#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম
পর্ব ২৬
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
” চল আর্শি আজই আমরা বিয়ে করে ফেলি। আই কান্ট স্টে আ সিঙ্গেল মোমেন্ট ইউদাউট ইউ”
এষ একেবারে নিজেকে শপে প্রস্তাবটা রাখলো আর্শির কাছে। তার কন্ঠে অনুনয়। কিন্তু এষের প্রস্তাব শুনে আর্শি সজোরে নিজেকে এষের বাহুডোর হতে ছাড়িয়ে নিলো।
এভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ায় এষের মেজাজ চড়ে গেলো। বাঁধা দেওয়ায় এষ আরো বেপরোয়া হলো। সে আর্শির হাতে ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে তড়িৎবেগে আর্শিকে পুনরায় নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। আগের বারের চেয়ে আরো শক্ত করে, গাঢ় আলিঙ্গনে। নিজের ঠোঁট আর্শির ঠোঁটে ছোঁয়াতে ধরতেই..
” প্লিজ..স্টপ এষ, ভালো লাগছে না, আমার!”
আর্শি চেঁচিয়ে বলে উঠলো।
এষ নিজেকে সারেন্ডার করলো। আর্শির ঠোঁটে শুধু একবার নিজের ডান হাতের তর্জনি মৃদু ছুঁইয়ে আর্শিকে ছেড়ে দিলো। তবে মেজাজ আগের মতোই। রুষ্ট মেজাজে দাঁতে দাঁত পিষে আর্শিকে বলে উঠলো,
” ওকে! ওকে মাই জানু, তোকে জোর করবো না, তবে আই নোটিস, বিয়ের কথা বললেই তুই আমার সাথে ওভার রি-এক্ট করিস!”
আর্শি হেসে বললো,
” ধুর! ওভার রি-এক্ট তো সেজন্য করিনি, তোর হাবভাব বেশি ভালো না এখন, কাছে আসার সুযোগ দিলেই তুই এখন ব্যাড টাচ করে বসিস!”
এষ দুষ্টু হাসি হেসে বললো,
” ওহ! হো! আমার টাচ বুঝি ব্যাড টাচ? কপাল গুণে পাইছিস তো একটা? জানিসই না ব্যাড টাচ কি জিনিস? তাহলে চল আরেকটু ব্যাড টাচ ই করে দেখাই তোকে, মাই লেডি!”
বলেই আবার আর্শিকে এক ঝটিকায় বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।
আর্শি পোষ্য বেড়ালের ন্যায় চুপটি করে বসে রইলো এষের বুকে। এষের হাত ও ঠোঁট জোড়া চঞ্চল হতে চাইলো খুব। কিন্তু সে নিজেকে তা হতে বিরত রাখলো। বরং পিন পতন নিরবতায় নিজের হৃদস্পন্দন আর্শিকে শোনাতে লাগলো সে। আর ভাবতে লাগলো, এটাই কি আমার আর্শিকে শেষ আলিঙ্গন?
.
.
রাতে আর্শিকে খাইয়ে দাইয়ে ঔষধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে নিজের রুমে আসতেই এষের ফোনে ডক্টর লিওয়ের কল এলো। এষ হাসিমুখে কুশল বিনিময় করলো। লিও আবার ফ্রান্সে উড়াল দিয়েছে পনেরো দিনের জন্য। প্রতি মাসের এদেশে চৌদ্দ দিন আর ফ্রান্সে চৌদ্দ দিন এভাবেই তার সারাটা বছর কাটে। লিও এখন ফ্রান্স থেকেই কল দিয়েছে।
লিও থমথমে গলায় সুধালো,
” মিস্টার এষ! আর্শির প্রেজেন্ট কন্ডিশন কেমন? আর আপনি এখন কেমন?”
” বেটার ডক্টর লিও। ও বর্তমানেই ডুবে আছে, অতীত বলতে যেনো কিছুই নেই ওর কাছে, ও সেগুলো মনেও করতে ইচ্ছে পোষণ করছে না! ”
লিও হেসে বললো,
” তাহলে তো হলো না এষ! আর্শির ব্যাপারে আমি বেশি টেন্সড কারন তাকে আগে যে মেডিসিনগুলো ইন্টেক করানো হয়েছে সব অতীত ভুলার জন্য, সেগুলো তার ব্রেইন কে বেশ ভালোভাবেই ওয়াশ করেছে প্লাস ইনজোর্ড( আহত) করে ফেলেছে। আগের স্মৃতি রিকভারি পেতে হলে আমার মেডিসিনগুলো এনি হাউ তাকে কন্টিনিউ করতে হবে এবং তাকে সবসময় বেশ রিলাক্স মাইন্ডে রাখতে হবে। এখন আপনাকে এটা এনশিউর করাতে হবে যে, সে রিলাক্স মাইন্ডে থাকবে আগামী এক মাস বা তার বেশি সময়! আর তাকে পারলে যে করেই হোক তার আগের বাড়ি বা আগের পরিচিত মানুষজনদের সমারোহে নিয়ে যান। তাহলে ওর সেরে ওঠার ব্যাপারটা এগিয়ে যাবে। বুঝেছেন?”
এষ বড় করে একটা নি:স্বাস ফেলে বললো,
” ওকে আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট! থ্যাক্স আ লট ফর ইউর কনশাচনেস”
একথা বলেই ফোন কেটে দিলো সে।
এষ আরেকটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেললো! আর্শির প্রতি তার দায়িত্ব বেড়ে গেছে। আগে ছিলো শুধু তাকে দেখভাল করা আর বডিগার্ডের ন্যায় পাহারা দেওয়ার কাজ, আর এখন তাকে তার অতীত ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব। আর যে করেই হোক সে এ দায়িত্ব পালন করবেই করবে।
.
.
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় সাত দিন ব্যাপী কূটনৈতিক মিশনের সমাপ্তি। অপরাজিতার দেশে ফেরার ফ্লাইট রাতেই। ভোররাতেই সে ঢাকায় ল্যান্ড করবে। ভিডিও কলে এমন কথাই সে বলছিলো আর্শিকে।
কিন্তু আর্শি বলে উঠলো,
” মাম্মি শোনোনা? আমার বন্ধুরা আজ সন্ধ্যার ট্রেনেই কক্সবাজারে উদ্দ্যেশ্যে রওনা করবে। ফাইনাল এক্সামের আগে এটা আমাদের লাস্ট ট্রিপ! ”
অপরাজিতা বুঝতে পারলো তার মেয়ে কি বলতে চাইছে।
তাই সে আদুরে স্বরে বললো,
” মা আর্শি, তোমার শরীর ভালো না তা তুমি জানো, এমন অবস্থায় কি তোমার যাওয়া ঠিক হবে?”
আর্শি বলে উঠলো,
” মাম্মি, তুমি বুঝতে পারছো না, এটা আমাদের ব্যাচের লাস্ট ট্রিপ, এর পর কে কোথায় যাবে তার কোনো ঠিক নেই, আগে কোনোদিন আমি আমার বন্ধুদের সাথে কোথাও যাইনি, এবারই প্রথম, এবারই শেষ। আর কোনোদিন আমরা এভাবে একত্র হতেও পারবো না!
অপরাজিতার মৌন মুখে চিন্তার ছাঁপ।
আর্শি পুনরায় বলে উঠলো,
” মাম্মি, তুমি চুপ কেনো? আমি কথা দিলাম নিজের যত্ন নেবো, আর এষকেও নিয়ে যাওয়া যাবে, সো ডোন্ট ওরি!”
এষের কথা শুনে অপরাজিতা কিছুটা আস্বস্ত হলো। তবে বলে উঠলো,
” এষকে নেওয়া যাবে? ও তো আউটসাইডার? ”
আর্শি আদুরে স্বরে অপরাজিতাকে বললো,
” না মাম্মী, এষকে নেওয়া যাবে, ও আলাদা ভাবে আমাদের সাথেই যাবে। ওকে নেওয়ার জন্য আমি আমাদের চেয়ারম্যান স্যার কে অনুরোধ করেছিলাম, আর তিনি রাজীও হয়েছিলেন! তুমি প্লিজ রাজী হয়ে যাও না মাম্মী? মাত্র কয়েকটা দিনেরি তো ব্যাপার!”
অপরাজিতা নিজ মনে হাজারো সংশয় আর শঙ্কা নিয়ে না চাইতেও জোর পূর্বক হেসে বলে উঠলো,
” ওকে! নো প্রব, তুমি যাও, আর এষকে বলো আমার সাথে একটু কথা বলে নিক”
আর্শি তার ফোনটা এষকে এগিয়ে দিয়ে দিলো।
এষের শেখানো বুলি আর্শি হুবহু অপরাজিতাকে বলেছে শুনে এষ একটা প্রশান্তির শ্বাস নিলো।
ওদিকে মা’কে মিথ্যে কথা বলে আর্শি হাঁসফাঁস করতে রইলো। যত যাই হোক, এত বড় হয়েছে আর্শি কোনোদিন অপরাজিতাকে মিথ্যে বলে নি।
এষ ফোনের স্ক্রিনে অপরাজিতার দিকেও ঠিকভাবে চাইলো না। এই মহিলাকে দেখেই তার ঘৃণা হচ্ছে।
ওদিকে অপরাজিতা মেয়েকে দেখেশুনে কক্সবাজার নিয়ে যাওয়ার পরামর্শের লিস্ট দিতে লাগলো এষকে।
অপরাজিতার সাথে এষ সৌজন্য কথাটুকুও বললো না, শুধু প্রতিটা কথার উত্তরে হু হু, অল রাইট, ওকে, ইত্যাদি বলে ফোনটা রেখে দিলো।
.
.
আর্শি আর এষ গাড়িতে বসা। না তারা কক্সবাজার যাচ্ছে না, যাচ্ছে অন্য কোথাও। এক কথায় তারা দুজনেই অপরাজিতার বাসা থেকে পালাচ্ছে। একটা প্রাইভেট ভাড়া করেছে এষ। পকেটে যে কিছু টাকা আছে সেগুলো দিয়ে তারা দুজনে মাস খানেক খুব সুন্দর থাকতে পারবে। কাপড় চোপড়ের লাগেজ সব সাথেই আছে।
আর্শি তেড়ে গিয়ে এষকে জিজ্ঞেস করলো,
” ব্যাপার কি? তুই আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস এষ?”
এষ হেসে বললো,
” ডোন্ট ওরি, তোকে তোর অতীতে নিয়ে যাচ্ছি! আর এই গাড়িটা দেখছিস, এটা একটা টাইম মেশিন! ”
বলেই এষ হা হা করে হেসে দিলো।
আর্শি চোখ কপালে তুলে বললো,
” হাউউ কিডিং?অতীতে? কিন্তু.. ম..মা.. আম্মী”
এষ আর্শিকে ধমকের সুরে বললো,
” নো কিন্তু! চুপ থাক! ফুপি জানতে পারবে না। আর ভুলও বুঝবে না। আমি যা করছি তোর ভালোর জন্যই করছি, আর যা করছি ডক্টর লিওয়ের পরামর্শ মতই করছি, এতে তুই তোর বারো বছর বয়সের আগের যে সকল স্মৃতি ভুলে গেছিস তা স্মরণ করতে পারবি, প্লিজ আমার উপর বিশ্বাস আর ভরসা রাখ! ”
আর্শি এষের কথায় আশ্বস্ত হলো।
সে আর কোনো প্রশ্ন করা হতে বিরত হলো।
.
.
গাড়িতে শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে আর্শি। শরীরটা দুর্বল। খুব ঘুম পাচ্ছে, তবে ঘুমের ঔষধ ছাড়া আর্শির ঘুম আসে না। ডক্টর লিওয়ের কথামতো এষ আর্শির মাথা ম্যাসেজ করে দিচ্ছে। কারন ঘুমের সকল ঔষধ এখন বাদ! এখন তার ডক্টর লিওয়ের ঔষধ পুরোদমে চলবে। তার ভয় হচ্ছে, অপরাজিতা দেশে এসেই তাদের এ মিথ্যে ধরে ফেলবে। এষ আর্শির লেখা সেই সেই ডায়রিটা নিজের ব্যাগেই পুরে রেখেছে। সেটার কথা আর্শি এখনো জানে না।
মাথা ম্যাসাজ করতে করতে আর্শি ঘুমে ঢলে পড়লো। এষের ঘুম আসছে না নানা দুশ্চিন্তায়।
আর্শির ডায়রির প্রথমের পৃষ্ঠাতেই তাদের নারায়নগঞ্জের বাড়ির ঠিকানা ছিলো, তার বাবার কন্টাক্ট নাম্বার ছিলো।
এষ ভীতু হাতে কন্টাক্ট নাম্বারটায় ডায়াল করলো। বন্ধ দেখালো। এখন আপাতত তারা নারায়ণগঞ্জের বাড়িতেই যাচ্ছে। এষ ডায়রির শেষ পৃষ্ঠাগুলো পড়েনি। আসলে তখন পড়ার সাহসে কুলায় নি। আর্শি ঘুমাচ্ছে, তাই ভাবলো এখন পড়ে নেওয়া যাক।
এষ পৃষ্ঠা উল্টালো।
আর্শি লিখেছে:
আমি আজ খুবই নার্ভাস। আমাদের স্কুলের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠান আছে। আমি কোনোদিন নাচ করিনি। প্রহ আমাকে জোর করেই নাচের প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে দিয়েছে। এখন কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। আমি তো আর প্রহের মতো ইন্টিলিজেন্ট না। আমি নাচ, গান কিচ্ছু পারি না। তাই টিভি ছেড়ে নাচ দেখছি, আর অনুকরণ করার চেষ্ঠা করছি।
আমার মনটাও ভালো না। আমার নানা বাড়ি থেকে কল এসেছে, আমার মায়ের অবস্থা ভালো না। যেই তার কাছে যাচ্ছে তাকেই সে কামড়াচ্ছে। আমার জন্মের পরো একবার মায়ের এমনটা হয়েছিলো। আমাকে কামড় দিয়ে র’ক্ত বের করে দিয়েছিলো। সেজন্যই আরো আমার দাদা দাদী আমাকে মায়ের কাছে থাকতে দেয়নি। এটা মায়ের প্রতি দাদা দাদীর ঘৃণা নয়, বরং আমার প্রতি শংঙ্কা। যাকে সে পছন্দ করে না তাকে সে খু’নও করে ফেলতে পারে।
তার সবচেয়ে বড় অপছন্দের তালিকায় রয়েছে, আমার বাবা, দাদা আর দাদী। আর আমার স্টেপ মম অপরাজিতা। তার ধারণা এরা সবাই আমাকে তার(মায়ের) কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে।
যাই হোক, আজ নানা বাড়িতে থাকবো, অর্থাৎ প্রহদের বাড়িতে থাকবো। আমার ভেতরে খুউবই উত্তেজনা হচ্ছে। কারন প্রহ আমাকে আজ স্কুলে বলেছিলো, সে আমাকে কিছু বলতে চায়!
এষ থামলো।
এটুকু পড়তেই গাড়ি এসে পৌঁছলো ঠিকানা অনু্যায়ী। সোনারগাঁও ক্রস করে আরো এক কিলোমিটার ভেতরে এ গ্রাম। বেশ প্রাচীন ও শুনশান এখানকার পরিবেশ।
এক বিরাট পুকুর বিশিষ্ট জমিদার বাড়ি তুল্য এক বাড়ি।
আর্শি ও এষ উভয়েই নামলো।
গাড়ি দেখে ভেতরবাড়ি হতে এক বয়স্ক লোক তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো।
সময় তখন ঠিক সন্ধ্যা।
চোখের চশমাটা ঠিকমতো পড়ে সে আর্শির দিকে তাকিয়ে বললো,
” আরে! তুমি আর্শি না দাদুভাই?”
(চলবে)