এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৭৯.
তখন মাঝরাত। আষাঢ়ে আকাশটা বড্ড অভিমান করেছে আজ। বছর ঘুরে আরো একটা আষাঢ়কে সদ্য বরণ করে নিয়েছে প্রকৃতি। সেই আষাঢ়ী রাতে কারো অপেক্ষায় বইয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে এক নারী। লম্বা চুল গুলো এলোমেলো ভঙ্গিতে পিঠময় ছড়িয়ে আছে। বারান্দার খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করা ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাস রুমটাকে শীতল করে তুলেছে।
ঘরের বাহির হতে আগত গাড়ির হর্ণের শব্দে নারী মন নড়েচড়ে উঠে। চাতক কিশোরীর ন্যায় বই ছেড়ে জানালার ধারে গিয়ে বাহিরে উঁকি মারে। কাঙ্ক্ষিত মানুষের মুখদর্শন হতেই একপ্রকার দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ায়। ক্লান্ত পুরুষের সকল ক্লান্তি প্রিয়তমার অপেক্ষারত মুখশ্রী দেখে ফুরোয়। একগাল হেসে ঘরে প্রবেশ করে বলে,
“ শুধরাবে না তুমি। রাত জেগে অপেক্ষা না করলে কি হয় না? “
“ অপেক্ষা করছিলাম কে বললো? আমি তো বই পড়ছিলাম। ইন্টার্ভাল পার্টে ছিলাম। পুরোটা শেষ না করলে ঘুম আসতো না। “
বাণীর বলা নিঃসংকোচ মিথ্যার পিঠে দূর্জয় কেবল সামান্য হাসে। বাণী সেদিকে খুব একটা তোয়াক্কা না করে চুল গুলো হাত খোপা করতে করতে বলে,
“ খাবার গরম করছি আমি। তাড়াতাড়ি গোসল করে এসো। “
কথাটুকু শেষ করেই বাণী রান্নাঘরে চলে যায়। সারাদিন বাইরে থেকে ঘরে ফেরার পর বাহিরের কাপড়ে বেশিক্ষণ বসে থাকার বদভ্যাস দূর্জয়ের কোনো কালেই ছিলো না। সে উঠে সবার আগে গোসল করতে চলে যায়। দশ মিনিটের একটা কুইক শাওয়ার নিয়ে বের হয়েই দূর্জয় কিছুটা সতেজ অনুভব করে।
নিজের রুম থেকে বেরিয়ে নয় কদম সোজা হেঁটে মেয়ের রুমে প্রবেশ করে সে। আফরা তখন গভীর ঘুমে বিভোর। দূর্জয় এগিয়ে গিয়ে মেয়ের ঘুমন্ত মুখটা দেখে কিছুক্ষণ পাশে বসে। আলতো ভঙ্গিতে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চিন্তা হয় তার। সবে মাত্র সাত বছর হবে মেয়েটার। অথচ কেমন শান্ত প্রকৃতির হয়ে গিয়েছে। চঞ্চল শিশু সত্তাটা কোথায় যেনো হারিয়ে গিয়েছে। খুব বুঝদার বাচ্চাদের মতো আচরণ করে। গম্ভীরতা যেনো ঘিরে ধরেছে বাচ্চাটাকে। নিজের বাবার নিয়মানুবর্তী জীবনের সঙ্গে নিজেকে কি সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে! সময় ধরে প্রতিটা কাজ করে।
বিষয়টা নিয়ে দূর্জয় ও বাণী দু’জনেই চিন্তিত ছিলো খুব। আফরার স্কুলে গিয়ে এই ব্যাপারে একপ্রকার তদন্তও চালিয়েছে তারা। কিন্তু সেখানেও সবকিছু স্বাভাবিক। সবশেষে বাধ্য হয়ে একজন চাইল্ড স্পেশালিষ্টের শরণাপন্ন হয়েছিলো তারা। সব শুনে ডাক্তার বলেছে, এইটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। ধীরে ধীরে বড়ো হওয়ার সাথে সাথে একটা শিশুর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশটাও হয়। এইটা তেমন কোনো চিন্তার বিষয় নয়।
দূর্জয় জানে এইটা তেমন কোনো চিন্তার বিষয় নয়। সুহালা বেগমের ভাষ্যমতেও অনেক ক্ষেত্রে দূরন্ত, চঞ্চল বাচ্চারা বড়ো হতে হতে অনেকটাই শান্ত প্রকৃতির হয়ে যায়। কিন্তু দূর্জয়ের এসব ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে দুইদিন আগেই তো মেয়েটা ছোট ছিলো, অথচ এখন কত দ্রুত যেনো বড় হয়ে যাচ্ছে! ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে দূর্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরো একবার মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে তার গায়ে ভালো করে কাথাটা টেনে দেয়। অত:পর নিঃশব্দে রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসে।
বাণী তখন টেবিলে খাবার গোছাচ্ছিলো। দূর্জয় এসে বসে বলে,
“ তুমি খেয়েছো? “
“ হ্যাঁ। “
কথাটা বলতে বলতে বাণী পাশের চেয়ারে বসে। দূর্জয় চুপচাপ নিজে খাওয়ার ফাঁকে লোকমা তুলে বাণীর মুখের সামনেও ধরে। বাণী তা ফেরায় না, বরং চুপচাপ খাবার মুখে নিয়ে নেয়। সংসার জীবনের প্রায় দেড় বছরের বেশি সময়টায় এটা এখন এক প্রকার তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।
খাওয়া দাওয়া শেষে রুমে এসে বাণী আবারও বই নিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে পড়ে। এবার সে সত্যি সত্যিই বইয়ে মনযোগ দিয়েছিলো। কিন্তু তার মনযোগে জল ঢেলে দূর্জয় ডিরেক্ট সুইচ চেপে আলো নিভিয়ে দেয়। বাণী অবাক গলায় বলে,
“ তোমার কি খুব ঘুম পেয়েছে? এক কাজ করো, তুমি তাহলে ঘুমাও। আমি পাশের রুমে বসে বইটা শেষ করে আসি। আর দুটো অধ্যায় শুধু বাকি। বেশিক্ষণ লাগবে না। “
দূর্জয় কোনো উত্তর না দিয়ে বিছানায় এসে সোজা বাণীর কোলে মাথা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে। বাণী অবাক হয় না। বরং নীরবে হাত থেকে বইটা রেখে নিজের কোমল হাতে দূর্জয়ের মাথার চুলগুলো টেনে দিতে থাকে। এই বদাভ্যাসটা ইদানীং হয়েছে দূর্জয়ের। মাথা ব্যথা করলেই এভাবে মাথা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে। বাণী তখন ধীরে ধীরে চুলে হাত বুলিয়ে তা টেনে দিলেই ঘুমে তলিয়ে যায়।
কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম হলো। দূর্জয় ঘুমালো না। বরং চোখ বুজে রেখেই বললো,
“ আফরা ওদিন কি বলেছিলো মনে আছে? “
কৃষ্ণপক্ষে ডুবে থাকা বাণী ভাবুক হয়। ওদিন বলতে কোন দিনের কথা বোঝাচ্ছে দূর্জয় তা সে ঠিক বুঝতে পারছে না। এই বুঝতে না পারার ব্যর্থতায় সে প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন জুড়ে দিয়ে ছোট্ট করে বলে,
“ কবে? “
“ আমাদের তিনজনের মুভি ডে আউটে। ওই ফ্রোজেন মুভিটা দেখার পরে। “
বাণী আবার মনে করার চেষ্টা করে। সচরাচর ডিজনি মুভি দেখে না আফরা। কিন্তু এই মুভিটা তার খুব পছন্দ হয়েছিলো। এলসাকে ডিজনি সিনেমার আইকনিক একটা চরিত্র হিসেবে ভূষিত করেছিলো। আর বিশেষ কিছু কি বলেছিলো? মনে করতে না পেরে বাণী আরেক দফা প্রশ্ন করে,
“ কি বলেছিলো? “
“ ভাই বোন থাকাটা একটা ব্লেসিং। “
বাণীর মনটা হঠাৎ বিষন্ন হয়ে যায়। দূর্জয় ধীর গলায় বলে,
“ আমরা দু’জনেই নিজেদের ভাই হারিয়েছি বাণী। সহদোরের অভাবটা আমরা খুব ভালো বুঝি। আমাদের মেয়ের সেই অভাবটা ঘুচিয়ে দিলে কেমন হয়? “
দূর্জয়ের কথার সূক্ষ্ণ ইঙ্গিত বুঝতে পেরেই বাণীর মুখটা লজ্জায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। অন্ধকার কক্ষে সেই লজ্জা মাখা মুখশ্রীটা দেখতে না পেলেও দূর্জয় সেই লজ্জার লেশ অনুভব করে। সে ধীরে ধীরে পাশ ফিরে বাণীকে জড়িয়ে ধরে। তার পেটে মুখ গুজে। শাড়ির আঁচল ভেদ করে উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের সংস্পর্শে আসতেই বাণী কিছুটা কেপে উঠে। দূর্জয় তখন নরম গলায় বলছে,
“ তোমার মত জানতে চাইছি কেবল। তুমি না চাইলে আই এম টোটালি ওকে উইথ দ্যাট। আমি আফরার বাবা। ও যথেষ্ট আমার জন্য। শুধুমাত্র ওর বাবা হয়ে আমি পুরো জীবন নির্দ্বিধায় কাটিয়ে দিতে পারবো। কিন্তু ওর মা বাবা হলেও অনেকগুলো জিনিস আমরা মিস করে গিয়েছি। আমি ওর জীবনের পাঁচটা বছর মিস করে গিয়েছি। তুমি একটা নরমাল প্রেগন্যান্সির জার্নি মিস করে গিয়েছো। একটা বাচ্চাকে কেন্দ্র করে মা বাবার এই অনুভূতি গুলো কতটা দামী হয় তা আমি আন্দাজ করতে পারছি। আমি জানি হারিয়ে যাওয়া সময় ফিরিয়ে আনার সুযোগ নেই।
কিন্তু আরেকটা ছোট্ট প্রাণের মাধ্যমে উই ক্যান এক্সপেরিয়েন্স দ্যা জার্নি অফ প্যারেন্টহুড এগেইন। “
বাণী এতক্ষণ চুপচাপ দূর্জয়ের কথা শুনছিলো। দূর্জয়ের কথার অর্থ সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। বাণী জানে সে যদি এই মুহুর্তে বলে যে সে আর বাচ্চা চায় না, তবে দূর্জয় জীবনেও এটা নিয়ে টু শব্দ করবে না। কিন্তু বাণীর মনেও একটা শূন্যতা আছে। প্রথম প্রেগন্যান্সি প্রত্যেকটা নারীর কাছেই একটা ম্যাজিকাল জার্নি হয়। কিন্তু বাণীর প্রথম প্রেগন্যান্সি জার্নিটা ছিলো ভয়াবহ। তার মানসিক পরিস্থিতি তখন এতটাই বাজে ছিলো যে সে প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ মন ভরে উপভোগের সুযোগও পায় নি।
হুট করে বাণীর চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠে। আফরার সঙ্গে ছোট্ট একটা প্রাণ এই ঘরে তাদের সামনে বেড়ে উঠবে। সেই প্রাণটা হবে তার আর দূর্জয়ের অংশ। দুই সন্তান মিলে তাদের জীবনটা পরিপূর্ণ করে তুলবে। দূর্জয় আর আফরা যখন ঘরের বাহিরে থাকবে তখন এই একাকী ঘরটায় ছোট্ট আরেকটা প্রাণ বাণীকে সঙ্গ দিবে। আফরার মতোই খুব আদুরে হবে সে। বাবা, মা এবং বোনের স্নেহ, শাসনে বেড়ে উঠবে।
বাণী আর ভাবতে পারে না। ভাবনাটাকে বাস্তবে দেখার খুব লোভ হয় তার। একটা সুস্থ মাতৃত্বের স্বাদের লোভ জাগে মনে। মুখে বলতে চায় যে সে-ও আরেকটা সন্তান চায়। কিন্তু মুখ ফুটে আর বলতে পারে না। নীরবে দূর্জয়ের পিঠে হাত রাখে। দূর্জয় হয়তো স্ত্রী’র নীরবতার ভেতরই লুকিয়ে থাকা ইচ্ছেটা বুঝতে পারে। শান্ত গলায় বলে,
“ ডক্টরের সঙ্গে কনসাল্ট করবো আমরা। তুমি ফিজিক্যালি বেবি ক্যারি করার মতো ফিট থাকলেই একমাত্র এই ব্যাপারে আগাবো আমরা। তোমার হেলথ নিয়ে কম্প্রোমাইজ করে কাউকে প্রয়োজন নেই আমার। “
অন্ধকারের মাঝেও বাণী ঘোর লাগা চোখে মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করলো। এই সুপুরুষটা তার স্বামী, তার মেয়ের বাবা ভাবতেই তার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। মনের এক কোণে উথলে উঠে ভালো লাগার অনুভূতি।
__________
বাহিরে তখন ঝুম বৃষ্টি। রাতের গভীরতার ফলে পুরো চট্টগ্রাম শহরটা তখন নিশ্চুপ। ঘুমিয়ে আছে সম্পূর্ণ নগরী। ঠিক সেই সময় ধীরে ধীরে দরজার নব ঘুরিয়ে কাঠের দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে ফেলে কেউ একজন। অতি সাবধানে পা ফেলে রুমের ভেতর প্রবেশ করে। তার পিছু পিছু আরেকজনও রুমের ভেতর প্রবেশ করে দরজাটা চাপিয়ে দেয়। ধীর পায়ে হেঁটে বিছানার দিকে এগিয়ে যায় দু’জন। প্রিয় কুশনটা জড়িয়ে আফরা তখন গভীর ঘুমে তলিয়ে।
নারী অবয়বটা এগিয়ে গিয়ে আফরার মাথার কাছে বসে। আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে স্বরে ডাকে,
“ মা? “
আফরা কিছুটা নড়েচড়ে উঠে। নারী স্বরটা আবার ডাকে,
“ মা। উঠো। “
আফরার পাতলা ঘুমটা ছুটে যায়। সে চোখ ডলতে ডলতে পিটপিট করে তাকায়। অত:পর কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে রয়। হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষ দুটো বলে উঠে,
“ হ্যাপি বার্থডে। “
আফরার ঘুম পুরোপুরি উবে যায় এবার। সে দ্রুত উঠে বসে। দূর্জয় হাতে আফরার প্রিয় ডার্ক ফরেস্ট কেক। কেকের উপর সুন্দর করে ইংরেজিতে লেখা ‘Afra Turns 7’ মেয়ের বিস্মিত মুখ দেখে দূর্জয় হাতের কেকটা একপাশে রেখে হাত বাড়িয়ে একটা সুইচ অন করে দেয়। মুহুর্তেই সম্পূর্ণ রুমটা ফেইরি লাইটের টিমটিমে সোনালী আলোয় আলোকিত হয়ে যায়। বাণী পিছন থেকে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ হ্যাপি বার্থডে মা। “
মধ্যরাতের এই অপ্রত্যাশিত সারপ্রাইজে আফরা খুশি হয়। খোলা মনে হেসে বলে,
“ থ্যাঙ্কিউ মাম্মা। “
দূর্জয় দুই হাত মেলে দিতেই আফরা মায়ের কোল ছেড়ে গিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে। দূর্জয় আদুরে গলায় বলে,
“ হ্যাপি বার্থডে প্রিন্সেস। আপনার সারপ্রাইজ পছন্দ হয়েছে? “
“ ইয়েস। “
বাণী উঠে দাঁড়িয়ে তাড়া দিয়ে বলে,
“ আগে কেক কাটো দ্রুত। ক্যান্ডেলস গলে যাচ্ছে। “
আফরা বিছানার মাঝটায় জায়গা করে বসে। তার দু’পাশে বসে আছে দূর্জয় আর বাণী। মোমবাতি গুলো ফু দিয়ে নিভিয়েই জীবনের নতুন একটা বছরকে শুভেচ্ছা জানায় সে। কেক কাটার পর্ব শেষ করতেই দূর্জয় উঠে গিয়ে বেশ কিছু ব্যাগ নিয়ে রুমে ফিরে আসে। ব্যাগ গুলো থেকে অনেকগুলো র্যাপিং করা গিফট বক্স বের করে আফরার সামনে রেখে বলে,
“ এগুলো সব আপনার। মাম্মা বাবা স্পেশালি আফরার জন্য এগুলো চুজ করেছি। “
গিফট বক্স গুলো নিয়ে আফরাকে আগ্রহী দেখায়। সে উৎসাহ নিয়ে একটা একটা করে গিফট বক্স আনবক্সিং করতে থাকে। কোনটাতে মারভেল স্টুডিওজের চরিত্রগুলোর টয় সেট, কোনটাতে আবার চমৎকার স্টোরি বুকস। পছন্দসই উপহার পেয়ে আফরার চোখ মুখ ঠিকরে তখন আনন্দ প্রকাশ পাচ্ছে। হঠাৎ গোলাপি রঙের র্যাপিং পেপার মোড়ানো বক্সটা চোখে পড়তেই সে সেটা হাত বাড়িয়ে নেয়। আনবক্সিং করতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা মুকুট। মুকুটের ডিজাইনটা অনেকটা এলসার মুকুটের মতো। দূর্জয় মুকুটটা নিয়ে আফরার মাথায় পড়িয়ে দিয়ে হাসিমুখে বলে,
“ আমাকে নিজের বাবা হিসেবে চুজ করার জন্য ধন্যবাদ বাচ্চা। আমাকে বাবা বানানোর জন্য ধন্যবাদ। আপনি আমার কাছে আল্লাহর পাঠানো সবথেকে স্পেশাল গিফট। “
বাণী মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে বাবা মেয়ের আদুরে আলাপ শুনতে থাকে। আফরা বিছানা ছেড়ে নেমে আয়নার সামনে যায় মাথার মুকটটা দেখবে বলে। আয়নায় তাকিয়ে ঘুরে ঘুরে বারবার মুকুটটা ছুঁয়ে দেখছিলো সে। হঠাৎ আবছা আবছা একটা ঘটনা তার মনে পড়ে যায়। ঘটনাটা তার পাপাকে ঘিরে। পাপাও একবার এরকমই একটা মুকুট নিয়ে এসেছিলো তার জন্য। পুরোপুরি দৃশ্যটা বহ্নির মনে না পড়লেও পাপার কথা মনে পড়ে তার। সুপ্ত মনে প্রশ্ন জাগে, পাপা এখন কোথায় আছে? কতদিন পেরিয়ে গেলো! শেষ কবে পাপাকে দেখেছিলো তা-ও আফরার মনে নেই। আচ্ছা, পাপার তাদের জীবনে আর না থাকাটা কি ভালো কিছু? দীদা তো তা-ই বলে। জীবনে যা হয় সবকিছুর পিছনেই না-কি কোনো না কোনো ভালো লুকিয়ে থাকে। আফরা ধরে নেয় তার পাপার দূরে থাকাতেই হয়তো তাদের ভালো। মাম্মাকে এখন আর কেউ ব্যথা দেয় না। মাম্মাও আগের মতো আর এতো চুপচাপ থাকে না। এমন নয় যে আফরা নিজের পাপাকে পুরোপুরি ভুলে গিয়েছে। কিন্তু সেই রাতের ভয়ংকর দৃশ্যটা তার মস্তিষ্কে সম্পূর্ণ বিধে গিয়েছে। যতবারই পাপার কথা মনে পড়ে ততবারই সেই রাতে মাম্মার ওই কান্নামাখা মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। ছোট্ট মনটা তিক্ততায় ভরে উঠে। অনুভব করে মায়ের সঙ্গে করা অন্যায়কারীর প্রতি ঘৃণা। মন বলে উঠে, ওই ভয়ংকর মানুষটা যেনো আর কখনো তাদের জীবনে ফিরে না আসে। ওইরকম ভয়ংকর পরিস্থিতির সাক্ষী আর কখনোই হতে চায় না আফরা।
__________
আফরার জন্মদিনের তিন দিন পেরিয়েছে কেবল। সেদিন সন্ধ্যায় রান্নাঘরে পাকোড়া ভাজতে ব্যস্ত ছিলো বাণী। আফরা তখন সবে পড়তে বসেছে। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠতেই বাণী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে। দরজা খুলতেই দেখে দূর্জয় ফিরেছে। বাণী অবাক হয়ে বলে,
“ আজ এতো তাড়াতাড়ি! “
দূর্জয় ঘরে প্রবেশ করতে করতে বলে,
“ ব্যস্ততা ছিলো না আজ খুব একটা। তাই দ্রুত ফিরে আসলাম। আর তাছাড়াও তোমার জন্য দুটো নিউজ আছে আমার কাছে। “
বাবার গলার স্বর টের পেয়ে আফরা ততক্ষণে নিজের রুম ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। মেয়েকে দেখে দূর্জয় হেসে বলে,
“ বাবা মাত্র বাহির থেকে এসেছি আম্মুজি। আপনি রুমে যান। বাবা ফ্রেশ হয়ে আপনার কাছে আসছে। “
আফরা মিষ্টি হেসে নিজের রুমে ফিরে যেতেই বাণী প্রশ্ন করে,
“ কি নিউজ? “
দূর্জয় জুতো খুলতে খুলতে বলে,
“ প্রথম নিউজটা হলো আমি সহ স্পেশাল ফোর্সের লেফটেন্যান্টদের বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হবে। আতঙ্কবাদীদের ওই কেসটা সফলভাবে সম্পন্ন করার কারণে এই আয়োজন। আয়োজনটা সামনের সপ্তাহে ঢাকা সদর দপ্তরে আয়োজিত হবে। “
বাণী প্রফুল্ল গলায় বলে,
“ কংগ্রেচুলেশন। “
দূর্জয় এবার উঠে বাণী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
“ আর দ্বিতীয় নিউজটা হলো একটা গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি যে, সামনের সপ্তাহে হিরণের মৃত্যুদন্ডের রায়টাও কার্যকর হয়ে যাবে। “
বাণীর প্রফুল্লতাটা ম্লান হয়। বিড়বিড়িয়ে বলে,
“ অবশেষে! “
দূর্জয় বাণীর কাধে হাত রেখে বলে,
“ ওই লোকটা দেখা করতে চাইছে তোমার সাথে শেষবারের মতো। দুঃসাহসিক আবদার করে বসেছে। তুমি কি চাও? “
বাণী বিস্মিত হয়। দেখা করতে চায় মানে? কি কারণে? মরার আগে বাণীর জীবনটা আবার নরক বানিয়ে দেওয়ার নতুন কোনো পায়তারা নাকি? বাণী ওই লোকটাকে এক বিন্দু ভরসা করতে পারে না। অভিশপ্ত একটা লোক! যার জীবনেই ওই লোকের ছায়া পড়ে তাদের প্রত্যেকের জীবনটা দূর্বিষহ করে তুলে। বাণীর এই নতুন জীবনটাও যদি আবার এলোমেলো হয়ে যায়?
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]