এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৫.
ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি পান করে গলার তেষ্টা কিছুটা মেটায় বাণী। অত:পর স্থির হয়ে বসে। দূর্জয় এক পল বাণীকে দেখে নিয়ে শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,
“ কার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছো? “
বাণী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দৃষ্টি নত রেখে জবাব দেয়,
“ হিরণ। “
“ হিরণ কে? “
“ আমার মেয়ের পাপা। “
দূর্জয় এবার আগ্রহ অনুভব করলেও তা প্রকাশ করে না। কেবল প্রশ্ন করে,
“ কেন? “
বাণী এই পর্যায়ে চোখ তুলে তাকায়।
“ কারণ অনেক বড়। কোথা থেকে শুরু করবো? “
“ শুরু থেকেই নাহয় শুরু করো। আমার হাতে সময় আছে। এক রাত যথেষ্ট হবে না তোমার দীর্ঘ কারণ বলার জন্য? “
বাণী দূর্জয়ের প্রশ্নের উত্তর দেয় না। সে এবার দূর্জয়ের চোখে চোখ রেখে বলতে শুরু করে,
“ সাত বছর আগের ঘটনা। ভাইয়া খুব করে চাচ্ছিলো আমি যেনো আমার হায়ার স্টাডিজ কমপ্লিট করার জন্য বাহিরের দেশে ট্রাই করি। আমি তখন ভাইয়ার কথা মতো আইইএলটিএস এর প্রিপারেশন নিচ্ছি। বাবা একদিন সন্ধ্যাবেলা করে আমাকে আর মামণিকে ডাকলেন গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বলতে। বাবার চেহারা দেখেই আমরা আঁচ করতে পারি খুব সিরিয়াস কোনো বিষয়। মামণি কি হয়েছে জানতে চাইলে বাবা বলেন, তিনি আমার বিয়ে নিয়ে ভাবছেন। শুধু ভাবছেনই না বরং তিনি রীতিমতো একজনের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা পাকা করে ফেলেছেন। বাবার এরকম ষ্টুপিড সিদ্ধান্তের পিছনে কোনো কারণ শোনার মতো ধৈর্য্য আমার ছিলো না। আমি সোজা না জানিয়ে দেই। বাবা তবুও ইনিয়ে বিনিয়ে আমাকে রাজি করানোর চেষ্টা করে। আমি রাজি হই না। জেদি স্বভাবটা ঘাড়ে চেপে ধরে। রুমে গিয়ে রাগে দরজা আটকে ভাঙচুর শুরু করি। কোথাও না কোথাও আমার বিশ্বাস ছিলো সবসময়ের মতো বাবা এবারও আমার জেদের সামনে হার মানবে। কিন্তু আমার বাবা সেদিন প্রথমবারের মতো আমার বিশ্বাস ভাঙে। আমার ভাঙচুর বন্ধ হয় মামণির চিৎকারের শব্দে। দরজা খুলে দ্রুত মামণি বাবার রুমের সামনে যেতেই চিৎকারের শব্দ আরো স্পষ্ট শুনতে পাই। মামণি কখনোই বাবার মতের বিপক্ষে কোনো কথা বলতো না। কিন্তু সেদিন মামণি বাবার বিপক্ষে গিয়ে আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলে। এটাই মামণির ভুল ছিলো। আদরের একমাত্র মেয়েকে কিছু বলতে না পেরে বাবা দরজা লাগিয়ে মামণিকে ঝাড়ু পেটা করে। আমি দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে যখন প্রায় ভেঙে ফেলার উপক্রম হয় তখন মামণির চিৎকার থেমে যায়। বাবাও দরজা খুলে গটগট করে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। বাবা যখন আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো আমার মনে হচ্ছিলো আমি এই লোককে চিনি না। নিজের বাবাকেই নিজে চিনতে পারছিলাম না। বাবা বের হয়ে যেতেই আমি রুমে ঢুকে দেখি মামণি ফ্লোরের একপাশে অর্ধ চেতনাহীন অবস্থায় পড়ে আছে। “
এতটুকু বলতেই বাণীর গলা ফের শুকিয়ে আসে। তবে সে থামে না। দূর্জয়ের চোখে তাকিয়ে বলতে থাকে,
“ বাবা পরের দিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসে। বাবা ফেরার আগ পর্যন্ত আমরা মা মেয়ে মূর্তির মতো সারাদিন যে যার রুমে পড়ে ছিলাম। না আমি লজ্জায় মামণির সামনে দাঁড়াতে পারছিলাম, না মামণি আমার সাথে কোনো কথা বলছিলো। সেদিন রাতের বাবার এই নতুন রূপের কথা মিশিগানে বসে থাকা ভাইয়াকেও জানাই নি আমরা। কি জানাতাম? মাথা কাজ করছিলো না তখন। জানানোর মতো পরিস্থিতি ছিলো না। বাবা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে অদ্ভুৎ এক কাজ করে। মামণির কাছে আমার সামনে পা ধরে মাফ চায়। আমাকেও বলে তিনি সেই বিয়ে ভেঙে দিয়ে এসেছেন। আমার সামনে আর বিয়ের কথা তুলবে না। জানিনা আমার মামণি কিসের তৈরী কিন্তু তিনি একমাস পেরোতেই বাবার সেই আঘাতের কথা ভুলে যায়। আবার আগের মতো স্বাভাবিক আচরণ শুরু করে। কিন্তু আমি বাবার সেই আচরণের কথা ভুলতে পারি নি। উপরে যতটাই স্বাভাবিক আচরণ করি না কেনো ভিতরে ভিতরে বাবার প্রতি আর সম্মান কিংবা ভালোবাসা অনুভব করতে পারতাম না। “
দূর্জয় শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,
“ তোমার বাবা পরে আর কখনো তোমার সামনে এরকম আচরণ করেছে? “
দূর্জয়ের প্রশ্ন শুনে বাণী মলিন হাসে। ঠোঁটের কোণে মলিন হাসি বজায় রেখেই ঠান্ডা গলায় বলতে থাকে,
“ সেই ঘটনার এক মাস পনেরো দিন পরে বাবা হঠাৎ জানায় তিনি কি যেনো এক কাজে চট্টগ্রাম যাবেন। আমাকেও সাথে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। আমার সবসময়ই সমুদ্রে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু কখনো সুযোগ কিংবা সময় হয়ে উঠেনি যাওয়ার। ভাইয়া যখন বন্ধুদের সাথে মিলে কক্সবাজার ট্রিপে গিয়েছিলো, তখন আমার খুব হিংসে হতো। এতো ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেদিন বাবার প্রস্তাবে আমার মন টানছিলো না। মানা করে দেই। সেদিন রাতে মামণি আমার রুমে আসে। মাথায় তেল দেওয়ার বাহানায় খুব কথা বলেন আমার সঙ্গে। কথায় কথায় এ-ও বলেন যে সেদিন প্রথম বাবা উনাকে আঘাত করেন নি। এর আগেও করেছেন বহুবার। এতটুকু শুনেই আমার বাবার প্রতি খুব ক্ষোভ জন্মায়। ইচ্ছে করছিলো থানায় গিয়ে নারী নির্যাতনের মামলা করি। কিন্তু মামণি আমাকে টেনে নিজের সামনে বসিয়ে খুব অদ্ভুৎ কথা বলে। এসব থানা পুলিশে নাকি মামণির সম্মান যাবে। উনার নাকি এই সংসারে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না। আর বাবাও নাকি শুধুমাত্র খুব রেগে গেলেই মাঝেমধ্যে এরকম গায়ে হাত তুলে। মামণি আমার এবিউজার বাবাকে ডিফেন্ড করে আমাকে অনুরোধ করে আমি যেনো বাবার সাথে চট্টগ্রাম গিয়ে ঘুরে আসি। তিনি চান না অযথা এসব নিয়ে আবার কোনো কথা কাটাকাটি হোক। আমি সেদিন মামণির অনুরোধ ফিরাই নি। চট্টগ্রাম যেতে রাজি হই। কিন্তু মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম একবার মিশিগান পৌঁছাতে পারলে ভাইয়াকে রাজি করিয়ে মামণিকেও আমাদের কাছে নিয়ে যাবো। আর দেশে বাবার কাছে কখনোই ফিরবো না। “
এতদূর বলে বাণী আচমকাই থেমে যায়। দৃষ্টি নত করে। আনমনে বলে উঠে,
“ কে জানতো সেটাই আমার নিজের বাড়িতে শেষ রাত হতে যাচ্ছে? কে জানতো সেটাই আমার মামণির সাথে শেষ সাক্ষাৎ ছিলো? “
বাণীর আনমনে বলা কথা দূর্জয়ের কানে পৌঁছায়। সে এখনো যথেষ্ট ঠান্ডা আছে। উত্তেজিত হয় নি মোটেও। শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,
“ তারপর? “
বাণী সম্বিত ফিরে পায়। ফের বলতে শুরু করে,
“ পরের দিন আমি বাবার সাথে চট্টগ্রাম আসি। প্রথমদিন বাবা সারাদিন কাজে ব্যস্ত ছিলো বিধায় আমি হোটেলে ঘুমিয়ে সময় পাড় করি। কিন্তু তার পরের দিন বাবা সারাদিন হাতে সময় রেখে আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। সারাদিন চট্টগ্রাম শহর ঘুরে বিকেলের দিকে খুব ক্লান্ত অনুভব করায় আমি চলন্ত গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু ঘুম যখন ভাঙে তখন আমি আর গাড়িতে ছিলাম না। ছিলাম অপরিচিত কারো বেডরুমে। ঘুম ভাঙতেই আমি অনুভব করি আমার মাথাও অজানা কোনো কারণে খুব ভারী অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু সেসব দিকে পাত্তা না দিয়ে আমি বাবাকে ডাকতে শুরু করি। রুম থেকে বের হতেই উপলব্ধি করি এটা কোনো সাধারণ বাড়ি নয়। আমাদের বাড়ির থেকেও কয়েকগুণ বড় এবং জৌলুশপূর্ণ বাড়ি। আমি ঘুরতে ঘুরতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে যেতেই দেখি বাবা সোফায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। উনার সঙ্গে আর কেউ নেই। আমি দ্রুত বাবার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করি আমরা কোথায় আছি। বাবা আমার প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে আয়েশ করে আগে চায়ে শেষ চুমুকটা বসায়। তারপর আমাকে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে বলতে শুরু করে, নিজের রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক দূরাবস্থার কথা। ব্যবসায় হঠাৎ বিশাল এক লস খেয়ে বাবার আর্থিক অবস্থার তখন করুণ দশা। অপরদিকে ইলেকশন এগিয়ে আসছে। ইলেকশন লড়ার মতো টাকাও বাবার কাছে নেই। এই পরিস্থিতির একটাই সমাধান। আমার বিয়ে। আমি যদি একবার বিয়েতে রাজি হয়ে যাই তাহলে পাত্র বাবাকে গুণে গুণে দশ কোটি টাকা দিবে। সেই সঙ্গে বাবার ইলেকশনে জেতার জন্য অনুসাঙ্গিক আর যা খরচ আছে সব সে বহন করবে। বাবার কথা শুনে আমি নির্বাক হয়েছিলাম। নিজেকে মানুষ কম পণ্য বেশি মনে হচ্ছিলো। আমার দাম কতো জানো? দশ কোটি টাকা। “
শেষ বাক্যটা উচ্চারণ করার সময় বাণীর গলা কাপলো। দূর্জয়ের স্থির চিত্ত মুখশ্রীতে এবার মৃদু অস্থিরতা লক্ষণীয় হলো। সে উঠে এগিয়ে আসতে চাইলো বাণীকে আরেক গ্লাস পানি দেওয়ার জন্য। কিন্তু বাণী তার আগেই বলে উঠে,
“ ঠিক আছি। “
বাণীর ইশারা পেতেই দূর্জয় আর নড়লো না। আপন জায়গায় বসে রইলো। বাণী নিজ থেকেই বলতে শুরু করে,
“ আমি রাজি হলাম না বিয়ের জন্য। চিৎকার, চেঁচামেচি করলাম খুব। আমার বাবা বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় নি। তিনি আমার সব চিৎকার গুলোকে নীরবে হজম করে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রেখে হেসে বলে, তিনি যা করছেন সবার ভালোর জন্য করছেন। আমাদের পুরো পরিবার এতে ভালো থাকবে। ভালো থাকবো আমিও। বাবার প্রতি আমার এতো দিনের রাগ আমি আর চেপে রাখতে পারি নি। রাগে ক্রোধে উনার হাত মাথা থেকে সরিয়ে একটা ফুলদানি তুলে নেই উনার দিকে ছুঁড়ে মারার জন্য। ছুঁড়েও মারি। কিন্তু উনি নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়। এক তিল পরিমাণ রাগ দেখায় না আমার উপর। দেখাবে কেনো? আমি উনার কাছে তখন সোনার ডিম পাড়া হাস। উনি শুধু মুচকি হেসে বলে, আমি না বিয়ে করি কিংবা না করি এখন থেকে আমাকে সেই অচেনা লোকটার সাথেই থাকতে হবে। কারণ বাবা ইতিমধ্যে টাকার বিনিময়ে আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে। যেদিন আমি রাজি হবো একমাত্র সেদিনই বিয়ে হবে। এটুকু বলেই উনি আমাকে সেই সম্পূর্ণ অচেনা বাড়িতে অচেনা এক লোকের আওতায় রেখে চলে যায়। “
“ তুমি? তুমি ওখান থেকে পালানোর চেষ্টা করো নি? “
দূর্জয়ের কণ্ঠে আগ্রহ না-কি চিন্তা তা ঠিক ঠাওর করতে পারলো না বাণী। সে আপাতত অতীতের তীক্ষ্ণ ব্যথা গুলো ফের অনুভব করছে। ব্যথাতুর দৃষ্টি মেলে বলে,
“ করেছি। সঙ্গে সঙ্গে বেরোনোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু বের হওয়ার সুযোগ পাই নি। কিছু অপরিচিত মুখ এসে আমাকে ঘিরে ধরে। অনুরোধের সুরে বলতে থাকে ভয় না পেয়ে শান্ত হয়ে বসতে। আমি রাগে উগ্র আচরণ শুরু করি। সামনে যা পাচ্ছিলাম সব ওদের দিকে ছুঁড়ে মারতে শুরু করি। কিছুজন আঘাত প্রাপ্ত হয়। এসবের মধ্যেই কোথা থেকে এক আহত লোক এসে হঠাৎ আমার ঘাড়ে সুঁচালো কিছু একটা চেপে ধরে। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কিছু একটা প্রবেশ করছিলো। তা আমি অনুভব করছিলাম। কিন্তু সেই অনুভূতি বেশিক্ষণ টিকে নি। চেতনাহীন হয়ে পড়ি। “
দূর্জয়ের বুকের ভেতর নীরব স্পন্দন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে ক্রমশ। দম আটকে সে বাণীর পানে চেয়ে থাকে। বাণী চুপ রইলো ক্ষণকাল। অত:পর বলতে শুরু করে,
“ যখন জ্ঞান ফিরে তখন গভীর রাত্রি। অন্ধকারের মধ্যেও আবার আমি নিজেকে সেই একই বেডরুমে খুঁজে পাই। চেতনানাশক ওষুধের প্রভাবে কিনা জানা নেই তবে শরীরে তখন বিন্দুমাত্র বল খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। না পাচ্ছিলাম কিছু বলার শক্তি। কোনো মতে বিছানায় উঠে বসি। তখনই রুমের দরজা খুলে অন্ধকারের মধ্যে কেউ একজন রুমে প্রবেশ করে। সে কে তা জানার প্রয়োজন বোধ করি না আমি। শুধু অন্ধকারে হাতড়ে হাতের কাছের বালিশটা তার দিকে ছুড়ে মারি। কোনো লাভ হয় না। কেউ একজনটা এগিয়ে এসে বিছানায় আমার মুখোমুখি বসে। মানুষটার উপস্থিতি আমাকে অস্বস্তি দিচ্ছিলো। তবুও আমি সাহস করে তার হাত খাঁমচে ধরি। নখের আঁচড়ে রক্ত বের করে আনি। গলায় মৃদু বল জুগিয়ে জানতে চাই সে কে। এক হিমশীতল পুরুষালি গলা জবাব দেয় ‘হিরণ’। নিজের নামটুকু বলেই উনি একটা লাইটার জ্বেলে ধরে আমার মুখের কাছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে সেই মৃদু উষ্ণ আলোয় আমি নিজের জীবনের অভিশাপের মুখদর্শন করি প্রথমবারের মতো। লোকটা শান্ত গলায় আমাকে জানায় ভয় না পেতে। আর কেউ আমাকে ছুঁতে আসবে না। যেই লোকটা আমাকে সেই চেতনানাশক ওষুধ ইনজেক্ট করেছিলো তাকে মৃত্যু উপহার দিয়ে এসেছে। আর কেউ যদি এই ভুল করার স্পর্ধা দেখায় তার-ও একই পরিণতি হবে। লোকটার এসব ভয়ংকর কথা শুনে আমার মাথায় উনার জন্য উপযুক্ত একটা শব্দই বারবার ঘুরছিলো। ‘মানিয়াক’। লোকটা আমাকে বলে, আমি যতদিন নিজ থেকে রাজি না হবো ততদিন বিয়ে হবে না। তবে আমার ওই বাড়ি থেকে পালানোরও অনুমতি নেই। আমার জীবন ওই উঁচু চার দেয়ালের সীমানার মধ্যেই বদ্ধ থাকবে। বাহিরের পৃথিবীর সাথে আমার বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে। “
দূর্জয় না চাইতেও তার গলায় বিস্ময় ফুটে উঠে। পাথরের ন্যায় প্রশ্ন করে,
“ বিয়ে করতে রাজি হলে কেনো তাহলে? “
দূর্জয়ের প্রশ্নের পিঠে বাণী এবার মৃদু হাসে। রহস্যময় সেই হাসি। বাণীকে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে দূর্জয়। এই ধরনের হাসি যে পরিস্থিতিকে কতটা রহস্যময় করে তুলছে সেই সম্পর্কে কি এই মেয়ের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে? বাণী দূর্জয়ের সেই প্রশ্নকে উপেক্ষা করে বলে,
“ এক বছর। এক বছর ওই বাড়িতে আমি বন্দী দশায় ছিলাম। বাহিরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। নিজের পরিবারের সাথে যোগাযোগহীন ছিলাম। এই এক বছরে হিরণের অসংখ্য লোককে আঘাত করে আহত করেছি। সুযোগ পেলে হিরণকেও ছাড়তাম না। যতবার সুযোগ পেয়েছি আঘাত করেছি। ওর বুকে কাঁটা চামচও গেঁথে দিয়েছিলাম একবার। মুহুর্তটা তৃপ্তিকর ছিলো। এই এক বছরে আমার জীবনের কন্ট্রোল আমার হাতে না থাকলেও, একটা জিনিসের কন্ট্রোল আমার হাতে ছিলো। সেটা হলো হিরণকে বিয়ে করতে মত দেওয়া। আমার বাবা হয়তো ভেবেছিলো আমি মামণির মতো এসব কিছু মেনে নিবো। কিন্তু বাবা আমাকে কখনো চিনতে পারে নি। আমার জেদ সম্পর্কেও হয়তো উনার ধারণা নেই। নিজের সঙ্গেই আমি জেদ ধরি। প্রয়োজনে মরে যাবো কিন্তু এই মানিয়াক বর্বরকে কখনো বিয়ে করবো না। আমি আমার জেদে অটক থাকি। এই এক বছর পর উপরওয়ালা আমার দিকে মুখ তুলে তাকায়। হিরণের কঠোর নিরাপত্তা ভেদ করে আমার ভাইয়া আমার পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়। আমাকে হিরণের জাহান্নামতুল্য প্রাসাদে ফেলে বাবা সিলেট ফিরে যাওয়ার পর মামণি আর বাবার মধ্যে কি হয়েছে তা ভাইয়ার অজানা। কেবল তার পরের দিন তিনি খবর পায় মামণি সিড়ি থেকে পড়ে গিয়েছে। আমার মামণি আর নেই। ভাইয়া খবর পেয়ে দেশে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ততক্ষণে মামণিকে দাফন করা হয়ে গিয়েছে। আমরা দুই ভাই বোন নিজের মা’কে শেষ বারের মতো দেখার সুযোগও পাই নি। আমাকে না পেয়ে ভাইয়া যখন বাবার কাছে জানতে চায় আমি কোথায়, তখন বাবা জানায় আমি তাদের মুখে চুনকালি মেখে কারো সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছি। বাবার এই মিথ্যাটা ভাইয়া বিশ্বাস করে না। উল্টো তার কাছে সবকিছু সন্দেহজনক লাগছিলো। তবে সেই মুহুর্তে তিনি কোনো রিয়েক্টও করে না। ভাইয়া আমার বিপরীত স্বভাবের। ঠান্ডা, শান্ত স্বভাবের। ভাইয়া নিজের পড়াশোনা ছেড়ে দেশে রয়ে যায়। বাবার ব্যবসা সামলানোর নাম করে বাবার উপর নজর রাখে। দশ মাস পর আমার তথ্য পেতে সক্ষম হয়। আমি কোথায় আছি জানতে পেরে দুইমাস ওঁৎ পেতে ছিলো আমাকে উদ্ধার করার জন্য। সুযোগ পেতেই ভাইয়া সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমার কাছে পৌঁছায়। হিরণের গার্ডদের চোখে ধূলো ছুড়ে আমাকে নিয়ে পালায়। “
দূর্জয় বাণীর কথায় এতটাই ডুবে গিয়েছে যে বাণী পালাতে সক্ষম হয়েছিলো শুনে আনমনেই সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বাণী বলে উঠে,
“ কিন্তু সেটাই আমাদের সবথেকে বড় ভুল ছিলো। চব্বিশ ঘণ্টাও পালিয়ে থাকতে সক্ষম হই নি আমরা। ভাইয়া আমাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে চেয়েছিলো। কিন্তু চট্টগ্রাম শহর ছাড়ার আগেই হিরণের লোকেরা আমাদের ধরে ফেলে। ফের নিয়ে যায় হিরণের ওই পাপের প্রাসাদে। ভাইয়ার এই দুঃসাহস হিরণের ক্ষোভের কারণ হয়। ক্ষোভে অন্ধ হয়ে ও ভাইয়াকে বাড়ির পেছনের ওই শিমুল গাছের সাথে বেঁধে রাখে। ভাইয়াকে মারতে মারতে ওরা রক্তাক্ত করে ফেলেছিলো। আঘাত করে যখন ক্ষান্ত হয় নি তখন হিরণ… “
এতদূর বলে বাণী আর কথা বলতে পারে না। চোখ বুজে জোরে একটা নিঃশ্বাস টেনে নেয়। গাল গড়িয়ে পড়ে তার উষ্ণ জল। কাঁপা গলায় বলে,
“ আমার চোখের সামনে আমার ভাইয়াকে খুন করে হিরণ। ওর হাতে আমার ভাইয়ার খুনের রক্ত লেগে আছে। “
দূর্জয়ের মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে আছে। তার আর কিছু শুনতে ইচ্ছা করছে না। গতকাল থেকে তার মস্তিষ্ক একের পর এক ধাক্কা সামলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত অনুভব করছে সে। আচ্ছা যেই অতীতের গল্প শুনতে গিয়েই সে অসুস্থ অনুভব করছে, সেই অতীতের ভার তার সামনে বসা এই মেয়েটা কিভাবে বয়ে বেড়াচ্ছে? দূর্জয় আর সোজা হয়ে বসে থাকার শক্তি খুঁজে পাচ্ছে না৷ শরীরটা অসাড়ল হয়ে আসে তার। সঙ্গে সঙ্গে দূর্জয় নিজের নীতি ভেঙে একটা কাজ করে। কঠিন চিত্তের খোলস ছেড়ে সোফায় পিঠটা এলিয়ে চোখ বুজে ফেলে সে। নিজের দূর্বল হয়ে পড়াটা সামনে বসে থাকা নারীর সামনে প্রকাশ করে নিজের অজান্তেই। বাণী অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি মেলে নীরবে দেখে সেই দৃশ্য। নিস্তব্ধ পরিবেশের নীরবতা ভেঙে মলিন গলায় বলে উঠে,
“ আমার শেষ আশ্রয়স্থল সায়াহ্ন তালুকদারের লাশের উপর পড়ে কাঁদছিলাম আমি। ভাইয়ার রক্ত আমার শরীর জুড়ে লেপ্টে ছিলো। কিন্তু আমি অভাগী। নিজের ভাইয়ের মৃত্যুর শোক পালনেরও সুযোগ পেলাম না আমি। ভাইয়ার লাশের উপর থেকে আমাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যায় হিরণ। নিজের ব্যক্তিগত বেডরুমে টেনে নিয়ে যায়। পালানোর শাস্তি শুধু আমার ভাই পায় নি সেই রাতে। আমিও পেয়েছি। হিরণের ভয়ংকর রূপের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে সেই রাতে। হি ডিস্ট্রোয়েড মি মেন্টালি এন্ড ফিজিক্যালি। বহ্নি যাকে নিজের পাপা বলে চিনে, সে আমার রেপিস্ট, আমার ভাইয়ের খুনী। ও বহ্নির পাপা হতে পেরেছে, কিন্তু আমার স্বামী হতে পারে নি। “
চলবে…
এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৬.
সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে রাখা দূর্জয়ের মধ্যে বিন্দুমাত্র হেলদোল দেখা গেলো না। কেবল ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন করে,
“ ডিড হি ডিড দ্যাট টু ইউ এগেইন? “
বাণীর পা ঝুলিয়ে সোফায় সোজা হয়ে বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না। পুরনো ক্ষত তাকে দূর্বল করে দিচ্ছে আবারও। শরীর ক্ষানিকটা টলছে। অশ্রুসিক্ত চোখের পানি মুছে ঝুলিয়ে রাখা পা জোড়া এবার সোফায় তুলে দ আকারে বসে বাণী। বুকের কাছে ঠেকানো হাঁটুর উপর থুতনি ঠেক দিয়ে সে মলিন গলায় বলে,
“ হুম। “
দূর্জয় এবার চোখ মেলে তাকায়। তবে সোজা হয়ে উঠে বসে না। নিজের থেকে ঠিক কয়েক হাত দূরের সোফাটিতে বসে থাকা নিজের মা’য়ের শাড়ি পরিহিতা নারীকে দেখে সে একপল। ভারী অমাবস্যায় মোড়ানো এই নারীর জীবন। জোছনার ছিটেফোঁটাও নেই যে জীবনে। বাণীর চোখ এড়ায় না দূর্জয়ের দৃষ্টি। সে-ও কিছুপল দূর্জয়ের পানে চেয়ে রয়। অত:পর রুগ্ন গলায় আবারও বলতে শুরু করে অতীতকথা,
“ ভাইয়ার মৃত্যুর ছয় বছর পর আমি দ্বিতীয় বারের মতো আবার পালাই। তবে এবার সঙ্গে করে বহ্নিকে নিয়ে। আমি জানতাম কখনো না কখনো আমি হিরণের কাছে ধরা পড়বো। তবুও আমি ওই জীবন থেকে মুক্তি লাভের লোভে সুযোগটা হাতছাড়া করি না। সকল গার্ডদের মনযোগ আকর্ষণ করে আমি পালাই। সবাই তখন আমার পিছু নেওয়ায় বাড়িতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বাড়াবাড়ি সিচুয়েশনটা কমে আসে। ওই পাপের রাজত্বে আমি একজন বড় আপুর মতো শুভাকাঙ্ক্ষী পেয়েছিলাম। আফিফা আপা। উনি আমার পালানোর প্ল্যান সম্পর্কে জানতো। উনি নিজেও এই প্ল্যানে শরিক ছিলেন। বাড়ির নিরাপত্তা ব্যবস্থা কিছুটা দূর্বল হতেই উনি সেই সুযোগে বহ্নিকে নিয়ে ওই বাড়ি থেকে পালায়। কথা ছিলো আপার ভাইয়ের বাসা থেকে আমি বহ্নিকে পিক করে এই শহর ছেড়ে পালাবো। কিন্তু পথিমধ্যে তোমার গাড়ির সঙ্গে আমার এক্সিডেন্ট হয়। গাড়িতে যখন তুমি আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলে তখন আমি ইচ্ছে করেই তোমাকে মিথ্যে এবং বানোয়াট জবাব দিচ্ছিলাম। এতো বছর পর আমি আবার তোমার বিরক্তির কারণ হতে চাচ্ছিলাম না। আমি শুধু আমার বাচ্চাকে নিয়ে ঝামেলাহীনভাবে এই শহর ছাড়তে চাইছিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। আমাকে সাহায্য করার অপরাধে আফিফা আপা নিজের প্রাণ হারায়। আবার ধরা পড়ে যাই আমি হিরণের কাছে। আরো একবার ওর ক্ষোভের শিকার হই। আরো একবার… “
এতদূর বলতেই বাণী থেমে যায়। চোখ বুজে জোরে নিঃশ্বাস টেনে নেয়। গলার কাছে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে সে। দূর্জয় পুরো দৃশ্যটা দেখে। কিন্তু কিছু বলে না। সে বাণীকে এই মুহুর্তে থামাতে চাইছে না। মেয়েটা প্রথম বারের মতো এই সুযোগ পেয়েছে। বলে হালকা হয়ে নেক। দূর্জয় নাহয় নীরবে সয়ে গেলো এই মানসিক যন্ত্রণা। তার এই ক্ষনিকের মানসিক যন্ত্রণা নিশ্চয়ই বাণীর লালিত সাত বছরের শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণার থেকে বড় নয়? বাণী আবার বলতে থাকে,
“ সেই রাতে ঝড়ের তান্ডব মাথায় নিয়ে আমি ওই অভিশপ্ত ব্যাক ইয়ার্ডে যাই। যেখানে আমার ভাইয়া খুন হয়েছিলো। শিমুল গাছটার নিচে গিয়ে মাটি আঁকড়ে ঝড় সয়ে নেই। মাটিতে মাথা রাখার পর মনে হচ্ছিলো ভাইয়ার কোলে মাথা রেখেছি। ভাইয়া হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সারারাত বৃষ্টিতে ভেজার ফলস্বরূপ অসুস্থ হয়ে পড়ি। সিরিয়াস অবস্থা হয়ে যাওয়ায় হিরণ আমাকে হসপিটালে এডমিট করাতে বাধ্য হয়। আমি সুযোগ বুঝে তৃতীয় বারের মতো পালাই। তবে এবার সম্পূর্ণ একা। “
দূর্জয় এবার নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে,
“ বহ্নি কোথায়? ও নিজের বাবার আসল রূপ সম্পর্কে জানে? “
“ বহ্নি হিরণের কাছে আছে। কিন্তু বেশিদিন থাকবে না। আমি আমার মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসবো। এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাবো। আর রইলো বহ্নির হিরণ সম্পর্কে জানার ব্যাপারে, তাহলে ওর কাছে ওর পাপা হিরো। মারভেল স্টুডিওজের সিনেমাগুলোর হিরোর মতো মনে করে ও নিজের পাপাকে। আমিও কখনো ওর সেই ধারণা পরিবর্তন করি নি। আমার মেয়ে এখনো খুব ছোট। এতো কম বয়সে আমি ওর মনে ঘৃণার বীজ বপন করে ওর মন কুলষিত করতে চাই না। ছোটবেলা থেকে যেই পুরুষকে হিরো জেনে এসেছি হঠাৎ করে সেই পুরুষের জঘন্য রূপ সামনে আসার অনুভূতি কেমন হয় তা আমি ভালো করেই জানি। আমি চাইনা আমার মেয়েও আমার মতো একই মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করুক। শুধুমাত্র ওর জন্যই আমি বিয়ে না হওয়া সত্ত্বেও সবার সামনে হিরণের ওয়াইফ সেজে থাকার মিথ্যা অভিনয় করে এসেছি এতদিন। আমি চাই না কেউ আমার মেয়ের পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলুক। “
দূর্জয় নীরবে সব শুনছিলো। বাণীর কথায় সে অনেকটাই গভীর ভাবে মশগুল হয়ে ছিলো। কিন্তু হঠাৎই তার টনক নড়ে উঠে। সে সোজা হয়ে উঠে বসে প্রশ্ন করে,
“ ওয়েট বাণী। হিরণের প্রফেশন কি? আই ডোন্ট থিংক হি ইজ এ র্যান্ডম রিচ গাই হু গট সাচ পাওয়ার। “
দূর্জয়ের প্রশ্নের পিঠে এবার বাণীও নড়েচড়ে বসে। তাকে ভাবুক দেখা যায়। সে জবাব দেয়,
“ হিরণের প্রফেশন কি তা আমার জানা নেই। উনি ওনার কাজের জগৎকে বাড়ির বাহিরে ফেলে আসে সবসময়। আমার সামনে কখনো নিজের কাজ নিয়ে কোনো কথাও বলে নি। অল আই নো এবাউট হিম ইজ দ্যাট হি ইজ এ অরফান। উনার কোনো ফ্যামিলি রুট নেই। “
দূর্জয় এতটুকু শুনে মনে মনে কিছু একটা ভাবতে থাকে। তার মাঝেই বাণী ফের বলে উঠে,
“ কিন্তু দেয়ার ইজ সামথিং। আমি জানিনা কিন্তু ফর সাম রিজন হিরণ আমার আর বহ্নির আইডেন্টিটি নিয়ে খুব প্রাইভেসি মেইনটেইন করতো সবসময়। এজ ইফ উনি কারো থেকে আমাদের ব্যাপারে লুকাচ্ছে। আর শমসের নামক একজন লোকের সঙ্গে উনার পরিচয় আছে। যে বর্তমানে আমার আর বহ্নির পরিচয় জানে। এই বিষয়টা নিয়ে হিরণকে খুব চিন্তিত হতে দেখেছি আমি। “
“ ওই শমসের নামক লোককে তুমি কখনো দেখেছো? “
“ হ্যাঁ। বাসায় এসেছিলো একবার। লোকটা সাধারণ কেউ নয়। অস্ত্রধারী। “
দূর্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আজকের জন্য যথেষ্ট হয়েছে। এই মুহুর্তে আর কিছু ভাবার পরিস্থিতিতে নেই সে। মস্তিষ্ক সামান্য আরাম চাইছে। দূর্জয়কে উঠে দাঁড়াতে দেখে বাণী হাঁটু থেকে মাথা তুলে প্রশ্ন করে,
“ তুমি কি বিরক্ত বোধ করছো? “
বাণীর প্রশ্নের কারণটা দূর্জয় ভালো করেই জানে। বহু বছর আগে সে বাণীকে নিজের বিরক্তির কারণ বলে সম্বোধন করেছিলো। বাণী হয়তো এখনো নিজেকে তাই ভাবছে। দূর্জয় বাণীর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে,
“ ঘুমাও বাণী। নিশ্চিন্তে ঘুমাও। হিরণ তোমার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে না, আমি সেই গ্যারান্টি দিচ্ছি। আর আমি আর্মিদের মেসে থাকি। এই বাসায় খুব কম আসা হয়। তাই তোমার এখানে কোনো অসুবিধা হবে না। কিছুর প্রয়োজন হলে বাহিরে ইলিয়াস এবং ফুয়াদ আছে। ওদের ডেকে বললেই চলবে। “
বাণী থমথমে গলায় বলে উঠে,
“ তুমি যথেষ্ট সাহায্য করেছো আমার। কিন্তু আমার তোমার ঝামেলা বাড়ানোর কোনো ইনটেনশন নেই। আমি যত দ্রুত সম্ভব আমার মেয়ের কাছে যেতে চাই। “
দূর্জয় নিজের ক্লান্ত গলা সামান্য দৃঢ় করে শুধায়,
“ তুমি ঝামেলা হও নাকি নও তা না-হয় আমি বুঝবো। আর বহ্নিকেও তুমি পাবে। আমাকে শুধু কিছুটা সময় দাও। আজ আসি। “
কথাটুকু বলে দূর্জয় আর অপেক্ষা করে না। প্রস্থান করে সেখান থেকে। বাণীর মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা যায় না। সে একই ভঙ্গিতে বসে রয়। বুকটা হঠাৎ এতো হালকা অনুভব হচ্ছে কেনো? কাউকে নিজের লাইফের বয়ে বেড়ানো স্যাড সংয়ের লিরিক্স শোনানোর ফলে? আচ্ছা সেই কেউ-টা কি অন্য কেউ হতে পারতো না? দূর্জয়ই কেনো হতে হবে?
__________
দ্বিতীয় মিশন সফল হওয়া উপলক্ষে শমসের মজুমদার নিজের বাসায় আজ আনন্দ মজলিসের আয়োজন করেছে। এই আনন্দ মজলিস আর দশটা সাধারণ আনন্দ মজলিসের মতো নয়। এ শয়তানের আনন্দ মজলিস। এখানে যেমন মদের যোগান রয়েছে, তেমনই রয়েছে এক লাস্যময়ী নারী। যে নিজের অঙ্গভঙ্গি দ্বারা বয়স্ক শমসেরের মনযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। শমসের মজুমদারও কম নয়। তিনিও নিজের মনযোগ সেই নারীর দিকে স্থির করে রেখেছে।
শমসের মজুমদার কখনো বিয়ে না করলেও নারী সঙ্গের অভাব হয় নি তার। যখনই ইচ্ছে জেগেছে এরকম লাস্যময়ী নারী নিজের বাসায় নিয়ে এসেছে। হাঁটুর বয়সী মেয়েরাও মোটা অঙ্কের টাকার লোভে শমসের মজুমদারকে ফিরিয়ে দেয় নি কখনো।
আচমকা কারো আগমনে শমসেরের মনযোগ ভঙ্গ হয়। নিজের ডান হাত মানিককে দেখেই তিনি প্রশ্নবোধক দৃষ্টি মেলে তাকায়। মানিক এগিয়ে এসে শমসেরের কানে কানে জানায়,
“ হিরণ স্যারের স্ত্রী বাণী হসপিটাল থেকে পালিয়েছে। “
ছোট্ট খবরটুকু পেতেই শমসের মনে মনে হিসাব মিলিয়ে ফেলে। তবে এই কারণেই হিরণ আজকের মজলিসে উপস্থিত হয় নি। শমসের এটা ভেবে পায় না বাণী নামক ওই মেয়ে হিরণের থেকে পালিয়ে বেড়ায় কি কারণে। হিরণ নামক ওই জানোয়ারটা তো কুকুরের মতোই বিশ্বস্ত। শমসেরের এতো লোভ দেখানো সত্ত্বেও এতো বছরে কোনো লাস্যময়ী নারী দ্বারা আকর্ষিত হয় নি। ওই বাণী নামক রুগ্ন দেখতে মেয়েটা ছাড়া অন্য কোনো নারীর সংস্পর্শে যায় নি। এমন বিশ্বস্ত কুকুর কি নিজের স্ত্রীর মন জয় করতে পারে নি? ভাবনাটা মনে উঁকি দিতেই শমসের একা একা হাসে। হিরণ নামক ওই পালিত কুকুরটার খুব আত্মগরিমা। অথচ সামান্য এক নারীর মন জয় করতে কি-না সে ব্যর্থ হলো?
শমসেরের ভাবনার মাঝেই মানিক প্রশ্ন করে,
“ স্যার এখন আপনার কি অর্ডার? “
“ হিরণ কি ওই মেয়েটাকে খুঁজছে? “
‘’ হ্যাঁ, স্যার। আকাশ পাতাল এক করে খুঁজছে। খবর পেলাম যাদের গাফলতির ফলে কিনা মেয়েটা পালিয়েছে তাদেরকেও খুন করেছেন তিনি। পরিস্থিতি বেশ গরম। “
শমসের মজুমদার বাকা হেসে শুধায়,
“ গরম পরিস্থিতিকে আরো গরম কিভাবে করে তোলা যায় জানো মানিক? “
মানিক প্রশ্নবোধক দৃষ্টি মেলে জানতে চায়,
“ আপনি কি কিছু ভাবছেন স্যার? “
“ হিরণ মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়ার আগে আমাদের ওকে খুঁজে বের করতে হবে। কুকুরটা খুব ঘেউঘেউ শুরু করেছে না? ওকে মিনি বিড়াল বানিয়ে পা চাটানোর মোক্ষম সুযোগ এটা। “
নিজের স্যারের কথা শুনে মানিকের মুখে সন্তোষজনক হাসি ফুটে উঠে। কি দারুণ, কি দারুণ! স্যার অবশেষে ওই হিরণকে নাচানোর পরিকল্পনা করছেন। কি দারুণই না হবে যখন হিরণ স্ত্রীর জন্য পাগলের মতো ছটফট করবে। দৃশ্যটা কল্পনা করে আরেক দফা হাসে মানিক।
__________
নিজের বেডরুমের সিঙ্গেল সোফাটায় বসে আছে এক পুরুষ। একহাতে একটা ল্যাভেন্ডার রঙের শিফনের ওড়না জড়িয়ে রেখেছে সে। ওড়নাটা নাকের কাছে চেপে ধরে চোখ বুজে রয়েছে সে। অনুভব করার চেষ্টা করছে কারো অস্তিত্ব। অন্ধকারে তলানো রুমটায় সুনসান নীরবতা পরিলক্ষিত।
আজ তিনদিন ধরে বাণী পলাতক। কোথায় আছে কে জানে? কার কাছে আছে সেটাও জানা নেই হিরণের। বাণীকে খোঁজার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে সে। বাস স্টপ, স্টেশন সর্বত্র নিজের লোক ছড়িয়ে রেখেছে। এতটুকু নিশ্চিত বাণী এখনো শহর ছেড়ে বেরোয় নি। কারণ সেই চেষ্টা করলেই হিরণের কাছে এতক্ষণে ধরা পড়ে যেতো। হিরণ একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠে,
“ দিনশেষে যেহেতু আমার কাছেই ফিরবে, তাহলে অযথা এই লুকোচুরি খেলে কি মজা পাও বাণী? আমার ভুলের জন্য আর কোনো শাস্তি খুঁজে পাও নি তুমি? খুব পুড়াচ্ছো। “
দরজা খোলার শব্দ পেতেই হিরণ ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। দরজাটা খুলে যেতেই বাহিরের আলোয় রুমটা কিঞ্চিৎ আলোকিত হয়ে উঠে। সেই আলোয় হিরণ দরজার সামনে বহ্নিকে দেখতে পায়। একহাতে একটা স্পাইডার ম্যানের সফট টয় ধরে মুখ লটকে দাঁড়িয়ে আছে সে। হিরণ মৃদু হেসে নরম গলায় ডাকে,
“ আসো মা। “
বহ্নি মুখ লটকেই তার পাপার কাছে এগিয়ে যায়। হিরণ মেয়েকে টেনে নিজের কোলে বসায়। একহাতে মেয়ের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করে,
“ ঘুম আসছে না? “
বহ্নি মাথা নেড়ে না বলে। হিরণ ফের হেসে প্রশ্ন করে,
“ কি করলে আমার প্রিন্সেসের ঘুম আসবে? “
বহ্নি কিছুক্ষণ চোখ সরু করে কিছু একটা ভাবে। অত:পর বলে উঠে,
“ আমি একটা মুভি দেখেছি পাপা। ওখানে একটা আমার সমান বয় ছিলো। ওকে ওর পাপা গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতো। তুমিও আমার জন্য গান গাইবে? “
মেয়ের অদ্ভুৎ আবদারে হিরণ অপ্রস্তুত হয়ে পরে। এসব গান টান তার কখনো তেমন একটা শোনা হয় না। তার গলাও গান গাওয়ার মতো না। কি গান গাইবে সে? গানের কথা ভাবতে গিয়েই হিরণের মনে পড়ে যায় বাণীর কথা। আনিসুজ্জামান তালুকদারের কাছে সে শুনেছিলো বাণী গান গাইতে খুব পছন্দ করে। ছোটবেলায় শিল্পকলা একাডেমি হতে গান গাওয়া শিখেছিলো। পরে কি হয়েছে কে জানে। হুট করেই বাণী গান ছেড়ে দিলো। আর কখনো কেউ তাকে গাইতে শুনে নি। তবে হিরণের সেই সৌভাগ্য হয়েছে। আনিসুজ্জামানের বাড়ি থেকে বাণীর গাওয়া বেশ কিছু ট্যাপ রেকর্ডার নিজের সংগ্রহে রেখেছে সে। মাঝেমধ্যেই তা শোনা হয়। সেখান থেকেই একটা গানের কিছু চরণ তার মনে আছে। মেয়ের আবদার রাখতে নিজের বেসুরো গলায় সেই লাইন গুলো গাওয়া শুরু করে হিরণ,
“ তু যো জুদা হো গায়ি
তেরি সাদা খো গায়ি,
দেখ লে ফির জিন্দেগী
হা কেয়া সে কেয়া হো গায়ি।
যাব সে বিছড়ি হু,
রাব সে কেহতি হু,
কিতনা সুনা হে তেরা জাহান।
ফিরতা রাহু দার বাদার
মিলতা নেহি তেরা নিশান,
হোকে জুদা কাব মে জিয়া?
তু হে কাহা? মে কাহা? “
নিজের পাপার বেসুরো গান শুনতে শুনতে বহ্নি বাণীর ওড়নাটা টেনে নিজের গায়ে জড়িয়ে নেয়। অত:পর হিরণের বুকে গুটিসুটি মেরে বলে,
“ আ’ম মিসিং মাম্মা। “
হিরণ নিচু গলায় বলে,
“ আ’ম মিসিং হার মোর। “
চলবে…
এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৭.
হসপিটালের সিঙ্গেল বেড ছেড়ে এতদিন পর হাত পা মেলে শোয়ার মতো বিশাল বিছানা পেয়ে নিশার ঘুম গভীর হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু গতকাল সারারাত সে ছটফট করে কাটিয়েছে। এক তিল পরিমাণ ঘুম তার দু চোখের পাতায় নামে নি। যতবার চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করেছে ততবার আম্মুর কথা মনে পড়েছে তার। এ এক অদ্ভুৎ লীলাখেলা! এতদিন যখন নাঈমার কাছে ছিলো তখন জুলফিকার তথা নিজের আব্বুকে খুব মিস করতো নিশা। আব্বুর কথা ভাবলেই মায়া লাগতো তার। আর এখন আব্বুর কাছে এসে আম্মুর জন্য মন পুড়ছে তার। এই কম্পলিকেটেড অনুভূতির দহন থেকে নিশা কিছুটা নিস্তার পেতো যদি তার আম্মু আব্বুর সাথে একসঙ্গে থাকার সুযোগ মেলতো। কিন্তু সেই সুযোগ এই ইহজনমে পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে মিঠে রোদ গায়ে মেখে এসব আকাশ কুসুম ভাবতে ব্যস্ত ছিলো নিশা। হঠাৎ হাতের ফোনে নোটিফিকেশনের টুংটাং আওয়াজ হতেই সে দ্রুত গতিতে ফোনের স্ক্রিনের পানে চায়। অত:পর সিম কোম্পানির ইন্টারনেট অফারের অপ্রয়োজনীয় ম্যাসেজটা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। সকাল থেকে বার কয়েক রুহীর নাম্বার ডায়াল করেছে নিশা। মেয়েটার নাম্বার আনরিচেবল বলছে। রুহীর আম্মু আব্বুর নাম্বারেও বার কয়েক কল করেছে। কিন্তু উনারাও ফোন রিসিভ করছেন না।
মেয়েটাকে ঘিরে তার চিন্তার শেষ নেই। খুব কাছের একজন ক্লাসমেটের কাছে সে ওই ভয়ংকর দিনের কিছুটা বিবরণ শুনেছে। সেই বিবরণে এ-ও উল্লেখ্য ছিলো যে রুহী নাকি কোন এক আতঙ্কবাদীর সঙ্গে পূর্ব পরিচিত ছিলো। খুব সম্ভবত তাদের মধ্যে কোনো প্রেম ঘটিত সম্পর্কও ছিলো। নিশা প্রথমে এটা বিশ্বাস করতে চায় নি। কিন্তু সেই ক্লাসমেট জানায় তারা স্বচক্ষে দেখেছে। রুহীর ওই আতঙ্কবাদীর সঙ্গে জড়িত থাকাকে ঘিরে ক্লাসের সকলেরই তার প্রতি তিক্ত অনুভূতি কাজ করছে। কেবল এক অজানা কারণে কেউ মুখ ফুটে সেই বিষয়ে আর কিছু বলছে না।
রুহী বর্তমানে কি অবস্থায় আছে তা আল্লাহই কেবল ভালো জানেন। কিন্তু নিশা জানে তার বেস্ট ফ্রেন্ড ভালো নেই। ওর জীবন যে খুব দূর্বিষহ কাটছে তা সে খুব আন্দাজ করতে পারছে।
রুহীর কথা মনে পড়তেই নিশা ফেসবুকে লগইন করে। অত:পর রুহীর আইডি সার্চ করে প্রবেশ করে রুহীর হাস্যজ্বল ছবি গুলো দেখতে দেখতে ভাবে এই একই হাসি কি আর কখনো দেখতে পাবে সে? নিশার উদাস মনে আরো কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়। সে রুহীর আইডি থেকে বের হতেই নিউজফিডে পিপল মে ইউ নো তে হঠাৎ একটা আইডি দেখে থমকে যায়। তামজিদ সাইফ। নিশা আইডিটায় প্রবেশ করে সর্বপ্রথম অদ্ভুত লোকটার প্রোফাইল পিকচার বড়ো বড়ো চোখ মেলে দেখে। জংলী প্রিন্টের টি শার্ট পরিহিত লোকটা, জংলী এক জায়গায় গলায় কালো সবুজের মাঝামাঝি রঙের একটি জংলী সাপ পেচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে তার ফকফকা বত্রিশ দাঁতের হাসি ঝুলে আছে। নিশার অবচেতন মন বলে উঠে,
“ লোকটা পাগল। মরার ভয় নেই একদম। “
আগ্রহ বশত এবার নিশা সাইফের আইডি স্টক করা শুরু করে। কিন্তু হতাশাজনক ভাবে সাইফের আইডিতে তেমন কোনো তথ্যই দেওয়া নেই তার ব্যাপারে। কেবল গোটা কুঁড়ি ছবি রয়েছে। প্রতিটি ছবিই বনে জঙ্গলে তোলা এবং প্রতিটি ছবিতেই তার সঙ্গী হলো কোনো পশু প্রাণী। গরু – ছাগল হতে শুরু করে জঙ্গলের বন মোরগ পর্যন্ত কাউকে রেহাই দেয় নি এই উন্মাদ লোক।
নিশা যখন স্টকিংয়ে ব্যস্ত ঠিক সেই মুহুর্তে বারান্দায় দরজায় এসে উপস্থিত হয় নার্স কলি। তিনি গলা ঝাড়ি দিয়ে প্রশ্ন করেন,
“ রুমে যাবে এখন নিশা? অনেকক্ষণ ধরে বসে আছো। “
আচমকা কারো আগমনে নিশা চমকায়। হাতের ফোনটা এলোমেলো ভঙ্গিতে কোলে রেখে দেয়। মাথা নেড়ে সম্মতি পোষণ করে বলে,
“ হ্যাঁ। বসে থেকে কোমড় ধরে আসছিলো। “
মহিলা নার্সটি হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলে,
“ ফিজিওথেরাপি চলছে যে তাই মাসল গুলোতে এরকম পেইন ফিল করছো। ধীরে ধীরে আবার আগের মতো ঠিক হয়ে যাবে। “
নিশা হেসে ফোনটা হাতে নিয়ে নার্স কলির সাহায্যে রুমে চলে যায়। ভীতু মেয়েটা জানলোও না, কখন তার অজান্তে এলোমেলো হাতের চাপ লেগে ওই পাগল লোকটার কাছে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট চলে গিয়েছে।
__________
গতকাল সন্ধ্যায় হেডকোয়ার্টারে গুরুত্বপূর্ণ সেনা সদস্যদের মধ্যে এক দীর্ঘ আলাপ চলেছে। আলাপের মুখ্য বিষয় ছিলো সদ্য ঘটে যাওয়া টেরোরিস্ট অ্যাটাক এবং সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনের এর সঙ্গে জড়িত হওয়ার তথ্যটা সম্পর্কে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবার সিনিয়র কর্নেল জুবায়ের শিকদার ফিলিস্তিনের ব্যাপারে জেনেই চাইছিলো এই ব্যাপারটা মিডিয়ায় ডিসক্লোস করে ফিলিস্তিনের উপর সব দায় চাপিয়ে দিতে। কিন্তু তাতে বাঁধ সাধে মিটিংয়ে উপস্থিত সকল সেনা সদস্যরা। জুবায়ের শিকদার তখন তেঁতে উঠে বলেন,
“ জনগণ আমাদের উপর থেকে আস্থা হারাচ্ছে। এটাই কি চাইছো তোমরা? “
মিটিং টেবিলে উপস্থিত মেজর শাহরিয়ার দূর্জয় তখন থমথমে গলায় শুধায়,
“ কোনো ধরনের কনফারমেশন ব্যতীত যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশের উপর এতো বড় দায় চাপিয়ে দেওয়া কি আমাদের নীতি বিপক্ষীয় নয়? “
দূর্জয়ের কণ্ঠস্বর শুনে সকলেরই শিরদাঁড়া বেয়ে হিমশীতল হাওয়া বয়ে যায়। মেজর দূর্জয় বরাবরই ব্ল্যাক কফির মতো তেঁতো গোছের মানুষ। সেই তেঁতো কফিতে আরো দু চামচ কফি পাউডার মিক্স করলে তা খেতে যতটা বিদঘুটে হবে, দূর্জয়ের কণ্ঠও ঠিক ততটাই ভয়ংকর শোনাচ্ছিলো। সবাই কিছুটা ভয় পেলেও কর্নেল জুবায়ের শিকদার দমে না। তিনি বলে উঠে,
“ আর কোন কনফারমেশন চাচ্ছো তুমি? সত্যটা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। এই টেরোরিস্ট গুলো সব ওদের নেওটা। “
দূর্জয়ের দমিয়ে রাখা রাগ ক্ষোভ এবার শীতল গলায় প্রকাশ পায়।
“ সত্যটা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার স্যার। ওরাও নিজেদের ভূখণ্ডের জন্য লড়াই করছে স্যার, ঠিক যেমনটা আমাদের দেশের মানুষ করেছিলো। “
মিটিংয়ে উপস্থিত কর্নেল আশরাফুল মামুন এবার জুবায়ের শিকদার এবং দূর্জয়ের এই নীরব দ্বন্দ্বে বাগড়া দিয়ে বলে উঠেন,
“ কর্নেল জুবায়ের শিকদার পরিস্থিতি লজিক দিয়ে ভেবে দেখুন। এই ঘটনার সঙ্গে যে দেশের নাম উঠে এসেছে তাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় এরকম একটা ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হওয়া। তবুও তারা জড়িত কিনা এই সন্দেহ কারো মনে থেকে থাকলে সেই সন্দেহ মেটানোর জন্য আমাদের সলিড প্রুফের প্রয়োজন। “
আশরাফুল মামুনের কথা শুনে জুবায়ের শিকদারের মুখ কালো হয়ে আসে। জুলফিকার মুজতবা সেই সুযোগে আশরাফুল মামুনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ স্যার একটা উপায় আছে সত্যটা জানার। “
কর্নেল আশরাফুল কি জানতে চাইলেই জুলফিকার বলেন,
“ আমরা সবাই জানি বাংলাদেশের তরফ থেকে ফিলিস্তিনিদের জন্য ত্রাণ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আগামী সপ্তাহেই আমাদের সামরিক বাহিনীর তত্তাবধানে সেই ত্রাণ ফিলিস্তিনে গিয়ে পৌঁছাবে। এই সুযোগে যদি আমরা আমাদের কিছু দক্ষ সেনাকে সেখানে পাঠাই তাহলে এর একটা বিহিত করা সম্ভব। আমাদের সৈন্যরা সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি তদন্ত করে জানতে পারবে যে কে কিংবা কারা সেই ওয়েবসাইটে এসব আপডেট পরিচালনা করছে। “
জুবায়ের ব্যতীত সকলেই জুলফিকারের প্রস্তাবে একমত পোষণ করে। কর্নেল আশরাফুল মামুন জানায় তিনি উপরের পদের লোকদের সঙ্গে এই ব্যাপারে আলোচনা করবেন। অনুমতি মিললেই উনারা এই প্রস্তাবে আমল করবেন। দূর্জয় এ শুনে মনে মনে খানিকটা স্বস্তি অনুভব করেছিলো। যাক! এই উপায়ে অন্তত সত্যটা তো সবার সামনে আসবে। তাই ঢের।
__________
মানিক নামক শমসের মজুমদারের নেওটা মালিকের কথা অনুযায়ী বাণীকে খুঁজে বের করার মিশনে নেমেছে। এই মিশনের শুরুতেই সে শমসেরের দেওয়া ক্ষমতা খাটিয়ে প্রথমে হসপিটালের সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখতে যায়। কিন্তু তখনই সে জানতে পারে উল্লেখ্য সময়ের সিসিটিভি ফুটেজটা এক্সিডেন্টলি ডিলিট হয়ে গিয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজের রেকর্ডিংটা এক্সিডেন্টলি ডিলিট হয়েছে নাকি ইচ্ছাকৃত ভাবে করা হয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না মানিকের। সে সঙ্গে সঙ্গে এই খবর পৌঁছে দেয় শমসের মজুমদারের নিকট।
শমসের মজুমদারের মতো ধূর্ত লোক উপলব্ধি করে হিরণের ওই রুগ্ন স্ত্রী কারো সাহায্য নিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু কার সাহায্য নিয়েছে? পর মুহুর্তেই শমসেরের মনে পড়ে একই সময়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবার মেয়েও একই হসপিটালে এডমিট ছিলো। এরকম একটা কাজ ঘটানো জুলফিকার মুজতবার জন্য কোনো অসম্ভব বিষয় নয়। তবে কি ওই অসভ্য মেয়েটা জুলফিকার মুজতবার হেফাজতে আছে? ভাবনাটা মাথায় উঁকি দিতেই শমসেরের মুখে বিতৃষ্ণা ছড়িয়ে পড়ে। হিরণের স্ত্রী তাদের কাজ সমন্ধে কতদূর জানে তা শমসেরের জানা নেই। কিন্তু ওই অসভ্য মেয়ে যদি তাদের কাজ সম্পর্কে এক বিন্দু পরিমাণ সত্যিও ওই লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে জানায় তবে ভীষণ বিপদ হবে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে শমসের মানিককে ফোন করে বলে উঠে,
“ জুলফিকার মুজতবার উপর নজর রাখো। ওই মা* খুব সম্ভবত ওই লেফটেন্যান্ট কর্নেলের খোপের ভেতর গিয়ে লুকিয়েছে। যতদ্রুত সম্ভব হিরণের মা*কে আমার চাই। “
বসের আদেশ পেতেই মানিক আর বিলম্ব করে না। সে দ্রুত জুলফিকারের উপর নজর রাখা শুরু করে। সকাল পেরিয়ে রাত হয়, কিন্তু সন্দেহভাজন কিছু তার চোখে পড়ে না। অবশ্য আর্মি কোয়ার্টারের ভেতর কিংবা তার আশপাশেও উঁকিঝুঁকি মারার সাহস করে না মানিক। সেকারণে আর্মি কোয়ার্টারের মধ্যে বাণী আছে কিনা তা বুঝতে বেশ হিমশিম খাচ্ছে মানিক। মনের হিমশিম দূর করতে সে শমসেরকে ফোন করে প্রশ্ন করে,
“ স্যার, আর্মি কোয়ার্টারের ভেতর বাণী ম্যাডামের থাকার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কি? “
শমসের সেকেন্ড পাঁচেক ভাবেন। তার মস্তিষ্ক জবাব দেয়,
“ না। কোনো সম্ভাবনা নেই। “
মুখে তিনি জবাব দেয়,
“ জুলফিকার নিজের ঘরে ওই মেয়েকে তোলার মতো বোকামি হয়তো করবে না। তুমি ভালো করে নজর রাখো। আমার মনে হয় অন্য কোনো সুরক্ষিত আস্তানায় হয়তো এই মেয়ে ঘাটি পেতেছে। “
__________
রাতের খাবার সেড়ে ঘুমানোর আগে স্টাফ মেসের কমন রুমে সাত সৈন্য এক হয়েছে। সকলেই তখন রাফির জন্য আনন্দ প্রকাশে ব্যস্ত। তাদের লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবাকে ফিরিয়ে দেননি অন্যার পিতা। জুলফিকার প্রচুর বিচক্ষণতার সঙ্গে ভদ্রলোকের বরফের ন্যায় মনকে গলাতে সক্ষম হয়েছেন। রাফির ব্যাপারে পজেটিভ মতবাদ দ্বারা তিনি ভদ্রলোককে বেশ ইম্প্রেস করেছেন। ফলস্বরূপ সামনের শুক্রবার রাফি এবং অন্যার বাগদান। বিয়েটা অবশ্য কেবল রাফির প্রমোশনের পরেই সম্ভব। কিন্তু ততদিনের জন্য অন্যা অফিশিয়ালি রাফির বাগদত্তা হিসেবে পরিচিত থাকবে। আর তাদের মনে বিচ্ছেদের ভয় কাজ করবে না। রাফির পরিবার অবশ্য আগে থেকেই অন্যার ব্যাপারে জানতো। উনারাও আর বাগদান নিয়ে কোনো আপত্তি করেন নি।
সবাই যখন আনন্দঘন মুহুর্তে মশগুল সাইফ তখন ক্লান্ত দেহটা একটা সোফায় মেলে বসে। ফোনটা হাতে নিয়ে নেট অন করতেই একের পর এক নোটিফিকেশন এসে ভীড় জমায়। এতো এতো নোটিফিকেশনের ভীড়ে সাইফের দৃষ্টি স্থির হয় অনাকাঙ্ক্ষিত এক নোটিফিকেশনের পানে। ‘ইয়াসমিন মুজতবা সেন্ট ইউ এ ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট।’
সাইফ বুঝে পায় না এই ভীতু বাচ্চা মেয়ে তাকে রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছে কোন উদ্দেশ্যে? ইনবক্সে এসে সাইফকে ভাইয়া ভাইয়া ডেকে মুখে ফ্যানা তুলতে? সাইফ ভাবনায় মশগুল হয়েই রিকুয়েষ্টটা এক্সেপ্ট করে। হাজার হোক, তার লেফটেন্যান্ট কর্নেলের একমাত্র ভীতু মেয়ে। অযথা মেয়েটাকে ঝুলিয়ে রাখার মানে হয়না। যদিও সাইফ জগতের সকল মেয়েকেই বউ জাত হিসেবে গণ্য করে, কিন্তু এই মেয়ের জন্য নাহয় নিয়ম বদলাবে। স্যারের আদরের মেয়েকে নাহয় পাতানো বোনের আসনে বসাবে স্ব সম্মানে।
__________
রাত তখন সবে ন’টা বাজে। নিশা খাওয়া দাওয়া সেড়ে বিছানায় শুয়ে ল্যাপটপে একটা মুভি দেখছিলো। হঠাৎ ফোনের নোটিফিকেশনের টুং শব্দে সে ঘাড় ঘুরিয়ে ফোনটা হাতে নেয়। অপ্রত্যাশিত নোটিফিকেশন পেয়ে তার চক্ষু চড়াক গাছ। তামজিদ সাঈফ এক্সেপ্টেড ইউর রিকুয়েষ্ট। এই অনর্থক নোটিফিকেশনের মানে কি? নিশা তো এই লোককে রিকুয়েষ্ট পাঠায় নি। তবে? তার আইডি হ্যাক হলো নাকি?
কথাটা ভাবতে ভাবতেই নিশা সাইফের ইনবক্সে এক শব্দে প্রথম ম্যাসেজটা সেন্ড করে,
“ ভাইয়া? “
ম্যাসেজটা সিন হয় সাথে সাথেই। অত:পর এক মিনিটের মাথায় রিপ্লাই আসে,
“ বলুন বোন। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]