এক মুঠো রোদ্দুর পর্ব-০৬

0
71

#এক_মুঠো_রোদ্দুর
[ ষষ্ঠ পর্ব ]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

আদনানের কেন জানি খুব চিন্তা হচ্ছে আদিবার জন্য। হঠাৎ করে মেয়েটার কি হলো? হঠাৎ করে হাসপাতালে আসেনি আবার ফোন ও রিসিভ করেনি। এসব ভাবছে আর গাড়ি আপন মনে এগিয়ে যাচ্ছে। আচমকা আদনানের ফোন বেজে ওঠে। আদনান ফোন হাতে নিয়ে দেখে আদনানের ফ্রেন্ড ফোন দিয়েছে। আদনান ফোন রিসিভ না করে ফোন রেখে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আদনান আদিবার বাসার সামনে পৌছে যায়। আদনান তাড়াতাড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে আদিবার বাসার সামনে গিয়ে দরজার কলিং বেলে চাপ দেয়।

কলিং বেলের শব্দ শুনে আদিবা এসে দরজা খুলে আদনানকে দরজার সামনে দেখে সে হতবাক হয়ে যায়।

— স্যার আপনি?

— তুমি ফোন রিসিভ করছিলে না কেন? আর হাসপাতালে যাওনি কেন?

আদিবা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ আদিবা অনেকটা ভয়ে আছে।

— হাসপাতালে যাবেনা ভালো কথা ফোন রিসিভ করে তো বলতে পারতে! তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছিল তুমি কি বুঝতে পারোনা?

আদিবা এবার চোখ তুলে আদনানের দিকে তাকায়।

রাগে আদনানের চোখ লাল হয়ে আছে।

— তোমার মতো এমন কেয়ার ল্যাস মেয়ে আমি দেখিনি। কারোর কোনো সমস্যা থাকলে সেটা জানাতে হয়।

— আসলে স্যার।

আদিবা কিছু বলতে যাবে তখনই আদিবার বাবা এসে বলল — আরে ডাক্তার সাহেব যে। তুমি কখন আসলে?

— একটু আগেই আসলাম।

— তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভিতরে আসো। আদিবা তুই ও না! দাড় করিয়ে রাখিলি কেন ওঁকে?

— আমি ভিতরে যাবোনা। হাসপাতালে কাজ আছে। আদিবা তুমি রেডি হয়ে আসো আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি।

এই কথা বলে আদনান চলে যায়।

— কিরে ডাক্তার এখানে কেন আসছে?

— আমি হাসপাতালে যাইনি সেই জন্য। তোমার সাথে পরে কথা বলব। এখন আমি যাই।

আদিবা অনেক বেশি ভয় পেয়ে যায়। আর সে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। আদিবা বের হয়ে দেখে আদনান গাড়ির ভিতরে বসে আছে। আদিবা গিয়ে গাড়িতে উঠে। আদনান গাড়ি চালাতে শুরু করে। আদিবা তো ভয়ে চুপসে আছে। আর আদনান ও কোনো কথা বলছেনা। দুজনেই নিশ্চুপ। কারোর মুখে কোনো কথা নেই।

আদনান হঠাৎ করে গাড়ি থামিয়ে বলল — নামো গাড়ি থেকে।

— এখানে কেন? হাসপাতালে যাবেন না?

— এতো প্রশ্ন করতে কেউ বলছে? মুখ দেখেতো মনে হচ্ছে না খেয়ে আছো।

আদিবা কিছুই বলল না। আদিবা আসলেই সকাল থেকে না খেয়ে আছে। কারণ গতকাল রাতে সে নিজের অজান্তে আদনানের সাথে কেমন ব্যবহার করছে তা সে এখনও জানেনা। হাসপাতালে না যাওয়া আর ফোন রিসিভ না করার এটাই কারণ ছিল।

এবার দু’জনে নেমে একটা রেস্টুরেন্টে যায়। দু’জন খাবার খেয়ে বেরিয়ে আসে। আবার গাড়িতে উঠে বসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালে পৌছে যায়।

আদনান আর আদিবা আদনানের চেম্বারে আসে। তখন আদনান আদিবাকে বলল — আমার ফোন রিসিভ করছিলেনা কেন?

— সরি স্যার।

— কীসের সরি!

— কাল রাতে আপনাকে কি কি বলছি তার জন্য। আর আপনার সামনে কীভাবে দাড়াবো সেই জন্য হাসপাতালে আসিনি। ফোন ও রিসিভ করিনি।

— নেক্সট টাইম যেনো এমন ভুল না হয়।

— হবেনা স্যার। আমি আর কখনও বিয়ার খাবোনা। কাল কেন যে খেতে গেলাম।

আদিবার কথা শুনে আদনান বলল — আমি বিয়ারের কথা বলিনি। আমি বলছি আজকে যেটা করলে সেটা যেনো আর কখনও না হয়।

— ঠিক আছে স্যার।

এবার আদনান পুরো হাসপাতাল ঘুরতে শুরু করে। সাথে আদিবা ও আছে। আদিবা আনমনে আদনানের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মানুষ টা খুব অদ্ভুত। রাগি মানুষের পিছনে অন্য একটা মানুষ লুকিয়ে আছে। যেটা সচারাচর কেউ দেখতে পায়না। বেখেয়ালি ভাবে হাঁটছে আদিবা। আচমকা সে কারোর সাথে ধাক্কা খেয়ে ফ্লোরের উপর পড়ে যায়। আর ও বাবা গো বলে একটা চিৎকার দেয়।

— তোমার চোখ কই থাকে?

— চোখ তো চোখের যায়গা থাকে।

— তাহলে দেখে চলতে পারো না?

— এতো কথা না বলে আগে আমাকে তুলুন স্যার। তারপর প্রশ্ন করবেন।

আদনান আদিবাকে না তুলে চেম্বারে চলে যায়।

— হাতি একটা। নিজে খেয়াল করেনা। আবার সব দোষ আমার দেয়। এই বেডার বউ যে হবে তার তো জীবন শেষ। রাক্ষস একটা।

নিজে নিজে এসব বলতে বলতে উঠে যায়।

দেখতে দেখতে কয়েকদিন কেটে যায়। আদিবা সুযোগ পেলেই আদনানের দিকে তাকিয়ে থাকে। যদিও আদনান বুঝতে পারে কিন্তু সে তেমন একটা পাত্তা দেয়না। আর আদিবা ভুল করলে বকা তো আছেই।

রাত ঠিক চারটে বাজে। তখনই আদনানের ফোন বেজে ওঠে। আদনান নাম্বারের দিকে তাকিয়ে দেখে আদিবা ফোন দিয়েছে।

এতো রাতে আদিবা ফোন দেওয়ার কারণ কি? এই মেয়ের কি চোখে ঘুম নেই? যত্তসব।

এসব বলতে বলতে ফোন রিসিভ করে।

— রাত কয়টা বাজে এখন?

— স্যার।

আদিবার কণ্ঠ শুনে আদনানের বুঝতে বাকি নেই যে আদিবা কান্না করছে।

— কি হইছে কান্না করছ কেন? সব ঠিক আছে তো?

— স্যার আপনি প্লিজ আমাদের বাসায় আসুন।

— এতো রাতে? কোনো সমস্যা হইছেকি?

— স্যার আমার বাবা কোনো কথা বলছেনা। আমি কিছু বুঝতে পারছিনা। আপনি প্লিজ আসুন। আমি কখন থেকে বাবাকে ডেকেই যাচ্ছি। কিন্তু বাবা কোনো রেসপন্স করছনা। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।

— ঠিক আছে আমি এক্ষুনি আসছি।

এই কথা বলে আদনান নিজের রুমের লাইট অন করে একটা টি-শার্ট গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আদিবার বাসার পৌছে যায়। আদনান যেতেই আদিবা তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে আদনানকে তার বাবার কাছে নিয়ে যায়।

আদনান আদিবার বাবাকে চেক করে বুঝতে পারে। আদিবার বাবা আর নেই। উনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছে।

— ও স্যার! আমার বাবা কথা বলছেনা কেন? আমার বাবার কি হয়েছে? আমার বাবা তো এভাবে চুপ থাকেনা।

— আদিবা শান্ত হও। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবেনা। তোমাকে শক্ত হতে হবে। আর বাস্তবতা কে মেনে নিতে হবে।

— আপনি বলুন না আমার বাবার কি হইছে? বাবা কথা কেন বলছেনা?

— তোমার বাবা আর আমাদের মাঝে নেই।

— না।

আদিবা একটা চিৎকার দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। আদনান আদিবাকে কি বলে সান্ত্বনা দিবে। সে ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা। এদিকে আদিবা তো বাবার লাশ জড়িয়ে কান্না করছে।

— বাবা তুমিও আমাকে একা করে চলে গেলে? তুমি না বলছিলে তুমি আমাকে ছেড়ে কখনও যাবে না? ও বাবা কথা বলো। আমি তোমাকে ছাড়া কীভাবে থাকব? ছোট বেলায় আম্মু আমাকে রেখে চলে গেছে। আজ তুমিও চলে গেলে বাবা? বাবা একটু কথা বলো আমার সাথে। আমার কথা টা একটুও ভাবলেনা তুমি? আমি কীভাবে একা থাকব? কথা বলো বাবা।

আদনান নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে রানী বেগমকে ফোন দিয়ে এখানে আসতে বলে। রানী বেগম কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসে। আর উনি আদিবাকে সান্ত্বনা দিতে থাকে। দেখতে দেখতে ভোর হয়ে যায়। আর মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে। সবাই আদিবার বাবার লাশ দেখতে আসে। আর আদিবা তো কান্না করেই যাচ্ছে। এদিকে লাশ দাফন করার সব ব্যবস্থা করে আদনান। শেষ বিদায়ের সময় আদিবাকে বাবার লাশের সামনে নিয়ে আসে। আদিবা হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে। রানী বেগম কিছুতেই আদিবাকে ধরে রাখতে পারছে না।

— আমার বাবাকে নিয়ে যাবেন না। আমি আমার বাবাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা। ও বাবা। আমি যে এবার এতিম হয়ে গেলাম। আমার তো আর কেউ নেই তুমি ছাড়া। বাবা।

রানী বেগম আদিবাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল — আদিবা মা আমার কে বলছে তোমার কেউ নেই। আমরা আছিনা?

আদিবা রানী বেগমকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আদিবার বাবার লাশ দাফন করা হয়। দাফন কাজ শেষ করে আদনান ফিরে আসে। আদিবা কান্না করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

— আম্মু আদিবা কোথায়? খেয়েছে কিছু?

— না। এখন ঘুমিয়ে আছে।

— আচ্ছা ঠিক আছে। তুমিও তো না খেয়ে আছো। আমি গিয়ে তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসি।

— তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।

— হ্যাঁ বলো।

— এখানে না।

রানী বেগম আদনান কে আলাদা একটা রুমে নিয়ে যায়। আর সেই রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। রুমের মধ্যে মা ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই।

চলবে?