এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৭৪.
সকাল সকাল ট্রান্সফার লেটারটা হাতে পেতেই কিছুটা অবাক হয় সাইফ। এতো জলদি? তার সঙ্গে অন্য কারো লেটার তো এখনো আসে নি। সাইফের ভাবনার মাঝেই তার বেয়ারা ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠে। স্ক্রিনে জুলফিকার মুজতবার নামটা দেখতেই সাইফ অপেক্ষা না করে কলটা রিসিভ করে। গতকাল জুলফিকার কোনো সিদ্ধান্ত জানায় নি। কে জানে আজ কি কারণে কল দিলো! কলটা রিসিভ করতেই সাইফ ভদ্রতার সহিত বলে উঠে,
“ আসসালামু আলাইকুম স্যার। “
“ ওয়ালাইকুম আসসালাম। লেটারটা পৌঁছেছে তোমার কাছে? “
সাইফ অবাক গলায় বলে,
“ ট্রান্সফার লেটারের কথা বলছেন? “
“ জি। “
“ পেয়েছি স্যার। “
“ গুড। তোমার কুমিল্লায় ট্রান্সফারের সুপারিশটা আমার তরফ থেকেই ছিলো। দ্রুত ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাও। নতুন যাত্রার উদ্দেশ্যে রওনা হও। “
সাইফের ভ্রু কুচকে আসে। স্যার তাকে দূরে পাঠানোর জন্য সুপারিশ করলো? এর পিছনে কারণটা কি ইয়াসমিন? স্যার কি তবে চায় না সাইফ ইয়াসমিনের আশেপাশে থাকুক? সাইফ প্রশ্ন করে,
“ স্যার আমি কি আপনার জবাবটা না ধরে নিবো? “
“ আমি তোমাকে সুযোগ দিলাম সাইফ। নিজেকে প্রমাণ করে দেখানোর সুযোগ। একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সবথেকে কষ্টের হয় যখন সেই সম্পর্কের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। দূরত্বটা থাকা সত্ত্বেও যদি তুমি এবং তোমরা এই সম্পর্কটা টিকিয়ে রেখে দেখাতে পারো, তাহলে আমি আমার মেয়েকে নিজে তোমার হাতে তুলে দিবো। সেই সঙ্গে কুমিল্লাতে পৌঁছানোর পর নতুন যেই দায়িত্বটা পাবে তুমি সেটাও মন দিয়ে এবং নিষ্ঠার সহিত পালনের চেষ্টা করবে। দায়িত্বটা কঠিন কিন্তু পরিশ্রম করলে সফল হবেই। এই দায়িত্বটার জন্য আমি তোমাকে রেফার করেছি। সুতরাং বুঝতেই পারছো এতে আমার নামও জড়িত। তোমার ব্যর্থতা আমার জন্য অসম্মানজনক হবে। “
সাইফ বিস্ময়তায় বিমূঢ় বনে যায়। স্যার তাকে সুযোগ দিলো? বিষয়টা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। সাইফ মাথা নেড়ে বলে,
“ রজার ফ্রম মাই সাইড স্যার। আই প্রমিজ ইউ দ্যাট, এই দূরত্ব আমাদের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ফাটল ধরাতে পারবে না। আর বাকি সব কেসের মতো আপকিং কেসটায়ও আমি নিজের সর্বোচ্চটা দিবো। ইন শা আল্লাহ। “
“ বেশ তবে। বেস্ট অফ লাক। হ্যাভ এ সেফ জার্নি। “
ফোনটা রেখেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে জুলফিকার মুজতবা। ছেলে মেয়ে দুটো ভাবছে এই দূরত্ব মেনে নিয়ে সম্পর্ক বয়ে চলা তেমন বড়ো কোনো বিষয় নয়। কিন্তু দূরত্ব একটা সম্পর্ককে কতটা নাজুক করে তুলে সেই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তাদের। তবে জুলফিকার মুজতবার আছে। নাঈমার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাঙনের প্রধান কারণ এই দূরত্বই ছিলো। জুলফিকার মুজতবা চায় না তার মেয়েও ভবিষ্যতে এই সামান্য দূরত্বের জন্য একটা সুন্দর সম্পর্কের ইতি টানুক। দূরে থেকে আগে সম্পর্কটার মর্ম বুঝুক, চর্চা করতে শিখুক, ধৈর্য্য ধরে সম্পর্কটা লালন করতে শিখুক। যদি না পারে তাহলে সম্পর্কটা রাখার মানে হয় না। আর যদি ঠিকঠাক ভাবে ধৈর্য্যের পরীক্ষায় সফল হতে পারে, তখন নাহয় জুলফিকার মুজতবা বাকিটা দেখে নিবেন।
__________
সুন্দর এবং একান্তে দুটো দিন কাটানোর জন্য কক্সবাজারের সবথেকে নিরিবিলি বীচের মনোরম একটা কটেজ হাউজ বেছে নিয়েছে দূর্জয়। বুকিং সহ যাবতীয় সব কাজ সে গতরাতে বাসায় বসে অনলাইনে সেড়ে ফেলেছে। এখন কেবল কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায় পৌঁছানো বাকি। বাণী আসার আগে এক এক করে আফরার সবগুলো মেডিসিন সুহালা বেগমকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে। বারবার করে বলেছে যেনো আফরাকে ধমকে হলেও চব্বিশ ঘণ্টা সুয়েটার পড়িয়ে রাখতে। বাহিরে বের হলে যেনো হুডি টেনে মাথা ঢেকে বের হয়। মা’য়ের মন। সন্তানের জন্য চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। দূর্জয়ও কম যায় না। নিজের ব্যক্তিগত লোক মাসুদকে মা ও মেয়ের উপর নজর রাখার দায়িত্বটা বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে। দিন হোক অথবা রাত যেকোনো ঝামেলা হলেই যেনো দূর্জয়কে কল দেয়।
কক্স বাজারের মেরিন ড্রাইভের রাস্তা ধরে কালো জিপটা এগিয়ে যাচ্ছে। পথে এই পর্যন্ত ৫/৬ বার সুহালা বেগমকে কল করে আফরার খবর নিয়েছে বাণী। সুহালা বেগম বিরক্ত না হলেও আফরা কেবল একবার বিরক্ত হয়ে বলেছিল,
“ ওহ গড মাম্মা। আই এম অলরাইট। তুমি প্যানিক বোমের মতো করছো কেন? “
ফোনটা স্পিকারে ছিলো সেই মুহুর্তে। আফরার কথা বলার ভঙ্গি শুনে গাড়ি ড্রাইভ করতে ব্যস্ত দূর্জয় না চাইতেও হেসে ফেলে। বাণী কেবল দূর্জয়ের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে ফোনটা রেখে দেয়। তারপর থেকেই মুখ কালো করে বসে আছে সে। দূর্জয় তা দেখেও কিছু বলে না। বাণী হঠাৎ গাড়ির কাঁচের জানালাটা নামায় প্রকৃতির স্নিগ্ধ বাতাস উপভোগ করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই দূর্জয় কাঁচটা উঠিয়ে দিয়ে বলে,
“ এই শিরশিরে বাতাসটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ঠান্ডা লেগে যাবে। পরে বীচ ছেড়ে আমাদের হসপিটাল ট্রিপে যেতে হবে। “
বাণীর মেজাজ এভাবেই খারাপ ছিলো। সে সামান্য ঘাড় ত্যাড়ামি করে বলে,
“ তোমার এই প্যারেন্টস স্পিচ গুলো আফরার সামনে দিবে। আমি আফরা নই। হাজবেন্ড আছো, হাজবেন্ডের মতোই থাকো। “
বলে বাণী আবার কাঁচটা নিচে নামায়। দূর্জয় সঙ্গে সঙ্গে কাঁচ তুলে দিয়ে বলে,
“ আমি হাজবেন্ডের মতোই আচরণ করছি। ওয়াইফের ভালো খারাপটা দেখবো না? গাড়ির স্পিডের কারণে কনকনে ঠান্ডা বাতাসটা বেশি অনুভূত হবে। শরীর খারাপ করবে। কথাটা শুনো। “
বাণীর রাগ হয়। বাতাসই যদি না খাওয়া যায় তাহলে সমুদ্রের কাছে এসে লাভ হলো কি? সমুদ্রের কাছে আসতে হলে বাধা নিয়ম ছিন্ন করে আসতে হয়। সম্পূর্ণভাবে সমুদ্রকে অনুভব করতে জানতে হয়। এতো রেস্ট্রিকশন মেনে কখনো ট্রিপ ইঞ্জয় করা যায় না। বাণী আবার হাত বাড়িয়ে কাঁচ নামানোর জন্য হাতের বাম পাশে দরজার কাছটায় ইলেক্ট্রিক সুইচটা চাপতে নিলেই দূর্জয় এবার গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,
“ বারবার এই গ্লাস অফ অনের জন্য যদি আমার জিপের কিছু হয় তাহলে ভালো হবে না বাণী। “
বাণী হতবুদ্ধির ন্যায় এবার দূর্জয়ের দিকে তাকায়। পরমুহূর্তেই বিষণ্ণ মনের ভারিক্কি সামলাতে ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে ফেলে। এই গাড়িটার প্রতি দূর্জয়ের মাত্রারিক্ত টানটা সে আগেও বহুবার লক্ষ্য করেছে। চলার পথে ভুল করে কেউ এই গাড়িতে সামান্য আঁচড় বসালেও দূর্জয়ের চেহারা থমথমে রূপ ধারণ করে। বাণী জানে না একটা গাড়িকে নিয়ে এতটা অবসেসড হওয়া আদৌ কতটা যুক্তিসঙ্গত। তবে তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়। দূর্জয়ের জীবনে এই গাড়ির স্থান বাণীর থেকেও উপরে ভাবতেই বাণীর নিজের প্রতি লজ্জা লাগে। অতিরিক্ত অধিকার খাটিয়ে ফেলেছে সে। দূর্জয়ের কোনো জিনিসে আর বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ করবে না সে। থাকুক দূর্জয় নিজের মাই লাভ নিয়ে।
__________
নির্ধারিত রিসোর্টে পৌঁছাতে তাদের আরো প্রায় এক ঘন্টা সময় লাগে। এই রিসোর্টের আওতায় প্রায় দশ থেকে বারোটা কটেজ হাউজ আছে। প্রত্যেকটা কটেজ হাউজেরই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম। দূর্জয় যেই কটেজটা বুক করেছে তার নাম ‘জলকাব্য’। এটা মূলত একটা সিঙ্গেল বেডরুমের ডুপ্লেক্স কটেজ। বেডরুমের সঙ্গে রয়েছে একটা ঝুল বারান্দা। আরো রয়েছে বিশাল ওয়াশরুম। পরিপাটি জলকাব্য কটেজের ঝুল বারান্দাটা হতেই সামনে সমুদ্রের দেখা মিলে। সে এক অপার্থিব দৃশ্য।
কিন্তু সেই অপার্থিব দৃশ্যের দিকে বাণীর বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সে চাবি নিয়ে রুমে প্রবেশ করেই সোজা বারান্দায় গিয়ে কাঠের আরামকেদারায় পা তুলে বসে রয়। বারান্দা হতে সমুদ্রটা সদৃশ্যমান হলেও সেদিকে চোখ তুলে তাকায় না বাণী। চোখ জোড়া নিবিদ্ধ রয় মেঝেতে।
স্ত্রীর মন খারাপ সম্পর্কে অবগত দূর্জয়। তবে তা ভালো করার কোনো তাড়াহুড়ো তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। সে আরাম করে বসে আগে দু তিনটে গুরুত্বপূর্ণ কলের কথা সেড়ে নেয়। অত:পর বারান্দায় গিয়ে বাণীর সামনে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলে,
“ সরি। “
বাণী চোখ তুলে তাকায় না। তবে অভিমান মিশ্রিত স্বরে বলে,
“ আই এম সরি। তোমার গাড়িকে আর কখনো ছুঁবো না আমি। “
দূর্জয় বলে,
“ একশো বার ছুঁবে। আমি তোমার ভালোর কথা ভেবেই বারবার মানা করছিলাম বাণী। নিজের মেডিক্যাল হিস্ট্রি খুব ভালো করেই জানো তুমি। নিউমোনিয়া থেকে রিকভার করা মানুষদের ঠান্ডার ক্ষেত্রে সচেতন থাকা উচিত। ঠান্ডা লেগে অসুস্থ হলে শারীরিক কষ্টটা সম্পূর্ণ তোমার হবে। সেই কষ্টটা যেনো না ভুগতে হয় তাই সামান্য রাগ দেখিয়েছি। ওই মুহুর্তে আমি ওভাবে গাড়ির কথাটা না বললে তুমি ত্যাড়ামি করে বারবার একই কাজটা করতে থাকতে। আমার ইনটেনশন তোমাকে হার্ট করা ছিলো না। “
বাণী মুখ তুলে তাকায় না। দূর্জয় বলে উঠে,
“ আমি জানতাম আফরাকে ছাড়া তোমার মন টিকবে না। বারবার করে তোমাকে বলেছি ইচ্ছার বিরুদ্ধে আসাটা বাধ্যতামূলক নয়। তবুও তুমি বলেছো কোনো সমস্যা নেই। “
বাণী দূর্জয়ের সব কথা নীরবে শুনে। অত:পর নিচু স্বরে জবাব দেয়,
“ তুমি প্রশ্রয় দিচ্ছো খুব আমাকে। তোমার প্রশ্রয়ের কারণে এই অহেতুক রাগটা দেখাতে পেরেছি আমি। আমার দোষ নেই। “
বাণীর কথার পিঠে দূর্জয় নীরবে হেসে বলে,
“ আচ্ছা। সব দোষ আমার। এখন বলো আফরাকে আনার ব্যবস্থা করবো? “
বাণী চকিতে দূর্জয়ের দিকে তাকায়। নিজের মনকে শক্ত করে জবাব দেয়,
“ না। ও মা’র সাথে থাকতে চাইছে। দীদার সঙ্গে সময় কাটাক। “
দূর্জয় অবাক গলায় প্রশ্ন করে,
“ মনের বিরুদ্ধে কথা বলছো কেনো তুমি? “
বাণী উঠে রুমের দিকে যেতে যেতে বলে,
“ মনকে শক্ত করার চেষ্টা করছি। আফরা বড়ো হলে ওর বিয়ে দিতে হবে না? তখন তো ওকে ছেড়েই থাকতে হবে। তাই এখন থেকেই প্র্যাকটিস করছি। “
বাণীর কথায় দূর্জয় বিস্মিত হয়। পরমুহূর্তেই বলে,
“ ওহ গড বাণী! তুমি এখন থেকেই এসব ভাবছো? শি ইজ স্টিল এ বেবি। এসব আইডিয়া মাথা থেকে বাদ দাও। ওকে কখনো দূরে কোথাও পাঠাবো না আমি। “
দূর্জয়ের কথার ধরনে বাণীর হাসি পায়। বাণী তো মজা করে কথাটা বলেছিলো। এই লোক সেই কথাটা সিরিয়াসলি নিয়ে বসে আছে। বাণীর মন খারাপ মুহুর্তেই দূর হয়ে যায়। ফুরফুরে মন নিয়ে সে ব্যাগ খুলে একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ড্রেস চেঞ্জ করতে।
__________
ছাই রঙা আকাশটায় সোনালী রঙের থালার ন্যায় গোলাকার এক চাঁদের দেখা মিলেছে আজ। সমুদ্রের হিংস্র ঢেউ গুলোর বুকে যামিনীর আলো পড়তেই তা খানিকটা উজ্জ্বল রূপালী বর্ণ ধারণ করে চিকচিক করে উঠে। বালিময় তীরে দু জোড়া নগ্ন পায়ের বিচরণ ব্যাপক তখন। সমুদ্রের মহিমান্বিত সৌন্দর্যকে অগ্রাহ্য করার সাধ্যি কার আছে?
প্রচন্ড বাতাসে তিরতির করে বাণীর খোলা চুল এবং শাড়ির আঁচল কাপছে। মুগ্ধ চোখে দেখছে চারিপাশটা। আনমনে হঠাৎ পাশে হাঁটা সাদা শার্ট পরিহিত মানুষটার হাতের সঙ্গে নিজের হাতের সংস্পর্শ টের পেতেই লজ্জায় খানিকটা সরে দাঁড়ায়। আশ্চর্য সুন্দর পৃথিবীর সৌন্দর্যকে অগ্রাহ্য করে দূর্জয়ের দৃষ্টি তখন স্ত্রীর পানে নিবদ্ধ।
চারিপাশের জলরাশি ভয়ংকর শব্দে করে যখন গর্জন করছে সেই মুহুর্তে দূর্জয় গাঢ় স্বরে ডাকে,
“ বাণী? “
বাণী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। দূর্জয় দু কদম এগিয়ে গিয়ে নিজের ডান হাতটা তুলে বাণীর বাম গাল ছুঁয়ে কানের পাশটায় একটা শুভ্র দোলনচাঁপা ফুল গুজে দেয়। আকস্মিক ছোঁয়ায় বাণী ক্ষানিকটা কেপে উঠে। ফুলটা মূলত সন্ধ্যার দিকেই রিসোর্টের এককোণে ফুটে থাকতে দেখে দূর্জয় ছিড়ে নিয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো শুভ্র ফুলটা ওই সবুজ পাতার গাছটার থেকে তার স্ত্রীর কানে বেশি মানাবে। দূর্জয়ের ভাবনাটা সঠিক ছিলো। সাদা ব্লাউজের উপর আকাশি রঙের শাড়ি প্যাচানো বাণীর কানে ফুলটা বেশ সুন্দর মানিয়েছে।
দূর্জয় কিছু না বলে নীরবে আবার হাঁটা শুরু করে। বাণীও কিছু না বলে দূর্জয়ের পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। মিনিট খানেক পর আবার আনমনে বাণীর হাতটা দূর্জয়ের হাত ছুঁয়ে যায়। এবার আর বাণী হাত সরিয়ে নেয় না। বরং আলতো করে দূর্জয়ের হাতটা ধরে। ইচ্ছাকৃত ছোঁয়ায় দূর্জয়ের মুখভঙ্গিতে বিস্ময়তা ফুটে উঠে। সে চকিতে বাণীর দিকে তাকায়। বাণী তখন সমুদ্রের দিকে মুখ করে হাঁটছিলো।
দূর্জয় স্পষ্ট বুঝতে পারে প্রশ্রয়টা কেবল সে বাণীকে নয় বরং বাণীও তাকে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে, অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। নিজের উপর অধিকারের কতৃত্বটা দূর্জয়ের হাতে সপে দিচ্ছে নীরবে। অব্যক্ত কথাগুলো ইশারায় বুঝাতে চাইছে। বলতে চাইছে,
“ আমি তোমার সঙ্গে ভালো থাকতে চাই। “
দূর্জয় এবার নীরবে বাণীর হাতটা ছাড়িয়ে নিজেই তার হাত ধরে। বাণীর মতো আলতো ছোঁয়া নয় তা, পাকাপোক্ত করে ধরা যাকে বলে। বাণীর প্রতিটি আঙুলের ভাজে নিজের আঙুল গুজে দেয়। মুহুর্তেই বাণী স্তব্ধ বনে যায়। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়। গন্তব্যহীন পথিকের ন্যায় কেবল দূর্জয়ের পদচারণ অনুসরণ করে এগোতে থাকে। গহীন অন্তর তাকে সঙ্গোপনে জানায়,
“ আরেকবার ভালোবাসতে ক্ষতি নেই। কোনো ক্ষতি নেই। “
__________
নিশাচর প্রাণীর ন্যায় বারান্দার রেলিং ঘেঁষে মেঝেতে বসে আছে বাণী। শাড়ির উপর পেঁচিয়ে রেখেছে একটা উষ্ণতা জড়ানো শাল। অপেক্ষা করছে দূর্জয়ের। বিশাল কটেজটায় তার উপস্থিতি নেই। কোথায় গিয়েছে কে জানে! কেবল বলে গিয়েছে এক্ষুনি এসে পড়বে।
রেলিঙের ফাঁক গলে বাণীর চোখ তখন সমুদ্র পানে স্থির। এই সমুদ্র দেখতে এসেই আজীবনের জন্য বন্দী হয়ে আটকা পড়েছিলো সে। সেই বন্দীদশা থেকে বাঁচার কোনো পথ খোলা ছিলো না। অথচ আজ এই সমুদ্রের তীরেই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাওয়া পাখির ন্যায় নির্ভয়ে বাণী বসে আছে। পরম করুণাময় চাইলে কি না সম্ভব!
মাথার উপর আকাশের বুকে অধিষ্ঠিত গোলাকার চাঁদ। তাকে সঙ্গ দিতে রয়েছে অসংখ্য তারা। অপার্থিব সেই সৌন্দর্য দেখে বাণী যখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সেই মুহুর্তে তাকে সঙ্গ দিতে দূর্জয় এসে উপস্থিত হয়। হাতে তার কালো রঙা গিটারটা দেখে বাণী অবাক হয়। প্রশ্ন করে,
“ এইটাও সাথে করে এনেছো তুমি? আমি দেখি নি কেনো? “
দূর্জয় বারান্দার অপর পাশের রেলিঙ ঘেঁষে বসে। শীতল আবহাওয়া থেকে রক্ষা পেতে সাদা শার্টটার উপর বুকবন্ধ একটা জলপাই রঙা সুয়েটার পড়েছে সে। গিটারটা নিজের কোলে বেশ কায়দায় রেখে উত্তর দেয়,
“ ব্যাক বোনাটে রেখেছিলাম। সারপ্রাইজ ছিলো। তাই তোমার অগোচরে এটা সাথে করে নিয়ে এসেছি। “
বাণী ছোট করে ওহ বলে বসে রয়। যেনো গিটারটার প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। দূর্জয় কথা চলমান রাখার জন্য কোনো প্রশ্ন খুঁজে। গিটারের দিকে তাকাতেই তার চোখে পড়ে এককোণে সাদা সিগনেচার পেন দ্বারা ইটালিক ফন্টে ছোট্ট করে ইংরেজি চার লেটারে লেখা নামটা। ‘Bani’
দূর্জয় প্রশ্ন করে,
“ লেখাটা অনেক সুন্দর। তুমি লিখেছো? “
বাণী একদফা গিটারটাকে দেখে নিয়ে বলে,
“ আমার হ্যান্ডরাইটিং বাজে। এটা ভাইয়া লিখে দিয়েছিলো। “
দূর্জয় অস্বস্তি অনুভব করে না। বরং আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,
“ খুব ব্রাইট ছিলেন উনি, তাই-না? “
“ হ্যাঁ। সম্পূর্ণ আমার বিপরীত। আমি তো গিটার বাজানো বাদে প্রতিটা ফিল্ডে নালায়েক ছিলাম। কিন্তু ভাইয়া একদম আমার উল্টো ছিল। ভালো ছেলে হওয়ার সব গুণ ভাইয়ার মাঝে ছিলো। আত্মীয় স্বজনদের ফেভারিট চাইল্ড ছিলো। যদিও আমার সাথে খুব একটা সখ্যতা ছিলো না। সব ব্যাপারেই আমাদের ক্ল্যাশ হতো। জানো? ভাইয়ার সাথে একবার আমার খুব সিরিয়াস ঝগড়া হয়েছিলো। ঝগড়ার কারণ ছিলো ভাইয়া ভুল করে আমার গিটার ভেঙে ফেলেছিলো। রাগে আমি এক সপ্তাহ ভাইয়ার সাথে কথা বলি নি। মনে হচ্ছিলো ওই বড়ো বাড়িটায় দুটো মানুষ আমাকে ভালোবাসলেও ভাইয়া আমাকে একটুও ভালোবাসে না। কি গাধী ছিলাম আমি… “
এতদূর বলে বাণী বোকার ন্যায় হেসে উঠে। একটা ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ ভাইয়া আমাকে ওই মানুষ দুটোর থেকেও বেশি ভালোবাসতো। ভাইয়া আমার স্বপ্নে আসে, জানো? আমার তখন ভাইয়াকে বলতে ইচ্ছে করে, ‘বোকামি করো না ভাইয়া। তোমার জীবনটা সুন্দর করে গুছানো আছে। দেশটা ছেড়ে চলে যাও। ভীনদেশে তোমার জন্য একটা সুন্দর জীবন অপেক্ষা করছে। তুমি চলে যাও।’ কিন্তু কথাগুলো বলতে পারি না। গলার কাছে আটকে থাকে। মানুষ তো একবার মারা যায়, তাই-না? কিন্তু ভাইয়া হাজারবার, বহুবার মারা যায়। স্বপ্নে ভাইয়াকে আমি প্রতিদিন মারা যেতে দেখি। আমি কিছু করতে পারি না। আফসোস হয় খুব। ওই নিষ্পাপ মানুষটার বোন হয়ে খুব আফসোস হয়। আমার জন্য ভাইয়ার জীবনটা… “
বাণী আর বলতে পারে না। মস্তিষ্কের নিউরন গুলোয় খুব চাপ অনুভব করে হঠাৎ করে। নিঃশ্বাস গুলো এলোমেলো হয়ে আসে। মস্তিষ্কের উন্মাদনা ব্যাপক মাত্রা ধারণ করলে সে অশান্ত হয়ে পড়ে। দূর্জয় দ্রুত গিটার ফেলে উঠে আসে। অস্থির হয়ে পড়ে। দু’হাতে বাণীর গাল আগলে ধরে বলে,
“ আমি তোমাকে হালকা হওয়ার জন্য প্রশ্ন করছিলাম। কষ্ট হলে বলতে হবে না। শান্ত হও। “
বাণী শান্ত হতে পারে না। যতবার মনে পড়ে তার ভাইয়ের জীবন নাশের পিছনে কারণটা সে নিজে ততবারই তার বুক থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। বেসামাল বাণী কিছু বলার চেষ্টা করে। কিন্তু গলা দিয়ে শব্দগুলো আর বের হয় না। দূর্জয় গাল ছেড়ে বাণীকে টেনে কাছে আনে। দক্ষতার সহিত পাজাকোলে তুলে উষ্ণ রুমটার ভেতর চলে গেলো। বিছানায় গিয়ে বসলেও বাণীকে আর ছাড়ে না। বরং আগলে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। বাণী এবার ডুকরে কেদে বলে উঠে,
“ আমি কি করবো? আমি কখনো সুস্থ হতে পারবো না। জীবনের ওই সাতটা বছরের স্মৃতি নিয়ে আমি কখনো ভালো থাকতে পারবো না। আমি ঘুমকে খুব ভয় পাই। ঘুমালেই ওই লোকটা… ওই লোকটা স্বপ্নে আসে। ওই রাতটা তাজা হয়ে উঠে। বাস্তবতায় যেই সংখ্যাটা দুইয়ের ঘরে, আমার স্বপ্নে সেই সংখ্যাটা হাজার পেরিয়েছে। আই ওয়াজ রেপড বাই হিম এ থাউজ্যান্ড টাইমস। আমি কি করবো? আমি… “
দূর্জয় স্বাভাবিক থাকতে পারে না। চোখ ভিজে উঠে। কঠোর ব্যক্তিত্বটা এই চরম নির্মমতায় টলে উঠে। বলার মতো শব্দ খুঁজে পায় না। স্বপ্নের উপর তো তার কর্তৃত্ব নেই। বাঁধ ভাঙা কান্নায় ডুবে যাওয়া বাণীকে আরেকটু শক্ত করে আগলে ধরে দূর্জয়। মনস্তাত্ত্বিক দিকটার উপর তার জোর খাটলে সে বাণীকে সুস্থ করার কোনো অবকাশ বাদ দিতো না। বাণী কাঁদতে কাঁদতে একটা সময় নিজেই কিছুটা শান্ত হয়। ক্ষীণ স্বরে বলে,
“ ওই গিটারটা… ওটা ভাইয়া দিয়েছিলো। আমার ভেঙে যাওয়া গিটারের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিয়েছিলো। “
দূর্জয় বলে,
“ একটু ঘুমানোর চেষ্টা করবে জানা? “
বাণী উত্তর দেয় না। দূর্জয় নিজ থেকে বলে,
“ দুঃস্বপ্ন আসবে না। আমি আছি না? চেষ্টা করে দেখো। “
বাণী বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। কিছুটা দূরে সরে যায়। দূর্জয় ভাবে হয়তো অস্বস্তি বোধ করছে। কিন্তু পর মুহুর্তেই দেখে বাণী তার কোলে মাথা এলিয়ে দিয়েছে। শাড়ি জড়ানো শীর্ণ দেহটা গুটিসুটি মেরে চোখ জোড়া বুজেছে। দূর্জয় শক্ত হাতটা দিয়ে যত্নের সহিত মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। ছোট্ট বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানোর মতো করে নরম গলায় গুনগুনিয়ে উঠে,
“ যদি চাও তুমি
তোমার সুরে,
আমি গেয়ে যাবো
তোমারই গান,
যেনো এই আমি
আছি তোমার আজও।
আর যত ভুল
তোমার রঙে
গড়া অভিমান,
তোমায় ভেঙ্গে গড়া
আবারো বলছি
তোমায় শোনো।
আমার রঙে
যাও হারিয়ে,
হারিয়ে যাও তুমি। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]
এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৭৫.
আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময়। বর্ষা ঋতুর আগমন ঘটেছে বাংলার বুকে। ঝপঝপিয়ে নামা বৃষ্টির শব্দের বদলে তীক্ষ্ণ এলার্মের শব্দে নিশার গাঢ় ঘুমে বিঘ্ন ঘটলো। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে সে। অতিরিক্ত ঘুমের ফলে ফুলে উঠা চোখ জোড়া মেলে জানালা ভেদ করে বাহিরের দিকে তাকায়। নতুন এক সকালের আগমন ঘটেছে।
মস্তিষ্কটা সম্পূর্ণ জাগ্রত হতেই উপলব্ধি করে সকাল হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে নিশা এক লাফে উঠে বসে। ফোনটা চেক করে সময়টা দেখে নেয়। ৫ টা বেজে ১৪ মিনিট। সাইফ বুঝি এসে পড়েছে? আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে দ্রুত পা ফেলে বিছানা ছাড়ে নিশা। দশ মিনিটের মধ্যে ওয়াশরুম থেকে সম্পূর্ণ রূপে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে এক পল দেখে নিয়ে আপনমনে হেসে উঠে। কি পড়বে সে? সাইফের প্রিয় রঙ?
আলমারি থেকে কলাপাতা রঙের একটা প্লেইন ফুল স্লিভসের টি শার্ট বের করে নেয়। সেই সঙ্গে একটা সাদা রঙের স্কার্ট আর একটা বাহারি রঙের স্কার্ফ। টি শার্টটা দেখে আরো এক দফা হাসে নিশা। জংলী লোকের পছন্দের রঙটাও জংলী গোছের। গায়ের পোশাকটা বদলে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের লম্বা চুলগুলোকে খেজুর বেণি করে পিছনে ছেড়ে দেয় নিশা। সরু চুলের বাধনটা সাপের ন্যায় তার কোমরের কাছটায় ঝুলতে থাকে। হাতের কব্জিতে ঘড়ির বদলে বাহারি রঙের কাঠের পুতি দিয়ে তৈরী ব্রেসলেটটা শোভা পাচ্ছে। আর কোনো অলংকার নেই শরীর জুড়ে। এতটুকুতেই তৃপ্ত সে।
কাধের ব্যাগটায় ফোনসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রুমের বাহিরে পা রাখতেই জুলফিকার মুজতবার মুখোমুখি হয় নিশা। মুখের হাসি হাসি ভাবটা মিলিয়ে গিয়ে অপ্রস্তুত দেখায় তাকে। অপ্রস্তুত দেখায় জুলফিকার মুজতবাকেও। ভোর বেলায় নিজ কন্যাকে এমন সুসজ্জিত রূপে দেখে আসল ব্যাপারটা আন্দাজ করে ফেলেন তিনি চট করে। স্বভাবসলুভ স্বরে জানতে চায়,
“ আজ আসছে ও? “
নিশা মৃদু মাথা নেড়ে বলে,
“ জি। “
জুলফিকার মুজতবা আর কিছু বলে না। নিশা লজ্জাটা একপাশে রেখে নমনীয় স্বরে বলে,
“ আমি যাই আব্বু? “
মেয়ের নরম গলার কথাটাকে অগ্রাহ্য করার সাধ্যি নেই জুলফিকার মুজতবার। তার উপর সাইফও আজ ছয়টা মাস পর চট্টগ্রামে ফিরছে। জুলফিকার মুজতবার বেধে দেওয়া শর্ত গুলো উত্তীর্ণ করে তবেই চট্টগ্রামের বুকে পা রাখতে যাচ্ছে। এই ছয়টা মাস ছেলে মেয়ে দুটো কি সুন্দর করে ধৈর্য্যের সহিত সম্পর্কটাকে টেনে নিয়ে এই পর্যন্ত এসেছে সেই সম্পর্কে জুলফিকার ভালো করেই অবগত। তাছাড়াও একটা দূর্দান্ত রেজাল্ট করে নিশা উচ্চ মাধ্যমিকটা উতরে গিয়েছে। অর্থাৎ এই সম্পর্কটার কোনো রকমের বিরূপ প্রভাব তার মেয়ের শিক্ষাজীবনে পড়ে নি। তাই তিনি আর বাধা না দিয়ে বলে,
“ বাহিরে বৃষ্টি খুব। ছাতা সঙ্গে নিয়ে যাও। আমি ড্রাইভারকে কল করে দিচ্ছি। তোমাকে পৌঁছে দিবে। “
নিশা খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,
“ আচ্ছা আব্বু। “
দরজার পাশেই একটা কাঠের শেল্ফ হতে নীল রঙের ট্রান্সপারেন্ট ছাতাটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বেরোতে নিলেই জুলফিকার মুজতবা নিশাকে পিছু ডাকে। নিশা তাকাতেই স্বাভাবিক গলায় বলে,
“ লাঞ্চটা বাসায় করবে। সাইফকে নিয়ে কাটায় কাটায় একটার সময় বাসায় উপস্থিত থাকবে। অপেক্ষা করবো আমি। “
নিশার মনটা খুব ভালো হয়ে যায়। আব্বু সাইফকে লাঞ্চে ইনভাইট করছে। এইটা কি একটা পজিটিভ সাইন না? উফফ! এখন শুধু আম্মুকে সবটা জানিয়ে আব্বু রাজি করাতে পারলেই আর কোনো বাধা থাকবে না। সাইফ আর নিশার পারফেক্ট ফ্যামিলির স্বপ্নটা পূরণ হয়ে যাবে।
__________
বেয়ারা ফোনটা বেজে উঠতেই ঘুম ঘুম চোখে কলটা রিসিভ করে প্রত্যয়। উপুড় হয়ে শুয়ে ফোনটা কানে চেপে ধরতেই উচ্ছ্বসিত একটা স্বর বলে উঠে,
“ এই! শুনো। এইমাত্র একটা চমৎকার স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙেছে। “
প্রত্যয় ঘুম জড়ানো স্বরে মিহি হেসে বলে,
“ আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছো নিশ্চয়ই? উফ! তুমি আর শোধরাবে না। “
জেসি বলে,
“ না। তোমাকে নিয়ে না। আমি দেখেছি আমাদের টাইগারের একটা ভাই এসেছে। ওর নাম জানো কি রেখেছি? কিং কং। উফ! কি সুন্দর আর মায়াবী দেখতে বাচ্চাটা! টাইগার ওকে পেয়ে এতো খুশি হয়েছে! “
প্রত্যয়ের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। ও ভ্রু কুচকে বলে উঠে,
“ কিং কং! এইটা কেমন নাম? “
“ এইটা সুন্দর নাম। তুমি বুঝবে না। এই শুনো না। আমরা আমাদের টাইগারের জন্য একটা ভাই নিয়ে আসি? “
আতংকে প্রত্যয়ের ঘুম ছুটে যায়। সে তড়িঘড়ি করে বলে,
“ কখনোই না। তোমার এক বাচ্চাকে পেয়েই তুমি আমাকে ভুলে যাচ্ছো। আরেকজন আসলে আমি যে এক্সিস্ট করি সেটা তোমার মনেই থাকবে না। “
জেসি হেসে বলে,
“ তুমি কি জেলাস? “
প্রত্যয় অকপটে বলে,
“ হ্যাঁ। “
“ তোমার জায়গা কেউ নিতে পারবে না। এতো চিন্তা করো না তো। আর ডিসিশন ফাইনাল। আমি আজকেই টাইগারের জন্য একটা ভাই আনার ব্যবস্থা করছি। তুমি এখন ঘুমাও। বাই। “
“ এই না… “
প্রত্যয়ের পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোনটা কেটে যায়। প্রত্যয় হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে। এই ঝামেলাটা শুরু হয় জেসির বান্ধবী রিমির বিয়ের মধ্য দিয়ে। রিমির একটা পোষা বিড়াল ছিলো। কালো রঙের মায়াবী বিড়ালটাকে শখের বশে পরিবারের বিপক্ষে গিয়ে পালতো রিমি। কিন্তু বিয়ের পর তার দেশের বাহিরে সেটেল্ড হয়ে যেতে হবে দেখে সে বেশ বিপাকে পড়ে যায়। একে-তো তার শশুর বাড়িতে বিড়ালটাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না তার উপর নিজের বাবার বাসায়ও সে চাইলে আর বিড়ালটাকে রাখতে পারবে না। কারণ সেখানে দেখাশোনা করার দায়িত্বটা নিতে কেউই রাজি নয়। বাধ্য হয়ে রিমি ফেসবুকে একটা পোস্ট দেয়। কেউ যেনো বিড়ালটাকে এডপ্ট করতে চাইলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেই পোস্ট দেখে পশুপাখি প্রেমী জেসি ফট করে গিয়ে বলে বসে সে বিড়ালটাকে এডপ্ট করতে চায়।
ব্যস! তারপর থেকে বিড়ালটাকে জেসি নিজের আমানত হিসেবে বুঝে নেয়। ভালোবেসে নাম রাখে টাইগার। নিজের বাচ্চার মতো তার আদর যত্নে মগ্ন হয়। বিড়ালটাও বেশ মিচকে শয়তান। অতিরিক্ত আদুরে মুখ করে তার জেসিটাকে একদম কাবু করে ফেলেছে। এই প্রাণীর মায়াটা জেসি আর ছাড়তেই পারছে না। উল্টো প্রত্যয়কে বলে বেড়াচ্ছে টাইগারের ভাই কিংবা বোন হিসেবে একটা বিড়াল এডপ্ট করার কথা ভাবছে সে। তার জন্য নামও জেসি ভেবে ফেলেছে। কিং কং।
পশুপাখি দেখলেই নাক ছিটকানো প্রত্যয় বাগদত্তার এমন পাগলামিতে চরম হতাশ। মেয়েটা কি বিয়ের পর ঘরটাকে চিড়িয়াখানা বানাতে চাইছে নাকি?
__________
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বারবার দুই দিকে চোখ বোলাচ্ছে নিশা। বুঝতে পারছে না ঠিক কোন দিক দিয়ে ট্রেইনটা আসবে। উৎসুক দৃষ্টি তখন অস্থির। ফোনটা বের করে একবার সাইফের পাঠানো টিকিটের ছবিটা দেখে নেয়। টিকিটে গোটা কালো অক্ষরে লেখা সময় এবং ট্রেনের নামটা মনে মনে আওড়িয়ে ফের অপেক্ষায় মগ্ন হয় সে। মানুষটা জানে না যে নিশা এই ভোর বেলা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এসে তার জন্য অপেক্ষা করছে। নিশা অবশ্য ইচ্ছে করেই জানায় নি। নাহলে সারপ্রাইজটা মাটি হয়ে যেতো।
বৃষ্টির সময় এবং ভোর বেলা হওয়ায় প্ল্যাটফর্মে খুব একটা মানুষের ভীড় নেই এই মুহুর্তে। কিছুটা দূর থেকে ভেসে আসছে একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ। সাইফের ভাষায় ক্যাসেটের ক্যাওক্যাও শব্দ। হঠাৎ বাচ্চার কান্নার স্বরকে ছাপিয়ে দূর হতে ভেসে আসে ট্রেনের আগমনী শব্দ। ঝকঝক শব্দে কেপে উঠে স্টেশন প্রাঙ্গণ। উদগ্রীব নিশা বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
সম্পূর্ণ বেগের ট্রেনটা ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে প্ল্যাটফর্মে এসে সম্পূর্ণ স্থির হয়ে দাঁড়ায়। এক এক করে প্রত্যেক বগির দরজা দিয়ে মানুষের উঠানামা শুরু হয়। নিশা বগি নাম্বার গুনতে গুনতে কাঙ্ক্ষিত বগির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ঠিক সেই মুহুর্তে স্বল্প মানুষের ভীড়ে লম্বা মানুষটার মুখ তার দৃষ্টিগোচর হয়। নিশার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। ভীড়ের মাঝে সাইফ তাকে লক্ষ্য না করে পাশ কেটে চলে যেতেই সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সাইফের এক হাত জড়িয়ে ধরে। আকস্মিক নারী স্পর্শে সাইফ বিরক্ত হয়ে একটা ঝাড়ি মারতে নিলেও পাশ ফিরে নিশার হাস্যজ্বল মুখটা দেখে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় বনে যায়। অস্ফুটে বলে,
“ আপনি? “
নিশা হেসে নিঃসংকোচে সাইফকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ চমকে দিলাম না? “
সাইফ তখনো বিস্মিত। চট্টগ্রামে পা রেখেই এতো সুন্দর একটা সারপ্রাইজ পেয়ে তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সে অবাক স্বরে বলে,
“ এই ভোর বেলায় আপনি স্টেশনে কিভাবে এলেন? স্যার? স্যারের থেকে লুকিয়ে এসেছেন? “
নিশা মুখ তুলে বলে,
“ আপনার স্যারের অনুমতি নিয়েই এসেছি। সেই সঙ্গে উনি এইও বলেছেন দুপুর একটার মধ্যে আপনাকে নিয়ে বাসায় উপস্থিত হতে। লাঞ্চটা আমরা আব্বুর সাথে করবো। “
লেফটেন্যান্ট কর্নেলের থেকে এহেন নিমন্ত্রণে সাইফ আরো অবাক হলো। নিশা তা দেখে হেসে বলে,
“ ছয় মাস পরে দেখা হচ্ছে। আপনি কি হা করেই থাকবেন শুধু? মিস করেন নি বুঝি? “
সাইফ এবার বিস্ময়তাকে পাশ কেটে প্রেয়সীকে দু’হাতের আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে। একগাল হেসে বলে,
“ এই সুন্দর সারপ্রাইজটার জন্য ধন্যবাদ ইয়াসমিন। আপনাকে বুঝাতে পারবো না কতটা খুশি হয়েছি। “
নিশা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
“ ছয় মাসের দূরত্বের উসুল এখন নেক্সট ছয় ঘন্টায় পুশিয়ে দিবেন। ছয় ঘন্টার জন্য একটা রিকশা ভাড়া নেওয়া যাবে না? রিকশা, বৃষ্টি, প্রেম। চমৎকার একটা কম্বো! “
“ রিকশা না-হয় নিলাম। কিন্তু বৃষ্টি যদি থেমে যায়? “
“ উঁহু। আজ সারাদিন বর্ষণ চলবে। দেখে নিয়েন। “
__________
রাত তখন এগারোটা বাজে। শহরজুড়ে অন্ধকার করা বৃষ্টি। ফাঁকা রাস্তায় হাঁটু সমান জল। একটু পর পর বজ্রধ্বনিতে কেপে উঠছে গোটা শহরটা। এমন আষাঢ়ের রাতে জানালা দিয়ে একটু পর পর বাহিরে উঁকি দিচ্ছে বাণী। এই বুঝি দূর্জয় এলো। কিন্তু বিগত এক ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করা সত্ত্বেও দূর্জয়ের আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। আফরাটা বাবার অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ঝড়ের গতি বাড়ছে। বাণী সময় কাটাতে একটা বইয়ে মুখ গুজেছে। বই পড়াটা ইদানীং তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তার মেন্টাল ট্রমাটা কাটানোর জন্য দূর্জয় একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সাহায্য নিয়েছে। বেশ কিছু সেশনের কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে কিছুটা হলেও উপকার পাচ্ছে বাণী। ধীরে ধীরে নিজের দুঃস্বপ্নের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে শিখছে। সাইকিয়াট্রিস্ট এর সাজেশনে বেশ কিছু হিলিং প্লটের বইও দূর্জয় তাকে এনে দিয়েছে। মনকে অতীতের ক্ষত থেকে ভুলিয়ে রাখতে সেগুলো বেশ কার্যকরী।
হঠাৎ গাড়ির হর্নের শব্দ শুনতেই বাণী বই রেখে দ্রুত জানালা খুলে বাইরে উঁকি মারে। পরিচিত গাড়িটা দৃষ্টিগোচর হতেই দ্রুত একটা ছাতা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। পোর্চ পেরিয়ে উঠোনে পা রেখে দ্রুত গাড়ির কাছে এগিয়ে যায় বাণী। দূর্জয় ততক্ষণে গাড়ি ছেড়ে নেমেছে। বৃষ্টির প্রকোপে ইতিমধ্যে ভিজে জবজবে অবস্থা তার। বাণীকে দেখে ভ্রু কুচকে বলে,
“ তুমি বাহিরে এলে কেনো? “
বাণী উত্তর না দিয়ে উন্মুক্ত ছাতাটা দূর্জয়ের মাথার উপর ধরে। বাতাসের প্রকোপে তার শাড়ির আঁচলও এতক্ষণে ভিজে গিয়েছে। এক ছাতার নিচে জুবুথুবু হয়ে দু’জন বাড়িতে প্রবেশ করে। দূর্জয় জুতা খুলতে খুলতে বলে উঠে,
“ রাস্তার বিশ্রী অবস্থা। ঝড়ের কারণে বেশ অনেক জায়গায় গাছের ডাল পালা ভেঙে রাস্তা ব্লক হয়ে ছিল। বেশ কয়েকবার গাড়ি ঘুরিয়ে রাস্তা বদলাতে হয়েছে। “
“ এই ঝড় বাদলের মাঝে তোমাকে ড্রাইভ করতে কে বলে? রাস্তা মোটেও সেফ নয়। অপেক্ষা করতে, ঝড় থামলে না-হয় আসতে! “
দূর্জয় জানে বাণী মুখে এই কথাটা বললেও মনে মনে ঠিকই চাচ্ছিলো যেন, দূর্জয় দ্রুত বাসায় ফিরে। বজ্রপাতকে খুব ভয় পায় কি-না! দূর্জয় প্রশ্ন করে,
“ আফরা কোথায়? “
“ স্কুলের সব হোমওয়ার্ক শেষ করে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছে। “
দূর্জয় চুপচাপ উঠে রুমে চলে যায়। ভেজা শার্টে বসে থাকতে খুব বিরক্তিকর লাগছে তার। বাণী ভেজা ছাতাটার পানি ঝেড়ে একটা কোণায় রেখে দেয়। মেইন দরজাটা আটকে দিয়ে আরো একবার চলে যায় আফরার রুমে। মলিন রঙা গেস্ট রুমটাকে দূর্জয় নতুন মেকওভার দিয়ে আফরার মন মতো সাজিয়েছে। সেই রুমেই বেশিরভাগ সময় ঘুমায় বাচ্চাটা। স্কুলে ভর্তি হওয়ার ফলস্বরূপ নিজেকে বিগ কিড ভেবে সে এখন নিজের রুমে ঘুমাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
আফরা ঠিকঠাক ঘুমাচ্ছে কি-না তা চেক করেই বাণী আবার নিজের রুমে ফিরে যায়। দূর্জয় তখন ওয়াশরুমে গোসল করতে ব্যস্ত। বাণী বইটা নিয়ে আরেক দফা বসে। কিন্তু মন আর বইয়ে টিকে না তার। খট করে ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হতেই বাণী চোখ তুলে তাকায়। ফরমাল গেট আপ বদলে ধূসর রঙের একটা টি শার্ট আর কালো ট্রাউজার গায়ে শোভা পাচ্ছে। গলায় ঝুলে আছে ভেজা টাওয়ালটা। ছাটছাট করে কাটা চুলগুলোয় মুক্তার দানার ন্যায় বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। বাণীর শরীর শিরশির করে উঠে। সে দ্রুত দৃষ্টি নামিয়ে বইয়ের দিকে তাকায় আবার। দূর্জয় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে মুছতে বলে,
“ আঁচল ভিজে নি তোমার? শাড়ি বদলাও নি কেনো? ঠান্ডা লাগছে না? “
বাণী দৃষ্টি নত রেখেই বলে,
“ উহু। “
দূর্জয় আবদারের সুরে বলে,
“ এক কাপ কফি নিয়ে আসবে বাণী? “
বাণী বই রেখে বলে উঠে,
“ দশ মিনিট ওয়েট করো। এখুনি নিয়ে আসছি। “
বাণী বেরিয়ে যেতেই দূর্জয় বসে ফোন চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মনটা বেশ ফুরফুরে তার। বাণীকে চমৎকার একটা সংবাদ শোনানোর অপেক্ষায় আছে সে। বারো মিনিটের মাথায়ই বাণী কফির মগ হাতে রুমে প্রবেশ করে। কফির মগটা দূর্জয়ের দিকে এগিয়ে দিতেই দূর্জয় তা নিতে উদ্যত হয়। কিন্তু মুহুর্তেই সে অবাক গলায় বলে,
“ তোমার কি ঠান্ডা লাগছে? “
বাণী বলে,
“ হু? “
“ তোমার হাত কাঁপছে কেন? “
বাণী লক্ষ্য করে দেখে আসলেই তার হাত কাঁপছে। কি অদ্ভুৎ! এই হাত কাপাকাপির মানে কি? হৃদয়ঘটিত কোনো ব্যাপার নয় তো? বাণী স্পষ্ট টের পাচ্ছে আজকাল দূর্জয় তার আশেপাশে থাকলে সে এলোমেলো হয়ে পড়ে। অসহনীয় ভালো লাগার অনুভূতি জেকে ধরে তাকে। যদিও সম্পূর্ণ ব্যাপারটার কৃতিত্ব দূর্জয়েরই। সে একটু একটু করে ভেঙে চুড়ে যাওয়া বাণীকে যত্নের আদ্রতায় নতুন করে গড়েছে। বিনিময়ে চেয়েছে কেবল স্ত্রীর ভালো থাকাটা।
বাণীকে নিরুত্তর দেখে দূর্জয় উঠে দাঁড়ায়। বাণীর হাত থেকে মগটা নিয়ে রেখে হাতের উল্টো পিঠের সাহায্যে বাণীর কপাল ছুঁয়ে তাপমাত্রা মেপে নেয়। উঁহু। জ্বর নেই তো। তাহলে? বাণী হাসফাস করে দূরে সরে গিয়ে বলে,
“ কিছু হয় নি। ঠিক আছি। তুমি কফি খাও। “
বলেই দিকদিশা না পেয়ে বাণী বারান্দার দরজা খুলে বারান্দায় চলে যায়। দূর্জয় অবাক হয়। এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বারান্দায় গেলো কেন? আর এরকম অদ্ভুৎ আচরণ করছে কেনো? কাউন্সিলিং শুরু করার পর থেকে ধীরে ধীরে তো অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। বাণীর কি কোনো কারণে মন খারাপ?
__________
বারান্দায় এসে বাণী উপলব্ধি করে সে ভুল করে ফেলেছে। দূর্জয়ের থেকে পালানোর জন্য তার আফরার রুমে কিংবা রান্নাঘরে চলে যাওয়া উচিত ছিলো। বারান্দাটা খুব খারাপ অপশন। বিনা কারণে এখন তার রাত বিরাতে ভিজতে হচ্ছে। বাণী মনে মনে ঠিক করে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে সে সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল করে ফেলবে। আর গোসল সেরে বেরিয়ে এক ঘুমে সে সকালের আগে উঠবে না।
বাণীর মনের ভাবনা আর বাস্তবে রূপ নিতে পারে না। তার আগেই দূর্জয় বারান্দায় এসে উপস্থিত হয়। চোখে মুখে খানিকটা উদ্বেগ। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে বাণীর কি হয়েছে। বাণী অস্বস্তি নিয়ে প্রশ্ন করে,
“ তুমি এখানে কি করছো? “
“ প্রশ্নটা আমার তোমাকে করা উচিত। কি করছো তুমি? অদ্ভুৎ আচরণ করছো খুব। কিছু হয়েছে? মন খুব খারাপ? “
“ কিছু হয় নি। আমার মনও খারাপ না। “
“ তাহলে? “
বাণী কিছুক্ষণ হাসফাস করে বাহিরে তাকায়। দূর্জয় আরেকটু এগিয়ে এসে ডাকে,
“ বাণী? “
ঝমঝমিয়ে নামা বৃষ্টিতে ভিজে কপোকাত বাণী ধীর স্বরে বলে,
“ সমস্যাটা হৃদয়ঘটিত। ইদানীং তুমি আশেপাশে থাকলে তা টের পাচ্ছি। নিস্তার পেতে পালাচ্ছি। “
দূর্জয়ের দৃষ্টিতে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। বিস্ময়তায় বাকহারা বনে যায়। বাণী একবার চোখ তুলে দূর্জয়কে দেখে। সে জানে এই মুহুর্তে সে দূর্জয়কে পাশ কেটে চলে গেলেও দূর্জয় কখনো তাকে বাধা দিবে না। না কখনো নিজ থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বটা ঘোচাতে এক কদম এগোবে। এতগুলো মাসে অন্তত এতটুকু বাণী বুঝতে পেরেছে যে কিছু ব্যাপার দূর্জয় সম্পূর্ণ বাণীর উপর ছেড়ে দিয়েছে। তাদের মাঝের দূরত্বটাও সেই ব্যাপার গুলোর মধ্যে অন্যতম।
নিজের জড়তা ভুলে বাণী নিজেই দুই কদম এগিয়ে আসে। আদ্র হাতটা বাড়িয়ে দূর্জয়ের এক হাত ধরে আলতো করে। বছর খানিক আগে বাণীকে দেখে দূর্জয়ের চারিপাশটা যেরকম থমকে যেতো একইভাবে আবার সে থমকে যায়। বাণীর দিকে তাকিয়ে গাঢ় গলায় বলে,
“ এইমাত্র বললে পালাতে চাইছো। “
বাণীর বলতে ইচ্ছে করে, গত ক’দিন ধরে সে পালানোর চেষ্টা করেছে খুব। কিন্তু প্রতিবারই সে উপলব্ধি করেছে দূর্জয় বাদে অন্য কোনো ঠিকানা নেই তার পালানোর জন্য। আর এই ঠিকানাটার মতো নিরাপদ, যত্নে মোড়ানো ভরসাস্থল সে আর কোথাও পাবেও না। উত্তরটা মনে চেপে গিয়ে বাণী আরেক হাত বাড়িয়ে দূর্জয়ের অপর হাতটাও ছুঁলো। অন্যরকম অনুভূতিতে দূর্জয়ের বুকটা ধুকপুক করে উঠে। বাণীর দুই হাতের পিঠে সন্তর্পণে নিজের অধর ছোঁয়ায়। নিশ্চিত হতে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে,
“ অস্বস্তি লাগছে তোমার? “
বাণী মৃদু মাথা নেড়ে না বোধক উত্তর দেয়। স্ত্রীর তরফ থেকে পরোক্ষ স্বীকারোক্তি দূর্জয়ের অনুভূতিকে প্রবল করে তুলে। নিয়ন্ত্রণের বেড়িবাঁধ ভেঙে শীতল হাতের সংস্পর্শে বাণীকে বৃষ্টির প্রকোপ থেকে বাঁচাতে তাকে দেয়ালের দিকটায় সরিয়ে এনে নিজে তার সামনে দূর্বোধ্য প্রাচীরের ন্যায় দাঁড়ায়। এবার আর বৃষ্টি বাণীকে ছুঁতে পারছে না। আলতো স্পর্শে কালো চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দিতেই বাণী চোখ বুজে নেয়। পরপর নিজের অলীকপৃষ্টে শীতল ওষ্ঠদ্বয়ের নিবিড় স্পর্শ টের পায়। স্পর্শকারীর মোহমন্ত্রে বাণী শিউরে ওঠে। বিমুগ্ধ সব স্পর্শে মোহাচ্ছন্ন হয়।
অনুভূতির উত্থাল স্রোতে বিভোর বাণীর কানের কাছে শ্যাম পুরুষের নিষ্প্রভ স্বর আওড়ায়,
“ কত তম ধাপে আছো তুমি? “
ধাপ? বাণী মনে করার চেষ্টা করে। এই মুহুর্তে সাতটা ধাপের কিছুটিই তার মনে পড়ছে না। সে সিক্ত স্বরে বলে,
“ জানি না। “
“ আমি ছয় নম্বর ধাপে আছি। “
ছয় নম্বর ধাপটা যেনো কি ছিলো? মনে করার চেষ্টা বৃথা যায় বাণীর। কণ্ঠনালির কাছটায় অবাধ শীতল নিঃশ্বাস আছড়ে পড়তেই স্পর্শ ইন্দ্রিয় অনুভব করে বিপরীত মানুষটার আসক্তি। মজবুত দৃঢ় হাতের বিচরণ তখন নির্মেদ উদর বাকে। দূর্জয় আরো একবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে বাণীর পানে তাকায়। আবির রাঙা মুখখানিতে আড়ষ্টতা কিংবা ভয়ের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। যা আছে তা কেবল লাজ, কুণ্ঠা। দূর্জয় বুঝতে পারে বাণীকে ঘিরে যেই ভয়টা তার মনে ছিলো তার অস্তিত্ব ম্লান হয়ে গিয়েছে। সেই বাধাটুকু, অদৃশ্য পর্দাটুকু বিলীন হয়েছে অতি গোপনে।
তিরতির করে কেঁপে উঠা সরু অধর যুগল পুরুষ্ট স্পর্শের কবলে সিক্ত হতেই সবশেষ দূরত্বটুকু ঘুচে যায়। শুভ্র নারী আঙুলের প্রতিটি ভাজ দখল করে নেয় শ্যাম পুরুষের আঙুল গুলো। নব আবেগের প্রখরতা স্নিগ্ধ সম্মোহনে উন্মুক্ত হয়। সময় পেরোয়… বৃষ্টির তীব্র পৈশাচিকতা থেকে রেহাই পেতে দু কদম সরে আসে দূর্জয়। বাণী চোখ মেলে তাকায়। দূর্জয়ের গভীর দৃষ্টি দেখে সঙ্গিন পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে ছোট্ট করে ঢোক গিলে।
সেই রজনীতে খোলস ছাড়ানো দূর্জয়ের নমনীয়তায় নিজের অস্তিত্ব ভুলে বসে বাণী। কখনো আবিষ্কার করে নির্মল হৃদয়ের ব্যকুলতা। কখনো বা ভীত হয় শ্যাম পৃষ্ঠে কালসিটে আঘাতের দাগগুলোর একমাত্র দর্শনকারী নারী হয়ে। বুঝতে পারে দাগগুলো দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ বহন করছে। ঠিক যেমন প্রেমময় বর্ষণের মুহুর্তে ঘুমকাতুরে পুরুষালি স্বরে ছোট্ট করে ‘জানা’ ডাকটা বাণীর প্রতি আবেশিত অনুভূতির প্রমাণ বহন করছে।
চলবে…
এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৭৬.
ভিনদেশের মাটিতে এক রহস্যজনক দৃশ্যপট। গাড়ির অন্তরালে ফ্রন্ট সিটে বসা নারীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সদূর এপার্টমেন্টের তিন তলার ব্যালকনিতে নিবদ্ধ। কিছুক্ষণ পর পর হাতের ওয়ান টাইম কফি মগটাতে চুমুক বসাচ্ছে সে। ঘুমের সঙ্গে তীব্র অবরোধ জারি করে চাকরির দায়িত্বটুকু পালনের তীব্র প্রচেষ্টা। হুট করে শূন্য ব্যালকনিতে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষের আগমন হতেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পন্ন নারী ব্যস্ত হয়ে উঠে। হাতের ওয়ান টাইম কফির মগটা পাশের ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা জুনিয়রের হাতে ধরিয়ে দিয়েই, নিজের ক্যামেরার সাহায্যে সচেতনতার সহিত আপন কাজে মগ্ন হয়ে পড়ে। দু চারটে ছবি ক্যামেরাবন্দী করতেই সে ছবিগুলো আবার ভালো করে চেক করে নেয়। ছবিতে মানুষটার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কি-না নিশ্চিত হতেই সে এবার ক্যামেরাটা রেখে দেয়। কফির মগটা নিজের হাতে বুঝে নিয়ে ঘুমে ঢুলতে থাকা জুনিয়রকে বলে,
“ কাজ শেষ। লেট’স গো। “
উক্ত জুনিয়র ছেলেটার মস্তিষ্ক দ্রুত সজাগ হয়ে যায়। সে সু কৌশলে গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে অন্য রাস্তায় প্রবেশ করতেই অপরাধীর স্বরে বলে,
“ সরি ম্যাম। সারা রাত ধরে লোকটার অপেক্ষায় জেগে ছিলাম তো! কখন চোখ লেগে গিয়েছিলো টের পাই নি। “
কফির মগে শেষ চুমুকটা দিয়ে সেই নারী জবাব দেয়,
“ বি সিরিয়াস এবাউট ইউর জব। ইট ইজ ইউর লাস্ট চান্স। নেক্সট টাইম আর সরি বলার সুযোগ পাবে না তুমি। “
“ ডোন্ট ওয়ারি ম্যাম। আমি আর কখনো আপনাকে অভিযোগের সুযোগ দিবো না। “
কথাটা বলেই সেই জুনিয়র ছেলেটা হাসি হাসি মুখ করে তাকায় পাশে বসা নারীর দিকে। ছেলেটার নাম ইমাম। শার্প ফেস স্ট্রাকচারের নারীটা তাদের ডিপার্টমেন্টে স্ট্রিক্ট আচরণের জন্য খুব আলোচিত। কিন্তু গত দু-মাস ধরে এই নারীর সঙ্গে এক কেসের পিছনে ছোটাছুটি করতে গিয়ে ইমাম উপলব্ধি করেছে ম্যাম সারাটাক্ষন কিছু একটা নিয়ে বিষন্ন থাকে। এই ব্যাপারে ইমাম নিজের প্রেমিকাকেও জানিয়েছে। কিন্তু তার প্রেমিকা উল্টো তাকেই সন্দেহ করে কয়েক দফা ঝগড়া সেরেছে। অতি ভদ্র ছেলেটা কাউকে বুঝাতে পারে না যে সে কেবল ম্যামের বিষন্নতার কারণ জানতেই আগ্রহী, আর কিছুই নয়।
হঠাৎ সেই নারী চিন্তিত সুরে চেচিয়ে উঠে,
“ আমার প্যান্ডেন্ট! “
ইমাম দ্রুত গাড়ির ব্রেক কষে। প্রশ্ন করে,
“ কি হয়েছে দৃশান ম্যাম? “
দৃশান সিটের আশেপাশে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে চিন্তিত গলায় জবাব দেয়,
“ আমার প্যান্ডেন্ট পাচ্ছি না। কোথায় পড়ে গেলো বুঝতে পারছি না। গলাতেই তো ছিলো। “
ইমাম অবাক হয় না তেমন একটা। মেয়ে মানুষ নিজেদের শখের গয়না নিয়ে একটু সেন্সিটিভই হয়। কিছুক্ষণ খোঁজাখুজি করতেই গাড়ির ভেতরে নিজের কাঙ্ক্ষিত প্যান্ডেন্টটা খুঁজে পায় দৃশান। সঙ্গে সঙ্গে তা হাতে তুলে নিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ইমাম অবাক দৃষ্টিতে দেখে সেই সামান্য প্যান্ডেন্টটা। লকেটের চেইনের সঙ্গে ঝুলছে একটা রেসিন দিয়ে তৈরিকৃত একটা বৃত্তাকার গোলক। স্বচ্ছ রেসিনের ভেতর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কিছু রঙ বেরঙের ছোট্ট ফুল। ইমামের এই মুহুর্তে হাসি পেলো। সে কিছু না ভেবেই বলে উঠে,
“ আপনার চিন্তা দেখে আমি ভেবেছিলাম কোনো হীরের হার হবে হয়তো! “
কথাটুকু বলেই ইমাম উপলব্ধি করে সে ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। সে ভীত দৃষ্টিতে একবার দৃশানের দিকে তাকায়। দৃশানের মনযোগ তখন সেই প্যান্ডেন্টের দিকে। রেসিনের ভেতর সংরক্ষিত ফুল গুলো কারো একজনের স্মৃতি বহন করে। সম্পর্কহীন মানুষের স্মৃতিও কি কখনো গুরুত্বপূর্ণ হয়? কি অদ্ভুত!
__________
সকাল সকাল নাস্তার জন্য টেবিলে খাবার গুছিয়ে নিয়েছে বাণী। আজকে নাস্তার আয়োজনে রয়েছে আফরার প্রিয় খাবার। চিকেন, ক্যাপসিকাম, ডিম এবং আরো হরেক রকমের সবজি দিয়ে ঝাল ঝাল করে পাস্তা রেধেছে বাণী। ধীরে ধীরে তার আনাড়ি হাতের রান্নায় পরিপক্বতার স্বাদের দেখা মিলছে।
নাস্তার জন্য মানুষ দুটোকে আর কষ্ট করে ডাকতে হয় না বাণীর। ঘরময় রান্নার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়তেই ইউনিফর্ম পরিহিত দূর্জয় এবং আফরাকে নিজ থেকেই রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। দু’জনকে একসঙ্গে দেখে বাণী সতেজ হাসে। সেই হাসিতে কোনো মলিনতা লুকিয়ে নেই। যেনো খুব সুখী গৃহিণী সে।
টেবিলে এসে বসতেই আফরা মাথা এলিয়ে দিয়ে আবার ঘুমের প্রস্তুতি নেয়। দূর্জয় সেই সুযোগ না দিয়ে তাকে টেনে টেবিলের উপর বসিয়ে দিয়ে বলে,
“ নট নাও প্রিন্সেস। বাসায় এসে ইচ্ছেমতো ঘুমাবেন। আপনার স্কুলের টাইম হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি নাস্তা করতে হবে। ওয়েক আপ। “
আফরা বিরক্ত হয়। সকাল সকাল স্কুলে যাওয়াটা খুব বড়ো কোনো পানিশমেন্ট মনে হয় তার কাছে। সে ঘুম ঘুম স্বরে বলে,
“ আই হেইট স্কুল বাবা। আমি স্কুল যাবো না। আমি ঘুমাবো। “
বাণী দ্রুত একটা বাটিতে পাস্তা বেড়ে আফরার মুখের সামনে ধরে বলে,
“ প্রত্যেক দিন এই এক মেলোড্রামা করবে না তুমি। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। তোমার কারণে বাবারও লেট হবে। “
মায়ের শাসন মিশ্রিত সুরের পিঠে আফরা আর কিছু বলতে পারে না। চুপচাপ খাবার মুখে নিয়ে ঠোঁট উল্টে দূর্জয়ের দিকে তাকায়। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয় না। দূর্জয় কখনো প্রয়োজনীয় শাসনের বেলায় বাণীকে বাধা দেয় না। আদরটা যেমন প্রয়োজনীয় তেমনই সন্তানের ভালোর জন্য শাসনটাও জরুরী বলে সে মনে করে। আফরাকে খাওয়াতে খাওয়াতে বাণী দূর্জয়কে বলে উঠে,
“ আরেকটু দিবো তোমাকে? “
“ না। আমার লাগলে নিয়ে নিবো। মেয়েকে খাওয়াও তাড়াতাড়ি। সাতটা বেজে যাচ্ছে। “
খাওয়া শেষ হতেই আফরা টেবিল ছেড়ে নেমে নিজের রুমে দৌড়ে চলে যায় নিজের ব্যাগ ঠিকঠাক গুছানো আছে কি-না দেখতে। বাণীও মেয়ের পিছু পিছু যেতে নিলে দূর্জয় তার হাত চেপে ধরে। বাণী অবাক হয়। সাধারণত দূর্জয় কখনো নিজ থেকে এমনটা করে নি এর পূর্বে। তাহলে আজ? সম্পর্কের নব পূর্ণতার ফলেই কি এই নিঃসংকোচ ছোঁয়া?
দূর্জয় উঠে দাঁড়ায়। বাণীর কপালের কাছটায় এসে থাকা কিছু খুচরো চুল কানের পিছনে গুজে দিয়ে স্নেহময় স্বরে বলে,
“ আষাঢ়ের বর্ষণ। কষ্ট করে কি আজকে খিচুড়ির আয়োজন করা যায়? “
বাণী দ্বিতীয় দফা অবাক হয়। বিয়ের এতো মাসে দূর্জয় কখনো নিজ থেকে বাণীকে কোনো রান্নার আয়োজন করতে বলে নি। বাণী যা-ই রাধতো চুপচাপ তা খেয়েই তৃপ্ত থাকতো। তবে আজ নিজ থেকে দূর্জয়ের করা এই আবদারে বাণী বিস্ময়ের থেকে বেশি খুশি হয়েছে। সে বলে উঠে,
“ হ্যাঁ। তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবে? “
“ কখন ফিরবো নিশ্চিত নই কিন্তু তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করবো। “
কথাটুকু বলেই দূর্জয় আবার শুধায়,
“ তোমাকে একটা চমৎকার খবর জানানোর ছিলো। “
বাণী আগ্রহী স্বরে জানতে চায়,
“ কি? “
“ খুব সম্ভবত আগামীকালই হিরণের চূড়ান্ত শুনানিটা হবে। “
হিরণের নামটা শুনতেই বাণীর হাস্যজ্বল মুখটা থমথমে রূপ ধারণ করে। দূর্জয় তা লক্ষ্য করে একহাতে বাণীর গাল ছুঁয়ে বলে,
“ খুশি হও বাণী। ইনশাআল্লাহ যথাযথ সিদ্ধান্তই নেওয়া হবে ওর ব্যাপারে। ইহকাল আর পরকাল দুই জগতেই ও নিজের প্রাপ্য শাস্তিটা পাবে। “
বাণীর মনটা হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে যায়। সে বিষন্ন মনে বলে,
“ ওই শাস্তি কি ভুক্তভোগীদের ক্ষতিটা কখনো পূরণ করতে পারবে? “
দূর্জয় শান্ত গলায় জবাব দেয়,
“ অপূরণীয় ক্ষতি কখনো পূরণ হয় না বাণী। কিন্তু অন্তত ন্যায় বিচারটা তো হবে। এই যুগে এসে ক’টা বিচারই বা সম্পূর্ণ সুষ্ঠুভাবে হয় বলো? “
বাণী আর কিছু বলার পূর্বেই আফরা নিজের ব্যাগ কাধে বেরিয়ে আসে। দূর্জয় এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে নেয়। আফরা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে দূর্জয় বাণীর কানের কাছে ধীর স্বরে বলে উঠে,
“ আমি আছি, আফরা আছে, তুমি আছো। ভাবনাগুলো সম্পূর্ণ আমাদের কেন্দ্রিক করে ফেলো। তাহলে দেখবে মস্তিষ্কে অযাচিত বাহিরের মানুষ গুলো আর জায়গা পাচ্ছে না। “
__________
চট্টগ্রাম শহর জুড়ে তখন ঝুম বৃষ্টি। ঘন্টা তিনেক পরে নিশার ঢাকার উদ্দেশ্যে ট্রেন ধরতে হবে। আগামী পরশু তার এডমিশন টেস্ট আছে। একই প্রাইভেট হতে জিপিএ ফাইভ পেয়ে উত্তীর্ণ চার বন্ধু মিলে নির্দিষ্ট কিছু পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিলেক্ট করেছে এডমিশন টেস্টের জন্য। অনেকটা একজোট হয়েই তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যদিও ঢাকা যাওয়ার কথা শুনে জুলফিকার মুজতবা মেয়ের জন্য ফ্লাইটের টিকেট বুক করতে চেয়েছিলো। কিন্তু নিশা বন্ধুদের আবদার আব্বুকে জানিয়ে বলে তারা ট্রেনে করে যেতে চাচ্ছে। সবদিক বিবেচনা করে জুলফিকার মুজতবা রাজি হলেও তিনি মেয়েকে কোনো বন্ধুর আত্মীয়ের বাসায় থাকতে দেওয়ার অনুমতি দেন নি। ঢাকায় জুলফিকার মুজতবার নিজস্ব কোনো আত্মীয়ও না থাকার কারণে তিনি নিশার ঢাকায় যাওয়ার ব্যাপারটা সুহালা বেগমকে জানান। সুহালা বেগম সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেন তিনি নিশাকে স্টেশন থেকে পিক করে নিবেন। ঢাকায় তিনটা দিন নিশা শান্তিকুঞ্জেই থাকবে। এই ব্যাপারে নাঈমার মতামত জানতে চাইলে সে-ও আর আপত্তি করে না। নিশার থাকার জন্য সুহালা বেগমের থেকে ভরসাযোগ্য মানুষ আর হয় না।
রিকশায় বসে বারবার ঘড়ির কাটা দেখতে ব্যস্ত নিশার উদ্দেশ্যে সাইফ বলে উঠে,
“ আপনি টেনশন করছেন কেনো বলুন তো? আমি তো বলেছি সময়মতো আপনাকে ট্রেনে তুলে দিবো। স্যারকেও কথা দিয়ে অনুমতি নিয়ে নিয়েছি। “
নিশা চিন্তিত গলায় বলে,
“ কি বৃষ্টি দেখেছেন? যদি রাস্তায় কোনো বাধা পড়ে? যদি যেতে না পারি? “
“ অযথা চিন্তা করছেন ইয়াসমিন। হাতে এখনো অনেক সময় আছে। চুপচাপ বসে থাকুন। “
ঘড়ি ধরে ঠিক সাত মিনিটের মাথায় একটা পাকা রাস্তা ঘেঁষে দাঁড়ানো দালানের সামনে এসে থামে রিকশাটা। সাইফ ভাড়া মিটিয়ে রিকশা ছেড়ে নেমে দ্রুত ছাতা মেলে ধরে। পরপর নিশাকেও হাত ধরিয়ে নামায়। নিশা আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
“ এখানে কেনো এসেছি আমরা? আপনি না বলেছিলেন একটা জরুরী কাজ আছে? এখানে কি কাজ? “
“ ভেতরে চলুন। “
নিশা আর কোনো প্রশ্ন করার অবকাশ পায় না। চুপচাপ সাইফের সাথে পা মিলিয়ে দালানের ভেতর পা রাখে। সম্পূর্ণ নতুন দালানটির বেশ কিছু ইউনিটেই ইতিমধ্যে মানুষ উঠে গিয়েছে। যার ফলে লিফট সার্ভিসটাও এখন সম্পূর্ণ সচল। সেই লিফটে করেই ষষ্ঠ ফ্লোরে পৌঁছে যায় সাইফ এবং নিশা। লিফট থেকে বের হতেই তারা মুখোমুখি হয় একজন লোকের। লোকটাকে দেখতেই সাইফ হেসে সালাম দিয়ে হাত মেলায়। নিশাও ভদ্রতাসূচক ভঙ্গিতে সালাম দিতেই লোকটা সাইফকে হেসে প্রশ্ন করে,
“ আপনার উড বি মিসেস? “
সাইফ লজ্জা পেলো নাকি বুঝা গেলো না। কেবল কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
“ জি। “
লোকটা সাইফের হাতে একটা চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বলে,
“ আপনারা ঘুরে দেখুন। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি। “
লোকটা চলে যেতেই নিশা আবার প্রশ্নের ঝুলি খুলে বসে। সেসব প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হিসেবে সাইফ বলে,
“ আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছি আপনাকে। আপনার চট্টগ্রামে ব্যাক করার ওয়েট করাটা কষ্টসাধ্য হয়ে যেতো। তা-ই আজই ভাবলাম আপনাকে সারপ্রাইজটা দিয়ে দেই। “
নিশা আর একটাও শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। সম্পূর্ণভাবে বাকহারা বনে যায়। সাইফ নিজেই চাবির সাহায্যে বাসার দরজাটা খুলে নিশার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ আমাদের ছোট্ট বাসায় আপনাকে স্বাগতম ইয়াসমিন। “
নিশা বিস্মিত ভঙ্গিতে একবার সাইফকে দেখে ফের বাড়ির ভেতরটার দিকে তাকায়। হুট করে তার সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। সাইফ তখন নিজের মতো বলে যাচ্ছিলো,
“ আমি জানি বাসাটা বেশি বড়ো না কিন্তু দুইজন মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে হয়তো। আমার বাজেটের সঙ্গে মিলিয়ে এর থেকে বেটার অপশন পাই নি। যদিও মাত্র হাফ পেমেন্ট ডান করেছি। বাকিটাও নেক্সট ছয় মাসে ক্লিয়ার করে দিবো। বিয়ের পর আপাতত আমরা এই বাসাটাতেই থাকবো। পরে অবশ্য আরো বড় বাসা নিবো আল্লাহ চাইলে। আপনি… “
সাইফের বাকি কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। তার আগেই নিশা আবেগে ভেসে ছলছল চোখ জোড়া হতে বর্ষণ নামায়। সাইফ তা দেখে হকচকিয়ে যায়।
“ ইয়াসমিন? বাসা পছন্দ হয় নি? আমি কিছু করেছি? “
নিশা নাক টেনে জবাব দেয়,
“ এটা আমাদের বাসা। কথাটা ভাবলেই আমার কান্না পাচ্ছে খুব। খুশির কান্না। “
সাইফ হেসে নিশার হাতটা ধরে বলে,
“ ভিতরে চলুন। “
সম্পূর্ণ খালি বাসাটায় এখনো বেশ কাজ বাকি আছে। তিনটা বেডরুম, একটা লিভিং এবং ডাইনিং রুম, সেই সঙ্গে রয়েছে একটা কিচেন। দু’জন মানুষের টোনাটুনির সংসার পাতার জন্য বেশ শোচনীয় বাসাটা। আগ্রহী নিশা ঘুরে ঘুরে সম্পূর্ণ বাসাটা দেখতে থাকলো। মনে মনে ঠিক করে ফেললো বাসাটা কিভাবে কি সাজাবে। সাইফ মুগ্ধ নয়নে নিশার আগ্রহ দেখতে ব্যস্ত তখন। হুট করে তার মনে প্রশ্ন জাগে, অপূর্ণতা গুলো কি পূর্ণতা হয়ে এরকম হুট করে এসেই ধরা দেয়?
__________
নিশার বান্ধবীরা মিলে নিজেদের জন্য একটা প্রাইভেট কেবিন বুক করে রেখেছে ট্রেনে। উদ্দেশ্য একটাই, যেনো চার বান্ধবী মিলে হেসে খেলে ঢাকা পৌঁছে যেতে পারে। অনেকটা পিকনিকের মতোই আয়োজন। স্টেশন থেকে কিনে নেওয়া বিভিন্ন হাবিজাবি খাবারের পাশাপাশি সকলে বাসা থেকেও টুকটাক রান্নাবান্না করে সঙ্গে নিয়ে নিয়েছে। ট্রেন সবে এসে থেমেছে স্টেশন প্রাঙ্গণে। তিনটা মুখ অস্থির ভঙ্গিতে আশেপাশে তাকাচ্ছে। নিশা এখনো পৌঁছাচ্ছে না কেন তা নিয়ে সকলের মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠেছে।
তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এক প্রকার দৌড়ে এসে হাজির হয় নিশা। তার পিছনে ব্যাগ হাতে আরেক যুবককেও দৌড়ে আসতে দেখা যায়। তিন বান্ধবীর তখন আগ্রহের বিষয় বস্তু হয়ে দাঁড়ায় নিশার সঙ্গে আগত যুবকটা। কিন্তু তাদের কথা দীর্ঘ হওয়ার সুযোগ পেলো না। তার পূর্বেই সাইফ তাদের তাড়া দিয়ে নির্দিষ্ট বগিতে তুলে দেয়। জানালা দিয়ে নিশাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ সাবধানে যাবেন। পৌঁছে কল দিবেন। “
নিশা জবাব দিতে পারে না কোনো। চোখ মুখ কেমন থমথমে তার তখনো। অযথাই খুব কান্না পাচ্ছে তার। পাশ থেকে বন্ধুরা মজা লুটতে ব্যস্ত তখন। নিশার সেসব কিছু বিরক্তিকর লাগছে। সাইফ জানে এখানে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করলে এই মেয়ে কেদে ভাসাতে পারে। তাই সেই রিস্ক না নিয়ে দ্রুত বিদায় নিয়ে পা বাড়ায়। সাইফ চোখের আড়াল হতেই আচানক নিশার কি যেনো হয়। নিজের স্বভাব বহির্ভূত একটা কাজ করে বসে সে। ব্যস্ত পায়ে কেবিনের দরজা ঠেলে বেরিয়ে যায়। নিশার বন্ধুরা বিস্মিত গলায় তার নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠে। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয় না। নিশা ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে নেমে অস্থির নয়নে চারপাশে কাউকে খুঁজতে ব্যস্ত। কিছুটা দূরে নির্দিষ্ট মানুষকে পিছন থেকে দেখতেই সে সেদিকে দৌড়ে যায়।
নিশার বান্ধবীরা ততক্ষণে বগির দরজায় দাঁড়িয়ে নিশার নাম ধরে উচ্চস্বরে ডাকছে। স্টেশনের একঝাঁক মানুষের মনযোগ তখন তাদের পানে স্থির। বেশিদূর না যাওয়ায় সাইফও সেই ডাক শুনে পিছনে ফিরে তাকায়। আর মুহুর্তেই তার বুকে এসে এক পশলা বৃষ্টির ন্যায় আছড়ে পড়ে নিশা। সাইফ বিস্মিত হয়। এক মুহুর্তের জন্য চারিপাশে সবাইকে কোণা চোখে পরখ করে নেয়। কেমন হ্যাবলার মতো মানুষ জন তাকিয়ে আছে। সাইফ সেসবের তোয়াক্কা না করে নিশার পিঠে হাত রেখে বলে,
“ কি হয়েছে আপনার? “
“ আমি কি কখনো আপনাকে বলেছি যে আমি আপনাকে কতো ভালোবাসি? “
সাইফ আরেক দফা অবাক হয়। ইয়াসমিন আবেগী গোছের মানুষ তা সে বেশ ভালো করেই জানে। তবে এরকম প্রশ্ন আগে কখনো করে নি সে। গত ছয় মাসের দূরত্বেও না। আজকে বাসাটা দেখতে যাওয়ার পর থেকেই কেমন বেশি আবেগী আচরণ করছে। ব্যাপারটাকে সাইফ স্বাভাবিক ভাবে নিয়েই বলে,
“ ভালোবাসেন বলেছেন, কিন্তু কতটা তা কখনো বলেন নি। “
নিশা আর কিছু বলতে পারে না। ওদিকে ট্রেনের হুইসেল শব্দ করে ডেকে উঠে। সাইফকে এবার চিন্তিত দেখায়। সে নিশাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,
“ ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। “
নিশা উল্টো আরেকটু দৃঢ়ভাবে সাইফের শার্টের পিঠের কাছটা আঁকড়ে ধরে বলে,
“ আর কিছু সেকেন্ড থাকি? “
নরম গলার আবদার উপেক্ষা করার সাধ্য হলো না সাইফের। কিছু সেকেন্ডই তো! কি এমন ক্ষতি হবে? কথাটুকু ভেবে সাইফ নিজেই এবার নিশাকে আগলে ধরলো। প্ল্যাটফর্মের উৎসুক জনতা তখন আগ্রহী দৃষ্টিতে দেখছে তাদের। বুঝতে পারছে না এই তৃষ্ণার্ত আলিঙ্গন কিসের প্রতীক? মহা মিলনের নাকি মহা বিচ্ছেদের?
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]