এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা ২ পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
1529

#এক_বৃষ্টিস্নাত_সন্ধ্যা(সিজন ২)
৩৪.
#WriterঃMousumi_Akter

রৌদ্রজ্জল সকালের শুরুতেই সূর্যের তাপহীন আলোকরশ্মি বড় জোড়া তালগাছ ভেদ করে এসে উঠানের এক কোনায় আর বাড়ির মেইন গেটে পড়েছে।রোজ সূর্যের আলো সবার প্রথমে বাড়ির মেইন গেইট আর ওঠানের এক কোনাতেই পড়ে।দূর্বাঘাসে জমে থাকা শিশির বিন্দু গুলো সূর্য মামা গ্রাস করতে শুরু করেছে।তাপ বাড়ার সাথে সাথেই শিশির বিন্দু গুলো শোষণ করে নিলো সূর্যমামা।উঠানের এক কোনায় লাউ আর কুমড়োর টাল,টালে কুমড়ো লতা গুলো গুলো নুইয়ে পড়েছে।নেট দিয়ে ঘিরে খানিক টা জায়গা তরকারি লাগিয়েছে দুই মামি।লাউ আর কুমড়োর ডগায় ডগায় ফুল ফুটেছে।সকালে ওঠা সূর্যের প্রথম আলো ফুলের উপর পড়ে ভারী মিষ্টি লাগছে দেখতে।কুমড়ো ফুলে ফুলে ভ্রুমর উড়ে বেড়াচ্ছে।বড় কাকি আর বিহান ভাই লাউ কুমড়ার কত গুলো ফুল থেকে ফল হয়েছে সেগুলো গুনছেন আর বিহান ভাই ছবি তুলছেন।সাইডে কিছু বেগুন আর ঝালের গাছ ও লাগানো আছে।বাজারের ফরমালিন যুক্ত সবজি খাবে না বলেই মামাদের বাড়িতে দুই একটা সবজি চাষ করে।যেহেতু শহর অনেক জায়গা নেই উঠানে তাই এক কোনায় যত টুকু সম্ভব তত টুকুই চাষ করেছে।পাশাপাশি বিভোর ভাই অসংখ্য ফুলের চাষ করেছে।নার্সারী থেকে বিভিন্ন জাতের ফুল এনে চাষ করেছেন।

–বড় মামা মানে বিভোর ভাই এর বাবার সিদ্ধান্তে সব কাজ করা হয় এ বাড়িতে।বড় মামা যা সিদ্ধান্ত নেয় সেটাই সবাই মাথা পেতে নেয়।বিহান ভাই ও তার ব্যাতিক্রম নয়।উনি সবার কথার অবাধ্য হলেও কখনো তার বড় কাকার কথার বিরুদ্ধে যান না।বড় মামার সিদ্ধান্তেই দুই মামার বাড়ি এক ই সাথে একই জায়গা করা,তবে ফ্ল্যাট আলাদা কিন্তু পাশাপাশি।এ জায়গা টা আমার নানা কিনেছিলেন আর বড় মামাকে বলেছিলেন তারা যেনো এ জায়গা ছেড়ে না যায়।বিহান ভাই এর ইচ্ছা ছিলো ঢাকাতেই ফ্ল্যাট নেওয়ার কিন্তু তার বড় কাকার অনুরোধেই এখানে থেকে যাওয়া।

–বিভা আপু আর ছোট মামি ইয়া বড় একটা চাল কুমড়া কেটে নিয়ে বসেছে তারা মোরাব্বা বানাবে বলে।মারুফা খালার গ্রামের বাড়ি থেকে চাল কুমড়া নিয়ে এসছে। বিহান ভাই কে মারুফা খালা চাল কুমড়ার মোরাব্বা খাওয়াবে।আমি আস্তে করে এসে পাটিতে বসে পড়লাম।বিভা আপু একটা কাটা চামচ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো এটা কাচিয়ে দে ভাল ভাবে। একটা চাল কুমড়ার পিচ হাতে নিয়ে কাটা চামচ দিয়ে কাচিয়ে যাচ্ছি।এমন সময় বিভোর ভাই এসে বসলেন আমাদের পাশে।বিভা আপু বিভোর ভাই এর হাতে একটা কাটা চামচ দিয়ে বললো,নে ধর কাজ কর।

–বিভোর ভাই বললেন,এহ আমি কাজ করবো এ কাজ কিভাবে করে আপু।এটা তো মহিলাদের কাজ।

–তুই ছোট বেলায় কি বলতি মনে আছে বিভোর।আমরা নাটক দেখলে বলতি যে আমি কি মহিলা মানুষ যে নাটক দেখবো।কাকু বা আব্বু কেউ খবর দেখলে আবার কাঁদতি যে আমি কি বড় পুরুষ মানুষ যে খবর দেখবো।আমি বাচ্চা মানুষ আমি দেখবো কার্টুন।আবার এখন বলছিস যে এটা মহিলাদের কাজ।ধর চমচ কাজ কর।
বউ বললে ঠিক ই পারতি তাইনা বিভোর।

–বিভোর ভাই কলার ঝাকি দিয়ে বললেন,আপু এইদিক টা একটু খেয়াল করো প্লিজ।বড় বোন আর দুলাভাই থাকলে এইসব দিক খেয়াল রাখতে হয়।তাছাড়া বিয়ে কিন্তু ফরজ আপু।তোমাদের সবার ফরজ আদায় হয়ে গিয়েছে আর আমাকে পাপী বানিয়ে রাখতে চাও।আমি জীবনে কোনো পাপ করিনি।এই একটা ফরজের জন্য আমি কি জান্নাত পাবো নাহ আপু।

–ছোট মামি বললেন,বিভোর মুরব্বি বলে আমাকে পছন্দ হচ্ছে না বাবা।

–কাকিমা তুমি যাও প্লিজ!এখন আমাদের বিশেষ মিটিং হবে।

–আচ্ছা যাচ্ছি তোরা মিটিং কর।

–আমি বললাম,মামি আমি আসবো কোনো হেল্প লাগবে রান্না ঘরে।

–দিয়া কাল রাতে বিহান খায় নি।এখন আর রান্না করবো না।তোর রান্না করতে শখ হয়েছিলো দুপুরে করিস ঠিক আছে মা।এখন চুনো মাছ পিয়াজ দিয়ে চচ্চড়ি করছি। এইটুকু কাজে তোর আসা লাগবে না।

–মামি চলে গেলে কিছুক্ষনের মাঝেই দুলাভাই এসে বসলেন।

–বিভা আপু দুলাভাই কে বললো আচ্ছা তোমার কি কোনো কান্ডজ্ঞান নেই।

–দুলাভাই এক গাল হেসে বললেন,ক্যানো ডারলিং।

–বিভোর ভাই বললেন,দুলাভাই ছোট শালা শালীর মাঝে এত রোমান্টিক আলাপ করিয়েন না।সিঙ্গেল আমি, এত রোমান্টিক অত্যাচার করিয়েন না।

–বিহান আর দিয়া কোন ভাবেই কাছাকাছি যায় না।আজ ওরা একটু কাছাকাছি গিয়েছিলো তুমি কাবাবে হাড্ডি হয়ে ওদের লজ্জা দিয়েছো ক্যানো?কোথায় ওদের একটু কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ করে দিবে তা নয় আরো ডিস্টার্ব করেছো।বিভোর আমাকে বললো,আপু শিঘ্রি দুলাভাই কে ডেকে আনো।

–শালা আর শালা বউ এর মাঝে দুলাভাই যাবে নাতো কি অন্য কেউ যাবে।

–এইদিকে লজ্জা ও পাচ্ছি আবার হাসি ও পাচ্ছে।ওদের কথার দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে কাটা চামচে হাত ফুটো হয়ে গেলো।ডিপ ভাবে খানিক টা ঢুকে গেলো বুড়ি আঙুলে।উহ শব্দে চিৎকার দিতেই আঙুল গড়িয়ে রক্ত বেরিয়ে গেলো।সাথে সাথেই বিভোর ভাই আর দুলাভাই আমার আঙুল চেপে ধরলেন।বিহান ভাই আমার আতকে ওঠার শব্দে দ্রুত এদিকে এগিয়ে এলেন।সবাইকে আমাকে নিয়ে ব্যাস্ত হতে দেখেই উনি ব্যাস্ত হয়ে ছুটে এলেন।উনি এসে আমার হাত ভর্তি রক্ত দেখে ভীষণ ভাবে এক্সসাইটেড হয়ে পড়লেন।উনার চোখ মুখের হাসি যেনো কোথায় বিলীন হয়ে গিয়েছে।বিভোর ভাই এর দুলাভাই এর হাত সরিয়ে দিয়ে উনি আমার আঙুল চেপে ধরে বললেন,এই দিয়া তোর চোখে পানি কেনো?নিশ্চয়ই অনেক লেগেছে, না হলে তুই কাঁদতি না।তোর কি অনেক ব্যাথা লাগছে।অনেক খারাপ লাগছে।কে বলেছে তোকে এসব করতে।উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে এক ভাবে কথা গুলো বলে চলেছেন।উনার চারপাশে যে এত গুলো মানুষ আছে সে খেয়াল ই নেই উনার মাঝে।উনার চোখে মুখে কষ্টের ছাপ,মনে হয় এখুনি কেঁদে দিবেন।আমি ব্যাথা পেয়েছি অনেক তবে উনার মায়াভরা কথার জন্য আরো বেশী করে কাঁন্না পাচ্ছে।আমি এবার আবেগ কন্ট্রোল করতে না পেরে উনার দিকে তাকিয়ে বেশ জোরেই কেঁদে দিলাম।এই কাঁন্নাটা ছিলো আমার প্রতি উনার কেয়ারের জন্য কাঁন্না।উনার কাছে আহলাদ প্রকাশের কাঁন্না।উনি আমার আঙুলে ফু দিতে দিতে বললেন,কিচ্ছু হবে না দিয়া।বিকাল হতে হতেই ঠিক হয়ে যাবে।অনেক লেগেছে তাইনা?

–বিহান ভাই কে এমন করতে দেখে সবাই ভীষণ অবাক হয়ে বিহান ভাই এর দিকে তাকিয়ে রইলো।সবাই মনোযোগ বিহান ভাই এর দিকে।কেননা বিহান ভাই কারো সামনেই নিজের কিছুই প্রকাশ করতে চান না।উনি ব্যাক্তিগত জিনিস ব্যাক্তিগত রাখতেই পছন্দ করেন।তাছাড়া মানুষের মাঝে বউ এর হাত ধরে এমন আকুতি করার ছেলে নন।বিভোর ভাই দুলাভাই কে ইশারা দিয়ে দেখালেন।

–এরই মাঝে বিভা আপু একটা কাপড় এনে বিহান ভাই এর হাতে দিলো।বিহান ভাই আমার হাতে কাপড় টা বেঁধে দিলেন।

–দুলাভাই বললেন,শালাবাবু তোমার বউ এর কতটুক লেগেছে জানিনা কিন্তু এখানে উপস্হিত আমরা সবাই বুঝতে পেরেছি যে,তোমার বেশী লেগেছে।কে বলে আমার শালাবাবু তার বউ কে শুধু রাগ দেখায় ভালবাসে না।আজ শালাবাবুকে দেখলাম শালাবউ এর জন্য কতটা সিরিয়াস।

–বিহান ভাই বললেন,ওর সত্যি লেগেছে দুলাভাই।দেখছেন না ওর চোখে পানি।

–ও পানি হাত ব্যাথার পানিনা। ও পানি আহলাদের বুঝলে।তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলে তবেই এই ব্যাথা কমতো।

–বিভা আপু বললো,আমার ভাই কে দেখে শিখো বুঝলে বুইড়া।তোমার মতো তো আর কেয়ারলেস না।

–এত বড় অপবাদ দিতে পারলে।আজ থেকে শুধু বউ এর দিকেই তাকিয়ে থাকবো।

–সবাই হাসাহাসি করলেও বিহান ভাই এর মুখে হাসি নেই।উনি আমার দিকেই চোখ স্হির করে তাকিয়ে রইলেন।আমার ভেজা পাপড়িও উনার দিকেই তাকিয়ে আছে।

সকাল গড়িয়ে দুপুর পার হয়েছে,প্রচন্ড গরমে ফ্যানের বাতাস ও যেনো গরম হয়ে গিয়েছে।বিভোর ভাই দের বাসা থেকে আজ দুপুরে আমরা সবাই খেয়েছি তাই রান্নার ঝামেলা নেই দুপুরে।বিহান ভাই দুপুরে খাওয়ার পরে ঘুমোচ্ছেন।বিহান ভাই একভাবে ৩-৪ ঘন্টা কিভাবে ঘুমোচ্ছেন কি জানি।আমি আধাঘন্টা ও ঘুমোতে পারিনা দিনে।মামা আমাকে ডেকে বললেন,দিয়া মা হাতের ব্যাথা কি কমেছে মা।আমি হাত দেখিয়ে বললাম,মামা একটুও ব্যাথা নেই দেখুন।মামা বললেন,সাবধানে কাজ করবা মা।মামি বললেন,আমি এইজন্য দিয়াকে কোনো কাজে দিতে চাই না।এর ই মাঝে মা বাবা ভাইয়া আর রিয়া এলো।হঠাত এ সময়ে ওদের দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম আমি।আম্মুর হাতে চারবাটির টিফিনবক্স। মামা আর মামি আম্মু আর বাবাকে দেখে ভীষণ খুশি।আমি আম্মুকে বললাম,আম্মু তুমি হঠাত বাবা তুমি।বাবা বললেন,বিহান বললো তোমার হাত অনেক খানি কেটে গিয়েছে মা।আমি হাত দেখিয়ে বললাম দেখো তো একটুও কেটেছে কিনা হাত একটু ফুটো হয়েছিলো চামচে।আম্মু বললো বিহান যে বললো,তুমি অনেক ব্যাথা পেয়েছো?আম্মু কি জানি কি ভেবে বলেছে।টিফিন বক্সে কি আম্মু।আম্মু মামির হাতে দিয়ে বললো ওই একটু রান্না করেছিলান তাই নিয়ে এসছি।মা বাবা, মামা মামি খোস গল্পে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।

আচ্ছা নি কি সবাইকে বলেছেন যে আমার হাত কেটে গিয়েছে।

–রিয়া আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে এসে বললো,দিয়া বিভোর ভাই বাসায় নেই আজ,উনাকে দেখছি না যে আজ।রিয়ার চোখ বিভোর ভাই দের ফ্ল্যাটের দিকে।মনে হচ্ছে রিয়া যেনো কিছু একটা খুজে চলেছে।

–আমি চোখ ঘুরিয়ে বললাম,কি ব্যাপার আমার ভাই কে খোজা হচ্ছে কেনো?কাহিনী কি?

–আহা বল না কোথায়?উনি কি বাসায় নেই।

–বিভোর ভাই যশোর গিয়েছে বিকালে আসবে।

–ওহ আচ্ছা।আমি তাহলে চলে যাচ্ছি।রিয়ার চোখে মুখে কেমন যেনো বেদনার দীর্ঘঃশ্বাস।সেদিন বিভোর ভাই এর দেওয়া চুড়ি গুলো রিয়া দুহাত ভরে পরেছে আজ।

–রিয়ার মুখটা ভীষন কালো হয়ে গেলো।এক মিনিট না দাঁড়িয়ে চলে গেলো।কি হয়েছে রিয়ার আজ।

আম্মু আর মামির সাহায্য নিয়ে সারা বিকাল রান্না করলাম নিজ হাতে।সকালেই বলে রেখেছিলাম আজ আমি রান্না করবো।উনার জন্য প্রথমবার নিজ হাতে রান্না।নিজের মনের কাছে ভীষণ শান্তি লাগছে।কখন উনাকে খাওয়াতে পারবো।আমি জানি উনি ভীষণ খুশি হবে আমার হাতের রান্না পেয়ে।রান্না শেষে আম্মু, বাবা সবাই চলে গেলো।সেই দুপুর থেকে বিহান ভাই বিশাল এক কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যাচ্ছেন।দুপুর একটা থেকে উনি ঘুমিয়েই যাচ্ছেন।দিনের বেলায় এত ঘুমোন কিভাবে উনি।আমার হাত নিয়ে সকাল থেকে বসে থেকে দুলাভাই দের সাথে খেয়ে এসে ঘুমিয়েছেন।বিকাল ৫ টায় বিহান ভাই ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করতে করতে এসে আমাকে বললেন,কি ব্যাপার দিয়া খবর শুনলাম আমার বউ তার কাটা হাতে আমার জন্য রান্না করেছে।বেশ সন্দিহান হয়ে বললাম,কে বলেছে ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখলেন নাকি।ঘুম ভাঙতেই রান্নার সুঘ্রাণ পেয়েছি নাকে, আর আজকের রান্নার ভীন্ন সুঘ্রাণে বুঝতে পেরেছি এটা বউ এর হাতের রান্না।আমি মুখে লাজুকতা নিয়ে কিছুই না বলে চলে গেলাম।

–সন্ধ্যার খানিকটা পরেই দুলাভাই আর বিভা আপু অনেক রিকুয়েষ্ট করলো তাদের সাথে বাইরে যাওয়ার জন্য।মামা বললেন, যাও মা তোমার দুলাভাই এতবার বলছেন যখন।বিভা আপু আর দুলাভাই এর সাথে হাঁটতে হাঁটতে দানাপানি রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার খাচ্ছি।এমন সময় বিহান ভাই মেসেজ করেছে দিয়া রাস্তায় আয়, দুজনে বালুর মাঠে হাটতে যাবো।এই মুহুর্তে বা কিভাবে যাবো, এভাবে খাবার ছেড়ে উঠে গেলেই বা কেমন দেখাবে।দানা পানি রেস্টুরেন্ট ব্রিজের নিচেই বাসা থেকে মিনিট পাঁচেক এর রাস্তা।বেয়াদব এর মতো কিভাবেই বা যাবো।

–বিহান ভাই কে মেসেজ করলাম এখন তো যেতে পারবো না বিহান ভাই, একটু বিজি আছি।আর প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে সাথে হাতেও ব্যাথা।অনেক রক্ত বেরোচ্ছে।
বিহান ভাই আর কোনো রিপ্লে দিলেন না।

প্রায় ৫ মিনিট পরে হঠাত দেখি বিহান ভাই ওয়েটার কে টাকা দিয়ে বলছেন,সরি ভাই টেবিল টা বুক করেছিলাম বাট আজ আর আসা হলো না।ওয়েটার বললো,ভাই সমস্যা নেই টাকা দেওয়া লাগবে না।বিহান ভাই এক প্রকার জোর করেই টাকা দিয়ে দিলেন।আমি বিহান ভাই কে দেখে মাথা নিচু করে রইলাম।বিহান ভাই টাকা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দুলাভাই ডাক দিয়ে বললেন আরে শালা বাবু।বিহান তাকিয়ে বেশ অবাক হলেন।এই সময়ে দুলাভাইকে ডাকতেই হলো।আমি অপরাধি মুখ করে তাকালাম।বিহান ভাই জাস্ট একবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,দুলাভাই আপনারা খান তাহলে রাস্তায় বন্ধু বাইকে আছে একটা ইমারজেন্সি কাজ পড়েছে।বলেই বেরিয়ে গেলো।

এইভাবে ধরা টা না খেলেও তো পারতাম।কি হবে এখন আমার।

চলবে,,,

#এক_বৃষ্টিস্নাত_সন্ধ্যা (সিজন ২)
৩৫.
#WriterঃMousumi_Akter

জানালার গ্রিলসহ খয়েরী কালারের মসৃণ পর্দা ভেদ করে এক টুকরো চাঁদের আলো রুমের পূর্বসাইডে রাখা আলমারির গায়ে এসে আচড়ে পড়েছে।আমার দৃষ্টি সোজা চন্দ্রপানে নিক্ষেপ রয়েছে।ঝলসানো চাঁদটাকে যেনো ভীষণ মলিন লাগছে আজ দেখতে।চাঁদের ও মনে হয় আজ ভীষণ মন খারাপ।জানালার গ্রিল ধরে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি আমি আর ভাবছি চাঁদের ও কি তার প্রিয় জনের সাথে অভিমান হয়েছে।কোথা থেকে এক টুকরো সাদা মেঘ যেনো ভেসে এসে গোলাকার চাঁদটাকে ঢেকে দিলো।আকাশ ভরা টুকরো টুকরো সাদা মেঘের ছড়াছাড়ি।নীল আকাশে সাদা মেঘে মনে হচ্ছে নীল কাপড়ে সাদা ছাপা। লাউ এর টাল এর সামনে খানিক টা জায়গা টালের জন্য অন্ধাকার হয়ে আছে দেখতে।ওই জায়গা বসে দুলাভাই আর বিভা আপু নিশ্চিন্ত মনে দুজনে প্রেম করছে এক জনের কাধে আরেকজন মাথা রেখে।তখন রেস্টুরেন্ট থেকে ভালো লাগছে না বলে খাবার রেখে উঠে ওয়েটারের কাছে গেছিলাম।ওয়েটার কে জিজ্ঞেস করলাম,যে টাকা দিলো উনি কার জন্য টেবিল বুকিং করেছিলো।

ওয়েটার বললো,বিহান ভাইয়ার কথা বলছেন নাকি আপু।

আমার দুই ঠোঁটের মাঝে কিঞ্চিত ফাঁকা।মাথা নেড়েই বললাম হা উনি।

ওয়েটার হেসে বললো,বিহান ভাইয়া মাঝে মধ্য বন্ধুদের সাথে এখানে আসেন।উনার বন্ধুরা ভাইয়ার ওয়াইফ কে নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেন কিন্তু ভাইয়া সে ব্যাপারে কিছুই বলেন না।শুধু এই টুকুই বলেন পুচকি আমার পারসোনাল সম্পত্তি সেই ব্যাপারে কাউকে কিছুই বলবো না আর কারো সাথে মিট করাবো না।ভাইয়া ভাবিকে ভীষণ ভালবাসেন।অনেক বলেছি ছবি দেখান না।তবে আজ হঠাত বললেন,ভাইয়া নাকি সন্ধ্যার পর ভাবিকে নিয়ে আসবেন।ভাইয়ার বউ দেখার সৌভাগ্য হবে এটা ভাবতেই অনেক ভাল লাগছিলো।কিন্তু ভাবি নাকি অসুস্থ তাই আসতে পারবে না।আপু বিহান ভাইয়াকে চিনেন না।অনেক বড় ডাক্তার সে।আমাদের নড়াইলের গর্ব সে।ভীষণ ভাল একজন মানুষ।
টেনশন আর দুঃচিন্তায় চোখ মুখ শুকিয়ে এত টুকু হয়ে গিয়েছে আমার।টেনশনে মাথা পাগল পাগল লাগছে। উনি যে একটা টেবিল বুকিং করে রেখেছিলেন আমি তো সেটা ভাবতেই পারিনি।কি করবো এখন।বুকের মাঝে দুরুম দুরুম করে যাচ্ছে।টেনশনে হাঁপাচ্ছি।

তখন ই বাড়ি ফিরে এসে থেকে আমি অপেক্ষা করছি উনার জন্য। উনি কখনো রাস্তায় অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দেন না।সব সময় বলেন বাইরে আড্ডা দেওয়ার থেকে তোকে বিরক্ত করার মাঝে তৃপ্তি বেশী।তাই ভাবছি হয়তো চলেই আসবেন।অত কিছু ভেবে তো মিথ্যা বলি নি আমি।দুলাভাই আর আপুকে বা কি বলতাম।ভেবেছিলাম উনি হয়তো জানবেন ই না আমি বাইরে গেছিলাম বা জানলেও রাগ করবেন না।উনি কি সত্যি রাগ করেছেন।ব্রিজে তো রেগুলার সন্ধায় যান আজ তো দেখলাম না।আসার সময় চোখ এদিক ওদিক করে চারদিক খুজলাম কোথাও পেলাম না উনাকে।রাস্তার দিকে চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছি আমি।রাতে ল্যামপোস্টের আলোয় রাস্তাঘাট ঝলমল করছে।রাস্তা দিয়ে গাড়ি বাইক ক্রামাগত যাতায়াত করেই যাচ্ছে।আমি প্রতিটা বাইকের হর্নেই মুখ উচিয়ে রাস্তা দেখছি উনি এসছেন কিনা।প্রহর গুনতে গুনতে রাত দশ টা বেজে গেলো উনার আসার নামে কোনো খবর নেই।ফোন সুইটস অফ,এই অবস্থায় কি করবো সেটাও বুঝছি না।এরই মাঝে দেখলাম উনার বাইক বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেছে আমি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দেখি উনার বাইকে বিভোর ভাই।বিভোর ভাই এর শার্টের বোতাম সব গুলো খোলা প্রায়।চোখ মুখ ঘেমে কেমন তেলতেলে হয়ে গিয়েছে।বিভোর ভাই কে দেখে মুখটা চুপসে গেলো আমার।নিমিষেই মুখটা কালো হয়ে গেলো আমার।কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপ করে।

–বিভোর ভাই আমাকে বললেন,দিয়া কি যে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি আজ জানিস না।সারাদিন যশোরে ছোটাছুটি করেছি গরমে জীবন যায় যায় অবস্থা। শরীর থেকে কয়েক মন পানি বেরিয়েছে।বিভোর ভাই প্যান্ট প্রায় হাঁটুর নিচ অবধি উলটে ভাজ দিয়ে রাখা।

–আমি চুপ রইলাম কিছুই বললাম না।

–বিভোর ভাই শার্ট খুলে হাতের কব্জিতে নিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে একটা মলম আমার হাতে দিয়ে বললেন,এটা বিহান তোকে দিতে বলেছে।দিনে চার বার করে লাগাবি হাতে।

–উনি কোথায় বিভোর ভাই?

–আমার গাড়ি আবির নিয়ে গিয়েছে,আর বিহান আমাকে রাস্তা থেকে ওর বাইক দিয়ে বললো বাসায় নিয়ে আসতে।

–উনি আসলেন না।

–আসবে এক্ষুণি! এক বন্ধুর সাথে দেবদার তলায় বসে তার ল্যাপটপে কিছু দেখাচ্ছে।বিভোর ভাই আমার হাতে বিহান ভাই এর ফোন টা দিয়ে বললেন,বিহান ওর ফোন ও পাঠিয়ে দিয়েছে।ফোনের সুইটস অফ হয়ে গিয়েছে দিয়া।

–কি আশ্চর্য উনি ফোন ও পাঠিয়ে দিয়েছেন।

–বিভোর ভাই কে ডেকে বললাম,বিভোর ভাই রিয়া আজ খুজছিলো আপনাকে।

–রিয়ার নাম টা শুনেই চোখ মুখ ঝলমল করে উঠলো বিভোর ভাই এর।রিয়া তাকে খুজছিলো এটা যেনো বিশাল কোনো নিউজ তার কাছে।

–বিভোর ভাই আমাকে বললেন,কি বলেছে দিয়া,অনেক এক্সসাইটেড বিভোর ভাই।

–কিছুই বললো না,তবে আপনাকে না পেয়ে মন খারাপ করলো।

–বিভোর ভাই মাথায় হাত চালিয়ে বললেন,ওহ শীট।আজ ই আমাকে যশোর যেতে হলো।

–বিভোর ভাই দ্রুত গোসল করে আবার বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন আর আমাকে বলে গেলেন দিয়া তোর বোনের সাথে দেখা করে আসি।মামি ডেকে বললেন,এই বিভোর এত রাতে না খেয়ে আবার কোথায় ছুটলি।এই ছেলেটা সারাদিন বেড়িয়ে কি মন ভরে নি।

বিভা আপু বললো,আম্মু ছেলে বিয়ে দাও বাড়িতে থাকবে।বলেই হেসে দিলো।

–বিভোর ভাই এর গায়ে খয়েরী গেঞ্জি,পরনে সাদা গ্যাবাডিং থ্রি কোয়ার্টার। আমাদের বাড়ির পেছনে রিয়ার ঘরের জানালার পাশে গিয়ে রিয়াকে ক্রমাগত ফোন কল দিয়েই যাচ্ছে।

–রিয়া ফোন কানে নিয়ে বললো,এত রাতে ফোন দিচ্ছেন যে?

–এই রিয়া একবার জানালার কাছে এসো প্লিজ।

–কেনো?

–প্লিজ এসো।

–না আম্মু মাইন্ড করবে দেখে ফেললে।

–একবার এসো।
সারাদিন জার্নি করে মাত্রই এসে জাস্ট গোসল করে না খেয়ে এসেছি।একবার কি তোমার চাঁদমুখ দেখার সৌভাগ্য হবে।

–না খেয়ে এসেছেন কেনো?

–তোমাকে দেখবো বলে।কসম লাগে এসো।একবার দেখেই চলে যাবো।

–রিয়া ফোন কানে নিয়ে জানালার পাল্লা সরালো।

বিভোর ভাই এর হাতে একটা বেলুন সেখানে লেখা আই লাভ ইউ রিয়া।

–রিয়া একটা কেক এর প্যাকেট জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললো আমার সামনে দাঁড়িয়ে খান।আর এখন যান আম্মু এসে যাবে।দ্রুত বাসায় গিয়ে ভাত খেয়ে নিন।

–আসুক আগে মন ভরে দেখতে দাও তো।

–যান বলছি।

–আমাকে খুজেছিলে।সেই মুহুর্তে মনে হচ্ছিলো আমার কপাল এত খারাপ।আমাকে আজ ই যশোর যেতে হলো।

রিয়া হাতের চুড়ি উঁচু করে দেখালো রিনিঝিনি বেজে চলেছে রিয়ার চুড়ি।রিয়া গাল ভরে হাসছে।বিভোর মুগ্ধ হয়ে হাসি দেখছে।
বিভোর ভাই উনার গাছ থেকে নেওয়া একটা গোলাপ ছুড়ে মেরে ফ্লায়িং কিস ছুড়ে দিলো রিয়ার দিকে।রিয়া লজ্জা জানালা লাগিয়ে দিলো।

__________________________________–মামি আমার রুমে এসে বললেন,দিয়া বিহান আজ এত দেরি করছে কেনো মা।

–উনার নাকি বাইরে কি কাজ আছে বিভোর ভাই বললেন।

–রাত এগারো টা বাজতে গেলো।

–মামি তুমি ঘুনিয়ে পড়ো উনি আসলে আমি খাবার দিয়ে দিবো।

আজ প্রথমবার উনার জন্য নিজ হাতে রান্না করলাম।রান্না করার সময় অনেক কিছু ভেবে রেখেছিলাম। উনার মুখে কত প্রশংসা শুনবো কত কিছু ভেবে রাখলাম অথচ আজ ই উনি আসছেন না।উনি কি রেগে গিয়েছেন নাকি কষ্ট পেয়েছেন।
রাত ক্রমশ বেড়েই চলেছে অথচ উনি আসছেন না।আমি এদিক ওদিক পায়চারী করেই যাচ্ছি।বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাড়ির মেইন গেইটে নজর রেখেছি কখন আসবেন তার জন্য।রাত একটায় উনি বাসায় আসলেন।উঠানে দুই প্যান্টের পকেটে হাত গুজে গম্ভীর মুডে হেঁটে দো’তলায় প্রবেশ করলেন।আমি উনার সামনেই দাঁড়িয়ে কিন্তু আমাকে যেনো দেখেন ই নি উনি সেরকম একটা ভাব।সোজা রুমের ভেতরে প্রবেশ করলেন।আমি আর কিছুই বললাম না।উনাকে দেখেই আমি ডায়নিং থেকে খাবার গুলো নিজের রুমে নিতে শুরু করলাম।সব খাবার নিয়ে টেবিলে রাখলাম।উনি রুমে এসে গেঞ্জিটা খুলে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়লেন।সেইই যে গেলেন আর বেরোলেন না।ভেতরে পানির শব্দ হয়েই যাচ্ছে। দেড় ঘন্টা পরে বেরোলেন উনি।মুখশ্রী ভীষণ গম্ভীর হয়ে আছে।সাওয়ার তো এত লং টাইম উনি নেন না।দেড় ঘন্টা পরে ট্রাউজার আর সাদা গেঞ্জি পরে বাইরে বেরোলেন।আমি খাটের এক কোনায় মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছি কিছু বলার সাহস পাচ্ছি না।

চলবে,,

#এক_বৃষ্টিস্নাত_সন্ধ্যা(সিজন ২)
৩৬.
#WriterঃMousumi_Akter

–উনি ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে ল্যাপটপ টা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে ল্যাপটপের সাটার তুললেন।উনার টুইটারা একাউন্টে গিয়ে বিদেশি কারো সাথে চ্যাটিং করছেন মনে হয়।এদিক ওদিক কোনো খেয়াল নেই উনার।চোয়াল একদম ই শক্ত করে আছেন।চোখে মুখে ভীষণ গম্ভীর ভাব লেগে আছে উনার।পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপ দেখছেন উনি।চুল থেকে টুপটাপ করে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে।পুরা রুম যেনো গম্ভীর আর থমথমে হয়ে আছে।এখুনি মনে হয় ভীষণ কোনো তুফান শুরু হবে।হৃদপিন্ড ভীতস্হ ভাবে আছে উনার মুড দেখেই।থর থর করে যেনন আমি কাঁপছি তেমন হৃদপিন্ড ও কাঁপছে।ভুল যেহেতু করেছি উনার বকা ঝকা শুনি আর যায় করি কথা আমাকেই আগে বলতে হবে।উনি ইহ জীবনে আমি মরে গেলেও নিজ থেকে কথা বলবেন না।কারো প্রতি রেগে গেলে উনি তো আর তার সাথে কথায় বলেন না।আমাকে নিয়ে বাজে কথায় বলার জন্য নিজের মামা বাড়িতে ঝামেলা করে সেখানে বিগত ৫ বছরে একবার ও যান নি উনি।ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে টাওয়াল নিয়ে এগিয়ে গেলাম উনার চুলের পানি মুছে দেওয়ার জন্য।উনার কাছে যেতেই উনি ড্রেসিন টেবিল থেকে ফোন নিয়ে কোথাও ফোন দিয়ে রেগে রেগে কথা বলছেন।ওপাশের কথা শোনা যাচ্ছে না তবে উনার কথা শোনা যাচ্ছে।উনি ভয়ানক রকম রেগে কথা বলছেন,”আপনার সাথে আমার সমস্ত চুক্তি আমি ক্যান্সেল করছি।অনেস্ট পারসন ছাড়া আমি কাউকে কোনোরূপ কাজের সুযোগ দিবো না।আপনার মতো মিথ্যুক ক্লাইন্ট আমার না হলেও চলবে।জীবনে দুইটা জিনিস ভীষণ ঘৃণা করি আমি সেটা হলো মিথ্যা আর মানুষ ঠকানো।সো নেক্সট টাইম ডোন্ট কল মি এগেইন।”উনি ফোন টা কেটে দিয়ে বিছানায় খুব জোরে ফোন ছুড়ে মেরে আবার ল্যাপটপের দিকে মনোযোগ স্হির করলেন।আমি কাঁপাকাঁপা হাতে টাওয়ল টা উনার মাথায় দিতেই উনি প্রচন্ড অগ্নিচোখে আমার দিকে তাকালেন।রাগে কপালে ভাজ পড়ে গিয়েছে উনার,চোখ রক্তজবার ন্যায় হয়ে আছে।উনার তাকানো দেখে আমি খানিক টা কেঁপে উঠে দু’পা পেছনে গেলাম।উনি আবার চোয়ল শক্ত করে ল্যাপটপের দিকে মনোযোগ দিলেন।আমি আবার ভীত মনে দু’পা এগিয়ে গিয়ে আবার টাওয়াল মাথায় দিয়ে বললাম,খা”খাবেন না।অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।এত দেরী করলেন কেনো আজ।
উনি কোনো কথা না বলে রুমের বড় আলোর লাইট টা অফ করে ডিম লাইট অন করে বিছানায় এসে সুয়ে আমার বিপরিত দিকে কাত হয়ে ল্যাপটপ দেখছেন।উনার থেকে এক হাত দূরে ল্যাপটপ আর হাতের মধ্য মাউস।আমি আবার লাইট অন করে দিলাম।উনি বেশ বিরক্ত হয়ে উঠে বিছানায় পা মেলে বসে পায়ের উপর ল্যাপটপ রেখে দেখছেন।আমি খুব ভাল ভাবে বুঝতে পারলাম উনি আমাকে সম্পূর্ণ ভাবে ইগনোর করছেন এবং কথা বলতে চাইছেন না কোনভাবে।আমি আবার ও উনার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে টাওয়াল উনার মাথায় দিয়ে বললাম পানি পড়ছে চুল দিয়ে বিহান ভাই।স’স’সরি বিহান ভাই।উনি তাৎক্ষনিক প্রচন্ড জোরে ল্যাপটপের সাটার অফ করে দিয়ে আমার হাত প্রচন্ড জোরে চেপে ধরে বললেন,হাউ ডেয়ার ইউ টাস মি ড্যামেড।উনি এত জোরে হাত ধরেছেন এক্ষুনি মনে হয় ভেঙে যাবে।উনার রিয়্যাক্ট দেখে ভীষণ জোরে কেঁপে উঠলাম আমি।উনার মতো শক্ত পক্ত মানুষের চেপে ধরা হাত ভেঙে যাওয়ার থেকে কম কিছু নয়।ভয়ে আমার চোখে এমনি পানি চলে এলো।উনি আমার হাত ধরা অবস্থায় বিছানা ছেড়ে উঠে খুব জোরেই বললেন, ইন ফিউচার যদি আমাকে টাচ করা তো দূরের কথা আমার কোনো ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার বা আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে আমি কতটুক ভয়াবহ হবো ভাবতেও পারবি না লাইয়ার কোথাকার।গেট আউট আই সে গেট আউট হেয়ার।উনি আমার হাত ছেড়ে দিলেন ভীষণ জোরে ধাক্কা দিয়ে।রাগ উনি কাঁপছেন আর আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপছি।উনার রাগের মাত্র ক্রমস ই বাড়তে আছে।রেগে মাথার চুলে হাত চালাতে চালাতে এদিক ওদিক কিছু খুজছেন।তেমন কিছু না পেয়ে টেবিলের উপর রাখা প্লাসিকের জগ বারান্দায় ছুড়ে মারলেন।উনার যে এই মুহুর্তে পৃথিবীর সব লন্ডভন্ড করতে মন চাইছে সেটা আমি উনাকে রাগে হাঁপাতে দেখে বুঝতে পেরেছি।চোখ দিয়ে যেনো অগ্নি ঝরছে।

–আমার চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে।কি বলবো আর কিভাবে উনার রাগ কমবে সেটাই বুঝতে পারছি না।

–উনার চেচামেচিতে মামি নিচ তলা থেকে চলে এলো।মামি আমাকে কাঁদতে দেখে বুঝতে পারলেন আমাদের মাঝে কোনো ঝামেলা হয়েছে।ছেলের রাগের মাত্রা দেখে মামিও কিছু বললেন না।একবার উনার দিকে আরেক বার আমার দিকে তাকাচ্ছেন।বিহান ভাই মামিকে দেখে বেশ চেচিয়ে বললেন,আম্মু আমার কি এ বাড়িতে কোনো স্বাধীনতা নেই।কি সমস্যা আম্মু।আমি কি বেশী হয়ে গিয়েছি এ বাড়িতে।এ বাড়িতে আমার পজিসন টা কি অবহেলিত।আমার দিকে কারোর কোনো খেয়াল নেই।আমি প্রয়োজন মতো কিছুই পাচ্ছি না এ বাড়িতে।এত অবহেলার কারণ কি আম্মু।তুমি ভাল ভাবেই জানো আমি কারো অবহেলা সহ্য করতে পারিনা।আমাকে নিয়ে যদি খুব সমস্যা হয় তাহলে বলে দাও আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।

–মামি শান্ত ভাবে বললেন,মাথা ঠান্ডা কর বিহান।তুই ছাড়া আমাদের কে আছে দিয়ার ই বা আর কে আছে।খাবার গুলো পড়ে আছে এখনো খাস নি কেনো। দিয়া কাটা হাতে দুপুর থেকে কষ্ট করে তোর জন্য রান্না করেছে। ছোট মানুষ পারে না তাও করেছে।তবুও বলছিস তোকে আমরা অবহেলা করি।

–প্লিজ আমু দয়াকরে অন্য কারো গুনগান গাইতে এসো না। আমি তোমাদের ছেলে আমি না খেয়ে থাকলে তোমাদের খারাপ লাগলে যে পৃথিবীর সবার খারাপ লাগবে এটা কিভাবে ভাবতে পারো।আমি না খেয়ে থাকলে কি কারো খাওয়া পড়ে থাকবে প্রয়োজনে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে আসবে।আম্মু আমি ভীষণ ক্লান্ত,আমার খাওয়া নিয়ে তো ভাবা তুমি ছেড়েই দিয়েছো অন্তত আমাকে ঘুমোনোর ব্যাবস্হা টুকু করে দাও।যেখানে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবো আমি।আমি নিচে যাচ্ছি ঘুমোতে এ বাড়ির কেউ যেনো আমাকে ডিস্টার্ব করতে না যায়।কথা গুলো বলেই উনি নিচে চলে গেলেন উনার বালিশ নিয়ে।উনার রাগ আজ বেশী দেখে মামি আর খাওয়ার জন্য জোরাজোরি করলো না।উনি বেরিয়ে গেলে আমি বেশ সোরালো করে কেঁদে দিলাম।বুকের মাঝে ভীষণ চিন চিন ব্যাথা করছে।অজানা ভয় বাসা বেঁধেছে। উনি কি আর কোনদিন কথা বলবেন না আমার সাথে।পৃথিবীর কেউ পারবে না উনার মন গলাতে।এই জীবনে উনি হয়তো আর কোনদিন আমার সাথে কথা বলবেন না।উনি কথা না বললে আমি বেঁচে থাকবো কিভাবে।উনি আমার সাথে কথা না বললে আমি থাকবো কিভাবে।পৃথিবীর সব রঙ নিমিষেই বেরঙ হয়ে গেলো।সব কিছু ফ্যাকাসে হয়ে গেলো আমার কাছে।এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে এই পৃথিবী টা অসহ্যকর।ভালবাসার মানুষ রাগ করে কথা না বললে তার যন্ত্রণা যে এত তীব্র হতে পারে আমার কল্পনার বাইরে ছিলো। এত আসহায় লাগে নিজেকে।এত কষ্ট হয় তার এক সেকেন্ডের অনুপস্হিতিতে।পৃথিবীতে এত কঠিন যন্ত্রণা আছে আমি তো আগে উপলন্ধি করতে পারিঞ্জ সেটা।শুধু একবার উনি আমায় ক্ষমা করুক,রাগ কমাক আর কোনদিন উনার অবাধ্য হবো না।এই যন্ত্রণা টা আমি আর নিতে পারছি না।মামিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছি ভীষণ ভাবে।মামি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে বিছানায় বসিয়ে বললেন কি হয়েছে দিয়া।কি নিয়ে রাগ করেছে বিহান।

–মামি বিভা আপু আর দুলাভাই এর সাথে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম।তখন তোমার ছেলে মেসেজ করেছিলো রাস্তায় যাওয়ার জন্য।আমি ভেবেছি দুলাভাই এর ওখান থেকে উঠে চলে এলে দুকাভাই মাইন্ড করতে পারে পরে আবার বিভা আপুকে কথা শোনাতে পারে।বিভা আপু তো পরের বাড়িতে গিয়েছে তাকে যেনো এটা নিয়ে কটু কথা না শোনাতে পারে তাই মিথ্যা বলেছিলাম আমি অসুস্থ এখন বাইরে যেতে পারবো না।ভেবেছিলাম পরে উনাকে বুঝিয়ে বললে একটু বকবে কিন্ত রাগ করবে না।আমি মেসেজ করার পাঁচ মিনিট পরে উনি রেস্টুরেন্টে গিয়ে আমাকে দেখে ফেলেছেন।

–মামি আমাকে বললেন,বিহানের রাগারাগি দেখে তোর মামা আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে বলেছে ছেলে হঠাত রেগে গেলো কেনো?তুমি একটু বুঝাও গিয়ে।
শোন দিয়া তুই একটুও মন খারাপ করিস না মা।বিহান যেমন রাগি তেমন পানির মতো।আর বিহান তোর সাথে রাগ করে থাকতেই পারবে না তুই দেখে নিস।আসলে বিহান তোকে অনেক ভালবাসেতো তাই এমন করছে, ওর রাগ দেখে কি কিছুই বুঝিস নি।বিহান রেগে থাকার থেকে কষ্ট বেশী পেয়েছে পাগলি।আমার ছেলে তো আমি জানি, ওর চোখ দেখেই বুঝেছি।কাল সকালে দেখিস রাগ কমে যাবে।আয় তো আজ মা মেয়ে এক সাথে ঘুমোবো আর গল্প করবো।

–আমার কাঁন্না যেনো থামতেই চাইছে না।মামির পাশে সুয়ে পড়লাম।মামি আমাকে বিভিন্ন গল্প বলেই যাচ্ছে কিন্তু আমার মন বিহান ভাই এর দিকেই রয়েছে।এক সময় মামি ঘুমিয়ে পড়লো আমার জন্য পার হলো একটা নির্ঘুম রাত।উনি কি ঘুমিয়েছেন নাকি আমার মতোই না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন।

চলবে,,