এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-১৭+১৮

0
290

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৭.

একজন সৈনিকের পায়ের গতিকে ঘোড়ার পায়ের গতির সাথে তুলনা করা হয়। সেই হিসেবে দৌড়ে বিশ মিনিটের রাস্তা পাড় করে প্রধান সড়ক পর্যন্ত পৌঁছানো সাইফ আর প্রত্যয়ের জন্য কোনো বড় বিষয় নয়। কিন্তু আচমকা একটা গলির মোড় ঘুরতে গিয়ে বাধে বিপত্তি। হঠাৎ দুই যুবককে নিজের স্কুটির সামনে দেখে ব্রেক কষারও সময় পায় না বাইকের মালিক। উল্টো দুর্ঘটনা হতে রেহাই পেতে সে বাইকটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে ফেলে। ফলে সজোরে রাস্তার পাশে এক ভ্যান গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বাইক সহ উল্টে পড়ে সে।

আকস্মিক ঘটনায় প্রত্যয় এবং সাইফও চমকে উঠে। এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো এই বুঝি স্কুটির নিচে পড়ে হাত অথবা পা কিছু একটা খোয়াবে। কিন্তু আল্লাহ রহম করেছেন যে সেরকম কিছুই হয়নি। ভাবনাটা মনে উঁকি দিতেই সাইফ বুকে ফুঁ দিয়ে রাস্তার পাশে তাকায়। সাথে সাথেই তার মেজাজ বিগড়ে যায়। সে গলা উঁচু করে চেচিয়ে উঠে,

“ শালার মাইয়া মানুষের হাতে স্কুটির চাবি দিলে এক্সিডেন্ট তো হইবোই। “

প্রত্যয়ও দেখলো রাস্তার পাশে বাইক সহ পড়ে থাকা একটা নারীকে। এক পা তার বাইকের তলে চাপা পড়ে আছে। অন্য হাতে সে ভর দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করছে এবং ব্যথায় উউউ জাতীয় শব্দ করছে। প্রত্যয় অবশ্য সাইফের মতো রাগ কিংবা বিরক্তি দেখালো না। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় মেয়েটাকে সাহায্য করতে। কিন্তু তার পূর্বেই রণচণ্ডী রূপী সেই মেয়েটা পিছনে ফিরে চেচিয়ে উঠে,

“ মাঝরাস্তায় পাগলের মতো দৌড়ানোর মানে কি? “

প্রত্যয় মেয়েটাকে দেখেই অবাক হলো। এটা সেই লাইব্রেরীর ঝগড়াটে মেয়েটা না? মেয়েটাও প্রত্যয়কে দেখে এক মুহুর্ত অবাক হয়। পরমুহূর্তেই সে ফের চেচিয়ে উঠে,

“ এই? আপনি ওই লাইব্রেরীর গালিগালাজ ভাইয়াটা না? “

প্রত্যয় বিরক্ত হয়। গালিগালাজ ভাইয়া? এটা আবার কেমন নাম? আর তাছাড়া প্রত্যয় নিজের সম্পূর্ণ জীবনে কখনো গালি উচ্চারণ করে নি। তার সাথে এই বেমানান নাম জুড়ে দেওয়ার মানে কি? প্রত্যয় কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই সাইফ এগিয়ে গিয়ে জেসির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠে,

“ আরে ম্যানারলেস, মাথামোটা ভাবী। আপনি? উঠেন উঠেন। আমার হাত ধরে উঠে আসেন। ইশ! বেশি ব্যথা পেয়েছেন? “

সাইফের এই আলগা পিরিত দেখে প্রত্যয়ের গা জ্বলে যায়। অপরদিকে জেসি ক্রোধ মিশ্রিত গলায় বলে উঠে,

“ এই ভাই! কে আপনি? আমাকে ম্যানারলেস আর মাথামোটা ভাবী ডাকছেন কেন? “

সাইফ দাঁত কেলিয়ে বলে,

“ ভাবী, আমি আপনার গুণধর দেবর। আর আপনার সাথে এই ম্যানারলেস আর মাথামোটা ট্যাগটা আমি বসাই নি। প্রত্যয় বসিয়েছে। “

প্রত্যয় বিড়বিড়িয়ে উঠে,

“ পাগলের সাথে ম্যা ম্যা করা ছাগলের দেখা হয়েছে। এখন দুই পাগল ছাগল মিলে আমার আমার মাথা খাবে৷ “

জেসির চরম মেজাজ খারাপ হয়। সে সাইফকে কিছু বলতে নিবে তার আগেই সাইফ এগিয়ে এসে তার পায়ের উপর থেকে স্কুটি তুলতে তুলতে বলে,

“ সরি ভাবী। আপনাকে হেল্প না করে এতক্ষণ ধরে প্যাঁচাল পারতেসি। “

পায়ের উপর হতে স্কুটাটা সরাতেই যেনো জেসি খানিকটা আরাম পেলো। পা টা একদম ঝিম ধরে আসছিলো। অপরদিকে বাম হাতের কনুইয়ের দিকটাও রাস্তার সাথে ঘষা লেগে চামড়া উঠে গিয়েছে। কি বিশ্রী ভাবে জ্বলছে আহত জায়গাটা। ব্যথায় জেসির লটকে রাখা মুখটা আরো কুচকে আসে। প্রত্যয় সেই দৃশ্য দেখে অনিচ্ছা স্বত্বেও হিউম্যান কার্টেসি মেইনটেইন করতে নিজের হাতটা বাড়িয়ে বলে,

“ রাস্তায় এভাবে পড়ে থাকাটা বাজে দেখাচ্ছে। উঠে আসুন। “

জেসি কুচকে রাখা চোখ জোড়া মেলে রাজহাঁসের গলায় চেচিয়ে উঠে,

“ আমাকে এই রাস্তায় আপনারাই ফেলেছেন। অসভ্য, অভদ্র, ম্যানারলেস কোথাকার। আপনাদের বাঁচানোর চক্করে আমি আহত হলাম আর আপনারা কিনা থ্যাঙ্কিউ না বলে আমাকে পাগলের মতো আজেবাজে নামে ডাকা শুরু করে দিয়েছেন। “

প্রত্যয় আর কিছু বলতে নিবে তখনই পিছন হতে ভেসে আসে চার পাঁচজন লোকের গলা। সাইফ তখন জেসির স্কুটিটা তুলে তা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত ছিলো। কিন্তু কিছু মানুষের পদধ্বনি ও গলার স্বর শুনে সে পিছু ফিরে তাকায়। মুহুর্তেই তার মুখের রঙ পরিবর্তন হয়। মানুষগুলো কেমন চটে আছে তা তাদের চেহারাতেই স্পষ্ট ফুটে আছে। দু তিনজনের হাতে লাঠি জাতীয় জিনিসও দেখা যাচ্ছে। সাইফ তা দেখে ভাবে এই লাঠির আঘাত তার গায়ে পড়লে সাইফের কিছু না হলেও তার এই সুঠাম দেহের বেশ অপমান হবে। সেই অপমান সাইফ কখনো মেনে নিতে পারবে না। উপস্থিত বুদ্ধি অনুযায়ী সাইফ দ্রুত ভঙ্গিতে স্কুটিটায় বসে চাবি ঘুরিয়ে প্রত্যয়কে তাড়া দেয়,

“ মামা! পাবলিক চেইত্তা গেসে। ইজ্জত আর জান বাঁচানো ফরজ। তাড়াতাড়ি বয় তুই। “

প্রত্যয়ের একহাত তখনো জেসির দিকে বাড়ানো। সে ঘাড় ঘুরিয়ে লাঠি হাতে আসন্ন একদল পুরুষকে দেখছিলো। সাইফের কথা কানে প্রবেশ করতেই সে-ও দ্রুত দৌড়ে স্কুটির পিছনে উঠে বসে। জেসি বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে দেখছিলো সেই দৃশ্য। সে দ্রুত উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে নিলেই সাইফ স্কুটি স্টার্ট দিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠে,

“ আপনার স্কুটি আপনার রোমিও সহ আপনার ঠিকানা অনুযায়ী পাঠিয়ে দিবো ভাবী। ফিকার নট। “

জেসি পিছন থেকে চিৎকার করে উঠে,

“ কুত্তা, লাফাঙ্গা আমার স্কুটি ফেরত দিয়ে যা। “

গোলাপি রঙা স্কুটির পিছনে বসা প্রত্যয়ের কানে পৌঁছায় জেসির চিৎকার। সে ঘাড় সামান্য ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখে রণচণ্ডী সেই নারী রাস্তার এককোণ হতে ছোট ইটের টুকরো তুলে তাদের দিকে নিশানা করে ছুড়ে এবং বলে,

“ মামলা করবো আমি। চুরির মামলা। তোদের জেলের ভাত খাইয়ে বদহজম না হওয়ালে আমি আলাউদ্দিনের মেয়ে জেসি না। “

__________

কর্ণফুলীর নদীর ঠিক পাশেই ইচ্ছানগর নামক জায়গাটা। কালো জিপটা মফস্বল এরিয়া পেরিয়ে কিছুটা নিরিবিলি একটা এরিয়ায় প্রবেশ করে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তা থামে জনমানবহীন একটা একতলা বাড়ির উঠোন সীমানার বাহিরে প্রধান ফটকের দ্বারপ্রান্তে। গাড়িটা থামিয়েই দূর্জয় চট করে তাকায় নিজের পাশের সিটে উপস্থিত নারীর পানে।

সিটের উপর দুই পা তুলে তা ভাজ করে বুকের কাছে ঠেকিয়েছে। দু’হাতের সাহায্যে আড়াআড়িভাবে নিজের বাহু চেপে ধরে একপাশে হেলে রয়েছে দূর্বল দেহটা। চল্লিশ মিনিটেরও অধিক এই পথ পাড়ি দেওয়ার সময় প্রথম বিশ মিনিট বাণী জেগেই ছিলো। কিন্তু শরীরটা ধীরে ধীরে নিস্তেজ অনুভূত হতেই সে আর চোখ মেলে রাখতে পারে না। গায়ের রেইনকোটটার ভেতর তপ্ত দেহটাকে যথাসাধ্য লুকিয়ে জড়সড় ভঙ্গিতে একপাশে হেলে বসে। একটা পর্যায় ধীরে ধীরে চোখ লেগে আসে তার।

সম্পূর্ণ ঘটনাটা দূর্জয়ের উপস্থিতিতেই ঘটেছে। দূর্জয়ও এ নিয়ে বাণীকে বাধ সাধে নি। মেয়েটা অসুস্থ তা যে কেউ দেখে হলফ করে বলে দিতে পারবে। কিন্তু মেয়েটাকে ঘিরে রাখা প্রশ্ন ও রহস্য আঁচ করা মুশকিল বটে।

আপাতত দূর্জয় পড়েছে সংশয়ে। তার পাশের সিটে ঘুমন্ত এই নারীকে তার সজ্ঞান ব্যতীত ছুঁতেও তার বিবেকে বাঁধছে। তার উপর এই নারী বর্তমানে বিবাহিত এবং এক সন্তানের জননী। বিষয়টা দূর্জয়ের জন্য অস্বস্তিকরই বটে। সে বাণীকে রেখে একাই গাড়িটা হতে নেমে যায়। বৃষ্টি থেমেছে বহু আগে। তবে প্রকৃতি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে সতেজতার ছাপ।

দূর্জয় নিজের পকেট হাতড়ে বের করে একটা চাবি। চাবিটার সাহায্যে প্রধান ফটকটা খুলেই তা সম্পূর্ণটা ঠেলে একপাশে সরিয়ে প্রবেশ দ্বার উন্মুক্ত করে সে। অত:পর ফের গাড়ির ভেতর বসে ড্রাইভ করে গাড়িটাকে ইট পাথরের তৈরী উঠোনে প্রবেশ করে। আবার গাড়ি হতে নেমে প্রধান ফটকটা টেনে তা ভেতর থেকে লক করে চাবির সাহায্যে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে সে। বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে অন্ধকার ঘরটাকে আলোকিত করার উদ্দেশ্যে সে সব লাইট জ্বালিয়ে দেয়।

জীর্ণ শীর্ণ দেহটা দু’দিনের জ্বরে যেনো আরো খানিকটা শুকিয়ে গিয়েছে। সেই নেতানো দেহটা শক্ত দু হাতের সাহায্যে তুলে হাঁটতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছে-না দূর্জয়ের। বাড়ির ভেতর প্রবেশের ঠিক আগ মুহুর্তে তার অবচেতন মস্তিষ্কে হানা দেয় বহু পূর্বে তার দাদীর মুখে শোনা একটা কথা। এই ইচ্ছানগরের বাড়িটা দূর্জয়ের বাবা রিফাতি বহু শখ করে বানিয়েছিলেন। বাড়িটাতে প্রথম যেবার দূর্জয়ের মাকে সহ রিফাতি এসেছিলো, সেবার নাকি লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বউকে কোলে তুলেই গৃহপ্রবেশ করেছিলো সে।

আচমকা এই কথা মনে পড়ার কারণ খুঁজে পায় না দূর্জয়। মনে মনে নিজের প্রতিই সে বিরক্ত হয়। অত:পর বাণীকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেই বসার ঘর পেরিয়ে পশ্চিম দিকের ঘরটার দিকে এগোয় সে।

ঘুমন্ত বাণীকে কাঠের তৈরী পালঙ্কে শুইয়ে দিয়েই দূর্জয় ফোন বের করে একটা নাম্বার ডায়াল করে। একবার রিং হতেই কলটা রিসিভ হয়। অপরপাশ হতে জুলফিকার চিন্তিত গলা শুধায়,

“ দূর্জয়! মাই বয়। আর ইউ ওকে? “

“ ইয়েস স্যার। “

“ কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো। হঠাৎ কল করে আমাকে বললে যেনো হসপিটালের বেসমেন্টের ফুটেজ ডিলিট করার ব্যবস্থা করি। আবার বলছো ব্যাপারটা পার্সোনাল। ইজ এভ্রিথিং ওকে? “

“ স্যার, আপাতত আরেকটা হেল্পের প্রয়োজন। যত দ্রুত সম্ভব বাবার ইচ্ছানগরের বাড়িটায় একটা মহিলা ডাক্তার পাঠান। শি হ্যাভ টু বি কনফিডেনসিয়াল অলসো। “

দূর্জয়ের কথার ভঙ্গিমায় জুলফিকারের চিন্তার পরিধি আরো বাড়ে। কি হয়েছে ছেলেটার? দূর্জয় সামান্য তাড়া দেখিয়ে বলে,

“ সরি স্যার কিন্তু ব্যবস্থাটা দ্রুত করলে ইট উইল বি এ বিগ হেল্প। আমি ইনশাআল্লাহ আগামীকাল হেডকোয়ার্টারে এসে আপনাকে একান্তে সব খুলে বলবো। “

জুলফিকার আর বিষয়টা তেমন একটা ঘাটায় না। দূর্জয় যেহেতু বলেছে সে নিজেই সময়মতো বলবে সেখানে আর এতো তাড়াহুড়ো দেখানোর কিছু নেই। ছেলেটার কাণ্ডজ্ঞান বেশ ভালো। জুলফিকার নিজ হাতে ওকে তৈরী করেছে। চোখ বুজে ভরসা করতেও কখনো দ্বিধা করবেন না তিনি। জুলফিকার আশ্বস্ত করে বলে,

“ আমি ব্যবস্থা করছি। চিন্তা করো না। টেক কেয়ার। “

ফোনটা কান থেকে নামিয়ে রেখে দূর্জয় বাণীর পানে তাকায়। তার মনে জমে রয়েছে অসংখ্য প্রশ্ন। বাণী কার থেকে বারবার পালাচ্ছে? এই অবস্থায়ই বা তার কি করে হলো? আর বাণীর পরিবার কোথায়? সম্পূর্ণ ব্যাপারটা দূর্জয়ের জানতে হবে।

__________

ঘুমন্ত নিশার কেবিনে বসে আছে জুলফিকার। নাঈমাকে আজ নিশা খুব বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসায় পাঠিয়েছে। একটানা লাগাতার এভাবে হসপিটালে থেকে চেহারার বিধ্বস্ত অবস্থা করে ফেলেছিলো সে। তার উপর আবার নাঈমার কোমড়ের ব্যথার সমস্যা রয়েছে। সামান্য ঠান্ডা লাগলেই ব্যথাটা হু হু করে বেড়ে যায়। এই বিষয়গুলো জুলফিকার ভুলে নি। কিন্তু যদি সে সরাসরি নাঈমাকে এ কথা বলতে যেতো তাহলে শুধুশুধুই কথা কাটাকাটি এবং তর্কের সৃষ্টি হতো আবার। তাই সে খুব সূক্ষ্ম বুদ্ধিটা মেয়ের মাথায় পাচার করে দিয়ে নিশার মাধ্যমে নাঈমাকে রাজি করিয়েছে।

নিজের চালাকির কথা ভেবে একা একা সামান্য হাসে জুলফিকার। ঠিক সেই মুহুর্তে তার হাতের ফোনটা ভাইব্রেট করে বেজে উঠে। জুলফিকার এক দন্ড ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে নামটা পড়ে নেয়। সাইফ। এই ছেলে এতো রাতে ফোন করছে কেনো? জুলফিকার কল রিসিভ করে কানে ধরতেই সাইফ বলে উঠে,

“ আসসালামু আলাইকুম স্যার। কিছু মনে না করলে যদি একটু কেবিনের বাহিরে আসতেন। “

জুলফিকার ঠান্ডা স্বরে আসছি বলে কলটা রেখে দেয়। কেবিনের বাহিরে বের হতেই জুলফিকার দেখে সাইফ, রাফি এবং একটা বধূবেশে মেয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। জুলফিকার কোনো প্রশ্ন করতে নিবে তার আগেই সাইফ বুলেট গতিতে বলে উঠে,

“ স্যার। এই মেয়ের নাম অন্যা। রাফি ওকে ভালোবাসে। অন্যাও রাফিকে ভালোবাসে। কিন্তু অন্যার হিটলার বাপ ওকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিচ্ছিলো। উনার মতে রাফি একটা অযোগ্য ছেলে। আর সৈন্যদের সম্পর্কে যথেষ্ট বিরূপ ধারণা পোষণ করেন তিনি। যেহেতু এই মুহুর্তে এই বড় শহরে রাফির নিজের কোনো গার্ডিয়ান নেই তাই অন্যাকে তুলে ওদের দু’জনকে নিয়ে সোজা আপনার কাছে চলে এলাম। আপনি জ্ঞানী ও বিচক্ষণ মানুষ। আপনি জানেন ওরা চাইলেও এই মুহুর্তে বিয়ে করতে পারবে না। কার রাফি এখনো লেফটেন্যান্ট পদে রয়েছে। কিন্তু ইনশাআল্লাহ আমার বিশ্বাস ও খুব শীঘ্রই পদোন্নতি পাবে। খালি ততদিন পর্যন্ত যেনো অন্যার বিয়েটা আটকে রাখা যায় সেরকম একটা ব্যবস্থা করে দিন প্লিজ। আপনি অন্যার বাবার সাথে কথা বলুন। আপনার মতো একজন বড় মাপের মানুষের কথা তিনি নিশ্চয়ই আমলে নিবেন। উনাকে আশ্বাস দিন যে রাফির সাথে অন্যার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত নয়। প্লিজ স্যার প্লিজ। “

সাইফের বুলেট গতিতে বলা কথা থামতেই রাফির বুক ধকধক করতে থাকে। মনে মনে বলে,

“ প্রত্যয় ঠিকই বলে। এই ছেলে নিজেও পাগল, তার আশেপাশের সবাইকেও পাগল বানিয়ে ছাড়বে। “

জুলফিকার সরু চোখে এতক্ষণ মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় সাইফের সব কথা শুনেছে। সম্পূর্ণটা শুনে তিনি ঠান্ডা গলায় সাইফকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ তুমি পাঁচ মিনিট ভিতরে গিয়ে দাঁড়াও। আমি ওদের সাথে একান্তে কিছুক্ষণ কথা বলতে চাই। “

সাইফের ঠোঁটে ফুটে উঠে বিশ্ব জয়ের হাসি। সে মাথা নেড়ে জুলফিকারকে থ্যাঙ্কিউ বলে কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করে। কেবিনে প্রবেশ করতেই তার দৃষ্টি স্থির হয় নিশার দিকে। সাইফ একগাল হেসে ঘুমন্ত নিশার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ সুখী মানুষের সবাইকে সুখী দেখতে ভালো লাগে। আপনিও সুখী হন মিস ইয়াসমিন। “

__________

অন্ধকার ঘরে একটা শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। সে চিৎকার করে ডাকছে নিজের মা কে। বাণী সেই চিৎকার অনুসরণ করে দৌড়ে যায়। কিন্তু কাউকে পায় না। আবার সেই শিশু স্বর কান্না মিশ্রিত স্বরে বলে উঠে,

“ তুমি আমাকে একা রেখে চলে গিয়েছো কেনো মাম্মা? তুমি আমাকে ভুলে গিয়েছো। “

কথাটা কানে এসে পৌঁছাতেই বাণী দেখে অন্ধকার চিড়ে ধীরে ধীরে বহ্নি বেরিয়ে আসছে। বাণীকে দেখেই সে ঘৃণাভরা দৃষ্টি মেলে বলে উঠে,

“ আই হেট ইউ মাম্মা। “

ছোট স্বপ্নটুকু দেখেই বাণী আতংক নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে। এখনো তার বুক ঢিপঢিপ করছে। তার মেয়েটা কেমন আছে? বহ্নি তাকে ভুল বুঝবে না তো? বাণীর ভাবনার মাঝেই গম্ভীর একটা স্বর বলে উঠে,

“ গুড মর্নিং। “

বাণী আতংক নিয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে বেতের তৈরী একটা এক সিটের সোফায় বসে আছে দূর্জয়। দৃষ্টি তার ফোনের স্ক্রিনে নিবদ্ধ। বাণী একটা ঢোক গিলে। বোঝার চেষ্টা করে সে এখন কোথায় আছে। দূর্জয় এতো ভনিতা না করে ফোনটা পকেটে ভরে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়। বিছানার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট গলায় বলে,

“ গায়ে জ্বর আছে। গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলে। এটা আমার বাড়ি। আপাতত এখানেই অবস্থান করছো তুমি। রাতে একজন ডক্টর এসেছিলো। উনি জ্বর পরীক্ষা করে তোমার গায়ের জামা বদলে দিয়ে গিয়েছে। সঙ্গে কিছু ওষুধও দিয়ে গিয়েছে। সেসব নিয়ে আপাতত পরে কথা হবে। আমি তোমার কথা অনুযায়ী তোমার আবদার রেখেছি। এখন তুমি আমাকে সত্যটা জানাও। “

দূর্জয়ের শেষ কথাটা শুনতেই বাণী যেনো সম্বিত ফিরে পায়। হ্যাঁ। তার তো শর্তমতে এখন সত্য জানানোর কথা। কিন্তু বাণীর প্ল্যান ছিলো যে সে সত্যি জানানোর পূর্বেই দূর্জয়ের চোখে ধূলো ছুড়ে পালাবে। দূর্জয়কে কিংবা অন্য কাউকে এসব বিষয়ে জড়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার নেই। সে চায় না অন্য কারো পরিণতিও সাত বছর পূর্বের সেই কালো রাতের মতো হোক। বাণী চায় না নতুন করে আরেকটা খুনের সাক্ষী হতে।

বাণীকে ভাবনায় বুদ দেখে দূর্জয় এবার বলে উঠে,

“ দেখো আমি কথা ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলা যথেষ্ট অপছন্দ করি। গতকাল রাতে যেই ফিমেল ডক্টর এসেছিলো উনার ভাষ্যমতে শি ফাউন্ড সাম মার্কস এন্ড স্ক্র্যাচেস ইন ইউর বডি। সেই দাগ গুলো কিসের হতে পারে সেই সন্দেহ সম্পর্কেও উনি আমাকে জানিয়েছেন। তাই যদি তোমার মনে হয় তোমার মনগড়া কোনো কথা শুনে আমি নিজের সময় নষ্ট করতে এখানে বসে আছি তাহলে তোমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। “

সবটা শুনে বাণী স্থির হলো। দূর্জয় কোন দাগগুলোর কথা বলছে তা সে ভালো করে জানে। এগুলো তো কেবল শরীরের দাগ। মলমে সেড়ে উঠবে। কিন্তু মনের দাগ! সেই দাগ দেখার সাধ্য কার? শারীরিক দাগের খাতা খুলে বসতে গেলে যে বাণীকে মনের দাগের খবরও দূর্জয়কে জানাতে হবে। বাণী চোখ বুজে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। তার জীবনের যেই সত্যি সবার অজানা, সেই অজানাকে জানার জন্যই বোধহয় আল্লাহ বারবার তাকে দূর্জয়ের মুখোমুখি এনে দাঁড় করাচ্ছে।

বাণী চোখ মেলে তাকায়। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে কিছু বলতে নিবে ঠিক সেই মুহুর্তে তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে দূর্জয়ের ফোনটা বেজে উঠে। বাণী থেমে যায়। মাথা নত করে ফেলে। দূর্জয় মৃদু বিরক্ত হলেও পকেট হতে ফোনটা বের করে রিসিভ করে। মুহুর্তেই তার মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়। সে ব্যস্ত গলায় বলে,

“ গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়েছে? “

প্রশ্নগুলো করতে করতে দূর্জয় দ্রুত নিজের পকেটে গাড়ির চাবিটা চালান করে দেয়। অত:পর এখুনি আসছি বলে ফোনটা রেখে বাণীর দিকে তাকায়। বাণীও সেই মুহুর্তে কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে তার পানে তাকিয়ে ছিলো। দূর্জয় ব্যস্ত গলায় বলে,

“ বাসার বাহিরে সেনা নিরাপত্তা কর্মী রেখে যাচ্ছি। কিছু প্রয়োজন পড়লে ওদের বলবে। এই কেবিনেটের উপর ওষুধ আর প্রেসক্রিপশন আছে। দেখে সেই অনুযায়ী ওষুধ নিও। “

কথাটা বলেই বেরিয়ে যেতে নিলে বাণী পিছু ডাকে,

“ কোথায় যাচ্ছো? “

বাণীর মনের অজান্তেই তুমি সম্বোধনটা দূর্জয়কে মিনিট খানিকের জন্য থামতে বাধ্য করে। সে একপলের জন্য পিছু ফিরে বলে,

“ কবে নাগাদ ফিরবো নিশ্চিত নই। ফিরবো কিনা তা-ও নিশ্চিত নই। না ফিরলে তোমার ব্যাপারে আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো অজানাই থেকে যাবে। জানি না কি সমস্যার মধ্যে আছো। আল্লাহর আমানতে রেখে যাচ্ছি। টেক কেয়ার। “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৮.

গণমাধ্যম জুড়ে চলছে ব্যাপক সোরগোল। আজ সকালেই চট্টগ্রামের বেসরকারি একটি কলেজের ভেতর হতে ভেসে আসে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ। স্থানীয়দের মধ্যে কিছুজন সেই গোলাগুলির উৎস খুঁজতে কলেজ প্রাঙ্গণে পা রাখতেই বিল্ডিংয়ের ভেতর হতে নিক্ষেপ করা হয় বোমা। পরিস্থিতি আরো বিরূপ রূপ ধারণ করলে সকলে আন্দাজ করতে পারে তার ভয়াবহতা। মিনিট পনেরোর মধ্যে পুলিশ ক্রাইম এরিয়াতে পৌঁছে সম্পূর্ণ এরিয়া ঘেরাও করে ফেলে। খবর পৌঁছে যায় সামরিক বাহিনীর প্রতিটি সেক্টরেও। আরো একবার! আরো একবার দেশের মাটি কুলষিত করার খেলায় মত্ত হয়েছে দস্যু আতঙ্কবাদীরা। এবার কয়টা তাজা প্রাণ ঝড়বে কে জানে?

__________

হেডকোয়ার্টার অফিসটার পরিবেশ আজ বেশ গরম। সকলে তস্ত্র পায়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। স্পেশাল টিমের মেজর এবং সাতজন লেফটেন্যান্ট মিটিং রুমে সম্পূর্ণ তৈরী হয়ে উপস্থিত রয়েছে। অপেক্ষা কেবল একটা অর্ডারের। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা এবং আরো উচ্চপদস্থ লোকেরাও উপস্থিত মিটিং রুমে।

কন্ট্রোল রুম হতে তাদের কাছে খবর এসেছে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের আজ শিক্ষা সফরে যাওয়ার কথা ছিলো। বাকি সব শিক্ষার্থীদের জন্য কলেজ বন্ধ ছিলো আজ। সকাল ছয়টা বাজে সকল শিক্ষার্থীরা কলেজ প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়। কিন্তু বাস আসতে দেরি করছিলো বিধায় শিক্ষকদের আদেশ অনুসারে তারা সকলে নিজ নিজ ক্লাসে গিয়ে বসে। সকাল সাতটা বাজে বাস এসে উপস্থিত হয় কলেজ প্রাঙ্গণে। তবে কিছু বুঝে উঠার আগেই বাসের ভেতর হতে একদল যুবক কলেজ গেটের দারোয়ান সহ কিছু সংখ্যক শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে নাম না জানা বিদেশি অস্ত্র দ্বারা গুলি ছুড়ে। মুহুর্তে কলেজের ভেতর অবস্থানরত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আতংকিত হয়ে পড়ে। তারা বেরোনোর পূর্বেই অস্ত্রধারীরা কলেজের দালানের ভেতর প্রবেশ করে। অস্ত্রধারী যুবকদের একদল দ্রুত চলে যায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জিম্মি করার উদ্দেশ্যে এবং বাকি একদল দালানের সকল প্রবেশ দ্বার রুদ্ধ করে দিতে মননিবেশ করে।

খবরটুকু শুনতেই জুলফিকারের বুক মোচড় দিয়ে উঠে। এই কলেজেরই দ্বিতীয় বর্ষের বিজ্ঞান বিভাগে নিশা অধ্যয়নরত। নিশা যদি এখন হসপিটালাইজড না থাকতো তাহলে আজ ওই জিম্মি শিক্ষার্থীদের একজন তার মেয়েও হতে পারতো। ভাবনাটা মনে উঁকি দিতেই জুলফিকার দাঁত চিবিয়ে বলে উঠে,

“ জানোয়ারের বাচ্চারা এবার শিক্ষার্থীদের টার্গেট করেছে। “

সাইফ রাগচটা স্বভাবের। এই পরিস্থিতিতে তার রাগ আরো তুঙ্গে। সে তুখোড় গলায় বলে উঠে,

“ স্যার আপনি অর্ডার দিন শুধু। আমরা স্পেশাল টিম কেবল আপনার অর্ডারের অপেক্ষায় রয়েছি। ওদের নিশ্চিহ্ন করে দিবো আমার দেশের মাটি থেকে। “

কর্নেল জুবায়ের শিকদার ঠান্ডা গলায় বলে উঠে,

“ তোমাদের প্রতি বিশ্বাস আছে আমাদের। তবে কিছু জিনিস মাথায় রাখতে হবে। আগে সেখানে পৌঁছে পরিস্থিতি বুঝবে। পরিস্থিতি না বুঝে এবং অর্ডার ব্যতীত কোনো পদক্ষেপ নিবে না। আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আতঙ্কবাদীদের মৃত নই জীবিত চাই আমরা। ওরা মরে গেলে ওদের সংঘ সম্পর্কে কিছু জানার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে আমাদের। যতক্ষণ না পরিস্থিতি খুব বিগড়ে যাবে ততক্ষণ ফায়ার করবে না। প্রতিটা জিম্মি এই বাংলার তরুণ প্রাণ। ওদের জীবন অনেক মূল্যবান। বিষয়টা মাথায় রাখবে। “

দূর্জয় পাথরের মূর্তির ন্যায় স্থির দাঁড়িয়ে থেকে জবাব দেয়,

“ রজার দ্যাট স্যার। “

__________

দূর্জয় যাওয়ার পর থেকে বাণী ঠাই বিছানায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। হৃৎপিণ্ড প্রবল গতিতে লাফাচ্ছে। মেয়েটাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হচ্ছে তার। বহ্নি নিশ্চয়ই তার মাম্মার পথ চেয়ে আছে? নাস্তাটাও মুখে তুলেছে কিনা কে জানে! আচ্ছা, হিরণ বাণীর প্রতি রাগটা মেয়ের সামনে প্রকাশ করবে না তো? বহ্নিকে ঘিরে নানারকম দুঃশ্চিন্তায় বাণীর মন ছটফট করছে। মুক্তির প্রশান্তিটাও তার কাছে তেতো ঠেকছে। বাণী বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ মাম্মা তোমাকে ভুলে যাই নি মা। ওই আজাব থেকে আমাদের একসঙ্গে পালানো অসম্ভব ছিলো। মাম্মা তোমাকে প্রমিজ করছি যত দ্রুত সম্ভব তোমাকে ওখান থেকে নিয়ে আসবো। আমার বুকে লুকিয়ে রাখবো তোমাকে। “

বাণীর কথা শেষ হতে না হতেই কলিংবেলটা শব্দ তুলে বেজে উঠে। বাণী ভীত হয়। এই মুহুর্তে কে এলো? দূর্জয় না চলে গিয়েছে? সে ছাড়া আর কে আসতে পারে? হিরণ নয়তো? ভয় জেকে ধরে বাণীকে। দূর্বল শরীর টেনে সে ধীর পায়ে বিছানা ছেড়ে নামে। বিড়াল ছানার মতো কদম ফেলে বেরিয়ে আসে বেডরুম হতে। চারিদিকটা পরখ করতে করতে কলিংবেলের শব্দ অনুসরণ করে সে মেইন দরজার কাছে পৌঁছে যায়। দরজার মধ্যিখানে একটা পীপহোল দিয়ে বাহিরে তাকাতেই সে দেখতে পায় ক্লিন শেভ করা চিকন দেখতে একটা আগুন্তকঃ ছেলে দাঁড়িয়ে আছে দরজার অপরপ্রান্তে। বাণী কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে,

“ কে? “

অপরপ্রান্ত হতে স্পষ্ট এবং পরিষ্কার গলায় সেই যুবক উত্তর দেয়,

“ ম্যাডাম আমি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইলিয়াস কাঞ্চন বলছি। আমি আপনার নিরাপত্তার দায়িত্বে আছি। দূর্জয় স্যারের অর্ডার অনুযায়ী আমি আপনার জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছি। “

দূর্জয়ের নাম শুনে মৃদু ভরসা খুঁজে পেলেও বাণী রিস্ক নেয় না। সে আশেপাশে খুঁজে ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগোয়। রান্নাঘর হতে একটা ছুরি হাতে বেরিয়ে এসে দরজার কাছে এগোয় সে। মনে মনে দোয়া পড়তে পড়তে দরজাটা সামান্য খুলে বাহিরের দিকে উঁকি দেয় সে। সাথে সাথে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা তার দিকে একটা পলিথিনের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ ম্যাডাম নাস্তা করে ওষুধ খেয়ে নিবেন আর স্যার বলেছেন আপনি যেই রুমে আছেন সেই রুমের কাবার্ডে উনার মায়ের কিছু জামা আছে। আপনার অসুবিধা না হলে বলেছে সেগুলো আপনি ইউজ করতে পারেন। “

কাটকাট গলায় বলা ছেলেটার কথা শুনে বাণী অবাক হয়। ধীর গলায় বলে,

“ আচ্ছা। “

দরজা লক করে ভেতরে এসে টেবিলের উপর পলিথিনটা রাখে বাণী। পলিথিনের ভেতর হতে বেরিয়ে আসে একটা পারুটির প্যাকেট, একটি নিওটেলা জার, একটা জ্যামের জার এবং এক ডজন কলা ও আপেল। বাণী থম মেরে একটা চেয়ার টেনে বসে রয়। ইলিয়াস কাঞ্চন নামক ওই সেকেন্ড লেফটেন্যান্টের কথাটা তার মাথায় ঘুরছে। দূর্জয় বাণীকে নিজের মায়ের শাড়ি ইউজ করার পারমিশন দিয়েছে? বিষয়টা অবিশ্বাস্য বটে। দূর্জয় নামক একগুঁয়ে ছেলেটা আজকাল শেয়ারিং করাও শিখে গিয়েছে?

ডাইনিং রুমটা হতে চারিদিকটা আরেকবার চোখ বুলিয়ে দেখে বাণী। একটা ডাইনিং, একটা বসার ঘর, একটা রান্নাঘর এবং তিনটা বেডরুম। দুটো বেডরুমের একটায় এতক্ষণ বাণী ছিলো এবং অপর বেডরুমটাও খোলা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বসার ঘরের অপরপাশে থাকা রুমটার দরজা লকড দেখা যাচ্ছে। বাণীর মনে প্রশ্ন জাগে, রুমটা লকড করে রাখা কেন?

__________

সম্পূর্ণ কলেজের বিল্ডিংটায় বোম সেট করে ফেলেছে আতঙ্কবাদীরা। বহিরাগত কেউ প্রবেশ করার চেষ্টা করতে গেলেই সাথে সাথে এক্সপ্লোশন হয়ে মারা পড়বে। প্ল্যান ম্যাপ অনুযায়ী সম্পূর্ণ বিল্ডিংটা নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে এসেছে আব্রাহাম। শেষ ছাদের দরজাটার এখানে বোম সেট করে উঠে দাঁড়াতেই একজন যুবক আব্রাহামের পিছনে দাঁড়িয়ে বলে,

“ ভাই! সব জিম্মিদের দো তলার অডিটোরিয়ামে একত্রিত করেছি। “

আব্রাহাম উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঝেড়ে বলে,

“ পুরো বিল্ডিং তালাশ করেছিস? আর কেউ অবশিষ্ট নেই তো? “

“ না ভাই। “

আব্রাহাম বলে,

“ চল তাহলে। স্টুডেন্টসদের ক্লাস নেওয়া হোক তাহলে। “

আব্রাহামের কথার পিঠে হাসি ফুটে উঠে সেই যুবকের মুখে।

__________

অডিটোরিয়াম জুড়ে প্রায় পঞ্চাশের উপর আতংকিত মুখ বসে আছে ফ্লোরে। সকলেই তাকিয়ে আছে মাস্ক পরিহিত অস্ত্রধারী যুবকদের পানে। কেউই জানে না কি এদের উদ্দেশ্য। সাধারণ শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে এরা কি’বা হাসিল করতে পারবে?

জিম্মিদের মধ্যে রয়েছে কেবল একজন মহিলা শিক্ষক। তিনি ভয় মিশ্রিত সুরে একজন আতঙ্কবাদীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে,

“ আমাদের বন্দী করেছেন কেনো? আমরা কি করেছি? “

শিক্ষিকার সেই প্রশ্নের পিঠে আআতঙ্কবাদীরা বিশ্রী ভঙ্গিতে হাসে। ঠিক সেই মুহুর্তে দরজা হয়ে বিশাল অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করে মাস্ক, কালো টিশার্ট, প্যান্ট এবং লেদারের জ্যাকেট পরিহিত এক যুবক। তার পিছু পিছু আরো দু’জন যুবকও অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করে। সকল জিম্মিদের দৃষ্টি স্থির হয় দরজার দিকে। আব্রাহাম বিশাল রাইফেলটা পাশের এক যুবকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের কালো প্যান্টের পিছন হতে একটা পিস্তল বের করে। পিস্তল বের করতে দেখে এক মুহুর্তের জন্য সকল জিম্মিরা ভয়ে চিৎকার করে উঠে। কিন্তু মাস্ক পরিহিত সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টির যুবকটা তাদের দিকে তাকাতেই তাদের গলার স্বর হারিয়ে যায়।

আব্রাহাম মাঝামাঝি অবস্থিত একটা চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসেই গম্ভীর স্বরে শুধায়,

“ গুড মর্নিং স্টুডেন্টস। “

তার চোখের অচেনা সেই দৃষ্টি এবং রাশভারী গলার স্বর শুনে জিম্মিদের মধ্যে হতে একজন কিশোরী বিস্ময় মিশ্রিত সুরে উচ্চারণ করে,

“ আব্রাহাম! “

পিনপতন নীরবতা পূর্ণ রুমে সেই ক্ষীণ আওয়াজ বেশ স্পষ্ট শোনা যায়। আব্রাহামের দৃষ্টি গিয়ে ঠেকে জিম্মিদের মধ্যে কলেজ ইউনিফর্ম এবং তার উপর একটা জ্যাকেট পড়ে থাকা রমণীর দিকে। দৃষ্টি মিলন হতেই রমণীর বুকে যেনো কেউ ছুরি চালায়। সে কোনো কিছুর পরোয়া না করে উঠে দাঁড়ায়। সাথে সাথে আব্রাহাম ব্যতীত উপস্থিত সকল আতঙ্কবাদীরা তার দিকে রাইফেল তাক করে ধরে। রমণীর সহপাঠীরা ফিসফিসিয়ে তাকে বলতে থাকে বসে পরার জন্য। কিন্তু রমণীর কানে পৌঁছায় না কোনো সতর্ক বার্তা। সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি মেলে এগিয়ে যায় আব্রাহামের দিকে।

আব্রাহাম পায়ের উপর রাখা পা টা নামায়। সোজা হয়ে বসে সে। রমণী ঠিক তার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। অবিশ্বাস্য চোখ জোড়া জলে টইটম্বুর হয়ে রয়েছে। চরম দুঃসাহসিকতা দেখিয়ে রমণী হাত বাড়িয়ে একটানে আব্রাহামের মুখের মাস্কটা খুলে ফেলে। সম্পূর্ণ মুখশ্রী উন্মোচিত হতেই রমণীর জলে টইটম্বুর চোখ জোড়া হতে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। চেনা মুখটার সঙ্গে এই পরিস্থিতিতে সাক্ষাৎ হওয়ায় রমণীর বুকের পাঁজরে যেনো টান পড়লো। রমণীর বিস্ময়ভরা ছলছল দৃষ্টি সেই মুখপানে চেয়ে বলে উঠে,

“ এটা ছিলো তোমার সারপ্রাইজ? “

আব্রাহাম হাতের পিস্তলটা সুকৌশলে ধরে তার নলটা রমণীর থুতনির নিচ দিয়ে ধরে। ট্রিগারে আঙুল রেখে একগাল হেসে বলে,

“ তোমার পছন্দ হয়েছে তো রুহী? “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]