এক মুঠো বুনোপ্রেম পর্ব-১৯+২০

0
11

#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম

পর্ব ১৯

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে এসে নিজের বেডরুমে আর্শি ধুম মাচিয়ে দিচ্ছে। এষকে বের করে সে দরজা ভেতর থেকে লক করে দিয়েছিলো অনেক আগেই। আর্শির চোখ মুখে খুশির চ্ছটা জ্বাজল্যমান। তার আলমিরার সবচেয়ে গর্জিয়াস পোশাক টা বের করে পড়ে নিলো। চোখের চশমাটা খুলে একটা লেন্স পড়ে নিলো। আর শেষে ধুম ধারাক্কা মেইক আপ করে সে এষকে হাঁক ছাড়লো।

” এষ, এষ, হারি আপ, এদিকে আয়..”

কিন্তু গানের শব্দে ওসব এষের কানে গেলো না।

ওদিকে এষ রুকাইয়া খালার সাথে কিচেনে কিছু বলার জন্য উদগ্রীব।

আর্শি দু চার বার এষকে ডেকে পুনরায় দরজা আরকে বরং এষকে ডাকা বন্ধ করে অপরাজিতাকে কল করা শুরু করলো। কারন আশচর্য হলেও সত্য তার একটা বি এম ডাব্লিও বাইক চাই ই চাই!
.
.

নেহালের জন্য কান্না করার ফলে এষের চোখমুখ লাল হয়ে আছে, আর অন্যদিকে আর্শির জন্য উদ্বেগে মুখ পাংশু বর্ন ধারণ করেছে। আর এখন রুকাইয়ার সম্বোধনে লজ্জায় আর কি বর্ণই বা ধারণ করবে? মাঝে মধ্যে রুকাইয়ার সাথে কথা হলে সে তাকে জামাই বলেই ডাকে। কারন অপরাজিতা একদিন আলাপ করেছিলো তার সাথে, ” মেয়ে জামাই যদি করি তবে আমার ভাইপো এষকেই করবো, ছেলেটা যতখানি ভালোবাসে আমার মেয়েকে ততটা আর কেউই বাসতে পারবে না!”

রুকাইয়া খালাকে কিভাবে প্রশ্ন করবে সে, তার আগামাথা কিছুই পাচ্ছিলো না।

তারপরো জিজ্ঞেস করে বসলো,

” খালা, আর্শিকে আজ খেয়াল করেছেন? ও একদম অন্যরকম আচরন করছে!”

রুকাইয়া বলে উঠলো,

” কেন? আপনেরে চিনতেছে না?”

” না! চিনছে না, সেরকম নয়, তবে এমন ভাব করছে যেনো, ও এক অন্য মানুষ, আর আমি… ”

রুকাইয়া উদ্বীগ্ন বদনে বলে উঠলো,

” শোনেন আব্বা, আপনেরা শিক্ষিত মানুষ, আমার মতো কাঙ্গালের কথা শুনবেন ক্যান? আমি অপরাজিতা ম্যাডামরে বহুতবার কইছি যে, আপনের মাইয়ারে কিন্তুক জ্বিনে পাইছে, ডাক্তার না দেখাইয়া একবার হুজুরের কাছে যান, ঠিক ভালা হইয়া যাইবো, কিন্তুক ম্যাডাম জীবনেও কানে তুলে নাই আমার কথা, জানেন না জামাই, আপনি তো আম্রিকা ছিলেন গত পাঁচ বছর, এখন না সাত/আটমাস থাইকা এই দেশে, আপনি তো দেখেন নাই, আর্শি মাইয়ারে প্রত্যেক বছর একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই জ্বীন আইসা জাঁইক্কা ধরে। এই সময় ঐ জ্বীন যা কয় আর্শি মাইয়া তাই ই করে, আর যা না করা কয় তা করে না, অপরাজিতা ম্যাডাম খালি ঐ ডাক্তার বসাকের দ্বারে যায়, কেন একটা ভালা কবিরাজ দেখাইয়া মাইয়াডারে ভালা করবার পায় না? এই ভাবে মাইয়াডার জীবন নষ্ট করনের কোন মানে হয়!”

রুকাইয়ার কথা শুনে এষের কপালের চিন্তার ভাঁজ আরো স্পষ্ট হলো। মনে উদ্বেগান্বিত প্রশ্নের উদয় হলো,

” এখন এই অবস্থায় আর্শিকে রেখে সে কিভাবে যাবে নেহালকে শেষবারের মতো একবার দেখার জন্য?”

কিন্তু নেহালের পা টলছে। আরাধ্যা এষকে বেশ কয়েকবার কল করে জানিয়েছে যে, জুম্মা নামাজের পরপরই নেহালের জানাজা।

এষ ভেবে চিন্তে এযাবতকাল সে যা কাউকে জিজ্ঞেস করেনি, আজ সে তা রুকাইয়াকে জিজ্ঞেস করলো।

” খালা? আর্শিকে কি কোনোদিন অন্য কোনো ছেলের সাথে দেখছিলেন?”

” না, তো জামাই? তুমি কি মাইয়াডারে সন্দেহ করো?”

এষ বিব্রত হয়ে গেলো। আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসে কুলালো না তার।

অগ্যতা সে রুকাইয়া খালাকে আর্শিকে দেখার জন্য ভালোভাবে বলে কয়ে বের হয়ে গেলো নেহালের শেষকৃত্যে।

.
.

অপরাজিতার মিটিং শেষ হয়েছে সবে।

ফোনের লক খুলে দ্রুত সে তার প্রাণপ্রিয় মেয়ে আর্শিকে কল দিলো।

মাই গড! আর্শির পঁয়ত্রিশ টা কল তার ফোনে।

অপরাজিতার চোখ কপালে উঠে গেলো।

এত বার কল দিয়েছে মেয়ে তার! তখন কল করে কি জানি কি বলছিলো? কি সব বি এম ডাব্লিও! অপরাজিতা কল রিসিভ করেছিলো বটে! তবে বৈঠক এ বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে “টু ন্যাশন প্যাক্ট” নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো বলে সে শুধু কল রিসিভ করে কিছু না শোনেই আবার কয়েক সেকেন্ড পরেই কেটে দিয়েছিলো। তাই আর্শির কথা সে পুরোবাক্যই শুনতে পারেনি। শুধু বি এম ডাব্লিও কথাটা শুনেছে।

অপরাজিতা দ্রুত কল ব্যাক করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
‘ দ্যা নাম্বার ইউ হ্যাভ কলড, ইজ নাউ আনরিচ এবল”

অপরাজিতার হাত পা কাঁপছে, এত বার আর্শি কেনো কল দেবে? এষ সাথে থাকতেও কি বিপদ হলো? গোটা বাড়িতে সিকিউরিটির কোনো কমতি নেই, তবে কি যা সে আশঙ্কা করছে সেটাই ঘটেছে সেখানে?

অপরাজিতা এষকে কল দিলো।

কিন্তু এষও কল রিসিভ করছে না।

অপরাজিতার মাথা, কপাল আর চিবুক ঘাম ছেড়ে দিলো। হাত পা এখনো কাঁপছে ভয়ে। হাজারটা প্রশ্ন এসে মাথায় ভীড় করলো। আর হাজারটা দুশ্চিন্তা ও অপরাধবোধ।

সে চলে আসার পর এষ কি তবে আর্শিকে নিয়ম করে ঔষধ খাওয়ায়নি? হায় হায়! ব্যস্ততায় এ ও জিজ্ঞেস করাও হয়নি এষকে! অথচ ঔষধগুলো এতটাই ইমার্জেন্সি যে, একরাতে ঔষধ না খেলেই সে উল্টাপাল্টা স্বপ্নে দেখে সাথে আর যা যা করে তা বলার যোগ্য নয়! অপরাজিতা খেয়াল করলো এষের সাথে সে শুধু ফাইলের বিষয়েই কথা বলেছে, তবে আর্শির বিষয়ে একবারো প্রশ্ন করেনি। এত চরম বেখেয়ালি মা সে হলো কিভাবে?

অসুস্থ মেয়ের জন্য চিন্তা করে এজন্যই চাকরিটা সে বাদ দিতে চেয়েছিলো কয়েকবার। কিন্তু সরকারি চাকরি বিশেষ করে ক্যাডার সার্ভিস এমনই জিনিস; কেউ যদি চাকরি ছেড়ে দিতেও চায়, চাকরি তাকে ছাড়ে না। চাকরি করতে চাইলে ভালো মা হওয়া যায় না আর যে ভালো মা হতে চায় তার চাকরি করা উচিত নয়।

অপরাজিতার মনে পড়ে গেল, প্রায় প্রতিবছরই এমন দিনে মানে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে মানে শরৎকালে আর্শির আলঝেইমার এর লক্ষন গুলো আরো প্রকটভাবে প্রকাশ পায়। তখন সে এলোমেলো কথাবার্তা বলে। অসলগ্ন আচরণ করে। একবার বছর বাড়ি থেকে পালিয়েও যায়। সে তার নিজের মায়ের সকল স্মৃতি ভুলে গেলেও এমন সময় আর্শির তার( আসল মায়ের) স্মৃতিগুলোও মনে পড়ে। সবচেয়ে বড় কথা এই সময় আর্শির তার ছোটোবেলার ভালোবাসা প্রহের কথা মনে পড়ে!

এসব ভাবতে ভাবতেই অপরাজিতা আর্শিকে কল করেই যাচ্ছে। তবে আর্শির ফোন তোলার কোনো বালাই ই নেই। স্তস্ত্র হাতে সে এবার কল লাগালো রুকাইয়াকে। অপরাজিতার মাথায় এতক্ষণ এটা আসেনি যে, তার রুকাইয়াকেই প্রথমে কল করা উচিত ছিলো।

রুকাইয়া কল রিসিভ করেই ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠলো৷

” ম্যাডাম, আর্শি মামনিকে আবার মনে হয় জ্বীনে পাইছে”

এটা শুনে অপরাজিতার রক্ত যেনো হীম হয়ে গেলো।

সে তিরতির করে কাঁপা কন্ঠে সুধালো,

” আর্শি কোথায়?”

রুকাইয়া ডুকরে কেঁদে বলে উঠলো,

” বাড়ি থেকে বের হইয়া গেছে, গাড়ি ছাড়াই, সে তো ঢাকার রাস্তাঘাট কিছুই চিনে না, সব ভুইলা ভাইলা যায়। আমাকে বলছে যে ভার্সিটিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ নোট আছে, সেটা আনতে যাবে। আমি ড্রাইভারকে কল করে বললাম, ড্রাইভার বললো, সে নাকি বাসার নিচেই আছে, কিন্তু মামনী গাড়িতে না উঠেই অন্যদিকে দৌড়ে চলে গেছে। ”

অপরাজিতার যেনো ব্রেইন স্টোক করলো।

সে ফ্লোরে ধপাস করে বসে পড়লো।

তার সহকারীরা এসে তাকে টেনে ধরলো।

অপরাজিতাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো।

.
.

নেহালের জানাজায় দাঁড়িয়েছে এষ। পকেটে রাখা ফোন যে অনবরত কেঁপেই যাচ্ছে, সেদিকে তার নজর নাই। নেহালের না পাওয়ার কষ্টটাকে একবার নিজেকে অনুভব করাতে চাইলো এষ। সত্যিই তো! এ কষ্ট মেনে নেওয়ার নয়। নেহালের স্থানে সে নিজেকে প্রতিস্থাপন করে দেখলো, নেহালের মতো তার জীবনে ঘটলে সে ও সু’ইসাইড ই করে নিতো!

বনানী কবরস্থানে দাফন শেষ করার পর এষ তার নিজের ফোনে হাত দিলো।

রুকাইয়া খালা ও অপরাজিতা ফুপি অসংখ্য বার কল করেছে।

কিন্তু রুকাইয়ার কল টা চলমান, সেটা রিসিভ করতেই রুকাইয়ার ক্রন্দনরত কন্ঠ,

” জামাই বাবা, মামনী আমারে মিথ্যা বইলা বাসা থেইকা একা একা বাইর হইয়া গেছে, ড্রাইভাররেও নেয় নাই, ফোনডাও নেয় নাই, ম্যাডামরে জানাইলে ম্যাডামও অসুস্থ হইয়া পড়ছে।”

এষের পা যেনো মাটিতে ঢুকে গেলো। আর্শির মতো ভীতু মেয়ে একা একা কোথায় গেলো?

( চলবে)

#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম

পর্ব ২০

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

বিদেশের মাটিতে বসে দেশে কণ্যা হারিয়ে যাওয়ার খবর কতটা ভয়ানক হতে পারে, তা কেউ অপরাজিতাকে দেখলেই বলতে পারে।

অপরাজিতা যেনো উন্মাদ বনে গেছে। ঘন্টাখানেক আগেই যে তার মূল্যবান স্পিচ সুনিপুন ভাবে পরিবেশন করছিলো, আর গোটা কনফারেন্সের মানুষ তা শুনছিলো, এখন তার ক্রন্দনে ফাটছে সর্বত্র।

” আমার মেয়ে কিচ্ছু চেনে না ঢাকা শহরের , ও এক আলঝেইমার এর পেইসেন্ট, আমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে, ও আর ফিরবে না..প্লিজ হেল্প মি… তোমরা আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দাও…”

অপরাজিতার এহেন অবস্থা দেখে তার অন্যান্য কলিগরা ফরেন মিনিষ্ট্রি থেকে দেশে খবর পাঠালো কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। দ্রুতই ফোর্স পাঠানো হবে, আর্শিকে খুঁজে বের করার জন্য। আর যে করেই হোক তাকে সহিহ্ সালামতে যেনো বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয় সেকথা স্বয়ং ফরেন মিনিস্টার অর্ডার করলেন কল করে।

এদিকে অন্যান্য কূটনীতিক কলিগ ও উচ্চপদস্থরা মিলে অপরাজিতাকে আশ্বস্ত করলো,

” ম্যাডাম অপরাজিতা, প্লিজ কিপ পেইসেন্ট, আপনার মেয়েকে ঠিকই খুঁজে বের করা হবে আর আমরা আপনাকে ইমার্জেন্সি দেশে পাঠানোর ব্যবস্থাও করছি। ওভার অল ফ্যামিলি উইল বি প্রায়োরিটাইজ দ্যান সার্ভিস, সো প্লিজ ডোন্ট ওরি!”

অপরাজিতা এসব কথায় ক্ষাণিক আস্বস্ত হলো বটে কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার যেনো তান্ডব বয়ে চলছিলো তার।

.
.

এদিকে এষ রুকাইয়া খালার কল পেয়ে দ্রুতগতিতে ফিরে এলো। আর্শিকে না পেয়ে সেও যেনো পাগল বনে যাওয়ার উপক্রম।

গাড়ি নিয়ে বের হলো এষ। বাসার এদিক সেদিক খোঁজা শুরু করলো হন্যে হয়ে। কারন থানায় গিয়ে জিডি করিয়েও কোন লাভ নেই। কারন এদেশের নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি নিঁখোজ হওয়ার চব্বিশ ঘন্টা পার হয়ে গেলেই কেবল পুলিশ ইনভেস্টিগেশন তথা খোঁজাখুঁজি শুরু করতে পারে, আর আর্শি তো হারিয়েছে সবে এক ঘন্টাও হয়নি।

দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে এষ রামপুরা লেকের সামনে মাথায় হাত দিয়ে ধপাস করে বসে পড়লো। এই তিন কোটি জনসং্খ্যার ঢাকা শহরে সে আর্শিকে কোথায় খুঁজে পাবে?
হন্যে হয়ে সে ট্রাফিক পুলিশ ও দোকানদার ও মানুষজনদের জিজ্ঞেস করতে লাগলো। মত্ত উন্মদের ন্যায় প্রলাপ বকতে লাগলো। এমনকি আর্শির বিভিন্ন বন্ধুদের কল দিতে লাগলো। কিন্তু কেউ আর্শির কোনো খবরই জানে না। এই ঢাকা শহরে অপরাজিতার আর কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। দুই ভাই তাদের ছেলে মেয়ে নিয়ে স্বপরিবারে আমেরিকাই থাকে। তাহলে এষ কোনো আত্মীয়র বাসায় আর কল দেবে?

এষের মনে হচ্ছিলো মাথার উপরে আকাশ নেই, আর পায়ের নিচে জমি নেই।
বিশেষ কারন তো এটাই যে, আর্শির কোনো কিছুই মনে থাকে না। এমনও তো হতে আর্শি যেখানে গিয়েছে সেখানে গিয়ে ভুলেই গিয়েছে যে সে কে? তার নিজের নাম কি? তাহলে কি হবে? এটা ভেবেই এষের দুচোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়াতে লাগলো। মনে মনে এটাও ভেবে নিলো,

আর্শিকে না পেলে নিজের কোনো একটা ক্ষতি সে করে বসবে নেহালের মতোই।

এমন সময় অচেনা এক নাম্বার থেকে কল এলো,

“হ্যালো স্যার, আমি ইন্সপেক্টর আরমান বলছি, রামপুরা থানার ওসি। স্যার আর্শিকে আমরা খোঁজাখুঁজি শুরু করেছি! ”

এষ বিস্মিত হয়ে সুধালো,

” বাট হাউ?”

অফিসার আরমান বলে চললো,

” অপরাজিতার হয়ে মাননীয় ফরেন মিনিস্টারের কল পেয়ে নিয়মের তোয়াক্কা না করেই আর্শিকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে ডি এম পি পুলিশ। সো প্লিজ স্যার, আতংকিত হবেন না, দয়া করে বাসায় আসুন স্যার, আমরা বাসাটায় তল্লাসী চালাবো, যদি আর্শি চলে যাওয়ার আগে কোনো এভিডেন্স বা ক্লু রেখে যায়, তাহলে তাকে খুঁজে পাওয়া সুবিধা হবে! ”

আর্শি ফোন রেখে যায়নি বরং নিয়েই গিয়েছে। সে বিছানার উপর তার নোটপ্যাড ছিলো, যা রুকাইয়া খালা দেখে ভেবেছিলো যে ফোন। তবে নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। তবুও পুলিশ নোটপ্যাড টাকেই ফরেনসিকের জন্য নিয়ে গেলো।

আর্শি চলে যাওয়ার আগে কোনো নোট লিখে গিয়েছিলো কিনা তা খুঁজে বের করার জন্য ইনভেস্টিগেটর টিম নেমে গেলো। এমনকি আর্শির শোয়ার ঘরে তারা তল্লাশি শুরু করলো।

এষ উদ্বিগ্ন বদনে সবটা দেখছিলো।
আর্শির ডায়রিটার কথা এষ ততক্ষণে ভুলেই গিয়েছিলো। ক্ষণিকের জন্য সম্বিত ফিরতেই আবার তার ডায়রিটার কথা মনে পড়লো। তাই পুলিশ সদস্যদের চোখ এড়িয়ে এষ দ্রুত চলে গেলো নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষে। তার লাগেজ খুলে সেটা বের করে নিয়ে কক্ষের এক কোণে গিয়ে বসে পড়লো।

শুকনো ঠোঁটগুলোতে তার বিষাদের জায়গায় যোগ হলো কৌতুহল। আর আর্শির সবকিছু জানার বিশাল আগ্রহ! নিজেকে অনেক ছোটো মনে হলো এষের। এই মেয়েটাকে সে শুধু ভালোবেসেই গেছে। কিন্তু মেয়েটার সম্পর্কে সে কিছুই জানে না! সে তাই একবার ডায়রিটা নিয়ে পড়া শুরু করলো আবার।

এষ পৃষ্ঠা উল্টালো।
আগের পৃষ্ঠার পরের পৃষ্ঠা।

“বাংলাদেশে এসেছি দু বছর হয়ে গেলো। আমি, বাবা, মা, দাদা, দাদী সবাই এসেছি একসঙ্গে। দাদী বলেন, এ দু বছরে আমাদের সাথে যা যা ঘটেছে, তা নাকি গত বিশ বছরেও ঘটে নি। অন্যদিকে আমার বয়স দশ ছেড়ে এগোরো পড়লো। আমি কি আর এতকিছু জানি? তবে ভাবি, কোরিয়ার মতো এত প্রাচুর্যের দেশ রেখে দাদা দাদী বাবা মা সবাই বাংলাদেশে চলে এলো কেনো? বাংলাদেশে কি আছে? এদেশের বৃষ্টির পরে ভেঁজা মাটির সেঁদো গন্ধ নাকি দাদার খুব ভালো লাগে। আর ভালো লাগে হেমন্তে নতুন কাঁচা ধানের গন্ধ, যে ধান ফুলগুলোর পরাগায়নের জন্য ভীড় জোগায় হাজার হাজার পামরি পোকা। ঐ গন্ধে নাকি এক ধরনের মাদকতা আছে। দাদা এদেশের না হয়েও এ দেশের প্রতি তার টান দেখে আমি অবাক হই। আমার দাদা একজন কোরিয়ার নাগরিক। তিনি প্রথম জীবনে বাংলাদেশে এসেছিলেন তার চাকরির সুবাদে। এখানে এসে সে এক বাঙ্গালী রমনী তথা আমার দাদীর প্রেমে পড়েন। প্রেম মানে তো প্রেম নয়, সে যেনো ছিলো এক অথৈ সাগর। সেই অথৈ প্রেম সাগরে হাবুডুবু খেয়ে দাদা দাদীকে আপন করে নেওয়ার উদ্দ্যেশ্যেই এদেশে তার খুঁটি গাড়েন। কিন্তু তার সে খুঁটিকে উঠাতে বাধ্য করে কোরিয়ার সরকার। দাদার যেহেতু সরকারি চাকুরি ছিলো সেহেতু, কোরিয়ার সরকারের নির্দেশে তাকে আবার নিজ দেশে ফিরে যেতে হয়, কিন্তু তিনি একা যান নি, সঙ্গী হিসেবে নিয়ে যান তার কচি বাঙ্গালী নববধূকে। বাবার জন্ম হয় তাদের বিয়ের বহু বছর পর অর্থাৎ প্রায় ত্রিশ বছর পর। এত বছর পর অর্জিত আত্মজকে তারা তাই প্রাণাধিক ভালোবাসতেন। তাড়াতাড়ি বিয়ে করিয়ে দেন আমার বাবাকে। আমার জন্মের পরই আমি আমার দাদা দাদীকে বয়োবৃদ্ধ দেখি। যাই হোক, সরকারি চাকরি হতে অবসর পাওয়া মাত্রই দাদার আবার বাংলাদেশ প্রীতি জাগে। আর দাদী তো সেই কবে থেকেই নিজের দেশের বিরহে দিনাতিপাত করছিলেন।
তাই দাদা দাদী এতদিনে বাংলাদেশে স্থায়ী আসন গেড়েছেন। আর তাদের এই স্থায়ী আসন গাড়তে সাহায্য করেন আমার সেই নতুন মাম্মী তথা অপরাজিতা। যিনি আমার জন্য সব করতে রাজী। এত ভালোবাসা আমি আমার স্টেপ মমের কাছ থেকে পাবো তা জীবনেও ভাবতে পারিনি। তবে নিজের মায়ের থেকে ভালোবাসা পাইনি বলে আমার আক্ষেপ একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই বোঝেন। আমার মা বাঙ্গালী। সাধা সিধা বাঙ্গালী নারীর এত বিরল রোগ আছে, তা দেখলে বোঝাই যায় না। আসলে আমার মায়ের একটা বিরল ব্রেইন ডিজিজ আছে, তাই সে পাগলা গারদে রয়েছে, একথা মুখে বলতে আমার যেমন বুক ফেটে যায়, লিখতেও আমি মুষড়ে পড়ছি। নিজের মায়ের এমন হাল দেখে আমার ভীষণই কষ্ট হয়। তবে মা কে দেখতে এতো স্বাভাবিক লাগে যে, মনেই হয় না মা অসুস্থ্য। ডক্টর বলেছে মায়ের মা’র্ডার করারও টেন্ডেন্সি আছে। মানে মাথায় রাগ চড়ে গেলে সে মানুষও খু’ন করে ফেলতে পারে সে। তবে আমি ছোটো বলে দাদা দাদী ওসব বিষয় আমার সামনে ডিসকাস করেনা কখনো। তবে আমি সবটা জানি। আমি মূলত এ কারনেই ইন্ট্রোভার্ট, কাউকে নিজের কথা যখন বলতে পারি না তখন এতো এক্সট্রোভার্ট হয়ে কি লাভ? তবে প্রহ আমাকে বুঝে। নারায়নগঞ্জের এই গ্রামে স্থায়ী হওয়ার পর আমার এক বন্ধু হয়েছে, তার নাম প্রহ। প্রহ এ এলাকার সবচেয়ে স্বনামধন্য পরিবারের ছেলে। সে এত ইন্টিলিজেন্ট যে, চোখ বন্ধ করেই সে রুবিকস কিউব মিলিয়ে ফেলে। আমরা একবার সবাই চোখ বেঁধে ইতল বিতল খেলছিলাম, তখন সে চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায়ই আমার শরীরের ঘ্রাণ শুঁকেই আমার নাম বলে দিতে পেরেছিলো। আমি এক কথায় প্রহের প্রতি ফিদা! ওকে আমার এত্তো ভালোলাগে কেনো তা জানি না। ওকে আমার সর্বোজ্ঞ মনে হয় কখনো আবার কখনো অন্তর্জামি। তবে প্রহ অনেক মজা করে। তার মতে লাইফ টা অনেক ছোটো, এত মুখগুমড়ো করেই কি লাভ? তাই আমি প্রহের সামনে সবসময় হাসিমুখেই থাকি! শুরুতে বাংলাদেশ আমার ভালো লাগে নি, তবে এখন ভালোলাগার একটা কারন আমিও পেয়ে গেছি, আর তা হলো প্রহ। আমরা রোজ সকাল, বিকাল খেলে বেড়াই, এলাকা দাপিয়ে বেড়াই। প্রহ জোন ভিত্তিক গণিত অলিম্পিয়াডেও প্রথম হয়েছিলো। আমি প্রহের মধ্যে আমার বাবাকে খুঁজে পাই। বাবাও জিনিয়াস, আর প্রহও জিনিয়াস। আর আমি অন্তর্মুখী হলেও, প্রহ আমার চোখ দেখেই সব বলে দিতে পারে। আমি বুঝি না সে কি জি এস পি কিংবা থার্ড আই এর অধিকারী নাকি?

এ পর্যন্ত পড়েই থামলো এষ।

ওসি আরমান তাকে ডাকছে।

(চলবে)