এক মুঠো রোদ্দুর পর্ব-০৮

0
66

#এক_মুঠো_রোদ্দুর
[অষ্টম পর্ব ]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

আচমকা আদিবার চোখ চেপে ধরে। আদিবা বুঝতে পারছেনা কে হতে পারে!

–কে?

আদিবার কণ্ঠ শুনে তাড়াতাড়ি করে চোখ ছেড়ে দেয় আদনান।

— স্যার আপনি?

— তুমি এখানে? আম্মু কোথায়? আর তুমি আম্মুর শাড়ি পড়লে কেন?

— আমি রান্না করতে আসছি।

আদনান এবার আর কিছু না বলে চলে গেলো। আদিবা তো থ হয়ে আছে। আদনান আম্মু আম্মু বলে ডাকতে থাকে। রানী বেগম আদনানের কণ্ঠ শুনে বেরিয়ে আসে।

— কিরে আজ হঠাৎ এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলি যে?

— হাসপাতালে তেমন একটা কাজ নেই। তাই চলে এলাম।

— আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে নে।

আদনান চলে গেলো। দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেলো। সবাই খাবার খাওয়ার জন্য চেয়ারে এসে বসে৷ আরিয়ান চৌধুরী ও আসে৷ আদিবা লক্ষ্য করল আদনান তার বাবার সাথে কোনো কথা বলছেনা। খাবার টেবিল নিরব হয়ে আছে। কেউ কোনো কথা বলছেনা। বিষয় টা আদিবার কাছে কেমন যেনো লাগছে। তখন আদিবার মনে পড়ে এই লোক কেই তো সে হাসপাতালে দেখেছে। চুপচাপ যে যার মতো খাবার খেয়ে উঠে যায়।

বিকেলে আদিবা রানী বেগমের কাছে যায়। তখন রানী বেগম সোফায় বসে আছে। রানী বেগম আদিবাকে দেখে বলল — আরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এখানে বসো।

— আন্টি আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। আসলে একটা জিনিস জানার ছিল।

— হুম বলো।

— খাবার সময় আমি একটা জিনিস খেয়াল করলাম। আদনান স্যারের সাথে কি আংকেলের কোনো সমস্যা হইছে? ওনারা কি একজন আরেক জনের সাথে কথা বলে না?

রানী বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল — আর বলোনা। আট বছর ধরে আদনান তোমার আংকেলের সাথে কথা বলে না।

আদিবা একটু অবাক হলো।

— কেন কি হইছে এমন?

— আসলে আদনান একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। আর তখন আদনানের পড়াশোনা চলছে। মেয়েটার সাথে রিলেশন হওয়ার পর থেকে আদনান কেমন যেনো হয়ে গিয়েছে। ঠিক ভাবে পড়াশোনা করেনা। খাবার ঠিক করে খায়না। আদনানের এমন অবস্থা দেখে আমাদের খুব খারাপ লাগতে থাকে। একদিন আমি আদনানকে গিয়ে বললাম,

— আদনান তোর কি হয়েছে বাবা? হঠাৎ তুই কেমন জানি হয়ে গেছিস।

— কিছু হয়নি তো।

— তুই আমার কাছে লোকাবি? আমি তোর মা। সন্তানের কিছু হলে সবার আগে মা-বাবা সেটা বুঝতে পারে। তুই আমার সাথে তো আগে সব শেয়ার করতি।

— আরে আম্মু কিছু হয়নি তো। শুধু শুধু আমাকে নিয়ে চিন্তা করছ।

আমাদের কথার মাঝে আদনানের বাবা চলে আসে। এসে উনি আদনানকে বলল,

— আদনান তোমাকে লন্ডন গিয়ে বাকি পড়াশোনা শেষ করতে হবে। আমি সব ঠিক করে এসেছি। ৭ দিন পরে তোমার ফ্লাইট।

— আব্বু আমাকে জিজ্ঞেস না করে এসব করার মানে কি?

— আমি চাই তুমি ভালো একজন ডাক্তার হয়ে দেশে ফিরে আসো। আর আমার হাসপাতালে দ্বায়িত্ব নাও।

— দেশের বাহিরেই কেন যেতে হবে? আমাদের দেশে কি কোনো কিছু কম আছে?

— আমি এতো কিছু শুনতে চাইনা। যেটা বলেছি সেটাই। মনে রাখবে সাত দিন পরে তোমার ফ্লাইট।

এই কথা বলে আদনানের বাবা চলে যায়। আদনান আমার কাছে এসে বলল,

— আম্মু এগুলোর মানে কি? আমাকে কিছু না জানিয়ে এগুলো কেন করছে?

— আমিও তো জানতাম না। তবে উনি যার করছে সেটা তো তোর ভালোর জন্য করছে।

— এমন ভালো তো আমি চাইনি।

— আরে বাবা সমস্যা কি? মাত্র তো চার বছর। চার বছর পরে আবার ফিরে আসবি।

— এই চার বছরে অনেক কিছু হয়ে যাবে।

— মানে?

— আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি। আমি যদি বাহিরে চলে যাই মেয়েটার যদি অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যায় তখন? তখন আমি কি করব?

— কিহ! তুই প্রেম করিস অথচ আমি জানি না।

— আসলে আমি ভাবছিলাম তোমাদের পরে সব বললব। কিন্তু এখন দেখি সব এলোমেলো হয়ে গেলো।

— আচ্ছা সমস্যা নাই। আমরা মেয়ের মা-বাবার সাথে কথা বলব। তুই চিন্তা করিস না। আমি তোর বাবাকে বলব এটা নিয়ে। তুই চিন্তা করিস না

রানী বেগম আরিয়ান চৌধুরীকে সব বললেন। আরিয়ান চৌধুরী এক মাত্র ছেলের খুশির কথা চিন্তা করে রাজী হয়ে যায়। তারা সবাই মিলে মেয়েকে দেখে আসে। আর আদনানের ব্যাপারে জানায়। আদনান অনেক খুশি হয়ে যায়। কিছু দিন পরেই আদনান পড়াশোনার জন্য দেশের বাহিরে চলে যায়। আদনান বাহিরে যাওয়ার ছয় মাস পরে মেয়েটা কেমন যেনো অন্য রকম রিয়াক্ট করতে শুরু করে। আর আমারা শুনতে পাই মেয়েটার পরিবার অন্য এক যায়গায় মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলে। আদনানের বাবা এ কথা শুনে মেয়েটার বাসায় চলে যায়। ফিরে আসে অপমানিত হয়ে। আর মেয়েটার ও বিয়ে হয়ে যায়। আর এসবের জন্য আদনান তার বাবাকে দায়ী মনে করে। এর পর থেকে আদনান আর তোমার আংকেলের সাথে কথা বলেনা ঠিক ভাবে।

আদিবা এতক্ষণ সব কথা শুনছিল।

— এখানে তো আআংকেলের কোনো দোষ নেই। আর মেয়েটা কিছু বলেনি?

— আসলে মেয়েটার অন্য একটা ছেলের সাথে রিলেশন হয়ে যায়। আর তার সাথেই মেয়েটা বিয়ে করে নেয়। আদনানের বাবা তাদের অনেক অনুরোধ করে কিন্তু মেয়েটা সহ তার পুরো পরিবার আদনানের বাবাকে অপমান করে। আমি আদনানকে অনেক বুঝালাম কিন্তু আদনান আমার কোনো কথাই শুনেনা। আদনান মনে করে সে যদি বাহিরে না যেতো তাহলে এসব কখনও হতোনা।

— এটা ঠিক নই। মেয়েটা যদি আদনান স্যারকে সত্যি ভালোবাসতো সে অন্য একটা রিলেশনে কিছুতেই যেতে পারতোনা। বিয়ে তো অনেক দূরে।

— এটাই তো আদনানকে বুঝাতে পারিনি আমরা।

— চিন্তা করবেন না আন্টি। সব ঠিক হয়ে যাবে।

— হুম মা। সেই আশায় আছি। আমার পরিবার যেনো আগের মতো হয়ে যায়। আদনানের বাবা আদনাকে অনেক ভালোবাসে।

— বুঝতে পারছি আন্টি। চিন্তা করবেন না। আমি এখন যাই।

এই কথা বলে আদিবা চলে গেলো। আদিবা মনে মনে ভাবছে। সে এই পরিবারকে ঠিক আগের মতো করবে। আবার সবাই এক সাথে হাসবে। এক সাথে আড্ডা দিবে।

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আদনান নিজের রুমে বসে আছে। তখন আদিবা আদনানের দরজার সামনে গিয়ে বলল,

– স্যার আসতে পারি?

— হুম। কিছু বলবে?

— হুম।

— বলো।

— বাবার কথা খুব পড়ে। জানেন স্যার। ছোট বেলা থেকেই এই একটা মানুষকে আমি খুব বেশি ভালোবাসি। আজ সেই মানুষ টাও নেই। বাবা যে আমাদের জন্য কতোটা প্রয়োজন বাবাকে হারালে বোঝা যায়। বাবা ছায়া আমার মাথার উপর থেকে সরে গিয়েছে। বাবাকে অনেক বেশি মনে পড়ে।

— কান্না না করে ওনার জন্য দোয়া করো।

— অনেক সন্তান আছে যারা মা-বাবার সাথে ঠিক ভাবে কথা বলেনা। মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। মা-বাবা কী জিনিস তারা বুঝতে পারেনা। যখন তারা হারিয়ে যায় তখন ঠিকই বুঝে। মা-বাবা কষ্ট তখন পায় যখন দেখে তাদের সন্তান গুলো তাদের সাথে ভালো ভাবে কথা বলেনা। সবাই নিজের সন্তানকে কাছে পেতে চায়। সন্তানের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে চায়। সব বাবামা চায় সন্তান তাদের পাশে থাকুক। তাদের কেয়ার করুক। মা-বাবার উপরে রাগ করে থাকা নেহাতি বোকামি। কারণ পৃথিবীতে মা-বাবা ছাড়া আর কেউ সার্থ ছাড়া ভালোবাসেনা।

আদিবার কথা গুলো সব শুনছে আদনান। আদনান নিরব হয়ে আছে।

— স্যার আপনি জানে ঠিক এই ভাবে কেউ একজন আপনার জন্য কষ্ট পায়? মানুষটা আপনার কাছে একটু সময় চায়।

আদনান নিশ্চুপ।

— স্যার আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন আমি কার কথা বলছি। সন্তানের খারাপ হয় এমনটা বাবা কখনও করেনা। আমি মায়ের ভালোবাসা কখনও পাইনি। কিন্তু বাবার ভালোবাসা পেয়েছি। বাবা কেমন হয় আমি জানি। আজ আর আমার বাবা নেই।

এই কথা বলে আদিবা কান্না করতে শুরু করে। আদনান কীভাবে আদিবাকে সান্ত্বনা দিবে। সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদনান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে সোজা তার মা-বাবার রুমে চলে যায়। আদিবা আদনানের পিছনে যেতে থাকে। আদনান রুমে গিয়ে দেখে আরিয়ান চৌধুরী মন খারাপ করে বসে আছে। তখন আদনান তার বাবার সামনে গিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। রানী বেগম আর আরিয়ান চৌধুরী বেশ অবাক হয়ে যায়।

— আদনান কিছু বলবে?

আদনান কোনো কথা না বলে সোজা আরিয়ান চৌধুরীর পা জড়িয়ে ধরে আর কান্না করতে শুরু করে।

— আদনান কি হইছে তোমার?

— আব্বু আমাকে তুমি প্লিজ ক্ষমা করে দাও। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।

আরিয়ান চৌধুরী এবার রানী বেগমের দিকে তাকায়। রানী বেগম আদনানের দিকে তাকিয়ে আছে।

— আব্বু প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমার উপরে রাগ করে ছিলাম এতো দিন। প্লিজ ক্ষমা করে দাও।

— তোর উপরে আমার কোনো রাগ নেই বাবা। আজ আমি সত্যিই অনেক খুশি। তুই আমাকে আব্বু বলে ডেকেছিস। অনেক দিন পরে এই ডাক শুনেছি।

আদনান তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। আরিয়ান চৌধুরী ও কান্না করছে সাথে রানী বেগম ও। আর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আদিবার চোখেও পানি।

রানী বেগম চোখে পানি মুছে বলল — অনেক হয়েছে এবার সবাই খেতে চলুন।

সবাই খাবার খেতে চলে গেলো। খাবা টেবিলের পরিবেশ আজ অন্যরকম। আজ সবার মুখে হাসি। আদিবা এসব দেখে অনেক খুশি। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে যে যার রুমে চলে যায়। আদিবা নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে। আদিবা দরজা বন্ধু করে দেয় ভিতর থেকে। হঠাৎ করেই দরজার শব্দ শুনে আদিবা দরজা খুলতে যায়। আর সে দরজা খুলতেই দেখতে পায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদনান।

চলবে?