এক মুঠো বুনোপ্রেম পর্ব-২৩+২৪

0
9

#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম

পর্ব ২৩

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

“নানাবাড়ি গিয়ে দেখি, সেখানে কি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে!”
এ পর্যন্ত পড়েই আর্শির ডায়রিটা বন্ধ করে এষ থামলো। দ্বীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে আর্শিকে এক পলক দেখার জন্য আর্শির বেডরুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমের গেইটে হাত রাখতেই বুঝে যে, আজ আর্শি গেইট লক করে ঘুমিয়েছে। এত রাতে ঘুমন্ত প্রেমিকাকে দেখাটাকে আর্শি সমীচীন বলে মনে করেনা বলেই কি আজ লক করেছে? কে জানে? আর্শি হয়তো তাকে আর বিশ্বাসই করেনা! আর্শির ইচ্ছের বিরুদ্ধে এষের কোনো ইচ্ছা নেই। সে ঘুমানোর আগে সকল ঔষধ পত্র নিজের হাতে খাইয়ে চলে গিয়েছিলো। আর আর্শি নিজেই গেইট লক করে ঘুমিয়ে গিয়েছে।
বাসার সকল কাজের লোকজন ঘুমাচ্ছে।
তবে রুকাইয়ার রুমে আলো জ্বলছে। কিছুক্ষণ পর পর এসে আর্শিকে দেখে যাচ্ছে সে। রুমের দরজা বন্ধ থাকায় সে দরজাটাই পরখ করে যাচ্ছে। তার মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। যদি আর্শি আবার পালিয়ে যায়?

আর্শি হারিয়ে যাওয়ার পর রুকাইয়া মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্নাকাটিও করেছে। কাঁদতে কাঁদতে পুলিশের সামনে সে বয়ান দিয়েছে, “আর্শি এর আগে আরো কয়েক বার এ বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো। তবে তখন এত খোঁজাখুঁজি করতে হয়নি। আবার নিজে নিজেই ফিরে এসে বলেছে, তার নাকি কিচ্ছু মনে নাই তখনকার কথা। কিভাবে বাসা থেকে বের হয়েছে, আর কোথায়ই বা গিয়েছিলো তা ও মনে নেই। পরে যখন সব মনে পড়েছিলো মানুষকে বাসার ঠিকানা বলে কয়ে পুনরায় বাসায় ফিরে এসেছে। একবার তো বাসার ঠিকানাও মনে ছিলো না, শুধু মনে ছিলো তার মা অপরাজিতা ফরেন মিনিস্ট্রির একজন সিনিয়র সচিব, আর সেই সূত্র ধরেই মানুষ তাকে অপরাজিতার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলো। ভাগ্য ভালো ছিলো বলে কোনো বারই সে খারাপ কোনো মানুষের হাতে পড়েনি। ”
এষ এসব কিছুই জানতো না। রুকাইয়া যখন কথাগুলো বলছিলো, তখন শুনে জেনেছে সে। সে তো গত পাঁচ বছর আমেরিকাতেই ছিলো।

দেশে এসেছে তো সবে সাত মাস পার হয়ে আট মাস হলো। আর এই আট মাস তো সেই আর্শির পেছন পেছন ঘুরেছে, ছায়ার মতো। কখনো ভার্সিটির ক্লাশরুম, কখনো ক্যাফেটেরিয়া, আবার কখনো বন্ধুদের সাথে রেস্টুরেন্টের আড্ডায়, সব জায়গায় আর্শির লেঙ্গুরের মতো আর্শির পেছন পেছন। সর্বত্রই এষ আর্শিকে চোখে চোখে রেখেছে, তবে আর্শির অগোচরে। আর রাতের বেলায় চুপিচুপি আর্শির ব্যাল্কনিতে ঘুমিয়েছে, আর্শিকে দেখার নেশায়। এষ নিজেকে বহুবারই ধিক্কার দিয়েছে, এভাবে প্রেমে পড়ার জন্য। কেউ এভাবে প্রেমে পড়ে নিজের সুন্দর ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ উপেক্ষা করে উন্মাদের মতো পেছন পেছন ছুটে?

এষ তার ফোন বের করে আর্শির ফোন থেকে টুকে নেওয়া নাম্বারটা ডায়াল করলো। এষের বুক কাঁপছে। কে এই ব্যক্তি?

নাম্বারটার কোড দেখে মনে হচ্ছে নাম্বারটা ইউরোপের দেশ কানাড়ার। আর ওসি আরমানও বলেছিলো আর্শি কানাড়ায় অবস্থিত কারো সাথে কথা বলেছে।

আর আর্শির ফোনের সিমটাও সে চেইঞ্জ করে নিয়েছিলো। নতুন সিমের খোসা সে ভুলে ঘরেই ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলো বলে পুলিশ তার নাম্বার পেয়ে তাকে ট্র‍্যাক করতে পেরেছিলো।

এষ তার কাঁপা হাতেই আর দুরুদুরু করা বুকেই কল দিলো। মনে মনে জপতে লাগলো, ” এটাই কি সেই প্রহের নাম্বার? আর্শির কি আবার তাকে মনে পড়েছিলো?”

কয়েকবার রিং হয়ে কেউ ফোনটা পিক করলো।

এক নারী কন্ঠ শুনে এষ খট করে কলটা কেটে দিলো।

কে এই নারী? হারিয়ে যাওয়ার পর কাকে আর্শি কল দিয়েছিলো এত বার? নারী পাশে এক পুরুষ কন্ঠও শোনা যাচ্ছিলো। এষ কান পাতলো, তবে কিছু শুনতে পেলো না!

এষের ভাবনার দুয়ারে এক ধরণের শঙ্কাও কড়া নাড়তে লাগলো।

রাতটা পার হতে পারলেই যেনো এষ বাঁচে। আগামীকাল ভোরেই ডক্টর লিও এ বাসায় আসবে। লিও আর্শির এ কেসের ব্যাপারে বেশ কৌতুহলী বলেই নিজের সহকর্মী দ্বারা এষের পকেটে পার্সোনাল ভিসিটিং কার্ড দিয়ে দিয়েছে। আর এষও সুযোগটা লুফে নিয়েছে। ডক্টর লিও ছাড়া আর্শিকে আর কেউ যে ঠিক করতে পারবে না, সেটা সে ভালো করেই জানে।

অপেক্ষার নির্ঘুম রাত যেনো কাটছেই না। তাই এষ আবার আর্শির ডায়রি নিয়ে পড়তে বসলো।

একে একে দশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়া শেষ।

এষ শুরু করলো, একাদশ পৃষ্ঠা হতে।

আমরা খ্রীষ্ট ধর্মীয়। প্রতিবছর যীশু খ্রীষ্টের জন্মদিন চব্বিশে ডিসেম্বর থেকে শুরু করে পরবর্তী এক সপ্তাহ আমি আমার নানা বাড়িতে কাটাই। আগে যখন আমরা দক্ষীণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে থাকতাম তখন আমরা এদেশে প্রতিবছর আসতাম এই বড়দিনেই। কোরিয়া থেকে আসার পর আমার দাদা দাদী যেখানে বাড়ি করেছেন, সেখান থেকে আমার নানা বাড়ির দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার। আমার মায়ের এহেন মানসিক অসুস্থতা ছাড়াও নানা বাড়িটা নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। এর কারন আমার নানা প্যারালাইজড, নানীও অসুস্থ্য, সে কয়েকজন সাহায্যকারীর সহায়তায় সারা রাত দিন আমার মাম্মী আর নানার সেবাই করে। আমি নানা বাড়িতে গেলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড প্রহের মায়ের কাছেই থাকি। প্রহের মা আমার মামী হন। ভীষণই ভালোবাসেন সে আমাকে। সারাদিন আমি আর প্রহ খেলে বেড়াই৷ এ কথা আগেই উল্লেখ করেছি যে, আমি আর প্রহ একই স্কুলে পড়ি, সে ক্লাশ ফাইভে আর আমি ফোরে। আমার সৎ মায়ের বিষয়টা আমার মা এখনো মেনে নিতে পারে না। আমার মা এ এলাকার একজন সেরা সুন্দরী ছিলেন। নাচ, গান, অভিনয় সবকিছুতেই সে সমান পারদর্শী ছিলো। আমার বাবা নাকি তার নাচ দেখেই তাকে পছন্দ করেছিলো। কয়েকটা নাটক সিনেমায়ও সে কাজ করেছিলো। কিন্তু এটা নিয়ে পাপার সাথে তার ঝড়গা অবশেষে বিচ্ছেদ। তখন আমার মায়ের গর্ভে ছিলাম। কিন্তু কিছু দিন পরই মাম্মির এ রোগটা ধরা পড়ে। এখন এক কথায় সে পাগল। আমি জন্মের পরেই দেখি আমার মায়ের কিচ্ছু মনে থাকে না, এমনকি আমি যে তার মেয়ে, সেটাও তার মনে থাকে না। এমতাবস্থায় আমার পাপা বিয়ে করেন অপরাজিতা নামে একজনকে। এর আগে আমি জানতাম না যে স্টেপ মম কি জিনিস। তবে আই থিংক স্টেপ মম এতটাও খারাপ হয় না, যদি সেটা অপরাজিতার মতো কেউ হয়।

এষ পৃষ্ঠা উল্টালো।

এর পর অনেকদিন আর্শি ডায়রি লেখেনি। এর প্রায় ছ মাস পর আর্শি লিখেছে।

আজ আমার বিয়ে হয়ে গেলো! আমি অবাক হচ্ছি! আমি এত ছোট্ট! আর মাম্মী আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “আর্শি মনি তুমি কি কাউকে ভালোবাসো? আমি বললাম হ্যাঁ বাসিতো, প্রহকে! এই বলা মাত্রই মাম্মী প্রহকে ডেকে এনে একবার আমাকে কবুল বলিয়ে আরেকবার প্রহকে কবুল বলিয়ে বিয়ে করিয়ে দিলো। আমি তো অবাক! এ কেমন বিয়ে? আমি তো দেখেছিলাম, বিয়েতে অনেক লোক আসে, মেয়েটাকে সুন্দর সাদা গাউনে সাজানো হয়, ছেলেটাকে সুন্দর পোশাকে সজ্জিত করা হয়, তবে আমাকে এসব কিছুই করানো হলো না। শুধু একবার কবুল পড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু আমাদের ধর্মে তো আই ডু, ইয়েস আই ডু বলিয়ে বিয়ে পড়ানো হয়। আমার মা পাগল বলেই কি এসব করালো? আমি বুঝলাম না। আমার নিজের ভীষণই লজ্জা হচ্ছে। কেনো আমি বলতে গেলাম যে, প্রহকে আমি ভালোবাসি? তবে আসলেই আমি প্রহকে ভালোবাসি। সে বাসে কিনা তা আমি জানি না। তবে প্রহকে একবার নানু জিজ্ঞেস করেছিলো, প্রহ তুমি কাকে কাকে ভালোবাসো? সে তখন উত্তরে বলেছিলো, আমি মাম্মা, পাপা এন্ড আর্শিকে ভালোবাসি। প্রহর উত্তর শুনে নানু অনেক হেসেছিলো। আর বলেছিলো, আর্শিকেই তোর বউ বানিয়ে দেবো, বুঝলি? শুনে আমি আর প্রহও অনেক হেসেছিলাম।

এটুকু পড়ে যেনো এষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

আনন্দে সে হেসেই ফেললো,

” তার মানে প্রহের সাথে আর্শির বিয়েটা একটা খেলা ছিলো? এটা সত্য ছিলো না? যাস্ট একটা ইনসিডেন্ট! ”

আবার আর্শির উক্ত লেখাটার রেশে সে কেঁদে দিলো,

“আর্শি আর প্রহ একে অপরকে ভালোবাসে? ছোটোকাল হতেই?”

এষের একথাটায় মাথায় বজ্রাঘাত হচ্ছে!
অপরাজিতাকে এক্ষনে এষের ধরে পেটাতে মন চাইলো।

” মিথ্যাবাদী মহিলা এত মিথ্যাচার করেছে? আর্শিরা খ্রীষ্টধর্মের? এজন্যই তো অপরাজিতা কোনোদিন আর্শির বাবা কে নিয়ে , অতীত নিয়ে মুখ খুলেনি, মুখ খোলেনি তার প্রেম, বিয়ে নিয়েও!”

এত এত সত্য এতদিন অপরাজিতা লুকিয়ে রেখেছিলো? আর না জানি কতকিছু সে লুকিয়েছে!

এষ দাঁতে দাঁত পিষে বললো,

” আই কিল ইউ অপরাজিতা! আই উইল কিল ইউ!”

( চলবে)

#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম

পর্ব ২৪

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

এষ নিজের প্রতি নিজের সংযম হারালো। অপরাজিতাকে পেলেই যেনো সে কিছু একটা করে বসবে! এক কথায় তার এখন খু’ন করতে মন চাইছে অপরাজিতাকে। এত শয়তানী বুদ্ধি অপরাজিতার মাথায়! এষ একবার মনে মনে ভেবে নিলো অপরাজিতার মাথায় রাইফেল তাক করলেই আর্শির অতীত সম্পর্কে আরো বহু সত্য বের হয়ে আসবে।
কিন্তু এষ একথা ভেবেই ক্ষান্ত হলো। মুষ্টিবদ্ধ হাত ঘুষি দিলো দেয়ালে, নিজের হাতেই নিজে ব্যথা পেলো প্রচন্ড। ছি: কি ভাবছে সে এসব? অপরাজিতা যে তাকে তার মায়ের মতোই স্নেহ করে! খু’ন করবে কথাটা রাগের বশে কথাটা মুখে উচ্চারণ করে নিলেও বাস্তবে তার পক্ষে এটা করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। অপরাজিতার স্নেহভরা চোখ দুটির দিকে তাকালে সে নিমিষেই সব ভুলে যাবে।
আর্শিকেউ অপরাজিতা তার সবটা ঢেলেই স্নেহ করে। কেউ কোনোদিন বুঝতে পারেনি যে, আর্শি তার নিজের মেয়ে নয়। নিজে চাকরি করা স্বত্ত্বেও আর্শিকে তার সব সময় ঢেলে দিয়েছে অপরাজিতা। ছুটিতে আর্শিকে নিয়ে বিভিন্ন দেশ বিদেশ ঘুরেছে সে। আর্শির পছন্দসই সব কিছু কেনা থেকে শুরু করে আর্শির সব শখই মিটিয়েছে অপরাজিতা! আর্শির ভালোর জন্য সে সবই করেছে। আর্শি দেশে থাকতে চায় বলে অপরাজিতা তার বড় বড় প্রমোশন রিজেক্ট করে দেশেই পড়ে থেকেছে বছরের পর বছর। যেহেতু তার চাকরি ফরেন মিনিস্ট্রিতে সেহেতু তার বিদেশেই থাকার কথা ছিলো, তবে তা সে করেনি, ইচ্ছে করেই এদেশে থেকে গিয়েছে, শুধু আর্শির জন্য। সরকারের অন্যান্য কূটনীতিক গণ যেখানে সরকারি বড় বড় ভাতা গ্রহণ করে বিদেশে ভোগ বিলাসে জীবন পার করছে সেখানে অপরাজিতা ঢাকা শহরের ধূলি, ধোয়া আর যানজট সহ্য করে এখানেই পড়ে রয়েছে। আর্শির জন্য যে এত ত্যাগ স্বীকার করেছে, তবে কেনো সে সেই আর্শির কাছে এত সত্য লুকিয়েছে? সমাজের কাছে না হয় লুকিয়েছেই, তবে আর্শির কাছেও কেনো লুকিয়েছে? আর্শি তো আর ছোটো নেই! সে জানেই না যে তার প্রকৃত মা কে? কোথায় তার জন্ম! আর কোথায় তার রক্তের ধারা? আর্শিকে তাফ নিজের সম্পর্কে এত সত্য লুকিয়ে আর্শির কি কল্যান? আর অপরাজিতার ই বা কি লাভ? আর্শি সুস্থ্য হয়ে গেলে যদি অপরাজিতাকে ঘৃণা করে? তাহলে অপরাজিতা তখন কি করবে?
এষের মাথায় এত জটিল কূটিল জিনিস কাজ করে না। সে শুধু নিজেকে প্রশ্নই করে যাচ্ছে বারংবার কিন্তু এসবের উত্তর কে তাকে দেবে?

এতসব ভেবে এষের মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে আসতে ধরলো।

সে একবার ভেবেই বসেছিলো যে, আর্শির ডায়রিটা আর পড়বে না। কিন্তু সবটা জানা তার অতিব জরুরি মনে করেই আবার সে এক জায়গায় স্থিতু হয়ে বসে ডায়রির পাতা উল্টাতে লাগলো। যেটুকু পড়েছিলো তারপর থেকে আবার পড়া শুরু করলো।

আর্শি লিখেছে:

” আজ শুভ রবিবার, ইস্টার সানডে! স্কুল বন্ধ! সারাদিন ঘরে বসে টিভি দেখা ছাড়া কাজ দেখছি না। দাদা দাদীর শখ দেখে আমি অবাক হই! তারা এই বুড়ো বয়সেও নাকি নৌকা বাইচ দেখতে যাবে। প্রতিবছর শীতলক্ষ্যা নদীতে যখন বর্ষার পানি আসে, তখন তারা নৌকাবাইচ দেখতে যায়। তাদের রোমান্টিকতা দেখে আমি অবাক হই, এই বয়সেও বৃষ্টি হলে তারা দুজনে মিলে সেই বৃষ্টিতে ভেঁজে। আবার বকুল ফুলের মালা গেঁথে তারা একে অপরকে পড়িয়ে দেয়। আবার ছোটোখাটো কোনো বিষয়েই তারা একে অপরকে হাগ করে কিস করে!
আর তাদের ম্যারেজ এনিভার্সারি তে আমি তাদের জাঁকজমক দেখে অবাক হই। তারা যখন কোরিয়ায় ছিলো তখন গোটা একটা সোসাইটিকে তারা এদিন দাওয়াত করতো আর বাংলাদেশে এসেও একটা বিয়েবাড়ির মতো করে তারা তাদের ম্যারিজ এনিভার্সারি সেলিব্রেট করলো। আমি অবাক হই আর তাদের প্রেম দেখে! আর আমার মনেও প্রেম প্রেম ভাব জন্মে, এজন্য তাদের প্রেমই দায়ী। তবে আমার প্রেম প্রেম ভাব ; তা একান্তই প্রহের জন্য। হি ইজ মাই অনলি ওয়ান ক্রাশ! হি অলসো আ ড্যাম স্মার্ট গাই! এত স্মার্ট সে! স্কুলের ইন্টার ( অন্ত:) ম্যাথ কম্পিটিশনে সে মাত্র তিন সেকেন্ডেই একটা ম্যাথ করে ফার্স্ট হয়েছে। ও নাকি এবাকাস শেখে, তাই এত দ্রুত সব ম্যাথ করতে পারে। আমার পাপাও এবাকাস পারে, সে তো আবার ঢাকায়ই থাকে। পাপা বি সি এস আই আর( বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সাইন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ) এর জবের কারনে প্রায় গোটা সপ্তাহ ঢাকাতেই থেকে যায়। সে তাহলে কিভাবে শেখাবে আমায়? দাদা দাদী কে বললাম যে আমিও এবাকাস শিখবো? তারা বলে দিলো প্রহের কাছ থেকেই শিখে নিও। তাই স্কুলের টিফিন পিরিয়ড়ে আজ থেকে প্রহের কাছেই এবাকাস শেখা শুরু করলাম। তবে ভুল করলে ও খুব মারে! এটা আমার অসহ্য লাগে। তবে মারার ছলেও তো সে আমাকে টাচ করে, এটা আমি খুউব এনজয় করি। ইটস নট আ ব্যাড টাচ বাট ইটস আ লাভ টাচ! ”

এটুকু পড়েই এষ এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে পান করে নিলো। সে হয়তো আর এই ডায়রি পড়তে পারবে না। পৃথিবীর সব সহ্য করা সম্ভব হলেও প্রহের সাথে আর্শির প্রণয় ঘটিত বিষয়গুলো সহ্য করা সম্ভব নয় যে!
.
.
চোখে থাকা বড় ফ্রেমের গোলাকার চশমা এক ঝটকায় খুলে ফেললো ডক্টর লিও। চেইনে ঝুলানো ছিলো বলে সেটা ছিঁটকে দূরে কোথাও পড়লো না।
হাতে তার আর্শির লেখা সেই ডায়রিটা। লিওয়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে তাপমাত্রা ষোলো ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। তারপরো সে কেমন জানি ঘামছে।
সকাল আটটায় এসে সে এ বাড়িতে পৌঁছেছে। এষকে দেওয়া কথা সে অক্ষরে অক্ষরে রেখেছে। ব্যাপক সময় নিয়ে সে এখানে এসেছে। আর্শির পুরো কেইস সলভ না করে আজ সে এই বাড়ি হতে যাবে না। লিওয়ের অনুরোধে আর্শির ফ্রেন্ড সার্কেল কেউ আসার জন্য নিমন্ত্রণ জানিয়েছে এষ। কারন তাদের কাছ থেকে বহু তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব। আর রুকাইয়া খালাকেউ এষ বুঝিয়ে শুনিয়ে পটিয়ে নিয়েছে।

লিও আর্শির গোটা ডায়রিটা পড়া শুরু করে সবে উঠলো সে। এখন সময় ঠিক সাড়ে নয়টা। একটা ঘন্টা সে পূর্ণ মনোযোগের সাথে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ডায়রিটা পড়েছে। তারপর আর্শির হাতের লেখা সহ আরো অনেক কিছু পর্যবেক্ষণ করেছে।

এবার সে আর্শির সাথে সামনা সামনি কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করলো।

আর্শিকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ফ্রেশ করে রুকাইয়া লিওয়ের ঠিক সামনে এনে বসিয়ে দিলো। বিশাল বড় ড্রয়িং রুমে লিও, আর্শি, এষ আর রুকাইয়া প্রত্যেকে একে অপর হতে দূরত্ব বজায় রেখে বসা।
শুরু হলো লিওয়ের পর্যবেক্ষণ।
সে আর্শির চোখের রেটিনার সংকোচন প্রসারণ একদৃষ্টে খেয়াল করছিলেন বহুক্ষণ। আর্শির মোটা লেন্সের চশমা পাশেই পড়ে আছে। আর্শিকে একদৃষ্টে একটা গ্লাসের তৈরি গোলকের দিকে তাকিয়ে থাকতে নির্দেশ দিয়েছে ডক্টর লিও।
আর্শি তার হাত পা গুটিয়ে মোটামোটি জড়োসড়ো হয়ে ডক্টর লিওয়ের বিপরিতে সরাসরি সামনে অবস্থিত একটা সোফায় বসে গোলকের পানে চেয়ে স্থির আছে।

লিও বেশ কয়েকবার শান্তস্বরে আর্শিকে বললো,

” প্লিজ স্টে কোয়াইট, ইভেন ডোন্ট মুভ ফর আ লিটল ইফোর্ট!” ( দয়া করে শান্ত থাকুন, এমনকি নড়াচড়া করার সামান্য চেষ্ঠাও করবেন না)

আর্শি ডক্টরের নির্দেশমত শান্ত হয়ে বসলো।
এখানে বসার আগে এষ তাকে বহু বুঝিয়েছে যে, ডক্টরকে ভয় পেলে তোর আর চিকিৎসা হবে না, কবে তুই আবার সব ভুলে গিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবি, সেদিন তুইও পালাবি, আর জেনে রাখিস আমিও সুইসাইড করে মরে যাবো সেদিন, তখন খুবই ভালো হবে!
এ কথাগুলো শুনে আর্শি তার ভয়কে বিদায় জানাতে বাধ্য হয়ে ডাক্টারের সামনে আসতে রাজি হয়। তাছাড়া নিজের জীবনের যে বারোটা বছর তার স্মৃতি থেকে হারিয়ে গিয়েছে, তা ও সে ফিরে পেতে চায়।

এবারে ডক্টর লিও একটা কাগজে কি জানি আঁকছেন। কেন আঁকছে? তার উদ্দ্যশ্য এক তিনিই জানেন। এষ সামনেই দন্ডায়মান। এষের মুখের সাথে সাথে চোখগুলোও শুষ্ক হয়ে গিয়েছে। গত রাতে সে ব্যাপক কেঁদেছে। সেগুলো যেনো অশ্রু নয় বরং আক্ষেপের বারিপাত। আর্শি অন্য কাউকে জীবনের কোন এক কালে ভালোবেসেছে এটা পর্যন্ত তার মন মানতে নারাজ! যেনো আর্শির উপর তার একচ্ছত্র অধিকার! কিন্তু সে জানে সে যা করতে যাচ্ছে তাতে আর্শি আবার তার পুরোনো অতীত স্মৃতিকে দূর থেকে টেনে এনে তাকেই বরং দূরে ঠেলে দেবে। তার পরো এত বড় রিস্ক সে নিয়েছে, একমাত্র আর্শির সুখের জন্যই।
আর্শিকে সকল প্রকার পর্যবেক্ষণ ও তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ শেষ লিও এষকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে উঠলো,

“মিস্টার এষ! আজই আমার ফ্রান্সে ফ্লাই করতে হতো! আমি এই কেইসটার ব্যাপারে খুব বেশি ইন্টারেস্টেড ছিলাম বলেই আমার সহকারী ডক্টর জেসিকা আপনাকে আমার পার্সোনাল কার্ডটা দিয়েছিলো, যেনো আপনি আমার সাথে পার্সোনালী যোগাযোগ করতে পারেন। তাছাড়া আপনি আমার মেইলে যোগাযোগ করলে সিরিয়াল পেতে হয়তো মাসও গড়িয়ে যেতো। সেক্ষেত্রে আর্শির প্রপার ট্রিটমেন্ট পেতে আরো অনেক ডিলে( বিলম্ব) হয়ে যেতো। ”

এষ লিওয়ের কথা শুনে মুখে জোর করে একটা হাসি টেনে আনলো। কাঁপা স্বরে বললো,

” আসলে আপনার কাছে আমি এত বেশি থ্যাংক ফুল (কৃতজ্ঞ), এত ব্যস্ততার মাঝেও আপনি..”

এটুকু বলতেই লিও এষকে থামালো,

” আসলে এতে আমারই প্রফিট বেশি, এই দেখুন, আমি একটা প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করছি(এষ কে নিজের ফোনের স্ক্রিনে কিছু একটা দেখিয়ে) এই যে.. হোয়াই পিপল টেল দ্যা লাই? কেনো মানুষ মিথ্যে বলে এই শিরোনামে, এটা করছি বলেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আর্শির হিস্ট্রি বলতে গিয়ে অপরাজিতা মিথ্যা বলছে, তখনই আমার এই কেইসটার প্রতি মূল আগ্রহ জন্মায়”

এষ আবারো কেঁপে কেঁপে উঠে বললো,

” ওহ! রিয়েলি?”

নিজের মোটা ল্যাদার জ্যাকেটের উপর এষ একটা শালও জড়িয়ে নিয়েছে। প্রচন্ড শীত লাগছে তার। প্রচন্ড জ্বরজ্বর বোধ হচ্ছে তার। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্ঠা করছে এষ। লিও আর্শির সামনে হতে গোলকটা সরিয়ে রাখলো। আর্শি নিজের গোলকধ্যান ভঙ্গ করে নড়েচড়ে বসলো।

লিও আর্শির দিকে ফিরে বললো,

” সো আর্শি আপনি কি আপনার দাদা দাদীর চেহারা কি কিছু মনে করতে পারেন? বা আপনার মা?”

আর্শি জোরে করে ‘না’ বোধক মাথা ঝাঁকালো।
গোলক থেকে চোখ সরাবার পর থেকে আর্শির চোখ বারবার ভিজে আসছে। তবে বেশি কথা বলছে না আর্শি। তার শরীর ভীষণ দুর্বল।

লিও আর্শিকে ভেতরে যেতে নির্দেশ দিলো।
রুকাইয়া খালা আর্শিকে নিয়ে ভেতরে চলে যেতে উদ্দ্যত হলো।
যাওয়ার সময় লিও রুকাইয়া খালাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো,

” আন্টি, আজ থেকে আর্শির আগের সব মেডিসিন স্টপ! ওগুলো এক্ষুণি ঘর থেকে ফেলে দেন আর এই যে এই মেডিসিন গুলো( নতুন কিছু ঔষধ দিয়ে) একটা একটা করে প্রত্যেকটা খাইয়ে দিন এক্ষুনি”

রুকাইয়া সজোরে “আচ্ছা” বলে মেডিসিনগুলো গ্রহণ করে নেয়।

আর্শি চলে যেতেই এষের উদ্দ্যেশ্যে লিও বলে উঠলো,

” আপন মায়ে মা’রে তো নিজেরেই মা’রে, সৎ মায়ে মা’রে তো রন্ধ্রে রন্ধ্রে মা’রে!”

এষ কিছু না বুঝেই ডক্টর লিওয়ের দিকে অর্থহীন দৃষ্টিতে তাকালো, এতে ডক্টর লিও হো হো করে হেসে উঠলো, আর বললো,

” এষ, বুঝলেন না তো কিছু, মনে হয়! তাহলে বুঝাই শোনেন, আমি পুরোপুরি বাঙ্গালী না হলেও একটা বাংলা প্রবাদ আমার জানা আছে, আর সেই প্রবাদ হলো, আপন মায়ে মারে তো নিজেরেই মারে, অর্থাৎ আপনাকে যদি নিজের মা কখনো মারে তো মারটা আপনি খেলেও, ব্যথাটা কিন্তু আপনার মা পাবে, আর স্টেপ মম বা সৎ মা মারলে আপনার গায়ে মারের আঘাত না লাগলেও আপনি ধুঁকে ধুঁকে মরবেন!”

এষ এবারো দ্বর্থ্যহীন চোখে চেয়ে থাকলো। অর্থাৎ এষ বুঝেনি কিছুই।

লিও এবারে তাই খোলাখুলিই বলা শুরু করলো,

” এষ, মনে হয় বুঝেন নি, তাহলে চলেন আপনাকে বুঝিয়ে বলছি, ডায়রিটা পড়ে আমরা যা বুঝতে পারছি, সেটা হলো, অপরাজিতা তো আর্শির সৎ মা, এম আই রাইট? ”

এষ মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,

” ইয়া, রাইট!”

লিও তার চশমাটা পুনরায় পড়তে পড়তে বললো,

” আপনি কি জানেন আপনার ফুপি মিসেস অপরাজিতা, একজন পার্মানেন্ট ইমফার্টাইল ওইমেন( বন্ধ্যা নারী)?”

এষ আশ্চর্য হয়ে উত্তর দিলো,

” না, তো! আমি জানি না, আমি ওসব ভাবিও নি কখনো…”

এষকে থামিয়ে লিও বলা শুরু করলো,

” স্বাভাবিক, হয়তো সেভাবে ভাবেনই নি, তবে এটার জন্য আমার কোনো চেকাপ বা মেডিক্যাল ডকুমেন্ট দরকার নেই, আমি অপরাজিতার বাহ্যিক গঠন দেখেই বুঝেছিলাম যে, সে সন্তান জন্মদানে অক্ষম, সে আর্শিকে একমাত্র এত ভালোবাসতো কারন আর্শির চেহারাটা একদম অবিকল তার বাবা আরশ নাংজুর মতো। আর্শিকে সে এডপ্ট( লালন পালন) করতো না, যদি না আর্শি অপরাজিতার ভালোবাসার মানুষ আরশের হুবহু অনুরুপ দেখতে না হতো। আর্শির মাঝেই সে আরশের চেহারা খুঁজে পায় বলে আর্শিকে সে এত আদরে নিজের কাছে রেখেছে। আর আর্শি কোনোদিন কোনো দূর্ঘটনায় পড়ে বা মাথায় আঘাত পেয়ে তার স্মৃতি শক্তি হারায় নি বরং ডক্টর বসাকের থেকে প্রাপ্ত ঔষধ খেয়েই সে তার স্মৃতিশক্তি সব হারিয়েছিলো। কারন অপরাজিতা চায় না যে, আর্শি আবার সুস্থ্য হয়ে তার মায়ের কাছে চলে যাক বা প্রহের কাছে চলে যাক!”

এষ স্বর উঁচিয়ে বলে উঠলো,

” হোয়াট!? আর্শি আর প্রহ?”

লিও বলে উঠলো,

” ঘাবড়াবেন না এষ, আর্শি স্টিল প্রহের সাথে যোগাযোগ করে, আর গতকাল সে প্রহের সাথেই ফোনে কথা বলেছিলো, প্রহ নিশ্চয় কানাড়ায় থাকে, নাম্বারটা কানাড়ার, এবং আর্শি বাড়ি থেকে এয়ারপোর্টে চলে গিয়েছিলো কারন সে চলে যেতে যায় প্রহের কাছে, এজন্যই”

একথা শুনেই এষ নিজের মাথা চিপে ধরলো। মুহূর্তেই প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়ে গিয়েছে তার মাথায়।

.
.
আরাধ্যা, অগ্র ও পূর্ণ এসেছে। ডক্টর লিও প্রত্যেকের সাথেই কথা বলতে চেয়েছিলেন।
লিওকে এক কাপ কফি করে দিয়েছে রুকাইয়া। সে কফির মগে গভীর চুমুক দিতে দিতে আরাধ্যাকে সুধালো,

” সো.. আরাধ্যা, আর্শিকে আপনি কেমন জানেন?”

আরাধ্যা বলতে লাগলো,

” আর্শিরা ( আর্শি ও অপরাজিতা) যখন ওর বনানীর নানা বাড়িতে এসে উঠলো তখন স্কুলেই ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। ক্লাশের কারো সাথেই ও কথা বলতো না। তবে স্যার ম্যাথ করতে বললে সবার আগে করে দেখাতো। কোনো কিছু মেমোরাইজ করলে সে কয়েক মাসের মধ্যেই সব ভুলে যেতো বলে পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো করতো না ও। রেজাল্ট ভালো না করলেও আর্শি ছিলো খুবই জিনিয়াস, এটা দেখেই ওর প্রতি আমার এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করে, আর এ থেকেই বন্ধুত্ব”

এবার লিও অগ্রের দিকে তাকালো।

অগ্র হাসিমুখে বললো,

” আমার সাথে ওর পরিচয় ভার্সিটি তে, ক্লাশে স্যার যখন কিছু বুঝায় তখন একবারেই সব বুঝে ফেলে ও। মিডটার্মেও লিখে আসে সেগুলো, কিন্তু ছ’ মাস বাদেই ফাইনাল টার্মে গিয়েই সে ওগুলো গুলিয়ে ফেলতো, আর ফাইনাল টার্মে সরাসরি ফেইল”

এবার পূর্ণ বলে উঠলো,

” এ কারনে আমি ওকে ফাইনালের আগে সবকিছু একবার করে পড়াতাম, যাতে ও সেগুলা লিখতে পারে, সেটা মিসেস অপরাজিতাই আমাকে রিকুয়েস্ট করেছিলো একদিন। এক কথায় আমি প্রতি সেমিস্টার এক্সামের আগে ওর একটা হোম টিউটরের দায়িত্ব পালন করতাম। মিসেস অপরাজিতার মতো মা হয় না, সে ভীষণ কেয়ার করতো আর্শির, তবে আর্শি প্রায়ই প্রহ নামে এক ছেলের নাম বলতো”

এবার আরাধ্যাও একযোগে পূর্ণের সাথে বলে উঠলো,

” আর্শি প্রায়ই বলতো, ওর হাবির নাম নাকি প্রহ! আর প্রহের ছবিও তো আমাকে ও দেখিয়েছে, আমি বিশ্বাস করিনি, ভেবেছিলাম, এসব আজগুবি, তার আর ওসব বিষয়ে কথা বাড়াই নি, কিন্তু আবার পরের দিনই প্রহকে ভুলে সারা, অপরাজিতা আন্টি বলেছিলো প্রহ নামে কেউ নেই, ওসব আর্শির কল্পনা, আমি অপরাজিতা আন্টির কথাই সত্য বলে ধরে নিয়েছিলাম। আর আর্শির ভুলে যাওয়া রোগ আছে সেটাতো জানতামই”

লিও গভীর মনোযোগের সাথে আরাধ্যার কথাগুলো শুনছিলো।

তারপর তাদের ( আর্শির বন্ধুদের) দিকে মুড়ে বললো

” আপনারা সবাই ভেতরে যান প্লিজ, আর্শির সাথে টাইম স্পেন্ড করেন, এখন ওর জলি মাইন্ডে থাকাটা বেশ জরুরি ”

সবাই ড্রয়িং রুম ছেড়ে ভেতরে চলে গেলো।

লিও ঘড়িতে সময় দেখলো, অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছে। সে আর্শির জন্য নতুন প্রেসক্রিপশন লিখে দিলো। আর এষের দিকে মুড়ে বললো,

” আ’ম সো স্যরি মিস্টার এষ! আমি আপনার প্রেমটাই হয়তো স্পয়েল করে দিলাম”

বলেই আবারো হো হো করে হেসে উঠলো লিও।
হাসিমুখেই সে বলে উঠলো,

” খাঁটি প্রেম এরকমই হয় এষ! ভুল মানুষকে আমরা আমাদের মনটা দিয়ে দেই, আমারো একবার প্রেম হয়েছিলো, তার বিপদের দিনে আমি ছাড়া কেউ ছিলো না, কিন্তু বিপদ ফুরিয়ে গেলেই সে আমাকে রেখে আরেক জনের সাথে পালিয়ে যায়!”

বলেই লিও পুনরায় হো হো করে হাসলো একগাল।

আবার বলা শুরু করলো লিও,

” প্লিজ ডোন্ট বি আপসেট এষ! আর্শি সেরকম মেয়ে নয়, মোটেও নয়। সে পরিস্থিতির স্বীকার। এবং আর অল্প কিছুদিন ডক্টর বসাকের দেওয়া মেডিসিন গুলো ইন্টেক করলে আর্শিকে আর আপনি প্রিয়তমা হিসেবে নিজের বাহুডোরে পাবেন না, বরং পাবেন কবরে শায়িত! ”

এষ বলে উঠলো, ” হোয়াট! ডক্টর লিও! রিয়েলি?”

লিও আর্শির ডক্টর বসাক প্রদত্ত ফাইল খুলে একটা মেডিসিনের নাম লিখে পাবমেডে( মেডিক্যাল বিষয়ক ওয়েবসাইট) সার্চ দিলো, আর তাতে বের হয়ে গেলো ঔষধগুলোর ইফেক্ট ও সাইড ইফেক্ট।

এষের কিছুক্ষণ আগের ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কানগুলো দিয়ে যেনো গরম ধোঁয়া বের হলো এগুলো পড়ে। প্রতিটা ঔষধেরই সাইড ইফেক্ট এরকম যে, ” লং টার্ম ইনটেক দিস মেডিসিন ক্যান কজ একিউট ডেথ( দ্বীর্ঘ মেয়াদী ঔষধ সেবন মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে)

উক্ত লেখাটা পড়ে অপরাজিতার প্রতি এষের হাত পা রাগে কাঁপতে লাগলো।

লিও এষের অবস্থা দেখে বলতে লাগলো,

” এষ! এখন রাগলেও কোনো লাভ নেই, আর্শির কোনো আলঝেইমার ছিলো না, বরং তাকে এসব ঔষধ খাইয়ে তার অতীত ভুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর আমি যখন অপরাজিতাকে এটা বলেছিলাম, তখন সে আমার ট্রিটমেন্ট ডিনাই করে চলে এসেছিলো। বুঝেছেন?

এষ মাথা ঝাঁকলো। তার মুখে অনুতাপের ছাপ। কেনো সে আগে আর্শির ঔষধগুলো ঘেঁটে দেখেনি, সে অনুতাপ!

লিও আবার শুরু করলো,

” এষ! যা হবার তা হয়ে গেছে, এখন আর অনুতাপ করে লাভ নেই। আর একটা কথা, আর্শির মায়ের ঘটনাটা কি তাকে না দেখে আমি বলতে তো পারবো না, তবে আমার কেনো জানি মনে হয় আর্শির মা স্টিল আর্শির অপেক্ষায় আছে, আর একটা কথা, আমাকে শিওর করুন যে, অপরাজিতা যেনো এসব কিছুই না জানে! যতই হোক সরকারি আমলাদের আলাদা একটা ক্ষমতা থাকে, তারা সুযোগ পেলেই সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে।”

এষ তার দৃষ্টি ও স্বর প্রকট করে বললো,

” অব কোর্স ডক্টর লিও, সে জানবে না কিছুই! আমি তার ব্যবস্থা করবো”

” আর আর্শিকে যদি সত্যিই
ডক্টর লিও সবাইকে বিদায় জানিয়ে প্রস্থান করলো।

অপরাজিতা ফিরবে রাত্রের ফ্লাইটেই। এষ তার আগেই সব বন্দোবস্ত করে ফেলার জন্য জোর প্রচেষ্ঠা চালানো শুরু করলো।

( চলবে)