এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৫+৬

0
227

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫.

কালো বোরখা পরিহিত নারী এবং ফ্রক ও কালো হিজাব পরিহিত বাচ্চা মেয়েটার দিকে বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইলো পাঁচ জোড়া চোখ। ছোট মেয়েটা নিজের সরু চোখ দুটো গরম করে তাকিয়ে আছে বন্দুকধারী পাঁচ যুবকের দিকে। ভাবখানা এমন যেন চোখ দিয়েই এই যুবক দলকে ভস্ম করে দিবে সে। বাণী এহেন পরিস্থিতি দেখে ভয় পায়। দু’হাতে মেয়েকে আগলে আরেকটু নিজের সাথে মিশিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টায় মত্ত সে। ভীত স্বরে সেই যুবক দলের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“ সরি। আমরা চলে যাচ্ছি। “

বলেই সে একহাতে কোনো মতে গাড়ির দরজা খুলে বহ্নিকে কোলে নিয়ে নেমে যায়। মনে মনে আওড়াচ্ছে সে বিপদ হতে রক্ষা পাওয়ার দোয়া। কিন্তু বিপদ হতে রক্ষা পেলেও সে রাস্তার অপরপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুঠাম দেহী পুরুষের দৃষ্টি হতে রক্ষা পায় না। নেকাব সড়ে যাওয়ার ফলে তার উন্মুক্ত মুখশ্রী স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেই মুখ পানে অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়েছে সেই পুরুষ।

বাণীর মুখ তখন ভয়াবহ কালো। গলাটা একদম শুকিয়ে যেনো খরাপূর্ণ ভূমির ন্যায় এক বিন্দু পানির অপেক্ষায় তড়পাচ্ছে। সারা মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভীতিপ্রবণ অবস্থা। বাঘের খাঁচা থেকে পালিয়ে কিনা শেষমেশ সিংহের গুহার মুখে এসেই তাকে ধরা পড়তে হলো?

নির্জন রাস্তাটা বিনা বাঁধায় ক্রস করে দূর্জয় জিপ গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাণীর মুখোমুখি এসে থামে। এক মুহুর্ত বাণীর পানে চেয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকায় বাণীর কোলে থাকা বাচ্চা মেয়েটার দিকে। মুহুর্তেই তার বিচক্ষণ দৃষ্টি গোলগাল মুখশ্রীর বাচ্চা মেয়েটার মুখের আদলের সাথে পরিচিত কোনো এক চেহারার খুব মিল খুঁজে পায়। মনে মনে নিশ্চিত হয় বাচ্চাটা বাণীর নিজেরই। বাণীর কিশোরী বয়সের চেহারার অনেকটাই প্রতিচ্ছবি এই শিশুর মুখে ফুটে উঠেছে।

দূর্জয় কিছু বলবে তার পূর্বেই গাড়ির ভেতর হতে জানালা দিয়ে মাথা বের করে সাইফ বলে উঠে,

“ স্যার, এই মহিলা কোনো কথাবার্তা ছাড়া হুট করে এসে গাড়িতে উঠে বসেছিলো। আই এম শিওর কোনো ঘাপলা আছে। মহিলা কোনো স্পাই নয়তো? “

সাইফের বলা কথাটুকু শুনে দূর্জয় ভ্রু কুচকে বাণীর পানে তাকায়। সাইফের কথার পিঠে নিজের মা কে ডিফেন্ড করে বহ্নি বলে উঠে,

“ চুপ থাকো ষ্টুপিড আংকেল। আমার মাম্মা কোনো স্পাই না। “

ছোট বাচ্চার মুখে এরকম কথা শুনে দূর্জয় অবাক হয় না। বাণী মেয়েকে চুপ থাকার ইশারা করে বলে উঠে,

“ বড়দের মাঝে কথা বলাটা ব্যাড ম্যানারস মা। “

বহ্নি সাথে সাথে চুপ হয়ে যায়। কিন্তু আড়চোখে কটমট করে সাইফের দিকে তাকিয়ে থাকে। সাইফ সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে পাল্টা রেগে বলে উঠে,

“ স্যার, এই মহিলার কথা জানিনা, কিন্তু এই বাচ্চা শিওর কোনো ওয়েল ট্রেইনড স্পাই। আপনি জানেন না এই বাচ্চা আমাদের দিকে ওর হাতে থাকা রিভলবার তাক করেছিলো। কি দুঃসাহস দেখেছেন? “

সাইফের কথায় দূর্জয় বিরক্ত হয়। সে সাইফের কথায় পাত্তা না দিয়ে ক্ষীণ স্বরে বাণীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে,

“ এখানে কি করছো? “

বাণী পাল্টা বলার মতো কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। তাই সে নীরব রয়। তার এই নীরবতা দূর্জয়ের পছন্দ হয় না। এক প্রশ্ন দ্বিতীয় বার করা ওর পছন্দ নয়। তবুও সে ফের প্রশ্ন করে,

“ তোমার স্বামী কোথায়? বাচ্চা নিয়ে একা এখানে কি করছো? “

বাণী শুষ্ক ঠোঁট জোড়া সামান্য ভিজিয়ে নিয়ে মনে মনে উত্তর সাজাতে থাকে। তখনই হঠাৎ তার দৃষ্টি স্থির হয় দূরে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে নেমে আসা হালকা ঘর্মাক্ত নীল শার্ট পরিহিত পুরুষের দিকে। কালো প্যান্টের সাথে ইন করে পড়ে থাকা শার্টটার হাতা দুটো কনুই পর্যন্ত গোটানো। মুখে মাস্ক পড়ে থাকার ফলে তার মুখ অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তার উন্মুক্ত বাজপাখির ন্যায় চোখ জোড়া দেখতেই বাণীর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। হারিয়ে ফেললো শব্দের সমারোহে সাজানো দূর্জয়ের জন্য উত্তরটা। উল্টো দিকশূন্য হয়ে সাহায্যের আবদার নিয়ে দূর্জয়ের একহাত ধরে তীব্র উৎকন্ঠা নিয়ে বলে উঠে,

“ সাহায্য করুন দয়া করে। এই মুহুর্তে এখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে চলুন। “

বাণীর এই অহেতুক আপনি সম্বোধন এবং অযাচিত স্পর্শ দূর্জয়কে বিরক্ত করে তুলে। তবুও সে সেটা প্রকাশ করে না। পাল্টা কোনো প্রশ্নও করে না। শুধু সামান্য মাথা নেড়ে বাণীকে বলে,

“ গাড়িতে উঠে বসো। “

বাণী এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে দ্রুত নিজের নেকাবটা মুখের উপর ফেলে দেয়। অত:পর পূর্বের জায়গায় সাইফের পাশে উঠে বসে। দূর্জয় সম্পূর্ণ দৃশ্যটা বিচক্ষণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে। বাণী সম্পর্কিত খুব গভীর কোনো ব্যাপার আছে যা তার অজানা। তা সে আঁচ করতে পারছে। কিন্তু আপাতত এই বিষয় নিয়ে সে প্রশ্ন করে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। হিরণের চোখের আড়ালেই বাণী মেয়ে সহ সেই শিকারপুরি হতে প্রস্থান করে।

__________

আয়তকার টেবিলের উপর থাকা একটা ছবির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা। চোখে মুখে তার কাঠিন্য ভাব। টেবিলের অপরপাশে দু হাত পিঠের পিছনে ভাজ করে সোজা দাঁড়িয়ে থাকা দূর্জয় বলে উঠে,

“ আট ঘন্টা অপেক্ষা করেছি স্যার। কিন্তু এই লোকের দেখা পাই নি। “

জুলফিকার মুজতবার কপালে চিন্তার ছাপ দেখা যায়। তিনি কিছুটা চিন্তিত গলায় বলে উঠে,

“ বিশ্বস্ত সূত্রমতে তো ওর খুব সকাল সকালই স্টেশনে এসে পৌঁছানোর কথা। কিন্তু ও পৌঁছালো না কেন বলো তো? ভুলেও আমাদের ফাঁদ এটা তা আঁচ করতে পারে নি তো? “

দূর্জয় আশ্বস্ত করে বলে উঠে,

“ আমার তা মনে হয় না স্যার। হয়তো অন্য কোনো কারণে ও আজ প্ল্যাটফর্মে দোকান খুলে বসে নি। তবে চিন্তা করবেন না। লেফটেন্যান্ট প্রত্যয় এবং সাদাত সেখানে আছে। নজর রাখছে। দেখামাত্রই সুকৌশলে ওকে আটক করে নিয়ে আসবে। “

জুলফিকার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ সেটাই আমার আশা দূর্জয়। আমাদের হাতে কেবল একটাই ক্লু আছে এই মুহুর্তে। তা হলো এই লোক। মোর্শেদ। ওকে ধরলেই একমাত্র এই কেসের আরো গভীরে প্রবেশের সুযোগ পাবো আমরা। ওর ধরা পড়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ না করুক যদি আবারও এরকম কোনো জঙ্গি হামলা ঘটে! “

দূর্জয়ের মুখ মুহুর্তেই শক্ত হয়ে আসে। সেই ভয়ংকর রাতের স্মৃতি এক মুহুর্তের জন্যও ভুলে নি সে। যেই রাতে সম্পূর্ণ দেশ সাক্ষী হয়েছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞের। দেশি বিদেশি সকল গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছিলো কেবল একটি শিরোনাম – “ A massive attack on Ever View Restaurant of Dhaka. 46 people are taken as hostages. “ সেই রক্তাক্ত জিম্মি সংকটের অবসান ঘটে নিরপরাধ ২৭ জন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়ে। যারা বেঁচে গিয়েছিলো তারা সকলে বয়ে বেড়াচ্ছে সেই ভয়াবহ রাতের ধ্বংসলীলার স্মৃতি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার হয় এক নতুন শিরোনাম – “ A long slaughtered night ended with 27 hostages killed in attack on Banani’s Ever View Restaurant. গত ছয় মাস ধরে যেই ঘটনা সামরিক বাহিনীর ঘুম হারাম করে দিয়েছে, সেই ঘটনার পিছনে আসল হোতা কে তা না জানা পর্যন্ত শান্তি পাবে না দূর্জয়।

দূর্জয় শান্ত গলায় বলে উঠে,

“ নেকড়ের মতো মূল পরিকল্পনাকারীকে তাড়া করে বেড়াবো স্যার। ওই হামলার সাথে জড়িত সকলকে খুঁজে বের করবো। আমার দেশের মাটি হতে ওদের নিশ্চিহ্ন না করে আমি দম নিবো না। “

__________

রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার চারপাশটা কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে দেখতে ব্যস্ত বাণী। বিগত সময়ে সে এতটুকু বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে দূর্জয় এখন সামরিক বাহিনীর অধিনে কর্মরত। তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুঠাম দেহী পাঁচ জন যুবক। যাদের সকলের দৃষ্টিই আপাতত সরু চোখে তাকিয়ে থাকা বহ্নির দিকে নিবদ্ধ। সাইফ বাচ্চা মেয়েটার সেই সরু দৃষ্টি দেখে বিরক্ত হয়। এভাবেই তার বাচ্চা কাচ্চা পছন্দ না। এদেরকে তার জ্বলজ্যান্ত ক্যাসেট ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। তবুও পুরো রাস্তা সে এই বিরক্তিকর বাচ্চাটাকে নিজের পাশে সহ্য করেছে। তার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা রাফি অনেক কিছু ভাবতে ব্যস্ত। এই মহিলার সাথে তাদের মেজরের কি সম্পর্ক? বাই এনি চান্স এই মহিলা মেজরের এক্স নয়তো? যার বাচ্চার বাবা হতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত মেজর মামা হয়ে গেলো। নিজের এই অদ্ভূত ভাবনার প্রতি বেশ বিরক্ত হয় রাফি। এটা কিভাবে সম্ভব? এরকম কিছু হলে মেজর নিশ্চয়ই এই মহিলার সাহায্য করতো না?

তাদের আপন মনের ভাবনার ভীড়ের ইতি ঘটে ইউনিফর্ম পরিহিত দূর্জয়ের আগমনে। দূর্জয়কে এগিয়ে আসতে দেখেই বাণী সাথে সাথে নিজের দৃষ্টি নত করে ফেলে। দূর্জয় সামনে এসে কোনো ভনিতা না করে স্পষ্ট গলায় বলে,

“ আই নিড টু টক টু ইউ বাণী। “

সকলের সামনে দূর্জয়ের এহেন নিঃসংকোচ কথাটা কি আবদার ছিলো না আদেশ তা বাণীর বোধগম্য হলো না। সে নীরবে মাথা নেড়ে এগুতে নিলেই দূর্জয় বলে উঠে,

“ একা কথা বলতে চাচ্ছি। কোনো সমস্যা না থাকলে বহ্নিকে ওদের কাছে রাখতে পারো। আই এম শিওর দেই উইল হ্যাভ এ গুড টাইম টুগেদার। “

দূর্জয়ের কথা শুনে বাণী একপলক মেয়ের দিকে তাকায় অনুমতির আশায়। বহ্নি অনেকটা ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলে উঠে,

“ ডোন্ট ওয়ারি মাম্মা। আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইসেল্ফ। “

বহ্নির কথা শুনে সাইফ সহ বাকি চারজন লেফটেন্যান্ট বিষম খায়। জুনায়েদ সামান্য হেসে বলে,

“ পাকনি খুব। “

জুনায়েদের এই সম্বোধন বহ্নির পছন্দ হয় না। পাকনি আবার কেমন ডাক? কই তার মাম্মা পাপাতো কখনো তাকে এসব অদ্ভুত নামে ডাকে না। দূর্জয় বহ্নির মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে বাণীর সাথে হেঁটে অন্যদিকে চলে যায়।

সাথে সাথে সাইফ হাঁটু গেড়ে বহ্নির সামনে বসে বলে,

“ এইযে কিড্ডো! বড়দের দিকে চোখ রাঙানো খুব খারাপ কাজ। আর আমাকে ষ্টুপিড বলেছো কোন সাহসে? আমাকে দেখে তোমার ষ্টুপিড মনে হয়? “

বহ্নি ঠোঁট উল্টে কিছুক্ষণ সাইফের দিকে তাকিয়ে থেকে জবাব দেয়,

“ উহু। আই ওয়াজ রং। তুমি দেখতে মারভেল সিনেমার একটা ক্যারেক্টরের মতো। “

মারভেল সিনেমার নাম শুনে সাইফের বিরক্তিকর মুখে সামান্য হাসি ফুটে উঠে। বাচ্চাটাকে সে যতটা বিরক্তিকর ভেবেছিলো ততটা বিরক্তিকর নয়। কার্টুন ফ্যান হওয়ার বয়সে মেয়েটা মারভেল সিনেমার ফ্যান। আহ! বাচ্চাটার চয়েজ ভালো বলতে হয়। সাইফ প্রচুর আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কোন ক্যারেক্টরের মতো দেখতে আমি? “

বহ্নি ছোট ছোট দাঁতগুলো বের করে হেসে জবাব দেয়,

“ দ্যা আমাজিং স্পাইডার ম্যান টু এর ক্যারেক্টর হ্যারি ওসবর্নের মতো। “

সাথে সাথেই সাইফের মুখটা চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো হয়ে যায়। পিছন থেকে ভেসে আসে রাফি, জুনায়েদ, ফারদিন ও রিদওয়ানের হাসির শব্দ। সাইফ বিরস মুখে অন্যদিকে ফিরে বলে উঠে,

“ শালা তোর বাপ হ্যারি ওসবর্ন। “

সাইফের বিরস মুখে বলা কথাটা বহ্নির কর্ণগোচর হয় না। সে সাথে সাথে জ্বলে উঠে সাইফের পেশিবহুল হাতে নিজের ছোট ছোট দু হাত দ্বারা খামচি বসায়। সাইফ মৃদু চিৎকার করে নিজের হাত সরিয়ে নিতেই বহ্নি তাকে ভেংচি কেটে বলে উঠে,

“ আমার পাপা কোনো ভিলেন না। হি ইজ এ হিরো। “

ফারদিন সাইফকে সচেতন করে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ মেয়েরা বাপের বিষয়ে খুব সেনসিটিভ হয়। স্টে সেফ। “

__________

গোধূলি লগ্নে সবুজ ঘাসের বুকে একটা বিশাল গাছের নিচে এসে দাঁড়ায় বাণী ও দূর্জয়। এখান থেকে অবশ্য দূরে পাঁচজন সামরিক সদস্যের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা বহ্নিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাণী সেদিকে তাকিয়ে রয় একদৃষ্টিতে। দূর্জয় নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে,

“ তোমার ফ্যামিলি কোথায়? “

বাণী দৃষ্টি ফেরায় না। সে অন্য পানে চেয়ে থেকেই শান্ত গলায় পাল্টা প্রশ্ন করে,

“ ফ্যামিলি দ্বারা কাকে বুঝাতে চাইছেন? “

“ বহ্নির বাবা। “

বাণী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠে,

“ চট্টগ্রামেই আছে। “

“ দুপুরের সেই ইন্সিডেন্টটা এক্সপ্লেইন করো। “

বাণী এবার দৃষ্টি নত করে বলে,

“ আমি আর বহ্নি ঢাকায় ফিরছিলাম। বহ্নির ট্রেইনে ট্রাভেল করার খুব ইচ্ছে ছিলো। ওর পাপা কিছু জরুরি কাজ থাকায় আমাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে চলে যায়। তখনই সেদিনকার সেই ছিনতাইকারীদের আমি ট্রেনে দেখতে পাই। তাই ভয় পেয়ে মেয়েকে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ি। স্টেশন প্ল্যাটফর্ম থেকে পালিয়ে এসে সামনে ওই জিপ গাড়ি দেখতে পেয়ে কিছু না ভেবে উঠে পড়ি। “

বাণীর সাজিয়ে বলা অতি সুন্দর মিথ্যেটা দূর্জয় মনযোগ দিয়ে শুনে। এরকম অবিশ্বাস্যকর একটা বর্ণনায় সে বিন্দুমাত্র সত্যতার ছোঁয়া খুঁজে পায় না। তবুও সে পাল্টা আর কোনো প্রশ্ন করে না। এর থেকে বেশি আগ্রহ দেখানোটা সমীচীন হবে না। আর নিজের সীমা লঙ্ঘন করা দূর্জয়ের স্বভাব বহির্ভূত কাজ।

বাণী সামান্য গলা ঝেড়ে বলে উঠে,

“ সেই মুহুর্তে আমাদের ওই বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা নিজেরাই চলে যেতে পারবো এখন। “

দূর্জয় সরু চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,

“ আমি একজন নিরাপত্তা কর্মীকে বলে দিবো। যেখানে যেতে চাও পৌঁছে দিয়ে আসবে। “

বাণী আর কোনো কথা বলে না এই বিষয়ে। সে উল্টো ফিরে বহ্নির দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে শুরু করে। দূর্জয় তার যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রয়। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে অতীতের অপ্রয়োজনীয় এক দৃশ্য।

অতি মনযোগী ফার্স্ট বেঞ্চার দূর্জয় ক্লাসে বসে স্যারের লেকচার নোট করতে ব্যস্ত। আচমকা বেখেয়ালি বসত তার দৃষ্টি গিয়ে ঠেকে তার ঠিক পাশের সারিতেই ফার্স্ট বেঞ্চে বসে টেবিলে মাথা এলিয়ে রাখা মেয়েটার দিকে। ক্লাসের সবথেকে অমনোযোগী ব্যাক বেঞ্চার স্টুডেন্টটা যে গত দু এক মাস ধরে সামনের সিটে সবার আগে এসে জায়গা দখল করে বসছে তা দূর্জয়ের দৃষ্টি এড়ায় নি। তা নিয়ে অবশ্য তার কোনো সমস্যাও নেই। তার সমস্যা হলো এই চরম অমনোযোগী মেয়েটা সারাক্ষণ তার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকে। বিষয়টা দূর্জয়ের জন্য বেশ অস্বস্তিকর বটে। তবুও সে যেচে এই ব্যাপারে কখনো কথা বলতে যায় না। তার একটাই কারণ যেনো মেয়েটা কোনো সুযোগ না পায়।

দূর্জয়ের অস্বস্তি আরো বাড়িয়ে দিতেই হয়তো মেয়েটা আচমকা টেবিল হতে মাথা তুলে সবার অগোচরে একটা ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে মারে। বাণীর এহেন কাণ্ডে দূর্জয় বিষম খায়। পরমুহূর্তেই বাণীর বত্রিশ পাটির দাঁত বের করা হাসি দেখে তার বিষম রাগে পরিণত হয়। তার মন চাইছে এই মুহুর্তে গিয়ে এই মেয়ের নামে ইভটিজিং এর মামলা ঠুকতে। কিন্তু আফসোস! এহেন অভিযোগ শুনলে পুলিশ সমাজ তার উপর হাসবে।

অতীতের পৃষ্ঠা উল্টে বর্তমানে ফিরে আসে দূর্জয়। সেই চরম অসভ্য আর বেহায়া মেয়েটাই কিনা এখন সারাক্ষণ নিজের চোখ নত করে চলে। কারো স্ত্রী এবং এক সন্তানের মা হওয়ার ফলেই কি বাণীর মধ্যে এহেন পরিবর্তন এসেছে? কে জানে?

__________

রাত্রি তখন সাতটা। বাণী বহ্নিকে কোলে নিয়ে একটা ক্যাব বুকিং দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ভাড়া ঠিক করছে। দূর্জয়ের পাঠানো সেই নিরাপত্তা কর্মী তাকে তার কথামতো একটা বাড়ির সামনে এনে ড্রপ করে দিয়ে যায়। সেখান থেকেই বাণী খুব সতর্কতার সহিত সোজা এখানে এসে পৌঁছায়। সে চাইলেই সেই নিরাপত্তা কর্মীকেবলে সোজা এখানে এসেই নামতে পারতো। কিন্তু সে দূর্জয়কে নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে মোটেও জড়াতে চাইছে না। তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে জড়ানো মানেই দূর্জয়ের বিপদ। সেই সামান্য বিপদের রিস্কটুকু নিতেও রাজি না বাণী।

ভাড়া ঠিক করেই বাণী নির্ধারিত ক্যাবের দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাস্তায় একটা পুরুষের অবয়ব দেখতে পায়। বাণীর পা জোড়া আপনাআপনি থমকে যায়। নিজের নত দৃষ্টিটা ধীরে ধীরে উঁচু করে সে সেই পুরুষের মুখপানে চায়। মুহুর্তেই তার একহাতের মুষ্টিতে আবদ্ধ ব্যাগটা কিছুটা শব্দ তুলে রাস্তায় পড়ে যায়। নেকাবের আড়ালে ঢাকা তার মুখটা ভয়ে একটুখানি হয়ে যায়। সম্পূর্ণ চিত্ত অসার অনুভূত হয়।

বাণীর অসার শরীরের হাতের বাধন আলগা হয়ে আসতে নিলেই বহ্নি তার কাধে গুজে রাখা মুখ তুলে সামনে ফিরে তাকায়। সাথে সাথেই সে প্রফুল্ল গলায় চিৎকার করে উঠে,

“ পাপা। “

মেয়ে দুই হাত বাড়িয়ে দিতেই হিরণ নিঃশব্দে মেয়েকে নিজের কোলে নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। বাণীর একহাতের কব্জি ধরে অতি থমথমে স্বরে বললো,

“ গেম ওভার। এখন চলো। “

বাণীর সম্পূর্ণ চিত্ত প্রবল ভয়ে শীতল হয়ে আসে। নেকাবের ভেতর একটুখানি নিঃশ্বাসের জন্য সে হাসফাস করছে প্রবল। ঘোলাটে চোখ জোড়ার সামনে সব আচানক ঝাপসা হয়ে আসে। নিস্তেজ শরীরটা চেতনাশূন্য হতেই তা সামনের দিকে ভিড়ে।

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৬.

শান্ত রুম জুড়ে মোমের মিটিমিটি আলো জ্বলছে। অতি সাধারণ তবে বেশ মজবুত কাঠের দ্বারা নির্মিত দরজা এবং থাই গ্লাসের তৈরী জানালা বদ্ধ রয়েছে। বাহিরে প্রকৃতিতে বয়ে চলেছে উত্তাল ঝড়ো হাওয়া। শুভ্র ও নীল রঙা বিছানার চাদরের উপর চোখ বুজে শুয়ে রয়েছে এক নারী। পড়নের কালো বোরখাটা আর গায়ে নেই আপাতত। কেবল একটা কমলা ও গোলাপি রঙা কামিজ এবং সালোয়ার দ্বারা আবৃত তার শরীর।

রাত হয়তো তখন প্রায় বারোটা ছুঁই ছুঁই। চেতনাহীন নারীর চেতনা ফিরে খুবই সন্তর্পণে। শীতল আবহাওয়ার শিরশিরে অনুভূতি লোমকূপে ছড়িয়ে পড়তেই বাণী হালকা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। মাথার কাছটায় ছোট্ট কেবিনেটের উপর জ্বলমান মোমের আলোটাও তার ক্লান্ত চোখে খুব তীক্ষ্ণ অনুভূত হচ্ছে। মোমের টিমটিমে আলোতে চারিদিকে একবার চোখ বুলাতেই সে উপলব্ধি করে যে সে এই মুহুর্তে কোথায় আছে।

এই সহজ উপলব্ধিটা বাণীর মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই সে ভীত নয়নে ফের চারিদিকে তাকায়। সাথে সাথে তার চোখ গিয়ে ঠেকে বিছানা হতে খানিকটা দূরে লেদারের তৈরী এক সিঙ্গেল সিটের সোফার দিকে। বিশাল জানালার দিকে মুখ করা সোফাটাতে দূর হতে এক পুরুষ অবয়ব দেখা যাচ্ছে। সেই পুরুষ অবয়বটা কার হতে পারে তা বুঝতে এক দন্ড সময় লাগে না বাণীর।

ভীত সে ভয়ে কুকড়ে হাতের কাছে থাকা বিছানার চাদরটুকু খামচে ধরে। অশান্ত দৃষ্টি আশেপাশে তাক করে বোঝার চেষ্টা করে বর্তমান পরিস্থিতি। বহ্নি? বহ্নি কোথায়? আর রুমে মোমই বা কেনো জ্বলছে? এই বিলাসবহুল বাড়ি জুড়ে ইলেক্ট্রিসিটির অভাব মেটানোর জন্য আইপিএস তো সদা প্রস্তুত। তবে এই মোমের আলো জ্বালানোর পিছনে কারণ কি?

ভীত বাণী কোনো দিক দিশা না পেয়ে ওড়নাটা গলায় দিয়ে ধীর কদম ফেলে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায়। তবে হিরণের মুখোমুখি হওয়ার সাহস তার হচ্ছে না। তাই সে নীরবে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দরজার দিকে এগুতে নেয়। সাথে সাথে পিছন হতে একটা পরিচিত শিসের সুর ধ্বনি সম্পূর্ণ রুম জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সহসা বাণীর পা জোড়া থেমে যায়। অসহায় সে নিজের নেত্রপল্লব বুজে নেয়। রুমের এককোণ হতে মৃদু শব্দের পদধ্বনি কাছে এগিয়ে আসতে আসতে একটা সময় ঠিক বাণীর পিছনে এসে থামলো।

বুকে এক বিন্দু সাহস সঞ্চার করে বাণী চোখ মেলে তাকায়। পিছন পানে না চেয়েই ক্ষীণ স্বরে উচ্চারণ করে,

“ বহ্নির কাছে যাচ্ছি। “

কথাটুকু বলেই এগিয়ে যেতে নিয়েও আর এগোতে পারে না সে। একটি বলিষ্ঠ হাত সাপের মতো আষ্টেপৃষ্টে তার কোমর জাপ্টে ধরে। বাণী সাথে সাথে ফের চোখ বুজে অস্বস্তিতে মুখ কুচকে ফেললো। অত:পর নিজের প্রতি নীরব করুণার হাসি নিক্ষেপ করে সে।

ছয়টা বছর! ঠিক ছয়টা বছর পর আবারও এই গাঢ় কুলষিত স্পর্শের সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাকে। কেনই বা হতে হবে না? বাণী ভুল করেছে। মস্ত বড় ভুল। বাণীর হাজারটা অপমান, ধিক্কার, চড়, থাপ্পড় মাফ করলেও এই অপরাধ কখনো মাফ করবে না অগ্যাত পুরুষ, তা বাণী ভালো করেই জানে। সে এটাও ভালো করে জানে এই অপরাধের শাস্তি হতে কেউই তাকে বাঁচাতে আসবে না। এত বছরেও কেউ আসেনি, এখনো আসবে না। যেই গুটি দুয়েক মানুষ তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো, তাদের সকলের অস্তিত্বই আজ এই পৃথিবীর বুক হতে বিলীন হয়ে গিয়েছে। তাই নীরবে মৃত্যুর কাছে পরাজিত সৈন্যের ন্যায় সব শাস্তি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত বাণী।

কানের কাছে মুখ নামানো শান্ত স্বর বলে উঠে,

“ বহ্নি নিজের বাসায় আছে এই মুহুর্তে। এই পৃথিবীতে ওর জন্য সবথেকে সুরক্ষিত জায়গা যেটা। ওকে নিয়ে তোমার চিন্তা না করলেও চলবে। “

ভুল বলেনি হিরণ। এই বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে তার মেয়ের ক্ষতি করতে পারবে এমন দুঃসাহস কারো নেই। এমন দুঃসাহসিকতা দেখানোর আগে সেই মানুষের ঠিকানা হবে সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে। ভাবলেশহীন গলায় বাণী শুধায়,

“ অপেক্ষা কিসের? আপনি জিতেছেন, আমি হেরেছি। নিয়ম অনুযায়ী পরাজিত ব্যক্তির শাস্তি পাওয়ার কথা। দিন শাস্তি। আমার প্রতিবাদ করার সাধ্যি নেই। “

বাণীর এহেন আত্মসমর্পণ শেষ হতে না হতেই হিরণের অপর হাত বাণীর উন্মুক্ত গলা আবৃত করা ওড়নার কাছে পৌঁছায়। ওড়নাটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সন্তর্পণে তা টেনে গলা মুক্ত করলো হিরণ। প্রাণহীন দেহটা কাধের কাছে নরম স্পর্শ পেতেই বাণীর সম্পূর্ণ অন্তর বিষিয়ে উঠলো। বিষের দানার প্রভাবে মূর্ছা যাওয়ার পূর্বেই ডান কাধের ভাজে লুকানো মুখটা ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে উঠলো,

“ হেরে যাবে জেনেও কেনো এই মরণ খেলায় মত্ত হলে? “

বাণী বুঝি অকারণে মৃদু সাহস খুঁজে পেলো। ক্ষানিকটা নির্ভীক গলায় সে জবাব দেয়,

“ জিতে যাওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনাটুকুর আশায়। “

হিরণ বাণীর কথার পিঠে রেগে গেলো কিনা বুঝা গেলো না। সে সাথে সাথে বাণীকে নিজের দিকে ফিরিয়ে তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে। চোখেমুখে তার হিংস্র অগ্নিশিখা দাউদাউ করছে। চোয়াল শক্ত করে সে শুধায়,

“ কেন জিততে চাও তুমি? মেনে নাও নিজের হার। আমাকে ঘৃণা করে খুশি থাকো। তোমার তিক্ত অনুভূতির অধিপতি হিসেবে আমি আছি। তোমার ভালোবাসার অধিপতি হিসেবে বহ্নি আছে। আমার অংশ। আমি ওতটুকুতেই সন্তুষ্ট। “

কথাটুকু বলতে বলতে হিরণের মুখের ভাবমূর্তি পরিবর্তন হলো। পলকহীন চোখ দুটো হতে হিংস্রতা উবে যায়। হাত বাড়িয়ে বাণীর কপালের একপাশের সাদা ব্যান্ডেজটা ছুঁয়ে দেয়। অত:পর মৃদু স্বরে বলে উঠে,

“ এই ইট পাথরের তৈরী সীমানার বাহিরে যাওয়ার ফল দেখলে? ক্ষত নিয়ে ফিরেছো। “

বাণী ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়,

“ আপনার সীমানার ভেতর থেকেও অক্ষত রইলাম কই? এই ক্ষতের থেকেও গভীর দাগ উপহার দিয়েছেন। আমৃত্যু তা ভুলবো না। “

হিরণের মুখ তখন ভয়াবহ কালো। সে এক’পা দু’পা করে পিছিয়ে যেতে শুরু করে। একটা সময় সে রুমে জ্বলমান একমাত্র মোমবাতির শিয়রে এসে দাঁড়ায়। বাণীর দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই সে একহাতে মোমের ঊর্ধ্বভাগ একহাতে চেপে ধরে। মুহুর্তেই সম্পূর্ণ রুম অন্ধকারে ছেয়ে যায়। মোমের বিগলিত গরম পানীয় চামড়ার সংস্পর্শে আসতেই তা জমে সাদা রূপ ধারণ করে। কিন্তু সেই উত্তপ্ত পানীয়ের সংস্পর্শে হিরণ যন্ত্রণা খুঁজে পায় না।

বাণী এক দন্ড সময় নেয়। চোখ বুজে বড় করে নিঃশ্বাস নেয়। হিরণ তাকে কোনো প্রকার শাস্তি দেয় নি। দিবেও না। ক্ষমা পেয়েছে সে। আজ রাতে হিরণের ভয়াবহ রূপের সাক্ষী হতে হবে না তাকে। এই উপলব্ধিটুকু কাজ করতেই বাণী আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। অন্ধকারে হাতড়ে দরজার নব ঘুরিয়ে দ্রুত পায়ে রুম থেকে প্রস্থান করে। ঝড়ের বেগে পৌঁছে যায় নিজের মেয়ের জন্য নির্ধারিত রুমটার ভেতর। এই রুমে ঠিকই মৃদু ড্রিম লাইটের আলো জ্বলছে। অর্থাৎ হিরণ ইচ্ছে করেই ওই রুমে লাইট অফ রেখে মোম জ্বালিয়েছিলো।

বাণী অতি সাবধানে মেয়ের পিছনে শুয়ে মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। বুকে জমে থাকা কান্নাগুলো উথলে উঠতেই তার অবাধ্য চোখ জোড়ার কার্ণিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। দূর্বল বাণী আরো একবার এই বন্দীশালায় বন্দী হয়ে রয়ে গেলো। আবারও তাকে ফিরে আসতে হয়েছে এই পাপের সাম্রাজ্যে। যেই বিষাক্ত সাম্রাজ্যে তার এক মলিন সুখ হলো বুকে আগলে রাখা এই নিষ্পাপ শিশুটা। চোখের কার্ণিশে জল ভেসে উঠলেও বাণীর বুকের কার্ণিশে ভেসে উঠলো ঠিক বারো বছর আগের অদ্ভুত সুন্দর কিছু স্মৃতিচিত্র।

__________

বর্ষা পেরিয়ে ঋতু রাণী বসন্তের আগমন ঘটলো কেবল। পরিষ্কার সাদা আকাশটা সর্বদা স্বচ্ছ থাকে এই ঋতুতে। আকাশ জুড়ে না দেখা যায় সূর্যের তীক্ষ্ণতা আর না দেখা যায় কালো মেঘদলের গুমোট ভাব। কিশোরী বাণীর হৃদয়ের অবস্থাও তখন এই পরিষ্কার আকাশের ন্যায়। যেই আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়ায় দূর্জয় নামক এক সুখপাখি।

বাংলা মাধ্যম শিক্ষা ব্যবস্থায় দশম শ্রেণির পর শিক্ষার্থীদের বসতে হয় এসএসসি নামক এক বোর্ড পরীক্ষার জন্য। কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের জন্য তার বদলে রয়েছে ও লেভেলের এক্সাম। বাণীর মা অহনা বেগম ও বাবা আনিসুজ্জামান তালুকদার অবশ্য বাণীর প্রতি একাডেমিক্যাল দিক দিয়ে কখনো তেমন একটা আশা রাখেনা। কারণ বাণী স্টুডেন্ট হিসেবে কতটা জঘন্য তা তারা বেশ ভালো করেই জানে।

কিন্তু জঘন্য এবং বেকবেঞ্চার হিসেবে খ্যাত বাণীর মধ্যে হঠাৎ লক্ষ্য করা যায় আমূল পরিবর্তন। নির্দিষ্ট দিন ক্ষণ হিসেব করে বলতে গেলে প্রথম সেমিস্টার এক্সামের রেজাল্টের দিন হতে সেই পরিবর্তনের আবির্ভাব ঘটে। টিচারদের একান্ত বাধ্যগত ছাত্র শাহরিয়ার দূর্জয় যেখানে সব সাবজেক্টে ৯৫+ পেয়ে টপ করেছে সেখানে বাণী তালুকদার এক সাবজেক্টে ফেল এবং বাকি সব সাবজেক্টে টেনেটুনে পাশ মিলিয়ে লাস্ট পজিশন দখল করেছে।

কখনো রেজাল্টের পরোয়া না করা মেয়েটা সেদিন প্রথমবারের মতো লজ্জিত অনুভব করে। সর্বদা চোখ পাকিয়ে চলা মেয়েটা সেদিন লজ্জায় স্কুলে চোখ তুলে কারো দিকে তাকাতে পারে নি। রেজাল্ট কার্ড নিয়ে বাড়ি ফিরেই সে থমথমে মুখে নিজের বাবার কাছে গিয়ে আবদার কম আদেশ বেশি সুরে বলে,

“ তিনদিনের মধ্যে সিলেট শহর তন্নতন্ন করে আমাকে প্রতিটা সাবজেক্টের জন্য বেস্ট টিউটর খুঁজে এনে দাও বাবা। “

বিকেল বেলায় সবুজ ঘাসে আবৃত উঠোনে বেতের সোফায় আয়েশী ভঙ্গিতে বসে কেবল মাত্র চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলো আনিসুজ্জামান তালুকদার। কিন্তু মেয়ের এহেন কথায় তিনি বিষম খেয়ে যায়। ফলস্বরূপ মুহুর্তেই উনার কাশি উঠে যায়। বাণীর মাঝে তেমন একটা ভাবান্তর দেখা গেলো না। সে ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে করতে নিজের মা অহনা বেগমকে ডেকে বলেন,

“ মামনি, টেক কেয়ার অফ ইউর হাজবেন্ড। “

মেয়ের উচ্চকণ্ঠ শুনে কিছুটা বিরক্তি নিয়েই ঘর ছেড়ে বের হয় অহনা বেগম। কিন্তু বাড়ির দরজার কাছাকাছি আসতেই তিনি দেখেন আনিসুজ্জামান কাশতে কাশতে নাজেহাল অবস্থা প্রায়। তিনি বিলম্ব না করে সাথে সাথে এক গ্লাস পানি নিয়ে স্বামীর দিকে ছুটে। স্ত্রীর আনা গ্লাসের পানিটুকু খেয়ে ধাতস্থ হতেই আনিসুজ্জামান প্রশ্ন করে,

“ বাণী কি আজও বাঁশ ঝাড়ের রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে বাসায় ফিরেছে? “

আনিসুজ্জামানের এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে অবাক হলেও অহনা বেগম বিরক্তি নিয়ে জবাব দেয়,

“ আর কোন রাস্তা দিয়ে আসবে ও? কতবার মানা করেছি এসব বাঁশ ঝাড়ের নিচ দিয়ে মেয়ে মানুষ একা যেনো আসা যাওয়া না করে। কিন্তু আমার কথা শুনলে তো! দামড়া মেয়ে যদি নিজের ভালো না বুঝে তাহলে কার কি করার আছে? “

অন্যসময় হলে অহনা বেগমের এমন সেকেলে কথাকে তেমন একটা গুরুত্ব দিতো না আনিসুজ্জামান। কিন্তু আজ গুরুত্ব না দিয়ে পারছে না সে। চিন্তিত গলায় বলে,

“ কোনো খারাপ কিছু আছড় করলো নাকি মেয়েটাকে? “

__________

বাবুই পাখির বাসার মতো রুমে বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে আছে এক কিশোরী। গায়ের ইউনিফর্ম এখনো বদলায় নি সে। তার রুমের প্রিয় কর্ণারে থাকা রেডিওতে বেজে চলেছে সদ্য রিলিজ পাওয়া মেরি ব্রাদার কি দুলহান সিনেমার হিট সং ইষ্ক রিস্ক। গানের শব্দ পৌঁছে যায় ঘরের প্রতিটি ইট পর্যন্ত। কিন্তু গানের সাথে বাণীর মনের অবস্থার কোনো সামঞ্জস্য নেই বললেই চলে। তার মন আকাশে কুণ্ডলী পাকা কালো মেঘেরা ভীড় করেছে। বুঝতে পারছে নিজের আর দূর্জয়ের মধ্যে থাকা বিস্তর পার্থক্য। দূর্জয়ের নজরে পড়তে হলে এবং তার মন জিততে হলে তাকে আগে দূর্জয়ের সমান স্থানে পৌঁছাতে হবে।

এরকম আরো অসংখ্য ভাবনার পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে ধীরে ধীরে বাণী ঘুমে তলিয়ে যায়। কালো রঙের রেডিওটায় বাজতে থাকা গানটা বুঝি ঘুম গাঢ় করতে আরেকটু সাহায্য করলো।

“ কই পিছে না আগে হে
ফির ভি জানে কিউ ভাগে হে
মারে ইষ্কে কা ইষ্কে কা দিল মেরা,
ইস্কে উস্কে ইয়ে হিসসে মে
তেরে মেরে ইয়ে কিসসে মে
মওলা সিখে বিন সিখে বিন দে সিখা। “

__________

রাতের শেষ প্রহর তখন। ফ্যাকাসে আকাশে চাঁদের অস্তিত্ব নেই। পরিবেশে তখন শিরশিরে গা কাপানো বাতাসের অস্তিত্ব। নিস্তব্ধ রুমটার দরজা হঠাৎ ধীর গতিতে খুলে যায়। ভূতগ্রস্তের ন্যায় একটি ছায়া খুবই সাবধানে প্রবেশ করে রুমের ভেতর। পাতলা টি শার্ট পরিহিত উজ্জ্বল ফর্সা রঙের পুরুষ শব্দহীন ভাবে এগিয়ে যায় বিছানার দিকে। অত:পর খুব নীরবেই বহ্নির গায়ে থাকা কোমফর্টারটা কিছুটা প্রসস্থ করে টেনে ঘুমন্ত বাণীর গায়েও মেলে দেয়। সম্পূর্ণ রুম জুড়ে উপস্থিত অক্সিজেনের সাথে মিশে যাচ্ছে তিনটা মানুষের নীরব নিঃশ্বাস। কারো নিঃশ্বাসে মিশে রয়েছে বিষাদের ছায়া তো কারো নিঃশ্বাসে মিশে আছে বুকের অস্থিরতা। তৃতীয়জনের ছোট্ট নিঃশ্বাসের সাথে মিশে আছে নির্ভীক প্রশান্তি।

ঘুমন্ত দুই মানবী সামান্য নড়ে উঠতেই সেই ছায়া দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। তড়িঘড়ি করে বের হতে নিয়ে কোনো এক কাঠের ফার্নিচারের কোণার সাথে পায়ের নখে আঘাত পেতেই সে নিঃশব্দে চোখ মুখ কুচকে ফেলে। পিছনে ফিরে আবার বিছানার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করে ঘুমন্ত ব্যক্তিরা জেগে গেলো কিনা! উহু! জাগে নি। উল্টো একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বেশ শান্তিতেই ঘুমোচ্ছে তারা। সেই ঘুমন্ত দুই মানবীর পানে চেয়ে থেকে অগ্যত ব্যক্তি উপলব্ধি করলো সে খুব জ্বালা অনুভব করছে। পায়ে নয় বরং বুকে। সিমেন্ট মানব খ্যাত পুরুষেরও কি বুক পুড়ে? ঠিক কতখানি পুড়লে হৃদয় ছাঁই হয়ে উঁড়ে যায়?

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]