এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৯+১০

0
204

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৯.

লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবার জরুরি তলবে মিটিং রুমে হাজির হয়েছে সামরিক বাহিনীর ১১ জন দক্ষ লেফটেন্যান্ট। ইতিমধ্যে সকলের কানে পৌঁছে গিয়েছে যে লেফটেন্যান্ট কর্নেলের মেয়েকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছে। বিষয়টার সাথে কে বা কারা জড়িত থাকতে পারে তা ইতিমধ্যে সবাই অনুমান করতে পারছে। মিটিং রুমে আরো উপস্থিত রয়েছে দু জন কর্নেল এবং একজন কম্পিউটার অপারেটর। ষোলকলা পূর্ণ হয় মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়ের আগমনে।

দূর্জয় মিটিং রুমে প্রবেশ করেই চিন্তিত গলায় শুধায়,

“ স্যার, নিশার কোনো আপডেট পাওয়া গিয়েছে? কিংবা ওর এড্রেস ট্রেস করা সম্ভব হয়েছে? “

জুলফিকার মুজতবা নত মাথাটা সামান্য নেড়ে না জানায়। একজন কর্নেল জুলফিকারকে আশ্বস্ত করে বলে,

“ ডোন্ট ওয়ারি জুলফিকার। বেস্ট ফোর্স পাঠানো হবে। তোমার মেয়ের কিছু হবে না। “

কর্নেলের কথাটুকু শেষ হতেই কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা একজন সামরিক অপারেটর বলে উঠে,

“ স্যার! অনলাইন ওয়েবসাইটে একটা ভিডিও পাবলিশড করা হয়েছে। আমি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে ভিডিওটা প্লে করছি। দেখুন। “

জুলফিকার সহ সকলেই উদগ্রীব নয়নে বিশাল মাল্টিমিডিয়া স্ক্রিনের দিকে তাকায়। মুহুর্তেই সফেদ স্ক্রিনে ভেসে উঠে কলেজ ইউনিফর্ম পরিহিত এক মেয়ের কান্নারত মুখশ্রী। ক্যামেরার পানে তাকিয়ে তার অস্ফুটে উচ্চারিত আব্বু ডাকটা জুলফিকারের কানে পৌঁছাতেই তার পিতা সত্তার নরম কোমল অবয়বটা মুখে ফুটে উঠে। কিন্তু মুহুর্তেই বিকট শব্দে মেয়েকে চিৎকার করে উঠতে দেখে তার সেই কোমল অবয়বটা উবে গেলো। সে আর্তনাদ করে উঠলো,

“ নিশা! “

সেই এগারো জন লেফটেন্যান্টের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সাইফ এতক্ষণ হতভম্ব দৃষ্টি মেলে দেখছিলো স্ক্রিনের নিশা নামক মেয়েটাকে। আরো ছয় জোড়া হতভম্ব দৃষ্টি তখন তার দিকে নিবদ্ধ। এই মেয়েটা তবে লেফটেন্যান্ট কর্নেলের মেয়ে? এই প্রশ্নটা মাথায় উঁকি দিতেই সাইফ বিষম খেলো। অজান্তে করা ভুলের জন্য মাথা ঠুকে মরে যেতে মন চাইলো। ছিচেকাদুনি এই মেয়েটা যদি সাইফের নামে লেফটেন্যান্ট কর্নেলের কাছে নালিশ করে তখন কি কি হতে পারে সেই হিসেব কষতে যখন ব্যস্ত সাইফ ঠিক সেই মুহুর্তে তার চোখের সামনে স্ক্রিনে ভেসে উঠলো আরেকটা দৃশ্য। একজন আতঙ্কবাদী বেরহমের সাথে গুলি করে মেয়েটার পা বরাবর। সাথে সাথে মেয়েটা তীব্র আর্তনাদ করে রক্তাক্ত পা চেপে ধরলো। এইটুকু দৃশ্য দেখেই সাইফের মেজাজ চরম বিগড়ে গেলো। শক্ত গলায় সে উচ্চারণ করে,

“ জানোয়ারের বাচ্চা। “

তার উচ্চারণ করা শব্দটা কর্নেল কিংবা অন্যদের কানে না পৌঁছালেও তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা লেফটেন্যান্টদের কানে ঠিকই পৌঁছালো। রাফি, জুনায়েদ, প্রত্যয়, সাদাত, রিদওয়ান, ফারদিন সকলেই এক পলক সাইফকে দেখে নিয়ে ফের স্ক্রিনের দিকে মনযোগ দেয়। আতঙ্কবাদীর বলা হুমকিসরূপ কথাটা দিয়ে ভিডিও ক্লিপ শেষ হতেই জুলফিকার রাগ মিশ্রিত সুরে আদেশ করে,

“ এখনই এই ভিডিও কোন জায়গা থেকে পাব্লিশ করা হয়েছে সেই ইনফরমেশন বের করো। “

কম্পিউটার অপারেটর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে কানে হেডফোন গুজে ডিউটি এবং অর্ডার পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছু সময়ের ব্যবধানেই সে কাঙ্ক্ষিত এড্রেস ট্রেস করে ফেলে। চট্টগ্রামের নির্জন এক পাহাড়ি এলাকার এড্রেসটা সম্পর্কে জুলফিকারকে অবহিত করতেই জুলফিকার কর্নেল হতে অনুমতি নিয়ে ছয় সদস্যের একটা বিশেষ টিম উক্ত স্থানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানায়। সেই ছয় জন সদস্যের দলের মধ্যে সাইফ এবং প্রত্যয়ও রয়েছে। দূর্জয় উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,

“ স্যার, অনুমতি থাকলে আমিও যেতে চাই। “

জুলফিকার দূর্জয়ের আবদার নাকোচ করে বলে,

“ তোমার উপর অন্য দায়িত্ব আছে দূর্জয়। বাকি পাঁচজন সহ তুমি রইস দিলদারের সন্ধানে যাবে। “

অর্ডার না মানা দূর্জয়ের স্বভাবের বহির্ভূত কাজ। সে মাথা নেড়ে এগিয়ে গিয়ে জুলফিকারকে জড়িয়ে ধরে। এই মানুষটার সাথে তার কেবল প্রফেশনাল লাইফের নয় বরং ব্যক্তিগত এবং আত্মিক একটা সম্পর্কও আছে। দূর্জয়ের মরহুম পিতা শাহরিয়ার রিফাতির সঙ্গে জুলফিকার মুজতবার ভাতৃত্ব সমতুল্য বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিলো। সেই সম্পর্ক এতটাই গভীর ছিলো যে প্রাণপ্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর পরও তার সন্তানকে একা ছেড়ে দেয় নি জুলফিকার। নিজের সন্তানের ন্যায়ই ভালোবেসেছে, স্নেহ করেছে, একজন মেন্টরের ন্যায় সঠিক গাইডলাইন দিয়েছে। বেহিসাবি এই ভালোবাসা ও স্নেহের প্রতিদান হিসেবে দূর্জয় এই মানুষটার প্রতি সবসময় মনে লালন করে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

দূর্জয় আলিঙ্গন মৃদু দৃঢ় করে শুধায়,

“ নিশা উইল বি ব্যাক সেফলি। “

__________

সাইলেন্সার বসানো রিভলবারটা নিশানা বরাবর তাক করে গুলি ছুড়তেই তা সদূরে অবস্থিত গোলাকার এক নিশানা চিত্র ভেদ করে চলে গেলো। টের পেলো না কোনো কাক পক্ষী। সঠিক নিশানায় গুলি ছুড়তেই পঞ্চাশর্ধো শমসের মজুমদারের মুখে এক দাম্ভিক ভাব ছড়িয়ে পড়লো। আত্মঅহংকারে ফুলে ফেঁপে উঠলো তার বুক। খোলা আকাশের নিচে বাড়ির পেছনের সবুজ এই খোলা মাঠটা তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত। এখানে দাঁড়িয়ে সারাদিন সে পিস্তল চালালেও তাকে কেউ কিছু বলতে পারবে না।

শমসের মজুমদারের পাশে দাঁড়ানো যুবকটার ফোন হঠাৎ বেজে উঠতেই তার মনযোগে ব্যাঘাত ঘটে। শমসের আড়চোখে তাকায় যুবকের পানে। কিছুক্ষণ কথা বলে যুবক ফোনটা রেখেই হাসিমুখে বলে উঠে,

“ লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা পর্যন্ত আপনার ম্যাসেজ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে স্যার। “

শমসের বাকা হেসে শুধায়,

“ আমরা শক্তিশালী কেন জানো? “

“ কেন স্যার? “

পিস্তলের নলের মাথায় সামান্য ফু দিয়ে ধোঁয়া উড়ানোর মতো করে শমসের বলে উঠে,

“ করাণ আমাদের কোনো দূর্বলতা নেই। পরিবার পরিজন এসব হলো মানুষের দূর্বলতার জায়গা। কিন্তু যেই পুরুষ পরিবার দিয়ে বাঁধা নেই সে সবথেকে শক্তিশালী পুরুষ। “

শমসের বলা কথার সাথে একমত পোষণ করে যুবক মাথা নাড়ায়। হাতে থাকা পিস্তলটা এবার গাছে বসে থাকা এক পাখির দিকে তাক করে শমসের বলে,

“ কিন্তু আমার এই তিলে তিলে তৈরী করা সংঘের খুঁটির মধ্যে ত্রুটির দেখা মিলেছে। আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে সংসার পেতে বসেছে সে। ভেবেছে আমি কখনো জানতে পারবো না। কিন্তু ও হয়তো ভুলে গিয়েছে আমি কে। যেই পাপের সাম্রাজ্যের খুঁটি ও সেই সাম্রাজ্য আমি স্থাপন করেছি। ওর মতো এতিমকে গড়ে তুলেছি নিজের মতো করে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মস্ত বড় ভুল করেছি। বাচ্চা সাপটা দুধ কলা খেয়ে কালসাপে পরিণত হয়েছে। ওর দূর্বলতায় হাত দিলে যে আমাকে ছোবল মারার আগে একবারও ভাববে না তা খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে। “

কথাটুকু বলেই শমসের সেই পাখির দিকে তাক করে রাখা রিভলবারের ট্রিগার পুল করলো। মুহুর্তেই মৃত শালিক পাখির দেহটা লুটিয়ে পড়লো মাঠে। যুবকটা এতক্ষণ খুব মনযোগ দিয়ে শমসেরের কথা শুনলো। অত:পর ইতস্তত গলায় প্রশ্ন করলো,

“ আপনার কি অর্ডার স্যার? ছোবল মারার আগেই কি বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া উচিত? “

“ না। এখনই না। বহুদূর পর্যন্ত এসে মাঝপথে আমি সব ভেস্তে দিতে চাই না। ওর প্রয়োজন পড়বে আমার। একবার প্রয়োজন মিটুক তারপর ওকে দেখে নিবো আমি। “

“ স্যার? জুলফিকার মুজতবার মেয়ের ব্যাপারে কি আদেশ আপনার? ইতিমধ্যে সৈন্যরা নিশ্চয়ই এড্রেস ট্রেস করে রেস্কিউর উদ্দেশ্যে রওনাও দিয়ে দিয়েছে। “

শমসের মৃদু বাকা হেসে বলে,

“ আমার চিতা সাহসী সৈন্যদের অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে রেখেছে। “

শমসেরের কথার অর্থ বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো যুবকের। বুঝতে পেরে সে-ও পৈশাচিক হাসি দিয়ে উঠলো।

__________

নিরিবিলি কফিশপটায় বসে তীক্ষ্ণ ও সতর্ক দৃষ্টি মেলে চারিদিকটা পরখ করতে ব্যস্ত লেফটেন্যান্ট সাদাত সরকার। মোর্শেদ হতে রইস দিলদারের সম্ভাব্য কিছু ঠিকানা জোগাড় করে সিভিল গেটাপে বিচ্ছিন্ন ভাবে তার তালাশে বেড়িয়েছে দূর্জয় এবং তার দলের পাঁচজন যুবক। মোর্শেদের মুখে শোনা রইস দিলদারের বাহ্যিক বিবরণ অনুযায়ী সন্দেহভাজন কাউকেই এখনো চোখে পড়ে নি সাদাতের। আল্লাহ ভালো জানেন অসভ্যের বাচ্চাটা কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে!

একজন ওয়েটার গরম গরম ধোঁয়া উঠা একটা কফির কাপ সাদাতের সামনে এনে রেখে চলে যায়। সাদাত সেই অপ্রয়োজনীয় কফি কাপটার দিয়ে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করে না। তার অতি মনযোগের মধ্যে কানে থাকা ব্লু টুথ ডিভাইস হতে ভেসে আসলো মেজর দূর্জয়ের কণ্ঠস্বর,

“ হান্টার ৩। এনি আপডেট? “

সাদাত চারিদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে জবাব দিলো,

“ নো স্যার। স্টিল নো সাসপেক্টেড ডিটেক্টেড। “

কথাটুকু শেষ করতেই সাদাতের চোখ স্থির হলো ঠিক তার বামে তিন টেবিল সামনে বসা এক নারীর দিকে। মুহুর্তেই সাদাতের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। তার তীর্যক দৃষ্টি ঠাহর করতে পেরেই সেই নারী অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। এলোমেলো দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে হাতে থাকা জিনিসপত্রগুলো ব্যাগে চালান করে দিলো। টেবিলের উপর বিলটা রেখে বিনাবাক্য ব্যয়ে সেই নারী মুহুর্তেই কফিশপ থেকে প্রস্থান করলো।

সাদাত বিচক্ষণ দৃষ্টি মেলে একবার কফিশপের চারদিকে তাকালো। কফিশপের তিন কর্নারে থাকা তিনটা সিসিটিভি ফুটেজ একবার দেখে নিয়েই সে-ও বিলটা টেবিলের উপর রেখে বড় বড় কদম ফেলে বেড়িয়ে গেলো কফিশপ থেকে।

কফিশপের দুই গলি পরে নিস্তব্ধ রাস্তা ধরে হাঁটছে এক নারী। প্রবল আগ্রহ ভরা দৃষ্টি মেলে দেখছে চারিদিকটা। পড়নে তার সাদা রঙের একটা টি শার্ট এবং জিন্সের প্যান্ট। তার উপর হাঁটু সমান অলিভ রঙের একটা ওভারকোটও পড়েছে সে। রেড ওয়াইন রঙের চুলগুলোকে উঁচু করে পোনিটেল করে রেখেছে। আচমকা তার কাধে ঝুলন্ত কালো সাইড ব্যাগটায় টান পড়তেই সেই নারী হতভম্ব দৃষ্টি মেলে ফিরে তাকালো। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চির এক টগবগে যুবককে চোখে পড়লো তার। সহজ করে বলতে গেলে সুদর্শন দেখতে এই পুরুষ চেহারা সে এই প্রথম দেখছে না।

একটু আগে সেই ভিন্টেজ কফিশপটাতেও এই পুরুষের নজরকাড়া মুখশ্রী তার চোখে পড়েছিলো। এবং চোখে পড়তেই তার অবচেতন মন বলে উঠেছিলো এই সুপুরুষটা দেখতে অনেকটা নাইন্টিসের আর্জুন রামপালের মতো দেখতে। কিন্তু ভদ্র দেখতে এই পুরুষ হঠাৎ অভদ্রের ন্যায় তার ব্যাগ ধরে কেন টান দিলো তা বুঝতে পারছে না সে। শুধু ব্যাগ টান মেরেই ক্ষান্ত হয়নি বরং তার ব্যাগ হতে তার ব্যাক্তিগত ডায়েরিটাও বের করে নিয়েছে। মেয়েটা রেগে গিয়ে বলে,

“ আরে আরে করছেন কি? “

সাদাত মেয়েটার কথার তোয়াক্কা না করে ডায়েরির কিছু পাতা উল্টে একটা পৃষ্ঠা বের করে তা একটানে ছিড়ে ফেলে। মেয়েটা আঁতকে উঠে বলে,

“ পাগল নাকি? “

সাদাত ব্যাগ এবং ডায়েরিটা মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে সেই কাগজটা কুটি কুটি করে ছিড়ে ফেলে। মেয়েটা এবার চটে উঠে বলে,

“ এক্সকিউজ মি? এমন অভদ্রের মতো আচরণের মানে কি? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া আমি কত কষ্ট করে স্কেচটা করেছি?

সাদাত কাগজের টুকরো গুলো রাস্তায় ফেলে দাঁতের সাথে দাঁত পিষে বলে উঠে,

“ কারো পারমিশন ছাড়া তার স্কেচ করাটাও অভদ্রতার কাতারে পড়ে। হোপ ইউ উইল কিপ ইট ইন মাইন্ড ফ্রম নাও অন। “

কথাটুকু বলেই সাদাত আর পিছনে ফিরে না তাকিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। মেয়েটা একপলক রাস্তায় অবহেলায় পড়ে থাকা নিজের স্কেচের পানে তাকিয়ে ফের চোখ তুলে সামনে চাইলো। দেখতে আর্জুন রামপালের মতো হলে কি হবে? আচরণ একদম বাংলা সিনেমার খচ্চর চৌধুরী সাহেবের মতো। অহংকারী, অভদ্র, জাদরেল কোথাকার!

__________

ট্র্যাকড এরিয়ার কাছাকাছি এসেই সামরিক হেলিকপ্টারটা আকাশপথে নির্দিষ্ট একস্থানে স্থির হয়। নিরাপত্তার কারণে সরাসরি ট্র্যাকড প্লেসে হেলিকপ্টার নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই। চিকন শক্ত তারের মতো দঁড়ি ধরে সমতলে নেমে আসে ছয়জন সৈন্য। সমতলে নেমেই তারা সবাই আপন পজিশনে দাঁড়িয়ে নিজেদের রাইফেল তাক করে ধরে। সম্পূর্ণ এরিয়াটা একবার পরীক্ষা করে নিয়েই তারা কাঙ্ক্ষিত এড্রেস অনুযায়ী এগিয়ে যায়। পাহাড়ি এই এরিয়াটায় জনমানবের কোনো বসতি নেই বললেই চলে। শত্রুরা বেশ ভালো জায়গার সন্ধান জানে বলতেই হয়।

সাইফ সরু দৃষ্টি মেলে সামনে একপা একপা করে এগিয়ে যাচ্ছে। এখানে আসার পথে প্রত্যয় তাকে জানিয়েছে যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং তার স্ত্রীর বেশ কয়েক বছর আগেই ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। নিশা নামক সেই মেয়েটাও তার মায়ের সাথেই থাকে। তাহলে সেদিন নিজের আম্মুকে কল না করে আব্বুকে কল করেছিলো কেন নালিশ করার জন্য? সাইফ নিজের ভাবনাকে দুটো গালমন্দ করে বলে,

“ ধ্যাৎ! যেই মাইয়্যার বাপ আর্মিতে ওই মাইয়্যা তো বিপদে পড়লে আগে নিজের বাপরেই কল করবো! “

এরকম আরো অপ্রয়োজনীয় ভাবনায় বুদ হয়েই একটা ইটের তৈরী একতলা বাসার কাছে পৌঁছে যায় তারা। ছয়জন সৈন্য সুকৌশলে সম্পূর্ণ বাসা চারিদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। রাইফেল এমন দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছে যেন গোলাবর্ষণের জন্য প্রস্তুত তারা। বিচক্ষণ ছয় জোড়া চোখ চারিদিকটা আরেকবার পরখ করে নিয়েই তাদের কষা ছক অনুযায়ী দুজন অতি সাবধানে একতলা বাড়িটার নীল রঙা কাঠের দরজার সামনে গিয়ে অবস্থান নিলো।

প্রত্যয় দরজার দিকে রাইফেল তাক করে ধরতেই সাইফ মনে মনে বিসমিল্লাহ বলে এক লাথি মারতেই পুরনো দরজাটা স্ব শব্দে খুলে যায়। দরজার বাহির থেকে খালি রুমটা একবার পর্যবেক্ষণ করে ভিতরে পা রাখে সাইফ। তার পিছু পিছু প্রত্যয় সহ আরো দুজন ভিতরে প্রবেশ করে। বাকি দুজন বাহিরে রয়ে যায় পাহাড়া দেওয়ার জন্য। দুই রুমের বাসাটার প্রথম রুমটা সম্পূর্ণ খালি দেখে এবার দ্বিতীয় রুমে প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি নেয় সাইফ। মনে মনে আরো একবার বিসমিল্লাহ বলে দরজাটা আলতো ধাক্কা দিতেই তা খুলে যায়।

ফ্লোরের উপর বিছানো পাটিতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এক রমণী। তার সাদা পাজামার একপাশটা রক্তে লাল হয়ে আছে। গুলি করা স্থানে হয়তো রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্য একটা কাপড় দ্বারা শক্ত করে বেধে রাখা হয়েছে। খোলা দ্বারের ভেতর এই দৃশ্যটুকু দেখেই সাইফের মুখটা প্রচণ্ড রাগে লাল রঙ ধারণ করে। শালা কাপুরুষের দল। নারীর কাধে পিস্তল রেখে গুলি চালানো পুরুষরা কাপুরুষই বটে। সাহস থাকলে এরা লেফটেন্যান্ট কর্নেলের মেয়েকে না তুলে লেফটেন্যান্ট কর্নেলের সাহসী যোদ্ধা সাইফকে তুলে আনতো। সাইফ তখন এদের বুঝিয়ে দিতো কত মাছে কত কাটা!

ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে সাইফ ভেতরে প্রবেশ করতেই তার পিছু পিছু বাকি তিনজন প্রবেশ করে। কারো উপস্থিতি টের পেতেই নিশা ভীত দৃষ্টি মেলে তাকায়। তার ভয় আরো গাঢ় হয় সাইফ এবং প্রত্যয়ের চেহারা দেখে। সে একটা ঢোক গিলে ভয়ে চিৎকার দেওয়ার প্রস্তুতি নিতেই সাইফ তাকে আশ্বস্ত করে বলে,

“ ঘাবড়াবেন না। আমি লেফটেন্যান্ট তামজিদ সাইফ। আপনার আব্বু লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা আমাদের পাঠিয়েছেন আপনাকে উদ্ধার করার জন্য। “

আব্বুর কথা শুনতেই নিশা সামান্য ভরসা খুঁজে পায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই সাইফকে এগিয়ে আসতে দেখে সে চেঁচিয়ে উঠে,

“ আসবেন না। “

সাইফ ভ্রু কুচকে তাকাতেই নিশা অতি সাবধানে উঠে বসে নিজের গায়ে জড়ানো ময়লা শালটা সরিয়ে ফেলে। সাথে সাথে সাইফ সহ বাকি তিনজনের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। নিশার পেটের কাছে বাধা ওই ভয়ংকর সাংঘাতিক জিনিসটা দেখেই সাইফ ব্যস্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠে,

“ ব্রিং দ্যা ডিফিউজ কিট রাইট নাও। “

প্রত্যয় এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। সাইফ ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে নিলেই নিশা ফের কান্নারত গলায় চিৎকার করে উঠে,

“ প্লিজ আসবেন না। শুধু দূর থেকেই আমার আম্মু আব্বুকে কল করুন। আমি উনাদের সাথে শেষ বারের মতো কথা বলতে চাই। “

সাইফ নিশার ভীত স্বরে করা আবদার ও নিষেধকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নিশার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে। তার বিচক্ষণ দৃষ্টি টাইম বোমের দিকে নিবদ্ধ। তেরো মিনিট সাতাশ সেকেন্ড। সময়টা দেখে নিয়েই সাইফ ফের ধমকের সুরে চেঁচালো,

“ সময় নেই। দ্রুত ডিফিউজ কিট নিয়ে এসো। “

এবার বাকি দু’জনও দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো ডিফিউজ কিট আনার উদ্দেশ্যে। সাইফ এবার টাইম বোমটা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সরাসরি নিশার চোখে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বলে উঠে,

“ চিন্তা করবেন না মিস ইয়াসমিন। আমি খুব দুর্দান্ত বোম ডিফিউজার। আপনাকে অভিযোগের কোনো সুযোগ দিবো না। “

নিশা কান্না বিরতি দিয়ে ফোলা ফোলা চোখ মেলে বোকা স্বরে প্রশ্ন করে,

“ আর যদি আপনি ব্যর্থ হন? “

সাইফের মেজাজ গরম হয়ে যায় নিশার এমন কথায়। মনে মনে বলে,

“ শালার পুরা মাইয়া জাতই একটা ব্যাডবাজ। “

মনে মনে এটা বললেও সাইফ বেরস সুরে উচ্চারণ করে,

“ তাহলে দুজনেই মরবো। “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১০.

প্রচন্ড ভয় নিয়ে সাইফের পানে তাকিয়ে রইলো নিশা। গলাটা বেজায় শুকিয়ে আছে। গত কয়েক ঘন্টায় আতঙ্কবাদীরা তাকে এক বিন্দু পানিও মুখে তুলতে দেয় নি। পায়ের ব্যথাটাও একপ্রকার সহনীয় হয়ে গিয়েছে এই পর্যায়ে। নিশা ক্লান্ত দেহটা দেয়ালে এলিয়ে দিয়ে খরা ধরা গলায় বলে,

“ আপনি চলে যান ভাইয়া। মরতে হলে আমি একা মরবো। দেশের জন্য জীবন গেলে তো আমাকে শহীদ বলা হবে তাইনা? “

সাইফ অবাক দৃষ্টি মেলে নিশার দিকে তাকালো। ভীতু মেয়েটা হঠাৎ মরার কথা বলছে কেন? সাইফ প্রশ্ন করে,

“ মৃত্যুকে ভয় পাও না? “

নিশা ব্যথাতুর চোখে তাকিয়ে থেকে বলে,

“ বাবা সবসময় বলতো মাতৃভূমি সবার উপরে। দেশের জন্য জীবন গেলে তাতে ভয় অথবা আফসোস থাকবে না। “

সপ্তাদশী রমণীর মুখে এই ভারী কথাগুলো খুব পছন্দ হলো সাইফের। কিন্তু সে কিছু বলার পূর্বেই প্রত্যয় ব্যস্ত পায়ে ডিফিউজ কিট নিয়ে প্রবেশ করে। সাইফ এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে সাথে সাথে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত হয়। হাতে সময় আছে কেবল আট মিনিট তেতাল্লিশ সেকেন্ড। সাইফ প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ সবাইকে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সড়ে যা। “

প্রত্যয় একরোখা স্বরে বলে,

“ ওদের আমি ইতিমধ্যে দূরে সড়ে যাওয়ার কথা বলে এসেছি। তুই তাড়াতাড়ি বোম ডিফিউজ কর। “

সাইফ গভীর মনযোগে বোমের প্রতিটা তার দেখতে দেখতে উত্তর দেয়,

“ আমি তোকে যেতে বলেছি প্রত্যয়। “

“ তুই নিজের কাজ কর। “

সাইফ এই পর্যায়ে রেগে গিয়ে বলে,

“ শালা বাংলা সিনেমা পাইসোস? তোর এইসব রঙঢঙ বিয়ের পর নিজের বউরে দেখাইস। এখন আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ। “

প্রত্যয়ের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। সে কিছু বলবে তার পূর্বেই সাইফ চেঁচিয়ে উঠে,

“ আই সেইড গো। “

ব্যস। সাথে সাথে প্রত্যয় সেখান থেকে প্রস্থান করে। সাইফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনযোগ দিয়ে আপন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিশা চোখ বুজে মনে মনে কালেমা পড়তে ব্যস্ত তখন। সময় যখন আর কেবল এক মিনিট বাকি তখন সাইফের কণ্ঠ তার কানে ভেসে আসে।

“ চোখ খুলুন মিস ইয়াসমিন। আনফরচুনেটলি এই দফায় আমাদের দুজনের একজনও শহীদের মর্যাদা পেলাম না। “

নিশা ভীত চোখ জোড়া মেলে তাকায়। নাহ। টাইম বোমের সেই টিক টিক শব্দ এখন আর কানে ভেসে আসছে না। বরং উল্টো সেই বোমের একটা নীল রঙা ওয়্যার কাটা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। সাইফের দক্ষ এবং সুনিপুণ হাতে এই বোম ডিফিউজ করার ঘটনাটা নিশার ঠিক বিশ্বাস হলো না। সে অবিশ্বাস্যকর গলায় প্রশ্ন করে,

“ এম আই সেফ নাও? “

নিশার এই বোকা প্রশ্নে সাইফ বরাবরের মতোই বিরক্ত হয়। মনে মনে শুধায়,

“ মাইয়া মানুষের এই এক সমস্যা। নিজের চোখে দেখা ঘটনাও এরা সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। “

সাইফ নিশার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজের ইউনিফর্মের বুকপকেটে থাকা ওয়াকি টকিটা বের করে প্রফুল্ল গলায় শুধায়,

“ দ্যা বোম ইজ ডিফিউজড। “

কথাটুকু বলেই ওয়াকি টকিটা ফের পকেটে রেখে সাইফ উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,

“ হাঁটতে পারবেন ম্যাডাম? “

নিশা চোখ তুলে সাইফের পানে তাকায়। সম্পূর্ণ বাম পা তার অবশ অনুভূত হচ্ছে। তবুও মুখ ফুটে সেই কথা না বলে সে মৃদু মাথা নেড়ে বুঝায় যে সে হাঁটতে সক্ষম। সাইফ দুই হাত পিঠের পিছনে ভাজ করে দাঁড়িয়ে নীরবে পর্যবেক্ষণ করে নিশার ক্লান্ত ও আহত দেহ টেনে উঠে দাঁড়ানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা। অত:পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে নিজেই নিচের দিকে ঝুকে নিশাকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে মনে মনে বলে,

“ এই প্রজাতির আরেক সমস্যা হলো এরা কখনো মুখ ফুটে কি সমস্যা তা বলতে চায় না। “

আচমকা কান্ডে নিশার লজ্জায় মূর্ছা যাওয়ার কথা থাকলেও সে তীব্র ব্যথায় একহাতে বাম পা চেপে ধরে আর্তনাদ করে উঠে। পাজাকোলে উঠার ফলে তার সম্পূর্ণ শরীর মনে হচ্ছে এখন হাওয়ায় ভাসছে। পা দুটোও ঝুলে আছে। সেই দুই পায়ের মধ্যে তার বা পা’টা মনে হচ্ছে এখনই হাঁটুর নিচ থেকে ছিড়ে পড়ে যাবে। কি তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাদায়ক সেই ব্যথা! নিশা তীব্র ব্যথার তারণায় নিজের চিকন হাতের আঙুলগুলো দ্বারা সাইফের ইউনিফর্মের বুকের কাছটা খামচে ধরে। নিশার ব্যথাতুর মুখশ্রীর পানে তাকিয়ে সাইফ শান্ত গলায় শুধায়,

“ আর কিছুক্ষণ ধৈর্য্য ধরুন। এখান থেকে সোজা হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হবে আপনাকে। “

সাইফের কথা শেষ হতে না হতেই দুজন লেফটেন্যান্ট ভিতরে প্রবেশ করে। সাইফ নিশাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে তাদের একজনকে বলে উঠে,

“ তুমি কিটটা গুছিয়ে নিয়ে আসো সামির। আমি ইয়াসমিন ম্যাডামকে নিয়ে পিক আপ পয়েন্টে যাচ্ছি। উনাকে আর্জেন্ট হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। “

সামির কিট গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেই সাইফ এবং অপর লেফটেন্যান্ট সেই বাড়ি থেকে বের হয়েই দ্রুত পায়ে বাকিদের সহ পিক আপ পয়েন্টের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তারা যখন সেই বাড়ি থেকে ঠিক একাশি কদম দূরে এসে পৌঁছেছে ঠিক সেই মুহুর্তে পিছন থেকে ভেসে আসে বিকট ভয়ংকর শব্দ। শব্দের উৎস খুঁজতে পিছনে ফেরার পূর্বেই কোনো এক অজানা শক্তির ধাক্কায় এক নারীসহ পাঁচজন যুবক ছিটকে এক এক দিকে পড়ে গেলো।

বিকট শব্দের পর চারিদিক ছেয়ে গেলো পিনপতন নীরবতা। সেই নীরবতাকে চূর্ণ করতেই বোধহয় নিশা মৃদু স্বরে গোঙালো। ধোঁয়ায় চারিদিকটা বেশ আবছা আবছা হয়ে আছে। পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না। সাইফ কাশতে কাশতে সোজা হয়ে উঠে বসলো। তার ঠিক সামনেই মাটির উপর পড়ে থাকা নিশাকে দেখে এগিয়ে যেতে নিয়েও সে থেমে গেলো। হতভম্ব ভঙ্গিতে চকিতে পিছনে ফিরে সেই বাড়ির পানে তাকালো। মুহুর্তেই সে তীব্র স্বরে চিৎকার করে উঠলো একটা নাম ধরে,

“ সামির! “

প্রত্যয় ইতিমধ্যে উঠে ছুট লাগিয়েছে সেই বাড়ির দিকে। হতভম্ব আরো দুজন লেফটেন্যান্টরাও সেদিকে ছুটে গিয়েছে। সাইফ বিস্ময় কাটিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে যেতে নিলেই একজন লেফটেন্যান্ট তাকে বাধা দিয়ে বললো,

“ আমাদের ম্যামকে নিয়ে এই মুহুর্তে এখান থেকে যেতে হবে। শি ইজ ইঞ্জুরড। “

সাইফ আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছেড়ে অতি কষ্টে উচ্চারণ করলো,

“ সামির ওই বাড়ির ভেতর ছিলো। ও ও ইঞ্জুরড। ওকেও নিতে হবে সঙ্গে। লেট মি গো। “

লেফটেন্যান্ট আটকে রাখা কান্না গিলে নিয়ে বলে,

“ ওই বাড়ি অক্ষুণ্ণ নেই। ওখানে এখন সামিরের ইঞ্জুরড বডি না বরং ওর ছিন্ন বিছিন্ন শরীরের অংশ পাওয়া যাবে। “

সাইফ ধপ করে ফের মাটিতে বসে পড়লো। দূর হতে ভেসে আসছে প্রত্যয় সহ আরো দু’জন লেফটেন্যান্টের চিৎকার। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য সাইফ নিষ্পলক চেয়ে রইলো সেই পানে।

এরকম অসংখ্য সামির মাতৃভূমির মাটিতে দেশের স্বার্থে শহীদ হচ্ছে। ক’জনার নাম জানে এই দেশের সাধারণ নাগরিকরা? এইরকম বহু সামিররা এই দেশের মাটিতে জন্ম নেয় বলেই হয়তো সাধারণ নাগরিকরা নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমাতে পারে। কারণ তারা জানে এই সামিররাই একদিন বড় হয়ে তাদের এবং মাতৃভূমির সুরক্ষার জন্য নিজেরা রাতের পর রাত নির্ঘুম পাড় করবে। যেই নির্ঘুম রাতের সাক্ষী কেবল মহান প্রতিপালক। অত:পর একদিন তারা এভাবেই চির নিদ্রায় শায়িত হয়। সন্তানের ঘরে ফেরার অপেক্ষা করা পিতামাতার কাছে পৌঁছায় সন্তানের বুলেটে জর্জরিত নিথর দেহ কিংবা ছিন্ন বিছিন্ন দেহাংশ।

নিবিড়ভাবে চোখের সামনের বিধ্বংসী দৃশ্যপট দেখতে থাকা সাইফ তার সম্বিত ফিরে পায় এক রক্তাক্ত হাতের ছোঁয়ায়। সাইফের ডানহাতটা সেই হাতের ছোঁয়ায় মুহুর্তেই লাল বর্ণ ধারণ করলো। মাথা ঘুরিয়ে পাশে চাইতেই সে দেখলো জীবন তৃষ্ণায় তড়পাতে থাকা এক রমণীকে। অতি কষ্টে তার মুখে উচ্চারিত একটা শব্দ সাইফের কানে এসে পৌঁছায়৷

“ পানি… “

ব্যস! এইটুকুই। অসম্পূর্ণ কথা মুখে রেখেই দ্বিতীয় দফা চেতনা হারায় নিশা। ডিউটিরত একজন আর্মির কাছে তার ডিউটিই ফার্স্ট প্রায়োরিটি। তাইতো সাইফ আটচল্লিশ কেজির সেই নারী দেহটা তুলে নিয়ে অগ্রসর হলো অপেক্ষারত হেলিকপ্টারের দিকে। তার পিছু পিছু আরেকজন লেফটেন্যান্ট হাঁটতে হাঁটতে হাতের ওয়াকি টকি দ্বারা হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে দিলো ক্ষুদে বার্তা,

“ দ্যা মিশন ইজ একমপ্লিসড উইথ ওয়ান মার্টার। “

__________

কক্সবাজার সি বীচের কাছাকাছি এক রিসোর্টে এসে পৌঁছেছে দূর্জয়। বিশ্বস্ত সূত্রের মাধ্যমে তদন্ত করে সে জানতে পেরেছে রইস দিলদার নামক একজন ভারতীয় লোক এই রিসোর্টের দায়িত্বে রয়েছেন। সেই রইস দিলদারকে হাতেনাতে ধরতেই দূর্জয়ের কক্সবাজারে আগমন। পরিকল্পনা অনুযায়ী একজন ডাক্তারের পরিচয় দিয়ে হোটেলে চেক ইন করে সে। রিসিপশন কাউন্টার হতে সে এই তথ্যটুকুও সংগ্রহ করে নিয়েছে যে রইস দিলদার এই মুহুর্তে রিসোর্টে উপস্থিত আছে কিনা। কিন্তু দায়িত্বরত রিসিপশোনিস্ট তাকে জানায় যে রইস দিলদারকে আগামীকাল রিসোর্টে পাওয়া যাবে। দূর্জয় আর অতি আগ্রহ প্রকাশ করলো না তার সামনে। সে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রুমের চাবি নিয়ে নিজের জন্য নির্ধারিত রুমে পৌঁছে যায়।

রুমে পৌঁছেই সর্বপ্রথম সে জুলফিকারকে কল দেয়। কিছুক্ষণ ফোন বাজতেই অপরপাশ হতে কল রিসিভ হয়। দূর্জয় উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ স্যার? নিশা কেমন আছে এখন? “

জুলফিকার থমথমে গলায় উত্তর দেয়,

“ সার্জারি চলছে ওর। আশা করছি সুস্থ হয়ে যাবে। “

দূর্জয় এই অবস্থায় সামান্য নরম সুরে প্রশ্ন করে,

“ আন্টি কেমন আছে? “

জুলফিকার সামান্য হেসে বলে উঠে,

“ এইমাত্র আমাকে শাসিয়ে গেলো। দু’দিন পর নিশার বার্থডে। সেই উপলক্ষে অগ্রীম একটা চমৎকার সাইকেল অর্ডার করেছে ও। নিশা যদি সুস্থ পায়ে সেই সাইকেলে বসতে না পারে তাহলে আমার পা ভেঙে দিবে বলেছে। “

জুলফিকারের হেসে বলা কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা দীর্ঘশ্বাস টের পেয়ে দূর্জয় বলে উঠে,

“ এক মুহুর্তের জন্য নিজেদের মধ্যের ঝামেলাটা মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলুন। আপনাদের আরেকটাও পরিচয় আছে। আপনারা দুজনেই নিশার আব্বু আম্মু। এই মুহুর্তে আপনাদের দুজনেরই মেন্টাল সাপোর্ট প্রয়োজন। মনমালিন্য ভুলে কিছু সময়ের জন্য সেই মেন্টাল সাপোর্টটা একে অপরকে প্রোভাইড করুন। “

জুলফিকার থমথমে স্বরে জবাব দেয়,

“ একহাতে তালি বাজে না দূর্জয়। আর তাছাড়াও আমি নাঈমার সব শর্ত মেনে শুধুমাত্র এই কারণে নিশার কাস্টাডি ওকে দিয়েছিলা, কারণ আমি মনে করতাম নাঈমার থেকে ভালো করে কেউ আমার মেয়ের খেয়াল রাখতে পারবে না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি নিশার নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে ওর মায়ের সাথে। তাই আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে নিজের বাড়ি ফিরবে এবার। তার বাবার বাড়িতে। চব্বিশ ঘণ্টা সম্পূর্ণ নিরাপত্তার অধীনে থাকবে ও। “

দূর্জয় কিছু বলতে নিবে তার আগেই জুলফিকার বলে উঠে,

“ তোমার মাথায় অলরেডি অনেক চিন্তার পাহাড় জমে আছে দূর্জয়। এসব নিয়ে ভেবে শুধু শুধু সময় নষ্ট করো না। সব ধ্যান এবং জ্ঞান মিশনে দাও। সময় হলে হসপিটাল এসে নিশার সাথে দেখা করে যেও। ও তোমাকে দেখলে খুশি হবে খুব। “

“ রজার দ্যাট। “

ফোনটা রেখে দিয়েই দূর্জয় তার পরিধেয় শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলতে খুলতে ব্যালকনির দরজার দিকে এগিয়ে যায়। বারান্দা হতে রিসোর্টের সীমানার ভেতরে একটা বাচ্চা শিশুকে বাস্কেটবল হাতে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে দূর্জয় অনিমেষ সেই পানে তাকিয়ে রয়। চোখের সামনে ভেসে উঠে সোনালী অতীত।

__________

নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই স্কুলের স্পোর্টস ক্লাবের একজন সক্রিয় মেম্বার হয়ে উঠে দূর্জয়। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের দূরান্ততার প্রকাশ দেয় বাস্কেটবল কোর্টে। বছরের মাঝামাঝি সময় তখন। হাফ ইয়ারলি এক্সামের রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ার দু’দিন পরের ঘটনা। বিশাল আকাশ জুড়ে সেদিন সূর্যের দেখা মিলে নি। বাস্কেটবল কোর্টে নিজের দলের কয়েকজন ছেলের সাথে বাস্কেটবল খেলতে ব্যস্ত দূর্জয়। পড়নে তার হাতা কাটা এক স্পোর্টস টি শার্ট এবং থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। হাঁটু সমান মোজা দ্বারা তার শ্যাম পা জোড়া আবৃত।

খেলতে খেলতে হঠাৎ দূর্জয় বাস্কেটে বল ছুড়ে মারতেই ফিল্ডের একপাশ হতে ভেসে এলো একটা তীক্ষ্ণ শিস বাজানোর শব্দ। দূর্জয় সহ বাকি ছেলেরাও সেই শব্দ অনুসরণ করে পাশ ফিরে তাকাতে দেখে একটা কাঠের বেঞ্চির উপর পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে বাণী। তার পাশেই বেঞ্চির হ্যান্ডেলে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে আরমিন। দুজনের পড়নেই এখনো স্কুল ইউনিফর্ম। তার মানে ছুটি হওয়ার পর এরা বাসায় না গিয়ে এতক্ষণ ধরে এদিকেই ঘুরঘুর করছিলো।

দূর্জয়ের স্বাভাবিক মুখখানা এইবার শক্তরূপ ধারণ করলো। এই মেয়ের সমস্যা কোথায় তা সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। এসব অহেতুক কাজ করে সে দূর্জয়ের নজরে পড়তে চাইছে। দূর্জয় চরম রাগ এবং বিরক্তি নিয়ে বাণীর দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করলেই আরমিন ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে। সে মিনমিনে গলায় বলে উঠে,

“ বাণী? চল পালাই। যদি ক্লাস টিচারের কাছে কমপ্লেইন করে? “

বাণী সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে আত্মবিশ্বাসের সহিত বলে,

“ কিছু করবে না। “

বাণীর কথা শেষ হতে হতেই দূর্জয় তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্পষ্ট গলায় প্রশ্ন করে,

“ মতলব কি তোমার? “

বাণী হেসে বলে,

“ তোমাকে টেক্কা দেওয়া। হাফ ইয়ারলিতে ফোর্টিন্থ হয়েছি। ফাইনালে তোমার পিছনের সিট দখল করবো। “

দূর্জয় বাকা হেসে বলে,

“ তাহলে আর আমাকে টেক্কা কিভাবে দিবে? সেই ফার্স্ট পজিশন তো আমার আয়ত্তেই থাকবে। “

“ তোমার পজিশন দখল করা আমার ইনটেনশন নয়। তোমার পাশের পজিশনটা দখল করাই আমার আসল ইনটেনশন। সেই পজিশনে অন্য কেউ সুইটেবল না। হোক সেটা একাডেমিক্যাল লাইফে কিংবা পার্সোনাল লাইফে। “

কথাটুকু বলেই বাণী দাঁত বের করে হেসে চোখ টিপে দেয়। দূর্জয়ের মেজাজ গরম হয়ে যায় বাণীর কথা শুনে। এই মেয়ের রোগ কি সেই সম্পর্কে এবার সে ক্লিয়ার হলো। বয়সের আগে পেকে গিয়েছে এই মেয়ে। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের থেকে দূরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। দূর্জয়ও বুদ্ধিমানদের কাতারে নিজের নাম লেখাতে চায়। তাইতো সে বাণীর পাশে বেঞ্চির উপর রাখা নিজের ব্যাগটা এক কাধে ঝুলিয়ে একটা বোতল হতে পানি খেতে খেতে উল্টো ঘুরে হাঁটতে থাকে। আচমকা পিছন থেকে বাণী ফের ডাকে,

“ ইয়ো টপার? “

দূর্জয় হাঁটা থামায় না। কেবল ঘাড় সামান্য ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। বাণী সাথে সাথে নিজের বুকের বা পাশে হাত রেখে চোখ বুজে ফেলে। দূর্জয়ের দুর্বোধ্য মনের আঙিনায় প্রতিধ্বনিত হয় একটাই শব্দ,

“ ইঁচড়েপাকা। “

দূর্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই বাণী চোখ মেলে তাকায়। তার পাশে বেঞ্চির উপর রাখা কালো রঙের গিটারটা কোলে তুলে নিয়ে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠে,

“ দিল কি খাতা ভি হে কেয়া
মুঝকো গিলা ভি হে কেয়া
ইস দিল লাগি কে সিভা
দিল নে কিয়া ভি হে কেয়া?
আশিক হে ইয়ে চোর নেহি হে
মে কেয়া কারু?
দিল পে মেরা জোর নেহি হে
মে কেয়া কারু? “

অতীতের পাতা উল্টে বর্তমানে ফিরে আসতেই এতো বছরে প্রথম বারের মতো বাণী নামক মেয়েটার কথা ভাবতে বসে দূর্জয়ের অবচেতন মন। সদা প্রফুল্ল হাস্যজ্বল মেয়েটা তার বর্তমান ব্যক্তিগত জীবনে কেমন আছে? ভালো আছে তো? ছোট প্রশ্নটা মন গহীনে উঁকি দিতেই দূর্জয় নিজের প্রতি বিরক্তবোধ করে। এই অযাচিত আগ্রহের মানে কি? বাণী কেমন আছে তা ভাবা নিশ্চয়ই দূর্জয়ের কাজ নয়? মাথা থেকে বাণী নামক ভাবনাকে ঝেড়ে ফেলে রুমে ফিরে আসে দূর্জয়। আজ রাতের অপেক্ষা রইলো কেবল। কালকে রইস দিলদারকে একবার হাতেনাতে ধরতে পারলেই কেবল অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।

__________

রাত তখন হয়তো সোয়া আটটা বাজে। বাড়িতে প্রবেশ করতেই হিরণের সামনে পড়লো এক চক্ষু শীতল দৃশ্য। সম্পূর্ণ লিভিং এরিয়া জুড়ে ছোট ছোট পা ফেলে বহ্নি দৌড়ে যাচ্ছে। তার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে বাণী। দুই মা মেয়ের মুখেই একই ধরনের হাসি। দাঁতের পাটিতে থাকা গেজ দাঁত যেনো সেই হাসির সৌন্দর্য্য আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আচমকা দৌড়াতে গিয়ে কার্পেটের সাথে পা লেগে বহ্নি পারে যেতে নিলেই হিরণ বড় বড় দুটি কদম ফেলে এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে বুকে তুলে নিলো। হিরণকে দেখতেই বাণীর পা জোড়া থমকে গেলো। মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো মুহুর্তেই। সেই দৃশ্যটুকু হিরণের চক্ষুগোচর হয়নি। সে খুব সূক্ষ্মভাবে সেই দৃশ্যটাকে এড়িয়ে গিয়ে মেয়েকে বলে,

“ ঠিক আছো মা? “

বহ্নি পাপার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

“ পাপা! সেভ মি! মাম্মা আমাকে হান্ট করছিলো। “

হিরণ চোখ সরু করে বলে,

“ পাপা এসে পড়েছি না? এখন আর পারবে না। পাপা মাম্মার থেকেও ফাস্ট দৌড়াতে পারি। “

বহ্নি হেসে বাণীর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ মাম্মা, এখন আমাকে আর পাপাকে ক্যাচ করে দেখাও। “

বাণী শুষ্ক মুখে অনাগ্রহ নিয়ে ধীর গলায় শুধায়,

“ মাম্মা টায়ার্ড এখন মা। “

বাণীর অনাগ্রহের কারণ কি তা বুঝতে অসুবিধা হয় না হিরণের। সে তাই আর বাণীকে বিরক্ত না করে মেয়েকে কোলে নিয়ে এগিয়ে যেতে নিলেই বাসার বাহির হতে ভেসে আসে গাড়ির হর্ণের শব্দ। মুহুর্তেই হিরণ সতর্ক দৃষ্টি মেলে দরজার দিকে তাকায়। এই মুহুর্তে তো কারো আসার কথা নয়। তাহলে এই অসময়ে কে তার বাড়িতে আসলো? হিরণের ভাবনার মাঝেই তার সবথেকে কাছের এবং বিশ্বস্ত লোক ইবাত ব্যস্ত পায়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। হিরণকে দেখতে পেয়েই সে আর বিলম্ব না করে বলে উঠে,

“ স্যার! শমসের স্যার এসেছে। এক্ষুণি প্রবেশ করবে। “

হিরণের চেহারা মুহুর্তেই বদলে যায়। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে মেয়েকে বাণীর কোলে দিয়ে বলে,

“ উপরে যাও রাইট নাও। রুম ভেতর থেকে লক করে দাও। আমি ছাড়া অন্য কারো কথায় দরজা খুলবে না। “

বাণী টু শব্দ কিংবা পাল্টা প্রশ্ন করে না। তার শান্ত মন জানে এতো বছর ধরে এই অতিথিহীন ঘরে হুট করে শমসের নামক সেই লোকের আগমন কোনো ভালো লক্ষণ নয়। নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কোনো ব্যাপার। সে আর অপেক্ষা না করে একপ্রকার ছুটে মেয়েকে নিয়ে উপরে চলে যায়। হিরণ শান্ত ভঙ্গিতে দরজা মুখো হয়ে দাঁড়ায়। তার পাশেই তীরের মতো দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইবাত।

শমসের মজুমদার বেশ সংখ্যক লোক নিয়ে মুখ্য দ্বার দিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে হেসে বলে উঠে,

“ হিরণ! মাই সান। তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চলে এলাম। “

হিরণের মুখভঙ্গি বেশ শান্ত ও দৃঢ়। সে গম্ভীর গলায় শুধায়,

“ এখানে আসার কারণ কি? আমি নিজেই একটু পর আপনার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হতাম মিটিংয়ের জন্য। “

শমসের মজুমদার কোনো ভনিতা ছাড়া একটা সোফায় গিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে হেসে বলে,

“ তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি আমি। যেই মিটিং আমার বাসায় হওয়ার কথা ছিলো তা এখন এখানে হবে। আর তাছাড়া আমি এখানে আরেকটা উদ্দেশ্যেও এসেছি। আমার বৌমা আর নাতনিকে দেখছি না। তারা কোথায়? “

হিরণ রুক্ষ দৃষ্টি মেলে একবার শমসের মজুমদারের পিছনে উপস্থিত বাকিদের দেখে নেয়। রইস দিলদার সহ আরো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এখানে উপস্থিত রয়েছে। হিরণের দৃষ্টি গিয়ে স্থির হয় রইস দিলদারের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা এক রাশভারী মুখশ্রীর যুবকের দিকে। আব্রাহাম! ইদানীং শমসের মজুমদারের সাথে প্রায় সর্বত্র এই যুবকের দেখা মিলে।

হিরণ আব্রাহামের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শমসেরের দিকে তাকায়। শমসেরের ঠোঁটের কোণে বাকা হাসি। সেই হাসির রহস্য হিরণ জানে। যেই সত্য এখন সূর্যের আলোর মতো স্পষ্ট তা আর লুকানোর মানে হয়না। সে নীরবে ফোন বের করে ডায়াল করে ব্যক্তিগত একটা নাম্বার। কলটা রিসিভ হতেই হিরণ শীতল গলায় শুধায়,

“ বহ্নিকে নিয়ে নিচে এসো। “

ব্যস! ছোট্ট বাক্যের আদেশ বর্তানো শেষ করেই হিরণ ফোনটা ফের প্যান্টের পকেটে চালান করে দেয়। কিঞ্চিৎকাল সময় পেরোতেই সিঁড়ি বেয়ে ধীর পায়ে নেমে আসে এক পরিপূর্ণ নারী। তার কোলে গলা জড়িয়ে কাধে মুখ লুকিয়ে রেখেছে এক ছোট্ট শিশু। বাণী নিচে নেমে হিরণের পিছু এসে থামে। এর সামনে আর পা বাড়ানোর সাহস নেই তার। শমসের হেসে বলে উঠে,

“ আরে! ছেলের আকাশে দেখি একটা না দুটো চাঁদ। “

হিরণ কোনো প্রতুত্তর করে না। সে নীরবে দাঁড়িয়ে রয়। শমসের নিজেই ফের বলে উঠে,

“ কই আমার দাদুভাইয়ের মুখটা দেখি? “

বাণী প্রশ্নবোধক দৃষ্টি মেলে হিরণের পানে তাকায়। হিরণ চোখের ইশারায় বলে মেয়েকে কোল থেকে নামাতে। বাণী তাই করে। বহ্নি ঘুরে শমসের মজুমদারের মুখোমুখি তাকাতেই শমসের মজুমদার দেখে হালকা গোলাপি রঙের একটা ফুটফুটে পুতুল যেনো দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের রঙটা বাপ মা মিলিয়ে উজ্জ্বল ফর্সা বর্ণের। মাথায় ঘাড় সমান পাতলা চুল। চোখের পাপড়ি গুলো বেশ ঘন। শমসের একপলক বহ্নিকে আগাগোড়া পরখ করে নিয়ে হাস্যজ্বল গলায় বলে উঠে,

“ দাদুভাই দূরে কেনো দাঁড়িয়ে? কাছে আসো। আমাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি তোমার দাদু হই। “

শমসেরের এই অহেতুক আদিখ্যেতা হিরণের ঠিক সহ্য হচ্ছে না। তবুও ঝামেলা এড়ানোর জন্য সে মেয়ের পানে তাকিয়ে নরম সুরে বলে,

“ যাও মা। “

বহ্নি বাধ্য মেয়ের মতো ছোট ছোট কদম ফেলে শমসের মজুমদারের দিকে এগিয়ে যায়। শমসের মজুমদার বহ্নিকে কোলে বসিয়েই তার সাথে আসা একজনকে চোখের ইশারায় কিছু একটা বলে। সাথে সাথে সেই যুবক নিজের হাতে থাকা র‍্যাপিং পেপারে মোড়ানো বেশ কিছু চকলেট বক্স বর্গাকৃতির টি টেবিলের উপর রাখে। অত:পর হেসে বলে,

“ এই সব গিফট আমার দাদুভাইয়ের জন্য। তোমার চকলেট পছন্দ তো? “

বহ্নি দাঁত বের করে হেসে মাথা নাড়ায়। শমসের ফের প্রশ্ন করে,

“ তোমার আর কি কি পছন্দ? “

বহ্নি সাথে সাথে প্রফুল্ল গলায় জবাব দেয়,

“ মার্ভেল মুভিস, সুপারহিরোস আর পাপার ব্ল্যাক শুটার। “

শমসের মজুমদার শব্দ করে হেসে উঠে শুধায়,

“ তাই নাকি? তুমি শুটার নিয়ে খেলতে পছন্দ করো? “

বহ্নি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। শমসের মজুমদার চোখের পলকেই নিজের পকেট হতে একটা পিস্তল বের করে তা বহ্নির হাতে ধরিয়ে হিরণের দিকে তাক করে। এই ঘটনাটা যতটা না দ্রুত ঘটলো তার থেকেও দ্রুত হিরণ নিজের ব্লেজারের ভিতর পিছনের দিকে প্যান্টে গুজে রাখা পিস্তলটা বের করে শমসের মজুমদারের দিকে তাক করে ধরে। মুহুর্তেই পরিস্থিতি বদলে যায়। হিরণের লোকেরা এবং শমসের মজুমদারের লোকেরাও নিজেদের পিস্তল বের করে একে অপরের দিকে তাক করে।

শমসের মজুমদারের ধূর্ত কর্মকান্ড এবং হিরণের পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখে বাণী পাথর বনে যায়। গোল গোল চাহনিতে বরফের ন্যায় জমে যায় সে। বহু কষ্টে তার গলা চিড়ে বেরিয়ে আসে দুটি শব্দ,

“ আমার মেয়ে! “

হিরণের কর্ণগোচর হয় না সেই ছোট্ট দুটি শব্দ। তার মেয়ের মুখের পানে তাকিয়ে তারও বুক মুচড়ে উঠছে। কিন্তু সেই দূর্বলতাটুকু প্রকাশের অবকাশ নেই তার। একটা প্রবাদ বাক্য অনুযায়ী বলা হয়ে থাকে একই বনে কখনো দুটি সিংহ রাজা হতে পারে না। তেমনই পাপের সাম্রাজ্যেও একসাথে দুজন বাপ কখনো থাকতে পারে না।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]