এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৮০ এবং শেষ পর্ব

0
511

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৮০. ( উপসংহার )

১০ ফুট বাই ৬ ফুট আয়তনের ছোট্ট অন্ধকারে মোড়ানো একটি নির্জন প্রকোষ্ঠ। জেলের ভেতরেই যেনো আরেকটি জেল। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামিদের জন্য তৈরি বিশেষ এই প্রকোষ্ঠটিকে কনডেম সেল বলা হয়। সেল জুড়ে কেমন একটা গা ছমছমে ভাব। এটাই সেই সেল যেখান থেকে রায় প্রাপ্ত আসামিকে সরাসরি ফাঁসির মঞ্চে নেওয়া হয়। অনেকের ধারণা কনডেম সেল হলো সেই সেল, যেখানে পৃথিবীর আলো বাতাসের কিচ্ছুটি প্রবেশ করতে পারে না।

রাত তখন হয়তো সাতটা বাজে। চোখ বুজে বসে থাকা আসামির মাথাটা তখন কিছুটা মেঝের দিকে ঝুকে আছে। বাইরে থেকে দেখতে তাকে বেশ শান্ত মনে হচ্ছে। ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে জানাটা নেহাৎই অপ্রয়োজনীয়। হঠাৎ একজন পুলিশী পোশাক গায়ে জড়ানো পুরুষের গলা শুনে সে মাথা তুলে তাকায়।

“ এই-যে, তাড়াতাড়ি চলো। দেখা করতে আসছে তোমার সাথে। শেষ ইচ্ছা পূরণ করা হয়েছে তোমার। “

হিরণ ম্লান হাসে। সে জানতো বাণী আসবে। শেষ দেখাটা যে এখনো বাকি! হাতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় হিরণ। রিমান্ডে পাওয়া আঘাতের ফলস্বরূপ ডান পা-টায় ভর দিতে খুব অসুবিধা হয় তার। আঘাতটা হয়তো খুব সম্ভবত হাড়ে লেগেছিলো। তবে তা কারো সামনে প্রকাশ করে না হিরণ। নিজেকে দূর্বল প্রদর্শন করা তার স্বভাব বহির্ভূত কাজ। উক্ত পুলিশের লোকটা একটা চাবির গোছা হতে নির্দিষ্ট চাবি দ্বারা সেলের দরজাটা খুলে দিতেই হিরণ নীরবে বেরিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে পড়ানো হয় হ্যান্ডকাফ। মস্ত বড়ো আসামি কি-না!

একটা সাধারণ শূন্য সেলের সামনে এনে হিরণের হ্যান্ডকাফ খুলে দেওয়া হয়। সেলের ভেতর তাকে প্রবেশ করিয়েই লোহার শিকের দরজাটা বাহির থেকে চাবি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। হিরণ কিছুটা অবাক সুরে বলে,

“ সেলে কেনো আনা হলো আমাকে? দেখা করাবে বলেছিলে। এখানে কেন আমি? “

পুলিশটা বিরক্তিকর গলায় শুধায়,

“ এখানেই দেখা হবে। সাধারণত সেলের সামনে এসে দেখা করার সুযোগ খুব একটা দেওয়া হয় না, ফাঁসির আসামির সঙ্গে তো আরো আগে না। কিন্তু উনারা বিশেষ অনুমতি নিয়ে এই ব্যবস্থা করেছেন। বাহিরেই অপেক্ষা করছেন। এখনই এসে পড়বে। “

নিজের কথাটুকু শেষ করেই পুলিশটা সেখান থেকে প্রস্থান করে। উক্ত মানুষদের উপস্থিতিতে তার এখানে থাকার অনুমতি নেই। একান্ত কথা আছে বোধহয়! তবে তিনি খানিকটা অবাকও। সাধারণত একজন ফাঁসির আসামির কাছে তার জীবনের শেষ ইচ্ছে জানতে চাওয়ার প্রথা আছে। তবে এক্ষেত্রে রয়েছে ইচ্ছের সীমাবদ্ধতা। একজন অপরাধী কেবল নির্দিষ্ট তিনটি ইচ্ছের যেকোনো একটি ইচ্ছেই পোষণ করতে পারবে। তার মধ্যে রয়েছে শেষ বারের মতো কিছু খাওয়ার ইচ্ছে, নিজের পরিবারের সাথে শেষ বারের মতো দেখা করতে চাওয়ার ইচ্ছে কিংবা নিজের ধর্মের কোনো পবিত্র গ্রন্থ পাঠের ইচ্ছে। হিরণ নামক লোকটা দেখা করতে চাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছে। তবে যেই নারীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে তার সঙ্গে হিরণের কোনো পারিবারিক সম্পর্ক নেই। তবে তাদের মাঝে কিসের যোগসূত্র রয়েছে?

__________

একাকী সেলটায় বাল্বের আলোর নিচে চারিদিকটা চুপচাপ পরখ করছিলো হিরণ। হঠাৎ দূর হতে দু জোড়া মানুষের আগমন টের পেতেই সে করিডোর পানে তাকায়। বাণী আসছে। ধীর কদম, নির্ভিক দৃষ্টি, শীর্ণ মুখের আদলে সুস্থতার ছাপ। তার পিছনে রয়েছে দূর্জয়। হিরণ এগিয়ে লোহার শিকের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। অপর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বাণীও। হিরণ চট করে বলে,

“ তুমি আসবে জানতাম। “

বাণী প্রতিত্তুরে কিছু বলে না। তার চোখে এসে ভীড় করেছে ঘৃণা। এক অসীম ঘৃণা। যা কখনো ফুরাবে না। সে সোজাসাপ্টা বলে,

“ নিজের চোখের তৃপ্তি মেটাতে এসেছি। আপনাকে বন্দী দেখতে পাওয়ার তৃপ্তি। ক্ষমতাহীন আপনাকে শেষ বারের মতো স্বচক্ষে দেখতে পাওয়ার তৃপ্তি। “

হিরণ নীরবে বাণীর কথাটুকু শুনে। জানতে চায়,

“ বহ্নি কেমন আছে? “

“ মরে গিয়েছে। “

বাণীর কাটকাট জবাব। মুহুর্তেই হিরণের শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে। বিস্ফোরিত নয়নে বাণীকে প্রশ্ন করে,

“ মানে? “

“ আপনার অস্তিত্ব, আপনার পরিচয় আর আপনার দেওয়া নাম তিনটাই আমি ওর জীবন থেকে সরিয়ে দাফন করে দিয়েছি। ও এখন আমাদের মেয়ে। আমার আর দূর্জয়ের। আমার মেয়ে নিষ্পাপ। নিজের অপবিত্র মুখে ওর নাম নেওয়ার সাহস দেখাবেন না আর। “

হিরণ টের পেলো তার ভেতরটা এতক্ষণ যেরকম শান্ত ছিলো, তেমনটা আর নেই। তার হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়ছে। গলা কেমন শুকিয়ে আসছে। নিজের মেয়ের নামটা মুখে উচ্চারণ করতে দ্বিধা বোধ করছে। মস্তিষ্কে আলোড়ন তুলেছে বাণীর বলা শেষ দুটি বাক্য। বাণী তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। বলে,

“ আমি আর ভাইয়া পালাতে গিয়ে যে রাতে ধরা পড়েছিলাম মনে আছে? মিনতি করেছিলাম। ভাইয়াকে যেতে দিতে বলেছিলাম। সেই মিনতি কানে তুলেন নি। একটুও দয়া দেখান নি। অথচ আমাকে দেখুন। ঠিকই আপনার শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করলাম। আমি আপনার মিনতি ফিরাই নি। দয়া দেখালাম আপনাকে। এটাই আমাদের মধ্যে পার্থক্য। ভালো করে দেখুন। “

হিরণের মনে পড়ে সে রাতের দৃশ্য। ভীত বাণী কেদে কেদে মিনতি করছিলো। ছটফট করতে করতে বলছিলো,

“ আমি যাবো আপনার সাথে। আমাকে বন্দী করে রাখুন, কিন্তু ভাইয়াকে যেতে দিন। আমার ভাইয়াকে দয়া করে যেতে দিন। “

ওই মুহুর্তে বাণীর মিনতি হিরণের কানে পৌঁছায় নি। তার হিংস্রাত্মক সত্তাটা খুনের নেশায় মজেছিল। মজেছিল বাণীকে খুবলে খাওয়ার নেশায়। মস্তিষ্ক বলছিলো,

“ এতো সংযম অহেতুক। ভেঙে গুড়িয়ে দে মেয়েটাকে। সম্ভ্রমটুকু কেড়ে নিয়ে পায়ের কাছে ফেলে রাখ। কখনো পালাবে না আর। সম্মান খুইয়ে এই চার দেয়ালের বাহিরে পা রাখার দুঃসাহস দেখাবে না কখনো। “

সেদিন হিরণ ঠিক তা-ই করেছিলো। তার পৈশাচিক সত্তাটা যখন পাপে মশগুল ছিল, তখন বাণী নিষ্প্রাণ দেহের ন্যায় পড়ে ছিলো। সদ্য ভাই হারানো মেয়েটা চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখছিলো। মনে হচ্ছিলো সব ফুরিয়ে এলো। সে বোধহয় মারা যাচ্ছে।

হিরণ ভেতর থেকে এলোমেলো হয়ে পড়েছে। মুহুর্তের মাঝে নিজেকে সামলে নেওয়ার প্রয়াস করে। মনে করার চেষ্টা করে, বাণীর সঙ্গে শেষ বারের মতো কেন দেখা করতে চেয়েছিলো সে? মনে পড়তেই সে একবার দূর্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ আমি বাণীর সাথে একা কথা বলতে চাই। “

দূর্জয় সেই কথার তোয়াক্কা না করে বলে,

“ যা কথা বলার আমার সামনে বলতে হবে। তোর ছায়াও আমার ওয়াইফের জন্য সেফ না। আই ক্যান্ট টেক এনি রিস্ক। “

বাণীও একমত প্রকাশ করে বলে,

“ দূর্জয় কোথাও যাবে না। “

হিরণ কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে চোখ দুটো বুজে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। অত:পর চোখ মেলে বাণীর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ ছয় বছর আগে তোমার সঙ্গে যা করেছি তা ভুল করেছি। উপলব্ধিটা ওই ঘটনার পরের দিন হুশ ফিরতেই হয়েছিলো। কিন্তু কখনো তোমার সামনে তা স্বীকার করা হয় নি। আজ স্বীকার করছি। আর সেই সঙ্গে তোমার কাছে মাফও চাইছি। “

বাণী অবাক হয়ে বলে,

“ ভুল? “

“ হ্যাঁ। একবার না দুইবার ভুল করেছি আমি। সেটার জন্য তোমার কাছে মাফ চাওয়াটা বাকি ছিলো। তোমার কাছ থেকে ক্ষমা না চাইলে শান্তি পাচ্ছিলাম না। ক্ষমা করে দাও। “

“ আপনি শুধু দুই বার ভুলে করেছেন? আমার সঙ্গে করা পাপকে ভুলের ট্যাগ দিচ্ছেন। আর বাকি যেসব পাপ করেছেন? ওগুলোকে কি বলবেন আপনি? “

“ ওগুলোর জন্য বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নই আমি। আমার সম্পর্ক শুধুমাত্র তোমার সাথে। তোমার ক্ষমাটাই শুধু আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তোমার ক্ষমা না পেলে আমি শান্তি পাবো না। মাফ করে দাও আমাকে বাণী। হাত জোর করে মাফ চাইছি। “
কথাটা বলতে বলতে হিরণ দু হাত জোর করে ধরে। বাণীর দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বলতে থাকে,

“ যতবার আমার ওই রাতটার কথা মনে পড়ে আমি ঠিক থাকতে পারি না। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অনুভব করি। এই ভুলের দায় নিয়ে মৃত্যু হলেও আমি মুক্তি পাবো না। তুমি মাফ করে দাও আমাকে বাণী। প্লিজ মাফ করে দাও। “

বলতে বলতে হিরণ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। লোহার শিক গলে দু হাত বাড়িয়ে বাণীর পা ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু সুযোগটা পায় না। বাণী দ্রুত পিছিয়ে যায়। দূর্জয় পিছন থেকে তার দু বাহু ধরে তাকে আগলে ধরে। বাণীর তখন ক্ষোভে শরীর মৃদু কাপছিলো। চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ছে তার। বিক্ষিপ্ত স্বরে সে বলে,

“ মানসিক অশান্তিতে আছেন খুব? তা থেকে মুক্তি পেতে এই নাটক করছেন তাই-না? আর কি বললেন? আমার সঙ্গে করা ভুলের জন্য মাফ চাইছেন? ওইটা ভুল ছিলো? ভুল ছিলো ওইটা? আর আপনার সাথে কিসের সম্পর্ক আমার? হ্যাঁ? কিসের সম্পর্ক? রেপিস্ট আর ভিক্টিম বাদে অন্য কোনো সম্পর্ক আমাদের মাঝে থাকতেই পারে না। ওই রাতটার কথা মনে পড়লে আপনি ঠিক থাকতে পারেন না। অথচ ওই রাতের স্মৃতি মস্তিষ্কে নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে আমার। আমার মেয়েকে আমি যতই ভালোবাসি না কেন এই সত্যটা কখনো বদলাবে না যে ও আপনার পাপের চিহ্ন, আমার প্রতি হওয়া অন্যায়ের চিহ্ন। কতটা মানসিক নিপীড়ন সহ্য করে এই সত্যটা মেনে নিতে হয়েছে আমার সেই সম্পর্কে ধারণা আছে আপনার? এতটা… এতটা সহজ মনে হয় আপনার সবকিছু? মাফ চাচ্ছেন না? করবো না আমি আপনাকে মাফ। কখনো করবো না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানসিক যন্ত্রণায় ধ্বংস হয়ে যান। আর মৃত্যুর পর, জাহান্নামের আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যান। প্রত্যেকটা পাপের হিসাব যেনো নেওয়া হয় আপনার কাছ থেকে। “

এতো গুলো কথা একসঙ্গে বলে বাণী এলোমেলো ভঙ্গিতে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। দূর্জয় তাকে আগলে রেখেছে। ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। হিরণ তখনও হাত বাড়িয়ে বাণীর পা ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। বাণী বুঝতে পারছে না। বাণী ওকে মাফ না করলে ওর শান্তি মিলবে না। এতগুলো মাস এই জেলের ভেতর যেই মানসিক অশান্তিতে ভুগছে সে তা থেকে কখনোই মুক্তি পাবে না সে। হিরণ কেমন কাতর স্বরে বলে,

“ প্লিজ বাণী। দয়া করো। মাফ করে দাও। “

বাণী নিজেকে সামলে নেয় দ্রুত। অনড় ভঙ্গিতে শিকের ও পাশে তার পায়ের সামনে লুটিয়ে থাকা হিরণকে দেখে। কিছুক্ষণ পরে বিষন্ন চোখে চেয়ে বলে উঠে,

“ আমি প্রতিদিন দোয়া করি জানেন? আল্লাহ যেনো আপনার প্রতিটা পাপের হিসাব শুধু আর শুধুমাত্র আপনার থেকেই নেয়। আপনার পাপের ভার যেনো কখনো আমার নিষ্পাপ মেয়েটার বইতে না হয়। কত মানুষের সঙ্গে অন্যায় করেছেন! বদদোয়া খুব ভয়ংকর হয় জানেন? যাদের সঙ্গে অন্যায় করেছেন তাদের বদদোয়া বা দীর্ঘশ্বাস যেনো কখনো আপনাকে ডিঙিয়ে আমার মেয়েকে না ছুঁতে পারে। “

বাণীর কথা হিরণের বুকে গিয়ে বিধে। বদদোয়া? এসব কি আদৌ সত্যি হয়? কে জানে! বহ্নিকে কি তার পাপার পাপের ভার বইতে হতে পারে? ভাবনাটা হিরণকে দূর্বল করে দেয় কেমন। মানসিক অশান্তির ভার যেনো খুব বেশি-ই ভারী হয়ে গিয়েছে। কান্নায় আছড়ে পড়ে সে। আকুতি জানায়,

“ আমার কোনো পাপের ফল বহ্নি ভোগ করবে না। তুমি শুধু আমাকে মাফ করে দাও। এতগুলো মাস ধরে তোমার থেকে ক্ষমা চাওয়ার অপেক্ষায়ই দিন গুনছিলাম আমি। এই অশান্তি থেকে আমাকে মুক্তি দাও বাণী। মৃত্যুর আগে একটা রাত অন্তত আমি শান্তিতে ঘুমাতে চাই। তোমার চিৎকার গুলো রাতে আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। তোমার কান্নার স্বর শুনতে পাই আমি। “

লোকে বলে ক্ষমা করা মহৎ গুণ। বাণী মহৎ নয়। সে ক্ষমা করে না হিরণকে। কিছু পাপের ক্ষমা হয় না। আর যদি ক্ষমাটা কেবল মানসিক শান্তি লাভের উদ্দেশ্যে চাওয়া হয় তাহলে আরো আগে না। বাণী সাবলীল গলায় বলে,

“ আপনার ক্ষমা চাওয়াতে কিছুই বদলাবে না। আমার জীবনের সাতটা বছর, আমার ভাই আর আমার সম্মান কোনটাই আর ফিরে আসবে না। নিজের মৃত্যুর আগ মুহুর্তে পৌঁছেও আপনাকে ক্ষমা করবো না আমি। “

কথাটা বলেই বাণী এক দু পা করে পিছিয়ে গিয়ে উল্টো ঘুরে সেখান থেকে প্রস্থানের জন্য পা বাড়ায়। পিছন থেকে হিরণের ভয়ংকর চিৎকারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আকুতি ভরা সেই চিৎকার।

“ বাণী। বাণী প্লিজ। ক্ষমা করে দাও বাণী। বাণী… “

দূর্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে একবার বাণীকে দেখে যে ইতিমধ্যে প্রায় দৃষ্টিসীমার বাহিরে চলে গিয়েছে, ফের ঘাড় ঘুরিয়ে হিরণকে দেখে। কিছু পাপের সামনে ক্ষমা খুবই ঠুনকো একটা শব্দ। ক্ষমা এতোটা সস্তা না যে চাইলে যে কাউকেই দিয়ে দেওয়া যাবে। দূর্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে-ও যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে নিলে হিরণ পিছু ডাকে,

“ দূর্জয়। “

দূর্জয় পিছু ফিরে তাকায়। হিরণ বলে,

“ দায়িত্ব পালনে খুব মাহির তুই তাই না? আমার বাণী আর বহ্নিকে আজ থেকে তোকে দিয়ে দিলাম। ওদের আগলে রাখবি। “

দূর্জয়ের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। হিংস্র চাহনিটা দপ করে চোখে জ্বলে উঠে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“ ওদের দু’জনকে আমার জীবনে আল্লাহ দিয়েছেন। আল্লাহর উপহারের মান আমি অবশ্যই রাখবো। আর নিজের ওয়াইফ আর মেয়েকে কিভাবে ট্রিট করতে হয় তা আমি ভালো করেই জানি। “

দূর্জয়ের আর এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়ানোর রুচি হয় না। বড়ো বড়ো পা ফেলে প্রস্থান করে সেখান থেকে। একাকী সেলটায় রয়ে যায় হিরণ।

__________

মস্ত কালো আকাশটায় রূপালী থালের মতো একটা চাঁদ উঠেছে। ভরা জোৎস্না। অদ্ভুত সুন্দর সেই রজনীতে একজন লোক ফাঁসির মঞ্চ এবং পাটাতন বারবার পরীক্ষা করে দেখছে। অপরদিকে আরেকজন ৩০ ফুট লম্বা দড়িটা মোম তেল ও সাবান দিয়ে মসৃন বানাতে ব্যস্ত। সে এক অদ্ভুৎ দৃশ্য। খুব মন দিয়ে রায় কার্যকরের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। কারো পরিণতির প্রস্তুতি!

রাত তখন দশটা। নিজস্ব কনডেম সেলটায় একাকী বসে আছে হিরণ। পরনে তার কয়দীদের পোশাক। হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেতেই সে চোখ তুলে তাকায়। কারাগার মসজিদের ইমামকে নিয়ে জেল সুপার এসে হাজির হয়েছেন। হিরণ মলিন হাসে। বুঝতে পারে সময় হয়েছে। সোজাসাপ্টা বলে,

“ কোনো নীতি রেওয়াজ পালন করতে এসেছেন নাকি ইমাম সাহেব? “

কিছুটা বয়স্ক সফেদ পাঞ্জাবি ও মাথায় টুপি জড়ানো লোকটা বলে,

“ তওবা আর কালেমা পড়াতে হবে তোমাকে। “

হিরণ সাফ সাফ জানায়,

“ ওসব অহেতুক ঝামেলায় যাবেন না। ওসবে আমার বিশ্বাস নেই। আরেক দফা রিমান্ডে নিলেও আমার মুখ দিয়ে এসব কিছু বের করতে পারবেন না। “

জেল সুপার বিরক্ত হয়। এই লোকটাকে সে ভালো করে চিনে। গন্ডারের চামড়া যেনো। গায়ে কিছু মাখে না। জেল সুপার খানিকটা আশাহত গলায় বলে,

“ এসব নাস্তিকের পিছনে সময় নষ্ট করা অহেতুক হবে ইমাম সাহেব। কেউ যদি নিজ থেকে তওবা করার সুযোগ হাতছাড়া করে তাতে আমাদের কি করার আছে? রোজ হাশরের ময়দানে যে যার হিসাব দিবে। “

হিরণের আর তওবা পড়ানো হলো না। সোজা তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ফাঁসির মঞ্চে। হিরণের মধ্যে তেমন একটা ভাবান্তর দেখা গেলো না। কেমন নির্লিপ্ত ভঙ্গি! যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে এসব কোনো কিছুর পরোয়াই সে করে না। দুজন এসে শক্ত করে তার হাত জোড়া পিছনে নিয়ে বেধে দেয়। ঘড়ির কাটাটা রাত বারোটা ছুঁতে যখন আর পাঁচ মিনিট বাকি তখন কালো রঙা যম টুপি পড়িয়ে দেওয়া হয় তাকে। হিরণ চোখ বুজে নেয়। এখন চোখ খুলে রাখাটা নেহাৎই অহেতুক মনে হয় তার। কারণ চোখ খুলে রাখলেও অন্ধকার ব্যতীত কিছুই দেখবে না সে।

আঁখি পল্লব বুজেই চোখের সামনে ভেসে উঠে কিছু দৃশ্য। বাণীকে প্রথম দেখা, বহ্নিকে প্রথম কোলে নেওয়া, বাণীর কোলে বহ্নিকে প্রথম দেখা। দৃশ্যগুলো সেকেন্ড কয়েক স্থায়ী হলো। অত:পর সবটা আবার আঁধারে তলিয়ে যায়। হিরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বাণীর কাছ থেকে তার আর ক্ষমা পাওয়া হলো না। খুব সম্ভবত মেয়ের মনেও নিজের পূর্বের জায়গাটা তার ফিরে পাওয়া হলো না। দিনশেষে তার কিছুই পাওয়া হলো না। মনে আক্ষেপ জাগে। বাণী তাকে ভালোবাসলেও পারতো! আক্ষেপ মনে পুষে শেষ নিঃশ্বাসের অপেক্ষায় রয় সে।

জেল সুপার তখন হাতে একটা রুমাল নিয়ে মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে। তার সঙ্গে আরো বেশ ক’জন দাঁড়িয়ে। জল্লাদের দৃষ্টি জেল সুপারের হাতের রুমালটার দিকে। কি অদ্ভুৎ ক্ষমতা সামান্য একটা রুমালের! মুহুর্তেই যেকোনো মানুষকে এপাড় হতে ওপাড়ে পাঠিয়ে দিতে জানে সে।

ঘড়ির কাটা ঠিক বারোটা ছুঁতেই রুমালটা কাঙ্ক্ষিত ইশারা দেয়। জল্লাদ পালন করে নিজের দায়িত্বটুকু। পায়ের নিচ থেকে সরে যায় শক্ত পাটাতনটা। ভারী দেহটা অতি দ্রুত পড়ার ফলে গলায় ১২৬০ ফুট পাউন্ড চাপ তৈরী হয়। চোখ মুখের সামনে সবটা অন্ধকার। কেমন দাঁতে দাঁত খেটে গিয়েছে যেন! বিশাল দেহটার ভার গলাটা বইতে পারে না। শেষ মুহুর্তটায় এসে পৃথিবীর মায়ায় জড়িয়ে পাপ করা মানুষটাও কেমন ছটফটিয়ে উঠে। পাড়ি জমায় এক রহস্যময় যাত্রায়। সে যাত্রা কেমন তা এপাড়ের মানুষের বর্ণনা করার ক্ষমতা নেই।

দশ মিনিট ধরে ঝুলে থাকা দেহটাকে অবশেষে নামিয়ে আনা হয়। একজন ডাক্তার ঘাড়ের চামড়া কেটে নিশ্চিত করে তার মৃত্যু। মুছে যায় আরেকজন পাপী পৃথিবীর বুক থেকে।

__________

পৃথিবীর বুক থেকে চলে গিয়েছে আরো একটা বছর। একাকী রুমটায় একটা চেয়ারে বসে আছে এক যুবক। সামনের টেবিলটার উপর থাকা কালো মলাটের ডায়েরিটার দিকে তার দৃষ্টি। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে সে ডায়েরির শক্ত মলাটটা উল্টে ভেতরটা উন্মুক্ত করে। প্রথম পাতাতেই লাল কালি দ্বারা লেখা আছে,

“ তেইশতম জন্মদিন উপলক্ষে ভাইয়ার জন্য। “

যুবক উক্ত পাতাটা উল্টে পরের পাতায় যায়। বাংলা গোটা অক্ষরে সাদা পাতায় অর্থপূর্ণ কিছু কথা লেখা আছে। তা খানিকটা এমন,

“ ডায়েরিটা আমার তেইশতম জন্মদিনে ছোট বোন সাওদা উপহার দিয়েছে। বারবার করে বলে দিয়েছে যেনো ডায়েরিটা আমি খালি না রাখি। বরং পরিবারের থেকে দূরে থাকার ফলস্বরূপ যখনই নিজেকে একা মনে হবে তখনই যেনো এটাতে দু চারটে শব্দ হলেও লিখি। বোনের কথা ফেলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ঠিক করেছি যতই আলসেমি লাগুক না কেন এই ডায়েরিতে কিছু পাতা হলেও অন্তত আমি লিখে রাখবো। ভাবছি ওর মূল্যবান উপহারে নিজের ব্যক্তিগত কিছু কথাই লিখে রাখি। যা কখনো কাউকে মন খুলে বলা হয় নি। হয়তো হবেও না।

রাত এখন প্রায় দুটো বাজে। সাধারণত এই সময় আমার ঘুমিয়ে পড়ার কথা। কিন্তু আমি ঘুমোতে পারছি না। বিগত অনেকগুলো দিন ধরেই রাতের ঘুমটা যেনো কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। তার উপর আজ যা শুনে এলাম তারপর মনের মধ্যে যে অশান্তি শুরু হয়েছে তা থামবার নয়। আমি তো মানুষ গুলোকে আপন ভাবতাম। আপন মানুষ গুলো এভাবে ক্ষতি কেন করলো তবে?

বিগত কতদিন ধরে অদ্ভুৎ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হই আমি। ব্যাপার গুলো স্বাভাবিক ছিলো না। নিশ্চিত হতে আজ একজন বিশ্বস্ত হুজুরের কাছে গিয়েছিলাম। আমার মুখ থেকে সব সমস্যা শোনার পর হুজুর যা বললো তা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। কেউ আমার উপর খারাপ কিছুর চালান দিয়েছে। সেই চালানের উদ্দেশ্যটা মোটেও ভালো নয়। বরং মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে কাজটা করা হয়েছে। সবথেকে অবাক করার বিষয় হচ্ছে হুজুর বলেছে কাজটা আমার কাছের কেউই করেছে।

আমি ধারণা করতে পারছি সবটা। বেশ অনেকদিন ধরেই জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে চাচী আর চাচাতো ভাইদের সাথে আমার ঝামেলা চলছে। উনারা খুব চেষ্টা চালাচ্ছেন যেনো জমি গুলো দখল করতে পারে। কিন্তু বাধা হয়ে আছি আমি। নিজের আব্বার খেটে করা উপার্জনের টাকায় কেনা জমি গুলো এভাবেই কাউকে দখল করতে দেওয়ার পক্ষে আমি নই। কিন্তু তাই বলে উনারা এতো নোংরা একটা কাজ করবেন? লোভ এতটাই ভয়ংকর?

আমি জানি কাজটা আমার চাচীই করেছেন। বিভিন্ন কবিরাজদের সঙ্গে উনার ওঠাবসা রয়েছে। নিজেকে নিয়ে চিন্তা করি না আমি। আমি যে-ই পেশাটায় আছি সেখানে মৃত্যুকে সাথে নিয়েই চলতে হয় আমাদের। আর তাছাড়াও আজ হুজুরও শরীর বন্ধ করে বেশ কিছু নিয়ম বলে দিয়েছেন পালন করতে। আল্লাহ চাইলে সেগুলো পালন করে আমি নিরাপদ থাকলেও আমার মা আর বোনদের কি হবে?

আল্লাহ না করুক যদি কখনো আমার কিছু হয়ে যায়? তখন উনাদের কি হবে? সব দায়িত্ব গিয়ে পড়বে সাওদার ঘাড়ে। যতই বুঝদার হোক না কেনো, আমার কাছে তো ও ছোটই থাকবে। ও কিভাবে এসব ফেস করবে? এই ভয়ংকর মানুষ গুলো আমার বোনের কোনো ক্ষতি করবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এসব চিন্তা মাথাই ঘুরপাক খেলেই নিজেকে দিশেহারা লাগছে। আমি কখনো না থাকলে ওদের কার আমানতে রেখে যাবো আমি? ছেলে হওয়া সত্ত্বেও আজ এতটা অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে। “

ডায়েরিটা বন্ধ করে আবার নির্দিষ্ট ড্রয়ারে রেখে দেয় সে যুবক। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতেই দেখে রুমের দরজা খুলে প্রবেশ করছে তার নববধূ। বিয়ে হয়েছে আজ সাত দিনও যেহেতু হয় নি তাহলে নিশ্চয়ই মেয়েটাকে নববধূ বলাই যায়। মেয়েটা কোমল গলায় বলে,

“ রান্না হয়েছে। খেতে চলুন। সবাই টেবিলে এসে পড়েছে। “

“ কাছে এসো সাওদা। “

সাওদা খানিকটা সংকোচ নিয়ে এগিয়ে যায়। যুবকটা তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ সায়রা না মেডিক্যালে পড়তে ইচ্ছুক? “

সাওদা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে।

“ ওকে বলবে টিএমএসএস মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে দেখতে। ওখানে চান্স পেয়ে গেলে ওর জন্য সুবিধা হবে। বাসা থেকে পড়াশোনাটা করতে পারবে। “

সাওদা অবাক হয়ে বলে,

“ সায়রা আমাদের সাথে থাকবে? “

“ শুধু সায়রা না মা-ও আমাদের সাথেই থাকবে। যেহেতু আমার পোস্টিং বগুড়ায় আপাতত। আমরা কিন্তু তিনদিন পরেই বগুড়া যাবো। সায়রা আর মা’য়ের সঙ্গেও এই ব্যাপারে কথা বলবো আমি। চাপ নিও না, আমি রাজি করিয়ে নিবো। “

সাওদা ইতস্তত করে বলে,

“ আম্মু আর আব্বু এই ব্যাপারে কি ভাববে? “

“ ভাবাভাবির তো কিছু দেখছি না। আমি দূরে থাকলেও আম্মু আব্বুকে নিয়ে কখনো চিন্তা হয়না। কারণ ভাইয়ারা আর ভাবীরা এখানে আছেন। কিন্তু তুমি আমার সাথে বগুড়া শিফট হয়ে গেলে মা আর সায়রাকে নিয়ে আমাদের চিন্তার শেষ থাকবে না। দু’জন মেয়ে মানুষের একা থাকাটা কি সেফ? আর তাছাড়াও দু’দিন হয়েছো না বিয়ে হয়ে এসেছো, অথচ ঘরের সব কাজে সেধে হাত লাগাচ্ছো। বাধা দিলে বলছো, এটাও তোমার বাড়ি। বিয়ের পর এটাও যদি তোমার বাড়ি হতে পারে, তাহলে আমি কি তোমাদের বাড়ির ছেলে হতে পারবো না? “

সাওদা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। এরেঞ্জ ম্যারেজ নিয়ে তার তীব্র ভয় ছিলো। তার উপর বিয়ের প্রতিও তার তেমন একটা ঝোক ছিলো না। কিন্তু এই মানুষটা যখন তাকে দেখতে আসে তখন কেমন একটা ভরসা খুঁজে পায় সে। মানুষটা ভাইয়ার বন্ধু বলেই বোধহয়। ভাইয়া তো কখনো খারাপ মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতো না।

সাওদাকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে যুবকটা বলে,

“ হা করে তাকিয়ে আছো কেন? “

“ আপনি ভালো মানুষ ক্যাপ্টেন জুনায়েদ রওফ। “

সাওদার কথার ভঙ্গিমা দেখে জুনায়েদ হেসে বলে,

“ বিয়ের চার দিন পরে তা টের পেলে? “

“ আপনি জানেন, আমার এরেঞ্জ ম্যারেজ ফোবিয়া ছিলো। মনে হতো কোন রাম সাম যদু মধু কপালে জুটবে। হয়তো তার সঙ্গেই এডজাস্ট করে নিতে হবে। কিন্তু এরেঞ্জ ম্যারেজে ভালো, ভদ্র মানুষ আল্লাহ মিলিয়ে দিবেন তা এক্সপেক্ট করি নি। তাই অবাক হচ্ছি। “

জুনায়েদ কিছুটা এগিয়ে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলে,

“ আমি ভদ্র তা কি করে বুঝলে? অভদ্রও হতে পারি! পুরোপুরি এখনো জানতে পারো নি আমাকে। “

ফিসফিসিয়ে কথাটুকু বলে রহস্য করে হাসে জুনায়েদ। সাওদা তা দেখে ভড়কে যায়। দ্রুত পিছিয়ে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। জুনায়েদ এবার শব্দ করে হাসতে থাকে। হঠাৎ হাসি থামিয়ে মনে মনে বলে,

“ তোর বোনটা অনেক ভালো। একদম তোর মতো। ওকে বিয়ে করে জিতে গিয়েছি মনে হচ্ছে। তুই আর প্যারা নিস না ব্যাটা। শান্তিতে ঘুমা তুই। তোর পরিবারটা তো এখন আমারও পরিবার। খেয়াল রাখবো না, বল? “

__________

বদ্ধ জানালার কার্নিশে বসা পাখিটা কিচিরমিচির সুরে ডাকছে। সেই ডাকটা কারো কাছে বিরক্তির কারণ হিসেবে ঠেকছে। ঘুমে বিভোর প্রত্যয় চোখ মুখ কুচকে ফেলছে বারবার। পাখিটা এতো বেয়াদব কেনো? নিজেও ঘুমায় না অন্যকেও ঘুমাতে দিচ্ছে না। উল্টো কেমন ষাঁড়ের মতো চ্যাওম্যাও করছে।

প্রত্যয় কাথা টেনে মুখ ঢেকে কাথার ভেতর হাতড়ে কিছু একটা জড়িয়ে ধরতে চায়। সঙ্গে সঙ্গে হাতের নাগালে একটা দেহ পেতেই তা জড়িয়ে নেয়। ঘুম জোড়ানো স্বরে বলে,

“ তুমি এতো তুলতুলে কবে হয়ে গেলে? “

কোনো মনুষ্য স্বর জবাব দেয় না। বরং প্রত্যয়ের কানে ভেসে হাসে একটা চিকন সূক্ষ্ণ ডাক। সেই ডাকটা প্রত্যয়ের কানে পৌঁছাতেই সে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। কাথার ভেতর জড়িয়ে রাখা দেহের মালিককে দেখতেই সে চিৎকার করে উঠে। এক লাফে বিছানা ছেড়ে নামতে যায়। কিন্তু তড়িঘড়িতে আরো কাথা পায়ে প্যাঁচিয়ে বিছানা থেকে সোজা মেঝেতে পড়ে যায়।

বিছানার উপর থাকা দেহের মালিকটাও চিকন সুরে চেঁচাচ্ছে তখন। জেসি হন্তদন্ত হয়ে খুন্তি হাতে রুমে প্রবেশ করে। হতবিহ্বল দৃষ্টি মেলে সে পুরো দৃশ্যটা দেখতেই তার হাত থেকে গরম খুন্তিটা পড়ে যায়। প্রত্যয় আরেক দফা চেঁচিয়ে উঠে। গরম খুন্তিটা একদম তার পায়ে পড়েছে। জেসির সেদিকে খেয়াল নেই। সে দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানার উপর থাকা ভীত বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদুরে গলায় বলে,

“ টাইগার? সোনা? বেশি ভয় পেয়েছিস? “

প্রত্যয় রেগে বলে,

“ তোমার কাছে স্বামী আগে নাকি ওই বিড়াল আগে? “

জেসি পাল্টা রেগে বলে,

“ লজ্জা করে না তোমার? একটা বোবা প্রাণীকে সারাদিন হিংসে করো। ভয় পেয়ে গিয়েছে ও। “

“ ওয়াও। তোমার এই ম্যাওম্যাও ভয় পেয়েছে এটা তুমি দেখতে পারছো। কিন্তু আমি ব্যথা পেলাম সেটা চোখে পড়ছে না? আর এই ম্যাওম্যাও রুমে ঢুকলো কি করে? তা-ও আবার বিছানায় উঠে কাথার ভেতর গিয়ে বসেছিলো। ম্যানারস শিখাও না একে? পর পুরুষের সঙ্গে একই কাথার নিচে বসে থাকতে লজ্জা করে না ওর? ছি! ইয়াক! “

জেসি প্রত্যয়কে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে বলে,

“ দিন দিন বাংলা সিনেমার জসিমের মতো আচরণ করছো তুমি। ধ্যাৎ! ওদিক দিয়ে হয়তো আমার রুটি পুড়ে যাচ্ছে। “

বলেই জেসি টাইগারকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। প্রত্যয় চরম হতাশ। কখনো ভাবে নি বিয়ে করে বউয়ের সঙ্গে একটা সতিনও ফ্রি পেতে হবে তার।

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠতেই প্রত্যয় কোমর ডলতে ডলতে উঠে দাঁড়ায়। বিছানা থেকে ফোনটা তুলে রিসিভ করে কানে ধরতেই অপর পাশ থেকে ফারদিন প্রফুল্ল গলায় বলে উঠে,

“ হেই ব্রো! হোয়াট’স আপ? “

“ একটা জীবনমুখী টিপস দিচ্ছি তোকে। পারলে কোথাও লিখে রাখ। জীবনে কখনো বিয়ে করতে গেলে আগে ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখবি পাত্রীর কোনো পোষা প্রাণী আছে নাকি। যদি দেখিস আছে তাহলে তোকে অগ্রীম অভিনন্দন। কারণ বিয়ের পর তুই বউয়ের সঙ্গে একটা সতিনও ফ্রি পাবি। একদম বাই ওয়ান গেট ওয়ানের মতো। “

__________

ক্লাস শেষ করে সদ্য বেড়িয়েছে নিশা। দুপুরের তীব্র গরমে শরীর সম্পূর্ণ ঘেমে আছে তার। আজকাল ভার্সিটি আসতে একটুও ইচ্ছে করে না তার। কেমন আলসেমি ঘিরে ধরেছে তাকে। ইচ্ছে হয় দ্রুত ক্লাস শেষ করে বাসায় চলে যেতে। ওই ছোট্ট বাসাটায় অনেক আরাম আর প্রশান্তি খুঁজে পায় সে।

ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে এতো মানুষের আনাগোনা উপেক্ষা করে মেইন গেট দিয়ে বের হতেই নিশা থেমে যায়। বোকার ন্যায় তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অত:পর চঞ্চল ভঙ্গিতে ছুটে এগিয়ে যায় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আখের শরবত খেতে ব্যস্ত মানুষটার কাছে।

নিশাকে দেখতেই সাইফ গ্লাসটা নামিয়ে রাখে। বিরক্তিকর মুখে বলে,

“ খুব গরম পড়েছে। ঘেমে বিশ্রী অবস্থা। আপনি খাবেন? “

নিশা মাথা দু’দিকে নেড়ে বলে,

“ আপনি আসবেন বলেন নি কেনো? “

“ মেয়ে মানুষের এই এক সমস্যা। অদ্ভুৎ প্রশ্ন বেশি করেন আপনারা। ব্রেকে আছি। লাঞ্চ সেরে আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আবার ফিরতে হবে আমার। শশুর আব্বা বলছেন আজকাল নাকি আমি খুব ঘর পাগল হয়েছি। শশুর আব্বাকে ভুল প্রমাণ করতে হবে। এখন থেকে বাসায় বউয়ের সামনে কম আর শশুর আব্বার চোখের সামনে বেশি থাকবো। “

নিশা হেসে বলে,

“ চলেন। রিকশা ডেকে নেই। “

নিশা এগিয়ে যেতে নিলেই সাইফ তার হাত ধরে আটকে দেয়। বলে,

“ উহু। রিকশার প্রয়োজন নেই। “

নিশা ভ্রু কুচকে বলে,

“ তাহলে? “

সাইফ পকেট থেকে একটা চাবি বের করে নিশার সামনে ধরে বলে,

“ রাজার প্রমোশন হয়েছে। এখন থেকে আর রাণীকে রিকশায় করে রাজার সাথে ঘুরতে হবে না। বরং রাজার ব্যক্তিগত বাইকে করেই ঘুরতে পারবে। “

নিশা একবার সাইফের হাতের চাবির দিকে তাকায় আবার সাইফের পিছনে থাকা নতুন চকচকে কালো রঙের বাইকটার দিকে তাকায়। মুহুর্তেই সে খুশিতে চিৎকার করতে নিলে সাইফ বলে,

“ থামুন, থামুন। রাস্তায় না প্লিজ। বাসায় গেলে বরং যত ইচ্ছা খুশিতে লাফালাফি করবেন। বেশি খুশি হলে জড়িয়েও ধরতে পারেন। মাইন্ড করবো না। “

নিশা সাইফের অর্ধেক কথাটুকু মেনে নেয়। একটুও লাফালাফি করে না। তবে খুশিমনে সাইফকে জড়িয়ে ঠিকই ধরে। সাইফ কিছু বলবে তার আগেই নিশা নিচু গলায় বলে,

“ জড়িয়ে ধরেছি আশেপাশের আগ্রহী নারী সমাজকে বুঝাতে যে এই লোকটা আমার স্বামী। “

নিশার কথা কানে পৌঁছাতেই সাইফ সরু চোখে আশেপাশে তাকায়। আসলেই বেশ ক’জন ভার্সিটিতে পড়ুয়া মেয়েরা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের দিকে বলতে মূলত সাইফকেই দেখতে ব্যস্ত তারা। সাইফ এই পর্যায়ে হাসে। নিচু গলায় বলে,

“ আপনি কিন্তু স্বামী নিয়ে দিনদিন খুব পসেসিভ হয়ে যাচ্ছেন ইয়াসমিন। “

নিশা বলে,

“ আপনি কি তা নিয়ে বিরক্ত? “

সাইফ উত্তর দেয় না। নীরব রয়। ইয়াসমিনের এই মিষ্টি মিষ্টি পসেসিভ ব্যবহার গুলো নিয়ে সে মোটেও বিরক্ত হয় না। বরং তার মনে হয় ব্যাপারটা খুব সুন্দর। নিশা সাইফকে ছেড়ে আগ্রহ ভরা নয়নে গিয়ে বাইকটাকে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। সাইফ অপলক সেই দৃশ্য দেখে। হঠাৎ তার মনে পড়ে বোরহান রাব্বানীর একটা উক্তি।

“ সহসা তুমি জীবনে এসেছ, ধুয়েছ কালি যত।
আমাকে তুমি পূর্ণ করেছো, আপন হিয়ার মত। “

__________

সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। জীবনটাও কখনো রূপকথা হয় না। বাণীর জীবনটাও রূপকথার কোনো মিষ্টি গল্প ছিলো না। তার জীবনের বিগত অধ্যায় গুলো ছিলো লোমহর্ষক। আসন্ন অধ্যায় গুলোও অজানা। তবে তার বর্তমানটা বেশ সুন্দর। এই বর্তমানটায় তার কাছে খুব আদুরে একটা মেয়ে, যত্নশীল স্বামী আর স্নেহময়ী মা তুল্য শাশুড়ি আছে।

সমুদ্রের তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এসবই ভাবছিলো বাণী। দমকা হাওয়ায় কাধে ঝুলন্ত লাল রঙা ওড়নাটা বেখাপ্পাভাবে উড়ছে। তার থেকে কিছুটা দূরেই প্রবল উৎসাহ নিয়ে ঘুড়ি উড়াচ্ছে বাবা আর মেয়ে। আকাশি রঙা ঘুড়িটা দেখতে অনেকটাই একটা প্রজাপতির ন্যায়। আট বছরের আফরা নাটাই হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আনাড়ি হাতে ঘুড়িটা উড়ানোর চেষ্টায় মত্ত দূর্জয়। কিন্তু ঠিকঠাক উড়াতে পারছে না। বারবার আকাশ ছেড়ে তা জমিনে নেমে আসছে। বহু চেষ্টার পরও ব্যর্থ হয়ে দূর্জয় হতাশ গলায় বলে,

“ আম্মুজি? এভাবে হচ্ছে না। আমাদের অলটারনেটিভ কোনো উপায় বের করতে হবে। “

আফরা বিজ্ঞের ন্যায় বলে,

“ ওহ গড বাবা! ঘুড়ি নাটাই ছাড়া উড়ে না। এটার কোনো অলটারনেটিভ ওয়ে নেই। “

দূর্জয় বাকা হেসে বলে,

“ বাবা একটা অলটারনেটিভ ওয়ে বের করে দেখাবো? “

আফরা আগ্রহী নয়নে তাকায়। দূর্জয় হঠাৎ বেশ খানিকটা সুতো হাতে রেখে একটানে সুতোটা মাঝখান থেকে ছিড়ে নাটাই থেকে ঘুড়িকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আফরার মুখ কালো করে দূর্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ এটা ছিলো তোমার অলটারনেটিভ ওয়ে? গ্রো আপ বাবা। এখন এইটা আর উড়বে না। “

দূর্জয় একগাল হেসে বাণীকে ডাকে। দূর্জয়ের ডাকে ধ্যান ফিরতেই বাণী তাদের কাছে এগিয়ে আসে। অবাক গলায় বলে,

“ সুতো কিভাবে কাটলো? “

আফরা বলে,

“ বাবা কেটেছে। “

দূর্জয় ঘুড়িটা বাণীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

“ আমি বললেই এটা একটু উপরের দিকে তুলে ছেড়ে দিও। “

বাণী বোকার মতো দাঁড়িয়ে রয় ঘুড়ি হাতে। দূর্জয় বলতেই তার কথা মতো ঘুড়িটা উপরে তুলে ছেড়ে দেয়। সুতো হাতে দূর্জয় তখন সামনের দিকে দৌড়াচ্ছিলো। বাতাসের দমকে এবার ঘুড়িটাও ঠিকঠাক উড়ছে। আফরাকে প্রফুল্ল দেখায়। সে-ও দূর্জয়ের পিছু ছুটে। বাণী ধীরে সুস্থে বালির উপর বিছানো ছোট চাদরটায় গিয়ে বসে। হাঁটু ভাজ করে বসে মুগ্ধ নয়নে সামনে তাকায়। দূর থেকেই তাদের আনন্দটুকু উপভোগ করে।

বাণীর মনে পড়ে যায় কিশোরী বয়সে এই ছেলেটার জন্যই কতো ধরনের পাগলামি করেছিলো সে। অথচ আজ? বিয়ের দুটো বছরেও কখনো মুখ ফুটে দূর্জয়কে বলা হয় নি যে সে দূর্জয়কে ভালোবাসে। অবশ্য দূর্জয়ও কখনো স্পষ্ট গলায় ভালোবাসার স্বীকারোক্তি করে নি। তবে তা নিয়ে বাণীর বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই। সব সম্পর্কে ভালোবাসি বলাটা গুরুত্বপূর্ণ না। ভালোবাসি তো বহু জনই বলে। দিনশেষে ক’জনই বা ভালোবাসতে জানে? ভালো রাখতে জানে? দূর্জয়ের ভালোবাসার প্রমাণ বাণী আর আফরার ভালো থাকার মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায়।

এই-যে চাপা আর ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের ছেলেটা শুধুমাত্র বাণীকে স্বাভাবিক করতে নিজের খোলস ছেড়ে কোমল আচরণটার বহিঃপ্রকাশ করেছে সেটা কি ভালোবাসা নয়? পেশাজীবনের কঠোর রূপটা ঘরের বাহিরে রেখে যখন আদুরে আর মনখোলা মুখটা নিয়ে আফরার কাছে যায় সেটা কি ভালোবাসা নয়? হিসাব করে কথা খরচ করা মানুষটা যখন স্ত্রী আর মেয়ের সামনে অগণিত কথার ঝুলি নিয়ে বসে সেটাও কি ভালোবাসা নয়? বাণীর কাছে তো এগুলোই ভালোবাসার সংজ্ঞা।

গভীর ভাবনায় বুদ বাণী টেরই পেলো না কখন দূর্জয় এসে তার পাশে বসেছে। দূর্জয় প্রশ্ন করে,

“ কি ভাবছো? “

বাণী হকচকিয়ে পাশে তাকিয়ে বলে,

“ তুমি কখন আসলে? “

“ যখন তুমি অন্য দুনিয়ায় ডুবে ছিলে। “

বাণী খানিকটা হেসে আবার সামনে তাকায়। লং ফ্রক পরিহিত আফরা তখন ঘুড়ির সুতো হাতে নিয়ে সমুদ্র তীর জুড়ে ছোটাছুটি করছে। দূর্জয় সেদিকে তাকিয়ে বলে,

“ অনেকদিন পর ওকে এরকম ছোটাছুটি করতে দেখছি। পড়াশোনায় এতটা ডুবে থাকে চঞ্চলতা যেনো ভুলেই গিয়েছে। আমি ওর চঞ্চলতাটা খুব মিস করি। “

বাণী পাশ ফিরে দূর্জয়ের দিকে তাকায় আবার। কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে লাজুক গলায় বলে,

“ আমরা তিন থেকে শীঘ্রই চার হবো। “

দূর্জয় বাণীর দিকে তাকায়। এক মুহুর্ত বাণীর মুখখানি দেখে নিয়ে কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে চমকায়। ঠোঁট কামড়ে খুশিটুকু চেপে গিয়ে বাণীকে প্রশ্ন করে,

“ আর ইউ শিওর? “

বাণী মাথা নুইয়ে বলে,

“ তিন মাস চলছে। “

দূর্জয় কি বলা উচিত বুঝতে পারে না। বাধন হারা খুশিতে মানুষ যেমন কথা হারিয়ে বসে তার অবস্থাও হয়েছে সেরকম। কেবল নির্মল চোখে মাথা নত করে বসে থাকা বাণীকে দেখছে। এই মেয়েটাকে সে কতটা দিতে পেরেছে তা জানা নেই দূর্জয়ের। কিন্তু এই মেয়েটা তার জীবনে এসে তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। দূর্জয় উপলব্ধি করে তার সমস্ত শরীরে ঠান্ডা কিছু বয়ে চলেছে। আনমনেই তার চোখ গড়িয়ে এক বিন্দু অশ্রু নেমে আসতে দেখা যায়। বাণী চোখ তুলে তাকাতেই তা দেখতে পায়। এ নিয়ে দ্বিতীয় বার সে স্বচক্ষে দূর্জয়ের চোখে অশ্রু দেখলো। প্রথম বার দেখেছিলো আফরা হসপিটালে ভর্তি থাকাকালীন। বাণী নম্র স্বরে শুধায়,

“ কাদছো তুমি। “

দূর্জয় এগিয়ে গিয়ে পরম আবেশে বাণীর গাল ছুঁয়ে তার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। প্রসন্ন হেসে বলে,

“ আমাকে দ্বিতীয় বার বাবা বানানোর জন্য তোমাকে কি দেই বলো তো বাণী? এই খুশিটা কিভাবে শোধ করবো আমি? আমার মতো অধমের জীবনটা পরিপূর্ণ করার জন্য তোমাকে কিভাবে শুকরিয়া জানাবো? “

বাণীর দু চোখের কার্নিশ ভিজে উঠে। বলতে ইচ্ছে করে,

“ বছর দুই আগে তুমি নিঃস্বার্থভাবে একটা বাচ্চাকে আপন করে নিয়েছিলে। বাচ্চাটা তোমার রক্ত না হওয়া সত্ত্বেও তুমি তার বাবা হয়ে দেখিয়েছো। আজ দুটো বছর পর তার ইনাম সরূপ আল্লাহ তোমাকে আরেকটা সন্তান দিলো। “

মনের কথাটুকু আর মুখ ফুটে বলতে পারে না বাণী। তার আগেই দূর্জয় তৃপ্তি মাখা হাসি নিয়ে গলা উঁচিয়ে ডাকে,

“ আফরা? আম্মুজি। এদিকে আসুন। “

বাবার ডাক শুনতেই আফরা ছুটে আসে। মাম্মা বাবার মুখখানি দেখে আফরা চট করে প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে তোমাদের? “

দূর্জয় মেয়েকে কাছে টেনে তার কপালেও একইভাবে চুমু খেয়ে বলে,

“ আপনাকে আপু ডাকার জন্য একজন চলে আসবে শীঘ্রই। “

মেয়ের সামনে লজ্জায় আরেকটু নুইয়ে যায় বাণী। আফরা হেসে বলে,

“ সত্যি? মাম্মা আমি আপু হবো? একটা ছোট্ট বেবি আসবে? “

বাণী হেসে বলে,

“ হ্যাঁ। “

“ বেবিটা ছেলে হবে নাকি মেয়ে? “

দূর্জয় প্রশ্ন করে,

“ আপনার কি চাই? “

আফরা কিছুটা ভেবে উত্তর দেয়,

“ ছেলে হোক বা মেয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। বেবি হেলথি হওয়াটা বেশি ইম্পোরট্যান্ট। আর মাম্মার বেশি বেশি টেক কেয়ার করাটাও ইম্পোরট্যান্ট। তাই না বাবা? “

মেয়ের বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়ে দূর্জয় আরেক দফা হাসে। ঠিক সেই মুহুর্তে তার ফোনটা শব্দ তুলে বেজে উঠে। দূর্জয় ফোন বের করে নাম্বারটা দেখে উঠে দাঁড়ায়। কলটা রিসিভ করতেই অপর প্রান্তের মানুষটা প্রফেশনাল গলায় অর্ডার জানায়,

“ মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়, আপনাকে এই মুহুর্তে ঢাকায় যেতে হবে। ইট ইজ এন ইমারজেন্সি। ব্যাপারটার গুরুত্বপূর্ণ আশা করছি বুঝতে পারছেন। “

দূর্জয় বলতে পারে না যে সে পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে এসেছে। ডিপার্টমেন্টে তার ছুটির খবরটা সকলের জানা। ব্যাপারটা জেনেও যেহেতু তাকে ডাকা হয়েছে তার মানে খুবই জরুরী কোনো কেস। দূর্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে একবার বাণীর দিকে তাকায়। বাণী আর আফরা ততক্ষণে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। দূর্জয়ের গম্ভীর মুখটা দেখেই বাণী কিছু একটা আঁচ করতে পারে। দূর্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ রজার দ্যাট স্যার। আমি খুব শীঘ্রই পৌঁছে যাবো। “

“ খুব শীঘ্রই নয় দূর্জয়, এখুনি। আপনার লোকেশন অনুযায়ী গাড়ি পাঠানো হয়েছে। আপনার অপেক্ষায় আছে তা। আপনাকে এখুনি এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেওয়া হবে। “

দূর্জয় কোনো ভনিতা ছাড়া বলে,

“ ওকে স্যার। “

ফোনটা কেটেই দূর্জয় ঘুরে তাকায়। স্পষ্ট গলায় বাণীকে বলে,

“ অর্ডার এসেছে। এখুনি যেতে হবে। “

বাণী অবাক হয় না। বরং স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ সমস্যা নেই। আমরা চলে যেতে পারবো বাসায়। তুমি যাও। “

দূর্জয় বলে,

“ একা যেতে হবে না। মাসুদকে কল করে বলে দিচ্ছি। ও তোমাদের বাসায় নিয়ে যাবে। “

আফরা বাবাকে আস্বস্ত করে বলে,

“ তুমি নিশ্চিন্তে যাও বাবা। আমি আছি। মাম্মা আর বেবির খেয়াল রাখবো আমি। “

দূর্জয় হেসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। বাণী দাঁড়িয়ে তা দেখছিলো। দূর্জয় একহাত বাড়িয়ে বাণীকেও কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে দেয়। মাথাটা বাণীর কানের কাছে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ নিজের আর আমার দুই সন্তানেরই খেয়াল রাখবে। সামান্যতম অবহেলা কিন্তু আমি মেনে নিবো না। “

বাণী ছোট্ট করে উত্তর দেয়,

“ রাখবো। “

দূর্জয় আর অপেক্ষা করে না। স্ত্রী আর সন্তানকে রেখে পেশাগত দায়িত্ব পালনে পা বাড়ায়। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আবার পিছনে ফিরে তাকায়। বাণী আর আফরা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছিলো। দূর্জয়কে তাকাতে দেখেই দু’জন হেসে বিদায় জানানোর ভঙ্গিতে হাত তুলে নাড়ে। দূর্জয়ও হেসে হাত নাড়ে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিবারকে সে যতটাই ভালোবাসুক না কেন, দেশ সর্বদাই তার কাছে অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রথমে থাকবে। দিনশেষে নিজের শপথ তো আর সে ভুলতে পারবে না।

“ সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা
সর্বত্র আমরা দেশের তরে। “

সমাপ্ত…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

[ অবশেষে শেষ হলো রক্তসন্ধ্যার যাত্রা। এই উপন্যাসটা বেশ কিছু কারণে আজীবন আমার মনের একটা নির্দিষ্ট জায়গা দখল করে রবে। উপন্যাসটা লেখার সময়সীমা ছিলো দীর্ঘ ছয় মাস। যদিও এই উপন্যাসের কাহিনী সাজানো শুরু করেছি আমি তার-ও বহু আগে। সবমিলিয়ে এক বছরের দীর্ঘ যাত্রা। লেখার সময় বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে আমাকে। শারীরিক, মানসিক। তাছাড়াও ভার্চুয়াল জগতের তিক্ততা। আলহামদুলিল্লাহ দমে যাই নি। যতবার বাঁধা পেতাম আরো বেশি মনে হতো, এটা সম্পন্ন না করে আমি থামবো না। যা-ই হোক। আমার তরফ থেকে আমি নিজের সম্পূর্ণ এফোর্টটা দিয়েছি। তবুও ভুল ক্রুটি হয়ে থাকলে তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আর এই যাত্রায় যেই সুন্দর মনের মানুষ গুলো দোয়া, স্নেহ এবং দামী পরামর্শ গুলো দিয়েছেন সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ আমি। ভালো থাকুন, ভালো রাখুন ]