এক মুঠো রোদ্দুর পর্ব-১৪

0
54

#এক_মুঠো_রোদ্দুর
[পর্ব – ১৪]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

পরিক্ষার রেজাল্ট দেখে আদিবার চোখে পানি চলে আসে। আদিবার এমন রেজাল্ট দেখে আদনান ও অবাক হয়ে যায়। এতো ভালো রেজাল্ট করবে আদনান আদিবা কেউ ভাবতেও পারেনি। রানী বেগম আদিবার রেজাল্ট দেখে অনেক বেশি খুশি হয়ে যায়।

রানী বেগম আদনানকে উদ্দেশ্য করে বলল — আদনান এক্ষনি বাজারে গিয়ে মিষ্টি নিয়ে আয়।

আদনান ও মিষ্টি আনতে চলে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিষ্টি নিয়ে ফিরে আসে। আর সবাই মিষ্টি মুখ করে। আদিবা আজ অনেক বেশি খুশি। শুধুই আদিবা না বাসার সবাই খুব খুশি। সবার খুশি দেখে আদিবা নিজের চোখের পানি আটকে রাখতে পারেনা। একটা পরিবার কতোটা ভালো হলে অন্যের খুশিতে খুশি হয়। একটা অচেনা মেয়েকে পরিবারের একজন করে নিয়েছে। আদিবার সব কিছুর খরচ বহন করছে। আদিবার চোখের পানি দেখে রানী বেগম আদিবার কাছে এসে বলল।

— আদিবা এই খুশির মুহুর্তে তোমার চোখে পানি?

— আন্টি আমি অনেক লাকি আপনাদের মতো একটা পরিবার পেয়েছি।

— বোকা মেয়ে কান্না করতে নেই। তুমি তো আমাদের একজন।

আদিবা রানী বেগমকে জড়িয়ে ধরে। এর পর কেটে যায় কয়েকদিন। আদনান বাসায় এসে সবাইকে ডাকতে শুরু করে। সবাই এসে উপস্থিত হয়ে যায়।

রানী বেগম বলল — কিরে কি হয়েছে? এতো ডাকাডাকি করছিস কেন?

— আদিবা কোথায়? আদিবাকে ডেকে দাও।

আদিবার কথা বলতে বলতে আদিবা চলে আসে।

আদনান এবার আদিবার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

— আদিবা তোমার স্বপ্ন পূরণ হতে চলছে। তোমার ভিসা রেডি হয়ে গেছে। তিন দিন পরে তোমার ফ্লাইট। ওখানে গিয়ে তোমার চার বছর থাকতে হবে। পড়াশোনা শেষ করে তারপর দেশে আসবে।

কথাটা শুনে সবাই অনেক বেশি খুশি হয়ে যায়। আদিবাও অনেক বেশি খুশি। আদিবা ভাবতেও পারছেনা তার স্বপ্ন যে এভাবে বাস্তব হয়ে যাবে।

দেখতে দেখতে দুই দিন কেটে যায়। কাল আদিবার ফ্লাইট। সবাই খুশি হলেও আদিবাকে ছেড়ে থাকতে হবে তাই সবার একটু মন খারাপ। আদনান ছাদের উপরে একা একা দাঁড়িয়ে আদিবার কথা ভাবছে। আদিবার করা দুষ্টমি গুলো খুব মনে পড়ছে আদনানের। আদিবার ও মন খুব খারাপ। সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে। আদিবা ছাদের উপরে চলে আসে। এসে আদনানের পাশে দাঁড়ায়।

— স্যার!

— হুম বলো।

— আমাকে কি মিস করবেন? আমি চলে যাওয়ার পরে?

আদিবার কথাটা ঠিক আদনানের হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করে। আদনানের বুকের ভিতর টা মোচড় দিয়ে উঠে। কথাটা শুনে আদনানের কঠিন মন টা কেঁদে উঠে। আদনান নিজেকে শান্ত রেখেই বলল,

— মিস করব কি জন্য?

— ওহ। আচ্ছা স্যার আমি তো কাল চলেই যাচ্ছি। আপনাকে তো আর কেউ ঝালাবে না। আমি খুব মিস করব আপনাকে।

আদনানের চোখের পানি টলমল করছে। আদনান অন্য দিকে ফিরে থাকে। আদনান নিজেকে শক্ত রেখে আদিবাকে বলল,

— আদিবা, মন খারাপ করলে তো হবেনা। তোমাকে তো তোমার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। স্বপ্ন পূরণ করতে হবে তোমার। আমি চাই তুমি অনেক বড় ডাক্তার হয়ে ফিরে এসো।

— জি স্যার, আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি যেনো আপনার মতো হতে পারি।

— হুম।

তারপর দু’জন আবার কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে থাকে।

আদিবা আবার বলল — স্যার!

— হুম।

— আপনাদের সবাইকে রেখে যেতে আমার ইচ্ছে করছেনা। আন্টি আংকেল আর আ,,, সবাইকে আমি অনেক মিস করব। জানেন স্যার আপনাদের এই পরিবার কে মনে হয় নিজের পরিবার।

— আমাদের পরিবারের সবাই তোমাকে মিস করবে।

— আপনি?

আদনান বলল — আদিবা অনেক রাত হয়েছে এখন রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কাল সকালে তো আবার এয়ারপোর্টে যেতে হবে।

— স্যার আরেকটু থাকিনা প্লিজ। আজি তো শেষ। কাল থেকে তো আর বিরক্ত হবেন না। কেউ আর জালাতন ও করবে না।

আদনান নিজেকে কন্ট্রোল করতে কেন জানি তার অনেক কষ্ট হচ্ছে। সে আর এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে নিজের রুমে চলে যায়। আদিবা আদনানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর অঝোরে কান্না করতে থাকে। আদনানের জন্য বুকের ভিতর জমে থাকা ভালোবাসার কথা গুলো বলা হলোনা আদিবার। আদিবা কিছুক্ষণ পরে আবার নিজের রুমে চলে যায়।

এদিকে আদনান কিছুতেই দুচোখের পাতা এক করতে পারছেনা। বার বার আদিবার মুখ ভেসে উঠছে। দেখতে দেখতে সকাল হয়ে গেলো। রাতে কেউ ঘুমাতে পারেনি। আদিবা এবার রেডি হয়ে বেরিয়ে আসে। রানী বেগম আরিয়ান চৌধুরী আর আদনান আদিবার জন্য অপেক্ষা করছে। আদিবা এবার রানী বেগমের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। আদিবা রানী বেগমকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করে।

— মারে কান্না করিস না। মাত্র তো চার বছর। আবার তো ফিরে আসবি।

— আন্টি মায়ের ভালোবাসা কেমন হয় তা আপনার থেকে পেয়েছি। কখনো মায়ের ভালোবাসা পাইনি। আপনাকে অনেক বেশি মিস করব। খাবার ঠিক ভাবে খাবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন।

— তুমিও নিজের খেয়াল রেখো। ভালো ভাবে পড়াশোনা করো।

এই কথা বলে আদিবার কপালে একটা চুমু খায় রানী বেগম। রানী বেগমের চোখ দিয়েও পানি পড়ছে।

আদিবা এবার আরিয়ান চৌধুরীকে সালাম করতে নিলে আরিয়ান চৌধুরী আদিবাকে থামিয়ে দিয়ে আদিবাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।

— আংকেল শরীরের যত্ন নিবেন। খাওয়া দাওয়া ঠিক ভাবে করবেন।

— তুমিও নিজের যত্ন নিবে। তুমি চলে গেলে বাড়িটা আবার খালি হয়ে যাবে।

এদিকে আদনান সবার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আদনানের খুব কষ্ট হচ্ছে। আদিবা এবার তাদের থেকে বিদায় নিয়ে আদনানের কাছে আসে।

— স্যার চলুন।

এবার আদনান আর আদিবা গাড়িতে উঠে বসে। আদনান গাড়ি ড্রাইভিং করছে আর আদিবা চুপচাপ বসে আছে। দুজনেই নিশ্চুপ। আদিবা তো কান্না করেই যাচ্ছে। কিন্তু কেউ কারোর সাথে কোনো কথা বলছেনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা এয়ারপোর্টে চলে আসে। আদনান আদিবার সব কাগজ পত্র ঠিক ভাবে বুঝিয়ে দেয়। আদিবার যাওয়ার সময় হয়ে যায়।

— স্যার!

— হুম।

— ভালো থাকবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন।

আদনান মুখে একটা মুচকি হাসি রেখে বলল,

— তুমিই নিজের খেয়াল রেখো। এক যায়গা থেকে আরেজ যায়গায় যাবে একটু খারাপ লাগতে পারে পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।

— ধন্যবাদ স্যার।

— আচ্ছা এখন যাও। ওখানে পৌছে কল দিবে।

এবার আদিবা চলে যেতে থাকে। আদিবার ইচ্ছে করছে শেষ বারের জন্য আদনানকে একবার জড়িয়ে ধরে তার ভালোবাসার কথা বলতে। কিন্তু সেটা আদিবা পারছেনা। আর আদনান আদিবার দিকে তাকিয়ে আছে। আর তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। একটু পরেই আদিবা চলে যায়। আদনান নিজের বাসায় চলে আসে। বাসায় এসে মন খারাপ করে সোফায় বসে আছে। তখন রানী বেগম আদনানের ঘাড়ে হাত রাখে।

— এতো কষ্ট যখন হয় তাহলে মেয়েটাকে যেতে দিলি কেন?

— আম্মু আদিবার স্বপ্ন তো পূরণ করতে হবে। এখানে থাকলে তার স্বপ্ন পূরণ হবে কি করে?

— তুই তো আদিবাকে বলতে পারতি তুই আদিবাকে ভালোবাসিস। আমি জানি আদিবাও তোকে ভালোবাসে।

— আম্মু আমি চাইনা আমার জন্য আদিবার পড়াশোনার ক্ষতি হোক।

রানী বেগম আদনানের মাথায় হাত রাখে আর আদনান রানী বেগমকে জড়িয়ে ধরে। আর বোবাকান্না করতে থাকে। যে কান্নার কোনো শব্দ হয়না।

অন্যদিকে আদিবা পৌছে যায়। আর সে বাসায় গিয়ে আপনাকে তাড়াতাড়ি করে ফোন দেয়। আদনান ও দেরি না করে ফোন রিসিভ করে।

— স্যার আমি মাত্র বাসায় এলাম।

— গুড। বেগ পত্র সব ঠিকঠাক ভাবে নিয়েছ?

— জি স্যার। স্যার আন্টি কোথায়?

আদনান এবার রানী বেগমকে ডেকে। দেয় আদিবাও রানী বেগমের সাথে কথা বলতে শুরু করে। দুজন অনেক্ক্ষণ কথা বলতে থাকে। তারপর ফোন কেটে দেয়।

আদিবার পড়াশোনা শুরু হয়ে যায়। আদিবা সব সময় ফোন দিয়ে যোগাযোগ করে। আদনানের সাথেও অনেক কথা হয়। কিন্তু কেউ কাওকে নিজের মনের কথা বলেনা। দেখতে দেখতে দুই বছর কেটে যেয়।

হঠাৎ করে আদিবা বাসায় এসে আদনানের নাম্বারে কল দেয়। কিন্তু নাম্বার অফ দেখায়। আদিবা বাসার নাম্বারে ও কল দেয় সেই গুলো ও অফ। হঠাৎ করে সবার নাম্বার অফ হওয়ার কারণ কি? আদিবা কিছুই বুঝতে পারছেনা। আদিবা ভাবছে হয়তো তার পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে আদিবার সাথে আদনান যোগাযোগ বন্ধ রাখছে। তারপর ও আদিবা প্রতিদিন কল দেয়। কিন্তু অফ। এভাবে কেটে যায় আরো এক বছর। ওদের বাসার নাম্বারে আদনানের নাম্বার এখনও সব অফ। আদিবা কিছু বুঝতে পারছেনা। সবার কি হয়ে গেলো?

আদিবা সব চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের পড়াশোনায় ফোকাস বাড়াতে থাকে। আদিবা মনে মনে ভাবে আদিবার পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলেই আদনান এমন করছে। আদিবা জানে আদনান ইমেইল তো অবশ্যই চেক করবে। তাই আদিবা ইমেইল করে নিজের পরিস্থিতির সব আপডেট দিতে থাকে। কিন্তু ইমেইল থেকে কোনো রিপ্লাই আসেনা। আদিবা মনে করে আদনাব অবশ্যই ইমেইল দেখে। দেখতে দেখতে আদিবার ডাক্তারি পরিক্ষা শেষ হয়ে যায়। আর ভালো রেজাল্ট করে সে ডাক্তারি পাস করে। আদিবা তাড়াতাড়ি আদনানের ইমেইল করে জানিয়ে দেয়। আদিবা অনেক খুশি। কিন্তু আদনান আর আদনানের পরিবারকে খুব মিস করছে। তারা যদি আজ আদিবার পাশে থাকতো কতই না খুশি হতো। আদিবার এবার দেশে চলে যাওয়ার প্ল্যান করে। দিশে যাওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি নিয়ে নেয়। চার বছর হয়েছে প্রিয় মানুষদের দেখেনা। আদনানের ছবি বুকে নিয়ে রোজ রাতে ঘুমায়। আর ছবির সাথে একা একাই কথা বলে আদিবা।

আদিবা বাংলাদেশ যাওয়ার জন্য বিমানের টিকিট কেটে নেই। কালি আদিবার ফ্লাইট। আদিবা আদনানের ইমেইলে বলে দেয় সে বাংলাদেশে আসবে। আদনান যেনো তার জন্য এয়ারপোর্টে আসে।

পরের দিন আদিবা বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে নামে। নিজের বেগ নিয়ে বের হয়ে। চারপাশে চোখ ভুলিয়ে নেয়। কিন্তু কোথাও তো আদনান নেই। তাহলে আদনান কি আদিবার ইমেইল চেক করেনি? আদিবা আদনানের নাম্বারে ফোন করে। কিন্তু নাম্বার এখনও অফ। আদিবা আরো কিছুক্ষণ আদনানের জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু আদনান তো আর আসেনা। আদিবার মন অনেক বেশি খারাপ হয়ে যায়। আদিবা এবার একটা গাড়ি ঠিক করে আদনানের বাসায় রওয়ানা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আদনানের বাসার সামনে গিয়ে নামে। আদিবা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে এই বাড়ির অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। আদিবা বাসার সামনে গিয়ে দরজার কলিং বেলে চাপ দেয়। ভিতর থেকে একটা অচেনা মহিলা এসে দরজা খুলে।

— কে তুমি?

— আপনি কে?

— আমার বাসায় এসে জিজ্ঞেস করছ আমি কে? তুমি কাকে চাও?

— এটা আদনান স্যারের বাসা না?

— আদনান আবার কে?

— ডাক্তার আরিয়ান চৌধুরীর ছেলে আদনান চৌধুরীর কথা বলছি।

— এই বাড়ি তো আমরা এক বছর আগে নিয়েছি। আর এই নামের কাওকে আমরা চিনি না।

ভদ্রমহিলার কথা গুলো শুনে আদিবা মাথায় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আদিবা কি বলবে বুঝতে পারছেনা। আদিবা তো ভুল ঠিকানায় ও আসেনি। তাহলে এসব কি হচ্ছে? আদিবা সব গুলিয়ে ফেলছে। আদিবা ঠিক করল সে এবার আদনানের হাসপাতালে যাবে। সেখানে গেলে অবশ্যই আদনানের সাথে দেখা হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। একটা গাড়ি নিয়ে আদনানের হাসপাতালে চলে যায়। কিন্তু হাসপাতালের সামনে গিয়ে আদিবার পায়ের তোলার মাটি যেনো সরে যায়। আদিবা দেখে হাসপাতালের গেটের মধ্যে তালা দেওয়া। তালা টা দেখেই মনে হচ্ছে এই হাসপাতাল অনেক দিন ধরে বন্ধ। আদিবা কিছুই বুঝতে পারছিনা। হঠাৎ করে কি হলো?

একটা লোককে আসতে দেখে আদিবা লোকটার কাছে চলে যায়।

— আংকেল। এই হাসপাতাল বন্ধ কেন?

— এই হাসপাতাল তো আজ দুই বছর ধরেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

— কেন কি হইছে?

— আসলে মা কি বলব। আল্লাহ ভালো মানুষদের খুব তাড়াতাড়ি নিজের কাছে ডেকে নিয়ে যায়।

এই কথা শুনে আদিবার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠে।

— মানে? কি হইছে আংকেল?

— শুনেছি এই হাসপাতালে মালিক আরিয়ান চৌধুরী ও তার পুরো পরিবার গাড়ি এক্সিডেন্ট দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। তারপর থেকে এই হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যায়।

এই কথা শুনে আদিবার পায়ের তোলার মাটি সরে যায়। আদিবা যেনো কিছুতেই নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছেনা। এটা সে মেনে নিতে পারছেনা যে আদনানের পরিবারের কেউ আর বেঁচে নেই।

চলবে?