#এক_মুঠো_কাঁচের_চুরি
#পর্ব_৪৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
চৈতালি আর তানহা থানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।একটু সকাল হবার কারনে,লোকজন খুব কম।চৈতালি তানহা’র হাত ধরে থানার ভেতরে গেল।
–স্যার আমরা ভেতরে আসতে পারি?বলল চৈতালি।
ফাইয়াজ রাফিনে’র সাথে দেখা করতে এসেছিল।চৈতালি’কে এত সকালে থানায় দেখে অবাক হলো।চৈতালি রুমের মধ্যে প্রবেশ করে বলল।
–স্যার আমার আপনাদের সাহায্য চাই।
–ভাবি আপনার মুখ এমন লাগছে কেনো?কোনো সমস্যা হয়েছে?বলল ফাইয়াজ।
–আপনি এত সকালে থানায় কি করছেন।বলল চৈতালি।
–আমি আজকে বাহিরে চলে যাব।তাই রাফিনে’র সাথে দেখা করতে এসেছি।ফাইয়াজে’র কথা শুনে,চৈতালি’র ভেতরে ধক করে উঠল।কিন্তু নিজের অনুভুতি’কে মাটি চাপা দিয়ে বলল।
–কাল থেকে ইফাদ ভাইয়া’র কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
–এসব কি বলছো?ভাইয়া’কে ফোন দাও নাই?
–দিয়েছি ভাইয়া’র ফোন বন্ধ।ভাবির অবস্থা খুব খারাপ।তাই পুলিশে’র সাহায্য নিতে এসেছি।
–তুমি চিন্তা করো না।রাফিন আমার ফ্রেন্ড হয়।তোমাদের যতদূর সাহায্য লাগে।রাফিন নিজের সবটুকু দিয়ে তোমাদের পাশে থাকার চেষ্টা করবে।
–আপনি আপনার বন্ধু’কে বলে,যদি একটু তাড়াতাড়ি ভাইয়া’কে খুঁজে বের করে দিতে পারেন।তাহলে সারাজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।
–চিন্তা করো না।আমি আছি।তোমার ভাইয়া’কে ঠিক খুঁজে বের করবো।তার আগে তোমাদের একটা মিসিং ডায়েরি করতে হবে।চৈতালি ফাইয়াজে’র কথা মতো সবকিছু পূর্ণ করল।
–চৈতালি চলো আমরা নিজেরা চেষ্টা করি।উনারা তো’ কোনো কাজই করছেন না।বলল তানহা।
–ভাবি আপনি একটু শান্ত হন।বললে-ই তো’ আর একটা নিখোঁজ মানুষ’কে খুঁজে বের করে নিয়ে আসা যায় না।ওরা ভাইয়া’র কল লিস্ট চেক করছে।ফাইয়াজে’র কথা মতো রাফিন নিজের কাজে লেগে পড়েছে।একটু পরে রাফিন এসে জানালো।ইফাদে’র ফোন কোথায় থেকে বন্ধ হয়েছে।
–আপনি যে,জায়গার নাম বলছেন।ওখানে ভাইয়া’র অফিস।চৈতালি’র কথা শুনে কেউ দেরি করল না।সবাই মিলে বেড়িয়ে পড়ল।
আজকে এক মাস পনেরো দিন কেটে গিয়েছে।পুলিশ এখনো ইফাদে’র খোঁজ দিতে পারে নাই।শহরের অলিতে-গলিতে,ইফাদ’কে খোঁজা হয়েছে।ফাইয়াজ নিজের সর্বস্ব দিয়ে চৈতালিদে’র সাহায্য করছে।বেশিরভাগ সময় চৈতালিদে’র সাথে থাকছে।বিনা স্বার্থে ক’জন মানুষ বিপদে’র সময় পাশে থাকে।ইফাদে’র চিন্তা করতে করতে,তানহা’র অবস্থা পাগল প্রায়।মেয়েটা’র দিকে তাকানো যাচ্ছে না।আজকে হঠাৎ করে-ই বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে।ফাইয়াজ বাসায় ডক্টর নিয়ে এসেছে।ডক্টর হাতে স্যালাইন করে দিয়ে,কিছু ঔষধ লিখে দিল।দিয়েই চলে গেল।এক হাতে স্যালাইন
,এক হাত কপালে,দু-চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।মেয়েটা’র অর্ধেক শরীর শুকিয়ে গিয়েছে।এভাবে চলতে থাকলে,মেয়েটা’কে আর বাঁচানো যাবে না।ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে না।চৈতালি এসে তানহা’র পাশে বসলো।চৈতালি’কে পাশে বসতে দেখে,তানহা মলিন মুখ করে বলল।
–উনার কোনো খোঁজ পেয়েছো চৈতালি?তানহা’র কথা শুনে,চৈতালি মাথা নিচু করে ফেলল।
–ভাবি আপনি চিন্তা করবেন না।আজকের মধ্যে ভাইয়া’র একটা খোঁজ পাওয়া’র আশা রাখা যায়।যারা ভাইয়া’কে ধরে নিয়ে গিয়েছে।তারা সবাই গভীর জলের মাছ।আমার মনে হয়।এর সাথে বড় বড় লোক জড়িত আছে।ফাইয়াজে’র কথা শুনে,সবাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
অন্ধকার রুমে বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে আছে ইফাদ’।শরীরে তৈরি হয়েছে হাজার রকমে’র আঘাতের চিহ্ন।শ্যামবর্নের পুরুষের শরীরটায় কালচে ভাব চলে এসেছে।চেহারায় মলিনতা বিদ্যামান।শরীর একদম শুকিয়ে গেছে।দেখলে যে,কারো আত্মা কেঁপে উঠবে’।অন্ধকার রুমে একরাশ আলো নিয়ে,প্রবেশ করল আবির।ইফাদ চোখ পিটপিট করে তাকালো।
–তা’ ইফাদ ভাইয়া।বলুন আপনার এক মাস পনেরো দিনের যাত্রা কেমন লাগলো।আমাকে মেরে ছিলেন না।বলে ছিলাম।এর প্রতিশোধ একটু একটু করে নিব।তিলে তিলে শেষ করে দিব।আবির তার কথা রেখেছে।আপনার দম আছে।মানতে হবে,এত মার খাওয়া’র পরে-ও বেঁচে আছেন।তানহা’র ভাগ্য আছে বলতে হবে।তানহা’র কথা শুনতেই ইফাদে’র বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল।ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল।
–আবির ভাই একবার তানহা’র সাথে কথা বলিয়ে দিবে।আমাকে তোমরা মেরে ফেলো।না হলে তানহা’র কাছে দিয়ে আসো।তাকে কাছে না পাওয়ার অসহ্য যন্ত্রনায় আমি হাজার বার মরে গিয়েছি।তানহা আমার চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে।আমি কথা দিচ্ছি।তোমাদের বিষয়ে একটা কথা-ও বলবো না।শুধু বলবো।আমি ভালো আছি।ঠিক আছি।ওর কণ্ঠস্বর একটু শুনতে চাই।আমার তোমার দুটো হাত ধরে বলছি।একটা বার কথা বলিয়ে দাও।
–একটা মেয়ে কতটা ভাগ্যবান হলে,এমন স্বামী পায়।আজকে তোমার জন্য মন থেকে ভালোবাসা আসছে।বিশ্বাস করো ইফাদ।আজকে আমি নিরুপায়।আমি চাইলে-ও তোমাকে সাহায্য করতে পারবো না।তুমি ওদের শর্তে রাজি হয়ে যাও।এখানে তুমি-ও বেঁচে যাবে।আর আমি’ও বেঁচে যাব।আমি যতদূর শুনেছি,তানহা তোমার চিন্তায় অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে।কথাটা শোনা মাত্রই ইফাদ কেমন জানি শান্ত হয়ে গেল।দু’টো বেড়ে অশ্রু কণা গুলো গড়িয়ে পড়ছে।একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল।
–বেশ তানহা’কে ফোন দাও।আর তোমাদের শর্তের কথা জানাও।আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারি।তানহা সবকিছু নিয়ে ছুটে চলে আসবে।
–এই তো’ সোজা পথে চলে এসেছো।তুমি অপেক্ষা করো।আমি ফোন নিয়ে আসছি।বলেই আবির বাহিরে চলে গেল।
তানহা’র স্যালাইন মাত্রই শেষ হয়েছে।ফাইয়াজ যত্ন সহকারে তানহা’র হাতের স্যালাইন খুলে দিয়েছে।রোকেয়া বেগম ফাইয়াজে’র উদ্দেশ্যে বলল।
–দেখো বাবা ফাইয়াজ।তুমি আমাদের সাহায্য করছো?এটা তোমার বাবা জানে?যদি না জেনে থাকে,তাহলে তুমি আর আমাদের সাহায্য করতে আসবে না।আমি চাই না।তোমার জন্য আমার পরিবারের ওপরে নতুন করে কোনো বিপদ আসুক।
–আম্মু তুমি উনার সাথে এমন করে কথা বলছো কেনো?উনি আমাদের কতটা সাহায্য করেছে জানো?
–তুই চুপ কর,কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে।সেটা তুই এখন আমাকে শিখিয়ে দিবি।
–আন্টি আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।আমার জন্য আপনাদের কোনো সমস্যা হবে না।ইফাদ ভাইয়া’কে খুঁজে পেলে-ই আমি বাহিরে চলে যাব।বলে এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না।দ্রুত গতিতে রুম ত্যাগ করল।চৈতালি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।রোকেয়া বেগম নিজের রুমে চলে গেল।
–চৈতালি তুমি নিজের রুমে যাও।আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
–সবাই’কে তাড়িয়ে দিয়ে,এখন কান্না করবে।আমি থাকতে তোমাকে কান্না করতে দিব না।তানহা রাগী কণ্ঠে বলল।
–আমি তোমাকে রুমে যেতে বলেছি।চৈতালি মাথা নিচু করে চলে গেল।চৈতালি চলে যাওয়া’র ত্রিশ মিনিট পরে,তানহা’র ফোনে ফোন এলো।তানহা তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করল।ওপাশ থেকে আবিরের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
–আমার কিউট বনুটা কেমন আছিস?তানহা কোনো কথা ছাড়াই কল কেটে দিল।আবিরের সাথে ফালতু কথা বলে,সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না।
–তোমার বউয়ে’র এত শিক্ষা হচ্ছে,তবু-ও তেজ কমছে না।দেখলে কেমন করে কল কেটে দিল।আমি পারবো না,তোমাকে সাহায্য করতে।
–তানহা একটু এমনই,একটু সহ্য করো।আর একবার ফোন দাও।
–ও হ্যালো আমি ইফাদ না।আমি আবির,কারো ভাব দেখার সময় নেই।ইফাদে’র আবির’কে জ্যান্ত পুতে ফেলতে ইচ্ছে করছে।তবু-ও নিজেকে দমিয়ে নিল।আবির’কে বুঝিয়ে রাজি করালো।আবির আবার কল দিল।দুইবার বেজে যাওয়ার পরে,তানহা বিরক্ত হয়ে ফোন তুলে বলল।
–কি হয়েছে সমস্যা কি?এভাবে রাত-বিরেতে অন্যের বউকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করছো কেনো?তানহা’র কণ্ঠস্বর শুনে,ইফাদ অদ্ভুত এক শান্তি অনুভব করল।ধীর কণ্ঠে বলল।
–তানহা আস্তে আমি ইফাদ’।অন্যের বউকে বিরক্ত করি নাই।আমি আমার বউকে-ই বিরক্ত করেছি।ইফাদে’র কণ্ঠস্বর শুনে,তানহা তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে হাতে ব্যথা পেয়ে কুঁকড়িয়ে উঠল।হাতের ব্যথাকে পাত্তা না দিয়ে, অস্থির হয়ে বলল।
–তুমি কোথাছিলে এতদিন।একবারো কি আমার কথা মনে হয় নাই।এতটা পাষাণ কেমনে হয়ে গেলে।তুমি ঠিক আছো।সুস্থ আছো।এই কয়টাদিন ঠিকমতো খাওয়া করছো?তুমি এতগুলো দিন কি করে আমাকে ছাড়া,পার করে দিলে,তোমার কোনো বিপদ হয় নাই তো’।তুমি কোথায় আছো।আমাকে বলো,আমি চৈতালি’কে সাথে নিয়ে,তোমার কাছে যাচ্ছি।ইফাদ কিছু বলতে যাবে।তার আগেই কেউ ইফাদে’র হাত থেকে ফোন নিয়ে নিল।আবিরের ফোনটা কানে ধরে বলল।
–ইফাদ অনেক ভালো আছে।খুব যত্ন সহকারে ইফাদ’কে রেখেছি।আমার কাছে ইফাদ কখনো খারাপ থাকতে পারে বলো।তানহা ধীর কণ্ঠে বলল।
–স্রুতি?
–তোমার মাথার ব্রেন খুব ভালো দেখছি।একদিন আমার কথা শুনেছিলে,এতদিন পরে-ও চিনতে পারলে।
–তুমি ইফাদ’কে কি করেছো?
–বেশি কিছু না।ইফাদ’কে বিয়ে করেছি।ইফাদ আর তোমার কাছে যাবে না।তুমি ইফাদে’র আশা ছেড়ে দাও।বলেই কল কেটে দিল।তানহা কেমন অস্থির হয়ে উঠল।চিন্তায় পুরো শরীর গরম হয়ে আসছে।তবে কি’ সত্যি-ই ইফাদ তাকে ছেড়ে চলে গেল।
আবির নিস্তব্ধ হয়ে ইফাদে’র মুখ ধরে রেখেছে।ইফাদ’কে সাহায্য করতে গিয়ে,নিজের চোখে নিজের মায়ের মৃত্যু তো’ আর দেখা যায় না।
–আমি জানতাম।তুমি ঠিক ইফাদ’কে সাহায্য করবে।হাজার হলে-ও ইফাদ তোমার বংশের মেয়ের জামাই।রক্তের একটা টান আছে না।আবির আগন্তুকে’র দিকে তেরে গেল।
–আপনার সাহস কি করে হয়?আমার আম্মু’কে এখানে নিয়ে আসার।
–তোমার সাহস কি করে হয়?আমার কাজে বাঁধা দেওয়া’র।
–দেখুন ইফাদ খুব ভালে ছেলে,এভাবে ইফাদ’কে কষ্ট দিয়ে কিছুই পাবেন না।বরং যার জিনিস তাকে দিয়ে,নিজের কাজ সফল করুন।
–কথাটা মন্দ বলোনি।
–আমি কিছুতে-ই ইফাদ’কে তানহা’র কাছে যেতে দিব না।ইফাদ শুধু আমার।বলল স্রুতি।
–নির্লজ্জ মেয়ে কথাকার বিবাহিত ছেলের পেছনে,ঘুরতে লজ্জা করে না।বলল আবির।
–দুলাভাই আপনি’ও বিবাহিত হয়ে,অন্য মেয়েদের সাথে কি করে বেড়িয়েছেন।সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।
–আমি তোমার মতো কারো সংসার ভাঙতে চাই নাই।কারো ক্ষতি-ও করি নাই।
–মন তো’ ভেঙেছেন।আবির রেগে স্রুতির গাল চেপে ধরলো।
–তুই যদি আর একবার আমার বোনের সংসার ভাঙার চেষ্টা করিস।তাহলে তোকে এখানে-ই শেষ করে দিব।তানহা’র সাথে অনেক অন্যায় করেছি।বাবা-মা মরা মেয়ের পানি অনেক ঝরিয়েছি।আর একটা অন্যায় করবো ওর সাথে,কিন্তু তানহা’র ভালোবাসার মানুষটা কে কেঁড়ে নিব না।মেয়েটা দিন শেষে শান্তিতে থাকতে পারে।সেই ব্যবস্থা-ই করবো।বলে-ই তানহা’র নাম্বারে মেসেজ করল।আবিরের নাম্বার থেকে মেসেজ পেয়ে,
তানহা একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে,কাউকে কিছু না বলে বেড়িয়ে গেল।চৈতালি জেগেই ছিল।রান্না ঘরে আসছিল এক কাপ চা তৈরি করার জন্য,তানহা’কে বেড়িয়ে যেতে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।নিজে-ও তানহা’র পেছনে ছুটলো।
–আবির স্রুতিকে ছেড়ে দাও।না হলে তোমার আম্মুর মাথায় গু*লি* করে দিব।
–আপনারা কতটা নিচে নেমে গিয়েছেন।আমার ভাবতে-ও ঘৃণা হচ্ছে,আবির নিজের ভুলটা ঠিকি বুঝলি।এখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে বাবা।বলল হাসনা বেগম।মায়ের কথা শুনে,আবিরের মাথা নিচু হয়ে আসলো।স্রুতি দ্রুত গতিতে ইফাদে’র হাত পায়ের বাঁধন খুলতে লাগলো।
চলবে…..