#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম
পর্ব ৪
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
আর্শিকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেওয়ার পর এষ যেনো অন্য দুনিয়ায় চলে গিয়েছিলো। নিজেকে হারাতে বসেছিলো আর্শির মাঝে। জড়িয়ে ধরে সে নিজের অজান্তেই আর্শির কাঁধে নাক ডুবিয়ে দিয়েছিলো। আর্শির শরীরের গন্ধে তার নেশা ধরে গিয়েছিলো। প্রেমিক পুরুষ তার প্রেমিকার প্রতি এভাবেই আকর্ষিত হয়, তা এষেরও জানা ছিলো না। তবে হঠাৎ ই শুনতে পেলো,
” ছাড়, আমাকে ছাড়, এই আমাকে ছাড় নাহ! আরেহ! আরেহ!..ছাড় না ! ছাড় বলছি!”
যদিও আর্শির শরীরের জোড় এষের কাছে হেরে যাচ্ছিলো তবে এমনটা শোনার পর এষ দ্রুতবেগে আর্শিকে ছেড়ে দেয়।
” স্যরি, স্যরি…যেভাবে হাত ধরে টান দিলি, আর জানিস ই তো, তোর প্রতি আমার দুর্বলতা! নিজেকে সরাতে পারছিলাম নাহ!”
আর্শি ক্রোধান্বিত স্বরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” আমি কি চশমা ছাড়া কিছু স্পষ্ট দেখি? আমি ভেবেছিলাম, মা, তাই তোর হাত ধরি, কিন্তু তুই কাছে আসার পর পারফিউমের গন্ধেই টের পেলাম, এটা তুই রাসকেল!
মা কোথায়, মা?”
এষ থমথমে মুখে বললো,
” এখানেই তো ছিলো, মনে হয় ওয়াশরুমে গিয়েছে। এই নে তোর চশমা”
বলেই আর্শির চশমাটা এগিয়ে দিলো। আর্শি চশমাটা পড়তেই এষ বলে উঠলো,
” এখন কেমন লাগছে রে তোর?”
আর্শি বিরক্ত স্বরে বললো,
” অনেক ভালো লাগছে! ঢের ভালো! আমার কি কিছু হয়েছিলো নাকি? তবে শরীর টা এত দুর্বল লাগছে!”
এষ আর্শির বেডেই বসে রইলো, ওর দিকে গাঢ় দৃষ্টি রেখে হাসিমুখে বললো,
” না না! তোর কিচ্ছু হয়নি, সামান্য একটু নার্ভাস ফেইলিয়র ছাড়া আর কিছুই না!”
এষ এমনিভাবে আর্শিকে কথাটা বললো, সত্যি যেনো ওর কিছুই হয়নি।
আর্শি একটা বালিশে হেলান দিয়ে নিজেকে আর আশপাশ দেখতে দেখতে প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করা শুরু করলো এষকে,
” তাহলে আমি এখানে কেনো? এটা তো হসপিটালের বেড দেখা যাচ্ছে? আর তুই কি সারা রাত আমার এই রুমেই ছিলি? আচ্ছা, তুই শর্ট প্যান্ট পড়ে আছিস কেনো? তুই আমার কিছু করিস নি তো? তোর তো আবার নজর খারাপ আছে, খারাপ দৃষ্টিতে দেখিস তুই আমাকে? চুপ কেনো তুই, তুই কি করেছিস আমাকে? আমার চুল, কাপড় চোপড় সব এলোমেলো কেনো? আমি কিন্তু মা কে ডাকবো,, মাম্মি.. মাম্মি..”
আর্শির এতসব কথায় এষ হাস্যোজ্জ্বল মুখে যেনো ভাটা পড়লো,
” সারা রাত যার জন্য জাগলো, সে এখন এসব বলছে? সে কি সামান্যও বোঝে না তার এহেম পাগলামী?”
মা মা ডাক শুনে অপরাজিতা ওয়াশ রুম থেকে বের হলো।
” আমার আর্শি সোনামনি জেগেছে, ও আমার সোনা মা”
বলে আর্শিকে জড়িয়ে ধরলো অপরাজিতা
” মা! আমার নাকি নার্ভাস ফেইলিয়র হয়েছিলো, আর তুমি এটা করো কি? সব জায়গায় এই উল্লুটাকে নিয়ে আসো কেনো মা?”
এষকে দেখিয়ে বললো, আর্শি।
অপরাজিতা গম্ভীর মহিলা। আর্শির এসব বকবকানির উত্তর না দিয়ে এষের দিকে নির্দেশ করে দৃঢ় বাক্যে বললেন,
” কজ, হি ওয়ান্টস টু ম্যারি ইউ!”
আর্শি ব্যঙ্গ করে বললো,
” বললেই হলো, হি ওয়ান্টস টু ম্যারি… ওকে কে বিয়ে করবে, আমি? নেভার! ওকে আমার ছেলেই মনে হয়না কখনো। আমি ওকে বিয়ে করতে পারবো না!”
এষ বলতেই যাচ্ছিলো, ” তাহলে কি মনে হয়, মে য়ে? খুলে দেখাবো নাকি?” কিন্তু ফুপিকে সে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে, তাই সে নিজেকে সংবরণ করলো।
অপরাজিতা কথা বাড়ালো না। সে শুধু বললো,
” আর্শি ইউ নিড রেস্ট, ডোন্ট টক মোর, ডক্টর তোমাকে একটু কম কথা বলতে বলেছেন! ওয়েট আমি একটু আসছি! ”
বলে অপরাজিতা কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো।
আর্শি চুপ গেলো। এষ আর্শির হাতে এক গ্লাস পানি তুলে দিয়ে পান করতে বললো।
অপরাজিতা ডক্তর বসাককে কল দিলো। ডক্টর বসাক দেশের একজন প্রথম সারীর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও ট্রমা থেরাপিস্ট। হাতে গোনা কয়েকজন পুরাতন রোগী ছাড়া তিনি রোগী দেখেন না। বি এস এম এম ইউ এর একজন এসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে তিনি পি এইচ ডি স্টুডেন্ট দের ক্লাশ নেন ও নতুন ডক্টরদের ট্রেইনিং দিয়ে থাকেন। তার কোনো অতিরিক্ত সময় নেই। তবে অপরাজিতার সাথে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। যেকোনো সময় অপরাজিতার জন্য তিনি প্রস্তুত।
আগের রাতে আর্শিকে দেখে গেলেও এবার আর তার পক্ষে আসা সম্ভব না। তাই ডক্তর বসাক ফোনেই অপরাজিতাকে আর্শির বর্তমান অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। ঘুম ভেঙ্গে আর্শি ভীষনই স্বাভাবিক আচরন করছে শুনে তিনি খুশি হলেন।
অপরাজিতা উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ” ও আর প্রহ নামক একজনের কথা আর বলছে না, হয়তো সে ওর স্বপ্নের কথা আবার ভুলে গিয়েছে!
ডক্টর বসাক প্রসন্ন চিত্তে বললেন, ” নাইস টু লিসেন ইউ! মাই মেডিসিন ইজ ওয়ার্কিং মিসেস অপরাজিতা! ”
অপরাজিতা ডক্তরকে ধন্যবাদ জানালেন।
তিনি আর্শিকে বাসায় নিয়ে যেতে পরামর্শ দিলেন। আর আর্শিকে কোনোক্রমেই উত্তেজিত করা যাবে না, এমনটা বলে দিলেন। কিছুদিন সময় লাগলেও আর্শি অতীতের খারাপ স্মৃতিগুলো যে ভুলে যাবে তিনি সে আশ্বাস দিলেন। তবে স্বপ্নের উপর কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তা ও তিনি স্পষ্ট করেই বললেন।
.
.
” দেখেছিস, নিহু, কাকতালীয় ভাবে বিধাতা তোর আর আমার নামটা পর্যন্ত মিলিয়ে দিয়েছেন!”
ফোনের অপর প্রান্ত হতে নেহাল বলে উঠলো নিহুকে হাস্যরসাত্মক স্বরে।
নিহু ভাবলেশহীন!
” আচ্ছা, আমি এত ভালোবাসি বলেই তোর এত কেয়ার করি! তুই কি একটুও বুঝিস না আমার ভালোবাসা? এতই কি অখাদ্য আমার ভালোবাসা? এই যে কান ধরে তোর সামনে প্রায়ই উঠবস করি, যদি কোনোদিন কোনো একটু ভুল হয়, আবার একশ বার করে স্যরি তো রোজই বলি, কোনো দোষ না করেই, যখন খুশি ডাকলেই চলে আসি পোষা কুকুরের মতো, আবার যদি বলিস পাঁচতলা হতে লাফ দিয়ে পড়ে যা নিচে, তাও আমি রাজী, তার পরো তোর মন ভরেনা! আর কি করতে হবে আমাকে তুই ই বলে দে! ”
নেহাল তার মনের সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়ে এ কথাটা বললেও নিহু ভাবলেশহীন ভাবে শুধু শুনছে।
তবে হঠাৎ চটাং চটাঙ্গ করে সে বলে গেলো,
” আচ্ছা, আমি না বুঝিনা, তুই কোথা থেকে এত সাহস পাস যে, মানুষকে বলে বেড়াস, আমি নাকি তোর বউ! আচ্ছা কবে বিয়ে হলো আমাদের? তোর কি এমনটা মনে পড়ে যে আমরা কোনোদিন একান্তে মিলিত হয়েছিলাম?… তাও নয়। ক্রাউডি রেস্টুরেন্ট বা ক্রাউডি পার্কে আমরা বেশ কয়েকবার ডেইট করেছিলাম মাত্র, তবে আমাকে কি কখনো তুই একটা প্যাশন্যাট কিস ও কি তোকে আমি করতে দিয়েছিলাম? তুই ই বল?”
নেহাল ক্ষাণিকক্ষণ চুপ থেকে নিহুকে বলল,
” না, তা হয়নি কোনোদিন আমাদের মধ্যে। তুই হয়তো আমাকে সিরিয়াসনি নিসনি কখনো তাই এত ক্লোজলি আমাকে এলাউ করিস নি, আর আমি তোকে বেশি সিরিয়াসলি নিয়েছি বলে সুযোগ পাওয়া স্বত্ত্বেও এত ক্লোজ আমি হইনি কোনোদিন, পাছে না আবার আমাকে লুজ ক্যারেক্টার বা বদ ছেলে বলে দূরে চলে যাস! আমি সত্যি অনেক ভয়ে থাকি তোকে নিয়ে, একচুয়ালি এটা হলো তোকে হারাবার ভয়, তোকে যদি কোনোক্রমে হারিয়ে ফেলি, তাহলে আমি মরেই যাবো রে!”
নিহু ক্রোধান্বিত হয়ে বললো,
” আমি তোকে কবে সুযোগ দিয়েছিলাম? নেভার! ”
নেহাল বললো,
” কেনো, তোর বাসায় একবার কেউ ছিলো না, সে রাতে আমি যাইনি তোর বাসায়? আমার কাছে এখনো ওসবের স্ক্রিন শট আর ভয়েস ম্যাসেজ গুলো স্টিল নাউ আছে!”
নেহালের বলা এ কথার বিপরীতে নিহু আর কথা খূঁজে পেলো না কাউন্টার করার মতো। কারন দু বছরের রিলেশনে সে এক রাতে নেহালকে তার নির্জন বাসায় আমন্ত্রন জানিয়েছিলো। কিন্তু নেহাল শুধুমাত্র কয়েকটা শুকনো চুমু খেয়ে স্থানত্যাগ করেছিলো সে রাতে। নিহু এভাবে ওকে ছেড়ে যাওয়াতে নিহু ভীষণই আহত হয়েছিলো, কিন্তু নেহাল আদর্শবান বলেই এত একা পাওয়া স্বত্ত্বেও কোনো সুযোগই নেয়নি। তবে নেহাল এত চালাক হলো কবে যে ওসবের স্ক্রিন শট রেখে দিয়েছে।
তবে যা নিহু মনে মনে রেখেছে তা হলো, নিহু নেহাল কে শুধু টাইম পাস করার একজন হিসেবে নিয়েছে। বিয়ে করে পার্মানেন্ট লাইফ পার্টনার হিসেবে সে নেহালকে কোনোভাবেই পছন্দ করে না। এদিকে নেহাল নিহুর ফ্রেন্ড সার্কেল অর্থাৎ আর্শি, পূর্ণ, আরাধ্যা ও অগ্রকে বলে বেড়িয়েছে সে নাকি নিহুকে বিয়ে করেছে! এটা শোনার পর থেকেই নিহু ও নেহালের মধ্যে বিচ্ছদের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। কিন্তু নেহাল তো নিহুকে সবকিছু উজাড় করেই ভালোবেসেছে।
কি সে কারন যেজন্য নিহুর নেহালকে মেনে নিতে এত আপত্তি তা নেহালের জানা নেই।
কয়েক দিন ধরেই নিহুর এরকম ছাড় ছাড় ভাব নেহালকে ভীষণই পীড়া দিচ্ছে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো, পরের দিন ক্যাম্পাসে গিয়ে সে একথা বলার জন্য সবার সামনে নিহুর কাছে ক্ষমা চাইবে। তাও যদি নিহু ক্ষমা না করে তবে সবার সামনেই প’য়জন পান করবে!
(চলবে)