এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-১৩+১৪

0
195

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৩.

২০১৩ সাল। বর্ষার কোনো এক বিকেল। ধরাপটে নেমেছে আকাশ ভেঙে তীব্র বর্ষণ। জনমানবহীন পাকা রাস্তায় জপজপ শব্দ তুলে দৌড়াচ্ছে এক কিশোরী। গায়ে পরিহিত অভারসাইসড টি শার্ট এবং লেগিংসটা বৃষ্টিতে ভিজে গায়ের সাথে আষ্টেপৃষ্টে রয়েছে। খোলা চুলের আগা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু পানি। কাধে তার বিশাল সাইজের একটা গিটারের ব্যাগ প্যাক। তার পায়ের গতি স্থির হয় স্কুলের কাছাকাছি একটা সুনসান রাস্তায় এসে। এই রাস্তাটা সাধারণত সাধারণ মানুষ এড়িয়ে চলারই চেষ্টা করে সবসময়। তার অন্যতম কারণ হলো রাস্তার দু ধারে থাকা সারিবদ্ধ বিশাল বাঁশ ঝাড়। লোকমুখে শোনা যায় জায়গাটা খুব একটা সুবিধার না। অশরীরীদের আবাস্থল স্থানও বলা হয় এই জায়গাটাকে।

কিন্তু বাণী সেই লোকমুখে বলা কথাগুলো কখনো কানে তুলে নি। এসব ব্যাপারে ভয়ডর তার সবসময়ই কম। তার বাসা থেকে স্কুলে পৌঁছানোর শর্টকাট রাস্তা এটা। বাণী সর্বদা শর্টকাট প্রেমী মেয়ে। যেখানে এই রাস্তা ধরে পনেরো মিনিটে স্কুলে পৌঁছানো যায়, সেখানে অযথা পয়ত্রিশ মিনিট ঘুরে অন্য রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাওয়ার কোনো মানে খুঁজে পায় না সে।

তবে আজ ঘটনা ভিন্ন। আজ সে স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এতক্ষণ দৌড়ে এই রাস্তায় এসে থামে নি। আজ সে অন্য উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে। তার সিক্ত নয়নযুগলের অশ্রু বৃষ্টির পানি বারবার ধুয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। বাণী নীরবে নিজের কাধের গিটারের ব্যাগপ্যাকটা নামিয়ে ছুড়ে রাস্তার একপাশে ফেলে দেয়। বুকের ভেতরটা খান খান হয়ে যায় তার। কষ্টের ভার বইতে না পেরে বাণী নিজেও রাস্তার ধারে বসে পড়ে। কান্নারত মুখশ্রী হাঁটুর ভাজে আড়াল করতেই এতক্ষণের নীরব কান্না এবার সুর তুলে। কি করুণ সেই কান্নার সুর! যেনো সত্যিই কোনো অশরীরী কাঁদছে।

সময় গড়ায়। হৈ হৈ হুঙ্কার তুলে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। সরু চিকন বাশগুলোও সেই বাতাসের প্রকোপে এদিক সেদিক দুলছে অবিরত। ঠিক সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত চলে বাণীর অশ্রু বিসর্জন এবং মেঘ জমা আকাশের করুণ বর্ষণ। যেই মুহুর্তে বৃষ্টি থেমে গেলো সেই মুহুর্তে যেনো বাণীও নিজের সম্বিত ফিরে পেলো। আদ্র হাতের পিঠ দিয়ে দু চোখের পাতায় জমে থাকা জল মুছে নেয় সে। কাকভেজা শরীর মৃদু থরথর করে কাঁপছে। বলা হয় কিশোরী হৃদয় বড়োই নাজুক প্রকৃতির হয়ে থাকে। অনেকটাই স্বচ্ছ কাঁচের ন্যায়। সামান্য আঘাতেই ভেঙে গুড়িয়ে যায়। তবে একটা বিষয়ে কাঁচ ভাঙার সঙ্গে হৃদয় ভাঙার পার্থক্য রয়েছে। তা হলো কাঁচ ভাঙে তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে। কিন্তু কিশোরী হৃদয় ভাঙে অতি নীরবে। কোনো শব্দ হয় না তাতে।

দুঃসহ যন্ত্রণা বুকে পুষে কম্পিত চিত্ত তুলে উঠে দাঁড়ায় বাণী। নিজের অতি প্রিয় গিটারের সঙ্গে নিজের চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া হৃদয়টাকেও অবহেলার সহিত রাস্তার এককোণে ফেলে রেখে প্রস্থানের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সে। পিছনে ফিরে তাকায় না একবারও। অবশ্য ফিরে তাকানোর মতো অবস্থায়ও ছিলো না সে। কয়েক ঘন্টা বৃষ্টিতে ভেজার ফলস্বরূপ কতদূর যাওয়ার পরই চেতনা হারিয়ে মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে যায় সে।

__________

বর্তমান,

গায়ে অসহন জ্বর। জ্বরে কাবু হয়ে ঘোরের মধ্যে কাতরাচ্ছে বাণী। গায়ের চামড়া যেন জলন্ত অগ্নিকুণ্ড হয়ে আছে। যে ছুঁয়ে দেওয়ার স্পর্ধা করবে সেই এই তীব্র উত্তাপে ভস্ম হয়ে যাবে। আচানক মাথায় আদুরে নারী হাতের ছোঁয়া পেতেই বাণী ভারী চোখের পাতা মেলে তাকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সে পারে না। ভাঙা গলায় অস্পষ্ট সুরে গোঙ্গায়,

“ মা। “

ডক্টর হুমায়রা অভিজ্ঞ হাতে একবার বাণীর কপালটা ছুঁয়েই নিজের হাতটা সরিয়ে ফেলে। অত:পর একটা ডিজিটাল থার্মেমিটারের একাংশ মৃদু কম্পিত ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে গুজে দেয়। এক মিনিট সময় গড়াতেই থার্মোমিটার হতে ভেসে আসে মৃদু এলার্ম জাতীয় শব্দ। হুমায়রা থার্মোমিটারটা হাতে নিয়ে চশমা ভেদ করে দেখে নেয় বাণীর শরীরের তাপমাত্রা। দেখতেই তিনি চিন্তিত গলায় শুধায়,

“ একশো চার ডিগ্রী! “

বিছানার শিয়রেই দাঁড়িয়ে ছিলো হিরণ। হুমায়রার কথা শুনেই সে উদ্বেগ মিশ্রিত স্বরে প্রশ্ন করে,

“ নিউমোনিয়া হওয়ার আশংকা আছে? “

“ কতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছে? “

এই বাড়ির নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে বাড়ির প্রতিটা কোণাতেই রয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা। ব্যাক ইয়ার্ডও সেই ইলেক্ট্রিক ক্যামেরার নজরদারির বহির্ভূত নয়। ডক্টর হুমায়রাকে কল করেই একজন মেইডকে বাণীর ভেজা কাপড় পরিবর্তনের দায়িত্ব দিয়ে হিরণ সেই সিসিটিভি দ্বারা ধারণকৃত ফুটেজ দেখতে বসে।

ঠিক রাত ৩ টা বেজে ১৩ মিনিটে তীব্র বর্ষণ মাথায় নিয়ে বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ডে গিয়ে হিজল গাছটার নিচে বসে বাণী। গাছের আড়ালে বসায় পিছন হতে আর বাণীর মুখ দেখা যায় না। তবে কান্নার দমকে তার কম্পিত পিঠ সিসিটিভিতে স্পষ্ট দেখা যায়। কাঁদতে কাঁদতে একটা সময় বাণী মাটি খামচে ধরে দু’হাতের মুঠোয়। এরকম করে প্রায় এক ঘন্টা বারো মিনিটের মাথায় তার নিস্তেজ দেহ ধীরে ধীরে একপাশে হেলে পড়ে।

সিসিটিভি ফুটেজ অনুসারে সময়ের হিসাব দিয়ে হিরণ বলে উঠে,

“ প্রায় চার ঘন্টা। “

পয়ত্রিশ বছর বয়সী ডক্টর হুমায়রার ভ্রু কুচকে আসে হিরণের কথার পিঠে। একটা মেয়ে তিন ঘন্টার অধিক সময় ধরে বৃষ্টিতে ভিজে চেতনাহীন অবস্থায় পড়ে ছিলো, অথচ একটা মানুষও তা দেখলো না? মনে মনে এই প্রশ্ন জাগলেও ডক্টর হুমায়রা মুখ ফুটে আর তা আর জিজ্ঞেস করে না। এই বাড়ির ব্যক্তিগত ব্যাপার হতে সে যত সম্ভব দূরে থাকারই চেষ্টা করে সবসময়।

উনার ভাবনার মাঝেই হিরণ বলে,

“ বাণীর আগেও একবার নিউমোনিয়া হয়েছিল। কোনো সমস্যা হবে না তো আবার? “

“ কবে হয়েছিলো? “

“ এগারো বছর আগে। বেশ অনেকদিন ভুগেছিলো। “

ডক্টর হুমায়রা কপালে ভাজ নিয়েই একটি ছোট নোটপ্যাডের সাদা কাগজে কলমের কালো কালি বসিয়ে ইংরেজিতে কিছু শব্দগুচ্ছ লেখে। অত:পর কাগজটা ছিড়ে হিরণের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

“ আপাতত এই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মেডিসিন গুলো দিতে হবে। আশা করছি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। “

ডক্টর হুমায়রা প্রেসক্রিপশন বুঝিয়ে দিয়ে চলে যেতেই হিরণ ইবাতকে ডেকে তাড়াতাড়ি মেডিসিন আনতে পাঠিয়ে দেয়। অত:পর বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে বাণীর মাথার কাছে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা বহ্নিকে। বহ্নি নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে বাণীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম সুরে বলে উঠে,

“ মাম্মা উঠো। আমি ডাকছি তো। “

হিরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের পাশে বসে তাকে টেনে নিজের কোলে নিয়ে বলে,

“ অনেক বেলা হয়েছে মা। এখনো নাস্তা করো নি তুমি। “

বহ্নি মলিন মুখে বলে,

“ মাম্মা তো সিক। আমাকে কে খাইয়ে দিবে? “

“ পাপা আছি না? “

বহ্নি মলিন মুখে একবার বাণীকে দেখে নিয়ে অত:পর রাগী স্বরে শুধায়,

“ আই হেইট রেইন পাপা। “

হিরণ অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

“ কেন? “

“ বৃষ্টির কারণেই মাম্মা সিক হয়েছে। “

মেয়ের ক্রোধ মিশ্রিত কথা শুনতেই হিরণের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে। বাণী অসুস্থ হয়ে পড়ায় সামান্য এক বৃষ্টির প্রতি বহ্নির এতো ক্ষোভ? যদি বহ্নি কখনো জানে যে বাণীর এই অবস্থার জন্য দায়ী বৃষ্টি নয় বরং হিরণ, তখন কি বহ্নি হিরণকেও ঘৃণা করবে? ভাবনাটা মনে উঁকি দিতেই হিরণের অন্তঃপুরটা গুমরে উঠে। বাণী সহ গোটা পৃথিবীর ঘৃণা সহ্য করার ক্ষমতা আছে তার। কেবল বহ্নির চোখে নিজের জন্য ঘৃণা কখনো সহ্য করতে পারবে না সে। এর থেকে মৃত্যু শ্রেয়।

হিরণ চোখ তুলে বাণীর পানে তাকায়। আরামদায়ক কোম্ফর্টারের নিচে অনেকটা কুঁকড়ে আছে জীর্ণ শীর্ণ নারী দেহটা। লাবণ্যহীন মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে কেমন ম্লান দেখাচ্ছে। বেদনার্ত দৃশ্যটা হিরণের মনে মেঘের আনাগোনা সৃষ্টি করে। তার মনে পড়ে যায় গতরাতে বাণীর বলা কথাটা,

“ আমার মেয়ে আপনার জন্য রহমত নয় বরং আপনার সবথেকে বড় শাস্তি। “

সত্যিই কি তাই? সৃষ্টিকর্তা কি হিরণকে ধ্বংস করার অস্ত্র হিসেবেই বহ্নিকে পাঠিয়েছে? শয়তানকে ধ্বংস করার অস্ত্র কি তবে তার নিজের অংশই?

__________

ফোনালাপে ব্যস্ত রাফি খেয়ালই করেনি কখন তার পিছনে ছয়জন মানুষ এসে রোবটের ন্যায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। কলটা কেটে পিছনে ফিরে তাকাতেই সে আচমকা এতো গুলো মুখ দেখে ভয় পেয়ে যায়। অত:পর নিজেকে সামলে নিয়ে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ তোরা এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? “

সাইফ চোখ সরু করে প্রশ্ন করে,

“ শালা একজন আর্মি হয়ে বাঘের মতো স্পষ্ট গলায় না গর্জে কার সাথে মিনি বিড়ালের মতো মিনমিন করে কথা বলছিলি? তুই দেখি পুরো আর্মি জাতির কলঙ্ক। “

জুনায়েদ চুইঙ্গাম চিবুতে চিবুতে বলে উঠে,

“ আরে বুঝোস না? বাঘ কার সামনে বিড়াল হয়ে যায়? “

রাফি কোনো ভনিতা না করে জবাব দেয়,

“ গার্লফ্রেন্ডের কল ছিলো। “

ফারদিন অবাক গলায় প্রশ্ন করে,

“ তোর গার্লফ্রেন্ডও আছে? কই আগে বলিস নি তো। “

প্রত্যয় রাফির চিন্তিত মুখশ্রী পরখ করে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে,

“ তোকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। অল গুড? “

রাফি এবার হতাশ ভঙ্গিতে কাঠের তৈরী বেঞ্চিতে বসে পড়ে। তার দু’পাশে বসে সাইফ এবং প্রত্যয়ও। বাকিরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়। সাদাত সিরিয়াস গলায় প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে রাফি? কোনো সমস্যা? “

রাফি উদাস গলায় বলে উঠে,

“ অন্যার বাবা ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। “

ফারদিন ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ অন্যা কে? “

রিদওয়ান পাশ হতে ফারদিনের মাথায় একটা চটা মেরে বলে উঠে,

“ বলদ ওর গার্লফ্রেন্ডের কথা বলতেসে। “

সাইফ ওদের কথায় ফোঁড়ন কেটে বলে উঠে,

“ তোদের সম্পর্কের কথা বাসায় জানিয়ে বিয়ে ভাঙতে বল তাহলে। “

রাফি জবাব দেয়,

“ ওর বাসায় জানে আমাদের ব্যাপারে। কিন্তু ওর বাবা রাজি হয় নি। “

সাদাত প্রশ্ন করে,

“ তোর মধ্যে অপছন্দ করার মতো কি পেলো? “

রাফি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ ওর বাবা ডিফেন্সের লোক পছন্দ করে না। অনেকটা পুরান ধাঁচের লোক উনি। চিন্তা চেতনাও তেমন। উনার মতে ডিফেন্সের ছেলেদের নাকি চরিত্রে সমস্যা থাকে। আমরা নাকি নেশা পানিতে আসক্ত হই। আর তাছাড়াও আমাদের জীবনের কোনো গ্যারান্টি নেই। “

এতটুকু শুনতেই সাইফের মাথায় রক্ত উঠে যায়। সে রাগী গলায় বলে উঠে,

“ ভুলে যা ওই মেয়েরে তুই। এমন শশুর তুই ডিজার্ভ করস না। আমরা যেখানে এদের জন্য নিজেদের জীবন বাজি রেখে লড়ে যাচ্ছি আর এরা কিনা আমাদের ব্যাপারে এতো চিপ ধারণা পুষে। “

সাত বন্ধুর আলাপে ভাটা পড়ে দূর্জয়ের আগমনে। সবাই সাথে সাথে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। দূর্জয় শান্ত গলায় বলে উঠে,

“ পনেরো মিনিটের মধ্যে মিটিং রুমে সবাইকে দেখতে চাই। “

এক বাক্যের আদেশটুকু ছুড়ে দিয়েই দূর্জয় শান্ত ভঙ্গিতে সেখান থেকে প্রস্থান করে। গতকাল রাতে রইস দিলদারের মুখে সেই ভবিষ্যৎ বাণী শোনার পর থেকেই তার চালচলন পূর্বের তুলনায় অধিক শান্ত হয়ে গিয়েছে। উপরে উপরে ঠান্ডা থাকলেও দূর্জয়ের ভেতরে বয়ে চলেছে অস্থিরতা। মনে ঘুরছে অসংখ্য প্রশ্ন। কি হবে? কোথায় হবে? কিভাবে হবে?

__________

সন্ধ্যা নামতে না নামতেই বাণীর জ্বর হু হু করে বেড়ে গেলো। শুধু জ্বর বাড়লেও বিষয়টা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতো না। কিন্তু জ্বরের পাশাপাশি অবচেতন অবস্থায় তার তীব্র শ্বাসকষ্টও শুরু হয়। এই পরিস্থিতি দেখে বহ্নি ও হিরণ দু’জনেই ভয় পেয়ে যায়। হিরণ দ্রুত বহ্নিকে ইবাতের সাথে রুমের বাহিরে পাঠিয়ে দিয়ে ডক্টর হুমায়রাকে কল করে বাণীর শারীরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানায়। ডক্টর হুমায়রা বিলম্ব না করে বলে,

“ ওকে এক্ষুনি হসপিটাল নিয়ে আসুন। “

বাণীর জন্য হিরণের চিন্তা আকাশসম হলেও সে হুমায়রার কথা মানে না। জেদ ধরে বলে,

“ সম্ভব না। যা যা প্রয়োজন সব নিয়ে বাসায় আসুন আপনি। বাসায় ওর ট্রিটমেন্ট হবে। “

ডক্টর হুমায়রা এবার ক্ষানিকটা বিরক্ত হয় বটে। সে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে কাটকাট গলায় বলে উঠে,

“ দেখুন হিরণ সাহেব, পেশেন্টের গুরুতর শারীরিক অবস্থা তার ডক্টর হিসেবে আমি আপনার চেয়ে ঢের ভালো বুঝি। বহ্নির জন্মের সময়ও আপনার এই একরোখা জেদের জন্য মেয়েটা মরতে মরতে বেঁচেছে। এখনো যদি আপনি সেই একই পরিস্থিতি ফেস করতে চান তবে আপনি আপনার জেদ নিয়ে থাকুন। “

অন্য সময় হলে ডক্টর হুমায়রার এহেন কথার পিঠে হিরণ ক্ষিপ্র রূপ ধারণ করতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। অলরেডি তার ভুলের সাজা মেয়েটা ভুগছে। বাণীর ভোগান্তি বাড়িয়ে দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হিরণের নেই। তাই সে বাধ্য হয়ে বলে,

“ আমি ওকে নিয়ে আসছি। কিন্তু ওর সিকিউরিটি আর প্রাইভেসির দায়িত্ব সম্পূর্ণ আপনার। সেই অনুযায়ী নিজের মেডিক্যাল টিম সিলেক্ট করুন। আমি কোনো ধরনের মিসম্যানেজমেন্ট মেনে নিবো না। “

কলটা কেটেই হিরণ দ্রুত গায়ে টি শার্ট বদলে একটা শার্ট জড়িয়ে নেয়। অত:পর রুম থেকে বেরিয়ে ইবাতকে ডেকে বলে,

“ বহ্নিকে তোমার দায়িত্বে রেখে যাচ্ছি। টেক কেয়ার অফ হার। আমার মেয়ের সামান্য অযত্ন যেনো না হয়। “

ইবাত সহ সকলকে বহ্নির দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েই হিরণ ফের রুমে প্রবেশ করে। বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে বাণীকে তুলতে নিলেই বাণী তপ্ত চোখ জোড়া মৃদু মেলে তাকায়। হিরণকে দেখতেই তার নিঃশ্বাস আরো অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। ভাঙা গলায় এলোমেলো কিছু শব্দ আওড়ায়,

“ খুনি… খুনি আপনি। খুন করেছেন। “

বাণীর হ্যালুসিয়েশন হচ্ছে। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে সেই কালো রাতের স্মৃতি। সেই হিজল গাছটার সাথে বাঁধা অবস্থায় হেলে থাকা রক্তাক্ত লাশ। সেই লাশের সামনে থেকে টেনে হিচড়ে বাণীকে বাড়ির ভেতর নিয়ে আসা। অত:পর চার দেয়ালের একটা রুমের ভেতর বাণীর আবদ্ধ আত্ম চিৎকার। নিজেকে বাঁচানোর আর্তনাদ। তার অস্তিত্বের কালো অধ্যায় হিসেবে হিরণের আধিপত্য ও বিচরণ।

সবটা চোখের পাতায় ভেসে উঠতেই বাণীর বদ্ধ চোখের কার্ণিশ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। হিরণ ততক্ষণে তাকে নিয়ে গাড়ির কাছে পৌঁছে গিয়েছে। একজন এসে গাড়ির দরজাটা খুলে দিতেই হিরণ বাণীকে সাবধানতার সহিত সিটে বসাতে নেয়। সেই মুহুর্তে বাণী হিরণের কানের কাছে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে উঠে,

“ আমি মুক্ত হবো। হাজার চেষ্টা করেও আমাকে বেঁধে রাখতে পারবেন না। প্রয়োজন হয় তো আপনাকে খুন করবো। “

শেষের কথাটুকু খানিকটা ফিসফিসিয়েই বললো বাণী। তার ফিসফিসিয়ে মৃদু স্বরে বলা কথাটা হিরণের বুকে ঝড় তুললো। সে বুঝতে পারলো বাণী আপাতত নিজের মধ্যে নেই। তাই সে চুপচাপ বাণীকে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটটায় বসিয়ে দিয়ে বাণীর সিট বেল্ট বেঁধে দিতে দিতে বলে উঠে,

“ সেড়ে উঠো আগে। হাতে বন্দুক তুলে দিবো। বুকের যে পাশটায় ইচ্ছা গুলি ছুড়ে ঝাঁঝড়া করে দিও। “

__________

শান্ত কেবিনটায় সুঠাম দেহের পুরুষের আগমন ঘটতেই নিশার চোখ মুখ চিকচিক করে উঠলো। সে প্রফুল্ল গলায় বলে,

“ দূর্জয় ভাইয়া! “

দূর্জয় ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে এগিয়ে যায় প্রথমে নাঈমার দিকে। সালাম দিয়ে প্রশ্ন করে,

“ ভালো আছেন আন্টি? “

নাঈমাও মৃদু হেসে অভিযোগের সুরে বলে,

“ আলহামদুলিল্লাহ। কোথায় থাকো তুমি? অনেকদিন ধরে তোমার সাথে দেখা হয়না। তোমার সব সম্পর্ক কি শুধু লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবার সঙ্গেই? আমার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই? “

“ এরকম কথা বলে আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না প্লিজ আন্টি। আমার ব্যস্ততা সম্পর্কে তো আপনি জানেনই। এখনো বহু গুরুত্বপূর্ণ একটা কেসের মাঝে সময় করে বোনকে দেখতে আসলাম। “

নাঈমা হেসে দূর্জয়ের কাধে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

“ আমি তাহলে এখন আর তোমাদের বিরক্ত না করি। তোমরা কথা বলো। আমি গিয়ে একটু ক্যানটিন থেকে কফি খেয়ে আসছি। “

নাঈমা চলে যেতেই দূর্জয় এগিয়ে গিয়ে নিশার বেডের পাশের টুলটায় বসে বলে,

“ এখন শরীর কেমন? “

নিশা হেসে বলে,

“ ঠিক আছি। ডক্টর বলেছে ফিজিওথেরাপি নিলে আমি হাঁটতেও পারবো। “

দূর্জয়ের মুখশ্রী সামান্য মলিন রূপ ধারণ করে। নিশাকে সে ছোটবেলা থেকে চিনে। তার নিজের আপন ছোট বোন থাকলে তাকে যতটা স্নেহ করতো নিশাকেও ঠিক ততটাই স্নেহ করে দূর্জয়। সেই সুবাদেই সে জানে যে এই মেয়েটা কতটা নরম ও ভীতু প্রকৃতির।

দূর্জয় প্রশ্ন করে,

“ ভয় পেয়েছিলে খুব? “

নিশা সাহসী ভাব নিয়ে বলে,

“ একজন আর্মির মেয়েকে এই প্রশ্ন করা তোমাকে মানায় না ভাইয়া। “

দূর্জয় হেসে নিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নিশা তখন উদাস মুখে বলে,

“ কিন্তু একটা আফসোস রয়ে গিয়েছে। “

“ কি আফসোস? “

“ ওই কাপুরুষদের মুখে থুথু মারতে পারলে হয়তো আত্মতৃপ্তি পেতাম। “

দূর্জয় ও নিশার টুকটাক আলাপ চলে প্রায় বেশ কিছুক্ষণ। আচমকা একটা কল আসতেই দূর্জয় বেরিয়ে যেতে নিলে নিশা পিছু ডাকে,

“ ভাইয়া। “

দূর্জয় পিছু ফিরে শুধায়,

“ হ্যাঁ বলো। “

নিশা কিছু একটা বলতে চেয়েও সে শেষ পর্যন্ত আর বলে না। মাথা নেড়ে কিছু না বলতেই দূর্জয় বেরিয়ে যায়। নিশার মনে তখন খচখচ করতে থাকে দূর্জয়কে না বলা কথাটা। সেদিন তাকে বন্দী করা ওই টেরোরিস্টদের মধ্যে মাস্ক পরিহিত একজন যুবককে তার অনেক পরিচিত মনে হয়েছে। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও নিশা মিলাতে পারছে না কে হতে পারে! তাই অযথা দূর্জয়ের চিন্তা বাড়িয়ে না দিতেই সে এই বিষয়টা চেপে যায়। মনে মনে নিজেকে শুধায়,

“ আমিই হয়তো বেশি ভাবছি। আমার পরিচিত কেউ দেশের শত্রু হতে যাবে কোন দুঃখে? “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৪.

চট্টগ্রাম শহরের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা আধুনিকতার ছোঁয়ায় মোড়ানো প্রাইভেট হাসপাতালটার সপ্তম তলা হতে তেরো তলা পর্যন্ত ফ্লোর গুলো সব প্রাইভেট কেবিনের আওতাভুক্ত। ডক্টর হুমায়রার তত্ত্বাবধানে মুহুর্তেই টপ ফ্লোরটা তথা থার্টিন্থ ফ্লোর সম্পূর্ণ খালি করার ব্যবস্থা করা হলো। সেই ফ্লোরে চিকিৎসাধীন পেশেন্টদের অন্য ফ্লোরের খালি কেবিন গুলোতে শিফট করা হলো যতদ্রুত সম্ভব। এই ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করা হুমায়রার একার পক্ষে এতো সহজ হতো না যদিও। কিন্তু ইবাতের একটা ফোন কলেই বিষয়টা অত্যন্ত সহজ হয়ে গেলো। হসপিটাল অথরিটির কাছে পৌঁছে গেলো সূক্ষ্ম আদেশ। চট্টগ্রাম শহরের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর স্ত্রী অসুস্থ। তার চিকিৎসার পাশাপাশি প্রাইভেসি মেইনটেইন এর দায়িত্বটাও হসপিটাল কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দিতেই তারা ব্যাপারটা আমলে নিলেন।

স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ স্পিডে গাড়ি চালিয়ে বাণীকে নিয়ে হসপিটালে পৌঁছায় হিরণ। তার পিছু পিছু আরো দু গাড়ি ভর্তি লোক এসেছে নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে। তবে তাদের গেটাপ এবং ভঙ্গিমা এমন যেনো তারা অতি সাধারণ সিভিলিয়ান মাত্র। হসপিটালের সামনে নামতেই তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো সাধারণ মানুষের ভীড়ে।

ডক্টর হুমায়রা আগে থেকেই দুজন ওয়ার্ড বয়কে নিয়ে নিচে প্রস্তুত ছিলো হিরণ এবং বাণীকে রিসিভ করতে। তিনি বিলম্ব না করে অতি দ্রুত লোক সমাগম এড়িয়ে তাদের নিয়ে স্টাফদের জন্য বরাদ্দকৃত শূন্য লিফটে উঠে থার্টিন বাটনে প্রেস করে। মিনিট একের মধ্যে লিফট পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট ফ্লোরে।

বাণীর শ্বাসকষ্টের পরিমাণ বেড়েছে বৈ কমে নি বিন্দু পরিমাণ। গায়ের জ্বরটাও বেপরোয়া হয়ে পড়েছে বেশ। প্রাথমিক লক্ষণ এবং অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে হুমায়রা নিউমোনিয়ার আশংকাই করে। তবে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে সে বিশেষজ্ঞ ডক্টরের সাথে আলাপ করে কিছু টেস্ট করার ব্যবস্থা করে। উল্লেখ্য টেস্ট গুলোর মধ্যে মুখ্য হলো চেস্ট এক্স-রে এবং সিবিসি টেস্ট। তার পাশাপাশি পালস অক্সিমেটরি নামক ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাডে উপস্থিত অক্সিজেনের পরিমাণটাও মেপে নিলো।

টেস্ট গুলোর রিপোর্ট যথাসম্ভব দেওয়ার আদেশ দিয়েই হুমায়রা বাণীর প্রাথমিক জ্বর নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়। তবে তার পূর্বে সে হিরণকে বলে কেবিনের বাহিরে যেতে। হুমায়রার আদেশ শুনে হিরণ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ আমার বাহিরে যেতে হবে কেন? “

“ নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে হিরণ সাহেব। রোগটা ছোঁয়াছে। রিপোর্ট পজিটিভ হলে বাণীকে সম্পূর্ণ আইসোলেটেড করতে হবে আমাদের। তাই নিশ্চিত রিপোর্ট পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করা গুরুত্বপূর্ণ। “

হিরণ ম্লান দৃষ্টি মেলে একবার তাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে অবস্থিত ডক্টর হুমায়রা সহ আরো দুজন নার্সের দিকে। তারা তিনজনই মাস্ক, সার্জিক্যাল গ্লাভস ও ক্যাপ পরিহিত অবস্থায় আছে। আশংকাজনক রোগের সংক্রমণ হতে নিজেদের বাঁচানোর সকল ব্যবস্থাই তারা নিয়েছে। একপলক তাদের দেখে নিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে হিরণ তাকায় শুভ্র বেডে শুয়ে থাকা দুস্থ দেহের মালিকানার দিকে। প্রিয়তমার এহেন দশা হিরণের বিবেক কাঁপিয়ে তুলে। মনে মনে নিজেকে শুধায়,

“ ভুল করেছিস হিরণ। নিজের কথার বরখেলাপ করেছিস। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছিস। যার জন্য নিজের পাষবিক রূপটা খোলসে ঢেকে রাখার ওয়াদা করেছিলি তার সামনেই নিজের পশুর ন্যায় রূপটা নির্মোচন করেছিস। কষ্ট দিয়েছিস বাণীকে। আরো একবার। “

বিবেকের দংশন উদয় হতেই হিরণ আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। এলোমেলো পা ফেলে দ্রুত সেই কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে আসে। করিডোরের শেষ মাথায় উন্মুক্ত এক বারান্দা রয়েছে। সেই বারান্দায় এসেই হিরণ পকেট হতে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে। অত:পর লাইটারের সাহায্যে একটা সিগারেট জ্বালিয়েই দু ঠোঁটের ফাঁকে তা চেপে ধরে। শান্তি মিলছে না। সিগারেটের অসহন ধোঁয়ার সঙ্গে তার আত্মগ্লানি উঁড়ে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে না। নিজের অসহায় অভিব্যক্তি হিরণ কাকে বোঝাবে?

ওই কেবিনে অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকা মেয়েটা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মেয়েটার সাথে তার জীবন ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। একই দঁড়ির দুই প্রান্তে বাঁধা তারা। কিন্তু মেয়েটা বোকা। বড্ড বোকা। তাইতো বাঁধা দড়ি সহই সে ছুটে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়। এই বুদ্ধিহীন আচরণের ফলে মেয়েটা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তার পাশাপাশি দঁড়ির অপরপ্রান্তের মানুষটাও সেই আঘাতের ক্ষীণ অংশীদার হয়। কিন্তু বোকা মেয়েটা তা মানতে নারাজ।

সিগারেটে শেষ টানটা দিয়েই হিরণ অবশিষ্ট অংশটুকু নিজের বাম হাতের মুঠোয় পুরে আহত স্বরে শুধায়,

“ তোমাকে ভালোবাসার কথা আমার আর ইহ জনমে মুখ ফুটে বলা হবে না বাণী। সেই সুযোগ আমি নিজ পাপে হারিয়েছি। কিন্তু এই নিঝুম রাতের আকাশ সাক্ষী রইলো, আমি একটা জানোয়ার এটা যেমন সত্য, ঠিক একইভাবে আমি তোমার ভালোবাসায় আহত এটাও ধ্রুব সত্য। “

__________

দশজন যুবক পাথরের মূর্তির ন্যায় সটান দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের দলনেতা আব্রাহাম। সকলের কাধেই রয়েছে ব্যাগ প্যাক। দেখে যে কেউ মনে করবে একদল ভার্সিটি পড়ুয়া যুবক বোধহয় ভ্রমণ যাত্রায় বের হওয়ার জন্য তৈরী হয়েছে। যদি তারা জানতো তাদের উদ্দেশ্যটা কতো ভয়ংকর! এ কোনো ভ্রমণযাত্রা নয়, বরং মরণ যাত্রা। যেখানে মানুষ মারে, মানুষ মরে। শমসের মজুমদারের আলিসান বাড়ির ত্রী সীমানার ভেতর এই মুহুর্তে আব্রাহাম সহ তার সঙ্গীদের অবস্থান। অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে তারা শমসের মজুমদারের।

অবশেষে তাদের অপেক্ষার পালা শেষ হয়। বিশাল গেট পেরিয়ে বাড়ির সীমানায় প্রবেশ করে শমসের মজুমদারের গাড়িটা। গাড়ি হতে নেমেই শমসের মজুমদার মুখে স্বভাবসুলভ হাসি বজিয়ে রেখে আব্রাহামের দিকে এগোয়। আব্রাহাম রাশভারী স্বরে শুধায়,

“ আমরা প্রস্তুত স্যার। “

শমসের মজুমদারের হাসির রেখা দীর্ঘ হয়। তিনি এগিয়ে গিয়ে আব্রাহামের কপালে চুমু খেয়ে বলে,

“ আমি জানি তুমি আমার মান রাখবে। “

আব্রাহাম মৃদু উৎসুক গলায় প্রশ্ন করে,

“ হিরণ স্যার? উনারও উপস্থিত থাকার কথা ছিলো। “

শমসের বিশ্রী হাসি আঁকে আব্রাহামের কথার পিঠে। রহস্যময় গলায় বলে,

“ হিরণের কাছে আজকাল মিশনের থেকে পরিবার বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। হয়তো সেখানেই সময় দিচ্ছে। “

আব্রাহাম আর এই ব্যাপারে কথা বাড়ায় না। সে বিদায় নিয়ে প্রস্থান করতেই শমসের মজুমদার তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের পানে তাকায়। ছেলেটার নাম মানিক। শমসের মজুমদারের বিশ্বস্ত ডানহাত। শমসের মজুমদার পর্যন্ত সকল তথ্য পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে নিযুক্ত রয়েছে সে। শমসের ভ্রু কুটি করে প্রশ্ন করে,

“ কি ব্যাপার মানিক? হিরণের এখানে উপস্থিত না থাকার কারণ কি? “

মানিক তোতাপাখির ন্যায় বুলি খুলে বসে,

“ স্যার, আপনার আদেশ অনুযায়ী হিরণ স্যারের বাড়ির উপর যাদের নজর রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো তারা খবর পাঠিয়েছে। সন্ধ্যার দিকে হিরণ স্যারকে গাড়িতে করে বাড়ি থেকে বের হতে দেখা গিয়েছে। সঙ্গে উনার স্ত্রীও ছিলো। উনি নিজের স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছে। অসুস্থ খুব সম্ভবত। “

শমসের চৌধুরী বেশ ঠান্ডা গলায় শুধায়,

“ হিরণ একের পর এক ভুল করে যাচ্ছে। ও ভুলে যাচ্ছে ওর প্রায়োরিটি কি হওয়া উচিত। আমার এতো বছরের শিক্ষা ওই দুই দিনের মেয়ের মোহে ভুলতে বসেছে সে। “

মানিক বলে উঠে,

“ স্যার উনার করা ভুল যদি আপনার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়? তার আগেই কি উনাকে থামানো উচিত না? “

শমসের মজুমদার হাঁটতে হাঁটতে উঠোনের একপাশে রাখা আরামকেদারায় আয়েশ করে বসে। অত:পর বলে,

“ শুনো মানিক। আমি পরিবার ও আপনজনহীন একজন শক্তিশালী মানুষ। আমাকে দমানোর কোনো রাস্তা আমি খোলা রাখিনি। অনেকে হয়তো মনে করে হিরণকে আমি আমার একাকিত্ব দূর করার জন্য এতিমখানা থেকে তুলে এনে নিজের ছায়াতলে রেখেছি। কিন্তু মূর্খের দল এ জানে না যে শমসের মজুমদার নিজের হৃদয় কেটে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে। যেখানে হৃদয়ই নেই সেখানে মায়া দয়া থাকবে কি করে? হিরণকে এডপ্ট করার একটাই কারণ, বিশ্বস্ততা। আমার এমন একজনের খুব প্রয়োজন ছিলো যাকে আমি নিজের মন মতো গড়ে তুলতে পারবো। হিরণ হয়েছেও তাই। আমার আদর্শে বড় করেছি ওকে। ওই একটুখানি বয়সে ওকে অস্ত্র আর মদের সাথে পরিচয় করিয়েছি। আমার মদের ব্যবসার সম্পূর্ণ হালখাতা সামলানো শিখেছে ওইটুকু বয়সে। একটা সময় ও আমাকেও ছাড়িয়ে যায়। আমার ব্যবসা ছেড়ে নিজের আলাদা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে। শালা মদ ছেড়ে অস্ত্রের ব্যবসা শুরু করে। অস্ত্রের নেশায় এতটাই ডুবে গিয়েছে ও যে লেলিহান শিখার ন্যায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। পোষ্য কুকুর নিজের মালিকের প্রতি যতটা অনুগত থাকে ও ঠিক ততটাই অনুগত ছিলো ও। কিন্তু আজকাল কুকুরটা নিজের মালিকের দিকেই সুযোগ পেলে ঘেউ ঘেউ করার সাহস দেখাচ্ছে। যার একমাত্র কারণ ওই নারী আর শিশু। ও হয়তো ভাবছে মালিকের দিকে ঘেউ ঘেউ করে ও খুব বীর বাহাদুর হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ও বুঝতে পারছে না যে ওই নারী আর শিশুর কারণে ও ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ছে। ওর এই দূর্বলতাই ওকে আপনাআপনি শেষ করে দিবে। আপাতত আমার ওকে নিজের মিশনের জন্য প্রয়োজন। প্রয়োজন মিটে গেলে ওই কুত্তার বাচ্চাকে নিজের অওকাদ মনে করিয়ে দিবো। “

শমসের মজুমদারের কথার পিঠে আর কোনো টু শব্দ করে না মানিক। মনে মনে সে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করে। বেশ হবে ওই জানোয়ারটা শায়েস্তা হলে। একবার হিরণকে সরাতে পারলে শমসের মজুমদারের সবথেকে কাছের মানুষ হিসেবে মানিক হিরণের জায়গা দখল করবে। যেই ক্ষমতার এতো আত্মগরিমা ওই জানোয়ারের সেই ক্ষমতা মানিকের আওতায় থাকবে তখন।

__________

আর্মিদের থাকার জন্য রয়েছে মেসের ব্যবস্থা। সেই মেসেই একই রুম শেয়ার করে থাকে সাইফ এবং সাদাত। রাতের খাবার সেড়ে সবেমাত্র রুমে ফিরলো তারা। সাদাত বিনাবাক্য ব্যয়ে নিজের সিঙ্গেল বেডটায় গা এলিয়ে দিয়ে একপাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। দূর হতে দেখে যে কেউ মনে করবে সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু সাদাতের চোখে এখনো ঘুম নামে নি। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের চোখে সহজে ঘুম নামেও না। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে রাত্রি বেলায় যখন বালিশে মাথা গুজে তখন তাদের মাথায় কিলবিল করে পারিবারিক বিভিন্ন চিন্তা। সাদাতের ক্ষেত্রে সেই চিন্তার পরিমাণ একটু বেশিই। এই মিশনে আসার পূর্বেই তার বাবা মারা গিয়েছে। সাদাত তখন অন্য মিশনের কারণে ফিল্ডে ছিলো এক সপ্তাহ। তার বাবার মৃত্যুর খবরটা সে পায় ঠিক দু’দিন পরে। ততক্ষণে দাফনকাজ শেষ। একমাত্র ছেলে হয়েও নিজের বাবার জানাজা পড়ার সুযোগটুকুও তার ভাগ্যে জুটে নি। সেই আফসোস এখনো ভিতরে ভিতরে সাদাতকে কুড়ে খায়। সঙ্গে রয়েছে নিজের মা আর ছোট বোন দু’টোর চিন্তা। চট্টগ্রাম হতে অদূরে খুলনা জেলায় যাদের অবস্থান। একা তিনটা মেয়ে মানুষকে আল্লাহ ছাড়া আর কারো আমানতে রেখে আসতে পারে নি সাদাত। মানুষ রূপী জানোয়ার ভর্তি দেশে মা, বোন, স্ত্রী কিংবা কন্যা সন্তানকে একা রেখে তাদের নিরাপত্তার আশংকায় এমন বহু সাদাতই নির্ঘুম রাত পাড় করে।

ঠিক তার পাশে তিন হাত দূরে থাকা অপর সিঙ্গেল বেডটায় সোজা হয়ে সিলিংয়ের পানে চেয়ে রয়েছে সাইফ। খাওয়ার পরে ক্ষানিকের আড্ডায় আজ সকলে নিজের পরিবার নিয়ে গল্প করছিলো। কি মিষ্টি খুনসুটিময় সেই গল্প গুলো! কতো কতো চরিত্র রয়েছে সেই গল্প গুলোতে! মা – বাবা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানি, চাচা-চাচি ইত্যাদি। সাইফ কেবল হাসিমুখে সবার গল্প গুলো শুনে যাচ্ছিলো। আচমকা রিদওয়ান প্রশ্ন করে উঠে,

“ কি রে! সাইফ মামা! তোর ফ্যামিলি সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। তোকে কখনো বাসায় কল করতেও দেখি না। তোর ফ্যামিলি কই থাকে? চাঁটগাইয়া নাকি? “

সাইফ তখন খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেসে জবাব দেয়,

“ আসছি একা, যামু একা। “

তার কথার ভাবার্থ বুঝতে না পেরে ফারদিন প্রশ্ন করে,

“ মানে? “

সাইফ তখন মৃদু বিরক্তি দেখিয়ে বলে,

“ মানে আমার বাপ-মা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন এসব কিছু নাই। আই হ্যাভ অনলি মি। “

কথাটা বলেই সাইফ সবার বিস্মিত মুখশ্রী দেখে ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,

“ ওহ সরি। তোগোর মতন তিনটা ছাগল আর তিনটা পাগলও আছে আমার জীবনে। “

সাইফের সেই কথার পরে কেনো জানি আড্ডা নিজের প্রাণ হারায়। সবকটা মুখ কেমন যেনো আঁধারে তলিয়ে যায়। সবারই হয়তো মনে মনে সাইফের জন্য মায়া লাগছিলো। কিন্তু এই মায়াটা তো সাইফ কখনো চায় নি। সে তো বেশ আছে নিজের এই একা জীবনে। কোনো ঝামেলা নেই, কোনো ঝঞ্জাট নেই। না আছে কোনো মাথা ব্যথা। পরিবার থাকা কি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ? কই? সাইফ তো দিব্যি পরিবার পরিজনহীন জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। কখনো কোনো অভিযোগ তার মনে উঁকি দেয় নি।

আপন ভাবনায় বুদ থেকেই সাইফ মনে মনে নিজের সিঙ্গেল বেডটার উদ্দেশ্যে বলে,

“ ধ্যাৎ শালা! তুই আর আমি সিঙ্গেলই ভালা। “

__________

রাতে ঘুমানোর আগে নার্স এসেছে নিশার পায়ের ব্যান্ডেজ বদলে দিতে। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে থাকা নিশা একবার পাশ ফিরে তিন সিটের সোফাটার দিকে তাকায়। নাঈমার কেবল মাত্র চোখ লেগে এসেছে। সারাদিন তিনি একপায়ে দাঁড়িয়ে নিশার দিকে খেয়াল রাখেন। মায়ের ক্লান্ত দেহটাকে ক্ষানিকের আরাম হতে ডেকে তুলতে মন চায় না নিশার। সে চুপচাপ বসে রয় নিজের মতো।

নার্স তার গাউনটা হাঁটুর উপর তুলতেই সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো পা উন্মুক্ত হয়। নিশার বুক ভয়ে ডিপ ডিপ করছে। এই কয়দিন ড্রেসিং চেঞ্জ করার সময় নাঈমাই পাশে দাঁড়িয়ে সবটা খেয়াল রেখেছে। নিশা ভয়ে চোখ বুজে রেখেছিলো। এখন পর্যন্ত সে একবারও নিজের পায়ের সেলাইয়ের জায়গাটা দেখে নি।

কিন্তু আজ ঠিক করেছে সে নিজে তাকিয়ে থেকে জায়গাটা দেখবে। যেই ক্ষত আর দাগ তার সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে তার মুখোমুখি হতে না জানলে জীবনটা পাড় করা খুব কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে তার জন্য।

সাদা ব্যান্ডেজের কাপড় সড়ে যেতেই একটা বিভৎস দৃশ্য দেখে নিশা। সেই দৃশ্যের ভার তার মস্তিষ্ক সইতে পারে না। আচমকা চিৎকার করে উঠে সে। দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে সে। চোখ জোড়া দৃঢ় করে বুজে রয়।

তার চিৎকারে ইতিমধ্যে নাঈমার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। জুলফিকারও কেবল মেয়েকে দেখার জন্য হেডকোয়ার্টার হতে সরাসরি হসপিটালে এসেছিলো। কিন্তু নিশার কেবিনের দরজার কাছাকাছি আসতেই চিৎকারের শব্দ শুনতে পেয়ে সে তড়িঘড়ি করে কেবিনে প্রবেশ করে। দ্রুত মেয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে কি হয়েছে। নাঈমাও একই প্রশ্ন করছিলো মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে।

নিশা কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“ আম্মু আমার পা দেখতে অনেক বিশ্রী হয়ে গিয়েছে। কি বাজে কালো দাগ! অনেক বাজে দেখতে আম্মু। “

আসল কারণ বুঝতে পেরে নাঈমা আর জুলফিকার দু’জনেরই হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠে। জুলফিকার চোখের ইশারায় নার্সকে বলে দ্রুত ড্রেসিং সেড়ে বেরিয়ে যেতে। নার্স নিজের কাজ সেড়ে চলে যায়। নিশা তখনও মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদছে। মেয়ের কান্না দেখে নাঈমাও আর স্বাভাবিক থাকতে পারে না। মায়ের মনে হানা দেয় অদ্ভুত সব চিন্তা। মেয়ে মানুষের শরীরে দাগ থাকাটা কোনো অভিশাপের থেকে কম নয়। এই সেলাইয়ের দাগ যে কোনো দিন যাবে না সেই বিষয়ে ডাক্তার নিশ্চিত করেছে। যদিও অন্য উপায় আছে। সেটা হলো প্লাস্টিক সার্জারি।

নাঈমা কান্নারত গলায় বলে,

“ আম্মু এই দাগ দূর করে দিবো মা। আমি দ্রুতই সবথেকে ভালো প্লাস্টিক সার্জিশিয়ান খুঁজে বের করবো। প্রয়োজন পড়ে তো দেশের বাইরে নিয়ে যাবো। তুমি চিন্তা করো না। “

নাঈমার কথায় জুলফিকারের মেজাজ চড়ে যায়। সে গরম গলায় বলে,

“ আজেবাজে কথা বলা বন্ধ করো। ওসব করতে গেলে ইনফেকশনের হাই রিস্ক আছে তা কি তুমি জানো না? “

নাঈমা এবার রাগী গলায় বলে,

“ তো কি আমার মেয়ে সারাজীবন এই দাগ সহ্য করবে? “

“ মেয়েটা জানে বেঁচেছে নাঈমা। সেটার জন্য শুকরিয়া আদায় করো। “

নাঈমা এবার নিশাকে ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠে,

“ তুমি সবসময়ই একজন অযোগ্য পিতাই রয়ে যাবে জুলফিকার। মেয়েকে বিয়ে দিতে গেলে এসব নিয়ে কতো ঝামেলা হতে পারে সেই চিন্তা তোমার মাথায় আছে? তুমি এসব না ভাবলেও আমি ভাবি। “

নিশা কান্না থামিয়ে ফোলা ফোলা চোখ মেলে দেখতে থাকে নিজের আম্মু আব্বুর তাকে নিয়ে ঝগড়া। জুলফিকারও একইভাবে চেঁচিয়ে উঠে,

“ হ্যাঁ। খুব ভাবো তুমি। তোমার ভাবার নমুনা আমি দেখতে পাচ্ছি। তোমার কি মনে হয় আমি কোনো অশিক্ষিত পাত্রর হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিবো? কেবলমাত্র অশিক্ষিতদেরই এসব নিয়ে মাথাব্যথা থাকবে। “

নাঈমা ও জুলফিকারের এই কথা কাটাকাটি চলতেই থাকে। ভুলে যায় তারা কেবিনে উপস্থিত আরেকজন মানুষের অস্তিত্ব। নিশা আচমকা আবার ডুকরে কেঁদে উঠে। সব কিছু অসহ্যকর ঠেকছে তার কাছে। দমবন্ধ লাগছে তার। কেমন হতো যদি নিশার অস্তিত্বই না থাকতো? তাহলে নিশ্চয়ই আম্মু আব্বু ঝগড়া করার কোনো কারণ খুঁজে পেতো না আর? কারণ তাদের সব ঝগড়াই হয় নিশাকে ঘিরে।

__________

নিজের ব্যক্তিগত রুমটায় প্রবেশ করতেই দূর্জয় এগিয়ে গেলো কাঠের তৈরী আলমারির দিকে। আলমারির একপাশের দরজাটা খুলতেই তার চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো দরজার ভেতরের অংশে কাঠের সাথে অতি সুনিপুণ কায়দায় আটকে থাকা আয়তকৃতির ছবিটা। দূর্জয়ের অতি ব্যক্তিগত এবং ভালোবাসার তিনজন মানুষকে ছবিটাতে বন্দী করা হয়েছে। ছবিটার পানে দু দন্ড তাকাতেই দূর্জয় প্রচন্ড ক্লান্ত অনুভব করে। বুকটাও বেদম ভারী অনুভূত হচ্ছে।

এই ভার বয়ে বেড়ানো হতে সাময়িক বিরতি নিতেই বোধহয় সে আলমারির সেই তাকের ভেতর হতে মোটা কাপড়ে আবৃত একটা বাদ্যযন্ত্র বের করে। অতি সাবধানে সেই কাপড়ের ভেতর হতে কালো রঙা বাদ্যযন্ত্রটা বের করে চার দেয়ালে আবদ্ধ রুমটার ভেতর একটা কাউচে বসে সে। অতি যত্নের সহিত কালো বাদ্যযন্ত্রটাকে নিজের কোলে বসিয়ে সুকৌশলে তা-তে নিজের দু’হাতের সাহায্যে সুর তুলে। গম্ভীর স্বর ছেড়ে খালি গলায় আওড়ায়,

“ ঘুণে খাওয়া মেঘে কালো হয়ে যায় এ হৃদয় যখন
একা একা শুধু অকারণেই ঝরে বৃষ্টি এমন,
আজও তাই অবাক রঙে এঁকে যাই
সাদা কালো রঙ মাখা ফানুসের মুহুর্ত রাঙাই,
ভীষণ কালো মেঘ পুড়ে ছাই আবেগে আজও তাই
অবাক জোছনায় পোড়া চোখ তবুও সাজাই।

এই সন্ধ্যায় দু-চোখ সাগরে
বুকের পাঁজরে ভেসে যায়।
অবাক জোছনায় লুকিয়ে রেখেছি
ভেজা চোখ দেখাইনি তোমায়।

এই অবেলায় তোমারই আকাশে
নীরব আপোষে ভেসে যায়।
সেই ভীষণ শীতল ভেজা চোখ
কখনো দেখাইনি তোমায়।

কেউ কোথায় ভালো নেই যেন নেই
কতকাল আর হাতে হাত অবেলায়।
কতকাল আর ভুল অবসন্ন বিকেলে
ভেজা চোখ দেখাইনি তোমায়। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]