এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৩+৪

0
264

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩.

লম্বা করিডোর পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদেহী নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম পরিহিত এক পুরুষ। চলার পথে যাদের মুখোমুখি হচ্ছে সকলেই আপন অবস্থানে দাঁড়িয়ে পড়ছে সাথে সাথে। এক হাত তুলে কপালে চেপে জানাচ্ছে স্যালুট। কিন্তু সেই পুরুষ সেদিকে তোয়াক্কা না করে আপাতত দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে নির্দিষ্ট এক রুমের দিকে। একটা বিশাল আকারের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই সে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয় খানিকটা। সেই সিংহ দ্বারের একপাশে দেয়ালের সাথে এটাচড রয়েছে আধুনিক কালো রঙের একটি ডিভাইস। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ফিঙ্গার প্রিন্ট সেন্সর। নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলটা সেই সেন্সর ডিভাইসে চেপে ধরতেই এক ধরনের সবুজ সিগন্যাল লাইট জ্বলে উঠে। বিশাল আকারের সেই অটোম্যাটেড দরজা আপন গতিতে দু’দিকে ধীরে ধীরে সরে যায়। খুলে যায় প্রবেশ পথ। যার অর্থ হলো ‘ইউ হ্যাভ দ্যা এক্সেস টু এন্টার দিজ রুম নাও’। এই রুমে প্রবেশের জন্য দুটি জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত ফিঙ্গার প্রিন্ট এবং দ্বিতীয়ত ইউনিফর্ম। যেহেতু এই দুটি জিনিসই তার কাছে রয়েছে তাই সে আর অপেক্ষা না করে প্রবেশ করে ভেতরে।

সুবিস্তীর্ণ রুমের মধ্যিখানে সাদা রঙের আয়তাকার আকৃতির বিশাল এক টেবিলের দু পাশে বসে রয়েছে চারজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাদের গায়েও রয়েছে নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম। টেবিলের এক মাথায় দু’হাতে ভর দিয়ে সামান্য ঝুকে দাঁড়িয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যস্ত চল্লিশার্ধ এক বলিষ্ঠ পুরুষ। কঠোর শৃঙ্খলার ভেতর আবদ্ধ জীবনের প্রভাবে মুখশ্রী জুড়ে মধ্য বয়স্কের ছাপ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। নাম তার জুলফিকার মুজতবা।

জুলফিকারের গুরুত্বপূর্ণ কথার মাঝখানেই মিটিং রুমে প্রবেশ করে সপ্তবিংশতি এক পুরুষ। টেবিলের সামনে এসেই সে দু’হাত পিঠের পিছনে নিয়ে ভাজ করে স্থির ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। মুখশ্রী জুড়ে তার লেপ্টে আছে গম্ভীরতা। সেই গম্ভীর মুখশ্রীর দিকে এক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে জুলফিকার শান্ত স্বরে বলে উঠে,

“ দ্যা ওয়েট ইজ অভার নাও। ইট’স টাইম টু হান্ট। তুমি কি প্রস্তুত? “

শক্ত চিত্তের পুরুষ স্পষ্ট গলায় জবাব দেয়,

“ সদা প্রস্তুত। “

জুলফিকার তার সামনে থাকা ল্যাপটপে কিছু একটা করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সাথে সাথেই তার পিছনে থাকা বিশাল প্রজেক্টের স্ক্রিনে ভেসে উঠে সাত জন যুবকের ছবি। প্রত্যেকের ছবির নিচে ইংরেজিতে গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে তাদের সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য। জুলফিকার বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে উঠে,

“ এই অপারেশন কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেই বিষয়টা মাথায় রেখেই হেডকোয়ার্টার থেকে তোমাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সাথে থাকবে প্লাটুনের সবথেকে দক্ষ সাতজন লেফটেন্যান্ট। আশা করছি ইউ উইল নট লেট আস ডাউন মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়। “

দূর্জয় মুখভঙ্গি স্থির রেখে জবাব দেয়,

“ আই এম অনারড টু সার্ভ মাই কান্ট্রি স্যার। “

জুলফিকার সহ উপস্থিত বাকি চারজনের মুখে ফুটে উঠে মৃদু হাসি। নামের আগে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদবীর অধিকারী জুলফিকার মুজতবা বলে উঠে,

“ লেফটেন্যান্টদের কাছে ইতিমধ্যে অর্ডার পৌঁছে গিয়েছে। দেই’ল বি কামিং সুন। আধঘন্টার মধ্যেই ইউ ক্যান মিট অল অফ দেম ইন দ্যা গ্রাউন্ড। “

__________

রাতের অন্ধকারটা কাটা পড়েছে গ্রাউন্ডের চারিদিকে জ্বলজ্বল করা ইলেক্ট্রিক্যাল বাতির সুফলে। উন্মুক্ত সবুজ মাঠ জুড়ে রয়েছে সমান করে ট্রিমিং করা ঘাসের সমারোহ। ঘন্টা ক্ষানেক আগে থেমে যাওয়া বৃষ্টির প্রমাণ চিহ্ন হিসেবে ভেজা ঘাসগুলোকে খুব সতেজ দেখাচ্ছে।

আচমকা শান্ত মাঠের ঘাসগুলো ব্যাপক বাতাসের প্রকোপে অস্থির হয়ে উঠলো। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো তীক্ষ্ণ সাঁই সাঁই শব্দ। আকাশ হতে নেমে এলো এক সামরিক হেলিকপ্টার। এই বিমানের নাম মিল এমআই ১৭। রাশিয়ায় তৈরী দুই টার্বাইন যুক্ত এই পরিবহন হেলিকপ্টার খুব বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া ব্যবহার হয় না। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। হেলিকপ্টারের ভেতর থাকা মানুষ গুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মূলত তাদের সুরক্ষিত ভাবে আগমন নিশ্চিত করার জন্যই লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা নিজের সিনিয়র কর্নেলের অনুমতি নিয়ে এই হেলিকপ্টার পাঠিয়েছে।

বত্রিশ জন সৈন্য সদস্য ধারণ ক্ষমতাকারী বিমানটা মাটি হতে ক্ষানিকটা উঁচুতে এসেই স্থির হলো। বিমানের উপরের অংশের ব্লেডের মতো ধারালো পাখাটা তখনও শব্দ তুলে একটি শক্ত মাস্তুলকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। বিমানের একদিকের দরজাটা খুলে যেতেই সেই দরজা দিয়ে পরপর সাতজন যুবক সুকৌশলে লাফিয়ে মাঠে নেমে পড়ে। পিঠে তাদের বিশাল বিশাল ব্যাগ প্যাক। তারা নেমে পড়তেই বিমানটা শব্দ তুলে ফের প্রস্থান করে সেখান থেকে।

সুঠাম দেহী সাতজন পুরুষ আলাদা আলাদা প্লাটুনের লেফটেন্যান্ট হওয়ার সুবাদে পরস্পর পরিচিত নয়। আপাতত তারা নিজেদের মধ্যে কোনো কথা বলছেও না। বরং আগ্রহী দৃষ্টি মেলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখছে। গ্রাউন্ডের সীমানা প্রান্তে বেশ কিছু বন্দুকধারী নিরাপত্তা কর্মীকে দেখা যাচ্ছে। এছাড়া আর একটাও কাক পক্ষী নেই চারিদিকে।

সাতজনের মধ্যে কিছুটা চঞ্চল দৃষ্টির যুবক হতাশ স্বরে সুধায়,

“ এ কি দিন এলো আমাদের সামরিক বাহিনীর? আমার মতো শত্রুদের জমকে অভ্যর্থনা জানাতে কেউ এলো না? “

বাকি ছয়জন সরু চোখে সেই যুবকের দিকে তাকাতেই তাদের পিছন হতে ভেসে আসে বুট শু পরিহিত কারো হেঁটে আসার আভাস। মুহুর্তেই সাতজন সম্পূর্ণ পিছনে ঘুরে ফিরে তাকায়। অন্ধকার ছাপিয়ে এগিয়ে আসা দীর্ঘদেহী ইউনিফর্ম পরিহিত পুরষের দিকে তাদের দৃষ্টি স্থির হয়।

দূর্জয় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে সোজা হয়ে তাদের মুখোমুখি দাঁড়ায়। কোনো ভনিতা না করে বেশ শান্ত গলায় বলে উঠে,

“ আমি মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়। আপনারা যেই অপারেশনের জন্য এই মুহুর্তে এখানে উপস্থিত আছেন সেই অপারেশন আমার আন্ডারেই লিড হবে। “

মুহুর্তেই সাতজন যুবক একহাত তুলে স্যালুট করে স্কাউটের ভাষায় আরামে দাঁড়ায়। দূর্জয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে একবার সাতজনের মুখশ্রী দেখে নেয়। আধঘন্টা আগে স্ক্রিনে দেখে আসা এই সাতজনের নাম সে ভুলে নি। তবুও সে বলে,

“ সকলে এক এক করে নিজেদের নাম বলুন এবং আপনি কেন নিজেকে এই অপারেশনের উপযুক্ত বলে মনে করেন তার একটা কারণ বলুন। “

সর্ব ডানে দাঁড়িয়ে থাকা চঞ্চল দৃষ্টির যুবক সর্বপ্রথম মুখ খুলে,

“ লেফটেন্যান্ট তামজিদ সাইফ। আমি নিজেকে এই অপারেশনের জন্য উপযুক্ত মনে করি কারণ আমি কখনো ময়দান ছেড়ে পালাই না, বরং শত্রুকে সেই ময়দানে দাফন করাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। “

সাইফের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যাম যুবক কাটকাট স্বরে বলে উঠে,

“ লেফটেন্যান্ট আরাফাত প্রত্যয়। আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য, যুদ্ধের ময়দানে শহীদের মর্যাদা লাভ করা। তাই এতো গুরুত্বপূর্ণ এক অপারেশনের জন্য আমি নিজেকে যোগ্য মনে করি। “

দূর্জয় সরু দৃষ্টি মেলে প্রত্যয় নামক যুবককে আগাগোড়া পরখ করে। যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হওয়া প্রত্যেক সেনার বুকে লালিত এক স্বপ্ন। দেশের জন্য জীবন দিতে যেই সেনা দ্বিধা বোধ করে সে কখনোই একজন সৈন্য হওয়ার মর্যাদা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। কিন্তু প্রত্যয় নামক এই যুবকের বুকে শুধু শহীদ হওয়াটাই যেন একমাত্র সুপ্ত ইচ্ছে নয়। বরং দূর্জয়ের মনে হচ্ছে সে শহীদ হওয়ার উছিলায় গভীর ভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছুক।

প্রত্যয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের কথা শুনে দূর্জয় ভাবনা ছেড়ে বের হয়। এই মুহুর্তে বেশ চিকন এবং লম্বা করে এক যুবক আপন পরিচয় দিচ্ছে।

“ লেফটেন্যান্ট সাদাত সরকার।… “

পর্যায়ক্রমে এক এক করে বাকি চারজনও নিজেদের নাম এবং উপযুক্ত মনে হওয়ার কারণ জানায়। অবশিষ্ট চারজনের নাম হলো ইমতিয়াজ রাফি, রিদওয়ান ইশরাক, ফারদিন ইসলাম এবং জুনায়েদ রওফ। প্রাথমিক পরিচয় পর্বটুকু শেষ হতেই দূর্জয় সাতজনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আগামীকাল সকাল সাতটায় তোমাদের সাথে দেখা হবে। গুড নাইট। “

দুই বাক্যের কথাটুকু শেষ করেই দূর্জয় বিলম্ব না করে সেখান থেকে প্রস্থান করে। পিছনে রয়ে যায় সেই সাত যুবক। সাইফ হতাশ গলায় বলে,

“ এ কার আন্ডারে আমার অভিযান করতে হবে? মেজরের মুখ দেখেই তো আমার মনের সুপ্ত রসিকতারা নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেললো। তার উপর আবার এখন বাজছে প্রায় রাত সাড়ে তিনটা। ঘুমাতে ঘুমাতে চারটা বাজবে। মাত্র দুই ঘন্টা ঘুম নসিব হলো আমার ভাগ্যে? এরকম চলতে থাকলে তো অভিযান শেষে আমি দু চোখের নিচে বিশাল ডার্ক সার্কেল গিফট পাবো। “

রাফি শান্ত পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে ঘুম জড়ানো স্বরে বলে উঠে,

“ আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো যে অন্তত দুই ঘন্টার জন্য হলেও কপালে ঘুম নসিব হয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে আফসোস করতে থাকলে সেটাও হারাবে। “

রাফিকে অনুসরণ করে জুনায়েদও তার পিছু পিছু যেতে যেতে বলে উঠে,

“ তাছাড়া আমার মেজরকে বেশ পছন্দ হয়েছে। চেহারার মধ্যে ব্যক্তিত্বের ছাপ স্পষ্ট। “

রাফি আর জুনায়েদের পিছু পিছু বাকিরাও এগিয়ে গেলে সাইফ ফের হতাশ গলায় সুধায়,

“ এই ছয়জন দেখি আস্ত উজবুক। সমস্যা নেই। আমার মতো রঙ পুরষের সাথে থাকতে থাকতে এদের ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট লাইফও রঙে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। “

সবশেষে সাইফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় বাকিদের পিছু পিছু। আগামীকাল তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক নতুন ভোর।

__________

কাঠের তৈরী সরু বিছানার মধ্যিখানে হেলান দিয়ে বসে আছে বাণী। আনমনে ডুবে আছে সে আপন ভাবনার জগতে। এতো বছর পর আচানক দূর্জয়ের সাথে দেখা হওয়াটা যেন তার মস্তিষ্কের সকল সাজানো পরিকল্পনা এলোমেলো করে দিয়েছে। বাণী মনে মনে নিজেকে সুধায়,

“ এলোমেলো হলে চলবে না। এতদূর এসে ধরা পড়তে চাই না আমি। দূর্জয়ের সাথে আমার সাক্ষাৎ কেবলমাত্র একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। সেই কাকতালীয় এক্সিডেন্টে বিভোর হয়ে ধরা পড়লে সব শেষ হয়ে যাবো। এটাই শেষ সুযোগ আমার। “

বাণীর ভাবনার মাঝেই একটা ছোট্ট কোমল হাত তার গাল ছুঁয়ে দেয় আলতো করে। বাণীর ধ্যান ভাঙে। সে চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকায়। তার বুকের সাথে লেপ্টে মাথাটা সামান্য উঁচু করে তার দিকে তাকিয়ে আছে ল্যাভেন্ডার রঙের ফ্রক পরিহিত এক শিশু। সেই ছোট্ট মানবী কোমল স্বরে প্রশ্ন করে উঠে,

“ তুমি কিভাবে ব্যথা পেয়েছো মাম্মা? “

ছোট্ট মুখটার পানে তাকাতেই বাণীর মুখে মৃদু হাসি ফুটে। সে নরম গলায় বলে,

“ মাম্মা তোমাকে বলেছিলাম না যে আমরা হাইড এন্ড সিক খেলছি? “

ছোট্ট মানবী উপর নিচে সামান্য মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। বাণী তার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলে,

“ গেম খেলতে নিয়েই মাম্মা পড়ে গিয়ে সামান্য ব্যথা পেয়েছি। তুমি চিন্তা করো না মা। সেড়ে যাবে। “

পাঁচ বছর বয়সী শিশুটা কিছুক্ষণ বাণীর চেহারার পানে চেয়ে থেকে প্রশ্ন করে,

“ পাপা আমাদের খুঁজে ফেললে কি আমরা হেরে যাবো মাম্মা? “

পাপা শব্দটা শুনতেই বাণীর মুখ মলিন হয়ে যায়। সে কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠে,

“ বহ্নি, মা আমার। মাম্মা তোমাকে তিনটা পয়েন্ট মেমোরাইজ করিয়েছি। তোমার মনে আছে সেগুলো? “

বহ্নি প্রফুল্ল গলায় জবাব দেয়,

“ ইয়েস মাম্মা। “

বাণী হেসে বলে,

“ বলো তো সেগুলো কি কি? “

বহ্নি এবার মায়ের বুক থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে। বিচক্ষণ শিশুর ন্যায় নিজের হাতের আঙুল দ্বারা গণনা করতে করতে জবাব দেয়,

“ পয়েন্ট ওয়ান, মাম্মা ছাড়া আর কাউকে ট্রাস্ট করবো না। পয়েন্ট টু, কেউ কোনো কুয়েশ্চন করলে কোনো উত্তর দিবো না। পয়েন্ট থ্রি, আমি গুড গার্ল হয়ে মাম্মার সব কথা শুনবো। “

মেয়ের কথা শেষ হতেই বাণী হেসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“ এখন ঘুমিয়ে পড়ো মা। “

বহ্নি মায়ের বাধ্য মেয়ে। সে এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে চোখ বুজে নেয়। বাণী মেয়ের কাধ সমান রেশমের ন্যায় চুলে হাত বুলিয়ে দিতেই বহ্নি গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। ঘুম নামে না কেবল বাণীর চোখে। তার মাথায় কিলবিল করছে অসংখ্য চিন্তা। আজকের রাতটা এখানে তার মাথা গুজার ঠাই হয়েছে। কিন্তু আগামীকাল? আগামীকালের মধ্যেই তার বহ্নিকে নিয়ে চট্টগ্রাম ছেড়ে বের হতে হবে যেকোনো মূল্যে। এই জাহান্নাম ছেড়ে যত দূরে যাওয়া যায় সে পালিয়ে যাবে।

__________

রাতের আঁধার চিড়ে ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু হয়েছে। মৃদু হাওয়া বয়ে আসছে খোলা জানালা দিয়ে। সেই হাওয়ায় রুমের বেবি পিংক রঙের পাতলা ফিনফিনে পর্দাটা উড়ে স্থানচূত্য হয়। সাদা আর গোলাপি মিশেলের রঙ করা রুমটার প্রতিটা কোণা বিভিন্ন সফট টয়স দিয়ে পরিপূর্ণ। যে কেউ রুমে প্রবেশ করে প্রথম দর্শনেই নিশ্চিত হতে পারবে যে এটা একটা বাচ্চার রুম। সেই রুমের মধ্যিখানে বিছানার এককোণে দু’হাতের উপর থুতনি ঠেকিয়ে বসে রয়েছে এক পুরুষ। অতি রক্তিম চোখ জোড়া নিবদ্ধ বেড সাইড কেবিনেটের উপর রাখা একটা ফোটো ফ্রেমের দিকে। পরিপূর্ণ এক নারী হাস্যজ্বল মুখে একটা বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে তার পানে চেয়ে রয়েছে। বাচ্চাটা একহাতে একটা খেলনা নিয়ে সেটা নিয়ে খেলতে ব্যস্ত। আনমনে নিজেদের ভুবনে ডুবে থাকা দুই মানবীর এই ছবিটা তোলা হয়েছিলো তাদের খুব অজান্তে।

আচানক দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। ক্রোধিত পুরুষ নিজের রক্তিম দৃষ্টি সেই ফোটো ফ্রেমের দিকে স্থির রেখে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিতেই একজন যুবক বেশ ধীরে দরজার নব ঘুরিয়ে রুমে প্রবেশ করে।

চোখ দুটো বন্ধ করে গভীর ভাবে নিঃশ্বাস ছেড়ে রুমে প্রবেশ করা যুবকের দিকে তাকাতেই সেই পুরুষের চোখ জোড়া বড় হয়ে গেলো। ব্যস্ত পায়ে উঠে সে এগিয়ে যায় সেই যুবকের দিকে। চিলের ন্যায় ছোবল মেরে ছিনিয়ে নেয় তারা হাতে থাকা শুভ্র ওড়নার অর্ধেক অংশ। যুবকটা মাথা নত রেখে বলে,

“ জঙ্গলের অপর প্রান্তের শেষ মাথায় হাইওয়ে যাওয়ার পথে একটা গাছের কাছে এটা পাওয়া গিয়েছে। আর… “

ক্রোধিত পুরুষ অধৈর্য্য গলায় প্রশ্ন করে,

“ আর? “

যুবকটা কিছু বলতে ভয় পাচ্ছে। সে বেশ কাচুমাচু করছে কথা বলতে। অধৈর্য্য সেই পুরুষ রাগে এবার একটা ধমক দিয়ে উঠতেই সেই যুবক নিজের অপর হাতে থাকা ছোট সাদা মুক্তার দুলটা এগিয়ে দিয়ে ভীত গলায় বলে উঠে,

“ আমরা খুঁজতে হাইওয়েতে যাই। সেখানে হাইওয়ের একপাশে আমরা এই কানের দুলটা খুঁজে পাই। আনফরচুনেটলি সেখানে রাস্তায় ক্ষানিকটা রক্তও পড়ে ছিলো। হতে পারে ওটা উনারই রক্ত। “

ক্রোধ এবং ভয়ে মিশ্রিত অনুভূতির জোয়ারে মনটা বেশ বিষিয়ে উঠে অধৈর্য্য পুরুষের। সে আর কিছু বলতে পারে না। নীরবে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় সে জানালার কাছে। অত:পর বেশ শান্ত গলায় বলে উঠে,

“ আমার জান নিয়ে পালানোর অপরাধে মন চাইছে এই মুহুর্তে তোমাকে জানে মেরে ফেলি বাণী। “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪.

কৃত্রিম আলোয় রাতের আধার কিছুটা ঘুচেছে বৈকি। নীরব ফ্রন্ট ইয়ার্ডের শান্ত পরিবেশের মৌনতা ভঙ্গ হয় আচমকা এক রমণীর চিৎকারে। ইট সিমেন্টের তৈরী ওয়াক ওয়েরের পথ ধরে টেনে হিচড়ে তাকে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এক পুরুষ। ক্ষিপ্ত তার দৃষ্টি। রমণী সেই দৃষ্টির তোয়াক্কা করলো না। সে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেকে ছোটানোর। কিন্তু দানবীয় হাতের বাধন ছেড়ে সে ছুটে পালাতে পারছে না। অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে স্পষ্ট মুক্তির আকুতি।

ফ্রন্ট ইয়ার্ডের চারিদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য নিরাপত্তা কর্মী। সকলে জড় বস্তুর ন্যায় নীরব ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দেখছে সেই দৃশ্য। কারো অন্তর পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না সেই আকুতি। রমণী আরেকটু জোর দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই তার পরিহিত ঘিয়া রঙের টপসটা কোমর থেকে কিছুটা উপরের দিকে সড়ে যায়। উন্মুক্ত হয় তার উদর। তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া সেই ক্ষিপ্ত পুরুষ সেই দৃশ্য দেখতেই তার রাগের পরিধি আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সে সাথে সাথে অগ্নিদৃষ্টি মেলে চারিদিকের গার্ডসদের দিকে একবার তাকায়। সবাই ইতিমধ্যে তার ভয়ে নিজের দৃষ্টি নত করে ফেলেছে। ক্ষিপ্ত পুরুষ এবার নিজের পায়ের বেগ বাড়ায়। আর্তনাদরত রমণীকে টেনে মুহুর্তেই উপস্থিত হয় ব্যাক ইয়ার্ডে।

সবুজ ঘাসে আবৃত ব্যাক ইয়ার্ডের একপাশে থাকা বিশাল হিজল গাছটার থোকায় থোকায় ঝুলে রয়েছে লাল রঙের হিজল ফুল। সেই হিজল গাছটার সাথেই শক্ত দড়ি দিয়ে বেধে রাখা হয়েছে কএক যুবককে। সাদা শার্টটা তার সম্পূর্ণ রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। ক্লান্ত মাথাটা একপাশে হেলে নত করে রেখেছে। দূর হতে সেই যুবককে দেখতে পেয়েই রমণীর আর্তনাদ থেমে যায়। চোখে ফুটে উঠে চরম অসহায়ত্ব। ঘাড় কাত করে আকুতি দৃষ্টি মেলে তাকায় ক্ষিপ্ত পুরুষের পানে। কিন্তু সেই পুরুষের মনে সেই দৃষ্টি মায়ার সঞ্চার ঘটাতে পারে না। সে সেই রমণীর চোখে চোখ রেখে কাঠকাঠ গলায় বলে উঠে,

“ ঘৃণা সহ্য করার ক্ষমতা আছে আমার। কিন্তু প্রতারণা সহ্য করতে পারবো না আমি। প্রতারণা করেছো তুমি। দু’জনেই শাস্তি পাবে। প্রথমে ও। “

কথাটুকু বলেই সেই পুরুষ গাছের সাথে বাধা যুবকের পানে চায়। অসহায় রমণীও ঘাড় ঘুরিয়ে সেই যুবকের দিকে তাকায়। আহত যুবক কারো উপস্থিতি টের পেয়েই মাথা সোজা করে সামনের দিকে তাকায়। তার দৃষ্টি মিলে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে থাকা সেই রমণীর সাথে। রমণীর চোখের অশ্রু দেখে সেই যুবকের বুকে পাহাড় ধ্বসে পড়া সমান পিড়া অনুভব হয়। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে মেয়েটা কার জন্য কাঁদছে? তার মতো অধমের জন্য কাঁদছে? এ-ও কি সম্ভব? যুবকের বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস জানান দেয় যে এই মেয়েটাকে মুক্ত করতে না পারার আফসোস তার কখনো মিটবে না।

টলমল চোখে তাকিয়ে থাকা মেয়েটা ক্রন্দনরত গলায় সেই যুবকের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে,

“ তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? “

ক্ষত বিক্ষত শরীরটা আঘাতে জর্জরিত। পুরোটা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেই আঘাতের বিষ ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু এই ব্যথার স্থায়িত্ব যে বেশিক্ষণের না তা ভালো করেই জানে আহত যুবক। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মুক্তি মিলবে তা সে ভালো করেই জানে। অন্তত সে যেই দুঃসাহসিক কাজ করেছে তার পর তাকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো সম্ভাবনাই নেই। লোকমুখে বলা হয়ে থাকে যে মানুষের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসলে ঠিক চল্লিশ দিন আগ থেকেই তার চারিদিকে আজরাইল ঘুরঘুর করতে থাকে। কথাটা অবশ্য সত্য না মিথ্যা তা জানা নেই সেই যুবকের। তবে রমণীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ক্ষিপ্ত পুরুষ গত চল্লিশ দিন ধরে তার চারিদিকে আজরাইলের মতই ঘুরঘুর করেছে। আজ যেহেতু সেই চল্লিশ দিন পূরণ হয়েছে তারমানে নিশ্চয়ই আজ তার শেষ দিন? মৃত্যু সন্নিকটে জেনেও মুখে আলতো হাসি নিয়ে সেই যুবক রমণীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ একটুও না। তুমি নিজের কান্না থামাও। যখনই মনে হবে এই পৃথিবীতে কেউ নেই তোমাকে ভালোবাসার তখনই আমাকে মনে করবে। জেনে রেখো আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। “

কথাটুকু শেষ হতে না হতেই একটা বিকট শব্দ শোনা গেলো। চোখের সামনে আহত দেহটা ঝাঁকি তুলতে তুলতে নিথর হয়ে শান্ত বনে গেলো। কিন্তু শান্ত থাকতে পারলো না রমণী। সে গগনবিদারী আর্তনাদ করে উঠলো। একবার দুবার না। বেশ কয়েকবার চিৎকার করে সে সামনে এগিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু সেই দানবীয় হাতজোড়া থেকে মুক্তি পেলো না সে। রমণী কান্না করতে করতে ছুটে সেই লাশ নামক রক্তাক্ত দেহের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। তার প্রমাণ হিসেবে সেই যুবকের খুনীর হাতে অসংখ্য খামচির দাগ স্পষ্ট দেখা গেলো। তবুও সেই ক্ষিপ্ত পুরুষ নিজের জায়গায় অটল রইলো। রমণী চিৎকার করে কাঁদতে থাকলো। যতক্ষণ না তার সম্পূর্ণ দেহ অসার হয়ে আসে ততক্ষণ। আঁধার কুহেলীর বুকে হেলে পড়লো সেই নিস্তেজ দেহ।

__________

শীতল প্রকৃতির মধ্যেও তিরতির করে ঘামতে থাকা দেহটা প্রচন্ড রকমের ভীতি নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলো। বাণী অনুভব করলো তার দু চোখ ভেজা। অতীতের এই বিষাক্ত খণ্ডাংশ আজও তাকে স্বপ্ন রূপে তাড়া করে যাচ্ছে। ভীত বাণী নিজের দুচোখ মুছে নিয়ে পাশ ফিরে তাকায়। বিছানার এককোণে উবুড় হয়ে শুয়ে থাকা বহ্নিকে দেখতেই তার বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। হঠাৎই তার টনক নড়ে উঠে। ব্যস্ত চোখে সে রুমের এককোণে থাকা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো ঘড়িতে সময় সকাল ১০ টা পেরিয়ে প্রায় ১১ টা ছুঁই ছুঁই।

মুহুর্তেই বাণী অস্থির ভঙ্গিতে বিছানা ছেড়ে নামলো। দ্রুত পায়ে সে বহ্নিকে কোলে তুলে ডাকতে ডাকতে ওয়াশরুমে নিয়ে ফ্রেশ করিয়ে আনে। বহ্নির ঘুম ততক্ষণে ভেঙে গিয়েছে। বাণী বহ্নিকে বিছানার এককোণে বসিয়ে তার হাতে একটা ছোট পাউরুটি এবং ওয়াটার পট ধরিয়ে দিয়ে নরম গলায় বলে,

“ মা তুমি টেন মিনিটসের মধ্যে ব্রেকফাস্টটা ফিনিশ করে ফেলো। মাম্মা ততক্ষণে আমাদের ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছি। “

কথাটুকু বলেই বাণী একটা হ্যান্ড ক্যারি ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বহ্নি অসহায় চোখে পাউরুটির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। এরকম নাস্তা করার তার মোটেও অভ্যাস নেই। আর না তার নিজের হাতে কিছু খাওয়ার অভ্যাস আছে। কিন্তু সে মাম্মাকে প্রমিজ করেছে যে সে মাম্মার সবকথা মেনে গুড গার্লের মতো চলবে। গুড গার্লরা নিশ্চয়ই কিছু নিয়ে অভিযোগ করে না? বহ্নিও অভিযোগ করে না। সে নিজের আনাড়ি হাতে সেই একটুকরো পাউরুটিতে একটা কামড় বসালো। পরপর শব্দ তুলে ওয়াটার পটের স্ট্রয়ের সাহায্যে কিছুটা পানি মুখে নিয়ে সেটা দ্বারা রুটিটাকে নরম করে চিবিয়ে খেলো। এরকম করে সে সম্পূর্ণ পাউরুটিটা খেয়ে শেষ করলো।

বাণী ততক্ষণে ব্যাগ গুছিয়ে নিজের জামা বদলে তার উপর একটা কালো বোরখা পড়ে নিলো। নেকাব করে সম্পূর্ণ মুখটাও ঢেকে নিলো। বহ্নি উৎসুক দৃষ্টি মেলে দেখলো সম্পূর্ণ দৃশ্যটা। পরমুহূর্তেই সে খিলখিলিয়ে হেসে বলে উঠে,

“ মাম্মা তোমাকে একদম ব্যাটম্যানের মতো লাগছে। পাপা কখনোই তোমাকে চিনতে পারবে না। “

বাণীর ভয়ার্ত হৃদয় মনে মনে দোয়া করে তাই যেনো হয়। সে বহ্নির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,

“ তুমিও মাম্মার মতো রেডি হতে চাও মা? “

বহ্নি চরম উৎসাহ নিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়। বাণী বহ্নির জামা পরিবর্তন করে অন্য একটা ফ্রক পড়িয়ে দেয়। তার সাথে মুখে মাস্ক পড়িয়ে মাথায় বাচ্চাদের ছোট একটা হিজাবও পড়িয়ে দেয়। হিজাব পড়ে বহ্নি মহা আনন্দে আয়নায় বারবার ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই সময়ে বাণী একটা কাগজ কলম নিয়ে ছোট একটা চিরকুট লিখে তা বিছানার একপাশে রেখে দেয়। অত:পর একহাতে হ্যান্ড ব্যাগ এবং অপর হাতে বহ্নির হাত ধরে সে দ্রুত সেই বাড়ি থেকে প্রস্থান করে। এখানে আর এক মুহুর্তও থাকা যাবে না।

__________

ভর দুপুর পেরিয়ে বিকেলের আগমনী লগ্ন তখন। পাহাড়তলির কোনো এক গলিপথে অতি সাবধানে হেঁটে যাচ্ছে এক মহিলা। অশান্ত দৃষ্টি মেলে সে বারবার আশেপাশে তাকাতে ব্যস্ত। রাস্তায় মানুষের সমাগম খুবই কম। দুই গলি পেরিয়ে একটা সুনসান গলির ইটের তৈরী একতলা একটা বাড়ির সামনে আসতেই সে দ্রুত বাড়ির সামনে থাকা একটা গাছের টবের মাটির ভেতর থেকে একটা চাবি বের করে নেয়। অত:পর সেই চাবির সাহায্যে দরজার তালা খুলে সে ভিতরে প্রবেশ করে।

একতলা এই বাড়িটা তিনরুমের মেলবন্ধনে তৈরী। একটা বেডরুম, একটা বসার ঘর আর একটা রান্নাঘর মাত্র। বাড়িটা প্রথম দেখেই বুঝা যাবে যে এটা কোনো এক মধ্যবিত্ত পরিবারের বাড়ি। সুস্পষ্ট ভাবে বলতে গেলে বাড়িটা ভদ্রমহিলার ভাইয়ের বাসা। স্ত্রী অসুস্থ থাকায় তার ভাই এক সপ্তাহের জন্য স্ত্রী সমেত ঢাকায় গিয়েছে ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ্যে। বাড়ির দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছে বোনের কাছে। তার বোন দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। ভদ্রলোকের অনুপস্থিতিতে তার বাড়ির কোনো অযত্ন করে নি। তবে খুব সাংঘাতিক একটা কাজ করেছে সে। ভাইয়ের খালি বাসায় এনে একরাতের জন্য আশ্রয় দিয়েছিলো সাহায্য কাম্য এক রমণী এবং শিশুকে।

ভদ্রমহিলার মন সেই পাষাণদের মতো কঠিন নয়। অসহায় রমণীর সেই সাহায্যের আর্তনাদ তার মনকে ঠিকই ছুঁয়েছে। তাই সামিল হয়েছে সে বাণীর পালিয়ে যাওয়ার এই পরিকল্পনায়। সবাই যখন বাণীকে খুঁজতে ব্যস্ত তখন অতি সুকৌশলে সে বহ্নিকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলো সেই নরকখানা থেকে। নিজের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে সে বাণীকে সাহায্য করার। যদিও সে ভালো করে জানে এই সাহায্যের পরিণাম ভয়াবহ হবে। তবুও সে এই দুঃসাহসিক কাজটা করেছে। পেটের দায়ে নরকখানায় কাজ করে বলে নিজের মনুষ্যত্ব এখনো বিকিয়ে দেয় নি সে।

ভদ্রমহিলার ভাবনা ভাঙে আচমকা কলিংবেলের শব্দে। মনে মনে সে কিছুটা অবাক হয়। এই সময় কে এলো? প্রশ্নের সমাহার মনে নিয়ে অসাবধানবসত সে কে এসেছে জানতে না চেয়েই দরজা খুলে দেয়। সাথে সাথেই তার হাত পা বরফের ন্যায় জমে যায়। সাক্ষাৎ যমদূত তার দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়ে!

কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই সেই যমদূতের পদচারণ ঘটে ঘরের ভেতর। তার সাথে থাকা দু’জন পুরুষও দ্রুত গতিতে ঘরে ঢুকে, একজন সেই ভদ্রমহিলার মুখ চেপে ধরে এবং অপরজন দরজা আটকে দেয়। নীল শার্ট এবং কালো প্যান্ট পরিহিত পুরুষ অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে চারিদিক দেখতে থাকে। আচমকা তার পা জোড়া থেমে যায় বেডরুমের দরজার সামনে এসে। খোলা দরজার বাহির হতে ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দাম্ভিক পুরুষ এগিয়ে যায় সেই রুমের ভেতর থাকা বেডের দিকে। বিছানার উপর এককোণে রাখা বাণী এবং বহ্নির পরিধেয় পোশাক।

হিরণ শীতল হাতজোড়ার মুঠোয় বহ্নির ছোট ফ্রকটা তুলে নেয়। পরম আবেশে সেই ফ্রকটায় চুমু খেয়েই সে বাণীর সাদা ওড়নাটা ফের তুলে নেয়। ওড়নাটা নাকের কাছে এনেই সে চোখ বুজে ফেলে। তার নাসারন্ধ্র চিড়ে অন্তরে যেন প্রবেশ করে খুব পরিচিত কোনো ঘ্রাণ। যেই ঘ্রাণকে গত বিশ ঘন্টা ধরে তাড়া করে যাচ্ছে সে, কিন্তু খুঁজে পাওয়ার আগেই হারিয়ে ফেলছে। হিরণের চোখ গিয়ে ঠেকে বিছানার এককোণে থাকা চিরকুটটার দিকে। সে হাতের ফ্রক এবং ওড়নাটা রেখে সেই চিরকুটটা এবার তুলে নেয়। সাদা কাগজে কালো কালির সাহায্যে কিছুটা খারাপ বাংলা হাতের লেখাটুকু সে পড়ে নেয়।

“ বন্দী খাঁচা থেকে এক জোড়া পাখিকে মুক্ত হতে সাহায্য করে আপনি আমাকে আজন্মের ঋণী বানিয়ে দিয়েছেন আফিফা আপা। এই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না। আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো আমি। “

হিরণ ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে। বাণী যেন দিন দিন বোকামির মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এ কেমন অদ্ভুত বোকামি? হিরণ অস্ফুটে বলে উঠে,

“ দূর্বল ডানার পাখি নিজের সীমানা অতিক্রম করে উড়ে বেশিদূর যেতে পারে না। তোমাকে নিজের ঠিকানায়ই ফিরতে হবে। “

কথাটুকু বলেই হিরণ রুম থেকে বেরিয়ে বাসার বাহিরে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়। তখনই পিছন থেকে একজন বলে উঠে,

“ এই মহিলার কি করবো স্যার? “

হিরণ এক মুহুর্তের জন্য দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বলে,

“ কেউ ক্ষমা পাবে না। “

__________

পড়ন্ত বিকেল তখন। জানালার কার্নিশে মাথা ঠেকিয়ে ব্যস্ত স্টেশনের পানে চেয়ে রয়েছে বাণী। উপরে তাকে দেখে শান্ত মনে হলেও ভিতরে ভিতরে সে প্রচুর ভীত। পাহাড়তলী হতে সে চট্টগ্রাম রেইলওয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছেছে সে প্রায় ঘন্টা তিনেক আগে। টিকেট কেটে প্রায় তিন ঘন্টা তার বসে থাকতে হয়েছে। এই তিন ঘন্টার ভেতর সে নিজের হাতের হীরের আংটি এবং গলার সোনার চেইন বিক্রি করে বেশ ভালো পরিমাণের টাকার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে। নতুন শহরে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে হলে এই টাকাটুকুর খুব প্রয়োজন পড়বে তার।

চট্টগ্রাম আন্তঃনগর ট্রেন ছাড়তে আর বেশিক্ষণ বাকি নেই। বাণী বাহির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কোলে বসে থাকা মেয়ের দিকে তাকায়। বহ্নি জানালা ভেদ করে স্টেশনের এক খেলনার দোকানের দিকে তাকিয়ে আছে। এই দৃশ্যটুকু দেখে বাণীর খুব মনখারাপ হয়। পালিয়ে আসার সময় সাথে করে বহ্নির কোনো খেলনা নিয়ে আসা হয়নি। বাচ্চা মেয়েটা অলরেডি বাণীর কারণে যথেষ্ট কম্প্রোমাইজ করছে। মা হিসেবে মেয়ের এইটুকু অব্যক্ত শখ কি বাণী পূরণ করতে পারবে না? বহ্নির জায়গায় অন্য কোনো বাচ্চা হলে হয়তো এতক্ষণে কেঁদে সব মাথায় তুলে ফেলতো। ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে বাণী বহ্নিকে কোলে নিয়েই উঠে দাঁড়ায়। অতি সাবধানে ব্যাগটাও সাথে তুলে নেয়। যেই দিনকাল চোখের সামনে থেকেই এখন ব্যাগ চুরি হয়ে যায়। সেখানে একা ট্রেনে ব্যাগ রেখে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

ট্রেন ছেড়ে নেমে পনেরো বিশ কদম হেঁটে খেলনার দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় বাণী। কোমল সুরে মেয়েকে প্রশ্ন করে,

“ কোনটা নিতে চাও মা? “

মায়ের এই সামান্য আস্কারা পেয়ে বহ্নি উৎফুল্ল অনুভব করে। সে দাঁত বের করে হেসে বলে উঠে,

“ আমি পাপার মতো ব্ল্যাক শুটার চাই। “

বাণী মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। শুটার দ্বারা যে তার মেয়ে গান চেয়েছে তা বুঝতে বাকি নেই তার। মেয়েটার কি নিজের পাপার ওই মরণ অস্ত্র এতোই পছন্দের? এই ভাবনা মনে উঁকি দিতেই ভয় হয় বাণীর। তবুও মেয়ের এই সামান্য ইচ্ছাটা অপূর্ণ রাখে না সে। একটা কালো খেলনা রিভলবার কিনে দেয়।

খেলনা কিনে ট্রেনের দিকে এগোতে নিলেই বাণীর দৃষ্টি স্থির হয় দূরে ভীড়ের মধ্যে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ঘুরে বেড়ানো একদল শিকারীর দিকে। মুহুর্তেই বাণীর শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে বহ্নিও ভীড়ের দিকে ভালো করে তাকায়। সাথে সাথে সে হাস্যজ্বল মুখে পাপা বলে চিৎকার করতে নিলেই বাণী তার মুখ চেপে ধরে দ্রুত উল্টো ফিরে দৌঁড়াতে শুরু করে। ভুলেও সে পিছনে ফিরে তাকায় না। এলোমেলো পায়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে সমতল মাটিতে নেমে আসে। এক বাচ্চা এবং ব্যাগ সাথে নিয়ে রেইললাইন ধরে দৌড়ে পাড় হতে তার বেশ বেগ পোহাতে হয়। দৌড়ের সময় বাতাসের বেগে তার মুখের নেকাবটাও সড়ে যায়। তবুও সে থামে না। রেইললাইন ক্রস করে এক নীরব রাস্তার কাছাকাছি আসতেই সে দেখে রাস্তার ধারে এক বিশাল কালো রঙের জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বাণী আর কিছু ভাবতে পারে না। এখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করতে হলে তার কোনো যানবাহনের প্রয়োজন। তাই সে দেরি না করে ধুপ করে সেই জিপ কারের পিছনের এক দরজা খুলে বিনা অনুমতিতে মেয়ে সহ সেই গাড়িতে উঠে বসে দরজা টেনে আটকে দেয়।

শিকারী দল হতে রক্ষা পেয়েছে ভেবে যে-ই না বাণী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে নিবে তখনই সে দেখে জিপ গাড়ি ভর্তি একদল যুবক বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আগুন্তকঃ এই নারীর অসময়ের বৃষ্টির মতো আগমনে তারা বিরক্ত না ভীত তা বুঝার সময় হলো না। তার আগেই সেই যুবক দল রিভলবার বের করে বাণীর দিকে তাক করে। বাণীর চোখের দৃষ্টি তখন ভয়াবহ করুণ। এক বিপদ ছেড়ে পালিয়ে এসে এ কি নতুন বিপদে পড়লো সে? বাণীর ভাবনার মাঝেই তার কোলে থাকা বহ্নি তাকে আড়াল করে নিজের হাতে থাকা খেলনা রিভলবার সেই যুবক দলের দিকে তাক করে চিকন স্বরে ধমকে বলে উঠে,

“ সারেন্ডার। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]