এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৫৯+৬০+৬১

0
213

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫৯.

সম্ভাব্য হামলার তদন্তের জন্য তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুলিশ, র‍্যাব, সেনাবাহিনীর তিনটি দল লাগাতার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়াও দেশের আটটি বিভাগে চলছে কড়া নজরদারি এবং টহল। পুলিশ, র‍্যাব এবং সেনাবাহিনীর সেই তদন্তে বিভিন্ন অপরাধী ধরা পড়লেও আতঙ্কবাদীদের আস্তানাটা এখনো ধরা পড়ছে না। কোন ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে এরা লুকিয়ে আছে তা সকলের অজানা। সকলের মনে প্রাণে কেবল একটাই দোয়া, যেনো খুব বড়ো কোনো অঘটন থেকে মহান আল্লাহ যেনো সবাইকে হেফাজত করেন।

সবেমাত্র মেজর শাহরিয়ার দূর্জয় এর আওতায় একটা সার্চ অপারেশন সম্পাদন করে বের হলো ছয় লেফটেন্যান্ট সহ গোটা একটা টিম। চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল হতে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে কিছু পলাতক আতঙ্কবাদীকে। আপাতত এদের সেনাবাহিনীর খাস রিমান্ডে নেওয়া বাকি। সেখানেই এদের থেরাপি দিয়ে পেট থেকে যথাসম্ভব তথ্য বের করা হবে।

সেনাবাহিনীর গাড়িটার পেছনে মুখোমুখি উঠে বসে ছয়জন লেফটেন্যান্ট। সামনে ড্রাইভারের পাশের প্যাসেঞ্জার সিটটায় বসে আছে মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিটা জানালার বাহিরে নিবদ্ধ। মনে চলছে গভীর চিন্তা। আজ একটা সপ্তাহ ধরে তীব্র ব্যস্ততায় তার সময় কাটছে। যতক্ষণে সে সামান্য ফ্রি হয় ততক্ষণে বাণীর স্কুল ছুটি হয়ে যায়। দেখা পাওয়া দুষ্কর। বাণীর কথা ভেবে দূর্জয় নিজেও সামনে যাচ্ছে না আপাতত। এটা সত্য যে সে বাণীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, তবে তা নিয়ে সে মোটেও তার উপর প্রেশার ক্রিয়েট করতে চাইছে না। মেয়েটা যত খুশি সময় নেক। দূর্জয় তো আছেই অপেক্ষা করার জন্য।

আচমকা ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠতেই দূর্জয়ের ধ্যান ভাঙ্গে। সে ফোনটা বের করতেই দেখে স্ক্রিনে মাসুদের নাম্বার। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে সে। অপর পাশ থেকে মাসুদ ব্যস্ত গলায় শুধায়,

“ স্যার, ম্যাডাম মাথা ঘুরিয়ে রাস্তায় পড়ে গিয়েছে। আমি উনাকে ওসমানী সিটি হসপিটালে নিয়ে এসেছি। কিন্তু বাচ্চাটা আই মিন বহ্নি আমাকে ভরসা করতে পারছে না। কান্নাকাটি করছে। কি করবো? “

দূর্জয় বিচলিত না হয়ে বরং মাথা ঠান্ডা রেখে বলে,

“ আমি আসছি। ফোনটা বহ্নিকে দাও। “

বহ্নির নাম শুনতেই পিছনে বসে থাকা পাঁচ লেফটেন্যান্ট বিস্ময় নিয়ে একে অপরের মুখে চাওয়াচাওয়ি করে। সাইফ ব্যতিক্রম। সে অবাক হয় না। বরং তাকে দেখে মনে হচ্ছে, এ যেনো হওয়ারই ছিলো। ফোনটা বহ্নির কাছে দিতেই অপর পাশ থেকে ফোপাঁনোর শব্দ শুনতে পায় দূর্জয়। সে কণ্ঠে অপ্রতিরোধ্য স্নেহ মিশিয়ে বলে,

“ কান্না করবেন না। আমি আসছি তো। একটু শান্ত হয়ে আংকেলটার কাছে থাকুন। উনি অপরিচিত নয়। মেজরের বন্ধু। “

বহ্নিকে কিছুটা শান্ত করে ফোনটা রাখে দূর্জয়। পাশে বসে ড্রাইভ করতে ব্যস্ত সৈন্যকে বলে,

“ গাড়ি ওসমানী সিটি হসপিটালের দিকে নিয়ে চলুন। “

আদেশটুকু বর্তিয়েই দূর্জয় পিছু ফিরে লেফটেন্যান্টদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,

“ আপনাদের কারো আপত্তি আছে? “

সাইফের ঠোঁটের আগায় যেনো উত্তর প্রস্তুতই ছিলো। সে বিলম্ব না করে বলে,

“ না স্যার। উই আর অল ওকে। “

দূর্জয় ফের নীরব ভঙ্গিতে সামনে ফিরে বসে। গত বিশ ঘন্টা ধরে সে নির্ঘু্ম রয়েছে। প্রতিক্রিয়া দেখানোর মতো বিন্দুমাত্র বল খুঁজে পাচ্ছে না শরীরে। তার উপর শীতের কারণে শরীর কেমন ঝিম মেরে আছে। কিন্তু এই বলহীন দেহের মনের ভেতরটা অস্থির হয়ে আছে। যা বাহির থেকে দেখে বুঝার সাধ্যি কারো নেই।

__________

দূর্জয়রা যখন হসপিটালে এসে পৌঁছায় তখন প্রায় বিকেল। লেফটেন্যান্টরা নিজ থেকে দূর্জয়ের সাথে এসেছে। যদি কিছুর প্রয়োজন হয়! করিডোর ধরে দ্রুত পায়ে ইমারজেন্সি ইউনিটের দিকে এগোনো ইউনিফর্ম পরিহিত যুবকদের দিকে সবাই বারবার ফিরে তাকাচ্ছে। মনে আগ্রহ ও প্রশ্ন জাগছে। সৈন্যদের গুরুতর কোনো কেস বুঝি?

দূর্জয় ইমারজেন্সি ইউনিটের সামনে আসতেই দেখে একপাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে মাসুদ দাঁড়িয়ে আছে। তার ঠিক পাশের বেঞ্চিটাতেই মাথা নত করে বসে জুস এবং চিপস খাচ্ছে বহ্নি। দূর্জয় এগিয়ে যায়। বহ্নির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে,

“ ভয় পেয়েছিলেন আপনি? “

বহ্নি চোখ তুলে তাকায়। দূর্জয়কে দেখতেই ভরসা খুঁজে পায়। এই লোকটা আশেপাশে থাকলে সে নিজেকে সেফ ফিল করে। মেজর যেহেতু এসে পড়েছে এখন মাম্মাও নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাবে? ভাবনটা মাথায় উঁকি দিলেও আবার বাণীর মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। বহ্নি আহ্লাদে কেঁদে উঠে বলে,

“ মাম্মা অনেক ব্যথা পেয়েছে। “

দূর্জয় বহ্নির ছোট হাত দুটো নিজের মুঠোয় নিয়ে তাতে আলতো করে চুমু খেয়ে আদুরে গলায় বলে,

“ মাম্মা ঠিক হয়ে যাবে। আপনি লাঞ্চ করেছেন? “

বহ্নি মাথা নেড়ে না বলে। দূর্জয় উঠে মাসুদের কাছে এগিয়ে যায়। আদুরে স্বর পাল্টে মুহুর্তেই গম্ভীর স্বরে বলে,

“ শুরু থেকে ডিটেইলস বলো এখন। “

“ স্যার, ম্যাম স্কুল থেকে বেরিয়ে বাসায় ফিরছিলো। উনাকে দেখে ডিস্টার্বড মনে হচ্ছিলো। কিছু দূর যেতেই রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে যান। পাকা রাস্তা তো, মাথাও ফেটে গিয়েছে। “

“ বহ্নিকে নিয়ে যাও ক্যান্টিনে। লাঞ্চ করে নি এখনো। লাঞ্চ করিয়ে আনো। “

কথাটুকু শেষ করে দূর্জয় আর কিছু না বলে দ্রুত পায়ে ইমারজেন্সি ইউনিটে প্রবেশ করে। লেফটেন্যান্টরা এতক্ষণ সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিলো। দূর্জয় ভেতরে যেতেই সাইফ এগিয়ে আসে। মাসুদের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলে,

“ হাই, আমি লেফটেন্যান্ট সাইফ। বহ্নিকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। আমাকে চেনে ও, তাই আমার সঙ্গে বেশি কম্ফোর্ট ফিল করবে। “

মাসুদ মানা করে না। তবে মনে মনে ঠিক করে সে নিজেও সঙ্গে যাবে। হাজার হোক স্যারের অর্ডার!

সাইফ এগিয়ে এসে বহ্নির পাশে বসে। বহ্নি আড়চোখে একবার সাইফকে দেখে চোখ মুছে আবার চিপস খাওয়ায় মনযোগ দেয়। সাইফ হাত বাড়িয়ে বহ্নির চিপসের প্যাকেট থেকে একটা চিপস নিতে চাইলেই বহ্নি দ্রুত দূরে সরে যায়। সে দেবে না। সাইফ ঢং করে বলে,

“ ভেবেছিলাম তোমাকে এখানের সবথেকে মজার বিরিয়ানি খাওয়াবো। কিন্তু তুমি মেবি ইন্টারেস্টেড না। “

বহ্নি সঙ্গে সঙ্গে সাইফের দিকে তাকায়। কিছু একটা ভেবে নিজের হাতের চিপসের প্যাকেটটা সাইফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ তুমি চিপস খাও ষ্টুপিড আংকেল, আমি বিরিয়ানি খাবো। “

অপমানে মুহুর্তেই সাইফের মুখটা থমথমে হয়ে যায়। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লেফটেন্যান্টরা সাইফের চুপসে যাওয়া মুখ দেখে চাপা হাসছিলো। তাদের দিকে তাকাতেই বহ্নির আচানক চোখ গিয়ে আটকায় সাদাতের দিকে। সুদর্শন যুবকটাকে দেখতেই সে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রয়! এই আংকেলকে সে আগে কখনো দেখে নি কেনো? কি সুন্দর! একদম মার্ভেল মুভির হিরো গুলোর মতো!

__________

ভারী চোখ গুলো মেলে পিটপিট করে তাকায় বাণী। মনে হচ্ছে যেনো এক গভীর ঘুম থেকে উঠেছে। চারিপাশ হতে ভেসে আসছে মানুষের চাপা কথাবার্তার আওয়াজ। প্রথম দফায় চোখ খুলতে নিয়েও লাইটের আলোয় চোখ কুচকে বুজে ফেলে সে। দ্বিতীয় দফায় ধীরে ধীরে তা মেলে তাকায়।

ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে চারিপাশে তাকাতেই দেখতে পায় তার হাতে ড্রিপ লাগানো। ফিরোজা রঙের থ্রি পিসটা সম্পূর্ণ কম্বলে ঢাকা। বেডের দু’দিকে বিশাল পর্দা টানা। বাকি দু পাশে রয়েছে দেয়াল। কিন্তু বাণীর চোখ গিয়ে আটকায় দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এলোমেলো দূর্জয়ের দিকে। মাথাটা দেয়ালের সঙ্গে এলিয়ে চোখ বুজে রেখেছে। হাত দুটো বুকের কাছে আড়াআড়ি ভাজ করা। চেহারায় সুস্পষ্ট কিছুটা চিন্তা এবং ক্লান্তির ছাপ।

বাণী মাথা তুলে বসতে চায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মাথার পেছনের দিকটা ব্যথা করে উঠে তার।
উঠে বসার বৃথা চেষ্টা বাদ দিয়ে বাণী শুয়েই রয়। মনে করার চেষ্টা করে কি হয়েছিলো। স্কুল থেকে ফেরার পথে আচমকা চোখের সামনে সবটা ঝাপসা হয়ে উঠে তার। তারপর আর কিছু মনে নেই। মুহুর্তেই বাণী অস্থির হয়ে উঠে। বহ্নি তার সঙ্গে ছিলো। তাহলে বহ্নি কোথায়?

বাণী আরেকবার আশেপাশে তাকায়। পরপর উঠে বসার চেষ্টা করে। কিছুটা শব্দ পেতেই দূর্জয় সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকায়। সে ঘুমায় নি বরং কিছু সময়ের জন্য চোখ বুজে রয়েছিলো। চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে। সে বাণীকে উঠে বসতে দেখে এগিয়ে আসে। বাণী ততক্ষণে বেডে পা ঝুলিয়ে বসেছে। দূর্জয় শান্ত স্বরে বলে,

“ রিল্যাক্স। বহ্নি ঠিক আছে। বাহিরেই আছে। ইমারজেন্সি ইউনিট হওয়ায় ওকে ভেতরে আসার পারমিশন দেবে না। “

বহ্নি ক্ষীণ স্বরে আওড়ায়,

“ ও একা বাহিরে? “

“ না। আমার লেফটেন্যান্টরা আছে। বহ্নি ওদের কোম্পানি বেশ ইঞ্জয় করছে। আমি দশ মিনিট অন্তর অন্তর চেক করে আসছি। চিন্তা নিও না। “

বাণী কিছুটা ধাতস্থ হয়ে স্থির হয়ে বসে। দূর্জয় একটা পানির বোতল খুলে এগিয়ে দেয় বাণীর দিকে। শান্ত গলায় বলে,

“ প্রেশার অত্যাধিক লেভেলের লো তোমার। হিমোগ্লোবিনের মাত্রাও লো। এতটা অযত্ন কেন বাণী? “

বাণী জবাব দেয় না। নীরবে পানির বোতলটা হাতে নিয়ে কিছুটা পানি খায়। গলাটা বেশ শুকিয়ে ছিলো তার। দূর্জয় আরো এক দফা প্রশ্ন করে,

“ কিসের দায়ে নিজেকে এভাবে শেষ করে দিচ্ছো? “

বাণী এবারও জবাব দেয় না। নীরব রয়। মনে পড়ে যায় গত কালের ঘটনা।

স্কুল থেকে ফিরে খাওয়া দাওয়া করে বাণী আর বহ্নি ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ছাদ থেকে কাপড় আনার কথা খেয়াল ছিলো না তার। যখন ঘুম ভাঙে তখন সন্ধ্যা। মাগরিবের আজানের ধ্বনি চারিদিকে শোনা যাচ্ছে। বাণী দ্রুত মাথায় ওড়না প্যাঁচিয়ে বেরিয়ে যায় কাপড় আনতে। ছাদের অন্য পাশে দাঁড়িয়ে তখন রিহাব নামক লোকটা সিগারেট ফুঁকতে ব্যস্ত ছিলো। পানির টাংকির অপর পাশে হওয়ায় বাণী তা খেয়াল করে নি। সে যখন এক এক করে কাপড় নিচ্ছিলো আচমকা শরীরে অশালীন ছোঁয়া অনুভব করে। বাণীর হাতের কাপড় গুলো পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সে ছিটকে দূরে সরে যায়। ঘুরে তাকিয়ে রিহাবের মুখটা দেখতেই সে হতভম্ব হয়ে যায়। রিহাবের মুখে সে কি বিশ্রী হাসি!

কিসের শংকায় জানা নেই তবে বাণী তখন ত্রস্ত পায়ে দৌড়ে ঘরে গিয়ে দরজা জানালা সব আটকে বসে ছিলো। সে কি দমবন্ধকর অনুভূতি! বাণীর খুব মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো। উপলব্ধি করতে পেরেছিলো এই গোটা বিশ্বের কোনো কোণেই সে নিরাপদ নয়। সবাই সুযোগের অপেক্ষায়। সুযোগ পেলেই বাণীকে বিষাক্ত ছোবলে মুমূর্ষু করে তুলতে প্রস্তুত।

সেই রাতে বাণী সাহস করে সিথী আপার নাম্বারে কল করে পুরো ঘটনা জানায়। উনার স্বামীর আসল মুখোশ সম্পর্কে জানায়। মহিলা কোন মাটির তৈরী তা বাণীর জানা নেই, কিন্তু মুহুর্তেই বড় বোনের মতো স্নেহ করা মহিলাটি রূপ বদলে ফেলে। বাণীকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে না। বরং বলে বাণী মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে। আসল সমস্যাটা বাণীর নিজের চরিত্রেই। নাহলে কি এরকম বাপ ছাড়া সন্তান জন্ম দেয়? আবার মাঝরাত্রে কি-না তার এপার্টমেন্টে কোন পুরুষ মানুষও আসে!

বাণী সেই মুহুর্তে ক্ষেপে উঠেছিলো। কিন্তু মহিলা বাণীর তেজ দেখে তাকে সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেয় তিনি আর বাণীকে নিজের বাসায় দেখতে চায় না। যতদ্রুত সম্ভব এই বাসা খালি করে দিতে। বাণীও তখন রাগের বশে বলে ফেলেছিলো এরকম চরিত্রহীনের বাসায় থাকতে সে-ও আগ্রহী নয়।

কিন্তু সকাল হতেই বাণী উপলব্ধি করে আরো একবার সে কূল কিনারা হীন সমুদ্রের মাঝে আটকা পড়েছে। তীরে পৌঁছানোর জন্য কোনো বৈঠা নেই তার কাছে। আর না সে সাতার জানে। এই বিষাক্ত, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি হতে মুক্তি পেতে বাণী স্কুলে যায়। কিন্তু সেখানেও শান্তি পায় না সে। সিথী নামক মহিলাটা ইতিমধ্যে বাণীর নামে কুৎসা রটিয়ে দিয়েছে তখন কলিগদের মাঝে। প্রতিটা কলিগ বাণীকে নিয়ে ফিসফিস করে সমালোচনায় মত্ত ছিলো, বাকা চোখে তাকাচ্ছিলো। বাণী এই মানসিক যন্ত্রণাটা আর নিতে পারছিলো না। দাঁতে দাঁত খিচে কোনো মতে ক্লাসগুলো শেষ করে বেরিয়ে আসে সে। বহ্নিকে নিয়ে স্কুল ছেড়ে বের হতেই অনুভব করে এই শীতেও তার ঘাড় ঘামছে। শরীরটাও মৃদু কাপছে। তারপর… তারপর সবটা ঝাপসা।

দূর্জয়ের ডাকে বাণী বর্তমানে ফিরে আসে। চোখ তুলে তাকায়। দূর্জয় সম্ভবত কিছু বলছিলো। কথাগুলো বাণীর কানে স্পষ্ট পোঁছায় না। সে নির্লিপ্ত দৃষ্টি মেলে দূর্জয়কে দেখতে থাকে। তার মন তাকে বলছে স্বার্থপরের ন্যায় এই নিখুঁত ছেলেটার জীবনে নিজের ছাঁয়া যেনো না মাড়ায় বাণী। আর তার মস্তিষ্ক তাকে বলছে যে কখনো কখনো সমুদ্রের উত্তাল ঢেউতে দক্ষ ডুবুরিও নিজেকে সামলাতে হিমশিম খায়। প্রতিটা ঢেউ তাকে আছড়ে তীর হতে দূরে সরিয়ে নেয়। নিজের অতল গহীনে টেনে নেওয়ার খেলায় মত্ত হয়। সেরকম পরিস্থিতিতে বাঁচার জন্য ডুবুরির প্রয়োজন হয় সাহায্যের। সেই সাহায্য নেওয়ার ফলে ডুবুরিটা কখনো ছোট হয়ে যায় না। তবে সাহায্যকারী ঠিকই সম্মানীয় হয়ে যায়। বাণীর মনে প্রশ্ন জাগে, দূর্জয়ই কি তার জীবনের সেই লাইফ জ্যাকেট?

দূর্জয় নিজের কোনো প্রশ্নের জবাব না পেয়ে চুপ হয়ে যায়। নীরবে দেখতে থাকে ফর্সা আদলের মুখটায় অযত্নে গড়ে উঠা রক্তশূণ্য এবং দূর্বলতার ছাপ। বাণী সেই মুহুর্তে বলে উঠে,

“ তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও কেনো? “

বাণীর প্রশ্ন শুনে দূর্জয় কিছুটা চমকায়। ফের ক্লান্ত স্বরে স্নিগ্ধতা মিশিয়ে জবাব দেয়,

“ পাঁচ নং ধাপে পৌঁছে গিয়েছি বলে। “

বাণী দূর্জয়ের কথার অর্থ বুঝে না। সে মাথা নত করে ফেলে। চোখের কার্নিশে তার অশ্রু এসে ভীড় করে। রুদ্ধস্বরে বলে,

“ আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না দূর্জয়। আমি জানি আমি তোমার যোগ্য না। কিন্তু আমার বেঁচে থাকাটা দুষ্কর হয়ে উঠছে। “

দূর্জয়ের কি হলো কে জানে! সে আলতো হাতে বাণীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

“ জীবনটা তোমার বাণী। সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমার নেই। তবে তুমি কতটুকু যোগ্য সেই হিসেবটা না-হয় আমাকেই ঠিক করতে দাও। “

“ তুমি শুদ্ধ। আমি দাগে জর্জরিত। সেই দাগ তোমার জীবনেও লাগবে। “

বাণী দৃষ্টি তুলছিলো না। কিন্তু দূর্জয় তার চোখে চোখ রাখতে ব্যকুল তখন। সে বেডের একপাশে থাকা বাণীর সাদা ওড়নাটা তুলে হাতে নেয়। অত:পর তা বাণীর গায়ে আলগোছে পেঁচিয়ে দিয়ে এক হাঁটু ভেঙে তার সামনে বসে। নিজে চোখ তুলে বাণীর বিষাদ মাখা চোখ দুটো দেখে। অত:পর হাজার বছরের তৃষ্ণার্তের ন্যায় তাকিয়েই রইলো। চোখ দুটো বাণীর পানে স্থির থাকলেও ঠোঁট নাড়িয়ে আপনাআপনি বলে উঠে,

“ তুমি আমার দেখা সবথেকে সাহসী, স্বচ্ছ এবং শুদ্ধতম নারী বাণী। “

আর দশটা নারীর মতো বাণী লজ্জায় লাল হলো না৷ বরং বাণীর দু চোখ বেয়ে তখন দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে নেয়। দূর্জয় নিজের ডান হাত বাড়িয়ে হাতের তালুতে সেই অশ্রু বিন্দু জমালো। অত:পর হাতটা সরিয়ে নিতে নিলেই বাণী কম্পিত ভঙ্গিতে সেই শ্যাম বর্ণের হাতের তালুতে নিজের বাম হাত রাখে। দূর্জয় বিস্মিত হয়। পরপর সচল মস্তিষ্ক ব্যাপারটা উপলব্ধি করতেই হাতের বন্ধন দৃঢ় করে। বাণী দূর্বল গলায় বলে,

“ ভরসাটুকু আমার শেষ সম্বল ছিলো। তা আজ তোমাকে দিলাম। সামলে রেখো। “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৬০.

“ সোজা সাপ্টা একটা সত্য কথা বলি
তোমায় ভীষণ রকম ভালোবাসি,
হাজার যুদ্ধ বয়ে গেছে মনে
তোমায় এই কথা বলবো বলে,
বলা হয় নি কথা কি ছিলো এই মনে
বলা হয় নি কথা কি ছিলো এই মনে।
জানি আবার একটি জন্ম আমার কভু হবে না
জানি আবার এমন করে তোমার দেখা পাবো না। “

কানে হেডফোন গুজে ক্যান্টিনের টেবিলটায় মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে ছিলো সাদাত। কিছুটা বিশ্রামের সন্ধানেই এই পদক্ষেপ। তবে আচমকাই গানটা থেমে কানে তীক্ষ্ণ স্বরে বেজে উঠে রিংটোনের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে সে চোখ মুখ কুচকে সোজা হয়ে বসে। ফোনটা হাতে নিয়ে নামটা দেখতেই ক্লান্তি ভুলে আচানক মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। সে সতেজ হাসি মুখে লেপ্টে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই অপর পাশ হতে বাজখাঁই স্বরটা বলে উঠে,

“ এই ছেলে! কোথায় তুমি? “

ব্যস! সাদাতের ফুরফুরে মেজাজের পিন্ডি চটকে দেয় দৃশান। সাদাত বেরস স্বরে বলে,

“ পৃথিবীতেই আছি। অন্য কোনো গ্রহে তো আর আমার এক্সেস নেই। “

দৃশান বিরক্তিকর গলায় বলে,

“ তোমাদের বয়সী ছেলেদের এই এক সমস্যা। বড়দের সাথে কথা বলার ম্যানারস নেই একদম। সালাম আদব কায়দা সব ভুলে বসে আছো। “

সাদাতের মেজাজ খারাপ হয়। এই মহিলার কি কথা বলার সময় প্রতি সেকেন্ডে রিমাইন্ডারের মতো ‘আমি তোমার সিনিয়র’ এই রিয়েলিটি চেক দেওয়াটা খুব জরুরি? সাদাত তো এই ব্যাপারটা ভুলে যায় নি মোটেও। তবুও কেন? সাদাত দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ জরুরি কিছু না হলে ফোনটা রাখো। আমি ব্যস্ত। “

“ আচ্ছা ওয়েট। এটা বলতে কল করেছিলাম যে আমি চট্টগ্রাম আছি। আগামীকাল সেইন্ট মার্টিন ঘুরতে যাবো। তারপর আবার ঢাকা ব্যাক করবো। যদি ফ্রি থাকো তবে এখন চাইলে দেখা করতে পারি। গত ক’দিন ধরে শুধু হোটেলের রিসিপশনিস্ট, উবার ড্রাইভার আর রেস্টুরেন্টের ওয়েটারদের চেহারা দেখতে দেখতে আমি হাপিয়ে গিয়েছি। “

সাদাত না চাইতেও কিছুটা উৎফুল্ল স্বরে বলে উঠে,

“ তুমি চট্টগ্রামে? কোথায়? কখন এসেছো? “

“ তোমার বয়সী ছেলেদের এই আরেকটা সমস্যা। তোমরা অতিরিক্ত প্রশ্ন করো। ফ্রি থাকলে নিজের লোকেশন শেয়ার করো। আমি আসছি। “

বলেই ফোনটা কেটে দেয় দৃশান। সাদাত ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে দ্রুত নিজের লোকেশন শেয়ার করে পাঠায়। আচমকাই তার হাসি মিলিয়ে যায়। সে ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের টেবিলটায় তাকায়। টেবিলে বসে থাকা পাঁচজন যুবকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তখন সাদাতের পানে নিবদ্ধ। সাইফ মুখে একটা একটা করে চিপস পুরতে পুরতে কেমন সন্দিহান দৃষ্টিতে সাদাতকে দেখছে!

সাদাত ঘাবড়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

“ এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন তোরা? “

জুনায়েদ হতাশ গলায় বলে,

“ তোর জীবনে কোনো নারীর আগমন ঘটেছে, আর সেই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা তুই একবারও আমাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না? এই ছিলো তোর বন্ধুত্ব? ছিহ সাদু। শেম অন ইউ। “

সাইফ সামান্য গলা ঝেড়ে বলে,

“ দ্যাটস নট এ বিগ ডিল। আমিও কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম তোদের একটা বিষয় জানাবো। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে জানানোর সুযোগ পাই নি। সেটা হলো আই এম ইন লাভ। দ্যা গার্ল আই লাভ অলসো লাভস মি। “

প্রত্যয় বাদে সকলেই বিস্মিত দৃষ্টি মেলে সাইফের পানে তাকায়। জুনায়েদ আহত গলায় বলে,

“ দোস্ত তুইও? “

প্রত্যয় এবার সামান্য কেশে সবার মনযোগ আকর্ষণ করে বলে,

“ আমারও কিছু জানানোর আছে। আমি আর জেসি বিয়েতে রাজি। আগামী ১৮ তারিখ আমাদের এনগেজমেন্ট ডেট ফিক্স হয়েছে। ইউ অল আর ইনভাইটেড। “

জুনায়েদের এবার প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। সে ক্ষোভ মিশ্রিত স্বরে বলে,

“ তোরা একদম বিয়ে করে দু চারটে বাচ্চা ফুটিয়ে পরে আমাকে জানাতি। এতো আগে আগে জানিয়ে ফেললি কেনো? “

জুনায়েদ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে টেবিলে মাথা এলিয়ে দেয়। ফারদিন হতাশা নিয়ে শান্তনা দিতে বলে,

“ মন খারাপ করিস না দোস্ত। এগুলো সবগুলো বিশ্বাসঘাতক। আই ক্যান ফিল ইউর পেইন। “

জুনায়েদ আর ফারদিন যখন নিজেদের দুঃখ ভাগাভাগি করতে ব্যস্ত তখন আচমকা শব্দ করে কেদে উঠে তাদেরই মাঝে বসে থাকা একজন। ছয় জন লেফটেন্যান্টই বিস্মিত দৃষ্টি মেলে তাকায় চেয়ারে বসে থাকা ছোট মানবীটার দিকে। সাইফ হতভম্ব হয়ে বলে,

“ খাইসেরে! এই ক্যাসেট কান্দে কেন ভাই? এই বহ্নি! কান্না করো কেনো? তোমার চিপস খেয়েছি দেখে? আমি তোমাকে আরো কিনে দিবো নি। “

বহ্নির কান্না থামে না। সে চেয়েও তা থামাতে পারছে না। ওই সুন্দর আংকেলটা এতো সুন্দর করে একটা মেয়ের সাথে কথা বলছিলো তা ও মেনে নিতে পারছে না। কিছু ঘন্টা আগে শুরু হওয়া লাভ স্টোরিটা এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে? ওই মেয়েটা কি বহ্নির থেকেও বেশি প্রিটি? প্রশ্নটা মাথায় উঁকি দিতেই বহ্নি কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ছয়জন তখন বহ্নির কান্না থামানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। এদের কারোই এসব বাচ্চা কাচ্চার কান্না থামানোর অভিজ্ঞতা নেই। তবে সাদাতের ছোট দুই বোন থাকায় তার অভিজ্ঞতা আছে। সে বহ্নির কাছে এগিয়ে এসে মন ভোলানোর চেষ্টা করে। এতে বহ্নির মন আরো খারাপ হয়ে যায়। সে ধরা গলায় বলে,

“ আমি মাম্মার কাছে যাবো। “

__________

হসপিটালের বাহিরের রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে দু’জন ব্যক্তি। সাদাত আড়চোখে বারবার দৃশানকে পরখ করতে ব্যস্ত। দৃশানের দৃষ্টি রাস্তায় নিবদ্ধ। আচমকা সে নীরবতা ভেঙে বলে উঠে,

“ তোমার সঙ্গের পাঁচ নমুনাকে বলো এভাবে পিছু পিছু স্টক না করে একেবারে আমাদের সঙ্গে এসেই নাইট ওয়াক করতে। “

সাদাত সঙ্গে সঙ্গে চমকে পিছনে ফিরে তাকায়। রাস্তার সোডিয়াম নিয়নে দেখতে পায় তাদের থেকে কিছুটা দূরেই পাঁচজন যুবক হাঁটা থামিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গুনছে। একেক জনের মুখের ভাবখানা এমন যেনো তারা কিছুই বুঝে না। সাদাত তখনও বিস্মিত। এই পাঁচ জন এতক্ষণ ধরে তাদের ফোলো করছিলো, আর তা সাদাত ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি! সে কি নামরাকে পরখ করতে এতোই মশগুল ছিলো? সাদাত দৃশানের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“ তোমার অস্বস্তি হলে বলো। ওদের যেতে বলছি। “

“ থাকুক। আমাদের মধ্যে তো তেমন কিছু নেই যা ওরা দেখলে আমি অস্বস্তি বোধ করবো। “

দৃশানের কথার ধরনে সাদাতের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। তেমন কিছু দ্বারা এই মেয়ে কি মিন করেছে তা বুঝতে হিমশিম খাচ্ছে সে। ধ্যাৎ! সাদাতের উচিত অতি শীঘ্রই বাদাম খাওয়া শুরু করা। আজকাল হুটহাট তার ব্রেইন খুব স্লো কাজ করছে।

সাদাত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাঁটতে থাকে। ঠিক সেই মুহুর্তে অতি সন্তর্পণে একজোড়া চোখ অতি গোপনে তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সেই দৃষ্টিতে রাগ নেই, ক্ষোভ নেই, বিরক্তি নেই। রয়েছে চাপা হাসি এবং একরাশ মুগ্ধতা। সে খুব ভালো করেই জানে যে সাদাত এতক্ষণ আড়চোখে তাকে দেখছিলো। ব্যাপারটা বেশ মজার হলেও, বিরক্তিকরও ছিলো বটে। কারণ সাদাতের চোখ না ফেরানোর দায়ে দৃশান তাকে দেখার সুযোগই পাচ্ছিলো না। আর তো কেবল ক’টা দিন আছে হাতে। একবার ইয়েমেনে ফিরে গেলে দেখার সুযোগ মিলবে না আর। সাদাত ঘুরে তাকাতে নিলেই দৃশান সঙ্গে সঙ্গে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।

সাদাত জানতে চায়,

“ তোমার দাদীর ওই জমির ঝামেলা সলভ হয়েছে? “

দৃশান চমকায়। কারণ প্রকৃতি পক্ষে সে কোনো জমির ঝামেলা দেখতে বাংলাদেশে ফিরে নি। সে এসেছে কেবল ক’টা দিন এই সুদর্শন পুরুষকে দেখার তৃষ্ণা মেটাতে। কিন্তু সাদাতের ব্যস্ততার কারণে এই পর্যন্ত কেবল দু তিন দিনই তাদের দেখা হয়েছে। দৃশান নিজের বিস্ময়তা মুহুর্তেই আড়াল করে বলে,

“ হ্যাঁ সলভড। “

সাদাত একবার নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকায়। যথেষ্ট রাত হয়েছে। তার এখন ফেরা উচিত। কিন্তু দৃশান? বেচারি এতো কষ্ট করে সাদাতের সঙ্গে দেখা করতে এলো, তাকে রেখে মেসে ফেরা কি ঠিক হবে? সাদাতকে বেশি আর ভাবতে হয় না। দৃশান নিজেই বলে উঠে,

“ ওয়েল, আমি তাহলে আজকে যাই। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। কালকে আবার সেইন্ট মার্টিন ট্রিপ। “

সাদাতের পা জোড়া থেমে যায়। সে দৃশানের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলে,

“ আচ্ছা, হ্যাভ এ সেফ ট্রিপ। “

দৃশান আশেপাশে তাকাতেই রাস্তার ধারে বেড়ে উঠা এক গুচ্ছ ফুলগাছ দেখতে পায়। সেই গাছ গুলোয় ফুটে রয়েছে বিভিন্ন রঙের ফুল। দৃশান আগ্রহী গলায় জিজ্ঞেস করে,

“ ওগুলো কি ফুল? “

সাদাত ঘুরে তাকায়। অত:পর হেসে শুধায়,

“ ওগুলো কৃষ্ণকলি ফুল। বাহারি রঙের গুচ্ছ। “

কথাটা বলেই সাদাত এগিয়ে গিয়ে মুঠো ভর্তি কতগুলো ফুল ছিড়ে নিয়ে আসে। দৃশানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ তোমার জন্য। ইয়েমেনে হয়তো এই ফুলের দেখা পাবে না। বাংলাদেশের স্মৃতি হিসেবে রাখতে পারো। “

সাদাতের কথা শেষ হতেই দূর হতে পাঁচটি স্বর একসঙ্গে সুর তুলে ওওও বলে উঠে। দৃশান এবং সাদাত হতভম্ব হয়ে সেই পানে তাকাতেই পাঁচজন সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকে ফিরে আকাশে তারা গুণতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সাদাত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দৃশানও সেদিকে আর তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে নিজের ব্যাগের ফিতের সঙ্গে বাধা একটা চারকোণা ছোট স্কার্ফ খুলে হাতে নেয়। অত:পর তা মেলে এগিয়ে ধরে ইশারা করে সাদাতকে। সাদাত সঙ্গে সঙ্গে মেলে ধরা স্কার্ফের বুকে নিজের হাতের ফুলগুলো রাখে। দৃশান তা অতি যত্নের সহিত ব্যাগে রেখে বলে,

“ ধন্যবাদ। যাই তাহলে? “

সাদাত কণ্ঠনালিতে কোনো রূপ শব্দ খুঁজে পায় না। কেবল মুখে হাসি ফুটিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। দৃশান এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। সঙ্গে সঙ্গে সেই পথ ধরে নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। আচমকা সাদাত পিছু ডাকে,

“ দৃশান? “

সাদাতের ডাক শুনতেই নামরা পিছু ফিরে তাকায়। সাদাত শান্ত গলায় জানতে চায়,

“ আবার দেখা হবে আমাদের? “

দৃশান মৃদু হাসে। প্রশ্নটার উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না তার। কেবল মৃদু গলায় বলে,

“ আল্লাহ হাফেজ লেফটেন্যান্ট সাদাত। “

কথাটুকু বলেই আর অপেক্ষা করে না দৃশান। নীরবে প্রস্থান করে। একবারও পিছু ফিরে দেখে না।

__________

সেই রাতে হসপিটাল থেকে বাণী এবং বহ্নিকে তাদের এপার্টমেন্টের সামনে ড্রপ করে দিয়ে দূর্জয়ের নিজের বাসায় ফিরতে রাত এগারোটা বেজে গিয়েছিলো। বাসায় ফিরেই সে সর্বপ্রথম নিজের মামণিকে কল করে। সুহালা কলটা রিসিভ করতেই দূর্জয় বলে উঠে,

“ ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাও মামণি। আমি তোমার আগামীকালের ফ্লাইটের টিকিট অনলাইনে বুক করে দিচ্ছি। তুমি চট্টগ্রাম আসছো। “

হুট করে ছেলের এহেন কথা শুনে সুহালা বিস্মিত হয়। পরপর বলে উঠে,

“ হঠাৎ? “

“ তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানানোর ছিলো আমার। “

“ হ্যাঁ, আমি শুনছি। বলো। “

“ কলে নয় মামণি। সামনাসামনি বলবো। “

সুহালা বেগম আর ঘাটে না। তার ছেলে অহেতুক এরকম বলছে না তা তিনি ভালো করেই জানে। তাই কেবল টুকটাক কথা বলে ফোন রাখতে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে দূর্জয় আবার বলে উঠে,

“ তোমাকে বেশ ক’দিন এখানে থাকতে হবে মামণি। সেই অনুযায়ীই কাপড় নিও। “

সুহালা বেগম এবার আরো অবাক হয়। দূর্জয়ের বাবা মারা যাওয়ার পর চট্টগ্রামের ওই বাড়িটায় গিয়ে তার এক দু’দিনের বেশি কখনো থাকা হয় নি। তার মূল কারণ ঢাকার বাড়িটার বাহিরে উনার মন টিকে না কখনো। দূর্জয়ও তা জানে বিধায় কখনো উনাকে জোর করতেন না। এবার তাহলে কি হলো? খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় বুঝি? নাকি ছেলেটা একা অনুভব করছে?

সুহালা বেগমের সঙ্গে কথা শেষ করেই দূর্জয় উঠে রুমে যেতে নেয়। সেই মুহুর্তে তার ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে জুলফিকার মুজতবার নাম্বার দেখে দূর্জয় সঙ্গে সঙ্গে তা রিসিভ করে। জুলফিকার মুজতবা কোনো ভনিতা না করে প্রশ্ন করে,

“ ইজ বাণী অলরাইট? “

দূর্জয়ের ভ্রু জোড়ার মাঝে ভাজ পড়ে। স্যার এই প্রশ্ন করছে কেনো? দূর্জয় তো এখনো উনাকে জানায় নি যে বাণী হসপিটালাইজড ছিল। তবে? দূর্জয় জবাব দেয়,

“ প্রেশার ফল করে আজকে রাস্তায় সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলো। হসপিটালাইজড করা হয়েছিলো। নাও শি ইজ অলরাইট। “

জুলফিকার এবার সামান্য চিন্তিত স্বরে বলে,

“ আমার মনে হয় না ও ঠিক আছে। “

“ কি হয়েছে স্যার? “

“ সানরাইজ হোপ স্কুলের প্রিন্সিপালের কল এসেছিলো। তুমি তো জানোই ও আমার পুরনো বন্ধু। কথায় কথায় আমাকে ও জানায় বাণীকে নিয়ে স্কুলে নাকি একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা ছড়িয়েছে আজ। ব্যাপারটা নিয়ে সে চিন্তিত ছিলো। স্কুলের সম্মানের কথা ভেবে আমাকে ব্যাপারটা জানিয়েছে ও। “

“ কি ধরনের অপ্রাসঙ্গিক কথা? “

জুলফিকার কথাটা বলতে অস্বত্তি অনুভব করছিলো। হাজার হোক মেয়ের বয়সী একজনের ব্যাপারে এমন কিছু বলতে উনার লজ্জা করছে। তবুও তিনি ইতস্তত করে বলে,

“ ওর সিঙ্গেল মাদার হওয়ার ব্যাপারটাকে নেগেটিভভাবে প্রচার করা হচ্ছে স্কুল জুড়ে। আর… “

বাকিটা আর বলতে হয় না জুলফিকারকে। দূর্জয় থমথমে স্বরে বলে,

“ আচ্ছা স্যার, আমি দেখছি বিষয়টা। “

ফোন কেটে দূর্জয় মাসুদকে কল করে। কলটা রিসিভ শীতল স্বরে কিছু অর্ডার বর্তিয়ে ফোনটা রাখে সে। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে হাজার খানিক চিন্তা।

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৬১.

হিম বাতাসে ঘরের পর্দা গুলো উড়ছে। বাণীর মুখোমুখি বসে আছে দূর্জয়। ভেতরের বেডরুম হতে গেমস খেলার শব্দ ভেসে আসছে। বহ্নিকে নিজের ফোন দিয়ে রুমে বসিয়ে রেখে এসেছে বাণী। তার কারণ হলো এই সকাল বেলা দূর্জয় এসেছে তার সঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বলতে। সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা ঠিক কি তা আন্দাজ করতে পারছে না বাণী।

দূর্জয়ের চোখ জোড়ায় গতকাল রাতের ক্লান্তি ভাবটা আর নেই। ছয় ঘন্টার ঘুমে চোখ মুখে আবার তীক্ষ্ণ গম্ভীর ভাবটা ফুটে উঠেছে। সে সরাসরি বাণীর চোখে চোখ রেখে বলে উঠে,

“ আমাদের মাঝে যেই সম্পর্কের সূচনা হতে যাচ্ছে সেই সম্পর্ক শুরুর প্রথম শর্ত হচ্ছে সম্পর্কটাতে কোনো ধরনের লুকোচুরি থাকবে না। তাই সাফ সাফ প্রশ্ন করছি বাণী, সিথী নামক মহিলা তোমার নামে আজেবাজে কথা রটানোর পিছনে কারণ কি? “

বাণী অবাক হতে গিয়েও আর হয় না। আজকাল বুঝতে পারছে তার জীবনের ছোট বড় সকল ঘটনা দূর্জয়ের নিকট পৌঁছে দেওয়াটাও কারো চাকরি। কি যেনো নাম লোকটার? মাসুদ! হ্যাঁ, ওই লোকটাই হয়তো এই তথ্য দূর্জয়ের নিকট পৌঁছে দিয়েছে।

দূর্জয় ফের বলে উঠে,

“ সত্যটা পর্যন্ত চাইলে আমি নিজেই পৌঁছাতে পারি বাণী। কিন্তু আমি তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাচ্ছি। ইউ নিড টু ওপেন আপ ইউরসেল্ফ টু মি হোয়েনেভার ইউ আর ফেসিং সামথিং টেরিবাল। “

বাণী লুকায় না আর কিছু। চোখ নত করে হাতের নখ খুটতে খুটতে জবাব দেয়,

“ পরশু সন্ধ্যায় আমি যখন ছাদ থেকে কাপড় আনতে যাই তখন সিথী আপুর হাজবেন্ড রিহাব নামক লোকটা আমাকে বাজে ভাবে ছুঁয়ে দেয়। আমি এই ব্যাপারে আপুকে জানাতে গেলে আপু আমাকে বিশ্বাস করে না। উনার মতে সমস্যাটা আমার চরিত্রে। “

দূর্জয় নীরবে শুনে সবটা। অত:পর শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে,

“ সিথী আপুকে জানানো গেলো, কিন্তু আমাকে জানানো গেলো না? ভয় পাচ্ছিলে আমি জাজ করবো? এতটুকু বিশ্বাস হয় নি এখনো আমার প্রতি? “

বাণী উত্তর দেয় না। বলতে পারে না যে সে দূর্জয়কে বিশ্বাস করে। কিন্তু নিজের সমস্যার কথা কাউকে যেচে জানাতে তার মধ্যে অস্বস্তি কাজ করে। দূর্জয় বলে,

“ ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাও। “

বাণী চমকে প্রশ্ন করে,

“ কোথায় যাবো? “

“ ডোন্ট টেল মি এই ইন্সিডেন্টের পরও তুমি এই বাসায় থাকতে চাচ্ছো। “

“ না, বাসা ছেড়ে দিবো আমি। কিন্তু এই মুহুর্তে কোথায় যাবো? “

দূর্জয় বলে,

“ বিয়ের আগ পর্যন্ত যেখানে তুমি আর বহ্নি সেফ থাকবে। “

বিয়ের আগ পর্যন্ত কথাটা শুনতেই বাণীর অদ্ভুৎ অনুভূতি হয়। সে কিছুক্ষণ নীরব থেকে উঠে চলে যায়। জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের পরিমাণ অধিক না হওয়ায় চল্লিশ মিনিটের মধ্যে তার ব্যাগ গুছানো শেষ হয়ে যায়। দূর্জয় দায়িত্ববান পুরুষের মতো লাগেজ দুটো নিজের দুই হাতে তুলে নেয়। বাণী প্রশ্ন করে,

“ ফার্নিচার? “

“ এগুলোর প্রয়োজন নেই আর। সব সেল করার ব্যবস্থা করে ফেলবো। কিছু প্রয়োজন হলে নিজের বাসায় তোমার মন মতো করে তা সাজিয়ে নিও। “

কথাটুকু কানে বাজতেই বাণী চোখ নামিয়ে নেয়। ঠিক লজ্জায় না, বরং অদ্ভুৎ অনুভূতিতে। এধরণের কথায় ঠিক অভ্যস্ত নয় সে। তাই বোধহয়। বহ্নি কাছে এসে হাত ধরে ঝাঁকাতেই বাণী অনুভূতির বৃত্তান্ত হতে বেরিয়ে আসে। একহাতে মেয়ের হাত ধরে এবং অন্য হাতে বাসার তালা চাবি নিয়ে দূর্জয়ের পিছু পিছু বেরিয়ে আসে।

__________

পরিচিত বাড়ির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাণী অস্বস্তি অনুভব করে। মিনমিনে গলায় দূর্জয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ এখানে কেন দূর্জয়? আমি আর বহ্নি না হয় ক’টা দিন হোটেলে থাকি? শুধু শুধু ঝামেলা… “

বাণীর কথা সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার পূর্বেই ভেতর থেকে দরজা খুলে হাস্যজ্বল মুখে বেরিয়ে আসে জুলফিকার। আজ তার পড়নে কোনো ইউনিফর্ম নেই বরং রয়েছে ঘরের টি শার্ট এবং ট্রাউজার। জুলফিকার প্রফুল্ল গলায় বলে,

“ ওয়েলকাম ব্যাক আম্মু। “

বাণী ইতস্তত গলায় বলে,

“ আসসালামু আলাইকুম আংকেল। “

বহ্নিও উৎফুল্ল গলায় বলে,

“ হ্যালো! “

বাণী নরম গলায় শাসিয়ে বলে,

“ সালাম দিতে হয় মা। “

বহ্নি সঙ্গে সঙ্গে সালাম দেয়। দূর্জয় ব্যাগ দুটো নিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। জুলফিকার মুজতবাও বহ্নিকে নিজের কোলে নিয়ে খোশমেজাজে ভেতরে চলে যায়। বাণী কিছুক্ষণ বাহিরে দাঁড়িয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেও ভেতরে প্রবেশ করে।

নিশা রুম থেকে বেরিয়েই বাণীকে দেখে সরল হাসি নিয়ে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। অত:পর বহ্নির সঙ্গে গল্পে মশগুল হয়ে যায়। জুলফিকার চোখের ইশারায় কিছু একটা বলতেই নিশা বহ্নিকে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। জুলফিকার মুজতবা দূর্জয় এবং বাণীকে বলে,

“ তোমরা বসো। আমি দুই মিনিট আসছি। “

বাণী এবং দূর্জয় আলাদা আলাদা দুটো সোফায় বসে জুলফিকারের অপেক্ষা করতে থাকে। বাণীর খুব লজ্জা লাগছে। এভাবে সম্পর্কহীন একটা মানুষের বাসায় এভাবে মুখ উঠিয়ে এসে পড়া কতটা ঠিক তা নিয়ে সে দ্বিধায় আছে। তার ঠিক পাশের সোফাটাতেই বসা দূর্জয় হয়তো তার মুখশ্রী দেখে তার সেই অস্বস্তি বুঝতে পারে। তাইতো নিজেই বলে উঠে,

“ স্যারের সঙ্গে আমারও রক্তের সম্পর্ক নেই। তবুও আমি উনাকে নিজের অভিভাবক মানি, সম্মান এবং শ্রদ্ধা করি। সব সম্পর্ক রক্তের হতে হবে এরকম কোনো লিখিত আইন নেই। “

বাণী চোখ তুলে তাকায়। ফের চোখ নামিয়ে নেয়। জুলফিকার মুজতবা তিন মগ কফির ট্রে হাতে এসে উপস্থিত হয়। বাণী অবাক হয় না। আগে যখন সে এই বাসায় ছিলো তখন প্রায়ই দেখতো জুলফিকার আংকেল ফ্রি টাইমে এটা সেটা বানাচ্ছে।

জুলফিকার বসে ধীরে সুস্থে বলে,

“ দূর্জয় আমাকে জানিয়েছে যে তোমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছো। কংগ্রেচুলেশন। আই এম হ্যাপি ফোর বোথ অফ ইউ। “

দূর্জয় মৃদু হাসলেও বাণী লজ্জায় আরো নত হয়ে যায়। নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছে সে। যতবারই নিজেকে দূর্জয়ের পাশে কল্পনা করছে ততবারই সেই হীনমন্যতা তাকে জেঁকে ধরছে। জুলফিকার এবার নরম গলায় বলে,

“ তোমার আপত্তি না থাকলে আমি আর নিশা কনে পক্ষের সদস্য হতে চাই। তোমার আপত্তি আছে আম্মু? “

বাণীর চোখ এবার টলমল করে উঠে। এ কথা সত্য যে টিনেজ বয়সে সে একবার পাশের সোফায় বসে থাকা মানুষটাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চেয়ে মেনিফেস্ট করেছিলো। তবে আর দশটা মেয়ের মতো আলাদা করে কখনো বিয়ের স্বপ্ন দেখে নি সে। যদি তার জীবনটা আজ স্বাভাবিক হতো তাহলে তার পরিবারকে নিশ্চয়ই কনে পক্ষ বলা হতো? কে জানে!

জুলফিকার এবং দূর্জয় পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পারে। জুলফিকার নড়ে চড়ে বসে নরম গলায় বলে,

“ মন থেকে বলছি আম্মু। “

বাণী মাথা নেড়ে বলে,

“ আমার আপত্তি নেই। “

দূর্জয় একবার হাত ঘড়ি দেখে বলে উঠে,

“ আমার মামণিকে রিসিভ করতে যেতে হবে। আপাতত বহ্নিকে এই ব্যাপারে কেউ কিছু বলবেন না। আমি সন্ধ্যায় এসে ওর সঙ্গে কথা বলবো। “

জুলফিকার দূর্জয়কে এগিয়ে দিতে দরজা পর্যন্ত যায়। দূর্জয় দরজার ওপারে গিয়ে জুলফিকারের পানে ফিরে তাকায়। জড়তা হীন স্বরে বলে,

“ মাই উড বি ফ্যামিলি ইজ নাও আন্ডার ইউর কাস্টাডি স্যার। শীঘ্রই আসবো। অধিকার সমেত নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবো। “

জুলফিকার কেবল হাসে। দূর্জয় গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ফোন বের করে কাউকে কল করে। কঠিন স্বরে কঠিন একটা অর্ডার বুঝিয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে সে।

__________

সুহালার শুভ্র মুখটা মূর্তির মতো স্থির। নিষ্পলক দেখছে তার সামনে বসে থাকা ছেলেকে। দূর্জয়ের মুখভঙ্গি অত্যন্ত স্বাভাবিক। সুহালা কণ্ঠে বিস্ময় নিয়ে বলে,

“ তুমি বিয়ে করতে চাচ্ছো, তা-ও এমন একটা মেয়েকে যার অলরেডি একটা বাচ্চা আছে? “

দূর্জয় শান্ত গলায় বলে,

“ আমি জানি বাচ্চাটা এখন একান্তই ওর। বিয়ের পরে আমাদের বাচ্চা হবে ও। আমি এতে কোনো সমস্যা দেখছি না। “

সুহালা বেগম কিছু বলতে পারে না জবাবে। তার ছেলে যে কঠিন ভাবে এই বিয়ের জন্য মনস্থির করে রেখেছে তা তিনি স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারছেন। দূর্জয় এবার নিজের মা’য়ের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কিছুটা কোমল স্বরে বলে,

“ আমি তোমার থেকে কিছু লুকাই নি মামণি। কারণ তুমি আর দশটা মানুষের মতো জাজমেন্টাল আচরণ করবে না সেই ভরসা আমার আছে। আর আমার যেকোনো সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানার অধিকারও তোমার আছে। “

সুহালা বেগম একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ে। চট্টগ্রামে এসেই এরকম একটা কথা শোনার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলো না। তার উপর মেয়েটার অতীত কি ভয়ংকর! একটা মাত্র ছেলে তার। মেয়েটাকে নিজে কাছ থেকে না জেনে তিনি হ্যাঁ ও বলে দিতে পারছে না। সুহালা বেগম প্রশ্ন করেন,

“ বিয়েটা কি তুমি দয়ার বশে করতে চাচ্ছো? “

“ মোটেও না। বিয়েটা আমি সম্পূর্ণ মন থেকে করতে চাচ্ছি। আই হ্যাভ ফিলিংস ফর বাণী। “

সুহালা বেগম উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“ হুট করে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। আমাকে ওদের সঙ্গে পরিচয় করাও। কাছ থেকে জানতে চাইছি। তারপর বাকিটা দেখা যাবে। আপাতত ক্লান্ত আমি। একটু ঘুমাবো। “

__________

শান্ত শীতল বিকেল বেলার নীরবতা ভাঙে এক মহিলার চিৎকারে। বাড়ির রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের গাড়িটার দিকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক হ্যান্ডকাফ পড়া পুরুষকে। তার পিছু পিছু দৌড়িয়ে আসছে তার স্ত্রী যিনি জোর গলায় দাবী করছেন,

“ আমার স্বামী নিরপরাধ। “

একজন কনস্টেবল বিদ্রুপের সুরে বলে উঠে,

“ সমস্যা নাই আপা। জেলে যাওয়ার পর অপরাধ বের হয়ে আসবে। “

আশেপাশের উৎসুক জনতা তখন নিজেরা ফিসফিস করতে ব্যস্ত। কেউ বলছে হয়তো চাচার মৃত্যুর পর চাচাতো বোনদের সম্পত্তির হক মেরে দালান বানানোর অপরাধে লোকটা গ্রেফতার হলো, কেউ বা বলছে দু’দিন আগে এই লোকের স্ত্রীর কাছে প্রাইভেট পড়ুয়া মেয়েটাকে মোলেসটের দায়ে লোকটাকে পুলিশে ধরেছে।

সিথী বুঝতে পারছে না কিসের দায়ে তার স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। রিহাব তখন চিল্লিয়ে বলে,

“ হা করে উজবুকের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে গিয়ে উকিল খুঁজে বের করো গর্দভ মহিলা। আমার জামিনের ব্যবস্থা করো দ্রুত। “

মহল্লার উৎসুক মানুষজন তখন চারিদিকে ভীড় জমিয়েছিল। এতগুলো মানুষের সামনে গর্দভ মহিলা বলে ডাকায় বেশ অপমানিত বোধ করে সিথী। যার সকল অপরাধ সে পর্দা দিয়ে আড়াল করে সে-ই লোকই কিনা তার সঙ্গে এমন আচরণ করে? মুহুর্তেই মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তিনি। এই লোকের কোনো জামিন করাবে না তিনি। জেলে পচে মরুক। দুটো দালানের বাড়ি ভাড়া এবং স্কুলের বেতন দিয়ে নিজের সন্তান নিয়ে বেশ শান্তিতেই দিন কাটাতে পারবে সিথী। এই পুরুষের কোনো প্রয়োজন নেই তার।

রিহাবকে পুলিশ ভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা নীরবে দেখে রাস্তার মোড়ে গাড়ির ভেতর বসে থাকা এক ঈগল দৃষ্টি। রাগে স্টিয়ারিংটা শক্ত হাতে চেপে ধরে বসে আছে সে। সমাজ থেকে যদি এই আবর্জনা গুলোকে উপড়ে ফেলা যেতো সম্পূর্ণ!

__________

গোধূলি লগ্ন তখন। ফোনে পরিচিত নাম্বার হতে আগত কলটা দেখেই বাণী তা রিসিভ করে। অপর পাশের মানুষটা কিছু একটা বলতেই সে অস্বস্তি অনুভব করে। ফোনটা রেখে ধীর পায়ে হেঁটে রুম থেকে বের হয়। লিভিং রুমে বসে ফোনালাপে ব্যস্ত জুলফিকারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। জুলফিকার কলটা এক মুহুর্তের জন্য হোল্ড করে প্রশ্ন করে,

“ কিছু বলবে আম্মু? “

বাণী ইতস্তত করে বলে,

“ আংকেল, দূর্জয় এসেছে। আমাকে আর বহ্নিকে রেডি হয়ে বের হতে বলছে। আমরা যাবো? “

জুলফিকার মুজতবার মনটা ভালো হয়ে যায় মুহুর্তে। মেয়েটার ভদ্র ব্যবহার এবং আচরণে তিনি বরাবরই মুগ্ধ। স্বভাবের দিক দিয়ে একদমই নিশার মতো শান্তশিষ্ট। এ কারণেই বোধহয় মেয়েটার প্রতি পিতৃস্নেহ জাতীয় মায়া কাজ করে তার মধ্যে। জুলফিকার হেসে বলে,

“ অবশ্যই। যাও ঘুরে আসো। “

বাণী ফের বলে,

“ নিশাও তো কোচিং-এ গিয়েছে। ফিরতে দেরি হবে। আমি সন্ধ্যার নাস্তা বানিয়ে দিয়ে যাই আপনার জন্য? “

জুলফিকার মুজতবা বলে,

“ আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না বোকা মেয়ে। তোমরা গিয়ে রেডি হও তাড়াতাড়ি। দূর্জয়কে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিও না। ডিফেন্স ম্যানরা কিন্তু সময় নিয়ে খুব পাঙচুয়াল হয়। “

বাণী আর কথা বাড়াতে পারে না। চুপচাপ ভেতরে চলে যায় রেডি হতে।

__________

গাড়ির সামনে টানটান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ফোন চালাতে ব্যস্ত দূর্জয় কারো আগমন টের পেতে মাথা তুলে তাকায়। রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার পরিপাটি রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে বাণী এবং বহ্নি। বহ্নি রাগে গাল ফুলিয়ে রেখেছে। সে নিজের সুন্দর লাল রণফের ফ্রকটার উপর কোনো সুয়েটার পড়তে চাচ্ছিলো না। বাণী একপ্রকার তাকে ধমকে কালো উলের সুয়েটারটা পড়িয়েছে।

বাণী বেখেয়ালি দৃষ্টি মেলে তাকাতেই সামনে দূর্জয়কে দেখতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে সে চোখ নামিয়ে নেয়। কি অদ্ভুৎ! সবসময় কালো রঙ পড়া দূর্জয় আজ সাদা শার্ট কেনো পড়লো? বাণীর খুব অস্বস্তি লাগছে। সে-ও আজ সাদা সালোয়ার কামিজ পড়েছে। রাস্তা ঘাটে যে কেউ দেখলে ভাববে তারা হয়তো টুইনিং করে জামা পড়েছে। অথচ ব্যাপারটা কাকতালীয়।

বাণী এবং বহ্নি দূর্জয়ের সামনে এসে দাঁড়াতেই দূর্জয় নীরবে দু’জনকে পরখ করে। পরপর বহ্নির সামনে বসে প্রশ্ন করে,

“ মুখ লটকে রেখেছেন কেনো? “

বহ্নি প্রশ্রয় পেতেই অভিযোগের সুরে বলে,

“ মাম্মা আমাকে জোর করে সুয়েটার পড়িয়েছে। তুমি বলো মেজর, আমার ড্রেসটার সাথে এই সুয়েটার ম্যাচ করছে? মাম্মার কোনো ফ্যাশন সেন্স নেই। “

দূর্জয় একবার আড়চোখে বাণীকে দেখে বহ্নিকে বুঝিয়ে বলে,

“ ইট ইজ নট এবাউট ফ্যাশন সেন্স। ইট ইজ এবাউট কেয়ার সেন্স। মাম্মা আপনার কেয়ার করে তাই আপনাকে সুয়েটার পড়িয়েছে। নাহয় আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে। আর ঠান্ডা লেগে যাওয়াটা খুব ভয়ংকর একটা ব্যাপার। “

বহ্নি কিছুক্ষণ দূর্জয়ের বলা কথাটা ভাবে। ভুল বলে নি মেজর। দূর্জয় উঠে দাঁড়িয়ে সামনের পেসেঞ্জার সিটের পাশের দরজাটা খুলে দাঁড়ায়। বাণী নীরবে তা দেখে বহ্নির হাত ধরে এগুতে নিলেই বহ্নি বলে,

“ তুমি সামনে বসো মাম্মা। আমি পিছনে বসবো। “

বাণী অগ্যতা একাই গিয়ে সামনে বসে। বাণী উঠে বসতেই দূর্জয় গিয়ে বহ্নিকে পিছনে বসিয়ে দেয়। অত:পর নিজে সামনে গিয়ে বসে। পুরো রাস্তা জুড়ে বহ্নি এবং দূর্জয় গল্প করে কাটিয়েছে। আর বাণী নীরবে তাদের কথপোকথন অবলোকন করে কাটিয়েছে। হুটহাট তার মনে হচ্ছিলো সবটা স্বপ্ন। যে-ই জীবন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে তা নিছকই কোনো স্বপ্ন মাত্র।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]