এক মুঠো বুনোপ্রেম পর্ব-১০

0
9

#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম

পর্ব ১০

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

ডক্টর লিওয়ের চেম্বারে মিসেস অপরাজিতা।

ঢাকা সিটির এক অভিজাত এলাকার পনের তলা বিল্ডিং এর টপ ফ্লোরে ডক্টর লিওয়ের চেম্বার। ডক্টর লিও আন্তর্জাতিক মানের একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সুতরাং তার চেম্বার যেমন সাজানো গুছানো হওয়া উচিত এটা তেমনি। চারজন সহকারী ও তিনজন কম্পাউন্ডার তার সাথে। তার সাথে তাকে সাহায্য করার জন্য একজন সহকারী মহিলা ডাক্টার ও আছেন। একটা সুবিশাল কক্ষের ভেতরে আরামদায়ক সয্যাশন, বিরাট মিউজিক সিস্টেম আর সুশৃঙ্খল ভাবে সাজানো বহু নাম না জানা বস্তু।

অপরাজিতাকে এক কাপ গ্রিন টি পরিবেশন করে লিওয়ের একজন সহকারী স্থান ত্যাগ করলো।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে লিও অপরাজিতাকে সুধালো,

” মিসেস অপরাজিতা, আপনি তো এক ফরেন এফেয়ার্স সেক্রেটারি?”

অপরাজিতা হেসে বললো,
” জ্বী, আমি এখন একজন সিনিয়র সেক্রেটারি, আমি ফরেন মিনিস্টারের পার্সোনাল স্টাফ ও ছিলাম কয়েক বছর, তবে একমাত্র আর্শির জন্য বহু লোভনীয় পদও ছেড়ে দিয়েছি। ইচ্ছে করলে এখনো আমি এবরোড কান্ট্রিতে জব করতে পারতাম, কিন্তু আর্শি সাথে আমার সবকিছু এদেশেই, সেজন্য আমি এদেশেই রয়েছি!”

লিও মাথা নেড়ে একটা শ্বাস নিয়ে বললো,

” ও আই সি! আপনি জানেন যে আমার একটু সময়ের স্বল্পতা আছে, মে আই নো ডিটেইল এবাউট ইউ এন্ড ইউর ডটার আর্শি?”

অপরাজিতা মৃদু হেসে বললো,

” ইয়েস অব কোর্স!”

” তার আগে আপনি একটু ইজি হয়ে নিবেন মিসেস অপরাজিতা? ঐ যে ওখানে আমাদের একটা ইজি চেয়ার আছে, আপনি কাইন্ডলি ওখানটায় হেলান দিয়ে বসুন আর পেট পর্যন্ত দ্বীর্ঘ শ্বাস টেনে আবার লম্বা সময় ব্যাপী ছেড়ে দিয়ে নিজেকে হালকা করে নিন, আর না পারলে ঐ স্ক্রিনে পদ্ধতিটা দেখুন। ”

অপরাজিতা হেলান দিয়ে বসলো। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিলো একটা নারী অবয়ব দ্বীর্ঘ শ্বাস প্রস্বাস নিচ্ছে আর ছাড়ছে। অপরাজিতা সেটা অনুসরন করলো। লিওয়ের মুখ ব্যতিত গোটা কক্ষের আলো হালকা হয়ে এলো। অপরাজিতা সেদিকে তাকালো। তার কাছে লিওকে অনেক বন্ধুসুলভ কাউকে মনে হলো, যার উপর আশ্বাস রাখা যায়, বিশ্বাস রাখা যায় আর ভরসা ভরে যাকে সব কথাই বলা যায়।

লিউ পুনরায় বললো,

” দেখুন মিসেস অপরাজিতা, আপনার মেয়ের ফুল ট্রিটমেন্ট করার জন্য ওর সকল ব্যাকগ্রাউন্ড ও স্টোরি জানা অত্যন্ত প্রয়োজন।

অপরাজিতা মুখে মৃদু হাসি বজায় রেখে মনে তবুও ক্ষাণিকটা দ্বীধা আর ক্ষানিকটা ভয় নিয়ে তার অতীত জীবনের সবটা বলা শুরু করলো ধীরে ধীরে,

” আজ থেকে বিশ বছর আগের কথা। আমি তখন মাত্র গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করেছি। আমরা তখন স্বপরিবারে আমাদের বনানীর বাড়িতে থাকি। বাবা মা, বড় দুই ভাই ও আমি। বড় দুই ভাইয়ের স্ত্রী রা ও ছিলো। তবে আমার অমতে বাবা এক জায়গায় আমাকে বিয়ে দিতে চায় বলে আমি রাগ করে বাড়ি ত্যাগ করি, আর ভার্সিটির হলে গিয়ে উঠি। ছোটো থেকেই আমার একটা ধারণা ছিলো যে, বিয়ে করা মানেই বোধহয় পুরুষের কর্তৃত্ত্ব স্বীকার করে নেওয়া। আমার এরকম ধারণার কারণ ছিলো আমাদের পরিবারও পুরুষ প্রধান ছিলো, আর পুরুষরা নারীদেরকে বেশ ভালোভাবেই ডমিনেট করতো। সেজন্যই মূলত আমি বিয়ের প্রতি অনিহা পোষণ করি। যেহেতু ছোটোকাল থেকেই আমি বেশ জেঁদি আর একগুঁয়ে ছিলাম। নিজেকে নিজে একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেই যে, নিজেই চাকুরী করে সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট হবো, আর যে করেই হোক বিয়ে আমি করবো না কোনোদিন। এই থেকে শুরু, আমার জীবন যুদ্ধ। শুরু করলাম চাকরির পরীক্ষা দেওয়া।

আর্শির বাবার সাথে আমার প্রথম দেখা পরীক্ষার হলেই। প্রথম বার বিসিএস পরীক্ষা দিতে গিয়েই আমার তার সাথে দেখা হয়েছে। বিসিএস এর রিটেন চলছিলো। একশ নাম্বারের আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি পরীক্ষার দিন আমি যার পর নাই হতাশ ছিলাম। কারন আগের রাতে হলে রাজনৈতিক গন্ডগোলের কারনে আমি কিছুই পড়তে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিষয় ছিলো পদার্থ বিদ্যা, আর পদার্থ বিদ্যার ছাত্রী হয়ে আমি কিভাবে বিশ্ব ইতিহাস আর চলমান বিশ্ব পরিস্থিতি এতো ভালোভাবে জানবো? পরীক্ষার হলে আতঙ্কে আমার হাত পা হিম হয়ে আসছিলো আর আমার পাশে যার সিট পড়েছিলো সে দেখি একদম কুল মাইন্ডে গান গাইছে। তার নাম ধাম কিছুই জানি না, আর না জানি তার কোনো পরিচয়। তাকে দেখেই স্বাভাবিকভাবে আমার খুবই হিংসে হয়, কারন আগের পরীক্ষার দিনও তাকে আমি খেয়াল করেছিলাম, একদম কুল মাইন্ডে প্রচুর লিখেছিলো সে, দূর থেকে একবার তার কলম, হাত আর খাতার দিকে তাকিয়েও ছিলাম, বেশ সুন্দর হাতের লিখা তার, একদম যেনো মানুষ নয়, কোনো যন্ত্র লিখছে। কিন্তু তার চেহারার দিকে কেনো জানি আমি একবারো ভালো করে তাকাইনি। আর আমাদের যামানায় মেয়েরা ছেলেদের দিকে বা ছেলেরা মেয়েদের দিকে ততটা তাকাতো না, এখন যেমন ফ্রি মিক্সিং চলে ভার্সিটি গুলোতে। তখন সেসব ছিলো না, তখন ছেলে মেয়ে কথা বললেই জরিমানা গুনতে হতো ভার্সিটি গুলোতে। তবে ভালোভাবে না তাকিয়েও এটা আমার কাছে ক্লিয়ার ছিলো যে, সে একজন লম্বাদেহি এবং গায়ের রং অনেক ফর্সা আর চেহারাটায় একটু আদিবাসিদের কাট রয়েছে। বেশি ফর্সা ছেলে আমার একদম দুচোখের বি’ষ, তাই তার দিকে তেমনভাবে তাকাইনি। তবে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি পরীক্ষার দিন সে ই আমাকে তার দিকে ডাকলো।

আমি প্রথম কোনো ছেলের ডাকে এভাবে সাড়া দিলাম।

সে আমাকে বললো, ” এত ভয় পাচ্ছো কেনো অপরাজিতা?”

আমি তার মুখে নিজের নাম শুনে আঁতকে উঠলাম।

সে তারপর আমাকে বললো, ” ডোন্ট ওরি! তুমি ইচ্ছে করলে আমার টা দেখে লিখতে পারো!”

তখন আমার মনে হচ্ছিলো যেনো, জান বাঁচানো ফরজ। আর চাকরিটা আমাকে পেতেই হবে। তাই তারটা দেখে লিখা শুরু করলাম।

আমি অবাক হলাম, বেঞ্চের এক পার্শে আমি আর আরেক পার্শে সে হওয়া স্বত্তেও আমি তার লেখাগুলো স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। সে এক বিশেষ পদ্ধতিতে সবকিছু লিখছিলো। এত সুন্দর করে তথ্যবহুল প্রশ্নের উত্তর আমি নিজে জীবনেও কোনো পরীক্ষায় লিখিনি। আমার তারটা দেখে সব লিখে একবার মনে হচ্ছিলো নিজের প্রতি অবিচার করছি, আরেকবার মনে হচ্ছিলো, তার প্রতি অবিচার করছি। ও যে কি লেভেলের স্টুডেন্ট তা আমার তখনি বোধগম্য হচ্ছিলো না।
পরীক্ষা শেষ করে হলের বাইরে বেরিয়ে তাকে একটা কৃতজ্ঞতাস্বরুপ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলাম। তখনি প্রথম আমি তার দিকে তাকালাম। মোটেও ভালো লাগেনি তার চেহারা আমার সেদিন! আশ্চর্যজনক ভাবে সে আমাকে বলে দিলো যে আমি নাকি ক্যাডার হবোই হবো।
সে পর্যন্তই!

তার কথাই সত্যি হলো। ফরেন এফেয়ার্সে সে যামানায় দেশের মাত্র দশ জন ব্যক্তিকে ফরেন এফেয়ার্স সচিব পদে নিয়োগ করা হতো। আর আমি ছিলাম সেই দশজনের একজন। নিজেকে অবিশ্বাস মনে হচ্ছিলো। তবে কেনো জানি সেই লিস্টে আমি তাকেও আশা করেছিলাম। কিন্তু নাহ? সেখানে সে ছিলো না।

তারপর অনেকদিন তার সাথে আমার দেখা হয়নি। চাকরি হওয়ার পর মা বাবার সাথে আর সব ঝামেলা মিটে যায়, এবং প্রথম পাঁচ বছর দেশে চাকরি করার পর ফরেন মিনিস্ট্রির নিয়ম অনুযায়ী আমার বিদেশে পোস্টিং হয়। প্রথমে আমার পোস্টিং হয় দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে। সিউলে বাংলাদেশি দূতাবাসে আমি কূটনৈতিক মিশনে ছিলাম। ওখানে গিয়েই আবার আমার ওর সাথে দেখা হয়। আমি অবাক হই, সে আমাকে প্রথম দেখাতেই চিনতে পারে।

“অপরাজিতা কি বলেছিলাম না?” এরকম একটা লাইন বলে সে আমার নিকটে আসে।
কতক্ষন কুশল বিনিময়ের পর আমি জানতে পারি, সে আসলে বাংলাদেশ আর কোরিয়ার দ্বৈত নাগরিক। তার বাবা কোরিয়ার আর মা বাংলাদেশি। মা বাবার বিচ্ছেদের পর মা কে দেখতে প্রায়ই সে বাংলাদেশে যায়। এবার সে একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলো যে, বাংলাদেশি সিভিল সার্ভিসে সে পরীক্ষা দেবে। এবং সে তাই ই করে। তবে রিটেনে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েও সে ভাইবা দেয় না, কারন সে নাকি নিজেকে যাচাই করছিলো। এবং সে দক্ষিণ কোরিয়াতে একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে। এভাবেই তার সাথে আমার একটা ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। ”
এটুকু বলেই অপরাজিতার গলা ধরে আসে। সে কাশতে থাকে। লিও তাকে এক মগ পানি এগিয়ে দেয়। লাইটগুলো অন হয়।

এটুকু শুনে লিও অপরাজিতা কে বলে উঠে প্লিজ ক্যারি অন মিসেস অপরাজিতা। অপরাজিতা চোখ মুছে আবার বলা শুরু করলো।

” এ দুনিয়াতে আমি বহু মেধাবীকে দেখেছি, কিন্তু আরশের ন্যায় মেধাবী আমি আর কাউকে দেখিনি। সে নিজের মেধার ব্যাপারে দারুন উদাসীন ছিলো। কখনো নিজের মেধাকে সর্বোচ্চ সম্মান বয়ে নিয়ে আসার অভিলাস তার ছিলো না। তাইতো কোরিয়ার সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায়ও উর্ত্তীণ হওয়া স্বত্তেও সে চাকরিতে যোগদান করেনি। আই ওয়াজ সামথিং লাইক সেপিওসে’ক্সুয়াল। মানে আমাকে কোনো পুরুষ কোনোদিন তার রুপ দিয়ে আকৃষ্ট করতে পারেনি, তার মেধা আমাকে টানতো। আর আরশের এধরনের স্বভাব আমাকে আকৃষ্ট করেছে। যেখানে আমি কোনোদিন বিয়ে করবোনা বলে ঠিক করেছিলাম সেখানে আমি তাকে নিজেই আগ বাড়িয়ে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে দেই।”

অপরাজিতা এটুকু বলেই তার উড়না দিয়ে চোখের পানি মুছলেন।

তারপর আবার নিজেই বলা শুরু করলেন।

” আমি আরশকে প্রেমের প্রস্তাব দেই, কিন্তু সে রাজী হয়না। সে আমাকে জানিয়ে দেয় যে, সে ডিভোর্সড। কিন্তু আমি তার প্রেমে এতটাই অন্ধ হয়ে যাই যে, তাকে সিডিউস করা শুরু করি। সে সাথে এও বলে তার একটা পাঁচ বছর বয়স্কা মেয়ে আছে, তার পরো আমি রাজী হয়ে যাই। আমি তখন এত বাজেভাবে আরশের প্রেমে পড়েছিলাম যে, একথা বলতে লজ্জা করিনা যে, তাকে নানা ফন্দি ফিকির করে প্রেমের ফাঁদে ফেলি। আমার বাবা মা দেশেই ছিলো আর আমার আর আরশের বিয়ে কোরিয়াতে হয়। আমি কাউকেই আমার বিয়ের ব্যাপারে জানাইনি। বিয়ের পর আমি আরশ আর আর্শি বেশ কিছুদিন ভালোই ছিলাম। তারপর বছর দুই বাদে আমি আবার এদেশে চলে আসি, যেহেতু আমার আবার দেশেই পোস্টিং হয়। দেশে আসার পরই ঘটনার শুরু। আরশের প্রথম স্ত্রী এসে আর্শিকে নিয়ে যায়। সে নিজের কাছে নিয়ে আর্শিকে বহুদিন রেখে দেয়। এদিকে আমি ততদিনে আর্শিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আর্শিকে ছাড়া আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। আর ওদিকে আরশের প্রথম স্ত্রী আর্শিকে নিজের কাছে রেখে তার এক আত্মিয়র সাথে আর্শিকে বিয়ে দিয়ে দেয়। আর আর্শি নিজের সেই বিয়ের ঘটনাই প্রায় সময় স্বপ্নে দেখে থাকে। কিন্তু ঘুমের মধ্যে ছাড়া স্বপ্ন ছাড়া সে আর পূর্বের কিছুই মনে করতে পারে না।

অপরাজিতা এটুকু বলেই থামলো।

(চলবে)