এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৬৮.
ঘরে প্রবেশ করেই সবার আগে বিছানায় এলোমেলো করে রাখা জিনিসপত্র গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বাণী। শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে যখন সে সব জিনিসপত্র জায়গা মতো রাখছিলো ঠিক সেই মুহুর্তে দূর্জয় বহ্নিকে কোলে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। দরজার কাছে দাঁড়িয়েই বাণীর পাক্কা গৃহিণীর মতো রূপ দেখে সেকেন্ড ক্ষানিকের জন্য থমকায়। বাণী চোখ তুলে দূর্জয়কে দেখে নিচু গলায় প্রশ্ন করে,
“ ঘুমিয়ে পড়েছে? “
দূর্জয় মাথা নেড়ে বলে,
“ উঠোনে কোলে নিয়ে হাঁটছিলাম। ক্লান্ত ছিলো হয়তো খুব। কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। “
বাণী একই স্বরে বলে,
“ আপাতত ওকে একটু অন্য রুমে শুইয়ে দিয়ে আসবে? আমি এসব কিছু জায়গা মতো রেখে বিছানা ঝেড়ে নেই। সবকিছুর হযবরল অবস্থা। “
দূর্জয় বলে,
“ আচ্ছা। একটু ওডোমোসটা দাও। ওর হাতে পায়ে লাগিয়ে দিচ্ছি। পায়ে মশার কামড়ের দাগ দেখা যাচ্ছে। “
বাণী ওডোমোসটা এগিয়ে দিতেই দূর্জয় বহ্নিকে নিয়ে পাশের রুমে চলে যায়। অতি সাবধানে বিছানায় শুইয়ে দেওয়ার পরও বহ্নি মিনিট দু এই ঘুমের ঘোরে মোচড়ামুচড়ি করে। দূর্জয় অপেক্ষা করে। সম্পূর্ণ ঘুমে নিমজ্জিত হতেই সাবধানে আগে পায়ের জুতো দুটো খুলে নিচে রাখে। অত:পর পায়ে আর হাতে ক্রিম মেখে দিয়ে কম্বল টেনে ছোট্ট শরীরটা ঢেকে দেয়। অত:পর রুমের লাইট অফ করে কেবল ড্রিম লাইটটা জ্বেলে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
নিজেদের রুমে পা রাখতেই দূর্জয় দেখে বাণী ইতিমধ্যে বিছানা ঝেড়ে রুমটা পরিপাটি করে ফেলেছে। দূর্জয়কে দেখতেই বাণী প্রশ্ন করে,
“ বহ্নি যেহেতু ঘুমাচ্ছে এই সুযোগে আমি ব্যাগ প্যাক করে ফেলি? “
বাণীর প্রশ্ন শুনে দূর্জয়ের মনে পড়ে আগামীকাল তাদের ঢাকায় যাওয়ার কথা। গত দেড় বছরে জমানো ছুটি গুলো থেকে বেশ কিছুদিন হাতে রেখে কেবল পনেরোটা দিন দূর্জয় পরিবারকে সময় দিবে বলে ছুটির আবেদন করেছিলো। ভাগ্যিস ছুটির আবেদনটা মঞ্জুর হয়েছে। এই সুযোগে বাণী এবং বহ্নিকে ক’টা দিন নিশ্চিন্তে সময় দিতে পারবে সে৷ দূর্জয় বলে,
“ আগে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো। তারপর দু’জনে মিলে প্যাকিং এর কাজটা করে ফেলবো চট করে। “
বাণী কথাটা মেনে নিয়ে নিজের একসেট কামিজ নিয়ে পাশের রুমে চলে যায়। দূর্জয়ও সেই ফাঁকে হাত মুখ ধুয়ে চেঞ্জ করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। ব্যাগ বের করার জন্য যে-ই না ও আলমারির মাঝের দরজাটা খুলে ঠিক সেই মুহুর্তে ওর চোখে পড়ে উপরের তাকের এককোণে জায়গা দখল করে রাখা গিটারটার দিকে। দূর্জয় গিটারটা দেখে মনে মনে কিছু একটা ভাবে। বাণীও ঠিক সেই মুহুর্তে গোসল সেড়ে শাড়ি বদলে রুমে পা রেখেছে। দরজা থেকেই দূর্জয়কে গিটারটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার পা জোড়া থেমে যায়। পুরনো স্মৃতি তাকে জেকে ধরে।
দূর্জয় বাণীকে লক্ষ্য করতেই স্বাভাবিক গলায় বলে,
“ তোমার গিটারটা বেশ ভালো বন্ধু। অনেক বছর ধরে আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে। “
বাণী গলা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলে,
“ ভালো তো! “
বলে নিজেই চুপচাপ এগিয়ে গিয়ে দূর্জয়ের পাশ কেটে একটা ব্যাগ নিয়ে তা গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দূর্জয়ের চোখ এড়ায় না বাণীর অস্থিরতা। বাণী আলমারির পাশের তাক হতে নিজের কাপড় নামাতে নিলেই দূর্জয় তার হাত ধরে থামায়৷ টেনে এনে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে বলে,
“ গিটারটা আমি যে-ই অবস্থায় পেয়েছিলাম, সেই অবস্থায় এতে সুর তোলা অসম্ভব বিষয় ছিলো। তা-ই বলে আমি গিটারটা ফেলে দেই নি। মেরামত করিয়ে সুরের উপযোগী করে তুলেছি। তুমিও ব্যতিক্রম নও। ভাঙা অংশগুলো জোড়া লাগানো শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি হাল ছাড়ছি না। আই উইল নট গিভ আপ অন ইউ। “
বাণী কিছু বলে না। তবে দূর্জয়ের চোখ থেকে চোখও সরায় না। ইদানীং যতটা সম্ভব নিজেকে সহজ করার চেষ্টায় মত্ত সে। তার সামনের মানুষটা যেখানে এতটা এফোর্ট দিচ্ছে সেখানে বিন্দুমাত্র সাড়া না দেওয়াটা বড্ড বেমানান দেখায়। আচমকা কি ভেবে যেনো বাণী প্রশ্ন করে,
“ বিয়ের দিন রাতে যাওয়ার আগে তুমি বলেছিলে তুমি পঞ্চম ধাপে আছো। এখনো কি ও-ই ধাপটাতেই আছো? নাকি এক দু ধাপ উপরে উঠেছো? “
বাণীর প্রশ্নের পিঠে দূর্জয় নিঃশব্দে হেসে জানতে চায়,
“ তোমার কি মনে হয়? “
বাণী ভাবনায় বুদ হয়ে জবাব দেয়,
“ তুমি সপ্তম ধাপে আছো। আমাকে প্রতিনিয়ত ভালো রাখার দায়িত্বটা পালন করছো। এটা সপ্তম ধাপ নয়? “
দূর্জয় বাণীকে টেনে আয়নার সামনে নিয়ে দাঁড় করায়। কিছু না বলেই হেয়ার ড্রায়ারটা তুলে নিয়ে বাণীর ভেজা চুলগুলো উষ্ণ হাওয়ায় শুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্ষানিক বাদে আয়নার দিকে তাকিয়ে বাণীর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে,
“ সপ্তম ধাপে পৌঁছাতে হলে আমাকে আগে ষষ্ঠ ধাপ অতিক্রম করতে হবে। ষষ্ঠ ধাপটা কি ছিলো মনে আছে? আসক্তি। কি মনে হয় বাণী? আমি তোমাতে আসক্ত? “
বাণী ক্ষানিকটা বিস্ময় নিয়ে আয়না হয়ে দূর্জয়ের চোখে চোখ রাখে। কি অদ্ভুৎ! এই প্রশ্নটার কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না কেন সে? নিরুত্তর বাণী নিজের চোখ নামিয়ে নেয়। দূর্জয় হেসে কথা ঘুরিয়ে বলে,
“ ঢাকায় গিয়েই বহ্নির আকিকার কাজটা সেড়ে ফেলতে হবে। ওখানে আমাদের বাসার কাছের মসজিদের হুজুরের সঙ্গে আমি এই ব্যাপারে কথা বলবো। একবার আকিকা হয়ে গেলে, তাহলে ওর বার্থ সার্টিফিকেট আর পাসপোর্টটা দ্রুত রেডি করতে দিয়ে দিতে পারবো। ওর বার্থ সার্টিফিকেটটা অন্তত থাকলে এখন বাই রোড লং জার্নিটা আর করতে হতো না। যদিও ও বাই রোড যাওয়ার জন্য খুব এক্সাইটেড তবুও আমার চিন্তা হচ্ছে এতদূরের লং জার্নির ধকল ও নিতে পারবে নাকি ভেবে! “
__________
মখমলের চাদরের উপর সামান্য জায়গা দখল করে বসে থাকা নয় মাসের বহ্নি তখন তারস্বরে কান্না মিশ্রিত গলায় পুরো বাড়িটা মাথায় তুলে রেখেছে। বাণী তার পাশে দু হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বহ্নির বিভিন্ন খেলনা এবং সেই সঙ্গে তার জন্য রেডি করা বেবি ফুড আর একটা ফিডারে করে পিউরিফাইড পানি। গত এক ঘন্টা ধরে মেয়েটাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে বাণী, কিন্তু মেয়ে খাওয়ার বদলে উল্টো কান্না করে খাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
সেই কান্নার স্বরে বাণীর মাথা ব্যথা করলেও করার মতো কিছু নেই হাতে। সম্পূর্ণ বাড়িতে একটা কাকপক্ষীও নেই। হিরণ নামক জানোয়ারটা এখনো বাসায় ফিরে নি। কেয়ার টেকাররা কাজ শেষ করে যে যার ঠিকানায় চলে গিয়েছে। বাণী বুঝতে পারে না এই মুহুর্তে তার কি করা উচিত। অভিজ্ঞ কেউ-ই নেই যে তাকে ধারণা দিবে একটা বাচ্চা কিভাবে হ্যান্ডেল করতে হয়। গত নয় মাস ধরে বহ্নিকে সম্পূর্ণ নিজের অভিজ্ঞতাহীন মস্তিষ্ক খাটিয়েই পেলে চলেছে বাণী।
বাণী নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে আবার খাবারের বাটি এবং চামচটা নিয়ে বহ্নির দিকে এগিয়ে গিয়ে নরম গলায় বলে,
“ একটু খেয়ে নাও মা। কয় ঘন্টা ধরে তুমি না খেয়ে আছো জানো? অন্তত দুই চামচ মুখে নাও। আই প্রমিজ, আমি আর একটুও জোর করবো না তোমাকে। “
এবারও বহ্নি খাবার মুখে তুলতে নারাজ হলে বাণী হার মেনে খাবার রেখে ওয়াটার ফিডারটা বহ্নির মুখের কাছে নিয়ে ধরে। কিছুটা জোর করে পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করতেই বহ্নির ছোট ছোট হাতের থাবায় ফিডারটা হাত থেকে পড়ে যায়। মুহুর্তেই ফিডারের উপরের মুখটা খুলে সম্পূর্ণ পানি বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। কেবল বিছানা নয় বরং বহ্নির জামাও বেশ অনেকটা ভিজে যায়। বাণী রাগে বিরক্তিতে মুখ দিয়ে চ জাতীয় শব্দ করে। সারাটা দিন নির্ঘুম থাকার দরুন মস্তিষ্কটা তখন ঠিকঠাক কাজ করছিলো না তার। দ্রুত খাবারের বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে বিছানার চারিদিকে বালিশ টেনে দিয়ে নিচে চলে যায় এসব রেখে আসতে।
বাণী মিনিট খানেকের মধ্যে খাবারের বাটি রান্নাঘরে রেখে বের হতেই দেখে হিরণ কেবল ঘরে ঢুকলো। বাণীকে দেখে হিরণ কিছু বলতে নিবে ঠিক সেই মুহুর্তে উপর থেকে বহ্নির গলা ফাটিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। বাণী এক সেকেন্ড কেবল হিরণের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা আঁচ করতেই ভয়ে কুকড়ে যায়। হিরণ ততক্ষণে বড় বড় কদম ফেলে একপ্রকার দৌড়ে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে গেলো। বাণীও দ্রুত হিরণের পিছু পিছু উপরে কাঙ্ক্ষিত রুমটায় পৌঁছে যেই দৃশ্যটা দেখে তাতে তার পুরো শরীর ভয়ে ঠান্ডা হয়ে যায়।
ছোট্ট দেহটা কেমন চিৎ হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে। নরম মাথাটা শক্ত ফ্লোরে আঘাত পাওয়ার ফলে যন্ত্রণার জানানটুকু দিতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। পুরো শুভ্র মুখটা ব্যথায় মুহুর্তেই লাল নীল বর্ণ ধারণ করেছে। হিরণ ততক্ষণে চিলের মতো ছোঁ মেরে মেয়ের ছোট্ট নাজুক দেহটা তুলে বুকে মিশিয়ে নিয়েছে। মা, মা বলে মুখে একপ্রকার ফ্যানা তুলে ফেলেছে।
বাণী দুরুদুরু বুকে হিরণের কাছে এগিয়ে মেয়েকে ছুঁতে নিলেই হিরণ ক্ষোভটুকু চেপে রাখতে না পেরে এক ঝাটকায় বাণীকে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত মেয়েকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। এক বারের জন্যও পিছনে ফিরে তাকালো না। কোনো কিছুর তোয়াক্কাও করলো না। হয়তো পিছনে ফিরে তাকালে দেখতে পেতো গোল কাঁচের টি টেবিলটার উপর গিয়ে পড়া নারী দেহটা কিভাবে চূর্ণ বিচূর্ণ কাঁচের দ্বারা আহত হয়ে নিচে পড়ে আছে।
অতীত বাস্তবতাটুকু দুঃস্বপ্ন হয়ে হানা দিতেই শীতের রাতেও ঘেমে একপ্রকার হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলো বাণী। তার পাশে ক্ষানিকটা দূরত্ব বজিয়ে ঘুমানো মানুষটাও তা টের পেতে দ্রুত উঠে বসলো। অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে পাশের পুরুষালি অবয়বটাকে হিরণের বলে মনে হলো বাণীর কাছে। কেমন এক ভয়ংকর ঘোরে বাঁধা পড়ে আছে সে। ভয়ে আচ্ছন্ন উন্মাদের ন্যায় অস্ফুটে কি আওড়াতে আওড়াতে যেনো সে বিছানা ছেড়ে নেমে যায়। সেই পুরুষটাও অন্ধকারের মাঝেই এক লাফে বিছানা ছেড়ে নেমে এসে বাণীকে পিছন থেকে অতি যত্ন এবং অধিকারের সহিত জাপ্টে ধরে সদ্য ঘুম ভাঙা জড়ানো গলায় আওড়ায়,
“ দুঃস্বপ্ন দেখেছো। কিছু হয় নি। শান্ত হও। “
বাণী শান্ত হয় না। তার শরীরটা এখনো কাঁপছে। শরীরের প্রতিটা ক্ষত যেনো তাজা হয়ে উঠেছে। ব্যথাগুলো স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে সে। দূর্জয় নিজের পেশল বাহুবন্ধনে স্ত্রীর সবটুকু তনু আগলে ধরে বলে,
“ তুমি কোথায় আছো বুঝতে পারছো? পৃথিবীর সবথেকে সেফ জায়গায় আছো। এখানে কেউ তোমার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারবে না। কেউ তোমাকে ছুঁতে পারবে না। তুমি কি আমার কথার মর্মার্থ বুঝতে পারছো জানা? “
উত্তাল খরস্রোতা নদীর ন্যায় আচরণ করা বাণী ধীরে ধীরে কেমন শান্ত হয়ে যায়। অন্ধকারের মাঝেও দূর্জয় এবং হিরণের মাঝে পার্থক্যটা উপলব্ধি করতেই প্রতিরোধ্য দেহটা মিইয়ে নিজের ভার ছেড়ে দেয়। আশ্বস্ত বাক্যগুলোর মাঝে খুঁজে পায় ভরসা। ছোট্ট সম্বোধনের মাঝে খুঁজে পায় স্নেহ। অধিকার পূর্ণ সেই হাতের বাঁধনে অসংলগ্ন কোনো কিছু অনুভত হয় না। বরং যা অনুভূত হয় তা কেবল গভীর এবং প্রগাঢ় পবিত্রতা।
শান্ত মনে আচমকা বহ্নির চিন্তা উঁকি দিতেই বাণীর মনে পড়ে বহ্নি পাশের রুমে ঘুমোচ্ছে। ঘুমের মাঝে তুলে আবার এই রুমে এনে শুইয়ে দেওয়ার সময় ঘুম ভেঙে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনাটুকুর জন্যই বাণী মেয়েকে ওই রুমটায় ঘুমাতে দিয়েছে। ভাগ্যিস বহ্নি রুমে ছিলো না। নাহয় মা’য়ের ভীত উন্মাদ রূপ দেখে তার মেয়েটা ভয়ে মিইয়ে যেতো।
বাণী কিছুটা শান্ত হয়েছে বুঝতে পেরেই দূর্জয় হাতের বাঁধন আলগা করলো। পরপর শক্ত হাত জোড়ার সাহায্যে বাণীকে শূন্যে তুলতেই বাণী ভীত স্বরে বলে,
“ কি করছো? “
দূর্জয় অন্ধকারের মাঝেই বাণীকে বিছানায় জায়গা দিয়ে নিচু স্বরে বলে,
“ ওয়াইফের সার্ভিসে আছি আপাতত। “
চার শব্দের বাক্যটার অর্থটা ঠাহর করতে পারে না বাণী। দূর্জয় নিরাপদ দূরত্ব রেখে পাশে এসে শুয়েছে উপলব্ধি করতেই হঠাৎ অবচেতন মন ভুল বুঝে বসে। কিন্তু তার ভুল ধারণা দীর্ঘস্থায়ী হতে না দিয়ে দূর্জয় নরম গলায় বলে,
“ মাঝের দূরত্ব সীমানা আমি পাড় করবো না বাণী। তবে নির্বিঘ্নে ঘুমের জন্য নিরাপদ আশ্রয় অফার করতে পারি। যদি মনে হয় ইউ আর ওকে উইথ ইট তাহলে নিজেই দূরত্বটুকু ঘোচাতে পারো। এই আশ্রয়স্থানটা একান্তই তোমার। মন সায় দিলে দ্বিধা পাশে রেখো এসো। “
দূর্জয় একহাত বাড়িয়ে দিয়ে কথাগুলো উচ্চারণ করে। বাণী নীরব থেকে যখন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না, দূর্জয় তখন কিছু না বলেই নিজের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা গুটিয়ে ফেলতে নেয়। কিন্তু ঠিক সেই মুহুর্তে বাণী সত্যি সত্যি দ্বিধাকে পাশ কেটে এগিয়ে এসে দূর্জয়ের বাড়িয়ে দেওয়া হাতে মাথা রাখে। তার কপাল গিয়ে ঠেকে প্রশস্ত বুকের একপাশে। দূর্জয় প্রথম দফায় ক্ষানিকটা অবাক হলেও পরমুহূর্তে তার ঠোঁটের কোণে নির্মল হাসি ফুটে উঠে। মনে মনে বাণীকে অজস্র ধন্যবাদ জানায়। দূর্জয় যতই চেষ্টা করুক বাণী নিজ থেকে সাড়া না দিলে সম্পর্কটা দূর্জয়ের একার পক্ষে স্বাভাবিক করে তোলা কখনোই সম্ভব হতো না।
যেই হাতটায় বাণী মাথা রেখেছে তা ভাজ অবস্থায় বাণীর পিঠে গিয়ে ঠেকেছে। উক্ত ছোঁয়া টের পেতেই বাণী নিজের কপালে পুরুষ্টু ওষ্ঠদ্বয়ের নিবিড় ছোঁয়া অনুভব করে। নিচু স্বর কানের কাছে উচ্চারণ করে,
“ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো এখন। কালকে লং জার্নি আছে। সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]
এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৬৯.
প্রায় ৩০০ কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রাম হতে ঢাকায় আসার সফরটা অনেকটা স্মৃতিময়ই মনে হলো দূর্জয়ের কাছে। পরিবারের সর্বোচ্চ প্রাইভেসিটা মেইনটেইন করতে আলাদা করে আর ড্রাইভার ঠিক করে নি সে। বরং নিজেই ড্রাইভ করে স্ত্রী সন্তানকে পাশে নিয়ে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। পথিমধ্যে যদিও বার তিনেক গাড়ি থামিয়ে বিশ্রাম নিয়েছে। তবে তার দরুন পাঁচ ঘন্টার যাত্রাটা প্রায় সাত ঘন্টা স্থায়ী হলো। দূর্জয় অবশ্য ভয় পাচ্ছিলো বাণী এবং বিশেষ করে বহ্নিকে নিয়ে। এতটা দীর্ঘ জার্নির ধকল সইতে পারবে নাকি সেই চিন্তায় বুদ ছিলো। তবে বাচ্চাটা প্রথম অর্ধেকটা পথ নিভৃতে ঘুমিয়ে এবং বাকি অর্ধেকটা পথ প্রফুল্ল মনে আর অবাক চোখে প্রকৃতি দেখতে দেখতেই এসেছে। শীতকাল হওয়ায় জার্নিটা তেমন একটা গায়েও লাগে নি তার।
দূর্জয়ের প্রিয় কালো জিপটা যখন শান্তিকুঞ্জ নামক বাড়ির দ্বারে এসে থামলো, ঘড়ির কাটা তখন কেবল দুপুর দুটোর কাটা পেরিয়েছে। উত্তাপহীন মধ্যাহ্নে পুত্র, পুত্রবধূ এবং নাতনির আগমন টের পেতেই সুহালা বেগম রান্নাঘর ছেড়ে এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। উনার পিছুপিছু বাড়ির কাজে সাহায্যের জন্য নিযুক্ত সতেরো বছরের মৌটুসীও ছুটে যায়। সুহালা বেগম শান্তিকুঞ্জের আঙিনায় আগ্রহী চোখ মেলে তাকাতেই দেখেন কালো গাড়িটার সামনের ডান পাশের দরজাটা খুলে নেমে আসছে শার্ট, প্যান্ট পরিহিত তার ছেলে। দূর্জয় গাড়ি থেকে নেমেই আধা পাক ঘুরে বাম পাশের দরজাটা খুলে হাত বাড়িয়ে দিতেই তার হাতে হাত রেখে গাড়ি ছেড়ে নামে বাণী। গায়ে তার শাশুড়ি মায়ের পছন্দ করে কিনে দেওয়া কালো মনিপুরী শাড়িটা। দূর্জয় এবার পিছিয়ে গিয়ে পিছনের দরজাটা খুলে বহ্নিকে গাড়ি থেকে নামায়। সুহালা বেগম আবেগময় দৃষ্টি মেলে দেখে দৃশ্যটা। কি মনোরম দৃশ্য!
বহ্নি দূর হতে সুহালা বেগমকে দেখতেই দৌড়ে এগিয়ে আসে দীদা বলে। দৌড়ে এসে সুহালা বেগমের কোমর জড়িয়ে ধরে বলে,
“ ইউ আর লুকিং প্রিটি দীদা। “
ছোট্ট বাচ্চাটার মুখে এরকম প্রশংসা বাক্য শুনে সুহালা বেগম লজ্জা পেয়ে বলে,
“ দীদা যতই চেষ্টা করুক, প্রিন্সেসের থেকে বেশি প্রিটি হতে পারবে না। “
দূর্জয় এবং বাণী বহ্নির মতো তাড়াহুড়ো করলো না। তারা ধীরে সুস্থে এগিয়ে আসে। বাণী শাড়ির আঁচলটা কাধে টেনে নিয়ে নমনীয় স্বরে বলে,
“ আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন আপনি? “
সুহালা বেগম পুত্রবধূকে জড়িয়ে ধরে হাসি হাসি মুখ করে বলে,
“ বহ্নিও দীদা ডাক শিখে গেলো আর তুমি এখনো আন্টি ডাকেই আটকে আছো। আন্টিতে আটকে থাকলে কিন্তু বাড়ির ভেতর নো এন্ট্রি জারি হবে। দ্রুত আম্মু, মা কিংবা দূর্জয়ের মতো মামণি ডাকে মুভ ইন করো। “
বাণী লজ্জা পেয়ে বলে,
“ আচ্ছা মা। “
দূর্জয় বলে,
“ এখানে আমিও দাঁড়িয়ে আছি। আমার দিকেও একটু মনযোগ দাও কেউ। নাকি আমাকে ভুলে গিয়েছো তুমি? “
সুহালা বেগম এবার ছেলেকে সবটুকু মনযোগ দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ ওয়েলকাম হোম বাবা। “
সুহালা বেগম আগ্রহী গলায় মৌটুসী এবং বাড়ির দাঁড়োয়ান নোমান ভাইকে ডেকে নিজের পুত্রবধূ এবং নাতনির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। নতুন মুখ দুটোকে ঘিরে তাদেরও যে প্রবল আগ্রহ!
__________
শান্তিকুঞ্জে বাণী এবং বহ্নির পদচারণ হলো দূর্জয়ের হাত ধরে। সুহালা বেগম মৌটুসীকে নিয়ে রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আর দূর্জয় স্ত্রী কন্যাকে পুরোটা ঘর ঘুরিয়ে দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাড়িটা মূলত দূর্জয়ের দাদার আমলে তৈরী বলেই বাড়ির অবকাঠামো গঠন আজকালকার বাড়িগুলোর সঙ্গে মিলে না। তবে নিয়মিত মেরামতের ফলে বাড়িটা এখনো নতুনের ন্যায় চকচকে। এর একছত্র ক্রেডিট সুহালা বেগম প্রাপ্য। তিনি যদি জনমানবশূন্য বাড়িটায় কোনো অভিযোগহীন থেকে অতি ভালোবাসা দিয়ে এই বাড়িটার যত্ন না নিতো তবে বাড়িটার অবস্থা আজ পরিত্যক্তের ন্যায় হতো।
বাড়ির নিচতলাটা বিশাল লিভিং রুম, ডায়নিং এরিয়া, একটা বেডরুম যেখানে মৌটুসী থাকে এবং রান্নাঘর মিলিয়ে সুসজ্জিত। পুরনো দিনের ডিজাইনে করায় রান্নাঘরটার সঙ্গে লাগোয়া একটা লম্বা বারান্দা আছে। সেই বারান্দার দরজা হয়ে বাড়ির পিছন দিকটায় যাওয়া যায়। বাড়ির পিছন দিকটাও বিশাল জায়গা জুড়ে। সেখানে রয়েছে একটা খোলা কলপাড় যেটা আপাতত কেউই ব্যবহার করে না। তাছাড়াও রয়েছে চতুর্ভুজাকৃতির একটা মোটামুটি সাইজের পুকুর। সেই পুকুরের চারিদিক ঘিরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল নারিকেল গাছের সারি।
বাড়ির ভেতরের সিড়ি বেয়ে দোতলায় যেতেই সরু করিডোর ঘেঁষে দেখা যায় চারটা বেডরুম। দূর্জয় একে একে বেডরুম গুলো কার কোনটা বলতে থাকে। বাম দিক থেকে শুরু করে প্রথম রুমটা দূর্জয়ের মরহুম দাদা দাদুর। দ্বিতীয় রুমটা হলো দূর্জয়ের ফুপ্পির। তৃতীয় রুমটা এককালে দূর্জয়ের মামণি বাবার রুম থাকলেও বর্তমানে সেখানে কেবল দূর্জয়ের মামণি একাই থাকে। চতুর্থ এবং শেষ রুমটা হলো দূর্জয়ের।
রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই দূর্জয় দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সবার আগে বারান্দার দরজার সামনে ঝুলন্ত পর্দা গুলো টেনে সরিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ দরজাটা খুলে দেয়। মুহূর্তেই আলো এবং দখিনা মৃদু বাতাসে রুমটা কানায় কানায় হয়ে যায়। দূর্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে বাণী এবং বহ্নির দিকে তাকায়। যারা আগ্রহ ভরা নয়নে রুমের দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের ব্যক্তিগত রুমটায় স্ত্রী আর কন্যার বরণের কাজটুকু কিভাবে সম্পন্ন করলে তা বিশেষ হিসেবে আখ্যা পাবে তা জানা নেই দূর্জয়ের। তার মন চাইলো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই মানুষ দুটোর জন্য মখমলের কার্পেটের বদলে নিজের বুকটা বিছিয়ে দিতে। মানুষ দুটো নগ্ন পায়ে সেখানটায় হেঁটে বেড়াক। স্বাধীন এবং মুক্ত পতাকার ন্যায় মাথা তুলে, নিঃসংকোচে।
মনের ভাবনা গুলো দূর্জয়ের মনেই চাপা রয়ে যায়। বাণী নিজেই অধিকারটুকু বুঝে নিয়ে বিনা অনুমতিতে মেয়ের হাত ধরে রুমে পা রাখে। চারিদিকটা চোখ বুলিয়ে দেখতে থাকে। বহ্নি বাণীর হাত ছেড়ে এক দৌড়ে বারান্দায় চলে যায়। তার চোখে মুখে খুশি চিকচিক করছে। সে বারান্দার কিনারা ঘেঁষে দাঁড়াতে নিলেই দূর্জয় সতর্ক করে ডাকে,
“ কিনারে যাবেন না কিডডো। বাচ্চাদের জন্য সেফ না। “
বহ্নি সাময়িকের জন্য দমলেও এই স্নিগ্ধ সুন্দর বারান্দাটাকে ঘিরে তার প্রবল আগ্রহ রয়ে যায়। আচমকা উন্মুক্ত দরজায় নকের শব্দ শুনতেই তিন জোড়া চোখ ফিরে তাকায়। বাড়ির দাঁড়োয়ান নোমাম ভাই দূর্জয়দের লাগেজ দুটো হাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। হাসি মুখে বলে,
“ রুমের সামনে রেখে দিয়ে যাবো আব্বা? “
দূর্জয় এগিয়ে গিয়ে ব্যস্ত স্বরে বলে,
“ আরেহ নোমান ভাই। আপনি লাগেজ আনতে গেলেন কেনো? আমি-ই নিয়ে আসতাম তো! এই ভারী ব্যাগ দুটো বয়ে দো তলায় নিয়ে এসেছেন। আপনার হাঁটুর ব্যথাটা নিয়ে বিন্দু মাত্র চিন্তা নেই দেখছি। “
বয়স্ক লোকটা ফোকলা হেসে বলে,
“ বাড়িতে নতুন সদস্য এসেছে। এসব হাঁটুর ব্যথা নিজ থেকেই সেড়ে যাবে এখন। “
বহ্নি এগিয়ে এসে দূর্জয়ের হাত ধরে প্রশ্ন করে,
“ আমি দীদার কাছে যাই মেজর? “
নোমান ভাই বলে,
“ আসো আসো দাদুভাই। আমিও নিচে যাবো। তোমাকে রান্নাঘরে দীদার কাছে নিয়ে যাবো, চলো। “
বহ্নি উৎফুল্ল হয়ে লোকটার হাত ধরে বলে,
“ লেট’স গো নোমান ভাই। “
বহ্নির সম্বোধনে বাণী বেশ লজ্জায় পড়ে যায়। আর দূর্জয় মুখ টিপে হাসতে থাকে। বহ্নি নোমান ভাইয়ের সঙ্গে নিচে চলে যেতেই বাণী অবাক গলায় প্রশ্ন করে,
“ তুমি ওই আংকেলকে ভাই বলে কেনো ডাকছিলে? “
দূর্জয় এবার সামান্য হেসে বলে,
“ আসলে উনি অনেক আগে থেকে আমাদের বাসায় আছেন। বলতে গেলে খুবই বিশ্বস্ত। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি উনাকে। তো মামণি আর বাবা সবসময় উনাকে নোমান ভাই ডাকতো। তো আমিও উনাদের অনুসরণ করে উনাকে নোমান ভাই বলেই ডাকতাম। অবুঝ ছিলাম তখন। বড় হয়ে বুঝতে শেখার পরও অভ্যাসটা বদলাতে পারি নি। তাই নোমান ভাই বলি। “
বাণী প্রথমে অবাক হলেও পরমুহূর্তে হেসে অবচেতন মনে বলে উঠে,
“ বাপেরও নোমান ভাই, মেয়েরও নোমান ভাই। “
কথাটুকু উচ্চারণ করেই বাণীর হুশ ফিরে। এক মুহুর্ত দূর্জয়কে দেখে নিয়ে চরম অস্বস্তি নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। বেলাগাম মুখটা অসময়ে কি অদ্ভুৎ কথা বলে বসলো। দূর্জয়ের বারান্দাটা থেকে বাড়ির পিছন দিকের দৃশ্যটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা বাণীর চোখ তখন পুকুরের সবুজ রঙা স্থির জলের দিকে নিবদ্ধ। বাণীর ধ্যানের মাঝেই তার বা পাশটায় এসে কেউ জায়গা দখল করে রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ায়। নিবিড় দৃষ্টি শান্ত পুকুরে স্থির করে বেশ অনেকটা সময় নিয়ে বলে উঠে,
“ বহ্নিকে আমি যতই ভালোবাসি না কেন, ওর শরীরে আমার রক্ত নেই এই সত্যটা তুমি কখনো ভুলতে পারবে না। তাই না? “
দূর্জয়ের সেই প্রশ্নের কোনো প্রতুত্তর করে না বাণী। দূর্জয় উত্তরের অপেক্ষাও করে না। সে জানে এই সত্যটা বাণী কখনোই ভুলতে পারবে না। ভুলে যাওয়া সম্ভবও নয়। দূর্জয়ের আকাশ সমান ভালোবাসা এবং যত্নের সামনে সেই সত্যটার উচ্চতা সবসময় বেশি-ই রবে। দূর্জয়ের গোপন মনের কোণে আচমকা আফসোস জেগে উঠে। বহ্নি দূর্জয়ের সন্তান হলে কি খুব বেশি কোনো ক্ষতি হয়ে যেতো? হিরণ নামক অমানুষটার অস্তিত্ব বাণীর জীবনে না থাকলে কি খুব বেশি কোনো ক্ষতি হয়ে যেতো? বাণীর জীবনে সেই ভয়ংকর সাতটা বছর না আসলে কি খুব বড়ো কোনো ক্ষতি হয়ে যেতো? দূর্জয় গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া কোনো বিশেষ ক্ষমতা থাকলে সে সবার আগে এক এক করে নিজের স্ত্রীর জীবনের সব খারাপ অধ্যায় গুলো মুছে দিতো। যেই অধ্যায় গুলো প্রতিনিয়ত বাণীকে তাড়া করে বেড়ায়। তার স্বাভাবিক জীবনের পথে বারবার বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তার দু চোখের ঘুমটুকু পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে। সেই অধ্যায় গুলোর অস্তিত্ব দূর্জয় নিজ হাতে ম্লান করে দিতো।
__________
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার অধ্যায় সেড়েই দূর্জয় সময় অপচয় না করে বিকেল হতেই চলে যায় এলাকার পরিচিত মসজিদটায়। আসরের নামাজ সেড়ে ইমাম সাহেবের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে বসে সে। সার সংক্ষেপে বেশ অনেকটাই ইমাম সাহেবকে বুঝিয়ে সে জানতে চায়,
“ হুজুর, আমি জানতে চাচ্ছিলাম যে আমার মেয়ের কি আকিকা দিয়ে তার নামের সঙ্গে আমার পদবী জুড়ে দেওয়া সম্ভব? “
বয়স্ক নূরানী চেহারার লোকটা আঁতকে উঠে বলেন,
“ আস্তাগফিরুল্লাহ। তা কখনোই সম্ভব না। নিজের ঐরশজাত সন্তান ব্যতীত অন্যের সন্তানের নামের শেষে নিজের পদবী বসানো আমাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মারাত্মক গুনাহর কাজ। এই কাজ ভুলেও করো না। “
দূর্জয় এই ব্যাপারে অবগত ছিলো না। সে দ্বিধা মিশ্রিত স্বরে বলে,
“ তাহলে কি ওর বায়োলজিকাল ফাদারের পদবী ব্যবহার করতে হবে ওকে? “
হুজুর মাথা নেড়ে বলে,
“ মূলত আসল পিতা যদি মৃত, তালাক প্রাপ্ত কিংবা সন্তানের দায়িত্ব পালন অথবা দেখাশোনা না-ও করে তবুও সন্তানের নামের শেষে সেই পিতার পদবী বসানোর কথা বলা হয়েছে আমাদের ধর্মে। কেবল একটি ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম সম্ভব। তা হলো শিশুটি যদি আল্লাহ মাফ করুক ব্যভিচারের ফলে জন্ম নেয়। সেই ক্ষেত্রে কেবল পিতার পদবী ব্যবহার করা জায়েজ নয়। এমন অবস্থায় শিশুটির নামের সঙ্গে মায়ের পদবী কিংবা অর্থবহ যেকোনো আরবী নাম রাখা যায়। “
দূর্জয়কে ক্ষানিকটা চিন্তিত দেখায়। অর্থাৎ বহ্নি হিরণ কিংবা দূর্জয় কারো পদবী-ই ব্যবহার করতে পারবে না। বাকি যে দুটো অপশন হাতে রইলো তা নিয়ে বাণীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। এই ব্যাপারে বাণীর ডিসিশন নেওয়ার অধিকার সবচেয়ে বেশি বলে মনে করে সে।
দূর্জয়কে চিন্তিত দেখে হুজুর এবার বলে উঠেন,
“ কিছু বিধি নিষেধ তো থাকবেই। এতটাও জটিল নয় বিষয়টা। যদিও আজকাল কেউই এসব বিধি নিষেধের ধার ধারে না। তবে আমি বলবো সন্তান এবং নিজেদের মঙ্গলের জন্য বিষয়টা আমলে নেওয়া উত্তম হবে। “
দূর্জয় এবার স্বাভাবিক গলায় বলে,
“ তা নয় হুজুর। জায়েজ নয় এরকম কিছুই আমরা করবো না অবশ্যই। তবে আপনার উল্লেখ করা শেষের পরামর্শটা নিয়ে আমার ওয়াইফের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। আমি ওর সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাবো। “
হুজুরের থেকে বিদায় নিয়ে দূর্জয় উঠতে নিলেই হুজুর আচমকা প্রশ্ন করে বসে,
“ মেয়ের নামটা যেনো কি বলেছিলে তুমি? “
“ বহ্নি। “
হুজুর কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন,
“ এই নামটা আকিকা না দেওয়াই উত্তম। নামের অর্থ ভালো না। বহ্নি নামের অর্থ আগুন অথবা হুতাশন। মেয়ের জন্য ভালো অর্থবহ আরবী নাম খুঁজো। মনে রাখবে নামের অর্থ কিন্তু একটা মানুষের জীবনেও প্রভাব ফেলে বেশ। “
__________
শরীরটা ম্যাড়ম্যাড়ে লাগায় এই শীতের বিকেলে বাণী গোসল করতে ঢুকেছে। গরম পানির ছোঁয়ায় যখন একটা কুইক শাওয়ার নিতে ব্যস্ত সে, ঠিক সেই মুহুর্তে আচমকা তার বুক কেমন কামড়ে উঠে। গোসল ছেড়ে মিনিট দুয়েক বাণী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আচমকা এরকম অনুভব করার কারণটা সে বুঝতে পারলো না। কোনো মতে নিজেকে ধাতস্থ করে দ্রুত গোসলটা সেড়ে ফেলে সে। বাসায় পরিধেয় যোগ্য একটা আরামদায়ক সিল্ক বাটিকের শাড়ি কোনোমতে গায়ে পেঁচিয়ে সে টাওয়াল হাতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে।
রুমে পা রাখতেই তার চোখ গিয়ে পড়ে খালি বিছানাটার দিকে। বাণীর ভ্রু জোড়া কুচকে আসে। সে সঙ্গে সঙ্গে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেই বারান্দা সহ সম্পূর্ণ রুমে চোখ বুলায়। বহ্নি কোথায়? গোসলে যাওয়ার আগেই তো মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে বাথরুমে গেলো সে। সুহালা বেগমের কাছে গেলো নাকি? প্রশ্নটা মনে উঁকি দিতেই বাণী টাওয়ালটা রেখে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নেয়। দরজার কাছেই দূর্জয়ের মুখোমুখি হয় সে। দূর্জয়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আগ্রহী গলায় জানতে চায়,
“ বহ্নিকে নিচে দেখেছো? “
দূর্জয় অবাক হয়।
“ না তো। কোথায় ও? “
“ গোসলে যাওয়ার আগে তো রুমে ঘুম পাড়িয়ে গেলাম। গোসল থেকে বের হয়ে দেখি রুমে নেই। ঘুমের ভং ধরে আমাকে ফাঁকি দিয়েছে এই মেয়ে। “
দূর্জয় বলে,
“ আমি এদিকটা চেক করছি। তুমি একটু নিচে গিয়ে দেখো, মামণি কিংবা মৌটুসীর কাছে গেলো নাকি। “
বাণী মাথা নেড়ে নিচে চলে যায়। দূর্জয় এক এক করে সম্পূর্ণ দোতলাটা খুঁজে। বহ্নিকে না পেয়ে সে পা বাড়ায় ছাদের দিকে। ছাদের সঙ্গে লাগোয়া পরিপাটি চিলেকোঠা ঘরটার ভেতরও খুঁজে সে, যেটা কি-না একটা সময় দীপ্তর বেডরুম ছিলো। কিন্তু সেখানেও বহ্নিকে না পেয়ে সে নিচে নেমে আসে। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই লিভিং রুমের সামনে বাণীর আতংকিত মুখ দেখেই তার বুক মুচড়ে উঠে। বাণী দূর্জয়কে দেখতেই ভীত অশ্রু মিশ্রিত স্বরে বলে,
“ আমার মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না দূর্জয়। আমার মেয়ে কোথায়? “
দূর্জয় বিস্মিত চোখে সুহালা বেগমের দিকে তাকাতেই সুহালা বেগম বলে উঠে,
“ আমি তো এতক্ষণ ধরে বাড়ির সামনেই ছিলাম। উঠোনের গাছে পানি দিচ্ছিলাম। বহ্নিকে তো বাসা থেকে বের হতে দেখি নি। আই এম শিওর বাসার ভেতরেই কোথাও আছে। “
মৌটুসী বলে উঠে,
“ আমি তো নিচ তলা পুরাডা খুঁজলাম। কোনোহানে নাই। পনেরো বিশ মিনিট আগেই তো আমার কাছে আইছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে কই হারায় গেলো? “
‘বহ্নিকে পাওয়া যাচ্ছে না’ ছোট বাক্যটিতেই দূর্জয়ের শরীর ঝিমঝিম করছে। তবুও সে নিজেকে শক্ত রেখে মৌটুসীর কাছে জানতে চায়,
“ তোমার কাছে এসে কি বলেছিলো? “
“ বেশি কিছু না ভাইজান। একটা কাগজ দিয়া বলসিল ওরে নৌকা বানায় দিতাম। আমি নৌকা বানায় দিতেই ওয় ওইডা নিয়া গেসে গা। “
দূর্জয় কেবল পাঁচ সেকেন্ড সময় নিলো পুরো ঘটনাটা মেলাতে। আর বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে গেলো রান্নাঘরের দিকে। বাণী, সুহালা বেগম আর মৌটুসী প্রথমে হতবাক হলেও পরমুহূর্তে তারাও দূর্জয়ের পিছু পিছু দৌড়ে যায়। দূর্জয় ততক্ষণে রান্নাঘরের বারান্দা পেরিয়ে পিছনের উঠোনে পৌঁছে গিয়েছে। চোখের পলকে কি হলো বুঝা গেলো না। তবে বারান্দা পেরিয়ে উঠোনে পা রাখতেই বাণী কেবল দেখলো দূর্জয় পায়ের জুতো ছেড়ে এক লাফে পুকুর পাড়ের সিঁড়ি ভেঙে সবুজ রঙা শ্যাওলা পড়া পুকুরটায় ঝাপ দিলো। ভয়ংকর ঘটনাটা আঁচ করতেই স্তব্ধ বাণী চিৎকার করে উঠে,
“ আমার মেয়ে! আল্লাহ! বহ্নি! আমার মেয়ে! ইয়া আল্লাহ! “
চিৎকার করে বাণী হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। ছুটে সামনে পুকুরে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে চায়। বিস্মিত সুহালা বেগম ও মৌটুসী তাকে জাপ্টে ধরে আটকায়। বাণী ছোটার জন্য ছটফট করছে। ধস্তাধস্তিতে তার শাড়ির আঁচল কাধ থেকে কিছুটা নিচে সরে আসে। সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ধ্যান নেই। তার উদ্ভ্রান্ত মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ ধ্যান সেই শ্যাওলা পড়া পুকুরটার দিকে। যেই পুকুরটা তার সম্পূর্ণ পৃথিবীটা গ্রাস করে নিতে ব্যকুল।
চলবে…
এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৭০.
বাণীর উন্মাদের ন্যায় কান্না বাতাসটা ভারী করে তুলেছে। অবাধ্য মনটা বারবার নিজেকে দোষারোপ করছে। দোষটা বাণীরই। মেয়েকে এক মুহুর্তের জন্য চোখের আড়াল করা তার উচিত হয়। যতবার, যতবারই মেয়েটাকে একা রেখে সে কিছু একটা করতে যায় ততবারই তার মেয়ের উপর নতুন একটা বিপদ এসে হাজির হয়। কখনো বিছানা থেকে পড়ে যাওয়া, কখনো হাত কেটে ফেলা, কখনো…
সময় গড়াতেই পুকুরের ঠিক মাঝখানটা হতে ধীরে ধীরে পাড়ে এগিয়ে আসতে দেখা যায় দূর্জয়কে। শীতের কাল হওয়ায় বেশ অনেকদিন ধরে পুকুরের পানি পরিষ্কার করানো হয় নি। নোংরা পানিতে ডুব দেওয়ার ফলে পুরো শরীরটা ভিজে জবজবে অবস্থা। তার দু’হাতের উপর বরফ ঠান্ডা পানিতে সিক্ত নিথর ছোট্ট দেহটা দেখা যাচ্ছে। হাস্যজ্বল মুখটা কেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বাণীর যেনো নিঃশ্বাস আটকে এলো। ফুলের মতো মেয়ের এই রূপ দেখে সে স্থির থাকতে পারলো না। চেতনা হারিয়ে সুহালার গায়ে হেলে পড়লো।
সবটা দুমড়ে মুচড়ে আসা দূর্জয় বহ্নিকে সহ পাড়ে এসে সিড়ি বেয়ে উঠার সময় এই দৃশ্যটা দেখতেই তার সচল মস্তিষ্কটা কেমন চুপসে যায়। ভেতরটা মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে। সে কেবল দূর হতেই চেঁচিয়ে বলে,
“ মামণি, বাণীকে সামলাও প্লিজ। “
সুহালা বেগম যেনো নদীর দু কূলের মাঝে আটকা পড়লো। ছোট্ট বাচ্চাটাকে দেখতেই অশ্রু এসে জমেছে তার দুই চোখের কার্নিশে। মন চাচ্ছে ছুটে বাচ্চাটার কাছে যেতে। কিন্তু পুত্রবধূকে আগলে ধরে মাটিতে বসে পড়ে তিনি আর সামনে আগান না।
নিথর দেহটাকে মাটিতে সোজা করে শুইয়ে দূর্জয় সবার আগে দুই আঙুল নাকের কাছে নিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস চলাচল করছে কি-না তা পরীক্ষা করে। ক্ষীণ নিঃশ্বাসের গতি টের পেতেই দূর্জয় সবার আগে আঙুল দিয়ে মুখের ভেতর থাকা কাদা মাটি বা অপদ্রব্য যতটা সম্ভব বের করে আনার চেষ্টা করে। পরপর দু’হাতের সাহায্যে বুকের বা পাশে চাপ দিতে থাকে যেনো ফুসফুসটা সক্রিয় চলে। চাপ দেওয়ার মাঝেই দূর্জয় বারবার নাড়ির গতিবিধি মেপে দেখতে থাকে। হাত মস্তিষ্ক আপন গতিতে মেয়েকে বাঁচানোর সবটুকু চেষ্টা করলেও দূর্জয়ের ভেতরটা ধ্বসে পড়ছে বারবার। আল্লাহ এই পরীক্ষা কেনো নিচ্ছে তার প্রশ্নটা লাগাতার মাথায় উঁকি দিচ্ছে তার।
প্রাথমিক চিকিৎসার ধাপটুকু দ্রুত গতিতে সম্পন্ন করেই দূর্জয় গলা হাকিয়ে মৌটুসীকে ডাকে। ভীত মৌটুসী ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে আসতেই দূর্জয় বহ্নিকে তুলে মৌটুসীর কোলে দিয়ে বলে,
“ ওকে নিয়ে তাড়াতাড়ি আমার গাড়ির কাছে যাও। আমি আসছি। সাবধানে ধরো ওকে। “
ব্যস্ত গলার আদেশটুকু মাথায় নিয়ে মৌটুসী বহ্নিকে কোলে নিয়ে দ্রুত ঘরের ভেতর দিকে চলে যায়। ভেতর থেকে ভেঙে চূড়ে আসা দূর্জয় নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে দ্রুত এগিয়ে যায় স্ত্রীর দিকে। সুহালা বেগমের আলিঙ্গন থেকে বাণীকে নিজের আওতায় বুঝে নিয়ে পাজাকোলে তুলে সে-ও বাড়ির ভেতর দিকে ছুটে।
লিভিং রুমের বিশাল সোফাটায় এনে বাণীর নেতানো দেহটা রেখে সুহালা বেগমকে বলে উঠে,
“ আমি বহ্নিকে নিয়ে হসপিটাল যাচ্ছি। মৌটুসী সাথে যাবে। যাওয়ার সময় নোমান ভাইকে বলে দিচ্ছি ফার্মেসি থেকে ডাক্তার ডেকে দিবে। ততক্ষণে ওর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করো। “
সুহালা বেগম ব্যস্ত গলায় বলে,
“ আমি আছি। চিন্তা নেই। তুমি যাও। “
বেরিয়ে যেতে নিয়েও দূর্জয় আরেকবার ধরা গলায় বলে,
“ ওকে একটু দেখে রেখো মামণি। “
__________
গাড়ির স্পিডটা সর্বোচ্চ গতিতে তুলে সুকৌশলে গাড়ি চালাচ্ছে দূর্জয়। রাস্তার পাশাপাশি বারবার পিছনের পেসেঞ্জার সিটে মৌটুসীর কোলে শুয়ে থাকা বহ্নিকেও লক্ষ্য করছে সে। মৌটুসী বারবার বহ্নির দু হাত মুঠোয় নিয়ে মালিশ করে যথাসম্ভব নিম্ন তাপমাত্রাটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত হসপিটালের পথে গাড়ি ড্রাইভ করতে মনযোগী দূর্জয় আচমকা লক্ষ্য করে স্টিয়ারিঙে থাকা তার হাতদুটো ক্রমাগত মৃদু কাপছে। দূর্জয় ব্যাপারটা লক্ষ্য করেও সেদিকে আর পাত্তা দেয় না। তার দূর্বল হয়ে পড়ার অনুমতি নেই।
সবথেকে কাছের হসপিটালে পৌঁছাতেই বহ্নিকে নিয়ে সোজা হসপিটালের ভেতর ছুটে দূর্জয়। ইমারজেন্সি ইউনিটে পৌঁছে কোনোমতে একটা খালি বেডে ছোট্ট দেহটাকে রেখে অন ডিউটিতে থাকা ডাক্তারকে বলে সম্পূর্ণ ঘটনা। মহিলা ডাক্তারটা ঘটনার সার সংক্ষেপ শুনেই দ্রুত দু’জন নার্সকে নিয়ে রোগীর জীবন বাঁচানোর চেষ্টায় লেগে পড়ে। দূর্জয় কেমন ফ্যালফ্যাল করে সম্পূর্ণ দৃশ্যটার সাক্ষী হচ্ছিলো। মহিলা ডাক্তারটা হাতে একটা কাচি নিতেই সে ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে থামায়। ডাক্তারটা কাচি কেনো নিলো তা তার মস্তিষ্ক এই মুহুর্তে ঠাহর করতে পারছে না। ওই নিষ্পাপ বাচ্চাটার শরীরে কাঁটা ছেড়া করবে নাকি? পানিতে ডুবলে কি কাঁটা ছেড়ার প্রয়োজন পড়ে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত দূর্জয় নিজের উত্তর খুঁজে পায় যখন দেখে ডাক্তার কাচির সাহায্যে এক এক করে বাণীর গায়ের সুয়েটার আর ফ্রকটা কাঁটছে। দূর্জয় মাথা নিচু করে অন্যদিকে ফিরে তাকায়। ঠিক সেই মুহুর্তে একজন নার্স একটা বোর্ডে কিছু কাগজ এবং একটা কলম হাতে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,
“ আপনি রোগীর কি হোন? “
দূর্জয় একটা ঢোক গিলে কেবল উচ্চারণ করে,
“ বাবা। “
“ রোগীর নাম আর বয়স? “
“ বহ্নি। বয়স পাঁচ। “
“ কোনো মেডিক্যাল হিস্ট্রি আছে রোগীর? বা কোনো মেডিসিনে এলার্জি জনিত সমস্যা? “
দূর্জয় নিষ্পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জবাব দেয়,
“ আমি জানি না। “
নার্সটা এবার ভ্রু কুচকে বলে উঠে,
“ মানে? “
“ আমার ওর মেডিক্যাল হিস্ট্রি জানা নেই। “
নার্সকে এবার ক্ষানিকটা বিরক্ত দেখায়। তিনি প্রশ্ন করেন,
“ বাচ্চার মা কোথায়? “
“ ও বাসায়। মেয়েকে এই অবস্থায় দেখে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে। “
নার্স এবার অধৈর্য্য হয়ে ডক্টরের কাছে চলে যায়। পিছন থেকে দূর্জয়ের কানে ভেসে আসে নার্সের বিরক্তিমাখা গলায় বলা কথাগুলো,
“ ম্যাম। ওই সাথে আসা লোকটা নাকি বাচ্চার বাবা। কিন্তু বাচ্চার মেডিক্যাল হিস্ট্রি বা এলার্জি আছে কি-না এসব কিছুই জানে না। “
“ বাচ্চার মা’কে জিজ্ঞেস করতে বলো তাহলে। “
“ ম্যাম বলেছি। মা নাকি বেহুশ হয়ে ঘরে পড়ে আছে। এখন কি করবেন ম্যাম? কোনো মেডিসিনে বাচ্চার রিয়েকশন হলে? বাচ্চার কিছু একটা হলে তো দোষ আমাদের ঘাড়ে চাপবে। অথচ এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন বাপ মা’র কোনো দোষ হবে না। “
ডাক্তারকে এবার বিরক্তি মিশ্রিত গলায় বলতে শোনা গেলো,
“ বুঝো না কেমন দায়িত্ব জ্ঞান ওয়ালা বাপ মা? সচেতন হলে কি বাচ্চা পুকুরে ডুবে নাকি? আল্লাহ যে এসব অযোগ্যদের কেনো বাচ্চা দেয়! কত মানুষ বাচ্চা চেয়েও পায় না… “
বাকি কথাটা আর শুনতে পারে না দূর্জয়। সে নিশ্চল পায়ে ইমারজেন্সি ইউনিট থেকে বেরিয়ে এসে একপাশে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় কোনো মতে। গায়ের ভেজা শার্ট, প্যান্ট গুলো ইতিমধ্যে শুকাতে শুরু করে দিয়েছে। তবে পুকুরের পানিটা নোংরা থাকায় তার গায়ের পোশাকও এখন নোংরা দেখাচ্ছে।
দূর্জয়ের মাথাটা এখনো নত। বুকের ভেতর অদ্ভুৎ অসহনীয় ব্যথা অনুভব করছে সে। মনের সুপ্ত জায়গাটা দোয়া করে চলেছে যেনো নিষ্পাপ বাচ্চাটার কিছু না হয়। মস্তিষ্ক বলে চলেছে বহ্নির কিছু হলে বাণীর সামনে কখনো সে মুখ তুলে তাকাতে পারবে না। হাজারটা চিন্তা মাথায় নিয়ে পকেটে হাত দিতেই সে দেখে পকেটে ফোনটা নেই। ফোন কোথায় তার? খুব সম্ভবত পুকুরে পড়ে গিয়েছে। দূর্জয় দূর্বল পায়ে হেঁটে এককোণে গিয়ে একটা লোককে দেখে বলে উঠে,
“ এক্সকিউজ মি ভাইয়। একটা কল করা যাবে? আমার ফোনটা পাচ্ছি না। হয়তো পানিতে পড়ে গিয়েছে। কলটা ইম্পোরট্যান্ট। “
ভদ্রলোক সূক্ষ্ণ চোখে দূর্জয়কে পরখ করে ফোনটা এগিয়ে দিতেই দূর্জয় সুহালা বেগমের নাম্বারে কল করে। কিছুক্ষণের মধ্যে কলটা রিসিভ হতেই দূর্জয় শান্ত গলায় বলে,
“ আমি দূর্জয়। “
সুহালা বেগম চিন্তিত গলায় বলে,
“ আমি তোমার নাম্বারে কল করছিলাম। ফোন বন্ধ বলছে। বহ্নি কোথায়? কি অবস্থা ওর? “
“ ইমারজেন্সি ইউনিটে আছে। ডাক্তাররা দেখছে। বাণীর কি অবস্থা? “
“ জ্ঞান ফিরেছে তুমি বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই। ডাক্তার এসেছিলো। কিন্তু ও দেখাতে রাজি না। হসপিটাল যেতে চাইছে। সামলানো মুশকিল। “
দূর্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হসপিটালের নামটা সুহালা বেগমকে জানিয়ে বলে,
“ ওকে নিয়ে আসো। দূরে থেকে আরো বেশি তড়পাচ্ছে। বহ্নির কাছে থাকার অধিকার আছে ওর। “
__________
পঁচিশ মিনিটের মাথায় এলোমেলো অবস্থায় দৌড়াতে দৌড়াতে হসপিটালে এসে পৌঁছায় বাণী। সঙ্গে সুহালা বেগমও রয়েছেন। তবে তিনি বাণীর পায়ের গতির সঙ্গে সামঞ্জস্যতা বজায় চলতে হিমশিম খাচ্ছেন। ইমারজেন্সি ইউনিটের সামনে এসে দরজার একপাশে দূর্জয়কে দেখতেই বাণী দৌড়ে যায়। দূর্জয়ের বুকের কাছে ভাজ করা হাত দুটো ধরে ব্যস্ত, ক্লান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,
“ আমার মেয়ে কোথায়? কেমন আছে? ঠিক হয়ে গিয়েছে না? “
দূর্জয়ের ভেতরের শেষ শক্তিটুকুও এই পর্যায়ে নিঃশেষ হয়ে গেলো। সে কোনো জবাব দিতে পারে না। কেবল নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে টলমল চোখে তাকিয়ে থাকা বাণীকে দেখে। বাণী আবারও হাত ঝাকিয়ে ব্যকুল গলায় জানতে চায়,
“ এই। বলো না প্লিজ। আমার মেয়ে কেমন আছে? “
দূর্জয়ের থেকে কাঙ্ক্ষিত কোনো জবাব না পেয়ে বাণী এবার ইমারজেন্সি ইউনিটের দরজার দিকে ছুটতে নেয়। দূর্জয় দ্রুত সামনে এসে বাণীকে বাধা দিয়ে আগলে ধরে। বাণী শান্ত হয় না। বরং উল্টো কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার কান্নার শব্দে ভেতর থেকে সেই নার্সটা বেরিয়ে আসে। রাগ মিশিয়ে বলে,
“ ইমারজেন্সি ইউনিটের বাহিরে এসব চেঁচামেচির মানে কি? ম্যানারস নাই আপনাদের কোনো? বাচ্চাকাচ্চার খেয়াল রাখতে পারেন না, তাহলে বাচ্চা নেন কেনো? নাটক করতে উঠে আসে যত্তসব। “
দূর্জয় বাণীকে টেনে সেখান থেকে দূরে নিয়ে গেলেও সুহালা বেগম চুপ থাকতে পারে না। হসপিটাল স্টাফদের এতো বিশ্রী আচরণ কেন হবে? তিনি প্রতিবাদের গলায় বলে,
“ আপনি উঁচু স্বরে কথা বলছেন কেনো? আপনার ম্যানারস কোথায়? আর কার ব্যাপারে আজেবাজে কমেন্টস করছেন ধারণা আছে? “
__________
হসপিটালের সবথেকে নীরব একটা জায়গায় নিয়ে বাণীকে জোর করে একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে তার সামনে হাঁটু ভাজ করে বসে দূর্জয়। বুকের ভেতরের উথাল-পাতাল কান্নাটুকু গিলে নিয়ে স্ত্রীর দু-হাত জোড়া ধরে মানা নত করে বলে,
“ আ’ম সরি। মাফ করো আমাকে। আমি দায়িত্ব নিয়েছি, কিন্তু ঠিকঠাক পালন করতে পারি নি। সরি বাণী। মাফ করে দাও। “
বাণী বোবা দৃষ্টি মেলে দেখতে থাকে শ্যাম বর্ণের পুরুষকে। মেজর শাহরিয়ার দূর্জয় কারো সামনে মাথা নত করে মাফ চাইছে। দৃশ্যটা খুব কম মানুষের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য ঠেকবে। বাণীর মেয়ের চিন্তায় দমবন্ধ হয়ে আসে। কোনো মতে বলে,
“ তুমি অন্তত ওকে সময়মতো উদ্ধার করেছো। আমি ওর খেয়াল রাখতে পারি নি। অযোগ্য মা একটা আমি। “
দূর্জয় জবাব দিতে পারে না। নিষ্পাপ বাচ্চাটার মুখ বারবার চোখের সামনে ভাসছে ওর। আচমকা সে নিজের দূর্বোধ্য দেয়াল ভেঙে, ‘ছেলেদের কাঁদার নিয়ম নেই’ উক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাণীর হাঁটুতে মাথা রেখে নিঃশব্দে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এটা তো তার স্বপ্ন ছিলো না। তার স্বপ্নের অংশ হিসেবে তো বাণী আর বহ্নি দুটো মানুষই ছিলো। যেকোনো একজনকে ছাড়া তো তার সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নটা অপূর্ণই রয়ে যাবে।
বাণী সবটা দেখে। অত:পর মৃদু গলায় বলে,
“ আমার অস্তিত্ব এখনো শুধু আমার মেয়ের জন্যই আছে। ওর কিছু হলে আমি মরে যাবো। বহ্নি একমাত্র আমার বেঁচে থাকার কারণ। “
__________
বিকেল গড়িয়ে গভীর রাত তখন। হসপিটালের ভীড় অনেকটাই কমে এসেছে। বহ্নিকে আপাতত সিসিইউ ইউনিটে শিফট করা হয়েছে। সিসিইউ ইউনিটের বাহিরে জ্যান্ত লাশের ন্যায় একটা বেঞ্চিতে বসে আছে বাণী। তার পাশেই দেয়ালে হেলান দিয়ে নির্বাক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে দূর্জয়। সুহালা বেগম এই মুহুর্তে হসপিটালে নেই। রাত গভীর হচ্ছিলো দেখে মৌটুসীকে সহ উনাকে জোর করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন দূর্জয়। এতো মানুষ এক সঙ্গে হসপিটালে ভীড় করলে কোনো লাভ নেই। উল্টো রোগীদের অসুবিধা হয়।
ঘন্টা দুই এক আগে ডাক্তার বেরিয়ে বলে গিয়েছেন এই মুহুর্তে পরিস্থিতি আশংকা মুক্ত। সম্ভবত বেশিক্ষণ পানির ভেতর ছিলো না বলে এবং সঠিক পদ্ধতিতে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিলো বলেই এতো বড় একটা বিপদ এড়ানো গিয়েছে। তবে ঠান্ডা পানির ভেতর থাকার কারণে এবং হসপিটালে পৌঁছানোর সময়টা ভেজা কাপড়ে থাকার ফলে ঠান্ডা জনিত সমস্যার আশংকা করছে ডাক্তার। তা-ও চিকিৎসার মাধ্যমে ঠিক করা সম্ভব। বাণী তখন বহ্নির সঙ্গে দেখা করতে চাইলে ডাক্তার কেবল বলে জ্ঞান নেই। জ্ঞান ফিরলে পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখা করার সুযোগ পাবে।
মেয়ের জীবন হুমকিতে নেই শুনেও বাণী ধাতস্থ হয় নি। যতক্ষণ না নিজ চোখে মেয়েকে দেখবে ততক্ষণ তার মন শান্ত হবে না। বেশ অনেকটা সময় পরে সিসিইউ ইউনিট থেকে একজন নার্স বেরিয়ে বলে উঠে,
“ বহ্নির গার্ডিয়ান কে? “
বাণী দ্রুত উঠে এগিয়ে যেতে নিলেই তার শরীর টলে উঠে। দূর্জয় এগিয়ে গিয়ে আগলে ধরে তাকে। অতিরিক্ত চিন্তা এবং রাতে না খেয়ে থাকার ফলে প্রেশার ফল করেছে সম্ভবত। তবে বাণী সেসবের তোয়াক্কা না করে বলে,
“ আমরা ওর প্যারেন্টস। “
নার্স বলে,
“ বাচ্চার জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার চেক করেছেন। সব ঠিকঠাক আছে। মা’কে খুঁজছে। ভেতরে আসুন আপনি। “
বাণী অপেক্ষা না করে দ্রুত নার্সের সঙ্গে ভেতরে চলে যায়। বাহিরে দূর্জয় কেবল একা রয়ে যায়। এই পর্যায়ে সে ধপ করে বেঞ্চিটায় বসে পড়ে। তার কানে বাজছে বাণীর বলা “আমরা ওর প্যারেন্টস” কথাটা। বহ্নির জ্ঞান ফিরেছে শুনে যেনো বুকের উপর থেকে খুব ভারী কিছু একটা সড়ে গেলো। মনে মনে তিন দফা উচ্চারণ করলো,
“ আলহামদুলিল্লাহ,
আলহামদুলিল্লাহ,
আলহামদুলিল্লাহ। “
প্রায় আধা ঘণ্টা পর একই নার্স আবার বেরিয়ে এসে দূর্জয়কে দেখে বলে,
“ আপনার ওয়াইফ আপনাকে ডেকে দিতে বলেছে। রোগী নাকি আপনাকে খুঁজছে। ভেতরে চলুন। “
দূর্জয় দ্বিধা অনুভব করে পা বাড়াতে। কেন যেনো মনে হচ্ছে বাচ্চাটার চোখে চোখ রাখতে পারবে না সে। দূর্জয়ের দ্বিধাদ্বন্দের মাঝেই নার্সটা তাকে একবার পরখ করে বলে,
“ আপনার জামা কাপড়ের এই বিশ্রী অবস্থা কেনো? এভাবে তো ভিতরে যাওয়া যাবে না। অন্য পেশেন্টদের ইনফেকশনের ভয় আছে। আপনি আমার সাথে চলুন। এপ্রোণ আর মাথায় সার্জিক্যাল ক্যাপ পড়তে হবে আপনার। “
__________
সিসিইউ ইউনিটের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেছে দূর্জয়। গায়ে তার সবুজ রঙের সার্জিকাল এপ্রোণ। পায়ের জুতো জোড়া প্লাস্টিক ব্যাগের আড়ালে ঢাকা। মাথার চুলগুলোও সবুজ সার্জিক্যাল ক্যাপ দ্বারা আবৃত। হাতের বামদিকের প্রথম বেডটার কাছে এগিয়ে গিয়ে সে ধীর ভঙ্গিতে পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। সঙ্গে সঙ্গে তার দৃষ্টি স্থির হয় নিষ্পাপ এবং শুষ্ক মুখের বাচ্চাটার দিকে। বহ্নি দূর্বল চোখ মেলে দূর্জয়কেই দেখছিলো। নিজের আবেগ লুকাতে ব্যস্ত দূর্জয় ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বাণীর পিছনে দাঁড়ায়। বাণী বিছানার পাশে একটা টুলে বসে ছিলো। দূর্জয়কে দেখতেই সে ফোলা চোখগুলো মুছে হাসার চেষ্টা করে।
বহ্নি নীরবে কিছুক্ষণ ডাক্তারদের মতো পোশাক পড়া দূর্জয়কে দেখে দূর্বল গলায় বলে,
“ তুমি ডাক্তার সেজেছো কেনো, বাবা? “
আচমকা সম্বোধনে দূর্জয় চমকায়। চমকায় বাণীও। অস্ফুটে প্রশ্ন করে,
“ কি বললে? “
বহ্নি ফের ছোট করে শুকনো মুখে বলে,
“ বাবা। “
ছোট্ট সম্বোধনটা দূর্জয়কে উথাল অনুভূতির জোয়ারে ভাসিয়ে নেয়। কান্না না করলেও চোখ জোড়া ছলছল করে উঠে তার। রুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করে,
“ মন থেকে বলছেন? “
বহ্নি এতক্ষণ মাম্মার কাছে শুনেছে মেজর কিভাবে তাকে সুপারম্যানের মতো বাঁচিয়ে হসপিটালে নিয়ে আসে। তার বলতে ইচ্ছে করে যে একমাত্র পাপা, বাবা কিংবা আব্বুরাই তো সুপারম্যানের মতো বেবিদের প্রোটেক্ট করে। বহ্নির তো অলরেডি পাপা আছে। মেজর তো তা-ই পাপা হতে পারবে না। কিন্তু বাবা তো হতে পারবে। মনে এতো লম্বা উত্তর আসলেও তা বলার শক্তি খুঁজে পায় না বহ্নি। তাই কেবল মাথা নেড়ে বুঝায় সে মন থেকেই বলছে। দূর্জয় আচমকা বাচ্চাদের মতো হেসে উঠে। এগিয়ে গিয়ে বহ্নিকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলেও সে আগায় না। যদি ব্যথা পায় এই ভয়ে। তবে তার সামনে বসে থাকা বাণীকে সে পেছন থেকে গলা পেচিয়ে জড়িয়ে ধরে। মেয়ের ভাগের চুমুটা মায়ের মাথায় খেয়ে ফের বাচ্চাদের মতো হাসতে থাকে। বাণী অশ্রু জমা চোখে দূর্জয়ের সেই হাসি থেকে। খুব সুপ্ত ভঙ্গিতে তার মনের গহীনে বেজে উঠা আনন্দের শব্দে মৃদু কেঁপে উঠে সে।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]