এক মুঠো রোদ্দুর পর্ব-১৬

0
294

#এক_মুঠো_রোদ্দুর
[পর্ব – ১৬]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

আদিবা আদনানের মতো কাওকে দেখে তাড়াতাড়ি করে গাড়ি থামাতে বলে। ড্রাইভার দেরি না করে গাড়ি থামিয়ে দেয়। আদিবা এক মিনিট ও দেরি করেনি। তাড়াতাড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে লোকটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। যতই সে এগুচ্ছে ততই তার হার্ট বিট ক্রমশ বাড়তে থাকে। আদিবা খুব দ্রুত লোকটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

আদিবা যখনই স্যার বলে ডাক দিবে তখনই লোকটা পিছনের দিকে তাকায়। সাথে সাথে আদিবার ভাবনা গুলো এক নিমিষেই হারিয়ে যায়। কারণ সামনে যে আছে সে আদনান নই। অন্য কেউ। আদিবা লোকটাকে কিছু না বলে মাথা নিছু করে গাড়িতে এসে বসে। গাড়িতে বসে কান্না করতে শুরু করে। তারপর সে হাসপাতালে চলে যায়। হাসপাতালে এসে আদিবার কোনো কিছুই ভালো লাগছেনা। আদিবা মন খারাপ করে বসে থাকে। আদিবার মন খারাপ দেখে নীল এসে বলল।

— ম্যাম কি হয়েছে আপনার? তখন থেকেই দেখছি আপনার মন খারাপ।

— কিছু হয়নি তো।

— ওহ আচ্ছা। পাশের কেবিনে একটা রোগী আসছে। ছেলেটার সাথে মনে হয় খারাপ কিছু হইছে দেখতে যাবেন?

— নতুন আসছে নাকি?

— জি অন্য একটা হাসপাতাল থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। অবস্থা তেমন বেশি ভালো নই। সব থেকে বড় কথা ছেলেটা কোমায় চলে গিয়েছে।

— ওহ। অন্য কোনো ডাক্তার কি দেখেনি?

— জি দেখেছে।

— ওহ তাহলে তো আমার না গেলেও হবে। আমার জন্য একটা চা নিয়ে আসুন।

নীল এবার আদিবার জন্য চা করে নিয়ে আসে। আদিবা চা খাওয়া শেষ করে উঠে অন্য রোগীদের দেখতে যায়।

অন্যদিকে কোমায় থাকা ছেলেটার অবস্থা খুব খারাপের দিকে যেতে থাকে। হঠাৎ করে ছেলেটার নিশ্বাস ভারী হতে থাকে। তখন কেবিনের ভিতরে চিৎকার শুরু হয়ে যায়। ছেলেটার বাবা ডাক্তার ডাক্তার বলে চিৎকার করতে থাকে। সাথে সাথে একটা ডাক্তার চলে আসে।

— ডাক্তার আমার ছেলেকে দেখুন ও কেমন জানি করছে।

— দাড়ান আমি দেখছি।

সাথে সাথে ডাক্তার ছেলেটাকে পরিক্ষা করতে থাকে। কিন্তু ডাক্তার ভালো ভাবে কোনো কিছুই ধরতে পারছেনা। ডাক্তার হতাশ হয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে আদিবার কাছে চলে গেলো।

— ম্যাম আসবো?

— জি।

— ম্যাম আমার সাথে একটু চলুন। সাত নাম্বার কেবিনের রোগীর অবস্থা খুব ক্রিটিকাল। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।

— চলুন তাড়াতাড়ি।

এই কথা বলে দু’জন ছেলেটার কেবিনে প্রবেশ করে। আদিবা ছেলেটার পরিক্ষা করতে শুরু করে। কিন্তু আদিবা একবার ও এখনও ছেলেটার মুখের দিকে তাকায়নি। আদিবা ছেলেটার মেডিক্যাল রিপোর্ট গুলো ভালো ভাবে চেক করতে থাকে। চেক করে এবার আদিবা ছেলেটার দিকে তাকাতেই হতবাক হয়ে গেলো। আদিবার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ে। কারণ বেডের মধ্যে শুয়ে থাকা লোকটা আর কেউ না। এটাই আদনান চৌধুরী।

আদিবা একটা চিৎকার দিয়ে আদনানের কাছে চলে গেলো।

— আর আপনাকে আমি কতো যায়গায় খুজেছি। কোথাও আপনাকে পায়নি। আমার বিশ্বাস ছিল আমি আপনাকে একদিন ঠিক খুঁজে পাবো। আজ আমি আপনাকে খুঁজে পেয়েছি। তাও এই অবস্থায়।

আদিবা এই কথা বলে আদনানকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করে। আদিবার এসব কথা শুনে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তার এ চুপচাপ হয়ে গেলো। সে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। সে হতবাক হয়ে আদিবার দিকেই তাকিয়ে আছে। আদিবার চিৎকার শুনে ছেলেটার বাবা ভিতরে চলে আসে কিছুক্ষণের মধ্যেই।

— ডাক্তার আমার ছেলে ঠিক আছে তো?

লোকটা আদনানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল। আদনান বলে ফেললাম। কারণ ওর নাম এখনো আমরা জানিনা। আদিবা আদনান মনে করছে তাই আমিও বললাম। যাইহোক।

আদিবা এবার লোকটাকে জিজ্ঞেস করল,

— উনি আপনার কে হয়?

— ও আমার ছেলে।

— কিহ! উনি আপনার ছেলে হয় কীভাবে? উনি তো ডাক্তার আদনান চৌধুরীর।

আদিবার কথা শুনে ভদ্রলোক বলল — কি বলছেন এসব? ও তো আমার ছেলে আদিল।

— দেখুন মিথ্যে কথা বলবেন না।

পাশে থাকা ডাক্তার বলে উঠলো — এখানে এভাবে কথা বলা ঠিক হবে না। রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। আপনারা বাহিরে গিয়ে কথা বলুন।

আদিবা আদনানের কাছে গিয়ে কান্না করতে করতে বলল — স্যার আপনার কিছু হবেনা। আপনি ঠিক হয়ে যাবেন।

ডাক্তার আর পাশে থাকা ভদ্রলোকটা অবাক হয়ে আছে। এবার সবাই বের হয়ে আসে।

— আংকেল প্লিজ সত্যি কথা বলুন। আপনি আদনান স্যারকে কোথাও পেয়েছেন।

— আপনি একজন ডাক্তার হয়ে কীসব বলছেন আমি তো আপনার কথা বুঝতেই পারছিনা। ও আমার ছেলে আদিল।

— না, এটা হতে পারেনা। উনি আদনান চৌধুরী। আমার এতো বড় ভুল কখনও হতে পারেনা। আপনি আমার সাথে মিথ্যে বলছেন। আমি আদনান স্যারকে খুব ভালো করেই চিনি।

— আজব মেয়ে তো তুমি। আমি বলছি ও আমার ছেলে আদিল। আর তুমি কি আবল তাবল বলেই যাচ্ছ।

— আংকেল বিশ্বাস করুন। আদনান স্যারের পুরো পরিবার একটা এক্সিডেন্টে প্রাণ হারায়। আমার বিশ্বাস ছিল আদনান স্যার যেখানেই থাকুক উনি বেঁচে আছেন।

— দেখো তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।

আদিবা নিজের ফোন বের করে আদনানের আগের ছবি গুলো বের করে লোকটাকে দেখাতে থাকে। কিন্তু সে কিছুতেই বিশ্বাস করছেনা যে এটা আদনান। পাশে থাকে ডাক্তার ও ছবি গুলো দেখে অবাক হয়ে গেলো। কারণ এই ছবি আর রোগীর চেহারা হুবহু এক।

ডাক্তার এবার আদিবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

— ম্যাম এক চেহারার মানুষ থাকতে পারে। হয়তো আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। উনি তো বলছে এটা ওনার ছেলে। আপনি বলছেন আদনান। প্রমাণ ছাড়া তো এগুলো বের করা সম্ভব নই।

— আমার কাছে তো স্যারের ছবি আছে। আর কিসের প্রমাণ চাই আপনাদের? আদনান স্যারের পুরো পরিবারের ছবি তো আপনাদের দেখালাম।

— ছবি তে তো সব প্রমাণ হয়ে যায়না। যাইহোক রোগীর মুখ থেকে তো জবানবন্দি নিতে হবে। আসলে সে কে?

— কিন্তু আদনান স্যার তো এখন কথা বলার অবস্থায় নেই।

— আমি জানি ম্যাম। এখন রোগী সুস্থ না হওয়া অব্দি আমাদের হাতে কিছু করার নেই।

— যে ভাবেই হোক আমি ওনাকে সুস্থ করে তুলবো। দরকার হলে স্যারের দেখা শোনা আমি করব।

হঠাৎ করে একটা মহিলা এসে লোকটার কাছে বলল — ওগো আমার আদিল এখন কেমন আছে?

মহিলাকে দেখে আদিবা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কারণ মহিলাকে আদিবার কেন জানি পরিচিত মনে হচ্ছে। কিন্তু কোথায় দেখেছে সেটা ঠিক মনে করতে পারছেনা।

মহিলা এবার ডাক্তারকে বলল — ডাক্তার আমার ছেলে এখন কেমন আছে? আমার ছেলেটা কি ঠিক হবে না? সে কি আমাকে আর কখনও মা বলে ডাকবেনা?

মহিলা এসব বলছে আর কান্না করছে। আদিবা এবার মহিলাকে বলল — আন্টি আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।

মহিলা আদিবার দিকে তাকিয়ে বলল – কি বলবেন বলেন?

— আপনি কি আমাকে চিনেন? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি আপনাকে এর আগে কোথাও দেখেছি।

ভদ্রমহিলা কিছু বলতে যাবে তখনই তার স্বামী বলে উঠে — আপনার সমস্যা কি? একবার বলেন আমার ছেলেকে চিনেন আরেকবার বলেন আমার স্ত্রীকে চিনেন। আপনার ব্যাপার টা তো ভালো মনে হচ্ছেনা। আপনি কি এখানকার ডাক্তার নাকি অন্য কিছু?

আদিবা কিছু বলতে যাবে তখনই ডাক্তার আদিবাকে বলল — ম্যাম আপনি আমার সাথে চলুন।

এই কথা বলে ডাক্তার আদিবাকে নিয়ে তার কেবিনে চলে যায়। আদিবা বলল,

— বিশ্বাস করুন আমি রোগীকে খুব ভালো ভাবে চিনি। ওড়না আমাদের সাথে মিথ্যা কথা বলছে।

— মিথ্যা বললেও তো আমাদের কিছু করার নেই। কারণ উপযুক্ত কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। সব কিছুর প্রমাণ হচ্ছে এই রোগী। রোগী যদি নিজের মুখে শিখার করে তাহলে প্রমাণ হবে এটা আদনান নাকি আদিল! এখন আপনি কিছু বলতে গেলে তারা আপনাকে অপমান করে কথা বলবে। তার চেয়ে ভালো আমরা অপেক্ষা করি। রোগী সুস্থ হওয়া পর্যন্ত। দেখুন ম্যাম আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছু তো করার নেই। তারা তো আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার ও করতে পারে।

আদিবার চোঝ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আদিবা কোনো কথা বলছেনা।

ডাক্তার এবার নীলকে ডাক দিতেই নীল তাড়াতাড়ি করে চলে আসে। নীল এসে দেখে আদিবার চোখে পানি।

— ম্যাম আপনি কান্না করছেন কেন কি হয়েছে আপনার?

আদিবা কান্না করেই যাচ্ছে।

— ম্যাম কি হয়েছে?

ডাক্তার বলল — নীল ম্যাম কে বাসায় নিয়ে যাও।

— ডাক্তার সাহেব ম্যামের কি হইছে?

— তেমন কিছু হয়নি। তুমি নিয়ে যাও। আর আদিবা আমি এখানে আছি চিন্তা করবেন না। হয়তো আপনার ও ভুল হচ্ছে।

নীল এবার আদিবাকে নিয়ে গাড়ির সামনে চলে যায়।

— তোমাকে আসতে হবে না আমি একাই যেতে পারবো।

— ঠিক আছে ম্যাম।

এই কথা বলে নীল চলে গেলো। আদিবা এবার গাড়িতে উঠে বসে। আদিবার হঠাৎ মনে হলো আপনাকে এভাবে একা ছেড়ে দিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। আদিবা এবার গাড়ি থেকে নেমে আবার হাসপাতালের দিকে চলে যেতে থাকে।

চলবে?