এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-১১+১২

0
189

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১১.

বাণীর অবিরত হৃদয় কাঁপছে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো তার। কি করতে চাইছে শমসের? মেয়ের হাতে তার বাবাকে খুন করবে? নিজেদের মতো বহ্নির হাতও রক্ত মেখে নোংরা করতে চাইছে? দুর্দম্য দুঃশ্চিন্তা ও ব্যাকুলতায় ছটফট করছে বাণী। তীব্র অস্থিরতায় তার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা এলোমেলো হয়ে পড়ে। নিজের অজান্তেই সে একহাতে হিরণের ব্লেজারের কনুইয়ের দিকটা চেপে ধরে।

হিরণ অনুভব করলো বাণীর অস্থিরতা। তবুও সে নিজেকে শান্ত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করলো। অন্যমনস্ক হলে চলবে না তার। হিরণ আরেকটু শক্ত করে পিস্তলটা আঁকড়ে ধরতেই আচমকা শমসের মজুমদার শব্দ করে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে তিনি বহ্নির হাতে চেপে ধরা পিস্তলটা নামিয়ে নিলেন। অত:পর মশকরার সুরে বললেন,

“ হিরণ? ভয় পেয়ে গিয়েছিলে নাকি? মেয়েকে খুব ভালোবাসো বুঝি? মেয়ের জন্য বাপ সমতূল্য পালকের দিকে পিস্তল তাক করতেও দ্বিধা করলে না। “

হিরণ অতি সন্তর্পণে নিজের রাগটুকু গিলে তাক করা পিস্তলটা নামিয়ে নেয়। মুহুর্তেই বাকি সকলের পিস্তলও নেমে যায়। বাণী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। বহ্নি বোকার ন্যায় সবার দিকে তাকিয়ে আছে। এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনার আগাগোড়া কিছুই তার ছোট্ট মস্তিষ্ক বুঝে উঠতে পারে নি। হিরণ নরম স্বরে মেয়েকে কাছে ডাকতেই বহ্নি একলাফে শমসের মজুমদারের কোল হতে নেমে তার দিকে দৌড়ে চলে যায়। হিরণ চোখের ইশারায় বাণীকে বলে মেয়েকে নিয়ে উপরে চলে যেতে। বাণী আর অপেক্ষা করে না। সে নিজের প্রাণভোমরাকে বুকে আগলে নিয়ে দ্রুত পায়ে উপরে চলে যায়।

হিরণ এবার ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠে,

“ বহ্নি কিংবা বাণী আমার এই জগতের অংশ নয়। ওদেরকে কেউ এই জগতের অংশ করুক তা-ও আমি চাই না। কেউ সেই দুঃসাহস দেখালে আমি তাকে ছেড়ে দিবো না। “

হিরণের বলা কথাটায় যেন খুব মজা পেলো শমসের। সে কৌতুক করে বললো,

“ আরে! আমি তো মজা করছিলাম কেবল। আর মজা নয়। এবার কাজের কথায় আসা যাক। “

কাজের কথা শুনতেই হিরণ শান্ত হয়ে শমসেরের মুখোমুখি এক সোফায় বসে পড়লো। সচল মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ ধ্যানটুকু নিবেশ করলো নিজেদের পরবর্তী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আলোচনার প্রতি। শমসের ঠোঁটের কোণে জয়ের হাসি ফুটিয়ে বলে,

“ লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা হাত ধুয়ে নেমেছে আমাদের সন্ধানে। যদিও উনার মেয়ের মাধ্যমে উনাকে সতর্ক করা হয়েছে ইতিমধ্যে। কিন্তু জুলফিকার যে সেই সতর্ক বার্তাকে তেমন একটা তোয়াক্কা করবে না তা আমি ভালো করেই জানি। হাজার হোক স্বাধীন রাষ্ট্রের সৈন্য বলে কথা। এদের রক্ত ফুটন্ত পানির ন্যায় টগবগে। সেই টগবগে রক্ত ঝরানোরও আলাদা মজা আছে। “

হিরণ পাষণ্ড মুখে বললো,

“ ভুল করেছেন। জুলফিকার মুজতবার মেয়েকে নিয়ে সাজানো খেলায় একজন সৈন্য মারা গিয়েছে। জুলফিকার মুজতবা ও তার স্পেশাল ফোর্স এই বিষয় ভুলে যাবে ভাবছেন? উহু। কখনোই না। তারা এখন আরো সক্রিয় হয়ে আমাদের পিছনে পড়বে। একজন সাধারণ নাগরিকের তুলনায় একজন শহীদ সৈন্যের রক্তের দাম ঢের বেশি। সামির নামক ওই সৈন্যের মৃত্যুতে জুলফিকার মুজতবা এবং তার স্পেশাল ফোর্স আঘাত পেয়েছে। আর আপনি জানেনই তো, জঙ্গলে অক্ষুণ্ণ বাঘের তুলনায় আহত বাঘ বেশি হিংস্র হয়। “

শমসের মজুমদার ক্রুর হেসে বলেন,

“ হিংস্র বাঘকে পোষ মানাতে আমি জানি। তাইতো পরবর্তী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আর দেরি করবো না। সময় এসেছে। শীঘ্রই আরেকটা বাজিমাত করবো। “

এই পর্যায়ে হিরণের ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠে। সে প্রশ্ন করে,

“ এই মহান পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব তবে কে পাবে? “

শমসের মজুমদার বুক ফুলিয়ে উচ্চারণ করে একটি নাম,

“ আব্রাহাম। “

হিরণের দৃষ্টি সাথে সাথে গিয়ে স্থির হয় শমসেরের পিছনে রইস দিলদারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের দিক। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পন্ন যুবকের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। সে স্থির চিত্তে রোবটের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। এই যুবক এতো বড় দায়িত্বের ভার বহন করবে? হিরণের চোখে মুখে অসন্তুষ্টি ফুটে উঠে। এতো অভিজ্ঞ লোক থাকতে দুই দিনের এই ছেলেকে এতটা ভরসা কেন করছে শমসের মজুমদার? নিশ্চয়ই তার পিছনে বড় কোনো কারণ আছে?

হিরণের অসন্তোষ মুখভঙ্গি দেখে শমসের শুধায়,

“ ও নিজের কাজে কতটা পারদর্শী সেই প্রমাণ ইতিমধ্যে আজ জুলফিকার মুজতবাকে শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে দিয়ে ফেলেছে ও। ওকে কেউ অবিশ্বাস করুক তা আমি চাই না। “

হিরণ নিজের অসন্তুষ্টি আর প্রকাশ করলো না। তবে তা সম্পূর্ণ আড়ালও করলো না। সে গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করে,

“ প্ল্যান ম্যাপ রেডি? “

আব্রাহাম নামক সেই রাশভারী যুবক এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে এগিয়ে এসে টি টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। নিজের হাতের রোল করা বিশাল কাগজটা টি টেবিলের উপর মেলে দিতেই সাদা কাগজের উপর দেখা যায় এক অদ্ভুত নকশা। এই নকশা বড় ভয়ংকর! এই নকশা বড় বিধ্বংসী! বিধ্বংসী সেই নকশার পানে চেয়ে একঝাঁক চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। ফুটে উঠে তাদের ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি। দেশবাসী যেই রক্তের খেলার ইতি ঘটেছিলো ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে সেই রক্তের খেলা তো কেবল শুরু!

__________

বারান্দায় থাকা আরামকেদারায় আয়েশী ভঙ্গিতে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বুজে রেখেছে এক পুরুষ। দখিনা বাতাস চিত্ত শীতল করে দিতেই ক্ষনিকের প্রশান্তিতে সে তন্দ্রাঘোরে মতে। তার সেই তন্দ্রাভাব কাটে তীক্ষ্ণ ফোনের রিংটোনের শব্দে। চোখ মেলে ফোনটা হাতে নিতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠে ইংরেজিতে পাঁচ শব্দের একটা নাম। বুকে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাসকে হাওয়ায় মিলিয়ে দিয়ে সে ফোনটা রিসিভ করে কানে দিতেই অপর প্রান্ত হতে এক নারী কণ্ঠ বলে উঠে,

“ ভুলে গিয়েছো আমাকে? “

“ এই প্রশ্নটা করতে কল দিয়েছো তুমি? “

“ তুমি কি আমার কল পেয়ে বিরক্ত হও দূর্জয়? “

দূর্জয় নিষ্প্রভ দৃষ্টি মেলে রাতের আকাশের দিকে তাকায়। সে কিভাবে বোঝাবে যে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে? ওই বাড়ি থেকে, এই নারী থেকে সে খুব ব্যস্ত হয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চাইছে। দূর্জয় মলিন গলায় শুধায়,

“ আমি তোমার প্রতি কখনো বিরক্তি প্রকাশ করেছি? “

ফোনের অপর পাশের নারীর গলা এবার খানিকটা নরম হয়ে এলো। উদাস স্বরে প্রশ্ন করে,

“ আজকের তারিখটা মনে আছে তোমার? “

দূর্জয় নীরব রয়। এখন হয়তো রাত বারোটার উপর বাজে। বছর ঘুরে সেই দূর্বিষহ তারিখটা তবে এসেই পড়লো! সত্য হতে অজান্তা নারী নিশ্চয়ই খুব আয়োজন করে আজকের দিনটায় দুঃখ বিলাস করবে? ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে দূর্জয় বলে,

“ ভুলি নি। “

দূর্জয়ের ছোট্ট দুই শব্দের জবাবের পিঠে সেই নারী বলে উঠলো,

“ আর বিরক্ত না করি তোমায়। “

দূর্জয় এবার নরম কণ্ঠে প্রশ্ন করে,

“ তুমি ভালো আছো মামণি? “

ফোনের অপর পাশ হতে এবার ক্ষানিকটা নাক টানার শব্দ এবং তার সাথে ব্যস্ত গলায় বলা কিছু শব্দ ভেসে এলো,

“ আমি ভালো নেই দূর্জয়। ছয়টা মাস ধরে তুমি বাড়ি ফিরছো না। তোমার কি মনে হয় আমি বুঝি না যে তুমি কেন বাড়িতে আসো না? ওর স্মৃতি থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করছো তাই না? কিন্তু যে অস্তিত্বে মিশে আছে তার স্মৃতি কিভাবে উপেক্ষা করবে তুমি? “

“ তুমি এতটা দূর্বল হয়ে পড়লে কবে? তুমি তো এতটা দূর্বল কখনো ছিলে না। বাবা তোমার এই রূপ দেখলে চমকে যেতো। কখনোই চিনতে পারতো না। “

“ তুমি যেই কঠিন ও দৃঢ় নারীর কথা বলছো সে মেজর শাহরিয়ার রিফাতির স্ত্রী ছিলো। শাহরিয়ার রিফাতির মৃত্যুর সাথে আমার সেই সত্তার মৃত্যুও ঘটেছে। এখন আমি শুধুমাত্র একজন মা। যার সবথেকে বড় দূর্বলতা তার সন্তান। “

“ তোমার ছেলেও কিন্তু তোমার স্বামীর পথেই হাঁটছে মামণি। আমাদের পেশা ভিন্ন নয়। একজন মেজরের স্ত্রী হয়ে সবসময় যেভাবে বিচক্ষণ মস্তিষ্ক ও শক্ত হাতে সব সামলেছো সেই একইভাবে এখন একজন মেজরের মা হয়ে সেম কাজটা করো। “

দূর্জয় যতটা সহজে এই কথাগুলো বললো ফোনের অপর পাশের নারীর ভয় ততটাই বেড়ে গেলো। এই একটাই তো তার ভয়। যেই পেশাকে এককালে মনের গহীন থেকে শ্রদ্ধা করতো তিনি আজকাল সেই পেশাই তার ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপন বলতে তো এখন শুধুমাত্র এই ছেলেটাই আছে তার কাছে। কোনো মূল্যেই এই ছেলেকে হারাতে পারবেন না তিনি।

__________

বজ্রপাতের ধ্বনিতে কেপে উঠছে নীরব রাত। একের পর এক বজ্রধ্বনি পরিবেশটাকে ভয়ংকর করে তুলছে। অস্ত্রধারী লোকদের সমাগম বিলীন হয়ে ঘরটা নিস্তব্ধ হয়েছে ঘন্টা খানেক আগে। নিজের রুমের পরিচিত সোফাটায় মূর্তির ন্যায় বসে আছে হিরণ। কাচের বিশাল জানালা দিয়ে দেখছে অন্ধকার রাতে মেঘের তান্ডবলীলা।

ঘড়িতে তখন রাত একটা বাজে। বহ্নিকে ঘুম পাড়িয়ে নীরবে রুম থেকে বেরিয়ে আসে বাণী। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রবেশ করে বহ্নির রুম বরাবর অপরপাশের বেডরুমে। রুমে প্রবেশ করতেই সে দেখতে পায় সম্পূর্ণ রুম অন্ধকারে ছেয়ে আছে। ১৬ ডিগ্রীতে সেট করা এসি হতে বেরিয়ে আসা বাতাস রুমের ভেতরকার পরিবেশকে হীম শীতল করে তুলেছে।

বাণী একবার সম্পূর্ণ পরিবেশ পরখ করে। অত:পর থমথমে গলায় বলে উঠে,

“ আমার মেয়ের সবথেকে বড় দূর্ভাগ্য হলো যে আপনার মতো নরপশু তার পাপা। “

বাণীর বলা কথাটা হিরণের কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই সে রাগে লাল হয়ে থাকা চোখ জোড়া মেলে পিছনে তাকায়। অন্ধকার রুমে বাণী হিরণের সেই দৃষ্টি স্পষ্ট দেখতে পেলো না। দেখলে হয়তো নিশ্চয়ই সে দমে যেতো। বাণী অটল গলায় ফের বলে উঠে,

“ আমি সবসময় ভাবতাম আল্লাহ আপনাকে কন্যা সন্তানের পিতাই কেন বানালো? মেয়ে সন্তান তো আল্লাহর রহমত হয়। আপনি তো জীবনে এমন কিছু করেন নি যে আপনি এই রহমত হাসিল করতে পারবেন। কিন্তু পরে আমি বুঝতে পারলাম আমার মেয়ে আপনার জন্য রহমত নয় বরং আপনার সবথেকে বড় শাস্তি। আপনার কি কখনো ভয় হয় না? যেই ভালোবাসার দাবি আপনি আমার কাছে করে বেড়ান, ধরুন সেই একই ধরনের ভালোবাসা কখনো বহ্নির জীবনে আসলো। কেমন অনুভব করবেন আপনি? “

হিরণ হিসহিসিয়ে বলে উঠে,

“ আর একটাও কথা বলবে না বাণী। “

হিরণের শান্ত গলার সতর্ক বার্তা বাণী কানে তুলে না। তার সহ্যেরও একটা সীমা রয়েছে। আজকে নিচে ঘটে যাওয়া ঘটনা সে মোটেও মেনে নিতে পারছে না। সেই শমসের মজুমদার যখন তার মেয়ের হাতে পিস্তল চেপে ধরেছিলো তখন বাণীর মনের অবস্থা কি রকম ছিলো তার একমাত্র সাক্ষী উপরওয়ালা। বাণী হিরণকে তোয়াক্কা না করে বলে,

“ ভয় পাচ্ছেন? বহ্নির ভাগ্যও আমার মতো হয়ে যায় কিনা সেই ভয় পাচ্ছেন? মেয়ের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখার ক্ষীণ সম্ভাবনাও আপনাকে ভীত করে তুলছে। “

হিরণের ধৈর্য্য শক্তি হারায়। সে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে গিয়ে বাণীর গলা চেপে ধরে। হিরণ সন্নিকটে আসার সাথে সাথেই বাণী নাকে একটা উটকো গন্ধের ঘ্রাণ টের পায়। এই ঘ্রাণ কিসের তা বুঝতে একটুও সময় ব্যয় করতে হয় না তার। শয়তানদের মজলিসে কোন পানীয় বেশি প্রাধান্য পায় তা বাণী ভালো করেই জানে। কিন্তু এই ব্যাপারে আর কোনো কথা বলার সুযোগ পায় না সে। হিরণ তার আগেই ক্ষোভ মিশ্রিত স্বরে বলে উঠে ,

“ আজকে নিচে যেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার সম্পূর্ণ দায়ভার তোমার। তোমার খাঁচা ছেড়ে পালানোর ফলেই শমসের মজুমদার তোমাদের পরিচয় জানতে পেরেছে এবং আমার বাড়িতে এসে আমার সামনেই এমন দুঃসাহস দেখানোর সুযোগ পেয়েছে। বাহিরের বাতাস গায়ে লাগতেই উড়ার জন্য খুব কিচিরমিচির শুরু করে দিয়েছো। তাই-না? কিন্তু আমিও খুব ভালো করে জানি কিভাবে ডানা কাটতে হয়। আমি যত নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করি, তুমি ততই আরো টেনে হিচড়ে আমার ভয়ংকর রূপ বের করে আনো। “

বাণীর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হতেই সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু হিরণের দানবীয় হাতের থাবা হতে মুক্তি পাওয়া মুশকিল। বাণী আর কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে আচমকা মুখ ভর্তি থুথু ছুড়ে মারে হিরণের দিকে। হিরণ সাথে সাথে হাতের বাধন আলগা করে ফেলে। দমবন্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতেই বাণী দু হাতে নিজের গলা ধরে কাশতে শুরু করে। ক্ষানিকটা প্রশান্তির আশায় সে চোখ বুজে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে।

কিন্তু আচমকা চুলের মুঠিতে টান খেতেই বাণী চোখ মেলে তাকায়। সাথে সাথে সে দেখতে পায় হিরণের ভয়ংকর রূপ। যেই রূপকে বাণী জমের মতো ভয় পায়। চুলের মুঠি আরেকটু শক্ত করে ধরতেই বাণী চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলে। হিরণের চোখ ঠিকড়ে যেনো আগুন বের হচ্ছে। সেই আগুন দৃষ্টি মেলে সে বলে,

“ আমাকে রাগিয়ে ভালো করো নি বাণী। “

বাণী আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না। তার পূর্বেই হিরণ নিজের হিংস্রতার পরিচয় দেওয়া শুরু করে। বাণী কেবল অনুভব করলো তার চারপাশটা বিকট শব্দ তুলে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে ছয় বছর পূর্বের এরকমই এক রাতের দৃশ্য। যেই রাতের প্রহর শুরু হয়েছিলো খুন, লাশ এবং রক্ত দিয়ে আর শেষ হয়েছিলো বাণীর হৃদয় ও দেহ কুলষিত হওয়ার মাধ্যমে। আজও সেই একই রাতের পুনরাবৃত্তি ঘটে।

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১২.

ভোর সকাল তখন। সারারাতের তান্ডবলীলা শেষে প্রকৃতি শান্ত হয়েছে কেবল। ব্যথার তীব্রতায় গায়ে অসহন জ্বর নিয়ে চোখ মেলে তাকায় নিশা। নিস্তব্ধ কেবিনটায় একবার চোখ বুলিয়ে ফের চোখ বুজে নেয় সে। চেতনানাশক ওষুধের রেশ কাটার ফলেই বোধহয় পায়ের কাঁচা সেলাইয়ের জায়গার যন্ত্রণাটা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে সে। তবুও এ ভেবে স্বস্তি পায় যে পা’টা অন্তত অক্ষত আছে। শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় ফাঁক করে থেমে থেমে দম নিতে থাকে সে। তখনই মৃদু শব্দে কেবিনের দরজাটা খুলে যায়।

নিশা চোখ মেলে দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় অপ্রত্যাশিত একজন মানুষকে। নিস্তব্ধ ভোর বেলায় নিশার কেবিনে তামজিদ সাইফ নামক এই পুরুষের আগমন অপ্রত্যাশিতই বটে। ইউনিফর্ম বদলে ফর্মাল গেটাপে থাকা এই পুরুষের মুখভাব স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থমথমে। নিশার সজাগ মস্তিষ্ক মুহুর্তেই মনে করে গত কালকের ঘটে যাওয়া ঘটনাটা।

বিকট এক দানবীয় শক্তির প্রলয়ে আচমকা যখন সবাই ছিটকে একেক জায়গায় পড়ে তখন পায়ে আরো গভীর আঘাত পায় নিশা। গুলিবিদ্ধ জায়গা হতে মুহুর্তেই গলগল করে রক্ত বেরোতে থাকে। ধোঁয়ার চাদরে ঢাকা চারিদিকটা তীব্র ব্যথার তাড়নায় আর দেখার আর সুযোগ হয় নি তার। তবে সে স্পষ্ট কানে শুনতে পাচ্ছিলো কিছু যুবকের আর্তনাদ ও হাহাকার মিশ্রিত ডাক। সামির। এই নামটা ধরেই সকলে ডাকছিলো। এরপর আর কিছু মনে করতে পারছে না সে। সব যেনো ব্ল্যাক আউট হয়ে গিয়েছে।

নিশা শুষ্ক গলায় প্রশ্ন করে,

“ সবাই ঠিক আছে? “

থমথমে মুখটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে সাইফ উত্তর দেয়,

“ জ্বি। আপনি এখন কেমন অনুভব করছেন ম্যাডাম? “

সাইফের উত্তরটা এবং সেই সাথে জুড়ে দেওয়া প্রশ্নটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নিশা ফের প্রশ্ন করে,

“ সামির? আমার মনে আছে আপনারা উনার নাম ধরে চিৎকার করছিলেন। উনি ঠিক আছে ভাইয়া? “

সামিরের নামটা শুনতেই সাইফের শক্ত খোলসের ভিতর একটা বিষাদের ঢেউ খেলে গেলো। চোখের সামনে ভেসে উঠে ছেলেটার চেহারা। আজ ছেলেটার জানাজা পড়ানো হবে। হাসপাতাল হতে সেই ক্ষত বিক্ষত লাশ সংগ্রহের দায়িত্ব আপাতত সাইফের উপরই পড়েছে। সেইজন্যই সে এই মুহুর্তে হাসপাতালে এসেছিলো। কিন্তু এখানে আসার পর অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির ফলে তার কাধে অর্পিত হয় সাময়িক এক নতুন দায়িত্ব। সেসব ভাবতে ভাবতেই কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে সাইফ জবাব দেয়,

“ সামির শহীদের খাতায় নাম লিখিয়েছে। “

নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে সম্পূর্ণ কেবিন জুড়ে। নিশার মন ভারী খারাপ হয়। মুহুর্তেই নিজের পায়ের কাঁচা সেলাইয়ের যন্ত্রণাটুকু ভুলে সেই শহীদ সৈন্যের পরিবারের দুঃখ উপলব্ধি করার চেষ্টা করে। কিন্তু না। সে ব্যর্থ হয়। যে হারায় সে ছাড়া কেউই কখনো হারানোর বেদনা অনুভব করতে পারবে না। এ অসম্ভব বিষয়। তীব্র মন খারাপ নিয়েই নিশা উচ্চারণ করে,

“ আল্লাহ উনাকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম নসিব করুক। “

“ আমিন। “

সাইফ বিষণ্ণতাকে একপাশে ঠেলে শুধায়,

“ আমি কেবিনের দরজার বাহিরেই আছি। প্রয়োজন হলে ডেকে নিবেন। “

কথাটুকু শেষ করেই সাইফ বেরিয়ে যেতে নিলে নিশা ধীর গলায় প্রশ্ন করে,

“ আম্মু – আব্বু কোথায়? “

প্রশ্নটুকু কানে পৌঁছাতেই সাইফ পিছু ফিরে তাকায় তবে প্রশ্নের জবাব দেয় না। নীরব রয়। নীরব সাইফের মুখপানে চেয়ে জবাব পেয়ে যায় নিশা। জ্বরের ঘোরে তার দু চোখ জ্বলছে। চক্ষুকোলের শেষ প্রান্ত বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দু ফোটা তপ্ত জল। দৃশ্যটুকু দেখে সাইফের সামান্য মায়া হয় বটে। মেয়েটা নিশ্চয়ই জ্ঞান ফেরার পর সর্বপ্রথম নিজের মা বাবাকে এখানে এক্সপেক্ট করছিলো? কিন্তু বেচারির জ্ঞান ফেরার কিছু সময় পূর্বেই তার মা বাবা ঝগড়া করে দুজন দু’দিকে চলে গিয়েছে নিজেদের শান্ত করতে। তাদের ঝগড়ার মূল বিষয়বস্তু ছিলো “ ইয়াসমিন মুজতবা নিশা হসপিটাল থেকে ফিরে কার সাথে থাকবে? “

জুলফিকার অবশ্য যাওয়ার আগে সাইফকে কিছুক্ষণের জন্য নিরাপত্তার দায়িত্বে রেখে গিয়েছে। সাইফ দায়িত্ব পালনে কখনো অপারগতার প্রমাণ দেয় না। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু তার দায়িত্ব কেবল নিরাপত্তা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। সেজন্যই সাইফ যেচে আর মন খারাপের অথৈ সমুদ্রে ডুবে থাকা মেয়েটাকে টেনে তোলার চেষ্টা করে না। থাকুক না দু একটা মন খারাপের গল্প। কালি শেষ হলেই তো সেই গল্প থেমে যাবে। ক্ষতি কি?

__________

একদল কাকের কুৎসিত স্বরে ডাকা কা কা শব্দ ভেসে আসছে দূর হতে। সেই বিদঘুটে ডাকের শব্দে হিরণের গভীর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। সে কপাল কুচকে চোখ মেলে তাকায়। মাথাটা সামান্য বালিশ হতে তুলে বেডসাইড টেবিলে থাকা ঘড়িতে সময়টা একদফা দেখে নে। ঘড়ির কাঁটা সাতটা একুশে স্থির দেখে ফের চোখ বন্ধ করে বালিশে মাথা গুজে সে। মুহুর্তেই হিরণের টনক নড়ে উঠে। তড়িৎ সে চোখ মেলে তাকায়। নিজের কৃতকর্মের স্মৃতিচারণ করতেই সে ব্যস্ত চোখে একবার সম্পূর্ণ রুমে চোখ বুলায়। নেই। বাণী নেই।

হিরণ দ্রুত গতিতে উঠে বসে নিজের মাথা চাপড়ে ধরে। আরো একবার। আরো একবার সে একই পাপের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে। ছয় বছরের বহু প্রচেষ্টায় যেই সম্পর্ককে সে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো সেই সম্পর্কে সে নিজহাতে আবার ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। ক্ষমা মিলবে কভু? বাণী এই ইহ জনমে কখনো ক্ষমা করবে?

বাণীর কথা স্মরণ হতেই হিরণ দ্রুত বিছানা ছেড়ে নামে। গায়ে একটা ধূসর রঙা টি শার্ট তাড়াহুড়ো করে জড়িয়ে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে সে। সর্বপ্রথম উঁকি দেয় বহ্নির রুমে। খেলনা সজ্জিত রুমটায় ঘুমন্ত বহ্নি ছাড়া আর কারো অস্তিত্বের দেখা না পেয়ে হিরণ নীরবে মেয়ের রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসে। অত:পর ব্যস্ত পায়ে সম্পূর্ণ বাড়ির প্রতিটা কোণা খোঁজা শুরু করে সে। কিন্তু কোথাও বাণীকে না পেয়ে তার মাথা আরো বিগড়ে যায়।

বড় বড় কদম ফেলে বাড়ির বাহিরে পা রাখতেই ফ্রন্ট ইয়ার্ডে ইবাতের মুখোমুখি হয় সে। এই সময় নিজের স্যারকে এই অবস্থায় দেখে ইবাতের মনে খটকা লাগে। কিন্তু সে কিছু বলার পূর্বেই হিরণ প্রশ্ন করে,

“ বাণী কোথায়? “

ইবাত অবাক সুরে জবাব দেয়,

“ ম্যাডাম তো বাসায় স্যার। “

হিরণ আর রাগ চেপে রাখতে পারে না। সে হিংস্র ভঙ্গিতে থাবা মেরে ইবাতের প্যান্টের একপাশ হতে একটা পিস্তল হাতে নিয়ে তা ইবাতের কপালে ঠেকিয়ে বলে,

“ বাসায় থাকলে আমি পাচ্ছি না কেন? কোথায় গিয়েছে? “

হিরণের এই রূপের সাথে বেশ ভালো ভাবেই পরিচিত ইবাত। তাই সে বিচলিত হয় না। বরং শান্ত গলায় জবাব দেয়,

“ সকল গার্ডস নিজেদের দায়িত্বে আছে। শমসের স্যার যাওয়ার পর থেকে আমি নিজে সারারাত দু চোখের পাতা এক করি নি। দরজার এখানে ঠাই দাঁড়িয়ে রয়েছি। ম্যাডাম বেরিয়ে আসলে আমি অবশ্যই দেখতে পেতাম। “

ইবাতের কথা শেষ হতে না হতেই বাড়ির ভেতর হতে ব্যস্ত পায়ে একজন মেইড বেরিয়ে এসে বলে,

“ স্যার! বাড়ির পিছনের দরজা লক করা নেই। সম্ভবত বাড়ির ভেতর থেকে কেউ খুলেছে। “

মেইডের কথা কানে প্রবেশ করতেই হিরণ স্তব্ধ বনে যায়। বাণী কি আবার পালিয়েছে? প্রশ্নটা মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই হিরণ পিস্তল হাতে দ্রুত বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। তার পিছু পিছু ইবাতও ছুটে।

পিছনের দরজা দিয়ে বাহিরে পা রাখতেই চোখের সামনে ব্যাক ইয়ার্ড দৃশ্যমান হয়। উঁচু চার দেয়ালে আবদ্ধ ব্যাক ইয়ার্ডের ভেতর কোনো গার্ডস রাখে নি হিরণ। যারা আছে সকলে দেয়ালের ওপারে চব্বিশ ঘণ্টা পাহাড়ার দায়িত্বে আছে। সবুজ ঘাসে আবৃত শূন্য ব্যাক ইয়ার্ডের এককোণে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল হিজল গাছটা। সেই গাছের আড়াল হতে দেখা যাচ্ছে এক নারী পোশাকের অংশবিশেষ। এই দৃশ্যটুকু দেখেই হিরণ যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় সেই গাছের কাছে।

বিশাল গাছের আড়ালে ভেজা সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে আছে এক খয়েরী রঙা থ্রি পিস পরিহিত নারী। গলায় ওড়নার চিহ্নটুকুও নেই। উল্টো গায়ের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে ভেজা কাপড়। দু’হাতের মুঠোয় তার ক্ষানিকটা মাটি রয়েছে। বদ্ধ চোখ জোড়ার শেষ ভাগে এখনো নোনাজল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে খালি হাতে মাটি খোড়ার নিদর্শন উক্ত পরিস্থিতি ইতিমধ্যে ব্যক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।

হিরণ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। বিস্মিত ইবাতও। তবে সে দ্রুত নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। মনে মনে সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে শমসের মজুমদারকে নিয়ে স্যার এবং ম্যাডামের মধ্যে বিশাল কোনো ঝামেলা হয়েছে। যার দরুন ম্যাডামের এখন এই অবস্থা।

হিরণ হুট করে চাপা ব্যথার মতো শ্বাস ছাড়ে। এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বাণীর মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুঁয়ে দেখে। সাথে সাথে সে চমকে উঠে। বরফের ন্যায় জমে আছে সেই হাত। হিরণের হিংস্র দৃষ্টি অজানা ব্যথায় কাতর হয়ে উঠে। সে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বাণীর মাথা কোলে তুলে নরম সুরে ডাকে,

“ বাণী? এই বাণী? “

কোনো প্রতুত্তর না দেখে ইবাত সাহস করে বলে,

“ স্যার আমি ডক্টর হুমায়রাকে কল করবো? “

হিরণ মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েই বাণীকে তুলে বাড়ির ভেতর চলে যায়। নিজের রুমের বিছানায় শুইয়ে দিয়েই ব্যস্ত ভঙ্গিতে বাণীর ঠান্ডা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মালিশ করতে থাকে। লাবণ্যহীন মুখশ্রী আরো মলিন রূপ ধারণ করেছে যেন রাতারাতি। এই তুফানী আবহাওয়ায় কতক্ষণ ধরে চেতনাহীন অবস্থায় বাহিরে পড়ে ছিলো কে জানে!

হিরণের বুকের ভেতর দানবীয় টাইফুন হুলুস্থুল বাধিয়েছে যেনো। অপরাধবোধে অস্থির হয়ে আছে ভেতরটা। কতটা কষ্ট পেয়ে এই মেয়ে সেই বোবা গাছের তলে আশ্রয় খুঁজতে গিয়েছে? হিরণ সেই শীতল হাতের তালু মালিশ করতে করতে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় আওড়ায়,

“ আ’ম সরি। ভুল করে ফেলেছি আবার। মাফ করো না কখনো। করতে হবে না… “

“ তুমি কি ভুল করেছো পাপা? “

ঘুম জড়ানো শিশু কণ্ঠ কানে এসে পৌঁছাতেই হিরণ নীরব হয়ে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার পানে তাকাতেই দেখে দরজার সাথে অনেকটা লেপ্টে কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে বহ্নি। মেয়ের মুখপানে চেয়ে বাকহারা হয়ে পড়ে হিরণ। অবুঝ বাচ্চার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই।

__________

শান্ত ভঙ্গিতে নিজের কেবিনে শুয়ে আছে নিশা। তার ঠিক পাশেই একটা টুলে বসে রয়েছে কলেজ ইউনিফর্ম পরিহিত এক রমণী। নাঈমা এবং জুলফিকার বেরিয়ে যেতেই সে উৎসুক গলায় প্রশ্ন করে,

“ দোস্ত? আংকেল তোকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চাইছে। তুই কি চাস? তুই আংকেলের সাথে যেতে রাজি? “

বান্ধবীর এহেন প্রশ্নে নিশার কোমল মন আরো গুমোট রূপ ধারণ করে। তার আম্মু আব্বু তার ভালো চায় সে বিষয়ে নিশার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা একটাবারও এটা জানতে চায় নি নিশা কি চায়। নিশা দু’জনকেই ভালোবাসে। দু’জনের সঙ্গেই থাকতে চায়, যা কখনো সম্ভব নয়। তাই সে এই বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করে না।

কলেজ ইউনিফর্ম পরিহিত রমণী হয়তো নিশার মনের অবস্থা বুঝতে পারে। তাই প্রসঙ্গ বদলে সে বলে উঠে,

“ আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম দোস্ত। আমি ভেবেছিলাম সেদিন তুই আমাকে কল করে যেই ভয়ংকর ভাইয়াদের কথা বলেছিলি তারাই হয়তো তোকে কিডন্যাপ করেছে। “

নিশার মনে পড়ে যায় সেদিন রাতের ঘটনা। সাইফ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের দেখে সে ভয় পেয়েছিলো বটে। তবে উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে সে পরিস্থিতি সামাল দিতে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডকে কল করে আব্বু সম্বোধন করে নালিশ করা শুরু করে। এতে কাজও হয়। তার এই কাজে সাইফ নামক সেই ভদ্রলোক ভালোই ভয় পেয়েছিলো। পুরনো কথা স্মরণ করে নিশা ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করে,

“ তুই সেই ঘটনা আম্মুকে জানাস নি তো? “

“ উহু। জানানোর সুযোগ পেলাম কই? তোকে তুলে নেওয়া হয়েছে শুনেই আন্টি এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে ছুটে চলে যায়। “

নিশা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

“ ভালো করেছিস না বলে। “

নিশাকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেখে রমণী চোখ সরু করে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,

“ তুই কি কিছু লুকাচ্ছিস নিশু? “

নিশা মৃদু ইতস্ততভাবে জবাব দেয়,

“ আসলে ওই ভাইয়ারা ডিফেন্সের লোক। যেই ভাইয়াটার সাথে ধাক্কা লেগে আমি রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম না? উনিই আমাকে উদ্ধার করেছে গতকাল। হি ইজ এন আর্মি। ছেলেধরা নন। “

“ আর ইউ সিরিয়াস? মানে তুই একজন আর্মিকে ছেলেধরা বলে আমার কাছে গালমন্দ করছিলি সেদিন? তুই কি অন্ধ? চেহারা দেখে বুঝিস না?… “

রমণীর বাকি কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। মৃদু রিংটোনের শব্দ তুলে তার ব্যাগে ফোন বেজে উঠে। ব্যাগ হতে ফোন বের করে স্ক্রিনে নামটা দেখেই রমণীর মুখের কোণে হাসি ফুটে উঠে। নিশার দৃষ্টির অগোচর হয় না সেই দৃশ্য। সে প্রশ্ন করে,

“ কে? “

রমণী সাথে সাথে হাসি লুকিয়ে জবাব দেয়,

“ আম্মু কল দিচ্ছে। কথা বলে আসছি। “

কথাটুকু বলেই এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে ফোন নিয়ে বেরিয়ে যায় সে। নিশা তার যাওয়ার পানে বোকার ন্যায় তাকিয়ে থাকে। তার শুধু এমন কেন মনে হয় যে তার বেস্ট ফ্রেন্ড তার থেকে কিছু লুকাচ্ছে?

__________

হসপিটালের করিডরের শেষ মাথায় গিয়ে কলটা রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে একটা পুরুষ বলে উঠে,

“ আই হ্যাভ এ সারপ্রাইজ ফর ইউ। “

রমণী অতি উৎসুক গলায় জানতে চায়,

“ কি সারপ্রাইজ? “

“ তোমার অপেক্ষার অবসান ঘটবে। আমি খুব শীঘ্রই আসছি রুহী। “

রুহী অবিশ্বাস্যকর সুরে প্রশ্ন করে,

“ সত্যি বলছো? “

ফোনের অপর পাশ হতে সেই পুরুষ কণ্ঠ মৃদু হেসে জবাব দেয়,

“ তোমাকে মিথ্যা বলেছি কখনো? “

__________

“ ছেড়ে দে দূর্জয়। “

যন্ত্রণায় কাতরানো গলায় এই আর্তনাদ দূর্জয়ের কানে পৌঁছাতেই সে নিজের গতিশীল হাত জোড়া স্থির করলো। দু ঘন্টার পাশবিক নির্যাতনের পর এই তিনটি শব্দ কেবল উচ্চারণ করলো রইস দিলদার। দূর্জয়ের এতক্ষণের চালানো তান্ডবের ফলশ্রুতিতে রইসের আহত দেহ রক্তে জর্জরিত হয়ে গিয়েছে।

মৃদু বিরতি পেতেই রইস মাথা নত করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। আড়চোখে দেখতে থাকে দূর্জয়ের মুষ্টিবদ্ধ হাত জোড়া। শ্যাম চামড়া ভেদ করে রগ গুলো ফুলে রয়েছে বেশ। কিসের তৈরী ওই হাত জোড়া? সিমেন্টের নাকি? নাহয় এক ঘুষিতেই কিভাবে রইসের একটা দাঁত উপড়ে ফেলে দিয়েছে?

দূর্জয়ের কোনো তাড়া নেই। সে বেশ শান্ত ভঙ্গিতে একটা সাদা রুমাল দিয়ে নিজের রক্তাক্ত দু হাত মুছে নিতে নিতে বলে উঠে,

“ যা জানিস সব বলে দে। অযথা আমার সময় অপচয় করাটা আমার সবথেকে অপছন্দের কাজ। “

রইস দিলদার এবার হাসতে হাসতে মাথা তুলে তাকায়। অত:পর বেশ ক্রোশ নিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারা রক্তাক্ত থুথুর দলা। হিসহিসিয়ে বলে,

“ এটা তোর দেশের উদ্দেশ্যে ছিলো। “

ঠান্ডা মাথায় খুন করতে সক্ষম দূর্জয়ের মাথা গরম হওয়ার জন্য রইস দিলদারের উচ্চারণ করা এই বাক্যটাই যথেষ্ট ছিলো শুধু। দূর্জয় ক্ষীপ্র ভঙ্গিতে রইসের নাক বরাবর ঘুষি মারে এবার। এক ঘুষিতেই নাসারন্ধ্র হয়ে বেরিয়ে আসে তরল রক্ত। তবুও রইসের মাঝে তেমন একটা ভাবান্তর হলো না। সে উদ্ভট স্বরে হাসতে হাসতে বলে,

“ খুব শীঘ্রই আরেকটা ধ্বংসযজ্ঞ চালাবো আমরা। বুম! “

শেষের শব্দটা উচ্চারণ করে আরো উচ্চস্বরে হাসতে থাকে রইস। দূর্জয় এবার রইসের চুল শক্ত করে মুঠো করে ধরে প্রশ্ন করে,

“ কোথায়? কোথায় হবে সেটা? “

রইস দিলদার ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলে,

“ আমাকে মেরে ফেল দূর্জয়। কারণ জীবিত অবস্থায় আমার মুখ দিয়ে কোনো তথ্য বের করতে পারবি না তুই। “

দূর্জয় বেশ বিরক্ত হয়। এখানে আপাতত আর সময় অপচয়ের মানে হয় না। তার লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে সম্ভাব্য আশংকা সম্পর্কে জানাতে হবে এই মুহুর্তে। সেই উদ্দেশ্যে দ্রুত পা ফেলে বের হতে নিলেই রইস পিছন থেকে ঠাট্টা মিশ্রিত সুরে বলে উঠে,

“ সবার জন্য অপেক্ষা করছে ধ্বংসযজ্ঞ আর তোর জন্য অপেক্ষা করছে চমক। দারুণ এক চমক! “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]