এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৭+৮

0
227

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৭.

আপন গতিতে এগোনো এক জোড়া পা হেটে চলেছে জামাল খান রোডের ফুটপাত ধরে। তার নেই কোনো তাড়া, নেই কোনো সঠিক গন্তব্য। আপাততর জন্য তার মাথায় কোনো দায়িত্বের বোঝাও নেই। যুবকের আপন চিত্ত জুড়ে বেশ ফুরফুরে ভাব। আচমকা চলমান পা জোড়া থমকায় আলোয় জ্বলজ্বল করা এক বিখ্যাত গ্রন্থাগারের সামনে এসে। চট্টগ্রাম বাতিঘর সেই গ্রন্থাগারের নাম। বই পড়ার প্রতি মৃদু ঝোক থেকেই বুঝি যুবক বাতিঘরে প্রবেশ করলো। বেশ কিছুক্ষণ আশেপাশে ঘুরঘুর করেও মনমতো কোনো বই খুঁজে পায় না সে। এখানে থাকা বেশিরভাগ ভালো বই গুলোই ইতিমধ্যে তার পড়া হয়ে গিয়েছে।

আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা কোমর সমান বইয়ের তাকের সামনে এসে থামে সে। তাকের উপর অংশে থাকা একটা বইয়ের দিকে তার চোখ আটকায়। A good girl’s guide to murder. হলি জ্যাকসনের লেখা বইয়ের নামটুকু পড়েই যুবকের মনে কৌতূহল জাগে বেশ। সে বইটা নেওয়ার উদ্দেশ্যে একহাত বাড়িয়ে বইটা ছুঁতেই কোথা থেকে উড়ে এসে একটা চিকন শ্যাম হাত বইয়ের অপরপাশ ধরে ফেললো। যুবক ভ্রু কুচকে তাকের অপর পাশে ঠিক সামনে বরাবর তাকাতেই দেখলো শ্যাম বর্ণের একটা মেয়ে বইটা ধরে রেখেছে। যুবক এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্ষীণ স্বরে বলে,

“ বইটা আমি আগে নিয়েছি। আপনি অন্য কপি নিয়ে নিন। “

জিন্স, কুর্তীর সাথে গলায় স্কার্ফ ঝোলানো শ্যান বর্ণের মেয়েটা যেন যুবকের কথায় মৃদু ক্ষেপে গেলো। সে বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলো,

“ এই মিয়া! মশকরা করেন? এই বই আগে আমি ধরেছি। “

মেয়েটার উচ্চস্বরে নীরব গ্রন্থাগারের নীরবতা ভঙ্গ হলো। আশেপাশের কিছু বড়ো বড়ো চোখ মেলে তাকিয়ে থাকা মানুষের দৃষ্টি দেখে যুবক বিরক্ত বোধ করলো। ভারী ম্যানারলেস মেয়ে তো! এটেনশন সিক্যার নাকি এই মেয়ে? এভাবে চেঁচানোর মানে কি?

যুবক ফের শান্ত গলায় বলে,

“ দেখুন বইটা আগে আমি ধরেছি। তারমানে বইটা আমার। আপনি কাইন্ডলি অন্য কপি খুঁজে নিয়ে নিন। “

মেয়েটা ফের চেঁচিয়ে উঠে,

“ আপনি আগে ধরেছেন মানে কি? হ্যাঁ? কোনো প্রমাণ আছে? আমাকে চিনেন মিয়া? এই বইয়ে আমি হাত রেখেছি মানে এই বই আমার। “

শান্ত যুবক এবার বেশ রেগে যায়। নিচু স্বরে সামান্য শাসিয়ে বলে,

“ দেখুন, আমি আপনার সাথে নিচু গলায় ভদ্রভাবে কথা বলছি। প্লিজ নিজের উগ্র কথার স্বর কমিয়ে আশেপাশের মানুষের মনযোগ আকর্ষণ বন্ধ করুন। “

শ্যাম রমণী এবার রেগে চেঁচিয়ে উঠলো,

“ এই আপনি আমাকে অভদ্র, উগ্র আর এটেনশন সিক্যার বললেন? “

রমণীর চেঁচানোর মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হলো আরেকজন মেয়ে। সে এসেই রমণীর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে জেসি? চিল্লাচ্ছিস কেন? “

রমণী অভিযোগের সুর মিশিয়ে বলে,

“ এই লোক আমাকে গালি দিলো মাত্র। এখন আমি আরো আগে এই বই ছাড়বো না। “

শেষের কথাটুকু কিছুটা জোর মিশিয়ে বলেই জেসি একটানে বইটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। উক্ত যুবক জেসির এহেন অভদ্রতায় বেশ বিরক্ত হলো। কিন্তু সে কিছু বলবে তার আগেই লাইব্রেরীর একজন কর্মী এসে বলে,

“ এক্সকিউজ মি আপু। বইটার জন্য অলরেডি একজন পেমেন্ট করে ফেলেছে। আর এই মুহুর্তে লাইব্রেরীতে এটাই লাস্ট কপি। আপনি পরে কখনো নিয়েন। “

কর্মীর কথায় যুবকের থমথমে কালো মুখের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠে। সে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে প্যান্টের পকেটে ভাইব্রেট মোডে বাজতে থাকা ফোনটা বের করে কানে গুজে সেখান থেকে প্রস্থান করে। রাগে লাল হয়ে থাকা জেসি বাধ্য হয়ে বইটা সেই কর্মীর হাতে দিয়ে দেয়। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা বোকা সুরে প্রশ্ন করে,

“ বাই দ্যা ওয়ে দোস্ত, তুই এটা কেন বলছিলি ওই লোককে যে তোকে চিনে কিনা? ওই লোক তোকে কেন চিনবে? তার কি তোকে চেনার কথা? “

জেসি রাগে কটমট দৃষ্টি মেলে বান্ধবীর দিকে তাকায়। পুরো পৃথিবীর সব ছাগল পাগল এসে তার কপালেই কেন জুটে?

__________

গ্রন্থাগার থেকে বের হয়ে যুবক আশেপাশে সামান্য চোখ বুলিয়ে ফোনের অপর পাশে থাকা ব্যক্তির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,

“ কোথায় তুই? “

প্রশ্নটুকু শেষ হতে না হতেই ছয়জন যুবক পিছন থেকে এসে তার আশেপাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ছয়জন যুবকের আকস্মিক এহেন কান্ডে অগ্যাত যুবক চমকায় না। বরং সে সামান্য হেসে ফোন কান থেকে নামিয়ে ফের পকেটে ভরে ফেলে। সাইফ চঞ্চল গলায় প্রশ্ন করে,

“ প্রত্যয় মামা? এদিকে আমরা চাকরির প্রেশারে হিমশিম খাচ্ছি আর তুই এখানে ছোকরিও পেয়ে গেলি? “

প্রত্যয় সরু চোখে ছয়জনকে একবার দেখে প্রশ্ন করে,

“ তোরা আমার উপর নজর রাখছিলি? “

সাদাত সামান্য গলা খাকড়ি দিয়ে বলে,

“ মেজরের থেকে হাফ ডে অফ পেতেই যখন তুই সুরসুর করে একা বেরিয়ে গেলি তখন সাইফ বললো নিশ্চয়ই তুই কোনো গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিস। তাই আমাদের সবাইকে নিয়ে সে অপারেশন প্রত্যয় অভিযানে নেমে পড়ে। “

সাইফ কথার মাঝে বাগড়া দিয়ে বলে,

“ ওয়েল, আমি ভুল ছিলাম না। এইবার বল মেয়ে কে? “

প্রত্যয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেথলেহেম এজি চার্চের পাশে ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠে,

“ ম্যানারলেস, মাথামোটা একটা মেয়ে। “

তার পিছনে হাঁটতে থাকা ছয়জন উউ বলে অদ্ভুত শব্দ করে উঠে। প্রত্যয় হাঁটা থামিয়ে সরু চোখে পিছু ফিরে তাকাতেই সাইফ এগিয়ে এসে প্রত্যয়ের গলায় ঝুলে থাকা হেডফোনটা একটানে নিয়ে বলে,

“ মামা! ম্যানারলেস আর মাথামোটা মেয়ের নাম কি? “

প্রত্যয় ভ্রু কুচকে বলে,

“ হেডফোন ফেরত দে। “

সাইফ উল্টো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠে,

“ আগে ভাবীর নাম বলবি তারপর হেডফোন পাবি। “

প্রত্যয় রাগ দেখিয়ে বলে,

“ কে ভাবী? কার ভাবী? “

রাফি পিছন থেকে বলে উঠে,

“ আমাদের ভাবী। যাকে এইমাত্র ম্যানারলেস আর মাথামোটা বললি। “

জুনায়েদ পাশ থেকে বলে উঠে,

“ লাভ বিয়িংস উইথ ওয়ার ব্রো। আই ক্যান স্মেল লাভ ইন দ্যা এয়ার। “

ফারদিন সামান্য বিরক্তি নিয়ে বলে,

“ আই ক্যান স্মেল অনলি পলিউশন হেয়ার। “

রিদওয়ান ফারদিনকে ধমকে বলে,

“ হোপ বেডা! তুই আনরোম্যান্টিক, সিঙ্গেল। তোর নাকে প্রেমের গন্ধরেও গরুর গোবরের মতো মনে হবে। “

উল্টো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সঙ্গীদের কথা শুনে শব্দ তুলে হাসছিলো সাইফ। তখনই ঘটে অঘটন। আকস্মিক কারো সাথে ধাক্কা লেগে সে পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। কিন্তু তার ৮৪ কেজির দেহের ভারের ধাক্কা সামলাতে না পেরে জ্বলজ্যান্ত এক মানবী ফুটপাতের পাশ কেটে পাকা রাস্তায় পড়ে গেলো। মুহুর্তেই নিজের হাঁটু চেপে সে আর্তনাদ করে উঠলো,

“ আম্মুউউউ! “

মানবীর আর্তনাদ এবং আকস্মিক দূর্ঘটনায় একদল যুবকের মুখের হাসির শব্দ থেমে গেলো। হতভম্ব সাইফ একবার রাস্তার ধারে হাঁটু ধরে বসে থাকা রমণীকে দেখলো আবার ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের সঙ্গীদের দিকে তাকালো। অত:পর বেশ ধমকে বলে,

“ এই মাইয়া! চোখ কি চান্দের দিকে দিয়া ঘুরো? শালার মাইয়্যা মাইনষেরে রাস্তায় চলার লাইসেন্স দেয় কে? “

আগুন্তক রমণীর ফোলা ফোলা চোখ থেকে মুহুর্তেই জল গড়িয়ে পড়ে। অপরিচিত কারো এমন ধমক তার ঠিক হজম হয় না। সে একহাতে পা চেপে ধরে রেখে আরেক হাতে নিজের কাধের সাইড ব্যাগ হতে ফোন বের করে একটা নাম্বার ডায়াল করে। এক মুহুর্তের মধ্যেই অপরপাশ হতে ফোন রিসিভ হয়। রমণী অতি নরম গলায় কান্না করতে করতে বলে,

“ আব্বু আমাকে একটা ভাইয়া রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। তুমি প্লিজ আসো। ভাইয়া আমাকে ধমকাচ্ছে। উনার সাথে আরো অনেক গুলো ভয়ংকর দেখতে ভাইয়া আছে। আমার ভয় করছে। “

এতদূর শুনতেই সাইফ বলে উঠে,

“ খাইসেরেএ! “

এইটুকু বলেই সে সাথে সাথে দৌড় লাগায়। রাস্তায় পড়ে থাকা রমণী এবং বাকি ছয়জন যুবক হতভম্ব হয়ে রয়। কিছুদূর যেতেই সাইফ ফের উল্টো দৌড়ে এসে সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বলে,

“ তোরা কি বলদ? মাইয়ার বাপের কেস খাওয়ার জন্য এনে দাঁড়ায় রইসোস? দৌড় দে। “

বলেই সাইফ ফের দৌড় দেয়। তার পিছু পিছু এবার বাকি ছয়জনও ছুটে। প্রত্যয় দৌড়াতে দৌড়াতে এবার বলে,

“ মেজরের সামনে তো প্রথমদিন খুব বড় মুখ করে বলছিলি যে তুই নাকি কখনো ময়দান ছেড়ে পালাস না? এখন দোষ করে আসামীর মতো পালাচ্ছিস কেন? “

সাইফ দৌড়াতে দৌড়াতে জবাব দেয়,

“ হোপ ব্যাটা! শালার মাইয়া জাতই একটা গ্যাঞ্জাম। আর গ্যাঞ্জাম দেখলে পালানোই হইসে বুদ্ধিমানের কাজ। “

__________

অন্ধকার রুমে মাথার উপর কেবল একটা মৃদু আলোর বাল্ব জ্বলছে। সেই বাল্বের ঠিক নিচেই রয়েছে একটা টেবিল ও একটা চেয়ার। টেবিলের উপর সামান্য ভর দিয়ে বসে আছে কালো প্যান্ট এবং কালো শার্ট পরিহিত এক পুরুষ। শার্টের হাতা তার কনুই পর্যন্ত গোটা। তার ঠিক সামনেই চেহারায় আহত অবস্থায় বসে আছে এক মধ্য বয়স্ক পুরুষ। ব্যথাতুর মুখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষকে আবেদন করে চলেছে,

“ হামকো ছোড় দো স্যার। হাম তো মামুলি আদমি হে। হামকো কুছ নেহি মালুম। “

সাথে সাথেই কালো শার্ট পরিহিত পুরুষ টেবিল থেকে ভর সরিয়ে নেমে আসে। লোকটার চুল মুঠি করে ধরে ভয়ংকর ভরাট কণ্ঠে শুধায়,

“ তুই যদি সাধারণ এক দোকানদারই হস তাহলে ছয় মাস আগে এভার ভিউ রেস্টুরেন্টে হামলা করা ওই জঙ্গিদের জন্য ড্রাইভারের কাজ করছিলি কেন? “

“ স্যার সাচ মে হামকো কুছ নেহি মালুম। “

দূর্জয়ের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। এই ধরনের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনালদের সাথে চলা লোকদের হয়তো এটাই নীতি। জীবন দিবে তবুও স্বীকারোক্তি না। দূর্জয় কিছু না বলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সেই অন্ধকার কক্ষ হতে বেরিয়ে যায়।

দূর্জয় প্রস্থান করতেই মোর্শেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। শ্যাম বর্ণের এই ভয়ংকর লোকটার প্রশ্ন উত্তরের পর্ব শেষ হওয়ায় খানিকটা স্বস্তি পায় সে। কিন্তু তখনই ফের রুমের দরজাটা শব্দ তুলে খুলে যায়। মোর্শেদ চোখ তুলে তাকাতেই দেখে দূর্জয় ফের রুমে প্রবেশ করছে। কিন্তু খালি হাতে বের হলেও খালি হাতে ফেরে নি সে। তার হাতে থাকা বস্তুটা দেখতেই মোর্শেদের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল হাওয়া বয়ে যায়। সে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রয় ছাট করে কাটা চুল এবং কাটকাট চেহারার পুরুষের দিকে। এই পুরুষ করতে কি চাইছে? মতলব কি?

মোর্শেদের মস্তিষ্কের প্রশ্নের আনাগোনার মাঝেই দূর্জয় সুইচবোর্ড চেপে সাদা আলোর বাল্বটা নিভিয়ে অন্য একটা সুইচ অন করে দেয়। মুহুর্তেই সম্পূর্ণ রুম জুড়ে ভুতুড়ে লাল রঙের মৃদু আলোর আভা ছড়িয়ে পড়ে। মোর্শেদ কিছু বলবে তার পূর্বেই দূর্জয় একহাতে তাকে চেয়ার সহ টেনে সুইচবোর্ডের দেয়ালের দিকে নিয়ে যায়। মোর্শেদ ফের ভীত চোখ মেলে দূর্জয়ের হাতে থাকা বস্তুটার দিকে তাকায়।

দূর্জয় খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বস্তুটার ইলেক্ট্রিক ওয়্যারের প্লাগটা সুইচবোর্ডে লাগিয়ে সুইচ অন করতেই তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে সরু, চিকন এবং ধারালো একটা অংশ ঘুরতে শুরু করে। সেই তীক্ষ্ণ শব্দে মোর্শেদের মাথা ধরে গেলেও দূর্জয় স্বাভাবিক গলায় বলে উঠে,

“ এই রুমটাকে প্রথম দেখায় সকল অপরাধী খুব স্বাভাবিক একটা রুম ভাবে। ঠিক আমার মতো। এই রুমে প্রবেশ করা সকল অপরাধী আমাকে প্রথম দেখায় বুঝতে পারে না যে আমি ঠিক কতটা ভয়ংকর হতে পারি। আমি তাদের সুযোগ দেই। কিন্তু তারা তা হাতছাড়া করে। ঠিক সেই মুহুর্তে এই রুম এবং আমি খোলস ছেড়ে নিজেদের ভয়ংকর রূপ ধারণ করি। দিজ ইজ দ্যা রেড রুম এন্ড আমি এই মুহুর্তে তোর আতংক। তাই এই ড্রিল মেশিন দ্বারা আমি তোর চেহারায় নতুন নকশা আঁকার আগে যা জানিস সব স্বীকার কর। “

মোর্শেদ ছোটার জন্য ছটফট করছে। কিন্তু সেই সুযোগ তার কাছে নেই। তার দুই হাত চেয়ারে পিছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পড়ানো। পা দুটোও শক্ত করে বাঁধা। এ কি জমদূতের হাতে এসে পড়লো সে? মোর্শেদ মুখ খুলতে যতই সময় নিচ্ছে ততই ড্রিল মেশিনটা ধীরে ধীরে তার কাছে এগিয়ে আনছে দূর্জয়। ঠিক তার চোখ বরাবর। সম্ভাবনীয় পরিণতির কথা ভেবে মোর্শেদ তিরতির করে ঘামছে। দয়ামায়াহীন এই নির্দয় পুরুষ যে কতটা ভয়াবহ তা উপলব্ধি করতেই তার বুক কাপে। ড্রিল মেশিনটা আর তার চোখের মাঝে যখন কেবল আর কয়েক আঙুলের ফারাক ঠিক সেই মুহুর্তে মোর্শেদ চোখ বুজে চিৎকার করে বলে উঠে একটি নাম,

“ রইস দিলদার। “

__________

জনমানবহীন নীরব এলাকাটার মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রাসাদ সমতুল্য এক ভিলা। রাত তখন নয়টা বাজে। ভিলার ঠিক মাথার উপরেই যেনো উঠেছে মস্ত বড় চাঁদ। বাহির হতে গাড়ির হর্ণের শব্দ ভেসে আসতেই সদর সিংহ প্রবেশ দ্বার খুলে যায় দু’দিকে। একটি কালো গাড়ি সমীচীন গতিতে প্রবেশ করে বিশাল ওয়াক ওয়ে ধরে। ঠিক ভিলার সামনে এসে গাড়িটা থামে। গাড়ি হতে নেমে আসে হিরণ। ফোনালাপে ব্যস্ত প্রবেশ করে বাড়ির ভেতর। বিশাল লিভিং এরিয়ায় উপস্থিত দু’জন কাজের লোককে চোখের ইশারায় বলে এখান থেকে চলে যেতে। আদেশের দাসরা আদেশ মাথা পেতে মুহুর্তেই প্রস্থান করে। ফোনের অপর পাশ হতে ভেসে আসে একজন পুরুষের স্বর,

“ আজকাল কাজে বেশ অমনোযোগী মনে হচ্ছে তোমায়। ব্যাপার কি? “

হিরণ নিজের ক্ষমতাবান স্বর বজায় রেখে বলে,

“ আপনার ধারণা ভুল। “

ফোনের অপর পাশে থাকা পুরুষ এবার সামান্য রসিকতা মিশিয়ে বলে,

“ শুনলাম তোমার নাকি বউ আর বাচ্চাও আছে। এটাও কি আমার ভুল ধারণা? “

অগ্যাত লোকের সূক্ষ্ম উপায়ে দেওয়া হুমকিটা ধরতে সময় লাগলো না হিরণের। সাথে সাথে তার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। কাটকাট স্বরে জবাব দেয়,

“ আপনি আজকাল কাজ ছাড়া অহেতুক জায়গায় খুব মস্তিষ্ক খাটাচ্ছেন। বয়স হয়েছে। মস্তিষ্ককে আরাম দিন। কে জানে? মস্তিষ্কের উপর এতো প্রেশার দিলে না আবার ব্রেইন হ্যামারেজ হয়ে যায় আপনার। “

কথাটুকু বলেই হিরণ ফোন কেটে দিলো। রাগে ফোস ফোস করছে সে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে ঘনঘন নিঃশ্বাস নেয় সে। পৌঁছে গিয়েছে তারা। খুব দূর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে তারা। এই এতো বড় ব্ল্যান্ডারটা কিভাবে হলো তা মনে পড়তেই তার উবে যাওয়া রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।

তড়িৎ গতিতে সে সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে আসে। নিজের রুম বরাবর মেয়ের রুমে প্রবেশ করতেই দেখে বহ্নি বিছানায় বসে খুব মনযোগ দিয়ে টিভিতে মার্ভেল স্টুডিওর একটা সিনেমা দেখছে। কিন্তু দরজা খুলে পাপার আগমন টের পেতেই তার মনযোগে ব্যাঘাত ঘটে। দাঁত বের করে হেসে সে বিছানার উপর দাঁড়িয়ে পাপার কোলে ছুটে যাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি নেয়। হিরণ এগিয়ে এসে মেয়েকে কোলে নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ ডিনার করেছো মা? “

“ ইয়েস পাপা। জানো আমি আর মাম্মা সন্ধ্যায় লেমন কেক বেক করেছি। আমি তোমার জন্যও রেখেছি। “

হিরণ মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলে,

“ থ্যাঙ্কিউ মা। তুমি এখন বসে মুভি দেখো। মাম্মা এখন একটু পাপাকে টাইম দিক? “

বহ্নি হেসে বলে,

“ শি ইজ ইউরস। “

হিরণ বহ্নিকে কোল থেকে নামিয়ে চোখ তুলে রুমের এককোণে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাণীকে দেখে। অত:পর রুমে আসার জন্য ইশারা দিয়েই বেরিয়ে যায়।

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৮.

নীরব ভঙ্গিতে রুমে প্রবেশ করেই দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দেয় বাণী। হিরণের চোখের অগাধ রাগ তার দৃষ্টি এড়ায় নি। কি হয়েছে আবার? সেই পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে মওকুফ করা ক্ষমার হিসেব কি আজ মেটাবে নাকি? কথা গুলো ভাবতে ভাবতে বাণী রুমের এককোণে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রয়।

কেবিনেটের উপর থাকা স্পিকারে লাউড ভলিউমে মিউজিক প্লে করে দিয়ে হিরণ অস্থির ভঙ্গিতে সম্পূর্ণ রুম জুড়ে পায়চারি করছে। মিউজিক প্লে করার কারণ হলো যেনো তাদের রুমের ভেতরকার দ্বন্দ্ব মেয়ের কান পর্যন্ত না পৌঁছায়। প্রচন্ড রাগে নাকি রাগ ঠান্ডা করতে তার এই অস্থিরতা তা ঠাওর করা যাচ্ছে না ঠিক। অতি মাত্রার রাগে তার চোখ ক্ষানিকটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। আচমকা তার পায়চারি বন্ধ হয়ে যায়। শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। অত:পর বেশ থমথমে গলায় বলে,

“ আমার এতো বছরের সতর্ক শিকল ভেঙে পালিয়ে গিয়ে মস্ত বড় ভুল করেছো তুমি। “

বাণী মাথা নত রেখে ভাবলেশহীন গলায় শুধায়,

“ আবার পালাবো। যতবার সুযোগ পাবো ততবার পালিয়ে যাবো। কখনো না কখনো আপনি ঠিকই বিরক্ত হয়ে পিছু নেওয়া ছেড়ে দিবেন। “

হিরণের সংবরণ করা রাগটা বাণীর বলা প্রথম কথাটুকুতে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে এসে বাণীর পাশের দেয়ালে এক হাতের সাহায্যে আঘাত করে চেঁচিয়ে উঠে,

“ কি বললে? তোমার কোনো ধারণা আছে কি করেছো তুমি? তোমার এই ভুলের কারণে আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মতো ট্রাম্প কার্ডের সন্ধান পেয়ে গিয়েছে তারা। বিষয়টার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারছো তুমি? “

হিরণের ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে আসা দেখে চোখ বুজে ফেলেছিলো বাণী। সেই চোখ জোড়া মেলে তাকায় সে হিরণের বলা কথাগুলো শেষ হতে। হিরণ তার পানেই চেয়ে ছিলো। সেই হিংস্র চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বাণী উত্তর দেয়,

“ আপনার থেকে ভয়াবহ আর কি হতে পারে? “

হিরণের হিংস্র চোখ জোড়া মুহুর্তেই শীতল হয়ে আসে। বাণীর বলা সামান্য কথাটা তার বিবেকের দোরগোড়ায় তাকে দুঃসহ যন্ত্রণার ভেতর ফেলে দিচ্ছে। ক্ষানিকটা সময় সেভাবেই পেরিয়ে যায়। হিরণ নীরবে ধীরে বাণীর কাছ থেকে সরে দাঁড়ায়। সবসময়ের শক্ত চিত্তটা বেশ শীতল ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় সোফার দিকে। যাওয়ার পথে স্পিকারে চলমান গানটাও বন্ধ করতে ভুলে না সে।

হিরণ সোফায় বসে চুপচাপ পিঠ এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে নেয়। পরিবেশটা নিঃশব্দতার ভুবনে তলিয়ে যায়। অসহ্য অনলে দগ্ধ হিরণের প্রতিটা রন্ধ্র তাকে চিৎকার করে জানান দিচ্ছে এই যাতনা আর সহে না। ভিতরটা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেলেও মুখে খুব শীতল স্বরে বলে,

“ কি চাও তুমি বাণী? আমি মরে যাই? তোমার সামনে নিজের বিধ্বংসী রাগটা আমি কেন সংবরণ করি বুঝতে পারো না? এইটুকু যথেষ্ট না? “

হিরণের শীতল প্রশ্নের পিঠে বাণী তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

“ দয়া করছেন বুঝি? কে বলেছে আপনাকে নিজেকে সংবরণ করে আমার উপর দয়া করতে? কৃতদাসীর উপর কেউ দয়া করে নাকি? “

বাণীর উচ্চারণ করা কৃতদাসী শব্দটা হিরণের কানে বিঁধে। অসহ্য যন্ত্রণাটা গলাধঃকরণ করে সে উচ্চারণ করে,

“ নিজেকে আজেবাজে নামে সম্বোধন করা বন্ধ করো। “

বাণী আর কোনো কথা না বলে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। বদ্ধ দরজার নবটা ঘোরাতেই তার হাতটা থেমে যায়। পিছনে না ফিরেই সে শান্ত গলায় বলে উঠে,

“ নিরানব্বইটা ভালো কাজ করা মানুষ যেমন কখনো একটা খারাপ কাজ করে খারাপ মানুষ ট্যাগ পায় না, একইভাবে নিরানব্বইটা খারাপ কাজ করা মানুষ একটা ভালো কাজ করে কখনো ভালো মানুষের ট্যাগ পায় না। “

কথাটুকু বলেই বাণী রুম থেকে বেরিয়ে যায়। একবারও আর ফিরে পিছনে তাকায় না। হিরণ চোখ বুজে রয়। বাণীর উচ্চারণ করা প্রতিটি শব্দই তার কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছেছে। কি সুকৌশলে সে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো যে তার কাছে হিরণের নিরানব্বইটা খারাপ কাজই মুখ্য। সেই মুখ্য বিষয়ের পিঠে হিরণের বাণী ও বহ্নির প্রতি ভালোবাসাটা অতি নগন্য এবং ঠুনকো একটা জিনিস।

মনের উঠোনে টইটই করে ঘুরে বেড়ানো ভয়কে বালি চাপা দিয়ে ফোন বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করে হিরণ। অপরপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই হিরণ শক্ত কণ্ঠে আদেশ করে,

“ বাড়ির চারিদিকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা দ্বিগুণ এবং জোরদার করো। আমার অনুমতি ব্যতীত যেন এই বাড়ির ভেতর একটা মাছিও প্রবেশ করতে না পারে। আমার অনুপস্থিতিতে বাণী আর বহ্নির উপর চব্বিশ ঘণ্টা যেনো নজর রাখা হয়। ওদের গায়ে একটা টোকাও যদি পড়ে তাহলে আমি কি কি করতে পারি তা সবাইকে মনে করিয়ে দাও। “

কঠিন বাক্যের আদেশ বর্তানো শেষ হতেই হিরণ ফোন রেখে দেয়। উঠে রুম থেকে বেরিয়ে সোজা নিচে কিচেনে চলে যায়। কিচেনে উপস্থিত একজন রাধুনি হিরণকে দেখেই তটস্থ স্বরে প্রশ্ন করে,

“ কিছু লাগবে স্যার? “

হিরণ মাথা নেড়ে না বলে থমথমে গলায় আদেশ করে,

“ যেতে পারো। “

দুই শব্দের আদেশ পেতেই রাধুনি হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দ্রুত পায়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। হিরণ গায়ের ধূসর রঙা ব্লেজারটা খুলে একটা চেয়ারের উপর রাখে। অত:পর বেশ শান্ত ভঙ্গিতে সাদা রঙের শার্টের হাতা গুটিয়ে ফ্রিজের দরজাটা খুলে। ফ্রিজের এককোণে রাখা অর্ধ গোলাকার কেকের ট্রে টা বের করে নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসে সে। ছুরির সাহায্যে বেশ সুকৌশলে এক স্লাইস কেটে একটা প্লেটে নিয়ে কাটা চামচ দিয়ে সামান্য কেক মুখে তুলে। মেয়ে আর মেয়ের মা’র বানানো বেমানান স্বাদের কেকটা বেশ তৃপ্তিসহই খেলো সে। বহ্নির ভাষায় বললে, হিরণের হন্টেড লাইফে এই বিদঘুটে কেকটার স্বাদ অনেকটা ফেইরি টেলের মতোই।

__________

লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবার অফিস রুমে কড়া নাড়তেই ভেতর হতে একটা ভরাট স্বর বলে উঠে,

“ কাম ইন। “

দূর্জয় রুমের ভেতর প্রবেশ করেই অভ্যাসবশত দু হাত পিঠের পিছনে ভাজ করে আরামে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠে,

“ মোর্শেদের জবানবন্দি রেকর্ড করে এসেছি স্যার। “

জুলফিকার সামান্য বাকা হেসে প্রশ্ন করে,

“ কি জানতে পারলে? “

“ রইস দিলদার নামক একজন ভারতীয় মোর্শেদকে একটা হিউজ এমাউন্টের ক্যাশ বান্ডেল অফার করেছিলো এই কাজটার জন্য। মোর্শেদ সেই অফার নাকোচ করে নি। ৬ মাস আগে সেদিন খুব সকাল বেলা ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ে হতে সেই যুবক দলকে নিজের গাড়িতে তুলে মোর্শেদ। পথিমধ্যে একটা হাইওয়ে রেস্তোরাঁতে নেমে তারা দুপুরের খাবারও খেয়েছিলো। অত:পর সেখান থেকে বনানীর এভার ভিউ রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি আসতেই তারা গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। এর বেশি কিছুই জানে না সে। “

জুলফিকারকে এবার সামান্য চিন্তিত দেখালো। সে মনে মনে ছক কষে কিছু একটা মিলিয়ে বলে উঠে,

“ দূর্জয় এই কেসের মূল হোতা পর্যন্ত পৌঁছানো এতো সহজ হবে না। আমার মস্তিষ্ক বলছে রইস দিলদারকে ধরলেও আমরা সরাসরি মূল কালপ্রিটের পরিচয় জানতে পারবো না। “

দূর্জয় বলে উঠে,

“ মেইন কালপ্রিট বহু সময় নিয়ে বেশ সাজিয়ে এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তা নিশ্চিত। তার পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য সকল ক্লু খুঁজে বের করবো আমি। দেখা যাক এখন এই রইস দিলদার হতে কি ক্লু পাই আমরা। “

জুলফিকার মাথা নেড়ে প্রশ্ন করে,

“ তোমার টিমের যুবকেরা কোথায়? ওদের আজ সন্ধ্যার পর থেকে কোথাও দেখি নি। “

“ ওদের জন্য আপাতত নতুন কোনো অর্ডার ছিলো না বিধায় হাফ ডে অফ দিয়েছি স্যার। আশা করছি কোনো সমস্যা নেই। “

“ না। ভালো করেছো। “

কথাটুকু বলেই জুলফিকার ফের ডাকে,

“ দূর্জয়? “

“ ইয়েস স্যার। “

“ আজকের রাতটা একটু রেস্ট করো। আর তোমার কলের অপেক্ষায় থাকা মানুষটাকে একবার কল করে খোঁজ নাও। ইট ইজ এন অর্ডার। “

জুলফিকারের বলা কথাটা কাকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না দূর্জয়ের। দূর্জয়ের শক্ত, কঠোর, তেজী স্বরটা উচ্চারণ করে,

“ শি ইজ অলরাইট স্যার। স্টিল আই উইল কল হার। “

তেজী স্বরে দু বাক্যে জবাব দিয়েই দূর্জয় বেরিয়ে আসে জুলফিকারের রুম থেকে। রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াতে বেরিয়ে আসতেই জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। তার সাথে কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকা মানুষটার মুখের উপর বারবার মিথ্যা বলতে তার অসহনীয় যন্ত্রণা হয়। সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই দূর্জয় ব্যস্ততার অজুহাতে যথাসম্ভব তার সাথে কথা বলা এড়িয়ে যায়। বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা সত্যটা গত একবছরে কাউকে জানতে দেয় নি সে। বেশ কায়দা করে মিথ্যার আড়ালে সত্যটা চেপে গিয়েছে। কারণ সে বেশ ভালো করেই জানে অপেক্ষারত সেই মানুষটার কাছে দূর্জয়ের বলা মিথ্যাটা সহনীয় হলেও সত্যটা সে সইতে পারবে না। সেজন্যই তো দূর্জয়ের এতো আয়োজন!

__________

মেঘের আবরণ সড়ে গিয়ে দুপুরের তপ্ত রোদের হাতছানি যখন ধরাপটে তখনকার চিত্র। কোলাহলে মুখর কলেজের রাস্তার মোড়ে একটা সাদা রঙের মাইক্রো গাড়ি থেমে আছে। গাড়ির ভেতর রয়েছে চারজন মানুষ। সামনের দু’জনের দৃষ্টি কলেজ গেটের দিকে নিবদ্ধ হলেও পিছনে বসা দু’জনের দৃষ্টি একটা ছবির দিকে নিবদ্ধ। বারবার ছবিটাতে চোখ বুলিয়ে মুখশ্রীটা মুখস্থ করে নিতে ব্যস্ত তারা। প্রাপ্ত আদেশে কোনো ভুল করার অবকাশ যেনো না হয় সেই নিশ্চয়তা দিতেই এতো মনযোগ তাদের।

মিনিট পাঁচেক পরে ফ্রন্ট সিটে বসে থাকা একজন বলে উঠে,

“ এই মেয়েটাই না? “

পিছনে বসে থাকা দুটি মানুষ চোখ তুলে সামনে তাকায়। বেশ সতর্ক দৃষ্টি মেলে পরখ করে কলেজ ইউনিফর্ম পরিহিত মেয়েটাকে। লম্বা চুলগুলো একটা বিনুনি করা, অতি ধীর তার পায়ের গতি, বোকা বোকা চোখ মেলে বান্ধুবীদের কথা শুনতে ব্যস্ত মেয়েটাকে দেখতেই ব্যাক সিটে বসা একটা গম্ভীর স্বর আদেশ করে,

“ গাড়ি স্টার্ট দাও। “

আদেশটুকু কানে যেতেই ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটা লুকিং গ্লাসে নিজের মাস্ক দিয়ে চেহারা ঠিকঠাক ভাবে ঢাকা কিনা তা একবার নিশ্চিত হয়ে নেয়। বাকিরাও মাস্ক দ্বারা মুখটা ঢেকে নেয়। গাড়িটা স্টার্ট দিয়েই সমীচীন গতিতে কলেজের গেটের দিকে এগোয় তারা। ব্যাক সিটে বসে থাকা একজন খুব কৌশলে চলন্ত মাইক্রোর একপাশের দরজা খুলে দেয়। কিছু বুঝে উঠার আগেই নির্দিষ্ট শিকারকে একটানে চলন্ত গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। এতক্ষণ সমীচীন গতিতে চলা মাইক্রোটা স্পিড বাড়িয়ে দেয় মুহুর্তেই। চঞ্চল পরিবেশটা মুহুর্তেই থমথমে হয়ে যায়। ঘটনার সাক্ষী সকলে হতভম্ব ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয় সেই নাম্বার প্লেটহীন মাইক্রোটার দিকে।

__________

শান্ত হেডকোয়ার্টারটা অশান্ত হয়ে উঠলো এক নারীর আগমনে। জরুরি ভিত্তিতে একজন সৈনিক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবাকে এসে জানালো একজন নারী তার সাথে দেখা করার জন্য এসেছে। জুলফিকার মুজতবা অনুমতি দেয় সেই নারীকে প্রবেশ করার। কিছু মুহুর্তের ব্যবধানেই তার রুমে ক্ষিপ্র পায়ে প্রবেশ করে মধ্যবয়স্কা একজন মহিলা। সেই নারীর আগমনের ধাক্কা সামলানোর পূর্বেই জুলফিকারের ইউনিফর্মের কলার সেই নারীর হাতের মুঠোয় চলে যায়। কান্না জর্জরিত হিংস্র নারী স্বর বলে উঠে,

“ আমার মেয়ে কোথায় জুলফিকার? “

অদ্ভুৎ এবং অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটা শুনে বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয় জুলফিকার। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ এই প্রশ্ন আমাকে করার মানে কি? নিশার কি তোমার সাথে থাকার কথা না? “

“ আমার মেয়ে কলেজ থেকে বাসায় ফিরে নি। কলেজের সামনে থেকে আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। “

জুলফিকার বিস্মিত গলায় শুধায়,

“ কি বলছো নাঈমা? কারা করেছে এই কাজ? “

জুলফিকারের শেষ প্রশ্নটা শুনে নাঈমা ক্ষুধার্ত বাঘিনীর ন্যায় ফুসে উঠে,

“ আমার মেয়ের বা আমার কারো সাথে কোনো শত্রুতা নেই জুলফিকার। কিন্তু তোমার আছে। আল্লাহ জানে কোন হায়নার দল আমার নিষ্পাপ মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। আমার মেয়ের সামান্যতম ক্ষতি আমি মেনে নিবো না। ধ্বংস করে দিবো সব। “

নাঈমার ক্ষুদ্ধ অভিযোগ ও হুমকি জুলফিকার কানে তুলে না। সে জোর করে নাঈমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে গলা উঁচু করে একজন সৈনিককে ডাকে। রুমের বাহিরে অপেক্ষারত সৈনিক ভিতরে প্রবেশ করতেই জুলফিকার আদেশ দেয়,

“ ম্যাডামের জন্য পানি আনাও। উনার দিকে খেয়াল রাখো। “

দায়িত্ব হতে ছোট্ট আদেশটুকু দিয়েই জুলফিকার ব্যস্ত হাতে ফোনে একটা নাম্বারে ডায়াল করতে করতে বেরিয়ে যায়। অপরপাশ হতে কলটা রিসিভ হতেই জুলফিকার ব্যস্ত গলায় বলে,

“ এখনি মিটিং রুমে উপস্থিত হতে বলো সবাইকে। রাইট নাও! “

__________

অন্ধকার রুমে পাটির উপর বসে থাকা রমণী ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে চারিদিকে তাকাতে ব্যস্ত। বাহিরের পৃথিবীর একবিন্দু আলোও এই রুমে প্রবেশের সুযোগ নেই। না বুঝার অবকাশ আছে এখন দিন নাকি রাত। কলেজ ইউনিফর্ম পরিহিত রমণী থেকে থেকে ভীত গলায় ডাকছে,

“ আম্মু? আম্মু? “

কিন্তু তার ডাকের পিঠে আম্মু নামক মানুষটার কোনো উত্তর মিলছে না। পায়ের ব্যথায় ক্লান্ত রমণী এবার শব্দ তুলে কান্না করে উঠলো। পত্রিকা পড়ার বদৌলতে তার ভালোই ধারণা আছে তার সাথে এই মুহুর্তে কি কি খারাপ ঘটনা ঘটতে পারে। ভয়ংকর সম্ভাবনা গুলো মনে উঁকি দিতেই রমণীর ভয়ে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হয়।

তখনই রুমের দরজা স্ব শব্দে খুলে যায়। অন্ধকার রুমে পাশের রুম হতে অনেকটা আলোর রেখা প্রবেশ করে। সেইসাথে প্রবেশ করে একজন যুবক ও দুইজন ত্রিশার্ধো পুরুষ। কাটকাট চেহারার মাস্ক পরিহিত যুবকের হাতে রয়েছে একটা ক্যামেরা। সেই ক্যামেরার পানে তাকিয়ে রমণী আরেক দফা ভয় পেয়ে যায়।

গম্ভীর মুখশ্রীর যুবক রমণীকে একবার দেখে নিয়ে বলে উঠে,

“ ইয়াসমিন মুজতবা নিশা। “

আগুন্তকঃ যুবকের মুখে নিজের নামটা শুনেই নিশার ভয়ে কপোকাত হৃদয়টা একটুখানি হয়ে যায়। সে সাথে সাথে কান্না মিশ্রিত গলায় বলে,

“ ভাইয়া আমাকে যেতে দিন। প্লিজ আমাকে যেতে দিন। “

আগুন্তকঃ যুবক রাশভারী গলায় বলে,

“ অবশ্যই যেতে দিবো। আগে তোমাকে আমাদের একটা কাজ করতে হবে। “

“ কি কাজ? “

নিজের হাতের ক্যামেরাটা দেখিয়ে যুবক বলে,

“ শুধু নিজের বাপকে হাই জানাবে। ব্যস। এইটুকুই। “

এহেন অদ্ভুত কথা শুনে নিশা অবাক হওয়ার সুযোগ পেলো না। তার আগেই সেই যুবক ক্যামেরা অন করে তার দিকে তাক করলো। নিশা বোকা বোকা চোখ মেলে একবার ক্যামেরার দিকে তো একবার ক্যামেরার পিছনে থাকা যুবকের দিকে তাকায়। যুবক চোখ রাঙাতেই নিশা ফোলা ফোলা চোখ ক্যামেরার দিকে তাক করে অস্ফুটে উচ্চারণ করে,

“ আব্বু! “

ছোট্ট ডাকটা শেষ হতে না হতেই একটা তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা গেলো। নিশা নিজের রক্তাক্ত বাম পা চেপে ধরে বিকট স্বরে আর্তনাদ করে উঠে। নিশার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ত্রিশার্ধো দুই পুরুষের মুখও কাপড় দ্বারা বাঁধা। তাদের একজনই এইমাত্র নিশার পা বরাবর গুলি ছুড়েছে। গুলি ছোড়া শেষ হতেই সে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,

“ লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা। শুনলাম সাপের সন্ধানে আপনি একদল চিতা নিয়ে গর্ত খুড়ছেন। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না গর্ত খুড়ে যেই সাপ বের হবে তার বিষ এতটাই ভয়ংকর যে আপনি আর আপনার চিতাবাঘের দল তার এক ছোবলেই প্রাণ হারাতে বাধ্য। তাই অযথা এই খোড়াখুড়ির কাজ বন্ধ করুন। আর যদি না করেন তাহলে পরবর্তী বুলেটটা আপনার মেয়ের মাথায় ছোড়া হবে। “

ক্যামেরাটা অফ করতেই ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে নিশা পাটির উপর লুটিয়ে পড়লো। আর্তনাদ করার আর কোনো সুযোগ দেওয়া হলো না তাকে। মুখের ভেতর গুজে দেওয়া হলো একটা বড় কাপড়ের দলা। ব্যথাটুকু আর সইতে না পেরে মুহুর্তেই সে জ্ঞান হারায়। সেই দৃশ্য দেখে পুরুষ দুইজন ঠাট্টা করে বলে,

“ কর্নেলের মেয়ের দেখি মুরগির থেকেও করুণ অবস্থা। “

রাশভারী যুবক অবশ্য সেদিকে তোয়াক্কা করলো না। সে সোজা রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটা ফোনকল রিসিভ করে। ফোনের অপরপাশ হতে এক নারী কণ্ঠ ভেসে আসতেই সে প্রতুত্তর করে,

“ আ’ম মিসিং ইউ মোর। শীঘ্রই দেখা হবে। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]