জন্য বেঁচে গেলো।” সে আর দেরী করেনি গাড়ী নিয়ে কেটে পড়ে।

ভরা পাবলিক প্লেসে কেউ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে রোদকে। বলিষ্ঠ দেহের একাংশ বুক পাঁজরে লেপ্টে আছে রোদ। ডায়েরিটা সাইডে পড়ে গেছে সেসবে হুশ নেই তার। বুকের ভেতর এখনো লাফাচ্ছ। অনিয়ন্ত্রিত হৃৎস্পন্দন হচ্ছে। চিত্ত তার সংযম হারাচ্ছে। সেই পাঁচ বছর আগের অনুভূতি আবারো নাড়া দিয়েছে মনে। তাহলে কী সেই পুরুষ আর বর্তমানে যার বাহুডোরে আবদ্ধ আছি দু’জন পুরুষই একজন? আদৌ এটা সম্ভব?

আদ্রিশ রোদকে কিছুটা আলগা করে। রোদ আদ্রিশের মুখের দিকে তাকিয়ে হচকিয়ে যায়। তড়িঘড়ি বাঁধন ছেড়ে দূর সরতে যাবে আদ্রিশ আগের থেকে দ্বিগুণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আশে পাশে তাকিয়ে রোদকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তখন হারিয়ে যেতে দিয়েছিলাম তাই হারিয়েছো এবার খুঁজে পেয়েছি। স্বয়ং মৃ’ত্যু ছাড়া আর কিছুই তোমাকে আমার এই বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।”

“গুড! আমার উপর অধিকার দেখানোর মতো অনুমতি আমি আপনায় এখন আর দিচ্ছি না মিস্টার আদ্রিশ চৌধুরী।”

“আদ্রিশ চৌধুরীর অনুমতি লাগে না মিস খানম। ভুলে যাবেন না আপনার বাবা কী বলেছিলো।”

“সেসব অতীত! আর আমি অতীত ভুলে গিয়েছি।”

“কতদিনে?”

“বহুদিনে!”

“বাহ্! ইমম্যাচিউর মেয়েটা ম্যাচিউর হয়ে গেছে। বেশ ভালো তো! এবার মনে হয় আপনার বাবার দেওয়া কথাটা রাখার সময় হয়ে গেছে।”

“আমার তাড়া আছে।”

রোদ সরে যায়। আদ্রিশ তার হাত শক্ত করে ধরে, পাশ থেকে রোদের ডায়িরটা উঠায় আদ্রিশ। একহাতে রোদ আরেক হাতে ডায়েরি নিয়ে হাঁটা শুরু করে। লুক লাইক, নায়ক! বাট পুরো সীনটা ভিলেনের মতো। রোদ হাতের বাঁধন ছাড়াতে গিয়েও পারে না। রোদকে গাড়ীতে বসিয়ে আদ্রিশ নিজেও ড্রাইভিং সীটে বসে।

গাড়ী স্টার্ট দিয়ে রোদকে প্রশ্ন করে, “বেঁচে আছো তুমি?”

রোদ জবাব দেয়না। আদ্রিশ চোয়াল শক্ত করে বলে, “আমার সাথে দেখা করোনি কেন?”

“আপনি আমার খোঁজ করেননি।”

“আমি তো ভেবেছিলাম সেদিন তুমি আগুনে পুড়েই ছাই হয়ে গেছো।”

“বেশ ভালো!”

“শাট আপ! কথা বলতে জানো তো? কীসব উল্টাপাল্টা প্রতিত্তোর দিচ্ছো?”
চেঁচিয়ে বলে আদ্রিশ। তখন রোদ বলে,
“চেঁচাবেন না। আপনার আগের সময়টা এখন আর নেই।”

“রোদ চেঞ্জড!”

“ইয়েস!”

“গুড!”

বাঁকা হেঁসে বলে আদ্রিশ। রোদের গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। আদ্রিশ একটা ক্যাফের সামনে গাড়ী থামায়। জানালা দিয়ে রোদকে ইশারা করে দেখায়, “ওই ছেলেটা বোধহয় তোমার কাজিন?”

রোদ নিজেও খেয়াল করে। পূর্ণ একটা মেয়ের সাথে বসে কথা বলছে। তখন রোদ বলে, “ওটা তো আপনার বন্ধু।”

“জানি কিন্তু তার আগে তো তোমার কাজিন শিকদার সাহেব।”

রোদ জবাব দেয়না।তখন আদ্রিশ বলে, ” তা রোদ আমাকে ছাড়া পাঁচটা বছর ভালোই কাটলো বুঝি? কাউকে জ্বালিয়েছো নাকী?
থেমে,
শুধু একবার হ্যাঁ বলো তো খবর আছে তোমার।”

ঠান্ডা মাথায় থ্রেট দেয় আদ্রিশ। রোদ কন্ঠে তেজ বৃদ্ধি করে বলে, “সেটা আপনায় বলতে বাধ্য নই।”

“তেজ একটুও কমেনি দেখি। গুড!”

রোদের কেন জানি কান্না পাচ্ছে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানের চেষ্টা করছে সে। আদ্রিশের সামনে দুর্বল হওয়া যাবে না। কান্না তো ঠিক তখনি পেয়েছিলো যখন আদ্রিশ তার বুকে স্থান দিয়েছিলো তাকে।

আদ্রিশ একটা রেড বল বের করে তাতে কয়েক চুমুক দেয়। রোদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় সে।

“তাহসিনা খানম রোদেলা কাঁদতে পারেন। মন উজাড় করে কাঁদতে পারেন কোন সমস্যা নেই। আমি বসে,বসে আপনার কান্না দেখতেও রাজী আছি।”

“রোদ বাইরে তাকায়। আদ্রিশের কল আসতে সে কল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রোদ আড়ালে চোখের পানি মুছে নেয়। আদ্রিশের আম্মু ফারিহা কল দিয়েছে।

ফারিহা ছেলেকে বলেন, ” আদ্রিশ বাবা বাড়ী আসো। গেস্ট তো আসছে!”

“আম্মু তোমার পূত্র বঁধুকে সময় দিচ্ছি! তুমি ওইদিকটা সামলে নেও।”

“পূত্র বঁধু মানে? আদ্রিশ তুমি বিয়ে করেছো কবে?”

“এমনিতে বললাম তোমায়। বিয়ে করিনি তবে করবো ইনশাআল্লাহ!”

“সে আর বলতে!”

“কথা বলবে?”

“কার সাথে?”

“তোমার ছেলের হবু বউয়ের সাথে।”

কথাটা বলে রোদের দিকে ফোন এগিয়ে দেয় আদ্রিশ। রোদ ফোন হাতে নেয়না। আদ্রিশ কলটা মিউট করে বলে, “বুঝেছি তোমার অন্য কিছু চাই তাহলে কথা বলতে রাজী হবে।”

“মানে?”

“কিছু না! কলে কথা বলো?”

“মুড নেই!”

আদ্রিশ আর কথা বাড়ায়না,জোর করে না। তার আম্মুর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দেয়। পূর্ণ, অরিন ক্যাফে থেকে বেড়িয়ে যেতে আদ্রিশ রোদকে নিয়ে প্রবেশ করে।

রোদ চেয়ারে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে। পাঁচ বছর আগের স্মৃতিতে ডুব দেয় সে। তখন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলো। অষ্টাদশী কন্যা মনে কত রকমের কিছুই চিন্তা হয়। তার চিত্ত নামক ফুলে ভ্রমর হয়ে এসেছিলো আদ্রিশ চৌধুরী। হাসে রোদ! কী যে চঞ্চলতা ছিলো তার মাঝে। বাবার একমাত্র মেয়ে ছিলো সবার বেশ আদরের। ফারিহা চৌধুরী ও রোদকে বেশ আদর করতো। রোদের বাবা তীর্থ খানের সাথে আদ্রিশের বাবা আলতাফ পারভেজ চৌধুরীর বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। তখন শিকদার পরিবারের সাথে তেমন ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেনি খান পরিবারের। শুধু পূর্ণর বাবার সাথে ভালো সম্পর্ক ছিলো। শিকদার পরিবারের সাথে ভালো সম্পর্ক হয়নি, কারণ রোদের বাবা মায়ের বিয়েটা ভালোবাসার ছিলো। কেউই মানতে পারেনি! কিন্তু তাঁদের ছোট্ট পরিবারে সুখের কমতি ছিলো না। তীর্থ খানের সব সুখ তার মেয়ে তাহসিনা ছিলো। মেয়ে বলতে তিনি পাগ’ল ছিলেন।

সেই দিনগুলো বেশ ভালো কেটেছে। শুধু কিছু মানুষের লোভ,লালসার স্বীকার হয়ে দুনিয়ায় বেশীদিন টিকতে পারেনি তীর্থ খান এবং তার অর্ধাঙ্গিনী। একমাত্র বাবার একমাত্র কন্যা যাকে একসময় সর্ব সুখী কন্যা বললেও ভুল হতো না তার জীবনের সুখ এক নিমিষেই শেষ হয় কালো আঁধারে ঢেকে গেলো।

“তাহসিনা খানম যদি অনুমতি দাও আমি তোমার ❝এক ফালি প্রণয়❞ নামক ডায়েরিটা টা গ্রহণ করতে চাই।”

“আমার নিজের ও মনে নেই কী লিখেছিলাম। আপনি লেখাগুলো পড়লে হাসবেন আমি শিওর।”

“বোকা মেয়ে! কারোর প্রতি কারোর অনুভূতি কখনো হাসির বিষয় হয়না। লিখা যাই হোক না কেন ওইটা আমার জন্য ভীষণ মূল্যবান কারণ প্রতিটা পৃষ্ঠায় সাজানো অনুভূতি,বিষাদ,হাসি-কান্না সবই আমায় ঘিরে ছিলো।”

রোদের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে। আদ্রিশ নিজেও হাসে রোদের হাসি দেখে। রোদের ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয় আদ্রিশ। রোদের নেত্রপল্লবে নিজের দৃষ্টি স্থির করে বলে, “ভালোবাসি বলাটা সহজ, কিন্তু ভালোবেসে আজীবন থেকে যাওয়াটা কঠিন।”

রোদ জবাব দেয়না। ভাগ্যে যা ছিলো তাই তো হলো! তবে হয়ত তার ভালোবাসা মিথ্যে ছিলো না তাই পাঁচ বছর পরে এসেও তারা একে অপরের চোখে ভালোবাসা,কোমল অনুভূতি, টান এবং সন্মান দেখতে পেয়েছে।

“উইল ইউ লাভ মি রোদ? এগেইন! আই প্রমিস আমার রোদকে আমি এবার হারাতে দিবো না।”

রোদ কথা ঘুরানোর জন্য বলে, “আপনি হঠাৎ এই শহরে?”

“অল্প কয়েক মাস হলো এসেছি। এতোদিন জার্মানিতেই ছিলাম। অফিসে কিছু কাজ ছিলো সেটা শেষ করে আসছিলাম। দূর থেকে তোমায় দেখেছি। কিন্তু তুমি যেই মেয়ে! এমনিতে মানুষ তোমায় মারতে চায় আর তুমি যা কেয়ারলেস তোমায় মা-রাটা খুবই ইজি।
থেমে,
আমার আসল কথার জবাব পেলাম না রোদ।”

“সময় থাকতে মূল্য দিতে হয়। আমি উঠি!”

কথাটা বলে রোদ উঠে দাঁড়ায়। নিজের ডায়েরিটা হাতে নিয়ে নেয়। তখন আদ্রিশ বলে, ” ডায়েরিটা দিবে না?”

“না!”

“প্লিজ….

রোদ কিছু বলেনা। মাথা নাড়ায় সে। আদ্রিশের রিকুয়েষ্ট ফেলার সাধ্য খোদা তাকে দেয়নি। এখনো সফট কর্ণার কাজ করে মানুষটার জন্য।

আদ্রিশ ডায়েরিটা নিয়ে উঠে রোদকে ধন্যবাদ দেয়।

” চলো তোমায় নামিয়ে দিয়ে আসি।”

“তার দরকার নেই।”

“আমি বলেছি না!”

চেখ রাঙিয়ে বলে আদ্রিশ।

#চলবে